Tuesday 13 October 2020

সাক্ষাৎকার , কার্তিক মোদকের মুখোমুখি শুভদীপ রায়, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 



মুখোমুখি কার্তিক মোদক

 

 

বাংলা সাহিত্যের ষাটের দশকের কবি হিসাবে তিনি সমধিক পরিচিত।
নিরলস সেবা করেছেন লিটিল ম্যাগ আন্দোলনের প্রচার প্রসারের জন্য। সম্পাদনা করেছেন (সীমান্ত সাহিত্য ) নামে স্বনামধন্য সাহিত্য পত্রিকা।
সারাজীবন কবিতাকে আঁকড়ে থেকেছেন। তাই তার কলমে ধ্বনিত হোয়েছে - " চিরকাল বেঁচে থাকা যায়"। তিনি প্রখ্যাত কবি কার্তিক মোদক।
সেই কবিতাপ্রাণ মানুষের সঙ্গে একান্ত আলাপ পর্বে সাংবাদিক শুভদীপ রায়


জন্ম : ৭ই জানুয়ারি ১৯৩৮
মৃত্যু : ১৮ ই জানুয়ারি ২০১৯

নালিশ জানাবো কার কাছে/
জন্মলগ্নে অমাবস্যা/
চাঁদ জ্বেলে দেওয়ার মত শিশিতে তেল ছিল না!/

             কার্তিক মোদক


শুভদীপঃ  নমস্কার , আপনাকে স্বাগত জানাই আজকের আলাপপর্বে। প্রথমেই জানতে চাই - আপনার শৈশব কোথায় কেটেছে, কীভাবে কেটেছে একটু যদি জানান --

  কার্তিক মোদকঃ  আমার শৈশব কেটেছে বনগাঁ শিমুল তলায়, মতিগঞ্জ। বনগাঁ হচ্ছে বাংলাদেশ বর্ডার , সীমান্ত এলাকা। ছেলেবেলা থেকেই গাড়াপোঁতা- বনগাঁর বিভিন্ন জায়গায় পদচারণ করতাম, সেখানে নদী ইছামতি, বোর্ড ব্রীজ, ভাসমান-টলমান নৌকো, তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, সেই নিয়ে আমার কাছে একটা বিস্ময় জাগতো শৈশব কৈশোরে। যখন বাতাসে দুলে উঠতো প্রকৃতি, আমি ভাবতে পারতাম না যে আমি এখানে থাকি। অবাক হোতাম। আর লিখতে মন চাইতো..

শুভদীপঃ শৈশবে শরৎ উৎসব এলে আপনার কী ধরনের ভালোলাগা কাজ করতো?

  কার্তিক মোদকঃ শৈশবের শরৎ উৎসব ছিল আলাদা মর্যাদার । আন্তরিকতা, ভাবনা, শ্রদ্ধা সম্পূর্ণ আলাদা রকমের। তখন ছিল অন্য সময়, এই সময়ের মতন নয়, ফলে শৈশবটা আমি আবার খুঁজে বেড়াই। আমার প্রিয় শৈশব যা হারিয়ে গেছে, সেই হারানো শৈশবকে ধরে রাখতে চাই , যার জন্যে বাংলা কবিতায় আমি স্মরণীয় করে রাখতে চাই আমার শব্দ কয়েন, শব্দ দিয়ে গাঁথা যেসব অর্থ, সেগুলো আমি তুলে রাখতে চাই, পারিনা..! তবু চেষ্টাটা করতে দোষ কি!

শুভদীপঃ
     আপনার লেখালিখির প্রারম্ভিক পর্যায় কেমন ছিল, সে সম্পর্কে একটু জানান 

  কার্তিক মোদকঃ অনেক ছোট থেকে লিখতে শুরু করি, তখন ওই গাড়াপোঁতায় শৈশব কেটেছে, গাড়াপোঁতা আমার অরিজিনাল বাড়ি ছিল , সেখানে পোদ্দার বাড়ি এবং মোদক বাড়ি । বাবার নাম ছিল বিষ্ণু মোদক , আমাদের হাজারী মোদকের খাবারের দোকান ছিল। ওখান থেকে এসে পরবর্তীতে রানাঘাটে স্থায়ী বাড়ি এখন। আমার মায়ের নাম যশোদা রানী মোদক। আমাদের যেভাবে বাবা-মা মানুষ করেছেন সেটা ভুলবার কথা নয়! বাবা খাবারের দোকানে ভিয়েন করতেন । আমাদের দোকান ছিল বেশ বড়। হাজারী মোদকের খাবারের দোকান ছিল খুব বিখ্যাত। সেটা ছিল বনগাঁ থেকে একটু দূরে । সেখানেই লেখালিখির সূত্রপাত।

শুভদীপঃ আপনার লেখালিখির প্রথম অবস্থায় কাদের লেখা , মানে কোন কোন কবি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তেন বা আপনি মুগ্ধ হতেন! কাদের লেখা আপনাকে বেশি টানতো ?

  কার্তিক মোদকঃ বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশ খুব টানতো।  আমার বাড়িতে, আমার সৌভাগ্য প্রখ্যাত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সবাই আসতেন এক সময়। কারণ কি বনগাঁ বাংলাদেশ হয়ে গেছে, স্বাধীন হয়ে গেছে, ভারতের থেকে কোথাও যেতে গেলে বনগাঁর উপর দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশে, ফলে আমার বাড়িতে বাংলাদেশ যাওয়ার জন্য যারাই আসতেন নদী পেরোতে সবাই খোঁজ করতেন কার্তিক মোদককে। বা ঠাকুরদার দোকান হাজারী মোদককে। এবং দেখাও পেতেন। আমার পক্ষে যতটা সাহায্য করার আমি সেই সব মানুষকে করতাম। কবিতায় দুই বাংলার এক ধ্বনি খুঁজতাম। তখন রবি ঠাকুরের সোনার বাংলা মনে আসতো।

শুভদীপঃ আপনি যে পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন অর্থাৎ সীমান্ত সাহিত্য পত্রিকার কথা বলছি,  সেটা শুরুর বিষয়ে কিছু বলুন

  কার্তিক মোদকঃ সীমান্ত সাহিত্য পত্রিকা সেই ছোট বেলা থেকে করে আসছি। আজকে সেটি দুর্লভ। বাংলা সাহিত্যের সকল ধরনের লেখক লিখেছেন এখানে। আমিও চেষ্টা করেছি এক একটা সাহসী উচ্চারণ খুঁজে বার করার। আসলে কবিতা খুঁজতে খুঁজতে কবিকেই আবিষ্কার করতে হয়। সীমান্ত সাহিত্য এটাই করে এসেছে। শুরুতেই সীমান্ত সাহিত্য পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল নতুন প্রতিভা অন্বেষণ। লিটিল ম্যাগের এটাই বড় অভিপ্রায় থাকা দরকার।

শুভদীপঃআপনার স্ত্রী শোভা মোদকের ভূমিকা কতখানি আপনার সাহিত্য জীবনে ?

  কার্তিক মোদকঃ অনেকখানি। ব্যাপার হচ্ছে কি জানো, সবচেয়ে বড় জিনিস আমি তো থাকতাম কবিতা পাগলের মত,  ওরা ( কবি বন্ধুরা) কেউ বাড়িতে আসলে  তখন রান্না বান্না দেখাশোনা শোভাকেই করতে হোতো। দায়িত্ব নিয়েই করতো সে। সকলে এলে তাদের সেবা করতো ভীষণ আন্তরিকতায়। আমিও কবিতার জগতে সময় দিতে পেয়ে যেতাম প্রশ্রয়।

শুভদীপঃ আপনার পত্রিকায় তো জয় গোস্বামী  প্রথম লেখেন সিলিং ফ্যান নিয়ে, কীভাবে তাকে আবিস্কার করলেন!?

  কার্তিক মোদকঃ আমি কবিতা শুনতে বরাবর ভালবাসতাম। এখনও বাসি। তখন কবিতা শুনতে শুনতে যেন মনে হয়েছিল যে, বাংলা কবিতার একটা নতুন কয়েনেজ খুঁজে পাচ্ছি। তখনই জয়কে সীমান্ত সাহিত্য পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের তাগিদ অনুভব করি। আজ সে কবিতায় খ্যাতি পেয়েছে। তাই আমি বারবার তরুণ কবিদের খুঁজতাম। তাদের কবিতা শুনি আজও। শুনে সেগুলোকে গ্রন্থনা করার চেষ্টা করি।

শুভদীপঃকোথায় প্রথম দেখা বা আলাপ হোলো জয় গোস্বামীর সঙ্গে!!? তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি বর্তমানে!?

  কার্তিক মোদকঃ নদিয়ার রানাঘাটে, আবার পরবর্তীতে  কখনো বনগাঁতে। সে তো নদিয়ায়ই বড় হয়েছে।
  এখন ব্যাপার হচ্ছে কি সকলেই কর্মব্যস্ত এবং লেখালিখির জগতে প্রতিষ্ঠিত, সেভাবে হয়তো তারা যোগাযোগ রাখতে পারে না। । এখনও তার পুরনো লেখা সংরক্ষিত রয়েছে আমার কাছে। বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছি সুনীল গাঙ্গুলি , শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ সবার কাছে নিয়ে গিয়েছি সময়ে সুযোগে।
সুবোধ সরকারও আসতো একসময়। সেও কবিতায় নাম করেছে। ছোটো বেলা থেকে জয়ের মা আমাকে বলেছিল ছেলেটিকে দেখবেন তো , বালিশের তলায় ছেলেটি কবিতা লিখে রাখে!
তারপর সাক্ষাতে আমার সত্যিই ভালো লাগে। আমি বললাম হ্যাঁ লিখুক। তারপর যতখানি চেষ্টা করা যায় আমি করবো।

শুভদীপঃ একজন ছোট পত্রিকা সম্পাদকের কি করণীয় বলে আপনি মনে করেন ?

  কার্তিক মোদকঃ ছোট পত্রিকা সম্পাদকদের জন্য বলবো   - তরুণদের বেশি করে ছাপা দরকার। শুধু ছাপা হলে চলবে না, সেই লেখাগুলো কতখানি সমৃদ্ধ বা অারও ভালো করা যায়, সেটাও সম্পাদক হিসাবে সেগুলি ছাপার যোগ্যতা আছে কি না, সেটাও দেখে নিতে হবে। সব ছেপে দিলাম আমি সম্পাদনা সেটা  নয় !

শুভদীপঃ কবি কি সহজাত প্রবৃত্তি ! নাকি কবি তৈরি হওয়া যায়!?

  কার্তিক মোদকঃকবি তৈরি হওয়া যায় না বোধ করি ! কেননা আমার এখানে প্রচুর যশ প্রার্থী মানুষ এসেছে, তাদের সই ঠিকানা পর্যন্ত রয়েছে, কবে এসেছে, কি লিখেছে সেগুলি লিপিবদ্ধ আছে। এবং অনেক ডকুমেন্টস আছে। উচ্চকিত আওয়াজ করলেই কবি হওয়া যায় না! নিবিড় পাঠক হতেও হয়। গভীর অধ্যবসায় দরকার

শুভদীপঃ এই যে সারাজীবন কবিতা নিয়ে থাকলেন, কি পেলেন কবিতার কাছে!?

  কার্তিক মোদকঃ এখনও একটি কবিতার সুর খুঁজে পাইনি! একটাও কবিতা পাইনি খুঁজে!
এখনও খুঁজে চলেছি, কত অারও ভালো লেখা যায়, কীভাবে একটি কবিতা খুঁজে পাওয়া যায়! 
আসলে কবিতায় যেটা পেয়েছি সেটা হোলো কবিতার কাছে যাওয়া শিখেছি....। মানুষের কাছে যাওয়া শিখেছি....।

(মানুষের কাছে  যাওয়া চাঁদের কাছে যাওয়ার থেকে বড়....)

শুভদীপঃ তার মানে আপনি বলতে চাইছেন কবিতার মাধ্যমে মানুষের কাছে যাওয়া যায় , তাই তো!?

  কার্তিক মোদকঃ হ্যাঁ ঠিক তাই! এটাই তো কঠিন বিষয়...

শুভদীপঃ আপনার ব্যক্তিগত জীবনে বাংলা সাহিত্যের প্রতি কোনো আক্ষেপ থেকে গেলো কি!?

  কার্তিক মোদকঃ না । আমার তেমন নেই...., আমি আমার টুকুই চেষ্টা করেছি। করে যেতে চাই। একটাও কবিতা আসলে লিখতে পারিনি। খুব আক্ষেপ হচ্ছে এখানেই !  বাংলা কবিতার  জগতে একজন পাঠকের কাছে একটি কবিতা মনে থাকা অনেক বড় ব্যাপার।

শুভদীপঃ তরুণ প্রজন্মের কবিতা চর্চার প্রতি আপনার মতামত জানতে চাইছি

  কার্তিক মোদকঃ এখনকার তরুণরা রাতারাতি ভাবতে চায় কবি হওয়া যায় ! কিন্তু প্রকৃত কবি হতে গেলে পড়াশুনা এবং অধ্যবসায় দরকার। যার কবিতা নিয়ে আমি গবেষণা করবো, দেখবো , ভাববো তাকে নিয়ে পড়াশুনা করা। তার কাছে যাওয়া। তাকে অধ্যায় করা, সেরকম এখন করছেনা .. ! তবে এখন ভালো কবিতাও হচ্ছে। সেগুলি আমরা আবিষ্কার করতে পারছি না  । পৌঁছাতে পারছি না।

শুভদীপঃ আপনার সমসাময়িক বন্ধুদের মধ্যে কার কার কথা মনে পড়ছে!?

  কার্তিক মোদকঃ কার কার কথা বলি..!

এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কালিকৃষ্ণ গুহ , দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ চক্রবর্তীও রয়েছে। কাকে বাদ দেই! তারপর কাকেই বা বাদ দেবো বলো ! সকলেই প্রিয়।

শুভদীপঃ একটি সহজ জানতে চাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলে একজন কবি  ব্রাত্য থেকে যান কি ?.

  কার্তিক মোদকঃ
স্বীকৃতি সময় দিয়ে বোঝা যায়। মানুষই প্রকৃত স্বীকৃতি দেবে.....
কবিতার জন্য কবিতার বই পড়া দরকার খুব। কিন্তু সেই পড়াটা ঠিক হচ্ছে না। নিজেকেও জানা চাই..!

শুভদীপঃ (নালিশ জানাবো কার কাছে ..) এই কবিতার নেপথ্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে প্রকাশ করছি, একটু যদি নিহিত বেদনা সম্পর্কে জানান --

  কার্তিক মোদকঃ সমস্যা ছাড়া কখনও বাঁচা যায় না, বুঝলে ... !!সকল জায়গায়ই সমস্যা থাকে। কখনো পারিবারিক সমস্যা, কখনো অর্থনৈতিক সমস্যা, কখনো সামাজিক সমস্যা। এগুলি থেকেই কবিতার উৎপত্তি। তখন ছিল দারুণ জীবন সংগ্রামের দিন। বেঁচে থাকার লড়াই। নিজেকে প্রকাশের জায়গা খুঁজি..., আজও..... হয়তো... তাই নালিশ জানাবো কার কাছে .....!!!

শুভদীপঃ আপনার জীবনের প্রিয় দুঃখ কি!?

  কার্তিক মোদকঃ আমার জীবনের দুঃখ খুঁজে বেড়াচ্ছি এখনও!!
সেভাবে কোনো জিনিস নিয়ে আফসোসও করিনা। আফসোস আক্ষেপ করলেই অন্য জিনিস এসে যায়...!

শুভদীপঃ আপনি  নিজের খাদ্যাভ্যাস ,রুচি সম্পর্কে কিছু যদি জানান, মানে কেমন ধরনের খাওয়া দাওয়া করতে ভালোবাসেন!?

  কার্তিক মোদকঃ আমার তো মুখরোচক খেতে ভালোলাগে। আর বিভিন্ন জায়গায় গ্রাম-গঞ্জে যখন ঘুরতাম তারা মুড়ি নিয়ে আসতো। ভাজাভুজি দেখলে ওরা নিয়ে আসতো , কারণ জানতো আমি সেটা পছন্দ করি। আর বাড়িতে মাছের ঝোল ভাত, একটু চচ্চড়ী, আর শাকটা খাই রেগুলার।

শুভদীপঃ অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এই বিশেষ মুহূর্ত দেওয়ার জন্য এবং আপনার জীবনের একান্ত স্মৃতিগুলি ভাগ করার জন্য। আপনাকে প্রণাম

  কার্তিক মোদকঃ তোমাকেও আশীর্বাদ করি, অারও এগিয়ে যাও, বাংলা কবিতার ভালো হোক। লিটিল ম্যাগ সমৃদ্ধ হোক...

No comments:

Post a Comment