Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Saturday, 22 April 2023

দেবশ্রী মজুমদারের গল্প

 




অপ্রয়োজনীয় 

 নীল রঙের চেক লুঙ্গিটায় পাক দিয়ে পেটের কাছে গুঁজতে গুঁজতে সাত পাঁচ ভাবছিলেন চিন্ময়বাবু । এই বাড়িটাতেই কেটে গেছে জীবনের বেশিরভাগ সময় ।  এক সময় বৌ, দুই মেয়ে, মা সবাইকে নিয়ে  একসাথেই কাটাতেন এখানে । অভাব, কম অভাব, বেশি অভাব – সব রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত সংসারের মতই সাদামাটা জীবন ছিল তাদের । একটা ধরা বাঁধা চাকরির শখ থাকলেও অকালে বাবা চলে যাওয়ায় বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারেননি তিনি । অগত্যা সেজ কাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া একটা চায়ের দোকানের মালিক হয়েই সারাটা জীবন বেশ কাটিয়ে দিয়েছেন । সকাল বিকালে জমজমাট আড্ডা বসত তার দোকানে ।  অনেকসময়ই লোকজনের গল্প গুজবে কানে তালা লেগে যেত তার । কারো কারো গল্প শুনতে ভারি মজাও লাগত ।  একবার পাড়ার বৃদ্ধ সনাতন বাবুর একটা কথা এখনও খুব মনে পড়ে ।  ভোজনরসিক বুড়োকে একবার তিনি ডাবল ডিমের মামলেট করে দিয়েছিলেন ।  অন্যমনস্কতায় নুনের পরিমাণটা খানিক বেশি হয়ে গেছিল । মুখে দিয়েই সনাতন বুড়োর চক্ষু চড়ক গাছ । সেদিন তৎক্ষণাৎ তিনি বলে ওঠেন, “ওহে চিনু, তোমার থেকে বয়সে আমি অনেক বড়, তাই একটা উপদেশ দিই, ভালো করে শুনে রাখ ভায়া, সারা জীবন তা মেনে চলার চেষ্টা কোরো । প্রয়োজনের থেকে কোন কিছুই বেশি দিতে নেই, যদি দাও, তাহলে তা বিস্বাদ হয়ে যায় । কথাটা মনে রেখো । ”

          সেই সময় কথাটার পুরো মানে তিনি বোঝেননি । বুঝেছেন অনেক পরে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে । যাক গে, এসব ভেবে এখন আর কাজ কি ! দুপুরে খাবার পর চিন্ময়বাবুর কোনদিনও ঘুম আসে না ।    তার এই একার জীবনে পুরনো স্মৃতি হাতড়ে যা একটু সময় কাটে । এই করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে আসে । 

 দিনের অনেকটা সময়ই এভাবে কেটে গেল । এবার তাহলে একটু লিকার চা করে খাওয়া যাক । ঢিলে হয়ে যাওয়া লুঙ্গিটা আবার একটু প্যাঁচ দিয়ে ঠিক করতে যাবেন, ঠিক তখনই দরজায় কে যেন একটা আলতো টোকা দিল । এ সময় কে আবার এলো রে বাবা ! বড় মেয়ে তো মালদায় থাকে। তার আসার প্রশ্নই নেই । আর ছোট মেয়ে পাশের পাড়াতে থাকলেও ও সবসময় দিনের বেলাতে এসে ঘণ্টা খানেক থেকেই বিদায় নেয় ।  এসব  ভাবতে ভাবতে চিন্ময়বাবু দরজাটা খুললেন ।  খুলে তো অবাক হয়ে গেলেন । “আরে হরি, তুই অ্যাদ্দিন বাদে ! আরে আয় আয় , ভেতরে ঐ চটি পরেই চলে আয় । ” তাড়াতাড়ি করে একটা স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার পেতে হরিকে বসতে দিলেন ।




- “আসলে এদিক দিয়ে ভাইপোর বাড়ি যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোর সাথে একবার দেখা করে যাই । কি খবর বল তোর ? আছিস কেমন ? ”

হরি চিন্ময়ের অনেক পুরনো বন্ধু । তার চায়ের দোকানে আগাগোড়া সে হরির কাছ থেকেই নেতাজী বেকারির কেক, বিস্কুট , পাউরুটি নিত । শীত, বর্ষা, গরম -যাই হোক না কেন রোজ সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে পৌনে সাতটায় ও ঠিক চলে আসত । তারপর  চা খেয়ে চটজলদি একটু গল্প সেরে আবার বেকারির ভ্যান চালিয়ে চলে যেত অন্য পাড়ায় । 

-“কি রে কি এত ভাবছিস ? তোর মেয়েদের খবর কি ? দাদুভাই, দিদিভাইরা কেমন আছে ? ”

-“কিছুই তেমন ভাবছি না রে ।  তুই বরং বল, তোর সেই নেতাজী বেকারির মালিক, কি যেন লোকটার নাম ? তার কি খবর ? ”

-“আর বলিস না, সে তো কবেই ঐ বেকারি বিক্রি করে দিয়ে দেশে চলে গেছে । তারপর আর খোঁজ রাখি না ।  শোন এবার উঠি তাহলে, ভাইপোর সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরতে হবে । এখন আর অন্ধকারে তেমন ঠাহর করতে পারি না । তুই একবার আসিস আমার বাড়ি । মিনিট দশেকের তো হাঁটা পথ । ”

                 দিন তিনেক পরে চিন্ময়বাবুর কুমড়োশাক খাওয়ার ইচ্ছে হল । ভাবলেন সকাল সকাল বাজারে গিয়ে একবার দেখা যাক , যদি মনমতো টাটকা শাক একটু পাওয়া যায় । ছোট একটা বাজারের থলি হাতে অশক্ত শরীরে বাড়ি থেকে বেরোলেন । আজকাল আর আগের মতো রোজ বেরোতে পারেন না । একটু হাঁটার পরই গলির মুখে দেখা হয়ে গেল হরির ছোট ছেলের সাথে । দেখামাত্র সাইকেল থেকে নেমে পড়ল ও । কি যেন ওর নামটা ? অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই মনে পড়ল না । হরি অনেকসময় ছুটির দিনে ওকে নিয়ে আসত তার চায়ের দোকানে । ডিমের পোচ খেতে ভারি ভালবাসত ছেলেটা । 

                                             ছেলেটা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল । বলল, “ কাকা একটা খবর আপনাকে জানানো হয়নি । আপনার বাড়ি ক’দিনের মধ্যেই যেতাম । আসলে আপনার শুনলে খুব খারাপ লাগবে । আজ দশদিন হল, বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । প্রায় একমাস বিছানায় পড়ে ছিলেন । ওই ওখানেই পেচ্ছাপ, পায়খানা সবই করতেন । আসলে বাবা বলে বলতে খুব খারাপ লাগছে । ওভাবে বেঁচে থাকা, চোখে দেখা যায় না । একদিকে ভালোই হয়েছে । ”

                                              চিন্ময় বাবুর মাথার ভেতরটা তোলপাড় করতে লাগল । অনেক কথা একসাথে বলতে চাইলেন । তাহলে গত পরশু নাকি তার আগের দিন হরি যে এল, গল্প গাছা করল । কিন্তু ওর ছেলে একি কথা বলছে ! সবকিছুই কেমন তালগোল  পেকে যাচ্ছে । একটা শব্দও তার মুখ থেকে বেরোল না । ছেলেটা আরও কত কি বলে চলল কিছুক্ষণ । সে সবের বিন্দু বিসর্গও তার কানে ঢুকল না । ওখানেই আরও কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি । কি যেন একটা কেনার জন্য বেরিয়েছিলেন , তাও মনে করতে পারলেন না । বাজারের থলিটাকে কোনভাবে খামচে ধরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন । হরিকে বসবার জন্য একটা স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার বার করে দিয়েছিলেন । বাড়ি পৌঁছে ওটা এখনও ওখানেই আছে কিনা তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন তিনি । 

                                                     ________________

Saturday, 18 March 2023

শ্রীদাম বায়েনের গল্প

 




লুকোচুরি

 

( সুন্দরবনের ভাষায় সুন্দরবনের গল্প)


রাখাল,

 নৌকা ঘোরা শীগগির…

 বলেই রাধাখুড়ো তাড়াতাড়ি জল থেকে জালের শেষ প্রান্তটা হিঁচড়ে নৌকায় তুলে নিল| 

আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা| চারিদিক যেন ধীরে গিলে ফেলছে কামটের মতো|


 খুড়োর হাঁকে রাখাল চমকে গিয়ে তড়িঘড়ি  নৌকার হালটা হাতে নেয়… 

কী যেন ভাবতে ভাবতে বলে…

 "খুড়ো, আরেট্টু দেরি কুরে গেলি হুতো না? মাছ তো ভালুই পুড়তোলো…"

 খুড়ো রাখালের কথাটা কানে শুনল বটে, কিন্তু তাকিয়ে রইল আকাশের পানে… তারপর বলল, "গতিক ভালো ঠিকতেছে না রে… সেবারো ধনাটাকে রাখে গেলাম এরাম লোভে পুড়ে রে… " 

বলতে বলতে খুড়োর গলা ভারি হয়ে উঠলো…… 


ধনা আসলে ধনঞ্জয় খুড়োর বড় ছেলে| বেশ কয়েক বছর আগে মহল করতে গিয়ে বাঘের মুখে পড়ে প্রান হারায়| সেবার ওরা বাপ-বেটা তিনজন গিয়েছিল মাছ ধরতে| 

 সুন্দরবনের  ঘন জঙ্গলের খাঁড়িতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়| তবে সেখানে মাছের পাশাপাশি ঝুঁকিও আছে তেমন| ঘন জঙ্গলের খাঁড়িগুলিতে ওত পেতে বসে থাকে সুন্দরবনের পাহারাদার দক্ষিন রায়| 




 সদ্য বিয়েতে প্রচুর খরচের পর সংসার সামলানোর জন্য বাপ-বেটা ঝুঁকির পথেই সেবার পা বাড়িয়েছিল| আসলে সুন্দরবনের মানুষের সাথে এখানকার জলের কুমীর আর জঙ্গলের বাঘের লুকোচুরি খেলা এমনি করে চলতেই থাকে| 


সেবার খুড়োদের নৌকা যখন বাড়ির ঘাটে ফেরে… তখন গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল নদীর পাড়ে| 

ছোট ছেলে পরাণ হাল ধরে কাঠের পুতুলের মতো বসে আছে, আর খুড়োর কোলে আধ-খাওয়া ধনার মুণ্ডুহীন দেহ| 

খুড়োর বুকফাটা কান্নায় সন্তান হারানোর যন্ত্রণা নিকড়ে নিকড়ে বেরোচ্ছিল… "ও ধনারে, তোর মাকে আমি কী জবাব দ্যাবো রে… 

ও বাপ, তুই একবারডা ওঠ বাপ… 

বাবা বুলে ডাক… , 

ও ধনা রে…… হা… হা… "  


সে ঘটনা রাখালেরও মনে আছে| সদ্য লায়েক হয়েছে রাখাল…  তাই কৌতূহল আটকাতে না পেরে বলল… "সেদিন কী হুয়োলো খুড়ো? এট্টুখানি বলবা?"  

বলেই রাখাল নৌকার হালে মোচড় দিয়েছে… নৌকা বাঁক নিয়ে জঙ্গলকে পিছনে ফেলে এগোতে শুরু করেছে… 

খুড়ো তখনো আকাশের দিকে চেয়ে…… ওদিকে ঘন কালো মেঘের বুক চিরে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি চলছে… 

খুড়োর চোখের জলে চিবুক চিক চিক করে উঠলো… খুড়ো বলতে শুরু করেছে…… "সেবার বোশেখ মাসে ধনাডার বে দেলাম| 

পাঁচ জনের সংসার ছ' জোন হুলো… বে তে বেশ খরচ হুয়েলো…

 বে-শাদি মিটলি, ধনা বুললো- 'বাবা, চলো নৌকা নে বার কতক জঙ্গলে যাই| আমাগো ধার-দেনা মিটে গেলি আর যাতি হবে না|'

মনডা শুনেই কু গায়্যে উটলো… তবু সংসারে যা অবস্থা, তা ভাবে রায় দেলাম| 

দু-তিন বার যাবার পর ধার-দেনা মিটে গেলো| 


ধনা বুলল- 'বাবা, এবারডা গে, আর যাবো না| এবারে যা হবে বৌডার জন্যি এট্টা গয়না দ্যাবো,

 ওরে তো বের সময়ও কিচ্চু দিতি পারিনি আমরা|' সত্যিতে বৌডাকে কিচু দিতি পারিনি ভাবে ধনার কথায় সায় দেলাম| 

সেদিন মাছ ধরা প্রায় শেষের পতে, হঠাৎ আকাশ ছায়্যে গেলো ঘন কালো মেগে…..

আমি বললাম- 'ধনা গতিক ভালো না রে বাপ| চল যা হুয়েচে, তা নে রওনা দেই…'

 ধনা বুলল, 'বাবা, আরেট্টু থাকে যাই, জালডা সবে দিচি| খানিক্ষন পরেই তুলে নিচ্চি……'

 বুলে ওৎ পাতে বুসে রুলো… 


হঠাৎ বৃষ্টি নামলো,

 চারিদিকে  জলে জলাকার…… 

দুম-দাম বাজ পড়তি লাগলো…… 

কারো কতা কেউ শুনতি পাচ্চি নে… 

ধনা জাল গুটাতি শুরু কুরেছে| এমন সময়……… ওর জালের দড়ি গেলো আটকে… 

 ও আমার হাতে জালডা ধরিয়ে দে জলে নামে গেলো…… এগুতে এগুতে সামনের গামো গাছের ঝোপের তলায় যেই গেছে, "বাবা গো" বুলে চিল্লে উঠলো…

 ঝপাত করে জলে ঝাপিয়ে পুড়ে চকির সামনে দে ধনাডারে তুলে নে যাচ্চে সে…… 

আমি...আমি... আমি… কিচ্চু করতি পারলাম না রে রাখাল… কিচ্চু করতি পারলাম না… পরাণ লগি নে লাপ দে জঙ্গলে ডুকোলো ওর দাদারে বাঁচাতি……… আমার ধনা আর ফিরলো না……  "


 বলতে বলতে খুড়োর দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে চলেছে……… 

হঠাৎ নামা বৃষ্টির জলে আজ একাকার খুড়োর বুকফাটা কান্না, 

সদ্য লায়েক হওয়া রাখাল তার গভীরতা কতখানি বুঝেছে, তা জানি না… 

কিন্তু আকাশে ততক্ষণে রেফারি লুকোচুরি খেলার বাঁশি দিতে শুরু করেছে… কড়্ কড়্ কড়াৎ

Monday, 13 March 2023

নিতাই ভট্টাচার্যের গল্প

 


অভয়ের আপদ



অশীতিপর অভয়ের অনিদ্রাব্যাধি। বাতের ব্যথা বাতাস দিয়েছে তাতে। অনেক লড়াইয়ের পর সেই মাঝরাতে ঘুম আসে। নিদ্রা পুষ্ট হয় ভোরে। তাই বেশ বেলাতেই সকাল হয় অভয়ের। এইভাবেই দিন যাচ্ছিল চলে। ছন্দপতন হঠাৎ। কারণ জার্সি গরু।

অভয়ের ঠিক পাশের বাড়ির লোক নাড়ু ঘোষ। দুগ্ধ ব্যবসায়ী। 

কারবারে জোয়ার আনতে নাড়ু খাটাল-রতনের কাছ থেকে জার্সি গরু কেনে,এবং খাল কেটে কুমির আনে। 
নতুন পরিবেশে গাভীটি তখনও মানিয়ে নিতে পারেনি, শিং নেড়ে দেয় হুংকার। কাছে ঘেঁষে সাধ্য কার!
একদিন গো-দোহনের জন্য নাড়ু জার্সি গরুটির কাছে যায় এবং চাঁট খায়। ক্ষুরাঘাতে ক্ষত গভীর, প্রাণ যায় যায়। চিন্তিত নাড়ুর মা স্মরণ করে কুলগুরু অঘোর চন্দ্রকে। সশিষ্য গুরুদেব হাজির নাড়ুর বাড়িতে। বলে, নাড়ুর কালসর্প দোষ। তাই ভীষন বিপদ। প্রতিকার চাই। এখনই।

অর্ধনিমীলিত চোখের পাতায় বাহ্যজ্ঞানটুকু ঝুলিয়ে কাতর কন্ঠে নাড়ুর মা জিজ্ঞাসা করে, উপায় কিছু নেই বাবা? অঘোরচন্দ্র বলে, উপায় আছে মা। হরিনামে পাথর যায় গলে। তাই একমাস হরিনাম নিলে মুখে, নাড়ু থাকবে সুখে। সংকীর্তন শুনে গাভীটিও শান্ত হবে। দুশ্চিন্তা যাবে ঘুচে।

ব্যবস্থা হল তেমন। রোজ অষ্ট প্রহর হরিনাম-বর্ষন। টানা একমাস। অভয়ের নাভিশ্বাস।




ভোর বেলায় গভীর ঘুমে অভয়। দখিনা বাতাসে অঘোর চন্দ্রের হরিনাম ভেসে অভয়ের কর্ণকুহরে প্রবেশে, মরমে আঘাত হানে। ব্যস। ভোরের নিদ্রা চৌপাট। মেজাজ টং। 

এমনিতেই হরিনামে এলার্জি। সেজন্য নাড়ু ঘোষের পূর্বপুরুষই দায়ী। সারা জীবন অভয় সয়েছে যন্ত্রণা কারণ উঠতে বসতে ঘোষেদের ' হরিস্মরণ ' । অভয় দিয়েছে গালি, বলেছে আপদ মরণ। ইদানিং বন্ধ ছিল সব। তাই ভোরের ঘুমে ছিল শান্তি। টিকল না আর। এসেছে গুরু অঘোর। ঘোষ বাড়ি যেন বৈকুণ্ঠধাম। অভয়ের অশান্তি। টানা একমাস।

এখন ফাঁড়া - মুক্ত নাড়ু। হরিনাম শ্রবণে জার্সি গরু মেনেছে বশ। বালতি উপচে দুধ। ফিরে গেছে গুরু। খুশি অভয়। আবার ঘুম জমাট। চনমনে শরীর। 

আজ বিধি বাম। ভোর বেলায় ঘুম চটকে শেষ। ছি, হায় রাম!

 ভোরে নিদ্রামগ্ন ছিল অভয়। হরিনামের হ্যাঁচকা টানে ঘুম ঘেঁটে ঘ। প্রথমে ভেবেছিল আতঙ্কের স্বপন। পরে দেখে না, সত্যি। সেই সুর যন্ত্রণা। অভয় হাঁটা দেয় নাড়ুর বাড়ি। অবাক কাণ্ড সেখানে। গোয়ালে ব্যস্ত নাড়ু। অভয় দাঁড়িয়ে উঠানে।

--- কী হল কাকা, এত সকালে?
--- আবার কেন নাড়ু? অনিদ্রায় মরবো যে অকালে!
--- আসলে...। শুরু করে নাড়ু।

খাটালের গরু। গান শুনিয়ে গো-দোহন নিয়ম। অভ্যাস তেমনই। রতন নাড়ুকে বলেছিল আগেই। আমল দেয়নি নাড়ু। এই একমাস মধুর হরিনাম শুনে শান্ত ছিল গাভীটি। নাড়ুর অজান্তেই। অঘোরচন্দ্র ফিরে যেতেই বন্ধ হরিনাম।স্বমহিমায় গরু। আবার শিং নাড়ে। নাড়ুর ভয়। তাই খাটাল-রতনের ডাক পড়ে। সব শুনে বুদ্ধি দেয় রতন। সেইমত রেকর্ড করে নিয়ে এসেছে নাড়ু গুরুদেবের কণ্ঠে হরিনাম সংকীর্তন। বাজানোর ব্যবস্থাও করেছে জব্বর। আবার শান্ত হয়েছে গরু। বালতি উপচে দুধ। তাই নাড়ুর সংসারে ফিরেছে সুখ।
সব কিছু দেখে বিমর্ষ অভয়। চোখে মুখে আতঙ্ক। মনে সেই পুরাতন অনিদ্রার ভয়।





Saturday, 26 December 2020

বৈদূর্য্য সরকার , গল্প, সাহিত্য এখন শীত সংখ্যা ২০২০-২০২১,

 


প্রান্তিক



শীতের ছুটি চলছে ।  পাড়ার চায়ের দোকানে বেলায় আড্ডা দিতে গেছি, রাজাদা উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে ।  তার রবি ঠাকুর মার্কা দাড়ি হাওয়ায় এবং উত্তেজনায় ছটফট করছে । 
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সত্যি কি কোনও ডক্যুমেন্ট আছে ? রাজাদা চটে বলল, ডক্যুমেন্ট আবার কি... সবাই এতকাল ধরে জানে – নেতাজীর মামার বাড়ি । 
ওর ধাত জানি বলেই শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম, সে ঠিক আছে...কিন্তু প্রোমোটিং যে হচ্ছে, তাদের কাগজপত্র পাশ হল কী করে ! 

পাশ থেকে খিটকেল ভটচাজ বলে উঠল, টাকা রে ভাই, সব টাকার খেলা...গোটা দেশটা বেচে দিল । আর এ হচ্ছে নেতাজী – মরার খবর পর্যন্ত চেপে দিয়েছে । 
এমন সময় ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে পুরুত বলে উঠলো, মানুষের আয়ু যত বাড়ছে... মানুষের কচি সাজাও যেন বেড়ে চলছে। বিরক্ত হয়ে তাকালাম । তখনই  ঝলমলে ক্যাবলাদা হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালো । মুখে কিছু বলে না বটে তবে অঙ্গভঙ্গি করে হাসে আর চোখ পিটপিট করে । পানও চেবায় অবশ্য। আজ লাল রঙের পায়জামা পাঞ্জাবি জুতো টুপি মুখোশ পরে এসেছে । অদ্ভুত এক মূর্তি। 
রাজাদা রেগে লাল হয়ে বলে চলেছে, নেতাজীর ভূত নিয়ে সিনেমা করে হাউসফুল করে দিলে... তার জ্যান্ত মামারবাড়ি নির্দ্বিধায় ভেঙে ফেলছে! 
 সেই সময়েই কোথা থেকে টুপি পরা পাগলা বাজিয়েটা মাটি ফুঁড়ে এসে মাউথ অর্গান নিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ বাজাতে লাগল । 
শুনে আমরা একটু থমকে গেলেও  পুজোয় ওর অ্যাসিটেন্ট হয়েছে বলে রোগাভোগা ভটচাজ পুরুতের সেই আগের কথাটা ধরে ততক্ষণে বকতে শুরু করেছে, মানুষ আগে চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের আগেই সটকে পড়তো । আর এখন আশি নব্বই আকচার। পাশ থেকে কে যেন বলেছিল, একশো বছর বাঁচলে নাকি ডবল পেনসান দেয় ।   

চায়ের দোকানে বসা লোকগুলোর আদৌ কোনও মিল নেই । না চেহারায় না বয়সে কিংবা কাজকর্মে । তবে মিল ভেতরে ভেতরে একটা আছে বটে – সবাই মোটের ওপর ব্যর্থ । সমাজে কোনও দাম নেই । তেমন কোনও পরিচিতিও নেই বটে। সবার মনের ভাবটা খানিকটা এর’ম – দুনিয়ার লোক ষড়যন্ত্র করে বিপাকে ফেলেছে । বিশ্বায়নের মতো সেই গভীর ষড়যন্ত্রে যাবতীয় ভাল ব্যাপার বন্ধ হয়ে গেছে । পুরুত যেমন বলে, দেবদ্বিজে ভক্তি চলে যাওয়াটাই আসল কারণ । রাজাদা বলে- সব ওপারের লোকেদের চক্রান্ত । আমি নতুন কিছু বলার মতো মুখে বলে বসি – পলিউশান, চারদিকে সব দরকচা মারা অবস্থা । পরিবেশ প্রকৃতির মতো মানুষগুলোও সব কেমন যেন হয়ে গেছে ।

আমাদের মতো সামান্য লোকের দল কি এসব ব্যাপারে আদৌ কিছু করতে পারবে ? জিজ্ঞেস করার আগেই দেখলাম রাজাদার মুখচোখে কেমন যেন একটা তেড়েফুঁড়ে ওঠা দৃষ্টি । 
কীভাবে এগোনো যেতে পারে সেটাও তো পরিষ্কার নয় । আমাদের না আছে দল, না অন্য কোনও বল । নেহাৎ পুরনো পাড়া বলে দু’চারটে নিস্কম্মাকে আড্ডায় পাওয়া যায় । এসব নিয়ে যদিও মাথা ঘামায় না কেউ আজকাল। 

চায়ের দোকানে অধিকাংশ সময় কাটানো অন্যান্য লোকের মতো আমার অবস্থা না হলেও রাজাদার সাথে সখ্যতার কারণেই ওখানে জুটে গেছিলাম । রাজাদা এককালে পদ্য লিখেটিখে নাম করেছিল । কীভাবে যেন জাতীয় পুরস্কার পেয়েওছিল একবার । কিন্তু তারপর থেকে ক্রমে কেষ্টবিষ্টুদের অবহেলায় কর্নার হয়ে গেছে । এমনকি ওয়েবসাইটে তখনকার পুরস্কৃত লোকগুলোর নাম পর্যন্ত নেই । আছে তার পরের সময় থেকে, যখন থেকে প্রবল প্রতাপান্বিত প্রেসিডেন্ট তার নিজের সিস্টেমের লোকেদের পুরস্কার দিয়েছে । রাজাদার মুখে শুনেছি, উনি নাকি পূর্ববঙ্গীয় গরীব বামুনদের প্রেফার করতাম । সেদিকে রাজাদা একেবারে মিসফিট । বাড়ির অবস্থা ভাল, এপারের বেণে । তবে এখন তেমন দাপদাপট নেই, বুঝতে পারি । এখন ও লেখালিখির থেকে এনজিও নিয়ে বেশি ব্যস্ত। বাইরে না যাওয়ার কারণে চাকরি ছেড়ে কিছু টুকটাক ফ্রিলান্স করে। একা মানুষ- তেমন কীই বা খরচ ! 

আমার অবস্থা ঠিক উল্টো – বিয়ে থা করে ল্যাজেগোবরে । যদিও সংসারে থিতু হওয়ার বদলে এসব উ্তপটাং ব্যাপারে বেশি টান । চাকরি নাম কা ওকয়াস্তে করলেও মন নেই । গায়ের জোরে লেখালিখির চেষ্টা করলেও বড় জায়গায় তেমন সুযোগ পাই না – মুরুব্বির জোর নেই বলে । ঘরে আশান্তি – গঞ্জনা । সমবয়স্ক বন্ধুরা বাইরে গিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে – গাড়ি বাড়ি বিলিতি বউ । আমি সেই এক জায়গায় পড়ে আছি – হেরিটেজ নিয়ে যাদের গর্ব, বর্তমানে কোনও আশা নেই ।

প্রোমোটার নয়তো রামকৃষ্ণ মিশন –এখানকার পুরনো বাড়িগুলো গিলে খাচ্ছে । টাকার লোভে অধিকাংশ লোক বাস্তুভিটে ছেড়ে চলে যাচ্ছে শহরতলিতে । সেখানে একজন ভুলে যাওয়া দেশনায়কের মামার বাড়ি ! আদৌ কিছু হবে ? বুঝতে পারছিলাম না । তবে সবার আগ্রহে যে কিছুটা জড়িয়ে পড়েছি- তা বুঝতে পারছিলাম ।
ওই চায়ের দোকানে বসার সূত্রে ভটচাজ এসে কথা বলে । ভাল বংশের হলেও সহায় সম্বলহীন লোক –একটা বন্ধ দোকানে থাকে । কাজকর্ম নেই । খাওয়া জোটে কী করে কে জানে ! পুরুতের পুজোর ব্যবস্থা থাকলেও তাতে আর কত । তবু ভটচাজটা ভিড়েছে কলাটা মুলোটার লোভে । তুলনায় অবস্থা ভাল ক্যাবলাদার । ওদের কী একটা ছোট কারখানা আছে । সেখানে না বসলেও কিছু মাসহারা পায় বটে । খরচ বলতে জামাকাপড়ের । একই স্টাইলের শেরওয়ানি পাজামা পাঞ্জাবি – ওর কমপক্ষে ত্রিশটা আছে বলে মনে হয় আমার । রোজ আলাদা রঙের । সাথে ম্যাচিং টুপি । ফক্কুড়ি করে জিজ্ঞেস করতাম, কাকে ইম্প্রেস করতে চাও ? শুনে রাগতো না, মৃদু হাসত আর চোখ পিটপিট করতো ।    

একটু আলাদা ছিল পাগলা বাজিয়েটা । ছোট থেকে ওকে মাউথঅর্গান বাজাতে দেখতাম এলাকার ছোটখাটো অনুষ্ঠানে । তখন থেকেই ন্যালাখ্যাপা । বয়স বাড়ার সঙ্গে পাগলামি বাড়ে আর এসব সুযোগও জুটতো না ওর । তবে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে বাজনা বাজাতে ক্লান্তি ছিল না । প্লাটফর্ম চায়ের দোকান কিংবা গলির মোড়ে সে আপন মনে বাজনা বাজাতো । কেউ বিরক্ত হয়ে কিছু বলত হয়ত । ও ভ্রূক্ষেপ করতো না। আমার মনে হতো – অনেকসময় অজান্তেই ও ঠিক মিউজিক বাজিয়ে আবহটা তৈরি করে দিয়ে যায় । 

রাজাদার আগ্রহে নেট ঘেঁটে বের করেছি, হেরিটেজ কথাটার সঠিক মানে - belonging to the culture of a particular society, such as traditions, languages, or buildings, which come from the past and are still important... রাজাদা ভাবতে শুরু করেছে কাকে দিয়ে কাকে কাঠি করানো যায় । শাসক দলের অনেক লবি... তাদের কাউকে ধরেই এসব ভাঙন আটকাতে হবে । কিন্তু কীভাবে ? রাজাদা বলছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।
বিধায়ক মন্ত্রী এমপি সব নিয়ে যখন কথাবার্তা চলছে তখন ফোকলা পুরুত আশ্চর্য একটা সমাধানসূত্র দিল । রবিবার সে একদল পুরোহিত নিয়ে আমাদের বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রীর সাথে দেখা করবে । মোদ্দা কথাটা হচ্ছে – চারিদিকে পুজো নিয়ে যে অনাচার... তার কিছু একটা ব্যবস্থা করা। এর খেই ধরে রাজাদা ওই বাড়ির ব্যাপারটাও বলে বসবে । তারপর দেখা যাবে । শুনতে কীর’ম অদ্ভুত লাগছে আমার । কিন্তু সবার উৎসাহে ওটাই ফাইনাল হল ।  
যেদিন এই আশ্চর্য মিটিং সেদিন আমি অবশ্য যেতে পারিনি । শুনেছি রাজাদার ক্যারিশ্মায় নাকি মন্ত্রী ব্যাপারটা শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য মেয়রের সাথে কথা বলা দরকার । এতো সহজে তো আর কাজকর্ম বন্ধ করবে না প্রোমোটার।

রাজাদা বেশ সেজেগুজে মেয়রের ঘরে গেছিল একদিন । তিনি চা খাইয়ে অনেক প্রশংসাও করেছে । শুনে আমাদের বেশ গর্ব হল বটে। পুরুতের ওর পুজোর ব্যাপারে দরবারের কতটা কী হয়েছিল জানি না, তবে সে বেশ খুশি মনেই রাজাদাকে পৈতে তুলে সাবাসি দিয়েছে । ভটচাজও বেশ বিগলিত মুখে বলছে, একখানা যা কাজ করলে না... । জিজ্ঞেস করলাম, কাজটা বন্ধ হবে কবে ? সেটা নিয়ে অবশ্য রাজাদা খুব কিছু বলতে পারলো না । 
পরের দিন বেলার দিকে রাজাদার কাছ থেকে একটা অদ্ভুত মেসেজ পেলাম – ‘মহাবিপদ...ফোন বন্ধ রাখছি... দরকার হলে কল করে নেবো... আপাতত গা ঢাকা দিতে হবে’। আগাগোড়াটাই বোঝার মতো কোনও বিষয় নয় । তবে কল করে দেখলাম, ফোন সুইচড অফ । কিছু বুঝতে পারলাম না ।

নানা হাবিজাবিতে ব্যাপারটা খেয়ালও ছিল না । ক'দিন পর হঠাৎ একদিন বিকেলে ওর ফোন পেলাম । আমার অফিসের কাছাকাছি কোথাও একটা দেখা করবে । যাইহোক, গিয়ে দেখি অবিন্যস্ত চেহারায় কাঁধে ঝোলা নিয়ে রাজাদা । অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বলল, ক’দিন এলাকাছাড়া । ওইদিন রাতে নাকি একদঙ্গল ছেলেপুলে ওর বাড়ির সামনে খিস্তিখেউড় করেছে । ঢিল পাটকেলও ছুঁড়েছে । তাদের উন্মত্ত চিৎকার থেকে যা উদ্ধার হয়েছে – ওই বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে ব্যাগড়া দেওয়ার কারণেই প্রোমোটারের উৎপাত । তবে ভাগ্যিস ওকে কেলানে কবি ভেবেছিল, তাই পেটো বা খুনজখমের প্রয়োজন মনে করেনি তারা ।

আমি হতবাক হয়ে ততক্ষণে ভাবতে শুরু করেছি – এটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাপার ! এই সামান্য ব্যাপারে লোকের ওপর এর’ম অত্যাচার হতে পারে ? আমার মনের কথা পড়ে রাজাদা বলল... কয়েক কোটি টাকার ব্যাপার, এতো সহজে কি ছেড়ে দেবে ! একটু থেমে বলল, এখন বুঝতে পারছি... মন্ত্রী কেন বলেছিল বেশ অনেক লোক সাথে নিয়ে মেয়রের কাছে দরবার করতে যেতে । তাহলে আর আমি একা মার্ক হতাম না । কিন্তু কেই বা যাবে ! আমাকে বলেছিল, নানা ঝামেলায় যেতে পারিনি । আর কে নিজের কাজকর্ম ছেড়ে যাবে ? থাকার মধ্যে পুরুত ভটচাজ ক্যাবলাদা আছে বটে... কিন্তু ওদের চেহারাছবি যা ! আমি রাজাদাকে থামিয়ে বললাম, ওদের দিয়েই হবে । মিছিলে ইন্ডিভিজুয়াল মুখগুলো বড় বিষয় নয় ।

পরিকল্পনা অনুযায়ী জানুয়ারির ২৩ তারিখ এলাকার কয়েকটা ছোটখাটো ক্লাব পতাকা আর নেতাজীর ছবি নিয়ে মিছিল বের করলো । তাদের সাথে আমরা জুড়ে গেলাম । ক্রমে স্লোগানের অভিমুখ ঘুরে গেল ‘নেতাজীর স্মৃতি’ তার মামার বাড়িটাকে বাঁচানোর দিকে । আগে থেকে অবশ্য কিছু লোক ঠিক ছিল । যাদের ব্যক্তিগতভাবে তেমন কোনও গুরুত্ব না থাকলেও দলগতভাবে অস্বীকার করা যায় না । 
মানুষের সে নদী নানা দিক থেকে আসা লোকের শক্তিতে বিপুলা হয়ে বইতে লাগলো রাজপথ জুড়ে । সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং স্বতঃসফূর্ত মিছিলের ছবি তোলার কিছু লোক আমাদের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল অবশ্য । গন্ধে গন্ধে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এসে গেল । স্বাভাবিকভাবে বিধায়কের বিবৃতি দাবী করা হল । তিনি আগে থেকেই খবর পেয়েছিলেন, ফলে মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী ঐ বাড়িটাকে হেরিটেজ হিসেবে মেনে নিতে দেরি করেনি । ওখানে নেতাজীর মূর্তি স্থাপনের কথাও দিয়ে ফেললেন । মুহূর্তের মধ্যে নেতাজীর ছবিতে মাল্যদান এবং পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করে তার দলের লোকেরা যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তির পরিচয়ও দিল । ততক্ষণে লোক জমেছে অনেক । বেলা পড়ে এসেছে । দু’একটা ফুচকা ভেলপুরি বেলুনওলা জমতে দেখে রাজাদা নিশ্চিন্ত হল । ওর মুখ দেখে বুঝলাম আমাদের দায়িত্ব ফুরিয়েছে । থাকার দরকারও নেই আর । এবার নদী যথানিয়মে মোহনায় যাবে ।

ভিড় ভেঙে পিছোতে লাগলাম । সঙ্গে ভটচাজ ক্যাবলাদা আর পুরুতও ফেরার পথ ধরেছে । ভটচাজ বলল, এভাবে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে... সব যখন মিটেই গেল । রাজাদা মৃদু হেসে বলল, যার জন্মদিন তার কথা জানো না... প্রেসিডেন্ট হয়েও ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে গিয়ে অজানার পথে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন যে। শুনে ক্যাবলাদাও বেশ মজা পেয়ে হাসতে লাগলো । ঠিক সেই মুহূর্তেই পাগলা বাজিয়েটা বাজাতে শুরু করেছে -‘একলা চলো রে ...’। 
 
শীতের ছোট বেলা ফুরিয়েছে। তখনই ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করলো না। চায়ের দোকানে আগডুম বাগডুম কথাবার্তায় মেতে উঠলাম আমরা। উনুনে আঁচ বেশ গনগনে । মনে হল, ছাই চাপা আগুন ঠিক সময়ে বেরোবেই । 







Tuesday, 20 October 2020

দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত,গল্প, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 



বন্ধু



শেষরাতের স্বপ্নে দেখা দিলেন নারায়ণ ।
              "অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি থেকে তোমাকে দেখা দিচ্ছি কন্যে ! “
" আমি অবাক। জীবনেও উপোস করিনি। দিব্যি হাসপাতালে রুগী দেখার নাম করে ভেগে  , ক্যান্টিনে পরোটা আর আলুর দম খেয়ে , বাড়িতে শাশুড়ি মায়ের কাছে শুকনো  রুগ্ন মুখোশ নিয়ে জন্মাষ্টমীর অঞ্জলি দিতে বসেছি। ওদিকে উনি কিন্তু নির্জলা উপোস। এক্কেবারে আমার ড্রাইভার ইউনিস এর মতো ।

“ও ইউনিস , এই রোজার সময় গাড়ি চালাবে- থাক না। কটা দিন ছুটি নাও।"           

“আমি তো থুতুও গিলি না দিদি , তবে কেন কাজটা কাড়ছেন ? কাজ না থাকলেই আমার খিদা পাবে।"
চুপ করে  ভাবলাম মরেছে , এতো সব নিষ্ঠাবান ভক্ত থাকতেও  ভগবান আমার কাছে কেন? 
প্রভু , আপনি এসেছেন কী সৌভাগ্য ! কী কী যেন চাইতে হবে দ্রুত মনে করতে লাগলাম । কুমারী অবস্থায় একটা সুবিধে হচ্ছে  বর চাই প্রশ্নের উত্তরও - বর চাই । এখন কী চাওয়া যায় ?
মোক্ষম আবদারটা করব ?
প্রভু পৃথিবীকে একদম করোনামুক্ত করুন। সেই আগের মতো।

কিন্তু ওদিকে  রোজই বিশেষজ্ঞরা বলে চলেছেন যে  আগের মতো  জীবন নাকি  কিছুতেই হবেনা। জীবাণু অস্ত্র এই নতুন  টেক স্যাভি যুগের হাতিয়ার ।
আমার অবশ্য বিশেষজ্ঞদের বিশেষভাবে অজ্ঞ মনে হয়। মানুষ যদি  ‘কোভিড পরবর্তী’ যুগে বন্ধুর মতো প্রকৃতি ও স্বজাতিকে নিয়ে বাঁচতে চায় , তাহলে পারবেনা কেন  ?
বাস্তবে  মানুষ জাতটা এতরকমভাবে ধর্ম , জাত পাতের নিরিখে  বিভক্ত , যে সে কি চাইবে আদৌ নতুন করে পৃথিবী গড়তে ? এটাই মূল প্রশ্ন।
জিজ্ঞেস করব কি করব না ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম “আপনি কীসে  এলেন ? “
“আলোর গতিবেগেরও আগে এলাম বুঝেছো।  ঈশ্বর কণার নাম শোনোনি?  গড পার্টিকল !”
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি । "যাক গে তোমার সাধারণ জ্ঞান দেখছি খুব পুওর ।  কিস্যু পড়োনা।  শোনো , হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করো আর বচ্চনের পুরনো কওন বনেগা ক্রোড়পতি দেখো । বুঝলে?”
“ কিন্তু ঠাকুর আমি যে  অনলাইন ক্যুইজ করি, গুগল করি।" 
“উঁহু বৎস্যা , তোমার সবেতেই গণ্ডগোল।  টিভি সিরিয়াল কি দেখতেই না  একেবারে ? দাদাগিরি  দ্যাখো । দিদি নাম্বার ওয়ান । সব শিখে যাবে। এবার বুঝলে?"
আমি উত্তেজিত হয়ে বলে ফেললাম "কিন্তু প্রভু ,আমাকে তাহলে কী বর দেবেন?"

এতক্ষণে নারায়ণ মিষ্টি হাসলেন। বুকটা ধ্বক করে উঠল। যা হ্যান্ডসাম!
  "দেবো না। চাইবো । এজন্যই তো এতোটা  মহাশূন্য বেয়ে এলাম।" 

এরপর  যেন বোমা ফাটানোর শব্দ শুনে চমকে উঠলাম !
নারায়ণ গদ্গদ হয়ে বলছেন  "প্লিজ , প্রভু বোলো না । আমার প্রোফাইলে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাও । কেউ পাঠায় না জানো .....................আমাকে নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য ব্যাভিচার সব করে ; কিন্তু  বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় না। “
আমি তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে বললাম “মানে ? আপনার কোটি কোটি ভক্ত তবু আপনি একা ? “

“বিশ্বাস করো চৈতন্য  চলে গিয়ে সেই থেকে আমি বড়ো একা।  লোনলি ।" 
চৈতন্য মানে নীলাচলের নিমাই নাকি বাঙালির চৈতন্য ? প্রশ্নটা বেয়াড়াভাবে আমার ঠোঁটে ঝুলে রইল।

তারপর  নারায়ণ অস্ফুটে বলে চললেন দিস ইজ কলি......কলি..... বন্ধু নেই কোথাও ....
টুক করে  জানলার পর্দা সরিয়ে কে যেন উঁকি মারল।
নারায়ণ বললেন , “কে  ওখানে ,যম ? “
তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন , তোমাদের অবশ্য প্রত্যেকেরই  ইচ্ছে বা অনিচ্ছেতে হোক যমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে। হবেই। আমার সে উপায়ও নেই।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নারায়ণ। আর আমি যমকে  আমার প্রোফাইল থেকে আনফ্রেন্ড করার জন্য প্রাণপন  চেষ্টা করতে লাগলাম।
নারায়ণ ভ্রূভঙ্গী করে বললেন , “উঁহু,
পাসওয়ার্ড  না বদলালে হবেনা ।”
“সেটা কী ? “
“ডেডিকেটেড ভালবাসা , ইয়ার! এর কোনও বিকল্প নেই। হতে পারেনা। সব গ্যালাক্সিতেই তাই।”

আমি গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

Monday, 19 October 2020

মনীষা শেখ, গল্প, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০, ভাস্কর্যে রামকুমার মান্না,

 


একটি চেনাশোনা রূপকথা


আমাদের গাঁয়ে কোন নদী আছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন? 

আছে। নদীর নাম মধুমতী। গাঁয়ের নাম?  

মনে করুন গাঁয়ের নাম রানির বাজার। 

সেখানে বাপ মা ভাই বোনের সাথে থাকতাম। বাপের আমার কিছু জমি জায়গা ছিল। চাষবাস করে চলত। কিছু হাঁস-মুরগি পালতাম। বাড়ির উঠোনে মরশুমি  সব্জি।

 লেখাপড়া করেছি কিনা? তা একটু-আধটু করেছি। মাধ্যমিক পাস দিলাম। আরো পড়ার ইচ্ছে ছিল জানেন!

পড়লাম না কেন? 

বাবা খরচ চালাতে পারলোনা। মাধ্যমিকের পরে বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগল। ভাইটা বদসঙ্গে পড়ল। ছোট ছোট ভাই বোন আমি দেখতে কেমন বলুনতো?

কী বললেন? সুন্দরী!   সুতরাং গ্রামের ছেলেরাও পিছনে লাগবে। বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবা একে তাকে ধরে সম্বন্ধে আনতে লাগলো। সে একটা উত্তেজনার সময় জানেন! বয়সটা তো তখন কাঁচা তো! বিয়ে, স্বামী, নতুন জীবন সব কিছু নিয়ে একটা রঙিন জগতে যেন চলে গিয়েছিলাম। 

প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিন কোন না কোন পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসত জানেন! তারপর বাড়ীটা যেন বিয়ে বাড়ি হয়ে যেত বাবা-মা বসে বসে আলোচনা করত পাত্রের কি কি গুণ, বাড়ির লোকেরা কেমন, সেখানে আমার কেমন লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। 


মা আমাকে চুলোর ধারে যেতে দিত না আমার গায়ের রং ময়লা হয়ে যাবে বলে। বাবা অবসর সময় নানা উপদেশ দিত। শ্বশুর-শাশুড়িকে যত্ন করতে বলতো। এইভাবে কেটে যেত পনের দিন কি এক মাস। মনে করুন পাত্রপক্ষের গ্রামের বাজারে মুদির দোকান। এই কদিন আমি হয়ে যেতাম মুদির দোকানের বউ। কীভাবে চললে মুদি দোকানি খুশি থাকবে তাই ভাবলাম বসে বসে। নিশ্চয় দোকান থেকে দুপুরে  ভাত খেতে আসে। সুতরাং তাকে ভাল করে রান্না করে খাওয়াতে হবে। রান্না পছন্দ না হলে সে কি আমায় মারধর করবে? কল্পনায় মার খেয়ে কেঁদেছি কত! ভালোবাসার কথা, আদরের কথা ভাবতাম কিনা?

যাহ! আপনি না! 

এই আমি চুপ করলাম।

কী বললেন?  তারপর কি হল? তারপর মুদির দোকানীর পছন্দ হল না। এরপর হয়তো চালের আড়তদার।

তার বউ সাজার কল্পনা চলল আরও এক মাস। 

 এই ভাবেই নানা পেশার লোকজনের বউ সাজা চলতেই থাকল। কিন্তু বিনা পয়সায় বিয়ে করার লোক  পাওয়া গেল না। 

এভাবে বছর দুই গড়িয়ে গেল। বাবা-মার উৎসাহ অনেকটা কমে এলো। তারপর?  তারপর রোজ সূর্য উঠতে থাকলো আর ডুবতে  থাকলো। ছোট ছোট বোনেরা বড় হয়ে উঠল। পাত্রপক্ষের আনাগোনাও অনেক কমে গেল। যদিও বা আসে তারা আমার বদলে আমার বোনদের পছন্দ করতে চায়। আমার মা তাদেরকে লুকিয়ে রাখতে লাগলেন। তবু কি করে যেন তারা সব খবর পেতে থাকলো। এমনকি কেউ কেউ বিনা পয়সায় বিয়ে করতেও রাজি হয়ে গেল। কিন্তু বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না বড়কে বসিয়ে রেখে ছোটদের পাত্রস্থ করার কথা। 


তারপর? এরপরেও আপনাদের শোনার ইচ্ছা হচ্ছে?

এরপর আমার ভাই একটা মেয়েকে তুলে আনল। সেই নিয়ে দিনরাত অশান্তি। সেই মেয়ে কিছুদিন পরে স্ব মূর্তি ধরলো,  আর আমি হয়ে গেলাম দিন-রাতের দাসী। 


বিয়েটা কি করে হলো? সে এক গল্প। ভাইয়ের বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে একদিন এক লোক এলো। তার বউ নাকি এক বছর হল মরে গেছে। বাড়িতে মেলা বাচ্চাকাচ্চা। তার একটা বউ দরকার। বাড়িঘর দেখাশোনা করবে, বাচ্চা সামলাবে। বয়স বেশি হলে অসুবিধা নেই। এমনকি বিয়ের খরচ বাবদ কিছু টাকা দেবে বলেছে। 

বাবা খুঁতখুঁত করতে লাগলেন। দ্বোজবর, বাচ্চাকাচ্চা- কিন্তু আমি রাজি হয়ে গেলাম। বেঁচে থাকার জন্য তখন আমি খড়কুটো ধরতেও রাজি। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে জোগাড় যন্ত্র করে বিয়েটা চুকে গেল। 


তারপর? তারপর আর কি? লোকটা বলল, শিবানী! তোমার হয়তো আমাকে পছন্দ হচ্ছেনা। বুড়ো হয়ে গেছি তো। তা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে চলো দুজন কোথাও ঘুরে আসি। গেলে তো সেই সংসারের যাঁতাকলে পড়ে যাবে। তুমি কোনদিন সমুদ্র দেখেছ? একথা শুনে আমি লোকটাকে কেমন যেন ভালোবেসে ফেললাম।  

    আহারে! সদ্য বউ মরে গেছে। তাকে হয়তো এখনো ভুলতে পারেনি। এর মধ্যেই আবার আমার কথা ভাবছে। সমুদ্রে গেলাম কিনা? গেলাম তো। জায়গাটার নাম খুব সুন্দর। চাঁদিপুর। সেখানে স্বপ্নের মতো তিন-চার দিন চলে গেল। 

তারপর? তারপর আমার বর একদিন জরুরী কাজের শহরে গেল। সেদিন রাত্রে সেদিন রাত্রে চারটে লোক আমার ঘরে ঢুকে এলো। বললো, আমার স্বামী আমাকে তাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে এক লাখ টাকায়। এটাই নাকি তার পেশা। 

তারপর? তারপর আমি পালাবার চেষ্টা করলুম। চিৎকার-চেঁচামেচি করলুম। অনুনয়-বিনয় করলুম। কান্নাকাটি করেও পার পাওয়া গেল না 


তারপর? 

তার আর পর নেই। গলা শুকিয়ে গেছে। মালকড়ি কিছু ছাড়ো তো বাপু! তখন থেকে বকিয়ে মারছে। 

কী বললে? টাকা কম আছে? শালা হারামির বাচ্চা! পয়সা নেই, বসে বসে গল্প মারাচ্ছে।

এ নিতাই! মাল আন বাপু।  গলাটা শুইকে গেছে। 

 

 ভাস্কর্যে রামকুমার মান্না

Wednesday, 7 October 2020

অরণ্যা সরকার, গল্প , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,


 

গহন স্বপন সঞ্চারিণী

 

তুমি, আমি ও আমাদের কথামেঘ 

নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলে তুমি। আমি জানি তোমার এই ছেড়ে যাওয়ায় কোনো অনন্তের আহ্বান ছিল না। আমাকে অবশ্য কোন নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়নি। আমিই বারবার নতুন  হয়ে এসেছি। পুরোনোর শ্বাসের ভেতর শ্বাস ফেলেছি। স্থিতি আসেনি। একটা পাথুরে চলমানতা আমাকে বয়ে বেড়ায়। নাকি আমি তার ভার বয়ে বেড়াই বুঝি না। জানি তোমার আগুন আরও তীব্র ছিল।  লুকোনো আগুনবাইরে গান ছিল। কথা ছিল। রবি আর তোমার নন্দন কানন ছিল। তোমাদের  ছাদের বাগান। মর্তলোকের দৃষ্টি এড়ানো পথে ছিল স্পর্শ যাতায়াত ছিল সব অমোঘ ভোর।

আমার ভোরগুলো দখল করে থাকে নেশা জড়ানো ঘুম। সকালের বেল, জুঁই তোমার যত্ন পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হত। আমার শিথিল আঙুল আঁ কড়ে থাকে বম্বে ডাইং আরাম। শুধু ভোর নয়, সকাল, দুপুর রাত কোথাও তোমার ছিটেফোঁটা  নেই আমার মধ্যে। এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে যে সব শব্দ ব্যবহার করছি সেসবও কিন্তু আমার নয়। তবু তোমার সঙ্গেই কেন এত বকবক করছি সেটাও জানিনা। কারণ খুঁজতে বা অনুভূতির গায়ে যুক্তির বুলেট বিঁধিয়ে বিক্ষত করতেও  চাইছি নাতোমার চলে যাবার পর অনেক বদলের রিপোর্ট জমা পড়েছে যুগের ফাইলে। তবু নিজের ভেতর নিঃসাড় পড়ে থাকা অন্য এক আমি কী করে যেন জড়িয়ে গেছে তোমার সঙ্গে। তোমাকে কে প্রথম চিনিয়েছিল সে কথা  অন্য একদিন  বলবো। সে আর এক আমির গল্প।

এখন আমার ভেতর থমথমে ক্ষোভ, গনগনে আঁচ, চকচকে প্রেজেন্টেশান ও ঊপচে পড়া সুখের ক্লান্তি। তোমার কাছেই এই যে নিজের খিড়কি খুলে দাঁড়িয়েছি সে শুধু ইচ্ছে করে বলেই। এমনি এসে ভেসে যাবার এই ইচ্ছের গভীরে যা আছে তা কেমন ঘোলাটে  আর ঠাণ্ডা। তোমাদের নন্দনকাননের ধুলো হয়ে উড়েপুড়ে বেড়াই নিজেকে জুড়িয়ে নেব বলে।

এখন দুপুর। তোমার খাটে,  বিছানায় লেগে আছে নিঝুম কবিতা। তোমার রবির কবিতালেগে আছে অপমানের দাগ।  কষ্টের গুঁড়ো। একটা স্পর্শ উড়িয়ে দিচ্ছে সব কষ্টের অণুধুয়ে দিচ্ছে অপমান দাগ।  স্নিগ্ধতায় ফুটে উঠছে ঠাকুরবাড়ির শ্রীময়ী ঘর। আমার ঘর বেশ গম্ভীর। এখন আমি অফিসে। এসি চলছে। ইনডোর প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন মিশে যাচ্ছে বন্দী বাতাসে। করিডরে অ্যাকোয়ারিয়ামবানানো জলজগতে সাঁতরে চলেছে রঙিন মাছ। কেবিনে কেবিনে যন্ত্রমানব, যন্ত্রমানবীরা   সংখ্যা সৌরভে মশগুল। একটু খিটখিটে। তবে  আপাদমস্তক নিখুঁত পরিচর্যায় ঝকঝকে। তুমি কি ভাবছ এসব থেকে আমি ব্যাতিক্রমী কেউ ? একদমই তা নয়।

আমি কাদম্বরী সেন। রবীন্দ্রভক্ত বাবার দেওয়া নাম। জানিনা নামটা রাখার পেছনে বাবার কি ভাবনা ছিল। সেকেলে নামের  জন্য আমার বেশ ক্ষোভ ছিল।  তবে এখন বেশ ওজনদার মনে হয়। নামে পুরনো গন্ধ থাকলেও আমার  জিম ও স্যাঁলো  চর্চিত ঝকমকে  শরীর। স্পা করা লম্বা চুল। পছন্দের পোশাক জিন্স কুর্তি। দশ ঘণ্টা ল্যাপটপে চৌকশ আঙুল। সামনে ঝুলন্ত টার্গেট। আমার দৃষ্টিতে, শ্রুতিতে, কোথাও সমাহিত স্নিগ্ধতা নেই।

 

ছায়া নেমে এলে

দুপুরটা চলে যাচ্ছে। তুমি শব্দ পাচ্ছ ? আমি পাই।  আমার ধারালো দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে  তোমার ছবি প্রকট হচ্ছে।  তুমি এখন গা ধুতে যাচ্ছ। সেই প্রস্তুতির শব্দও আমি পাচ্ছি। সেই শব্দের উপর হামলে পড়ছে আমার সময়। চাপা পড়ে যাচ্ছে তোমার চুড়ির রিনিক ঝিনিক। তোমার শাড়ির খসখস।

মগজের কনফারেন্স শেষ। আজ শনিবার। সন্ধ্যে আটটা। বাড়ি ফিরছি। নন্দনকাননের দোলনা থেকে তুমি ফিরে গেছ অনেকক্ষণ। সন্ধ্যেপ্রদীপ নিভে গেছে। তোমার ভিজে শরীরের জলকণা যখন শুষে নিচ্ছিল বাতাস, যখন আকাশের দিকে  মুখ করে  তোমার তরলিত সুষমা ছড়াচ্ছিলে নরম সন্ধ্যেকে, তখন আমি অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে, শপিং করে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাম জ্যাবজেবে হয়ে একটা ঠাণ্ডা শাওয়ারের স্বপ্ন দেখছি। বুঝলে রবির ‘সরোবরময়ী’। আমার বুকের ভেতরও ঘাপ্টি মেরে থাকে একটু জলের টুকরো। একে সরোবর বলা যায় না। ওটা তোমার জন্য। তোমার রবির দেওয়া শব্দ। সে যাই হোক , শুধু তোমাকেই বলছি ওইটুকুই আমার ভিজে ওঠার গোপন। বাইরে আমি সবসময় নিজেকে পারফিউমে মুড়ে রাখি। সবসময় ক্যারি করি সুগন্ধ। আসলে নিজেকে লুকিয়ে রাখি সুগন্ধের ভেতর।

বাথটাবে নিজেকে ডুবিয়ে এখন আমি বেশ ফুরফুরে। আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে নিজেকে একটা পতঙ্গ মনে হল। খুব রূপসী, অহংকারী পতঙ্গ। আমার মাস্কারার কালো, আর আইশ্যাডোর নীল মিলেমিশে আকাশ তৈরি করলো। তারপর ছোট্ট    নীল পোশাকের চেন আটকাতেই আমি পাখি হয়ে গেলাম। সেই ছোট্ট নীল পাখি, যে গরমের ছুটির দিনগুলোতে ডালিম গাছে বসতো। না না আমি এখন কোন নীল পাখি বা ডালিম গাছের কথা মনে করতে চাইছিনা। বরং আমি নতুন কেনা পারফিউম মাখার জন্য উন্মুখ হতে চাইছি

পারফিউমটা স্প্রে করতেই আমি কেমন অদৃশ্য হয়ে গেলাম। তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ ? আমি কেমন ফুরিয়ে গেলাম দেখলে? এমনি করে আমি মাঝে মাঝে একেবারে ফুরিয়ে যাই। শুধু গন্ধটা থাকে। রূপক আসে। গন্ধে মাখামাখি হয়ে  কখনও আমি ওর সঙ্গে সেঁটে যাই। তারপর পার্টি, রেস্টুরেন্ট, নেশা আর ঘুমিয়ে পড়া। কতদিন যে ধীরে ধীরে ঘুমের মধ্যে নামিনি আমি ঘুমকে উপলব্ধি করিনি। আমার  ল্যাপটপের স্ক্রিনসেভারে নীল নীল ঢেউ আছড়ে পড়ে। ওরাও ঘুম জানেনা। কোথাও ঘুম নেই। ঘুমের মধ্যেও ঘুম নেইতরলে তরল নেই। শুধু ঘূর্ণন।  তাই নিয়ম ভাঙার ধুমধাম আছে। টলিয়ে  দেবার ও টালমাটাল থাকার হুল্লোড় আছে। 

আমি এখন সেই অন্ধকার আলোর মধ্যে শরীরী লটবহর বিছিয়ে রূপান্তরিত হবার চেষ্টা করছি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ না। আসলে আমি এখন একটা ডিস্কোতে। নব্বই ডেসিবেল শব্দের বিস্ফোরণ বুকে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি সেই সশব্দ ভাঙনের তালে তালে নেচে চলেছি। শরীরে শরীর জড়িয়ে সঙ্গ দিচ্ছে রূপক। আমরা এক দৃশ্যমান উষ্ণতার মধ্যে অদ্ভুত ভাবে শীতল   হচ্ছি। বরফদৃষ্টিতে  ভেসে উঠছে - নন্দন কানন থেকে মাদুর তাকিয়া ঘরে ফিরেছে। রুপোর রেকাবিতে রাখা ভিজে রুমাল শুকিয়েছে বহুক্ষণ। বেলফুলগুলো স্মৃতিদাগ রেখে চলে গেছে নক্ষত্রলোকে। সাদা চাদরে তুমি জেগে আছ। সন্ধ্যের তৈরি  হওয়া গান এসে শুয়েছে তোমার পাশে। তোমার  রবি ও কি জেগে থাকতো  তোমার মত ? তিনি কি তাঁর ধ্রুবতারার জন্য  নতুন করে দ্বিগুন হয়ে উঠতেন আগুনে আগুনে ?

 

মাধুকরী

রূপকেরও একরকম আগুন আছে। সেই গনগনে আঁচে নিজেকে সেঁকে নেওয়া যায়, তবে অলৌকিক আলোয় ভেসে থাকা   যায় না। আমি জানি অস্ফুট মুখরতা বলে আমার জগতে কিছু নেই। আমার মত টার্গেট তাড়িত মানুষের পাথরে পাথর ঘষে  শ্বাসরোধ করে বসে থাকাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও দ্বিধাগ্রস্ত ঋতুর চিবুকে মাঝে মাঝে  পথভোলা কোনো জোনাকি  এসে বসে। 

ব্যালনিতে বসেছিলাম। শহরের খোলস থেকে বেরিয়ে আসছিল অন্য এক শহর। রূপক এসে বসেছিল পাশে। মনে  হয়েছিল চরাচর ভরে উবে পূর্ণিমায়। আকাশে বড় চাঁদও ছিল। তবু পূর্ণিমা আসেনা। রূপক শুধু বলেছিল,  ‘আজ তোকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।’

কেমন অন্যরকম ?

সাম থিং ডিফারেন্ট। লাইক ফ্লাওয়ার, বাট নট  লাইক অ্যান  অর্কিড।’ 

আর প্রশ্ন করিনি। এটুকু বোঝে বলেই তো রূপক পাশে এসে বসতে পারে। আর আমি ও পাশে থাকলেও নিজের কাছে  থাকতে পারি। বাকিদের স্রোতে স্রোত রাখি শুধু। এই যে তুমি আমার মধ্যে বইছ এভাবে, তুমি তো সত্যিই স্রোতস্বিনী। তোমার মত আমিও প্রবাহই বহন করি। তবে আমার এই প্রবাহে ধারন বলে কিছু নেই। শুধুই বহন। যা কিছু রোজ ভাঙি  বানাই, তা শুধু বয়ে বেড়াই । দিন শেষে কিছুই জমেনা। ভেতরে গুমরে ওঠে ভিক্ষের ঝুলি। 

 

ছুটি ছুটি

আজ রবিবার। আমার ছুটির দিন। খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল।  অনেকদিন পর আজ সকাল দেখলাম। বসন্তের সকাল।  ব্যালকনিতে বসে থাকতে থাকতে মনে হল সকালের কোন ভূগোল থাকেনা। রোদ আর ব্যস্ততা হামলে পড়ার আগে যে  এমন  একটা  স্নিগ্ধ আহ্বান এসে রোজ  ডেকে ডেকে ফিরে যায়, ভাবতেই মনখারাপ হয়ে গেল। ঘর থেকে মার পুজোর   ফুল আর ধুপের গন্ধ ভেসে আসছে। ঘেন্নায় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে  নেওয়া , বিরক্তিতে সরে যাওয়া মুহূর্তরা সে সুগন্ধ মেখে ফিরে আসছে  আজ আর কোথাও যাবো না। আজ সারাদিন শুধু তুমি আর মা।  আচ্ছা তোমরা যে কি সব  পরপারের কথা বল, সে যদি থেকে থাকে তবে তো তুমি এখন সেই চির বসন্তের দেশের মানুষ। এবার বলো তো তোমার  রবি কি এখনও তার ‘সাধের সাধনার’ জন্য তেমনই একাগ্র ? যে অতৃপ্তি নিয়ে তুমি চলে গেলে সে কি এখনও আছে ? বাঁশির সুরের দূরত্বটুকু কি তোমরা অতিক্রম করেছ ? খুব আশ্চর্য লাগছে জানো, এই যে আমি তোমাকে যা যা বলছি, যেসব  শব্দে বলছি এসব নিয়ে কিন্তু আমি এখনও যথেষ্ট আমার ভাষায় খিল্লি করি।  অথচ দ্যাখ, কেমন স্বছন্দে তোমার সঙ্গে   বোকা বোকা বিষয় নিয়ে কথা বলছি। তবে কি --- না থাক, আর ছেঁড়াখোঁড়াও করতে ইচ্ছে করছে না এখন। বরং    তোমাকে সেই অন্য আমির গল্পটা বলি। 

আমার কলেজ জীবন শুরু ইলেভেন থেকে। দশটা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাস চলতো। কো এড কলেজ। ইচ্ছেমত ক্লাস কামাই-এর স্বাধীনতা, গাছতলার আড্ডা, সব মিলিয়ে বিস্ময় আর ঘোর। ছোট  থেকেই আমি খুব একটা হৈচৈ করতে    পারতাম না। শুনতাম আর ভরে উঠতাম। নির্ঝরও ছিল আমার মত। ওর চশমায় বন্দী চোখ, বাউন্ডুলে চুল, উদাস ভঙ্গি সবকিছুকেই ছুতে পারতাম আমি। অনেক বই পড়ত নির্ঝর। কবিতা ভালোবাসতো। আমাকে শোনাতো, ‘রাতের সব তারাই   থাকে দিনের আলোর গভীরে।’ বলতো ‘বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট, আর ফুসফুসভরা হাসি’র কথানির্ঝরই প্রথম    শুনিয়েছিল তোমার কথা রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠানের কথা। ও বলতো, তুমি নাকি কবির সৃষ্টির আত্মার বন্ধু ছিলে। তখন  তোমাকে জানার মত খুব বেশী উপাদান ছিল না আমাদের সামনে। তবু ও তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী জানতহয়ত  তোমার ঠাকুরপোর চেয়েও। ঠাকুরবাড়ির শিক্ষা, আদবকায়দা আর সবার উপেক্ষায় কুঁকড়ে থাকা তোমার যন্ত্রনাকে  চিনিয়েছিল নির্ঝর। কবির কবিতার প্রথম পাঠক ও সমালোচক ছিলে তুমি। অথচ কি স্নিগ্ধতায় মুড়িয়ে রাখতে তোমার সমস্ত শক্তি, সব আগুন। সেই প্রথম পূর্ণতার স্পর্শ পাই আমি। যত সময় পেরিয়েছে তোমার ভেতর আশ্রয় নিয়েছি আমি। যে সেই খোঁজ দিয়েছিল, সেই নির্ঝর কিন্তু হারিয়ে গেল জীবন থেকে। বাবার ইচ্ছেয় বড় চাকরীর জন্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল। প্রথমে কিছুদিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। বুঝতাম পড়াশোনাটা ওর কাছে খুব চাপের মনে হচ্ছে । তারপর দুজনেরই  নানা ঠিকানা বদল হল। আমরা হারিয়ে গেলাম। থেকে গেল ওর শোনানো কবিতা, ‘বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে...’    আমার একলা বিষাদ, একলা জাগা, একলা সকালের গল্পগুলো বড় হতে লাগলো। এই সফল জীবনে খুব জানতে ইচ্ছে করে ,ওর সেদিনের সেই দুঃখ বিহীন দুঃখগুলো কি এখনও আছে ? ভিড়ের ভেতর ওকে খুজি। খোঁজটা আড়াল করে রাখি আমার ঝকঝকে যাপন দিয়ে।

 

জমাতে জমাতে জমকালো পাথর

ওইটুকু ছাড়া আমার আর কোন ধার নেই। সামনে এগোনো কখন যেন অভ্যেস হয়ে গেছে। গতির স্রোতে ভেসে গেছে মুখচোরা মেয়েটা। জয়েন্টে আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি টেক পাস  করে   আমি এখন এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। এই পদে পৌঁছতে আমাকে কয়েকজন যোগ্যতা সম্পন্ন  ব্যক্তিকে টপকাতে হয়েছে। আর এই কাজ শুধু দক্ষতায় হয়নি। দেওয়া নেওয়ার শুরু সেই থেকেই। অ্যাম্বিশন নামের  জেদি   স্মার্ট শব্দকে কিছুতেই তাড়াতে পারিনি। আমাকে এক্সপ্লয়ে করেনি কেউআমিই  নিজেকে তুলে ধরেছি বসেদের দামী  একাকীত্বের কাছে। একের পর এক  বাধা ডিঙ্গিয়েছি। ক্রমশ জড়তা কেটেছে। নিজের থেকে শরীরকে আলাদা করেছি শানিত হয়েছে সৌন্দর্য। নেশা এসেছে। পুরুষ এসেছে। হাত পেতেছে। উভয়েই পূর্ণ হয়েছি। না, বিয়ে করবো না। গণ্ডী, খাঁচা এসব আমার জন্য নয়। দামী ফ্ল্যাটে মাকে নিয়ে থাকি। মা আছে বলে এখনও ঘরের গন্ধ পাই। এখনও কম কথা বলি, তবে শোনার কিছু পাই না। রো ওয়াইনের সঙ্গে গিলে ফেলি এক একটা অতিক্রমের গল্প।  

সন্ধ্যেটা থমথম করছে। দূরে কোথাও সন্ধ্যামণি ফুটেছে। ঝিঙ্গেমাচার হলুদ ফুলেরা সন্ধ্যাতারাকে পৃথিবীর গল্প পাঠাচ্ছে। চুল বেঁধে, গা ধুয়ে তুমি এসে দাঁড়িয়েছ ছাদে। পড়েছ ফলসা রঙের কালোপাড় শাড়ি। জমানো রক্তের মত ছোট্ট চুনির দুল  তোমার কানে। খোঁপায় দোলনচাঁপা। হোক না বসন্ত, তবুও দোলনচাঁপাই। আমি আমার সমস্ত আমিটুকু জড়ো করে বাড়িয়ে  দিচ্ছি। তুমি আমায় ছুঁয়ে থাক। আমার আলোয় পোড়া শরীরে তোমার প্রিয় সব অন্ধকার পুঁতে দাও। আজ চাই,    ভীষণভাবে চাই, তোমার হু হু ডাক আমায় নিংড়ে নিক। আমার ভালবাসতে না পারার যন্ত্রণা তীব্র হোক।  অন্তত দুএক  ফোটা সকাল পাক কাদম্বরী সেন। ভেতরের দিঘটা গভীর হোক। নির্ঝরের জন্য প্রতীক্ষা থাক অনিবার্য হয়ে। কিন্তু আমার  তো তোমার মত একাকীত্বের ঐশ্বর্য নেই। আমাদের একাকীত্বকে, কষ্টের গৌরবকে প্রতিমুহূর্তে  ঠুকরে খাচ্ছে  আমাদেরই আরোপিত স্মার্টনেস।  কি করে ফিরবে এযুগের কাদম্বরীরা ?  কতটা বিষ জমালে তবে নির্বাসন ?