Wednesday 9 May 2018

সাহিত্য এখন, মে,২০১৮






সম্পাদকীয়ঃ আজ রবীন্দ্রনাথের ১৫৭তম  জন্মদিবস।প্রতিবছর আশ্রমের রেওয়াজ অনুসারে সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে বৈতালিক এবং উত্তরায়ণের উদয়ন গৃহে কবি কণ্ঠের গান ও কবিতার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় তাঁর জন্মোৎসব। আজও তিনি ছেয়ে আছেন আমাদের মননে ও চেতনায়।সাহিত্য এখন মে সংখ্যা প্রকাশের জন্য তাই বেছে নিলাম এই পুণ্যদিন। এই সংখ্যায় থাকছে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার। এছাড়া থাকছে প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা। থাকছে মনের কথা।
চলে গেলেন বেলাল চৌধুরী ।পতন হল এক নক্ষত্রের। যিনি অনায়াসে বলতে পারেন, "এই জীবনে কোন অনুশোচনা নেই"আজ তাঁরই কবিতায় তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবো।

নারীটি যখন নদী হয়ে গেল
বেলাল চৌধুরী 

সে কি তার মৃত্যু দৃশ্যে
পেয়েছিল পরিপূর্ণতা, কে জানে!
না হলে ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসিটি
কি করে ফুটিয়ে তুলেছিল বিভ্রম ; ---
নগ্ন পদযুগল যেন নীরবে কওয়াকয়ি করছিল
এসেছি ঢের দূর, আর নয়,
নদীটি বহে যাচ্ছিল আপন মনে
এঁকে বেঁকে হেলায় ফেলায় . . .
ভরা জোয়ারের টানে গেল ভেসে
জ্যোত্স্না উদ্ভাসিত চরাচরকে আঁধারে ডুবিয়ে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকারঃ প্রভাত চৌধুরী  
প্রশ্নোত্তর পর্ব
আমিঃ আপনারছেলেবেলা/বাল্যকাল/শৈশব সম্পর্কে আপনি যা যা ইতিপূর্বে লিখেছেন,তার বাইরে এমন কিছু বলুন, যা আমরা জানি না।
তিনিঃ সমস্যায় ফেলে দিলে।এমনটা তো কথা ছিল না।তবে কথার পিঠে কথা গেঁথে যাওয়াটাই তো আমার কাজ। তবে পুরনো সেই দিনের কথা শুনতে তোমাদের ভালো লাগবে।
(আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম,তিনি বলতে লাগলেন)
 আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমার একটা নিজস্ব ঘুলঘুলি ছিল,ছেলেবেলায়, এতে কখনো কোন চড়ুই এসে বসেনি,বাসাও বাঁধেনি।ঘুলঘুলিটি ছিল ঘোরানো সিঁড়ির এক স্থানে। আমি ওই ঘুলঘুলিতে সঞ্চয় করতেম আমার যাবতীয় সম্পদকে।আমার বেশ মনে পড়ছে ওই ঘুলঘুলির ভেতর আমি রেখেছিলেম ময়ূরের পালক,রঙিন মারবেল,ঝাড়লণ্ঠনের একটা তেকোনা কাচ,এমনকি একতা কাগজের নৌকোও। কাগজের নউকোটি সেজোদাদা বানিয়েছিলেন,সেটাও বেশ মনে আছে। ‘কুমকুম’এর একটা শিশি,খুবই ছোটো,তাও রেখেছিলেম ওই ঘুলঘুলিতে। রাখার সময় মনে হত এগুলি খুবই দুর্লভ বস্তু,মহামূল্যবান।এগুলিকে গোপনভেবে না রাখতে পারলে খুবই ক্ষতি হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
কিন্তু বড়ো হয়ে যাবার পর কোনদিনই খোঁজ করিনি ওই মহার্ঘ জিনিষগুলির। এমনকি ঘুলঘুলিটিও হারিয়ে গিয়েহিল স্মৃতির অর্গল থেকে।তুমি না লেখা তথ্য চাইলে বলেই বললেম।
আমিঃ আচ্ছা,যদি হারিয়ে না যেত তাহলে ওগুলিও আপনার লেখার বিষয় হতে পারত।
তিনিঃ হয়তো,হত। আবার না হবারও সম্ভাবনা ছিল।
আমিঃ আজ ২০১৭র ২৯শে মার্চ,দুপুর ১২টা ৪৮এ যদি আপনাকে অনুরোধ করি – আপনার ছেলেবেলার সেই হারিয়ে যাওয়া ময়ূরের পালকটি নিয়ে কিছু বলার জন্য
তিনিঃ বেশ বিপদে ফেললে দেখছি।তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ঠিক করিনি। বুঝতে পারছি। শোন তাহলে-
ময়ূরপাখির পালকে একাধিক চোখ আছে,প্রতিটি চোখ
স্বাধীন ভাবে আলাদা আলাদা দৃশ্য এবং শব্দকে
দেখতে সমর্থ হয়,যেমন প্রথম চোখটি দ্যাখে
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল
দ্বিতীয় চোখটি শোনে শান্তিনিকেতনের কাচমন্দিরের নিকটবর্তী
গাছগাছালির ওপর জ্যোৎস্না পতনের শব্দ
তৃতীয় চোখ নিস্পন্দ থাকে শিলাইদহের বোটের একটি আরামকেদারায়
চতুর্থ চোখ একটি রক্তকরবীকে ফুটতে দ্যাখে
পঞ্চম চোখটি কিছুই দ্যাখে না,অন্য চোখগুলির গতিবিধি লক্ষ্য রাখে
আমিঃ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।কথা দিচ্ছি,আর কখন আপনাকে এই বিপদে ফেলব না। আপনি বরং আপনার একটি গানের কথা বলুন,গানের উৎসের কথা বলুন। যা আমরা জানি না।
তিনিঃ ২৬শে চৈত্র ১৩১৬,আমি তখন বোলপুরে,তখন শান্তিনিকেতনের এত রমরমা ছিল না। সেকারণেই বোলপুর বললেম। একটি গান লিখেছিলেম, যার প্রথম লাইনটি ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’।
তুমি গানটি শুনতে পাচ্ছ তো? তুমি শুনতে থাকো,আর আমি ফিরে যাই ১৩১৬র চৈত্র মাসের সেই নির্দিষ্ট তারিখে। সকালতা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।কিছুটা হেঁটে আসার বাসনা হল ।রোদের তাপ ততটা তীব্র নয়।তখনি কালবোশেখি হয়ে গেছে।সঙ্গে ২/১০ ফোঁটা বৃষ্টিও।
খুব কাছ থেকে একটা কোকিল ডাকছিল।এই ডাক কি তার সঙ্গিনীকে কাছে আসার ডাক। তা তো বলতে পারছিনে ,তবে এটুকু বলতে পারি- কোকিলরা আমাদের জন্য ডাকে না, অর্থাৎ আমাদের ডাক শোনাবার জন্য ডাকে না। কোকিলের ডাক তার স্বজনের উদ্দেশ্যে ডাক।আমাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয় আছে বলেই আমরা সে ডাক শুনতে পাই। ডাকের অর্থ বুঝি কি!
কোকিলের ডাকের উত্তরে কিছুক্ষণের মধ্যেই আর একতা কোকিল ডেকে উঠল,পূর্বপল্লির দিক থেকে। বোঝা গেল কোকিলের ডাকটি কার্যকরী হল।
তিনিঃ তোমরা তো জানো শিলাইদহে আমার একটিকুঠি-বাড়ি ছিল।ওকে আবার কাছারিবাড়িও বলতে পারো।আর ছিল সেই বোটটি ,যে গেট এ আমার যাতায়াত এবং লেখার ঘর বা দ্যাখার ঘরও বলতে পারো।
তুমি নিশ্চয় জানো একটি জায়গা থেকে সব কিছু দ্যাখা যায় না। সূর্যোদয় দ্যাখার জন্য যদি হিমালয়কে বেছে নাও, তবে সূর্যাস্ত দ্যাখার জন্য যেতে হবে সমুদ্রে। আর নিজেকে দ্যাখার জন্য চাই গোঁসাঘর। ‘গোঁসাঘর’ শব্দটি পছন্দ না হলে একে ‘নিজ নিকেতন’ নামেও ডাকতে পা্রো। নামে কিছু এসে যায় না, লক্ষ্যে স্থির থাকাটাই হল মূলমন্ত্র ।
শিলাইদহের বোট থেকে নিস্তরঙ্গ নদীর ওপরে যে ফুটফুটে জ্যোৎস্না দেখেছি,তার জুড়ি মেলা ভার। ওই নদির ধারে একবার পশ্চিমদিকে সোনার সূর্যাস্ত আর একবার পূর্বদিকে রূপোর চন্দ্রদয় দ্যাখার কথা তো তোমরা জানো। কিন্তু যা তোমরা জানো না, আমি কখনো জানাইনি বলেই। আজ তোমার কাছে যে গোপন প্রকাশ করব,তার কোন সাক্ষী নেই। স্বার্থও নেই।
আমি ত আগেই একটি চিঠিতে লিখেছিলেম- মেয়েতে ও জলেতে বেশ মিশে যায়।এই উপলব্ধিতে পৌঁছোবার অলক্ষে একটি ঘটনা আছে। সে এক ভরা জ্যোৎস্নার রাত।ঘুম আসছে না।বাইরে এলেম।এসেই মনে হল এমন রাত তো আমার আগে দ্যাখা হয়নি।  চরের ওপর একটা টিটি পাখি ডাকছে।এত রাতে টিটি কেন ডাকে?একা একা।নৌকো স্থির।ভালো করে লক্ষ করে দেখলেম, টিটি একা নয়, এক সাধারণ মেয়ে চর থেকে জলের দিকে,বোটের দিকে হেঁটে আসছে। মেয়েটি কি কোন বিপদে পড়েছে! সে কি সাহায্যের আশায় এদিক পানে আসছে!কিন্তু আমি তো নিরুপায়। আমি কীভাবে তার দিকে বাড়িয়ে দেব আমার সাহায্যের হাতমেয়েটি বোটে পৌঁছোবার জন্য জলে নেমে পড়ল।হাত নেড়ে আমাকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করল।আমি ওর হাতের ভাষা বুঝতে পারলেম নে।বোটের কিনারার দিকে এগিয়ে গেলেম।মেয়েটিকে বোটে উঠতে সহায়তা দেবার বাসনায়।
হঠাত কুব করে একটা শব্দ হল।মেয়েটিকে আর দ্যাখা গেল না। জলের ভেতর ভুড়ভুড়ি কাটতে দেখলেম যেন।সে কি তলিয়ে গেল জলে! বাতি নিয়ে এসে দেখলেম।জলে কোন তরঙ্গ নেই। এত রাতে কাকে ডাকব।কী হবে। মেয়েটির ডুবে যাবার কোন চিহ্ন নেই। জ্যোৎস্না থইথই নদীজল। দক্ষিণ দিক থেকে আসা একটা বাতাস কেমন যেন হু হু করে উঠল।সাহায্যপ্রার্থী মেয়েটির কথা পরদিনও কাউকে বলতে পারিনি। বললে ওরা সবাই অভিযোগ করত সে সময় ওদের ডাকিনি কেন।একটা চরম পাপবোধ আমাকে নিথর করে রেখেছিল।
এখন মনে হচ্ছে তুমি বলতে পারো,আমি মেয়েটিকে একা পেতে চেয়েছিলেম।এজন্য লোক জানাজানি করিনি। চরাচরের যাবতীয় ঘটনা মিথ্যে হতে পারে কিন্তু ওই মেয়েটির জলের অতলে তলিয়ে যাওয়াটা মিথ্যে নয়।
তবে পরের দুচারদিনের মধ্যে কোন মেয়ের নিরুদ্দেশ হবার কথাও কানে আসেনি। না কাছারিঘরে, না বোটে।
এর কী ব্যাখ্যা দিতে পারো তুমি!
এসেছিলাম প্রশ্ন নিয়ে।এখন তাঁর প্রশ্নের কী উত্তর দেব আমি। এর কোন সর্বজনগ্রাহ্য উত্তরও আমার কাছে নেই।
তাকিয়ে দেখি তিনিও নেই। জ্যোৎস্নায় মিশে যাবার কোন শব্দ হয় না। এ এক নির্জন নিরপেক্ষ মিশে যাওয়া। মনে মনে উচ্চারণ করি-
তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।

মনের কথা
বিতর্কিত
সম্পূর্ণা চ্যাটার্জী

অনেকগুলো শব্দকে প্রোডাকশনে দিয়েছি! এক্ষুণি তৈরি হয়ে যাবে কবিতা! হ্যাঁ একটা ফ্যাকট্রি খুলেছি আধুনিক কবিতা জন্ম দেব বলে!তিনবছর হল কবিতা লিখছি | সবাই বলছে গল্পটাও মন্দ লিখছিনা তাই এখন  "টোটাল সাহিত্যিক " বলতে যা বোঝায় আমি সেই কম্বিনেশন! রবীন্দ্রনাথ থেকে কিশোর কুমার, বিল গেটস থেকে মার্ক জুকেনবার্গ এরা স্কুল, সিলেবাস বা তথাকথিত  তালিম না নিয়েও সফল! আমি শুধু সেটুকুই জানি এবং মানি! আর ওইটুকুই নিজের মন থেকে মগজ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছি। তাই আমি লিখি, আমি শেখাই! আমায় পড়তে হয়না, শিখতে হয়না।

 আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল,"ইনপুট নাহলে নাকি আউটপুট সম্ভব নয়!"  আমি কবি আমার আবার ইনপুট কিসের!পড়াশোনা আর খাওয়া এক হল নাকি! কবিদের পড়তে লাগেনা, এটাই বাস্তব এবং সত্যি। অবাক হচ্ছি দেখে আরও বলেছিল,"রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ , শক্তি চ্যাটার্জ্জী-সুনীল গাঙ্গুলী এঁরা নাকি সময় পেরিয়ে সময়কে দেখতে পেতেন! তাই বহু বহু বছর পরেও তাদের লেখা পড়লে তা সমকালীন মনে হয়! একজন কবির নাকি আগামী  পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে দেখার চোখ থাকে!সেটা পড়াশোনা না করলে নাকি সেই দেখার চোখটা জন্মায়না!" আমি অত কিছু বুঝিনা! শুধু বুঝি আমায় কেউ প্রশংসা করলে আমিও তার লেখার প্রশংসা করে সাহিত্যের দায় মেটাতে হয়। সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করিনা।  আমায় কেউ, "বাহ্!" বললে, আমি তাকে, "বাহ্! বাহ্! " বলবই। এ ওর পিঠ চাপড়ে বা কলকারখানার মতো সাহিত্যেও মজদুর, মজুরি, হপ্তা নেয়া ও দেয়া বা ইউনিয়নবাজি করা বিদগ্ধ কবি আমি ! এসব ব্যস্ততায় নিজের পড়ার তাই সময়ই হয়না! না, না ভুল হয়ে গেল ! আমায় পড়তে বা শিখতে লাগেনা!

এভাবে সাহিত্য সাধনা করে কালে কালে আমি ফেবুর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়েও চলে এসেছি। যেকোনো বিষয়ে মতামত দিতে পারি। হ্যাঁ, পারি।  সমাজ, জীবন, দেশ, খুন, ধর্ম, ধর্ষণ সব বিষয় সম্বন্ধে আমি ওয়াকিবহাল! প্রতিবাদ করি মিছিল মিটিঙে না হেঁটে, শুধুমাত্র জ্বালাময়ী পোস্ট দিয়ে! এখন জনতা "ধর্ষণ" আর "ধর্ম"খুব খাচ্ছে! আমিও  সহানুভূতি, শোক কবিতায় ঠুসে খাইয়ে দিচ্ছি! আর ধর্ষণে প্রতিবাদ কম হলেও চলবে। "ধর্ষণ" শব্দটাও যথেষ্ট নয় নৃশংসতা,অত্যাচার বা কারুর যন্ত্রণা সঠিকভাবে বোঝাতে! তাই ঠিক কি কি ভাবে হয়েছিল আমি সেখানে ছিলামও না, তবুও জানি! তাই সেটা জনস্বার্থে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে চাটনি বানিয়ে শেষ পাতে পরিবেশন করি অবাধ যৌনতা অথবা নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা বিকৃতি!

আর ধর্ম? ওটা তো আরো বেশি সহজ আর সহজলভ্য এই হাইপ্রাইসের যুগে!!পৃথিবীর সব থেকে পুরনো প্রোডাক্টও! যার সেলসম্যান ছিল আমার মতই কোনো ধর্মীয় অন্ধ মেয়ে বা পুরুষ, "মানুষ" নয় কিন্তু!  ওইজন্যই মেট্রোপলিটন সিটির নর্দমার পাশ ঘেঁষে তৈরি হওয়া স্লাম এড়িয়ায় নাকে রুমাল দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় খিদে খুঁজি! পেট ভরতি খিদে নিয়ে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা হতশ্রী চেহারা গুলোর হাতে দিয়ে যাই বেশকিছু অশিক্ষা আর অন্ধত্ব ! পকেটে গুঁজে দিই টাকা, আর বন্দুক! কানে দিই জেহাদী মন্ত্র আর  দেশি মদের ঠেকে সস্তায় বিক্রি করি নতুন কোনো ধর্মীয় জিগির! আমিও তেমন কবি! ঠাকুরের সিংহাসনে মাটির গণেশের হাতটা একটু ভাঙলেই বুক মোচড়ায়! সিনেমায় রানী পদ্মিনীর দিকে আলাউদ্দিন খিলজি তাকালে হাউমাউ করে কেঁদে জহর ব্রতের আগুনে সতী খুঁজি! অথচ আমার পাশের বাড়ির মেয়েটার মলেস্টশনে পাই কেচ্ছার গন্ধ !  ছোটবেলার বন্ধু আসিফের ঘরটা আমার আত্মীয়রা পুড়িয়ে দিলে যুক্তি সাজাই! আর অজুহাত দিই ওই সেই ধর্মের!লিখি সাম্প্রদায়িক সময়ের ঝলসানো প্রতিবাদ। হ্যাঁ, বুদ্ধিজীবীদের এমনই হতে হয়, সে ফেবুই হোক বা সন্ধ্যেয় টিভির চ্যাটশোয়ের অতিথিই হোক!

ওই যে! আগেই বললাম আমি পড়িনা, আমার লেখা সবাই পড়ে ! যেকোনো বিষয়ে মতামত দিতে পারি! দেশ,সমাজ,জীবন নিয়ে লিখে লিখে পানসে হয়ে গেলে ছাড়িনা "প্রেম", "পরকীয়া"কেও! ওই শব্দ দুটো শুনলেই মন উসখুস করা যৌন গন্ধ পাই!  পার্কের কোনে একটা চুমুর শব্দ কানে এলে ছিঃ ছিঃ করে উঠি!ওতেও যদি ধর্ম গুঁজে দেয়া যায় বেশকিছুদিন আনন্দে কেটে যায় এতেই! তারমধ্যে দেশ ফাঁকা করে টাকা বিদেশে চলে গেলেও নেই অসুবিধা।  প্রেমের কবিতা দেখলেই আঁতিপাঁতি করে খুঁজি বেনামে কারজন্য লেখা! বুঝতে না পারলে হই অন্য কারুর দ্বারস্থ! আর বুঝতে পারলে আরো কজনকে "বুঝতে পারাটা" সাগ্রহে দিই পৌঁছে! নেট পুড়িয়ে, সংসারের গালমন্দ শুনে কতো আর ভালোলাগে সাহিত্য পুজো করতে, দেশ বা সমাজ উদ্ধার করতে! তাই সাহিত্য চর্চার পাশে এগুলোও করি! ঠিক পাড়ার কলে যেমন হয় অমুক বাড়ির দাদার সাথে তমুক বাড়ির বৌদির, এর বাড়ির ছেলেটার সাথে পাশের পাড়া মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে! বদল খুঁজি তুমি---সের মধ্যে,নিজে বদলাই না!এমনই প্রাজ্ঞ সাহিত্যিক আমি!

আমায় শিখতে হয়না, আমি শুধু শেখাই!
আমায় পড়তে হয়না, আমার লেখা পড়ে সবাই!
আমি কবি, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।


এই লেখাটা লিখতে গিয়ে বহুবার বিতর্কের ভয়ে পিছিয়ে গেছি...সেদিন শ্রদ্ধেয় আবুল বাশারের একটা লেখা পড়ে খানিক সাহস পেলাম...আমি খুব সামান্য, তবুও লিখলাম আমার মতো করে...
অনুগল্প
২ হাজার টাকা
সতীশ বিশ্বাস
একটি আমগাছের তলায়, লাইনে দাঁড়িয়ে দুলাল। সারাদিন কাজ করেছে। মজুরি পাবে ২০০০টাকা। আর মাত্র সামনে ২জন। এর পরেই টাকাটা সে হাতে পাবে। আর একজন। অমনি টুক করে একটা পাকা আম পড়ল তার মাথায়। দুলালের ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্ন গেল চটকে। খাটের সঙ্গে মাথার ঠোকা খেয়েছে। আবার ঘুমের গর্তে ঢুকতে চাইল সে। কিন্তু ওতো খরগোশ নয়। 




গল্প
সেই পূর্ণিমার সন্ধ্যে... 
দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়

পাহাড়ে এসেছি মাস তিনেক হল। ছোটখাট দপ্তরের ছোট অফিসার হয়ে। স্বেচ্ছায় এমন দুর্গম জায়গায় যেতে চাই বলায় আমার উপরওয়ালা একটু অবাকই হয়েছিলেন। কেউ যেতে চায় না সেখানে... জনান্তিকে বলাবলি করেছিলেন, ওর কি মাথা খারাপ হয়েছে! আমি লেখালেখি করি বলে এমনিতেই আমাকে একটু খ্যাপা গোছের ভাবতেন।

প্রথমটা বেশ খারাপই লেগেছিল, বিশেষ করে বিকেলে যখন অফিস থেকে বেরোতাম। বাইরের শুনশান রাস্তা, দূরে দূরে জ্বলা দুএকটা আলো কেমন যেন গিলে খেতে আসতো আমায়। তবে এই নিস্তব্ধতা, চেনা মানুষের অচেনা মুখ না দেখার জন্যই তো আসা। দুকামরার ছোট্ট বাড়িটাতে ফিরে নিজের হাতে চা বা কফি বানিয়ে বাইরে বারান্দায় বসে কাটালাম কদিন। আমার অফিসের বড়বাবু ক্ষেত্রী, আসার পর দিনই রান্নার জন্য একজনকে ঠিক করে দিয়েছিলেন। জুলি নামে একটি নেপালী মেয়ে, বছর সতের আঠের বয়স হবে। ফুটফুটে পুতুলের মতো চেহারাভালো বাংলা জানে।

আমাকে বলেছিল, বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। মা ছোটখাট কাজ করে, ভাইরা স্কুলে পড়ে, পড়ে ও নিজেও, এবার টুয়েলভ হবেকিন্তু তারমধ্যে এই রান্নার কাজটা নিয়েছে যাতে একটু মাকে সাহায্য করা যায়। আগে যে সাহেব ছিল, তার বৌ আর একটা বাচ্চা ছিল। ওরা ওকে আটশো টাকা দিত। আমি একা তাই যা মনে হবে তাই যেন দিই। আমি বলেছিলাম আমি তোমাকে হাজার টাকা করে দেব কিন্তু একটা শর্ত আছে আমার।

একটু আশঙ্কার ছায়া ঘনিয়েছিল ছোট ছোট চোখদুটোতে। আমি বলেছিলাম কাল সকালে আমার সাথে ব্যাংকে যাবে, ওখানে আমি তোমাকে একটা বই খুলে দেব। প্রতিমাসে বাড়তি যে টাকাটা দেব সেটা বইতে রেখে দেবে। ওটা খরচ করা যাবে না, এটাই শর্ত। খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠেছিল জুলির মুখটা।

কদিনের মধ্যেই আমি খুঁজে পেলাম একটা অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। ছোট্ট পাহাড়ী শহরের মূল রাস্তা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে একটা পায়েচলা পথ উঠে গ্যাছে অনেক উপরে। সেখানে পাহাড়ের উল্টো ঢালে একটা ছোট্ট মন্দির। শিবেরই হবে। চারদিকে বারান্দা। কাঠের রেলিং দেওয়া। মন্দিরের পিছন দিকে কুড়ি পঁচিশ ফুট দূরেই নেমে গ্যাছে অতল খাদ। নিচের দিকে দৃষ্টি যায় না। পিছনের বারান্দায় বসলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে দূরের একটা উপত্যকা, জঙ্গলে মোড়া তারপর নগাধিরাজের রাজত্ব। ছোট বড় পাহাড়ের ভাঁজ।

কোথাও জমে আছে মেঘ, কোথাও বা এই হেমন্তেই হালকা বরফের চাদর জড়ানো চূড়া। তাতে খেলা করছে শেষ বেলার সুর্যকিরণ। আমি যখন গিয়ে পৌঁছাই তার আগেই পুরোহিত পুজাপাঠ শেষ করে ফিরে যান হয়তো। আমি পেয়েছিলাম ধূপের হালকা গন্ধই শুধু।

প্রথম দিকে ওনার দেখা পাই নি আমি। আসিও নি রোজ অবশ্য। এক শনিবারে, আধা অফিস করে চলে এসেছিলাম। সেদিন দেখা মিলেছিল ওনার। ধুতি পরা গায়ে গেরুয়া চাদর জড়ান, লম্বা, টান টান চেহারার এক বৃদ্ধ। দেখেই ভক্তি আসে মনে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করেছিলাম। মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করে বলেছিলেন, এখানে সবাই আসে না। আপনার মনে এস্থান আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে বুঝতে পারছি, কিন্তু পূর্ণিমার দিন এখানে আসবেন না। জায়গাটা ভালো নয়।
আমি আর ওনাকে জিজ্ঞেস করি নি কিসের ভয় এখানে। কলকাতার মানসিকতা সবটা ফেলে আসতে পারি নি, বেপরোয়া মনোভাব খানিকটা ছিলইতাছাড়া আমি থাকি একা। বইপত্র স্তূপ করে এনেছি সাথে, প্রায় দিনই নতুন নতুন পার্সেল এসে পৌঁছচ্ছে। কিন্তু পঞ্জিকা সাথে নিয়ে তো ঘুরি না। ফলে কবে পূর্ণিমা কিনা জানবোই বা কি করে। চাঁদ ওঠার আগেই তো চলে আসি এখানে।

জুলি জানতো আমি রোজ অফিস ফেরতা বেড়াতে যাই। ওর কাছে বাড়ির একটা চাবি দিয়ে রেখেছিলাম। সন্ধ্যে বেলায় ও এসে রুটি বা পরোটা বানিয়ে হটকেসে রেখে যায়, কোনদিন ইচ্ছে হলে কিছু একটা সব্জিও বানায়। আমি ফিরে আসার আগে বেশিরভাগ দিনই ও চলে যায়। কচিৎ দেখা হয় ওর সাথে সন্ধ্যে বেলায়। সেদিন পুরোহিতের সাথে কথা বলার পর ঘণ্টা দুয়েক থেকে ফিরে এসেছিলাম। জুলি এসেছিল একটু পরে। আমাকে একা বারান্দায় বসে থাকতে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল বোধহয়। তারপর দ্রুত কফি নিয়ে হাজির হয়েছিল আমার সামনে।

আমি জানি ও নিজেও কফি খেতে ভালোবাসে তাই বলেও দিয়েছিলাম, তোমার নিজের বাড়িই ভাববে এটাকে। যখন যা ইচ্ছে করবে বানিয়ে খেয়ে নেবে। ভালো কিছু বানালে আমার জন্য একটু রেখো। সব খেয়ে ফেলো না আবার।

ওর নিজের কাপটা নিয়ে এসে ও বসেছিল সিঁড়িতে। জিজ্ঞেস করেছিল, আজ কেন আমি ঘুরতে যাই নি। আগেই ও বলেছিল, পাহাড়ি রাস্তায় টর্চ যেন সবসময় সাথে রাখি রাতের বেলায়। ওর পাকামি দেখে হেসেছিলাম কিন্তু যুক্তিটা মেনেও নিয়েছিলাম। সবসময়ই একটা টর্চ পকেটে রাখি আমি।

ওকে আমি বললাম আজ পুরোহিতের বলা কথাটা। মুহুর্তে পাল্টে গেল ওর চোখমুখ। আপাত হাস্যমুখির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আপনি ওখানে যান রোজ, ওই মন্দিরে? কেন যান? আপনাকে কেউ বারণ করেনি যেতে। ওটা ভালো জায়গা নাআর যাবেন না। ওটার একটা নাম আছে, লাভার্স পয়েন্ট। এখানকার কেউ সন্ধ্যের পরে যায় না ওখানে। আর যাবেন না স্যার। বলে উঠে রান্নাঘরে চলে গেল জুলি।

ওর আচমকা এই পরিবর্তনে আমি একটু ঘাবড়েই গেলাম। এই মেয়েটাকে হাসিমুখে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে পরেছিলাম, ও যে গম্ভীরও হয়ে যেতে পারে সেটা প্রথম দেখলাম। চুপচাপ কাজ শেষ করে, খাবার গুছিয়ে রেখে চলে গেল জুলি। আজ যাওয়ার সময়ও ওকে ভীষণ চিন্তামগ্ন দেখলাম। মুখ তখনো ফ্যাকাসে হয়ে আছে।

দুই তিন দিন যাই নি ওই মন্দিরের পথে। আমাকে ঠিক সময় বাড়ি ফিরতে দেখে জুলির মুখে হাসি ফিরে এল। কিন্তু তারপর কি যে হল, আমায় কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেল সেই রাস্তায়। আমি যখন পৌঁছোলাম তখনো আকাশে সামান্য আলো আছে। ধূপের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। দেখতে দেখতে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। চমকে উঠে দেখলাম আমার ডানদিকে আকাশ আলো করে উঠে এল পূর্ণিমার চাঁদ। ঠিক যেন একটা গোল সোনার থালা।  

কেন জানিনা মনটা ছ্যাঁত করে উঠল। আজ এসে কি ভুল করলাম? পুরোহিত না করেছিলেন, বারবার আটকেছে জুলি, তারপরও কেন এলাম। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে ছিলাম, হঠাত মনে হল কেউ পাশে এসে বসেছে। চমকে তাকিয়ে দেখি, জুলি। নাঃ এতো জুলি না, কে তবে? এখানে নাকি কেউ আসে না সন্ধ্যের পরে, তাহলে এই মেয়েটা একা এল কি জন্য, কিভাবে এল। সাথে কি কেউ এসেছে?

আশপাশে মাথা ঘুরিয়ে দেখে কাউকে দেখতে পেলাম না। আমার অচেনা সঙ্গী ততক্ষণে জুত করে বসে পরেছে আমার পাশে, একটু দুরত্ব বজায় রেখে। আমাকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে কাঁচভাঙার শব্দে হেসে উঠল।বলল, আমি একলাই এসেছি, সাথে কেউ নেই। আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে কি।

না মানে, এখানে সন্ধ্যের পরে কেউ আসেনা শুনেছিলাম, তাই অবাক খানিকটা হয়েছি । আপনি এখানেই থাকেন? মানে আমি আগে দেখি নি আপনাকে, তাই জিজ্ঞেস করছি। আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল সে। কি যেন একটা আছে সেই দৃষ্টিতে। আমার শরীরটা কেমন যেন ভার ভার ঠেকতে লাগল।

যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছে এমনই চাপা গলায় সে বলল, ওই যে নীচে উপত্যকাটা দেখছেন, ওখানেই থাকি। রোজ আসি না এখানে, শুধু পুর্ণিমার সন্ধ্যায় আসি, আসতে হয়। অপেক্ষা করি একজনের জন্য, সে এলে ফিরে যাই তার সাথে, না হলে একাই যেতে হয়। কিন্তু আপনি একা এভাবে এখানে এসেছেন কেন? এত নিষেধ মানা শোনার পরও এভাবে এসে বসে আছেন কেন?
সাথে বসে থাকার কেউ নেই, তাই একা। যার বসে থাকার কথা ছিল সে এখন অন্য কারুর সাথে বসে আছে, এই পৃথিবীর অন্য কোনখানে। আমার কথা মন দিয়ে শুনছিল সে। একটু সাহস পেয়ে বললাম,  কিন্তু আপনি একা কেন? আপনার তো একা এখানে আসার প্রয়োজন ছিল না। আমার প্রশ্ন শুনে সে হাসিতে ভেঙে পড়ল। খান খান হয়ে গেল নিস্তব্ধতা।

কে বলল আমি একা? ওই তো আমার মানুষ আসছে আমার জন্য। হেমন্তের শেষ, কুয়াশা পড়া শুরু হয়ে গেছে। সেই কুয়াশা যেন একটা লম্বা সেতুর মতো ঝুলে আছে মন্দির প্রান্ত থেকে দূরের উপত্যকা অবধি। আমি চেয়ে দেখলাম সেই কুয়াশার সেতু বেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে একজন। একটা ছায়ামুর্তির মতো। আবিষ্টের মতো দেখতে লাগলাম।

আমার বন্ধু চলে এসেছে। চলুন আমাদের সাথে যাবেন আমাদের দেশে? সেই মুর্তি তখন বেশ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। আমি চাঁদের আলোতে দেখলাম, মানুষটির সাথে আমার অসম্ভব রকমের মিল, মনে হচ্ছে যেন আয়নায় নিজেকে দেখছি আমি। এটা কি ভাবে সম্ভব? আমার পাশে বসে থাকা সঙ্গী হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা ধরল। কি মারাত্মক ঠাণ্ডা হাত, যেন বরফ দিয়ে তৈরি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তি বলল, চলো দেরী হয়ে যাচ্ছে। আরে এতো আমারই গলা। আমি হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। মেয়েটি ক্রমশ আমাকে সামনে হাঁ করে থাকা খাদের দিকে টানছিল

ঠিক সেই মুহুর্তে মন্দিরের ঘণ্টাগুলো একসাথে বেজে উঠলো, ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা তীব্র স্রোত কোত্থেকে বয়ে গেল ঝড়ের মত। ঘণ্টার আওয়াজের সাথে সাথেই দেখলাম আমার হাত ছেড়ে দিয়ে মেয়েটি ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল কুয়াশার সেতুর মধ্যে।তার সঙ্গীকেও আর দেখতে পেলাম না।  চারদিক কেমন যেন অন্ধকার করে এল।

জ্ঞান হতে দেখলাম, দেখি জুলি আমার মাথা কোলের ওপরে নিয়ে বসে ঝুঁকে আমাকে ডাকছে। আমি চোখ খুলতেই বলল, আপনাকে আমি মানা করেছিলাম এখানে আসতে। কেন এসেছিলেন। চাঁদ ওঠার পরও আপনি আসছেন না দেখে পুরোহিত ঠাকুরকে নিয়ে চলে এসেছি। মন্দিরে ঢোকার আগেই শুনলাম আপনা আপনি ঘণ্টাগুলো বেজে উঠল। বেজেই চলল। দৌড়ে এসে দেখি আপনি খাদের মাথায় পড়ে আছেন। আর একফুট গেলেই...... কেঁপে উঠলো জুলির শরীর।
ওরা কারা জুলি? আমাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি তো নিজেকেই দেখতে পেলাম ওই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসতে। ওরা কে? তুমি কিছু জানো?

জুলি তখন কিছু বলে নি। বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম অতিকষ্টে। আমাকে গরম কফি দিয়ে নিজের কাপ নিয়ে বিছানার পাশে চেয়ারে বসেছিল জুলি। আমার প্রশ্নের জবাবে বলল, আমার দিদি, লিলি ওর নাম ছিল। এখানকার এক বড় ব্যবসাদার, কন্ট্রাক্টার রায় সাহেবের ছেলে ভালোবেসে ফেলে আমার দিদিকে। সেই অপরাধে ওকে কেউ একদিন ওই মন্দিরের পাশের খাদে ফেলে দেয়। আমরা জানতামও না।

দুচোখের জল মুছে আবারো বলল জুলি, তার পাঁচদিন বাদে ছিল পূর্ণিমা। রায় সাহেবের ছেলে অনীক ঠাকুরের কাছে দিদিকে ফিরে পাওয়ার জন্য মানত করতে গেছিল, সাথে দুই বন্ধুও ছিল। ওদের চোখের সামনে ঠিক আজকের মতো দিদি উঠে আসে খাদ থেকে। অনীকদাদাকে হাত ধরে নিয়ে চলে যায় বন্ধুদের সামনে দিয়ে। পরদিন পুলিশ আরো সব লোকজন এসে খাদে নামে। দেখে ওরা দুজনেই নীচে রয়েছে, তখনো দিদির হাত আর অনীকদার হাত একসাথে ধরা আছে। সেই শোকে আমার বাবা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান। তারপর থেকে আমরা এভাবেই বেঁচে থাকার জন্য লড়াই চালাচ্ছি। স্যার, এর আগে আরো দুজন ওখানে গিয়ে ফিরে আসে নি। সেজন্যই আপনাকে মানা করেছিলাম যেতে।

জুলির কান্নাভেজা মুখটা দেখে আমার নিজেরও চোখে জল চলে এল। আধশোয়া অবস্থাতে ওর হাতের অপর আমার হাতটা রেখে বললাম, তুমি আমাকে আর স্যার বলে ডেকো না। এখন থেকে আমাকে দাদা বলে ডেকো আমারও নাম অনীক রায়।

  প্রবন্ধ



অবিরল অন্ধকারে তিনি আলো,
    অসুন্দরের মাঝে সুন্দর

 রবীন বসু

চারপাশের এই অবিরল অন্ধকারে, এই অসুন্দরের বর্ণাঢ্য পরিবেশনের মাঝেই তিনি আছেন l সীমাহীন লাঞ্ছনা আর আত্মপ্রবঞ্চনার এই মহাদেশে তিনিই বোধহয় শেষ বিবেক l  শেষ বাতিস্তম্ভ l  আমাদের চৈতন্য টনিক l

তুমি রবে নীরবে”, নিভৃতেই তিনি আছেন,আমাদের
হৃদয়ের গভীর-গোপনে l আমাদের ভালোবাসায়, বিচ্ছেদে, মরণে সহমরণে l আমাদের নিত্য দিনের নিঃশ্বাসে তিনিই ফ্রেশ ক্লোজআপ l আনন্দ বিষাদ ক্রোধ আর হোককলরবে তিনি প্রবল ভাবে বিরাজ করেন l তিনি তরুণের তারুণ্য l বয়স্কের আশ্রয় l আর সর্বহারার নির্ভরতা l

যদি তিনি না থাকতেন কি হত আমাদের? প্রেমিকের
চিঠি (মেসেজ) লেখা হত না l  প্রেমিকা মাথায় ফুল দিয়ে অপাঙ্গে তাকাত না l পাড়ায় পাড়ায় নাচ আর গানের স্কুল থাকত না l ছেলের জন্য কনে দেখতে গিয়ে কোন বৃদ্ধ বলত না, একটা রবিঠাকুরের গান গাইবে, মা l ভগ্নহৃদয় আশার আলো দেখতে পেত না l প্রতিবাদী যুবক আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে  একলা হাঁটত না l একটা জাতির সংস্কৃতি কী তা আমরা জানতাম না l একটা বই (শেষের কবিতা)  যদি না থকত, সব প্রেম, সব যুবক-যুবতী কেমন কানা হয়ে যেত l আমরা এক অপ্রেম পৃথিবীতে অনিঃশেষ অন্ধকারে ডুবে যেতাম l

মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে হিংসা যত বেড়েছে, ব্যক্তির মানসিক শান্তি আর আশ্বাস তত কমেছে l অশান্ত সেই মনে শান্তির বারি বর্ষণ করে তিনি আনলেন নোবেল l আমাদের গর্ব, পরাধীন দেশের স্পর্ধা l আন্তর্জাতিক রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনেছি তাঁর ইউরোপ ভ্রমণে, তাঁর আন্তর্জাতিকতা বাদে l

তবুও তিনি গুরু নন, কবি নন l তিনি সখা, বন্ধু ও প্রিয়জন l যিনি সব সুখে আছেন, দুঃখে আছেন l হাসিতে ও কান্নায় আছেন l প্রতিবাদ বিদ্রোহ ও সমর্পণে আছেন l তিনি জড়িয়ে সাময়িক ঘটনায়, দূরবর্তী ভবিষ্যতের দিগ নির্দেশে l

শুরু করেছিলাম যে অন্ধকার দিয়ে, তিনি সেই অন্ধকারে ভীষণভাবে আলো জ্বালেন l তাঁর জীবনবেদ ছিল উপনিষদ l যে উপনিষদ জীবনকে আর মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় l

আমাদের চারপাশে এখন শুধুই হিংসা, নির্যাতন, ধর্মীয় উন্মাদনা আর ভয় l দমবন্ধ করা সেই ত্রাস থেকে বেরিয়ে আসা, ভয়কে জয় করার মন্ত্র তিনি আমাদের শিখিয়েছেন l সেই মন্ত্র আমরা কবি বুদ্ধদেব বসুর “রবীন্দ্রনাথের প্রতি” কবিতায়ও পাই l

..….এত দুঃখ, এ দুঃসহ ঘৃণা—
এ নরক সহিতে কি পারিতাম, হে বন্ধু, যদি না
লিপ্ত হ’তো রক্তে মোর, বিদ্ধ  হ’তো গূঢ় মর্মমূলে
তোমার অক্ষয় মন্ত্র l  অন্তরে লভেছি তব বাণী
তাই তো মানি না ভয়, জীবনেরই জয় হবে জানি l

 তোমার আকাশ তোমার বাতাস

    
কেকা  সেন

সেই যে ছোট্ট বালক, ইস্কুলের চার দেওয়াল যার কাছে জেলখানার মত ছিল, যার শুধু মুক্ত মনে আকাশের নীচে হাওয়ার নেশায় খুশীর পাল তুলে ছুটে বেড়ানোই সবথেকে পছন্দের ছিল, সেই ছোট্ট বালক যে, বাড়ির তথা বঙ্গের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে সকলের মন জয় করে নেবে, এমন কথা সেই উনিশ শতকে তাঁর পরিবারের কেউ কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন?
               ইং- মে,( ২৫শে বৈশাখ) ১৮৬১ সাল। প্রেক্ষাপট কলিকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ি। প্রচন্ড খরতাপের মধ্যে এক মহান মানবের জন্ম, যিনি পরবর্তী কালে তাঁর কাব্যরস আর শৈল্পিক বারিধারায় বাঙালি তথা বিশ্বের মন শীতলতায় ভরে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক,প্রাবন্ধিক, শিল্পী, দার্শনিক ইত্যাদির পাশাপাশি একজন সমাজকর্মীও ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর বাড়ির পরিবেশেই পেয়ে এসেছেন শৈল্পিক চেতনার ভাবধারা। পেয়ে এসেছেন তাঁর গুনী দাদাদের স্নেহের সান্নিধ্য। তাঁদের মধ্যে তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। জ্যোতিদাদার স্ত্রী, সমবয়সী নতুন বৌঠান ছিলেন রবি ঠাকুরের কবি চেতনার অন্য এক প্রাণ প্রতিষ্ঠাত্রী। এইসময় কবি মৈথিলী ভাষায় বিদ্যাপতির ভাবানুসারে, ভানুসিংহ ছদ্মনামে রচনা করেন পদাবলী যা আজও আমাদের কাছে সমানভাবে সমাদৃত। তেমনিভাবে আরও একজন কবিকে সমানভাবে অনুপ্রানিত করেছিলেন, তিনি হলেন অক্ষয় চৌধুরী, কবির ' অক্ষয় বাবু। '
                  ছোটবেলায় বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে রবীন্দ্রনাথ, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন,পরবর্তীকালেও তাঁকে পারিবারিক এস্টেটের কাজে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তে যেতে হয়েছে। তারফলে তিনি পল্লীজীবন তথা মানুষের জীবনধারাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর প্রতিটা সৃষ্টিতেই আছে জীবনকে নব নব রূপে উপলব্ধি করার আর্তি। তাঁর নিজের ভাষায় বলতে গেলে---- ' জীবনকে এড়িয়ে গেলে চলে না, পেরিয়ে যেতে হয়।'
           রবি ঠাকুরের প্রথম কবিতায় হাতেখড়ি তাঁর বছর বয়সে। তারপর একে একে সৃষ্টি করে গেছেন কাব্যের রূপলেখা। কখনো তিনি তাঁর রূপকধর্মী কবিতায় রূপজগতের বর্ণনার মধ্য দিয়ে ক্রমশ সত্যোপলব্ধি ঘটান, আবার কখনো তিনি কাব্যের মধ্যে ঘটান মুক্তক ছন্দোমুক্তি।কবির শিশু ভোলানাথ যেমন এক্কেবারে কৈশোরের অলীক স্বপ্নগুলোকে মুক্তোর মত এক সুঁতোয় গাঁথে, তেমনি গদ্যছন্দের কবিতাগুলি ভাষায় প্রকাশরীতিতে ' পদ্যের বিশেষ ভাষারীতি ' ত্যাগ করে বাস্তব চরিত্র চিত্রায়ন ঘটায়।
            ধীরে ধীরে এগোতে থাকে তাঁর প্রতিভার নৌকাখানি। তারপর আসে সেই শুভক্ষন,১৯১৩ সাল, ' গীতাঞ্জলী ' হাত ধরে নোবেল প্রাপ্তি আর বিশ্বজয়ের স্বীকৃতি। বিশ্বকবির ক্রমান্বয়ে ' কবিগুরু' হয়ে ওঠা।
                  কবি তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় ,২৩০টা গান রচনা করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই নাচ, গান, নাটকের পরিবেশে বড় হওয়া কবি গান,অনুভূতি আর নাচের সংমিশ্রনে এক নতুন ধরনের ভাবনার সৃষ্টি করেছিলেন যা রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য রূপে প্রসিদ্ধ।  জীবনের সায়াহ্নে এসে, প্রায় ৬০ বছর বয়সে তিনি রঙ আর তুলিতেও নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আর্টিস্টিক স্টাইল তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। কবি কখনো কখনো ম্যানুস্ক্রিপ্টেও আর্টিস্টিক স্টাইল ব্যবহার করতেন।
                    ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর যথাসর্বস্ব দিয়েই শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর সাধের আশ্রমটি। প্রথম অবস্থায় একটি প্রেয়ার হল, একটি স্কুল আর লাইব্রেরী নিয়ে, গাছপালা দিয়ে ঘেরা সুন্দর একটি মুক্ত পরিবেশে শুরু হয় ' শান্তিনিকেতন আশ্রম ' এর পথ চলা। এই আশ্রমের ক্রমবর্ধমান এগিয়ে চলার পিছনে কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠা বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে।প্রতিটি দরিদ্র গ্রামীন শিশু জীবনকে সঠিক পথে গড়ে তোলার যে ব্রত কবি সেদিন নিয়েছিলেন তা তাঁর সমাজ সংস্কারক মনেরই পরিচায়ক ছিল। পরাধীন দেশের দৈন্য দশা তাঁর কবি মনকে বিক্ষুব্ধ করত। পরাধীন দুর্বল দেশের মানুষকে তিনি তাঁর রচনার মাধ্যমে শৃঙ্খলা মোচনের লড়াই উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে কবি যেমন প্রত্যক্ষভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন বিভিন্ন স্বদেশমূলক গানের মাধ্যমে, তেমনি তিনি ব্রিটিশ কুশাসনের বিরুদ্ধে ' জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘটন ' তীব্র প্রতিবাদে ব্রিটিশদের দেওয়া ' নাইটহুড ' উপাধি ফেরত দিয়েছিলেন। সমাজে দলিতদের অধিকারেও তিনি যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন।
                   জীবনের অন্তিম লগ্নে কবি বারবার মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে কাছ থেকে উপলব্ধি করে গেছেন। জীবন দার্শনিক এইসময় শুধু সত্যকে অনুসন্ধান করে গেছেন ঈশ্বর চেতনের মধ্য দিয়ে আর মুক্তির দুয়ারে অনবরত রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টির সুগন্ধ। কবির ভাষায় বলে যাই---
   ' স্বরূপ তাঁর কে জানে, তিনি অনন্ত মঙ্গল--
    
অযূত জগত মগন সেই মহাসমুদ্রে।।
     
তিনি নিজ অনুপম মহিমামাঝে নিলীন--
     
সন্ধান তাঁর কে করে, নিষ্ফল বেদ বেদান্ত।
     
পরব্রক্ষ্ম, পরিপূর্ণ, অতি মহান--
     
তিনি আদিকারণ, তিনি বর্ণন-অতীত।। '
 


 কবিতা

রবিঠাকুর
সুশান্ত ভট্টাচার্য
রাজহাঁসের গলা মুচড়ে তুমি বোঝালে
দেশটা কর্ষনের।
পাতার ফাঁকে বনজ্যোৎস্না
সান্ধ্য পিয়ানো বাজে
বোতলবন্দী অসুখজল।
এই তো ঘাম দিয়ে জ্বর সেরে গেল
ওই তো পলাশগুচ্ছ বাতিল ফ্লাইট
নীল সাদা শাড়ি আমার অশ্রুর চেয়ে
ঝাপসা হয়ে এলে গীতবিতানের পৃষ্ঠা ওড়ে
পাখা ঘোরে পাখার নিয়মে।
আকাশ কে ফুটনোট পাঠাই চেনো নাকি? চেনো
আমার বুকের ঘরে কোনো কার্নিশ নেই , চিলেকোঠাও।
বস্তুত ফোটার আগেই কিছু স্থবিরতা
দৃষ্টি হীন ভেজা ভেজা বালির উল্লাস
কথা হাটে কথা পাশ ফিরে শোয়
রোজ মৃত তারাটির খোঁজে মা পাখিটি।
দেশটা কর্ষনের, মৃত ফসলের খোলাবুক
জন গন মন ধর্মের গিট ছিঁড়ে এতো শিশির
মেখেছে মেঘপাতা-এতো চন্দন
কেন বিমুর্ত বাঁশের বাঁশিটি
পাড়ার জলসায় ফটোহীন খরতোয়া
চারপাশে দুর্বোধ্য ভ্রমর । কলকাতা খেয়ে নিচ্ছে
অকৃপণ কুষ্ঠের বাতাস আর ভুতুরে প্রশ্রয় ঠেলে
একটা টিকটিকি চৌকাঠ ডিঙোচ্ছে।
দেশটা কর্ষনের।
এখানে আকুতির মতো নদী
পোড়া বোশেখেও মজে ওঠে।
ভিড়ে ঠাসা ট্রাম বাস কোথাও পূর্ণগ্রাস
অসুখ বাতাস নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
অশ্রুর চাঁদ ঠিক কোনদিকে ওঠে?
দু একটি কক্ষচ্যুত তারার নির্মাণ
কেন সমর্পণের দিকে যায়
পৃথিবীর তিনভাগ জলস্তর
সব তোমার।
যে নৌকোয় তুমি পা রাখলে
নৌকোটি পাথরের।

দু:স্বপ্ন
বৈজয়ন্ত রাহা

তুমি জড়াচ্ছো সে জড়াচ্ছে
কেউ দেখছে না, জল ঘুমোচ্ছে,
                 শুধু নদী দূরে পাশটি ফিরে..

কে হও তোমরা -- পাড়া প্রতিবেশী?
নাকি সহোদর ভাই ও বোনটি...

চাঁদ পুড়ে খাক,  মেঘ পুড়ে যাক
কেউ দেখছে না,  গাছ ঘুমোচ্ছে, 
                 কেবল ছায়াটি হাড় জিরজিরে..

কে হও তোমরা জানলা-বৌদি...
 ভাটি-গাঙ ফেরা নদী ও নাবিক?

তুমি দেখে যাও, সেও দেখে যাক,
দৃষ্টির বিষ ভিতরে ফুরাক, 
                  রোদ খসা ধান ফসলের ভীড়ে..

যে হও তোমরা অনাদির আদি
জড়িয়ে ধরছো বাদী ও বিবাদি

নৌকো পুড়ছে  স্রোতও পুড়ছে
গ্রাম অগ্রামে খবর উড়ছে

                   ঘুম ভাঙ্গছে না, শূন্য এ নীড়ে...

 রবি
আর্যতীর্থ

আমার আকাশে রাত্রি নামেনা, নিয়ত জ্বলেন রবি,
বাতিদান আর মোমবাতি কিছু এখনও লাগেনা তাই,
আমার পৃথিবী আলোচান করে সাজে চিরউৎসবী,
ঘর থেকে শুধু দুই পা বেরোলে ঝিকিমিকি রোশনাই।

রবির কিরণ এতটা কোমল, ঢাকে না অন্য তারা,
বরঞ্চ দ্যুতি আরও বেড়ে যায়, রবির স্পর্শে এসে,
ঘরের ভেতর নকল আঁধারে মন হলে দিশেহারা,
উঁকি মেরে দেখি আঙিনা কেমন আলোতে গিয়েছে ভেসে।

কখনো আকাশে মেঘ ধমকালে ভয়াল বাজের ডাকে,
ঝড়ের দাপটে কুঁকড়িয়ে বাঁচি ,সাহসের ঝুলি ফাঁকা,
মেঘকালো চিরে রবিকর আনে প্রায়মৃত ভরসাকে,
কানে কানে বলে কাটবে আঁধার, বন্ধ কোরোনা পাখা।

স্খলিত জীবনে যদি নেমে আসে চকিত অকালসন্ধ্যা,
বন্ধু চিনতে ভুল হয়ে বুঝি জীবন থমকে দাঁড়াবে,
এতদিনকার উর্বরা মাটি কপালের ফেরে বন্ধ্যা,
একলা চলার ডাক দিয়ে রবি তখন জীবনে ফেরাবে।


ছদ্মনাম
বিশ্বজিৎ মাইতি

তোমাকে যদি গভীর সমুদ্র রঙের একটা সকাল পাঠাই,
একেবারে অচেনা ছদ্মনামে,
মেঘ সরিয়ে উড়ে যাচ্ছে সোনালি ডানার চিল-
যেন বহু বছর পর,
জলের পালক
ঘাসফড়িং।
রোদের উঠোনে শালপাতায় রাখা
কুড়চি ফুলের মালা
ধবধবে সাদা,
নদীর আঁশটে গন্ধ
বাঁশের সাঁকো,
বিচ্ছিরি দাঁড়কাক।
তবুও কি তুমি বাহানা করে
কদম রঙের শাড়িখানায়
বারান্দায় এসে
শুকিয়ে নেবে ভেজাচুল,
এড়িয়ে যাবে,
ওঘরে বাজতে থাকা একঘেঁয়ে টেলিফোন,
জলের কল
অপেক্ষার আঁচে পুড়তে থাকা প্রগাঢ় অভিমান,
শোবার ঘর
ফটোফ্রেম
স্কুলের টিফিন।
তোমাকে যদি গভীর সমুদ্র রঙের একটা সকাল পাঠাই
একেবারে অচেনা ছদ্মনামে,
দেরাজ খুলে তুমি কি হাতড়াবে,
আমার চোখ মুখ
নাকের গড়ন?

ডেকেছিলে, তাই গেছি
পিনাকী দত্তগুপ্ত 
তুমি ডেকেছিলে বলেই গেছিহয়ত এটাই শেষ
যদি না ডাকতে, যেতাম না নিশ্চই
তুমি হয়ত ডাকতেও চাওনিতবুও, ডেকেছো
কারণ, আমি চেয়েছিলাম একটা ডাক আসুক

ট্রেনটা এগিয়ে চলেছে পরবর্তী স্টেশনের দিকে
জানলা দিয়ে ঢুকছে শীতের বাতাস
হকারদের আহ্বা, যাত্রীর গুঞ্জন, ইঞ্জিনের শব্দ,
এমনকি এই যে ফিরে আসা, ভীষণ নির্লিপ্ত লাগে

ভাবছি যারা ডাক পায়নি কিংবা পারেনি ডাক দিতে
তারাও কি এই একই ট্রেনে আছে?
তারাও কি বুঁদ হয়ে বসে আছে অবসন্ন সন্ধ্যা-যাপনে?
নাকি আমার দিকে আঙুল তুলে বলছে বিশ্বাসঘাতক’!


শতভিষা-
সর্ভানু দাশগুপ্ত

সমস্ত অস্ত্র ও ঘোড়া বাজেয়াপ্ত হয়ে গেলে
হাঁটু মুড়ে বসেছিল এক মিরাস যুবক,
কয়েকশো মাইল দূরে কেঁদে ফেলেছিল পশুপালক
হে আওরঙ্গজেব,
আমার ভালোবাসা উল্মুক ছিল
হে অমলিন ইশ্বর
আমার ঘৃণা ছিল একেশ্বরবাদী
সাম্রাজ্যের পাথর আমার -
পরজন্মে বিশ্বাসী নয়...তবুও
নগ্ন কিন্তু উলঙ্গ নয় এমন পুঁথির পাতা
খসে পড়ল সত্যাচার্যের হাত থেকে,
যেন এক প্রাচীন শীতকালের বিকেল
মৃত পিয়ানোবাদক-এর আঙুলে ও শরীরে
ফেলে দিল চন্দ্রনিবাসের ছায়া...

বেলাশেষের কবিতাবিতান
জ্যোতির্ময় মুখার্জী

তখন বিকেল। আলো নিভুনিভু। দীর্ঘতম পথ শেষে। দুই পৃথিবী। কাছাকাছি। পাশাপাশি। ঘেঁসাঘেঁসি…..

এক পৃথিবী এঁকে চলেছে। বাতাসের কানে কানে কিছু কবিতা। অপরপারে মুগ্ধ শ্রোতা। হয়তো আমগাছটাও। বা ডালিয়া। চন্দ্রমল্লিকা। ঘাসফুল পেরিয়ে। ছোট্ট সাঁকোর নীচে। কালচে ঘোলা জলে। মিহি মিহি রঙে মিশে যাচ্ছিল আমাদের কানাকানি। বা হয়তো গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ঝাউগাছটাও কান উঁচিয়ে শুনেছিল আমাদের ফিসফিস। বা হয়তো বিরক্ত হয়েছিল সে। হয়তো বা রাগে গজর গজর। দূর শ্লাআআআ….ভাল্লাগে না। কোথায় এবার গুডিগুডি রাত-ঘুমের তোড়জোড়। না, দুটো মানুষের ছা। কানের কাছে ঘ‍্যাঙর ঘ‍্যাঙ্

ঠিক তখনই। উড়ে যাওয়া একটা পাখি। ও কি ঘাড় ঘুরিয়েছিল ? জানিনা ঠিক। হয়তো কান পেতেছিল। বা হয়তো অপাংক্তেয় মানব শিশু ভেবে। অবহেলায়। মুখ ফিরিয়ে। আরো অনেক দূরে। বেলাশেষে। পালকের ওম্

আচ্ছা, ওটা কী পাখি ছিল? কাক? না চড়ুই?
না কাকই হবে? একটা কালো রেখা
ওটা কি চড়ুই ছিলনা? কেন?

মুহূর্তে সরে সরে। চোখের সামনে। ও পিছনে। অসংখ্য ছবি। দুটো পা। একটা ঠোঁট। পালক। কালো কালো

কাআআআআ…...কাআআআআ…..
একটা কালো রেখা….

এভাবেই প্রশ্নের জাল বোনা। মা প্রশ্ন। ছেলে প্রশ্ন। নাতি প্রশ্ন। জ‍্যেঠু প্রশ্ন। কাকা-কাকীমা-পিসি-পিসেমশাই। আরো কতো কী। প্রশ্ন ভেঙে ভেঙে। প্রশ্নের জালে জড়িয়ে নিয়েছিলাম আমাদের। উত্তর খোঁজার দায় তো ছিলনা। বা হয়তো। প্রশ্নের নাতি পুতিরাই। জানিয়েছিল আমাদের। হাই বস্। থ‍্যাঙ্কু

ঘরটায় একটা আলো ছিল। নীল কি? না, না সবুজ। একটা হালকা সবুজ আলো। বাআআআ...হয়তো আমাদের ভিতরেও। অযাচিত বকবকবকবকমবকম্। মাথা গলিয়ে উনিশ ও একুশ। এবং একটি বোকা বাক্স। ফ্রেঞ্চ কাটে ইস্মার্ট বিগ বি। কাকাকা...জজজললল। কভি খুশি কভি গম্

আমাদের পিছনে একটা লেডিস টয়লেট। তবে, লেডিস ছিল না মোটেই। বা হয়তো ছিল। হয়তো আমাদের আকাঙ্ক্ষায় সারি সারি মেয়েরা এসেছে আর চলে গেছে। মৃদু হেসে। চোখে চোখ রেখে। না থাকা মেয়েতে পূর্ণ। মুগ্ধ। লেডিস টয়লেটকে পিছনে রেখে দেখলাম। কীভাবে একটা টিকটিকি পড়লো। এবং এক ভয়ঙ্কর বিষ্ফোরণ। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকলো কালো কালো শব্দরা। হয়তো ওরা আলো এঁকেছিল বা কালো। ঠিক জানিনা। ঠিক জানিনা কীভাবে ফেলে যাওয়া দাসখত পুরিয়ে। লেখা হয়েছিল একরাশ কবিতা

এভাবেই আলো নিভে এসেছিল। এভাবেই ধীরপায়ে হেঁটে এসেছিল। গর্ভবতী সাঁঝ। নিকোটিন প্রেম শেষে। ফিরে এসেছিলাম আমরাও। আকাশের বুক থেকেও নেমে এসেছিল তারারা। বড্ডো কাছাকাছি। আবছায়া কুয়াশারর মতো। জড়িয়ে-ভরিয়ে আমাদের বেলাশেষের কবিতাবিতান




মকরক্রান্তি বিপ্লব                                    
সৌরভ বর্ধন

" I know we shall never meet."

আমি শতাব্দীকাল মাটি খুঁজিতেছি স্তনের নীচে
কলাকার বাষ্প রঙের বাতি নিভুনিভু আলাপন
চার প্রকোষ্ঠের পৃথিবী স্পন্দিত আদম চেতনায়
ঠোঁট-লেপনের কারসাজি ছুঁয়ে দ্যাখে নীল ফুল
তার দ্বিতীয় চোখের কাঁপা কাঁপা স্বেদ অবিকল
নিভিয়ে রাখে নরম হলুদ মাছের কঙ্কালসার মেঘ
ঝুঁকে আসে ঝাউফল উলোটপালোট ঊর্ণাময়
কবরের হ্যারিকেন গুল্মআশায় ভোর সমাপন

(
বাইরে ঘোর কুয়াশা। ভিতরে উদ্বিগ্ন যাত্রীদের ভিড়।)

উড়ে চলে আবলুস রঙা অন্তর্জাল গহীন স্পর্ধায়
উইলো কাঠের বনে আদর্শ গ্যাসের পাখায় কতক
ডায়াফ্রাম ঝুলিয়ে দাও - ধিকিধিকি জ্বলুক সারা-রাত

ক্ষমা করো
মতিউল ইসলাম
গীতাঞ্জলি হাতে থমকে দাড়িয়েছি
হে রবীন্দ্রনাথ, তোমার সামনে,
আজ এই বৈশাখের প্রভাতে,
চৌদ্দশো পঁচিশে পড়ছি বসে
তোমার কবিতা খানি.
জান কবি গ্রাম ছাড়া রাঙামাটি নয়
আমার বিষন্ন করে রক্তঝড়া ভূমি.
আমার হৃদয়ের  রক্তে রক্তিম তোমার
গীতাঞ্জলি.
বৈশাখের প্রভাতে কোথায় ও নেই
বিদুষক,
চারিদিকে রাজার সৈন্য শিক্ষা দেয়,
শেয়াল কুকুর ও ভীত
তাদের কন্ঠরোধ হয়েছে
মন্ত্রীর লালচক্ষুতে.
ফটিক ছুটি পেয়েছিল শেষ পর্যন্ত,
এক আকাশ বিষন্নতা নিয়ে
আমি ছুটি খুজি ডাকঘরে.
পহেলা বৈশাখের সকালে গীতাঞ্জলি
হাতে বেরিয়ে পড়েছি চিঠির খোঁজে,
নন্দিনী কে ওরা তুলে নিয়ে গেছে,
আমার ক্ষমা কর কবি,
আমি রঞ্জন হতে পারবো না,
শুধু চিঠির প্রতিক্ষা করি
অমলের মতো.
পাগলা মেহের আলীর মতো
স্পর্ধা নিয়ে উচ্চারণ করতে পারলাম না
সব ঝুট হ্যায়.
ক্ষমা করো হে বৈশাখ, হে রবীন্দ্রনাথ...

পৌঁছাতে পারিনি
প্রত্যূষ কর্মকার

তোমার সঙ্গে দেখা হলে কি বলবো তোমায়?
আমার হাতে আর কোনো বিকেল লেখা নেই?
অন্ধকার শব্দের গভীর থেকে উঠে আসে আর্তনাদের তীর?
মধ্যরাতের কিনারা জুড়ে দীর্ঘ গাছের ছায়া নেমে আসে
আমি দু হাতের নিঃস্বতা মুঠো করে নৌকোর খোলের মধ্যে ডুবে থাকি
তোমাকে কি বলবো ভেবে মাঝনদীতে ঝড়ের মুখে গান গাই
এমনকি আমি বিছানায় পাশ ফিরে শুতে ভুলে যাই
আমার দেওয়ালে অজস্র ফলার মত রাত্রের স্ট্রীট লাইট বিঁধে থাকে
আমি একটা একটা করে যতিচিহ্ন সরাই,কাটি মুছে দিই
অথচ রক্তবীজের মত কথামালা আমার সিলিং বাইতে থাকে
প্রতিটি অক্ষর থেকে রক্তবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ে পালকে,
আমি কি কথা বলবো বলো,পাশাপাশি বা মুখোমুখি,
আমি তো পাহাড় টপকে নবীন মেঘের কাছে পৌঁছতে পারিনি

নভেম্বরের বাগানে
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

তখন নভেম্বর  মাস
দ্বিধাহীন রোদ ঝিকিয়ে উঠছিল কলকাতার রাস্তায়
বোটানিক্যাল গার্ডেনে নদীর বুকে আঙুল ডুবিয়ে
আধশোয়া হয়ে ছিল একটি গাছ
আহ্লাদী জল  স্টিমারের গা ঘেঁষে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছিল
প্রৌঢ় পাতার ফাঁক দিয়ে  নেমে আসছিল   আলোছায়ার  চৌখুপি
বাসা বাঁধছিল ইন্দ্রাণীর গালে
মনে আছে
পুলক যে গানটা গেয়েছিল
তার সুর বিবাগী হয়ে ভেসে গিয়েছিল নৌকার সাথে
মানসের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি জোড়বদ্ধ হয়ে বসেছিল পান্থপাদপের পায়ের কাছে
নির্বিরোধী পায়রার মতো  খুঁটে নিচ্ছিল টুকরোটাকরা কথা
কিছুকিছু  স্বরক্ষেপ উড়তে উড়তে গিয়ে জমা হচ্ছিল ইথারে
আমরা হেঁটে বেড়িয়েছিলাম বাগান জুড়ে
আমাদের হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল গোলাপ থেকে জারবেরায়
গাঁদা থেকে গ্লাডিওলাসে
অমর বটের নীচে ছিটকে গেছিল তোমার এইচ এম টি ঘড়ি
হয়তো বুঝে ফেলেছিল নিজের ধৃষ্টতা
তোমার মনে পড়বে কিনা জানি না
সেদিন সন্ধ্যায় ধুলোমাখা শিশিরের জামা পরে
টি এস এলিয়ট এসেছিলেন
বিষণ্ণ বেঞ্চে বসে আলোচনা করেছিলেন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে