গহন স্বপন সঞ্চারিণী
তুমি, আমি ও আমাদের কথামেঘ
নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলে তুমি। আমি জানি তোমার এই ছেড়ে যাওয়ায় কোনো অনন্তের আহ্বান ছিল না। আমাকে অবশ্য কোন নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়নি। আমিই বারবার নতুন হয়ে এসেছি। পুরোনোর শ্বাসের ভেতর শ্বাস ফেলেছি। স্থিতি আসেনি। একটা পাথুরে চলমানতা আমাকে বয়ে বেড়ায়। নাকি আমিই তার ভার বয়ে বেড়াই বুঝি না। জানি তোমার আগুন আরও তীব্র ছিল। লুকোনো আগুন। বাইরে গান ছিল। কথা ছিল। রবি আর তোমার নন্দন কানন ছিল। তোমাদের ছাদের বাগান। মর্তলোকের দৃষ্টি এড়ানো পথে ছিল স্পর্শ যাতায়াত। ছিল সব অমোঘ ভোর।
আমার ভোরগুলো দখল করে থাকে নেশা জড়ানো ঘুম। সকালের বেল, জুঁই তোমার যত্ন পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হত। আমার শিথিল আঙুল আঁ কড়ে থাকে বম্বে ডাইং আরাম। শুধু ভোর নয়, সকাল, দুপুর রাত কোথাও তোমার ছিটেফোঁটা নেই আমার মধ্যে। এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে যে সব শব্দ ব্যবহার করছি সেসবও কিন্তু আমার নয়। তবু তোমার সঙ্গেই কেন এত বকবক করছি সেটাও জানিনা। কারণ খুঁজতে বা অনুভূতির গায়ে যুক্তির বুলেট বিঁধিয়ে বিক্ষত করতেও চাইছি না। তোমার চলে যাবার পর অনেক বদলের রিপোর্ট জমা পড়েছে যুগের ফাইলে। তবু নিজের ভেতর নিঃসাড় পড়ে থাকা অন্য এক আমি কী করে যেন জড়িয়ে গেছে তোমার সঙ্গে। তোমাকে কে প্রথম চিনিয়েছিল সে কথা অন্য একদিন বলবো। সে আর এক আমির গল্প।
এখন আমার ভেতর থমথমে ক্ষোভ, গনগনে আঁচ, চকচকে প্রেজেন্টেশান ও ঊপচে পড়া সুখের ক্লান্তি। তোমার কাছেই এই যে নিজের খিড়কি খুলে দাঁড়িয়েছি সে শুধু ইচ্ছে করে বলেই। এমনি এসে ভেসে যাবার এই ইচ্ছের গভীরে যা আছে তা কেমন ঘোলাটে আর ঠাণ্ডা। তোমাদের নন্দনকাননের ধুলো হয়ে উড়েপুড়ে বেড়াই নিজেকে জুড়িয়ে নেব বলে।
এখন দুপুর। তোমার খাটে, বিছানায় লেগে আছে নিঝুম কবিতা। তোমার রবির কবিতা। লেগে আছে অপমানের দাগ। কষ্টের গুঁড়ো। একটা স্পর্শ উড়িয়ে দিচ্ছে সব কষ্টের অণু। ধুয়ে দিচ্ছে অপমান দাগ। স্নিগ্ধতায় ফুটে উঠছে ঠাকুরবাড়ির শ্রীময়ী ঘর। আমার ঘর বেশ গম্ভীর। এখন আমি অফিসে। এসি চলছে। ইনডোর প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন মিশে যাচ্ছে বন্দী বাতাসে। করিডরে অ্যাকোয়ারিয়াম। বানানো জলজগতে সাঁতরে চলেছে রঙিন মাছ। কেবিনে কেবিনে যন্ত্রমানব, যন্ত্রমানবীরা সংখ্যা সৌরভে মশগুল। একটু খিটখিটে। তবে আপাদমস্তক নিখুঁত পরিচর্যায় ঝকঝকে। তুমি কি ভাবছ এসব থেকে আমি ব্যাতিক্রমী কেউ ? একদমই তা নয়।
আমি কাদম্বরী সেন। রবীন্দ্রভক্ত বাবার দেওয়া নাম। জানিনা নামটা রাখার পেছনে বাবার কি ভাবনা ছিল। সেকেলে নামের জন্য আমার বেশ ক্ষোভ ছিল। তবে এখন বেশ ওজনদার মনে হয়। নামে পুরনো গন্ধ থাকলেও আমার জিম ও স্যাঁলো চর্চিত ঝকমকে শরীর। স্পা করা লম্বা চুল। পছন্দের পোশাক জিন্স কুর্তি। দশ ঘণ্টা ল্যাপটপে চৌকশ আঙুল। সামনে ঝুলন্ত টার্গেট। আমার দৃষ্টিতে, শ্রুতিতে, কোথাও সমাহিত স্নিগ্ধতা নেই।
ছায়া নেমে এলে
দুপুরটা চলে যাচ্ছে। তুমি শব্দ পাচ্ছ ? আমি পাই। আমার ধারালো দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে তোমার ছবি প্রকট হচ্ছে। তুমি এখন গা ধুতে যাচ্ছ। সেই প্রস্তুতির শব্দও আমি পাচ্ছি। সেই শব্দের উপর হামলে পড়ছে আমার সময়। চাপা পড়ে যাচ্ছে তোমার চুড়ির রিনিক ঝিনিক। তোমার শাড়ির খসখস।
মগজের কনফারেন্স শেষ। আজ শনিবার। সন্ধ্যে আটটা। বাড়ি ফিরছি। নন্দনকাননের দোলনা থেকে তুমি ফিরে গেছ অনেকক্ষণ। সন্ধ্যেপ্রদীপ নিভে গেছে। তোমার ভিজে শরীরের জলকণা যখন শুষে নিচ্ছিল বাতাস, যখন আকাশের দিকে মুখ করে তোমার তরলিত সুষমা ছড়াচ্ছিলে নরম সন্ধ্যেকে, তখন আমি অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে, শপিং করে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাম জ্যাবজেবে হয়ে একটা ঠাণ্ডা শাওয়ারের স্বপ্ন দেখছি। বুঝলে রবির ‘সরোবরময়ী’। আমার বুকের ভেতরও ঘাপ্টি মেরে থাকে একটু জলের টুকরো। একে সরোবর বলা যায় না। ওটা তোমার জন্য। তোমার রবির দেওয়া শব্দ। সে যাই হোক , শুধু তোমাকেই বলছি ওইটুকুই আমার ভিজে ওঠার গোপন। বাইরে আমি সবসময় নিজেকে পারফিউমে মুড়ে রাখি। সবসময় ক্যারি করি সুগন্ধ। আসলে নিজেকে লুকিয়ে রাখি সুগন্ধের ভেতর।
বাথটাবে নিজেকে ডুবিয়ে এখন আমি বেশ ফুরফুরে। আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে নিজেকে একটা পতঙ্গ মনে হল। খুব রূপসী, অহংকারী পতঙ্গ। আমার মাস্কারার কালো, আর আইশ্যাডোর নীল মিলেমিশে আকাশ তৈরি করলো। তারপর ছোট্ট নীল পোশাকের চেন আটকাতেই আমি পাখি হয়ে গেলাম। সেই ছোট্ট নীল পাখি, যে গরমের ছুটির দিনগুলোতে ডালিম গাছে বসতো। না না আমি এখন কোন নীল পাখি বা ডালিম গাছের কথা মনে করতে চাইছিনা। বরং আমি নতুন কেনা পারফিউম মাখার জন্য উন্মুখ হতে চাইছি।
পারফিউমটা স্প্রে করতেই আমি কেমন অদৃশ্য হয়ে গেলাম। তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ ? আমি কেমন ফুরিয়ে গেলাম দেখলে? এমনি করে আমি মাঝে মাঝে একেবারে ফুরিয়ে যাই। শুধু গন্ধটা থাকে। রূপক আসে। গন্ধে মাখামাখি হয়ে কখনও আমি ওর সঙ্গে সেঁটে যাই। তারপর পার্টি, রেস্টুরেন্ট, নেশা আর ঘুমিয়ে পড়া। কতদিন যে ধীরে ধীরে ঘুমের মধ্যে নামিনি আমি। ঘুমকে উপলব্ধি করিনি। আমার ল্যাপটপের স্ক্রিনসেভারে নীল নীল ঢেউ আছড়ে পড়ে। ওরাও ঘুম জানেনা। কোথাও ঘুম নেই। ঘুমের মধ্যেও ঘুম নেই। তরলে তরল নেই। শুধু ঘূর্ণন। তাই নিয়ম ভাঙার ধুমধাম আছে। টলিয়ে দেবার ও টালমাটাল থাকার হুল্লোড় আছে।
আমি এখন সেই অন্ধকার আলোর মধ্যে শরীরী লটবহর বিছিয়ে রূপান্তরিত হবার চেষ্টা করছি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ না। আসলে আমি এখন একটা ডিস্কোতে। নব্বই ডেসিবেল শব্দের বিস্ফোরণ বুকে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি সেই সশব্দ ভাঙনের তালে তালে নেচে চলেছি। শরীরে শরীর জড়িয়ে সঙ্গ দিচ্ছে রূপক। আমরা এক দৃশ্যমান উষ্ণতার মধ্যে অদ্ভুত ভাবে শীতল হচ্ছি। বরফদৃষ্টিতে ভেসে উঠছে - নন্দন কানন থেকে মাদুর তাকিয়া ঘরে ফিরেছে। রুপোর রেকাবিতে রাখা ভিজে রুমাল শুকিয়েছে বহুক্ষণ। বেলফুলগুলো স্মৃতিদাগ রেখে চলে গেছে নক্ষত্রলোকে। সাদা চাদরে তুমি জেগে আছ। সন্ধ্যের তৈরি হওয়া গান এসে শুয়েছে তোমার পাশে। তোমার রবি ও কি জেগে থাকতো তোমার মত ? তিনি কি তাঁর ধ্রুবতারার জন্য নতুন করে দ্বিগুন হয়ে উঠতেন আগুনে আগুনে ?
মাধুকরী
রূপকেরও একরকম আগুন আছে। সেই গনগনে আঁচে নিজেকে সেঁকে নেওয়া যায়, তবে অলৌকিক আলোয় ভেসে থাকা যায় না। আমি জানি অস্ফুট মুখরতা বলে আমার জগতে কিছু নেই। আমার মত টার্গেট তাড়িত মানুষের পাথরে পাথর ঘষে শ্বাসরোধ করে বসে থাকাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও দ্বিধাগ্রস্ত ঋতুর চিবুকে মাঝে মাঝে পথভোলা কোনো জোনাকি এসে বসে।
ব্যালকনিতে বসেছিলাম। শহরের খোলস থেকে বেরিয়ে আসছিল অন্য এক শহর। রূপক এসে বসেছিল পাশে। মনে হয়েছিল চরাচর ভরে উঠবে পূর্ণিমায়। আকাশে বড় চাঁদও ছিল। তবু পূর্ণিমা আসেনা। রূপক শুধু বলেছিল, ‘আজ তোকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।’
‘কেমন অন্যরকম ?’
‘সাম থিং ডিফারেন্ট। লাইক ফ্লাওয়ার, বাট নট লাইক অ্যান অর্কিড।’
আর প্রশ্ন করিনি। এটুকু বোঝে বলেই তো রূপক পাশে এসে বসতে পারে। আর আমি ও পাশে থাকলেও নিজের কাছে থাকতে পারি। বাকিদের স্রোতে স্রোত রাখি শুধু। এই যে তুমি আমার মধ্যে বইছ এভাবে, তুমি তো সত্যিই স্রোতস্বিনী। তোমার মত আমিও প্রবাহই বহন করি। তবে আমার এই প্রবাহে ধারন বলে কিছু নেই। শুধুই বহন। যা কিছু রোজ ভাঙি ও বানাই, তা শুধু বয়ে বেড়াই । দিন শেষে কিছুই জমেনা। ভেতরে গুমরে ওঠে ভিক্ষের ঝুলি।
ছুটি ছুটি
আজ রবিবার। আমার ছুটির দিন। খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। অনেকদিন পর আজ সকাল দেখলাম। বসন্তের সকাল। ব্যালকনিতে বসে থাকতে থাকতে মনে হল সকালের কোন ভূগোল থাকেনা। রোদ আর ব্যস্ততা হামলে পড়ার আগে যে এমন একটা স্নিগ্ধ আহ্বান এসে রোজ ডেকে ডেকে ফিরে যায়, ভাবতেই মনখারাপ হয়ে গেল। ঘর থেকে মা’র পুজোর ফুল আর ধুপের গন্ধ ভেসে আসছে। ঘেন্নায় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া , বিরক্তিতে সরে যাওয়া মুহূর্তরা সে সুগন্ধ মেখে ফিরে আসছে। আজ আর কোথাও যাবো না। আজ সারাদিন শুধু তুমি আর মা। আচ্ছা তোমরা যে কি সব পরপারের কথা বল, সে যদি থেকে থাকে তবে তো তুমি এখন সেই চির বসন্তের দেশের মানুষ। এবার বলো তো তোমার রবি কি এখনও তার ‘সাধের সাধনার’ জন্য তেমনই একাগ্র ? যে অতৃপ্তি নিয়ে তুমি চলে গেলে সে কি এখনও আছে ? বাঁশির সুরের দূরত্বটুকু কি তোমরা অতিক্রম করেছ ? খুব আশ্চর্য লাগছে জানো, এই যে আমি তোমাকে যা যা বলছি, যেসব শব্দে বলছি এসব নিয়ে কিন্তু আমি এখনও যথেষ্ট আমার ভাষায় খিল্লি করি। অথচ দ্যাখ, কেমন স্বছন্দে তোমার সঙ্গে বোকা বোকা বিষয় নিয়ে কথা বলছি। তবে কি --- না থাক, আর ছেঁড়াখোঁড়াও করতে ইচ্ছে করছে না এখন। বরং তোমাকে সেই অন্য আমির গল্পটা বলি।
আমার কলেজ জীবন শুরু ইলেভেন থেকে। দশটা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাস চলতো। কো এড কলেজ। ইচ্ছেমত ক্লাস কামাই-এর স্বাধীনতা, গাছতলার আড্ডা, সব মিলিয়ে বিস্ময় আর ঘোর। ছোট থেকেই আমি খুব একটা হৈচৈ করতে পারতাম না। শুনতাম আর ভরে উঠতাম। নির্ঝরও ছিল আমার মত। ওর চশমায় বন্দী চোখ, বাউন্ডুলে চুল, উদাস ভঙ্গি সবকিছুকেই ছুঁতে পারতাম আমি। অনেক বই পড়ত নির্ঝর। কবিতা ভালোবাসতো। আমাকে শোনাতো, ‘রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।’ বলতো ‘বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট, আর ফুসফুসভরা হাসি’র কথা। নির্ঝরই প্রথম শুনিয়েছিল তোমার কথা রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠানের কথা। ও বলতো, ‘তুমি নাকি কবির সৃষ্টির আত্মার বন্ধু ছিলে। তখন তোমাকে জানার মত খুব বেশী উপাদান ছিল না আমাদের সামনে। তবু ও তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী জানত। হয়ত তোমার ঠাকুরপোর চেয়েও। ঠাকুরবাড়ির শিক্ষা, আদবকায়দা আর সবার উপেক্ষায় কুঁকড়ে থাকা তোমার যন্ত্রনাকে চিনিয়েছিল নির্ঝর। কবির কবিতার প্রথম পাঠক ও সমালোচক ছিলে তুমি। অথচ কি স্নিগ্ধতায় মুড়িয়ে রাখতে তোমার সমস্ত শক্তি, সব আগুন। সেই প্রথম পূর্ণতার স্পর্শ পাই আমি। যত সময় পেরিয়েছে তোমার ভেতর আশ্রয় নিয়েছি আমি। যে সেই খোঁজ দিয়েছিল, সেই নির্ঝর কিন্তু হারিয়ে গেল জীবন থেকে। বাবার ইচ্ছেয় বড় চাকরীর জন্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল। প্রথমে কিছুদিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। বুঝতাম পড়াশোনাটা ওর কাছে খুব চাপের মনে হচ্ছে । তারপর দুজনেরই নানা ঠিকানা বদল হল। আমরা হারিয়ে গেলাম। থেকে গেল ওর শোনানো কবিতা, ‘বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে...’ আমার একলা বিষাদ, একলা জাগা, একলা সকালের গল্পগুলো বড় হতে লাগলো। এই সফল জীবনে খুব জানতে ইচ্ছে করে ,ওর সেদিনের সেই দুঃখ বিহীন দুঃখগুলো কি এখনও আছে ? ভিড়ের ভেতর ওকে খুঁজি। খোঁজটা আড়াল করে রাখি আমার ঝকঝকে যাপন দিয়ে।
জমাতে জমাতে জমকালো পাথর
ওইটুকু ছাড়া আমার আর কোন ধারণ নেই। সামনে এগোনো কখন যেন অভ্যেস হয়ে গেছে। গতির স্রোতে ভেসে গেছে মুখচোরা মেয়েটা। জয়েন্টে আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি টেক পাস করে আমি এখন এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। এই পদে পৌঁছতে আমাকে কয়েকজন যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে টপকাতে হয়েছে। আর এই কাজ শুধু দক্ষতায় হয়নি। দেওয়া নেওয়ার শুরু সেই থেকেই। অ্যাম্বিশন নামের জেদি স্মার্ট শব্দকে কিছুতেই তাড়াতে পারিনি। আমাকে এক্সপ্লয়েট করেনি কেউ। আমিই নিজেকে তুলে ধরেছি বসেদের দামী একাকীত্বের কাছে। একের পর এক বাধা ডিঙ্গিয়েছি। ক্রমশ জড়তা কেটেছে। নিজের থেকে শরীরকে আলাদা করেছি। শানিত হয়েছে সৌন্দর্য। নেশা এসেছে। পুরুষ এসেছে। হাত পেতেছে। উভয়েই পূর্ণ হয়েছি। না, বিয়ে করবো না। গণ্ডী, খাঁচা এসব আমার জন্য নয়। দামী ফ্ল্যাটে মাকে নিয়ে থাকি। মা আছে বলে এখনও ঘরের গন্ধ পাই। এখনও কম কথা বলি, তবে শোনার কিছু পাই না। রোজ ওয়াইনের সঙ্গে গিলে ফেলি এক একটা অতিক্রমের গল্প।
সন্ধ্যেটা থমথম করছে। দূরে কোথাও সন্ধ্যামণি ফুটেছে। ঝিঙ্গেমাচার হলুদ ফুলেরা সন্ধ্যাতারাকে পৃথিবীর গল্প পাঠাচ্ছে। চুল বেঁধে, গা ধুয়ে তুমি এসে দাঁড়িয়েছ ছাদে। পড়েছ ফলসা রঙের কালোপাড় শাড়ি। জমানো রক্তের মত ছোট্ট চুনির দুল তোমার কানে। খোঁপায় দোলনচাঁপা। হোক না বসন্ত, তবুও দোলনচাঁপাই। আমি আমার সমস্ত আমিটুকু জড়ো করে বাড়িয়ে দিচ্ছি। তুমি আমায় ছুঁয়ে থাকো। আমার আলোয় পোড়া শরীরে তোমার প্রিয় সব অন্ধকার পুঁতে দাও। আজ চাই, ভীষণভাবে চাই, তোমার হু হু ডাক আমায় নিংড়ে নিক। আমার ভালবাসতে না পারার যন্ত্রণা তীব্র হোক। অন্তত দু’এক ফোঁটা সকাল পাক কাদম্বরী সেন। ভেতরের দিঘীটা গভীর হোক। নির্ঝরের জন্য প্রতীক্ষা থাক অনিবার্য হয়ে। কিন্তু আমার তো তোমার মত একাকীত্বের ঐশ্বর্য নেই। আমাদের একাকীত্বকে, কষ্টের গৌরবকে প্রতিমুহূর্তে ঠুকরে খাচ্ছে আমাদেরই আরোপিত স্মার্টনেস। কি করে ফিরবে এযুগের কাদম্বরীরা ? কতটা বিষ জমালে তবে নির্বাসন ?