Tuesday 13 October 2020

সৌমী গুপ্ত , দুর্গাপুজো, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০




 ছেলেবেলার দুগ্গিপুজো'


'পুজো আসছে' এই কথাটা বলার আগেই সমগ্র ধরিত্রী যেন সেজে ওঠে পুজোর সাজে। তাই নতুন করে আগমনীর আগত সময়কে উল্লেখ করার প্রয়োজন হয় না। ভোরবেলায় নরম রোদের আদর মেখে সবুজ ঘাসের ডগায় প্রথম শিশিরকণা মনে করাতো পুজো আসছে। গ্রামের বাড়ির উঠানের একপাশে মৃদু গন্ধ মেখে শুয়ে থাকা কমলা টিপ পরা সাদা দুধের মত কোমল ছোট্ট শিউলির তাকিয়ে থাকা মনে করাতো মা আসছেন। কিংবা হলুদ স্কুল বাসের জানালা থেকে উঁকি মেরে রাজ পথের দু'পাশে বাঁশের তৈরি প্যান্ডেলের কাঠামোর প্রথম প্রস্তুতি বুকের ভেতর উৎসবের আনন্দ জাগাতো।  পাশাপাশি ঢাকের বোল এর পাশে মনের তাল ঠুকতে ঠুকতে  কখনো আবার মন কেঁদেও উঠতো ঢাকির পাশে বসা জীর্ণ পোশাক পরিহিত শ্যাম বর্ণের ক‍্যাংলা ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ।তালটা মিলে গিয়েও কোথাও যেন কেটে যেত। নদীর ধারে মৃদুমন্দ হাওয়ায় পালতোলা নৌকার মতো সাদা কাশের মাথা গুলো মনে করাতো অপু দুর্গার ছোটবেলার পুজো—"অপু আমায় একদিন রেলগাড়ি দেখাবি?" তারপর নরম হাওয়া আর  আলতো রোদকে  সরিয়ে চিড়বিড়িয়ে  উঠত বেলা বাড়ার সাথে মেঘ ভাঙ্গা রোদ। নীল ত্রিপল টাঙ্গানো নীল আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সরের মত মেঘ। রোদ রোদ ছায়া, ছায়া ছায়া রোদ। মাঝে মাঝে আবার ধূসর পায়রার ডানার রং এর মতো ভাসা মেঘ থেকে দু-এক পশলা ঝির ঝিরে বৃষ্টি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে ঝুপ করে বেলাটা শেষ হয়ে আসতো— বোঝা যেত দিনের দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করেছে । তারপর পড়ন্ত রোদ্দুর এর শেষ কিরণ মাখা ছেঁড়া ছেঁড়া নিঃসঙ্গ মেঘ। একেবারে কালো সন্ধ্যা না হওয়া অবধি মেঘের কোলে সোনালি আভা দেখা যায়।  একফালি চাঁদের পাশে মিষ্টি হাওয়ায় ভেসে ভেসে চলা —মাকে মর্তে‍্য আহবান করার অপেক্ষায়!
পুজো মানেই মিত্তির দের দালান বা মুখার্জিদের দুর্গা মন্ডপে একমাটি ,দুমাটি এবং রং এর গন্ধ, মাটির গন্ধ! মহালয়ার আগে প্রায় সমাপ্তির পথে কাজ! মানে মা দুগ্গি ছেলেপুলে নিয়ে আসার জন্য একেবারে প্রস্তুত ।শুধু রাস্তা দেখানোর জন্য চক্ষুদানের অপেক্ষায়।
নীল আকাশের সন্ধে‍্য না হওয়া অবধি ঘুড়ির রেষারেষি তারপর কোনো একটা ঘুড়ির ভোকাট্টা খেয়ে ঘাড়, মাথা নামাতে নামাতে কার্নিশে গিয়ে আটকানো, মনে করায় বিশ্বকর্মার আসতে আর বেশি দেরি নেই— তার মানে পুজোর কটা দিন আর বাকি হাতে গোনা যাবে এবার! ছোটবেলায় গোটা ঘর তোলপাড় করে ঝাড়পোঁছ করা আর তার সাথে ন্যাপথলিন মাখানো জামাকাপড় এবং জীবাশ্ম পড়া শাড়ির মাদুরে রোদ্দুর খাওয়া মানে পুজো ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে জোর কদমে। তারপর একটা মস্ত ফর্দ বানিয়ে ঠিক করে ফেলা হতো কর্তা-গিন্নি মিলিয়ে কার জন্য কি কি বরাদ্দ! উৎসুক মনে কান খাড়া করে নিজের নামটা শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। সেই ফর্দ থেকে লাল পাড় সাদা থান শাড়ি মা দুর্গার জন্য সবার আগে লেখা হতো— সাথে পুজোর গামছা। সঙ্গে লটকনের দোকানে যাবার ফর্দটিও স্বমহিমায় হাজির হয়ে যেত বেশ জারিজুরি নিয়ে! শপিং মল ,অনলাইন মারকেটিং এর আধিপত্য তখনও ছিল না। আর কে কে আসছে বছরশেষে দেশের বাইরে থেকে! গলদঘর্ম হয়ে কচিকাচাদের নিয়ে পুজোর মার্কেটিং এবং নিজেদের চেয়ে একসাইজ বড় জামাটাই বেছে বেছে কেনা হতো। আসার সময় মাতৃ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে টক, মিষ্টি চাটনি সমেত সিঙ্গারা আর রসগোল্লা! ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ তখন বইপত্তর গুলোকে চরম শত্রু ভাবতো। বিজয় দর্প তখন বরাদ্দ থাকত একেবারে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত। সে এক হই হই রই রই ব‍্যাপার‌। গোটা দশেক নারকেল কোরানো হতো পড়ন্ত বেলার ধূলিকণা মাখা রোদ্দুরে বসে অলস দুপুর এর শেষে! পিতলের বা কাঠের এত্ত বড় রেকাবিতে ঘি মাখিয়ে রাখা হতো গোলাকার অমৃত সমান সাধের নাড়ু। মোটেই তার উপর হামলে পড়া চলতো না কিন্তু। সেসব ছিল বিজয়ার জন্য তোলা। তার আগে বড়জোর শেষ তলানিটুকু  চেঁচে পুঁছে মোটামুটি একটা গোল আকৃতি দিয়ে সৌভাগ্যবানের  লোভী চোখে অনেকক্ষণ ধরে তাকানো ছেলেবেলার হাতে এসে পৌঁছাতো। তাতেই আনন্দে আহ্লাদে আটখানা। গোটা ঘর নাড়ুর গন্ধে মম করতো।

পুজোর গানের একটা আলাদা ক্যাসেট বের হতো। সকালবেলার সংস্কৃত শ্লোক চললেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেলাতে জায়গা করে নিতেন। গোটা দুপুর বিকেল শ্রীকান্ত আচার্য বা নচিকেতার পুজোর গানের ক্যাসেট। সে এক অনাবিল আনন্দ। তারপর সন্ধ্যেবেলা হলে কুমার শানুর হৃদয়ে রক্ত ছলকানো গান' ধীরে ধীরে সে মেরে জিন্দেগি মে আনা'' শুরু করে "বাদা রাহা সনাম 'থেকে' ,'তু প‍্যায়ার হে কিসি অউর কা'! কেউ প্রেম করবো না ভাবলেও এই গানগুলো প্রেমের ভরা পুকুরে হাবুডুবু খেতে বাধ্য করতো এই পুজোর সময়েই। পুজোর প্রেমটা ছিল একেবারে অন্যরকম ,মাখো মাখো! এই চারটে দিন ছিল সাতখুন মাপ। অতএব বীরদর্পে বলে দেওয়া যেত  মনের কথা! মাদুগ্গির সামনে পাপ হতো না তখন! ভরা শরতেও বসন্তের রঙ মেখে প্রজাপতি নাচতো চোখের সামনে। চোখে চোখে কথা হলেও মুখে কিছু বলার প্রয়োজন হতো না ।নিজেকে স্পেশাল দেখানোর জন্য প্রত্যেকটা দিন নির্ধারিত হত পরনের পোশাক। নতুন প্রেমের ইতিহাস তখন পঞ্চাশ ভাগ পুজোর সময় রচিত হত। বাদবাকিটা সরস্বতী ঠাকুর নিজের জিম্মায় তুলে রাখতেন।
মহালয়া ছিল বিশেষ আনন্দের দিন। আগের দিন ঘড়ির কান মুলে পরের দিন সকালে ওঠার সময় ঠিক করা ছিল  অনর্থক! কারণ সারারাত ভালো করে দুচোখের পাতা এক হতো না উৎসবের আনন্দে, উত্তেজনায়। পরের দিন যে বাবার ঠিক করা রেডিওতে বীরেন্দ্র কিশোর ভদ্রের কন্ঠে দুরুদুরু বুকে প্রহর কাটিয়ে ভোরের আলো দেখব আমরা! ভোর রাতের শিশির ভেজা হাওয়ায় সূর্যের প্রথম কিরণ মেখে ঘরে ঘরে ভেসে আসত 'আশ্বিনের শারদ প্রাতে!" বুকের উপর দামামা বাজিয়ে হাতুড়ি মেরে কেউ বলত পুজো আর ছটাদিন বাকি! চক্ষুদানের সময় নিজের অজান্তেই নয়ন জলে ভেসে আসতো।তারপর বেলা বাড়তো। সকালের জলখাবার এর পাতে বলের মত আটা ময়দা মেশানো একান্নবর্তী পরিবারের লুচি পাশে জ্বলজ্বল করা সোনালি বর্ণের তেল ভেসে আসা আলুর দম। দুপুরের পাতে বাটি ভর্তি লালচে কালো জলে ডুবে থাকা পাঁঠার মাংস আর অর্ধচন্দ্রাকৃতি আলু। আঙুল ডুবিয়ে আঁচ করতে হতো কার ভাগে কটা জুটল —তারচেয়েও আশংকা হতো নলির পিসটা বাদ পড়ে যায় নি তো! তখন থেকে জানা হতো এখন থেকে পুজোর মেনু গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অষ্টমীর ভোগ ছিল স্টেটাসে অগ্রগন্য—মানে অমৃত সমান! পাঁচ রকম ভাজার সাথে এক চিমটে চাটনি আর পায়েস সংযোগে বাসন্তী রঙের খিচুড়ির স্বাদ কোন রান্নাঘর থেকে আবিষ্কৃত হতো না। এদের স্বয়ং অন্নপূর্ণার অন্ন ব্যঞ্জন! নাঃ স্ট্যাটাস মেইটেইনের চোখরাঙানি তখন ছিল না । সবাই পাত পেড়ে খেতাম একসাথে। নদীর পাড়ে বস্তিবাড়ির ভুলুও সস্তার জামা পড়ে নির্দ্বিধায় বসে গল্প জুড়তো হাপুস হুপুস করে গরম খিচুড়ি গলাধঃকরণ করতে করতে!
দেখতে দেখতে দশমীর বিষাদ সন্ধ্যা জানান দিতো একটি বছর আবার হাপিত্যেশ করে বসে থাকো! বিসর্জনের পর ফাঁকা অন্ধকার মন্ডপ, তারও পরে প্যান্ডেলের কঙ্কালগুলো বুকের মধ্যে ফাঁকা ধুধু মন খারাপের প্রান্তর নিয়ে বসে থাকতো বেশ কিছুদিন! আকাশে ভাসমান ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলোকে টিমটিমে জাজ্বল্যমান তারাদের পাশে কি যে নিঃসঙ্গ লাগতো তখন! গোল কাঞ্চনবর্ণা চাঁদের পাশে মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের মাথাগুলো রাতের ছায়ায় মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে দোলাতো !মনে হতো এমন টা হতো যদি  'ওগো নবমী নিশি' কখনো' না হইও অবসান"!

1 comment:

  1. এতো সুন্দর পূজোর আমেজ মন ভরিয়ে দিল কানায় কানায়। এক ঝলকে লেখা পড়তে পড়তে পাড়ি দিয়েছিলাম সেই শৈশবের সাদামাটা কিন্তু আন্তরিক পূজোর দিনগুলিতে।

    ReplyDelete