Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts

Thursday, 14 January 2021

ভাস্কর পাল,প্রবন্ধ,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


 

বয়সসীমা, নাকি মানসিকতা

মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে ঠিক কোন পরিবর্তনের দিকে জোর দিতে হবে আমাদের?

==============================================================



অষ্টাদশ শতকে নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট যে গভীর ভাবনা উপলব্ধি করে বলেছিলেন - ‘Give me an educated mother, I will give an educated nation’ আজ ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসে এসে আমাদের মনে হল দেশের মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন। মেয়েদের বিয়ের বয়স চিন্তাভাবনায় দেশ স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আবার নিয়ে এসেছে নারীর মর্যাদা ও তাঁর সম্পর্কে রাষ্ট্রের ভাবনা প্রসঙ্গ।বিয়ের ন্যূনতম বয়স,বিশেষত মহিলাদের জন্য এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেযে আইন এখন নির্ধারিত রয়েছে সেই অনুযায়ী বিয়ের সর্বনিম্ম বয়স ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১বছর এবং মেয়েদের জন্য ১৮বছর। যদিও ধর্মীয় এবং সামাজিক রক্ষণশীলদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে এই আইনকে। অনেকাংশের আবার মত বয়সের ক্ষেত্রে আইনের উচিত লিঙ্গ-নিরপেক্ষ থাকা। ভারতীয় ম্যারেজ আইন, ১৮৭৫ অনুসারে ১৮ বছর বয়সকে বিবাহের ন্যূনতম বয়স হিসেবে ধরা হয়েছে।

বিগত কয়েক সহস্রাব্দে ভারতীয় নারীর অবস্থা বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে তাদের অবস্থার অবনতি আর কয়েকজন সমাজসংস্কারকের প্রচেষ্টায় তাঁদের সমমর্যাদার অধিকারে উত্তরণের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নারীর অধিকারের অর্ন্তভুক্ত মূল বিষয়গুলি হল সাম্য,মর্যাদা। আজও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা লিঙ্গবৈষম্য ও অপরাধের শিকার।

বৈদিক যুগের আদিপর্বে নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার ভোগ করেছে। পতঞ্জলি বা কাত্যায়ণের মতো প্রাচীণ ভারতীয় বৈয়াকরণের লেখা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে আদি বৈদিক যুগে নারীরা শিক্ষিত ছিলেন। ঋক বেদের শ্লোক থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে নারীরা পরিণত বয়সে বিবাহ করতেন এবং সম্ভবত স্বয়ম্বরা নামক প্রথায় নিজের স্বামী নির্বাচনের বা গান্ধর্ব বিবাহ নামক প্রথায় সহবাসের স্বাধীনতা তাদের ছিল। ঋক বেদ, উপনিষদের মতো আদি গ্রন্থে বহু প্রাজ্ঞ ও ভবিষ্যদ্রষ্টা নারীর উল্লেখ আছে, গার্গী ও মৈত্রেয়ী তাঁদের নাম আমরা জানি

মধ্যযুগীয় ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থার ভীষণ অবনতি ঘটে এবং বাল্যবিবাহের প্রচলন ও বিধবাদের পুনর্বিবাহের নিষেধাজ্ঞা ভারতে কিছু সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গেই ভারতীয় সমাজে পর্দা প্রথার প্রচলন ঘটে। রাজনৈতিক কারণে হিন্দু ক্ষত্রিয় শাসকদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল।

ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে নারী সম্পর্কে ধারনা অনেকটাই দুর্বল সংস্কারগ্রস্ত পুরুষ নির্ভর পরিবার সত্তা রূপেই ছিল। পরিবারের উন্নতির কথা ভেবেই মেয়েদের জন্য অন্তঃপুরের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সংস্কারপন্থী নব্য শিক্ষিত পুরুষেরা পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে সংগ্রাম করে বাইরের পৃথিবীতে মেয়েদের পরিচিত করে তুলতে চাইলে উনিশ শতক থেকেই অন্তঃপুরের আগল মুক্তির সূচনা হয়। পরবর্তীতে সতীদাহ রদ, বাল্য বিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ আইন তৈরি হল। জনচেতনা বৃদ্ধির ফলে নারীদের উপর থেকে সামাজিক ব্যভিচারের দায়ভার অনেকটাই কমে গেল।1876 এ কাদম্বিনী বসু উচ্চ শিক্ষার জন্য আবেদন করলেন। উনিশ শতকে উচ্চবিত্ত শ্রেণী ইউরোপীয় বিদুষী নারীকে যেরূপ সর্ব গুণান্বিত দেখে এলো বাঙালী মেয়েদেরও তেমনি মেমসাহেব মডেলে গড়ে তুলতে আগ্রহী হলো।

1913 য় শরৎচন্দ্রের “নারীর মূল্য” যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখনও মেয়েদের আপন কথা আপন ভাষায় প্রকাশ করা খুব সহজ ছিল না। আশাপূর্না দেবী যে প্রক্রিয়ার সূচনা দেখেছিলেন,আধুনিক কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত চেয়েছিলেন পুরুষ সর্বস্ব এই পৃথিবী উভলিঙ্গ হোক সেই সময় লেখিকা মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় নারী আন্দোলনের ইতিহাস ও নারীবাদ শীর্ষকে লিখলেন  “সমাজ এতটুকু বদলায়নি, বরং যে সব সুযোগ সুবিধে এখন আমরা পাই  যেমন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া, চার দেওয়ালের বাইরে পা বাড়ানো , বিশাল বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা,শিক্ষার অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সেগুলি আমাদের পূর্বসূরীরা অনেক লড়াই করে অর্জন করেছে। সেই পথিকৃৎ দের পথ বেয়েই এযুগের মেয়েরা মেয়েমানুষ থেকে মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে পৌছেছি"

প্রবাহমান সময়েও বাল্যবিবাহ এবং নাবালিকাদের উপর অত্যাচার এবং তার অতীত সেই ঘটনা রুখতেই বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, আইনে ১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে তাঁকে অবৈধ ঘোষণা করার কথাও বলা রয়েছে। যদিও বাল্যবিবাহকে এখনও আইনানুযায়ী অবৈধ ঘোষণা করা যায়নি।

একথা ভাবতে খুব অবাকই লাগে যে আইনে পুরুষ এবং মহিলাদের বিবাহের জন্য বয়স কেন আলাদা হবে এর কোনও সঠিক যুক্তি নেই। আইনের বেশ কিছু নীতি এবং ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী এই বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে।

বর্তমানে উদ্বেগজনক ভাবে শিশু মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়া ও সাথে মেয়েদের শারীরিক সমস্যার কথা ভেবেই এই আইন বদলানোর বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখা হচ্ছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক গর্ভাবস্থার ঝুঁকি কমাতে নারীদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স বাড়ানোর পক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে। প্রথম পর্যায়ের গর্ভাবস্থা শিশু মৃত্যুর হারের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং মায়ের স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে।

যদি বায়োলজিক্যাল ভাবনায় একজন নারীকে আমরা জানতে চাই তাহলে নারীর দেহ হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি, গোনাড, ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি নিয়ে অন্তক্ষরা প্রজননতন্ত্র গঠিত।  সত্যিকারের বয়ঃসন্ধিকে কেন্দ্রীয় বয়ঃসন্ধি হিসেবে অভিহিত করা হয়, কারণ কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে এই পরিবর্তন শুরু হয়।

মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশ জিএনআরএইচ হরমোন ক্ষরণ শুরু করে এবং এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোন ক্ষরণ শুরু হয়, এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোনের প্রভাবে যথাক্রমে ডিম্বাশয় ও শুক্রাশয় কাজ করা শুরু করে। সেই সাথে এরা যথাক্রমে এস্ট্রাডিওল ও টেস্টোস্টেরন উৎপন্ন করা শুরু করে, শরীরে এস্ট্রাডিওল ও টেস্টোস্টেরনের বৃদ্ধি ঘটায় মেয়ে ও ছেলের মাঝে বয়ঃসন্ধিকালীন বৈশিষ্টগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।স্বাভাবিক ভাবেই  আঠারোর আগে শারিরীক ও মানসিক কোন দিক দিয়েই একটি মেয়ে বিয়ে এবং গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয় না। আঠারো বছরের আগে যদি মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় তখন তার প্রপার গ্রোথ হয় না। এক্ষেত্রে গর্ভধারণ করলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির শঙ্কা থাকে। যেটি শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি করে। দেখা যাচ্ছে বাল্য বিবাহ মেয়েদের স্বাস্থ্যে সমস্যার পাশাপাশি শিশু মৃত্যুরও অন্যতম কারণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গর্ভকালীন 37 সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে বা 259 দিনেরও কম সময়ের পূর্বে জন্মগ্রহণ করা শিশুকে প্রিম্যাচিওর কথা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। বিশ্বজুড়ে ২০১০ সালের সমস্ত জীবিত জন্মের আনুমানিক ১১.১% প্রিম্যাচিওর জন্মগ্রহণ করেছিলেনপ্রিম্যাচিওর শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই পূর্ণ-মেয়াদী বাচ্চাদের চেয়ে অনেক ছোট এবং অনেক ওজন দুই পাউন্ডের চেয়েও কম। জন্মের আগে জন্মগ্রহণ, শিশুর অন্যান্য কারণের কারণে মারা যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়ায়, বিশেষত প্রসবকালীন জন্মের সাথে নবজাতক সংক্রমণ থেকে সমস্ত নবজাতকের মৃত্যুর কমপক্ষে ৫০% ঝুঁকির কারণ বলে মনে হয়।

বর্তমানে অনেকটাই বদলেছে বাংলার কিশোরীদের মানসিকতা। অনেক দৃঢ় হয়েছে তাদের চিন্তা। নিজের পায়ে স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ের কথা মাথাতেই আনছে না তাঁরা। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগেও তাদের বিয়ের কোনও ইচ্ছাই নেই। যেখানে সারা দেশে নাবালিকা ও কিশোরীদের বিয়ে দিয়ে পরিবারের লোকজন দায় ঝাড়তে চাইছে, সেখানে বাংলার ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। সবুজসাথী, কন্যাশ্রী ও মাধ্যমিকের আগে ও পরে স্কলারশিপের ফলেই এই পরিবর্তন বলে মনে করা যায়  আমাদের ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ,কেরল, তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ নারী উন্নয়নে এগিয়ে রয়েছে সবথেকে পিছিয়ে আছে মধ্যপ্রদেশ। নানহি কলি নামক এক সংস্থার করা সমীক্ষায় যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সেখানে দেখা গেছে জেলার ৫৪ শতাংশ এবং কোলকাতার ৭৫ শতাংশ কিশোরী ঋতুকালীন সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নেয়। দেশের ৬০০ টি জেলায় এই সংস্থা কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট তৈরী করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে কোলকাতার ১৩ থেকে ১৯ বছরের মেয়েদের প্রায় ১০০ শতাংশ পড়াশোনা করছে। যেখানে দেশের গড় ৮০। চাকরি করতে আগ্রহী কোলকাতার ৫৯ ও পশ্চিমবঙ্গের ৭১ শতাংশ কিশোরী।

যুগের পরিক্রমায় নারী শিক্ষার গুরুত্ব বর্তমানে অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। নারীর অবস্থান সমাজে চিরকাল ধরেই অবহেলিত। নারীর এই অবস্থান থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা অর্জন করে নারী তার নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে, স্বাস্থ্য সচেতন হবেতাই নারীর উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক উপাদান হলো নারী শিক্ষা।

নারীকে স্বাবলম্বী হতে হলে কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। কেননা কর্মসংস্থানই নারীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে। নারীর জন্য যুগোপযোগী কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারের একটি পরিবারের সুরক্ষায় একজন শিক্ষিত নারী একটি সুরক্ষিত দুর্গের মতো কাজ করে। কারণ একজন সুশিক্ষিত নারী স্বাস্থ্য সচেতন। একজন সুশিক্ষিত নারী সুরক্ষিত পরিবারের জন্য খুবই প্রয়োজন।

সন্তান জন্মের পর থেকে মায়ের সংস্পর্শেই বেশির ভাগ সময় থাকে। মায়ের আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা সব কিছুই সন্তানকে প্রভাবিত করে। মায়ের হাতে সন্তানের শিক্ষার প্রারম্ভিক আবর্তন। মা যদি শিক্ষিত হন তাহলে সন্তান অবশ্যই শিক্ষিত হবে। একজন নারী শিক্ষিত হওয়ার অর্থ ওই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে ওঠা।

তাই স্বাভাবিক ভাবেই নারীকে সঠিক মানসিকতায় শিক্ষিত করে এবং শরীর ও স্বাস্থ্যের পরিপূর্ণতা এনেই বিয়ের ভাবনা প্রবাহিত করতে হবে। বর্তমানে একটি সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্য জানিয়েছে বিবাহের জন্য ২৩ বছর হল আদর্শ সময় । এই সময়ে একজন শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে পরবর্তী প্রজন্ম কে ধারণ করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলার জন্য । এক্ষেত্রে দায়িত্ব শুধুই নারীর নয় এই দায়িত্ব সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের,এই দায়িত্ব সমাজের সর্বোপরি দেশের। প্রয়োজন সঠিক আইন যে আইনের ভেতর আইনের ফাঁক থাকবেনা ।তবেই এই বিশাল জনসমষ্টিকে শিক্ষার মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া বর্তমানে সময়ের দাবী। নারীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করলে দেশ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 ছবিঃ মঙ্গলদীপ সর্দার

Tuesday, 6 October 2020

প্রসঙ্গঃ বিদ্যাসাগর, কানাইলাল জানা , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


প্রসঙ্গঃ বিদ্যাসাগর

 

তাঁর জন্মের দুশ বছর পর,জন্ম মাসের শেষ দিনে কিছু কথা।  বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে মিথ থাকবেই। দুটির কথা বলব , সঙ্গে আরো কিছু প্রসঙ্গ। 

(১) যখন আমি ছাত্র, কলকাতা সহ ভিন্ জেলার মানুষজনকে বহুবার বলতে শুনেছিঃ
লেখাপড়ায় তো ভাল হবেই কারণ  তোমরা যে বিদ্যাসাগরের জেলার লোক। ' বিস্মিত হয়েছি কিন্তু উত্তর দিইনি। 1828 সালে আট বছর বয়সে ঈশ্বর চন্দ্র যখন কলিকাতা পাড়ি দেন তখন বীরসিংহ গ্রাম তথা ঘাটাল হুগলি জেলায়। 1872 সালের জুন মাসে ঘাটাল ও চন্দ্রকোণা থানা যখন মেদিনীপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত হয় ,বর্ণপরিচয় প্রকাশ ও অন্যান্য যুগান্তকারী সংষ্কার ততদিনে বিদ্যাসাগর সেরে ফেলেছেন যার সুফল যে কোনো বাঙালি পেতে পারে। আমাদের জেলা পূর্ব মেদিনীপুর যে শিক্ষার শীর্ষে আছে্‌ , মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোলে বোঝা যায়।তার কারণ  এই জেলার ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান। শিল্প নেই,  যেটুকু আছে হলদিয়ায়, তার সুযোগ সুবিধা এই জেলার মানুষ পেয়েছে অতি অল্প। বরং এই জেলার ছেলেমেয়েদের দুবেলা পড়তে বসার অভ্যেস আছে, তার ওপর আছে শিক্ষক ও অভিভাবকদের দায় দায়িত্ব যা এখন হয়ে গেছে পরম্পরা। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী এই  জেলায় বিরাজ করে এক শান্ত পরিবেশ ( স্বাধীনতা সংগ্রামের  কাল বাদে) যা লেখা পড়ার ক্ষেত্রে  খুবই উপযোগী। 

(২) বিদ্যাসাগরের দামোদর নদ সাঁতরে পার হওয়াঃ
দামোদর নদ কিন্তু যে কোনো নদীর থেকে আলাদা। বয়স্ক অজগর যখন একটি ছাগল গিলে  হজম হতে না হতে আবার একটি  বাছুর গিলে ফেললে যেমন সরু মোটা হয় তার দেহ, তেমনি দামোদর সারা পথ সরু প্রশস্ত সরু প্রশস্ত আবার সরু আবার প্রশস্ত এভাবে তার দেহ সৌষ্ঠব। 
 ফোর্ট উইলিয়াম অধ্যক্ষ জন মার্শালের কাছে ছুটি মঞ্জুর হতে দুপুর। ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে কেনা ধুতিশাড়ি কিছু টাকা পয়সা ও দ্রব্য সামগ্রী মিলে ব্যাগটি নেহাত খুব ছোটো নয়, কানা দামোদর পার হয়ে যখন চাঁপা ডাঙায় হাজির হন ঘোর বর্ষায় উত্তাল দামোদরে নৌকো চলাচল বন্ধ। এখানে নদী বেশ সরু বলে স্রোত বেশি। পদাতিক ঈশ্বর চন্দ্র দক্ষ সাঁতারু কিন্তু ব্যাগপত্র নিয়ে ভয়াল নদ পার হওয়া অসম্ভব। আরামবাগ হয়ে বাড়ি পৌঁছোতে মাঝরাত। সম্ভবত মাতৃভক্তির মহিমা প্রচার করতে বিদ্যাসাগর জীবনীকার চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বর পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের কথা শুনে লিখেছেন। তাঁর থেকে অনেকে। 
এই দুটো বিষয় বাদ দিলে কিসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও মুগ্ধতা, ঋণ? একে একে বলি দুই পর্বে। 
(ক)  মনীষীদের মধ্যে বিদ্যাসাগরই একমাত্র প্রান্তিক মানুষ কলকাতায় এসে প্রথমে বড়বাজারে রাইমণির স্নেহ পরে জানবাজারের রাসমণির আজীবন (মৃত্যু 1861)  সাহচর্য পেয়েছিলেন, যা তিনি কোনোদিন  ভোলেননি। এদিকে সৎসঙ্গ না পেয়ে পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের কী হাল হল? বীরসিংহ গ্রামে  ঠাকুরদার লাগামহীন শাসনে থেকে বেয়াড়া বন্ধুদের সঙ্গে   মিশে জীবনকে এমনই বিপদজনক  করে তুললেন যে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করে ছাড়লেন বিদ্যাসাগর। সম্পত্তির ভাগ পর্যন্ত দেন নি। নিজের কাছে রাখলে তা একেবারেই হত না: (২) ঈশ্বর চন্দ্র যে হিন্দু কলেজে ভর্তি হতে পারেননি ( তাঁর বাবার মাসিক আয় যেখানে ১০ টাকা,হিন্দু কলেজের মাসিক বেতন ৫ টাকা) সেটা হয়তো আমাদের জন্য সৌভাগ্য কারণ ডিরোজিয়ান হালচাল সামলে বিদ্যাসাগরের এতোটা মৌলিক থাকাটা ছিল বেশ কঠিন। 
(৩) বোধোদয় -এ তাঁর ঈশ্বর ভাবনাঃ বিশ্বব্রহ্মান্ডের সব বস্তুই পদার্্‌  যা তিন রকম -চেতন, অচেতন -উদ্ভিদ। ঈশ্বরের জন্ম চেতনায়,তাঁকে কেউ দেখতে   পায় না। অসাধারণ এই বিশ্লেষণ অন্তত আমার কাছে। 
(৪)ছাপাখানা  স্থাপনঃ বটতলার কুরুচিপূর্ণ বইর ঠেক ছিল  চিনাবাজারে।কিন্তু বিদ্যাসাগর বুঝলেন ,কলেজ  স্ট্রিটই হবে আগামী দিনের প্রকৃত বইবাজার। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার কে সঙ্গে নিয়ে কলেজ স্ট্রিটে খুললেন ছাপাখানা সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটর  সেই ১৮৪৭ সালেই। 

(৫) তেলা মাথায় তেল না দেওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণঃ ১৮৬৬ সালে  নিজের গ্রামে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে অন্নসত্র খোলার পর দেখা গেল যারা  খেতে বসেছে তাদের মধ্যে অনেক দুঃখী মেয়ের মাথার 
চুল উস্কো খুস্ক্‌ তেল নেই বলে। 
তিনি মাথায় মাখার তেল দিলেন। ছোঁয়াচ এড়িয়ে তেল দেওয়া হচ্ছে  দেখে নিজেই কারু কারু মাথায় মাখিয়ে দিলেন। 
(৬) যুক্তি যুদ্ধের সেরা সৈনিকঃ দেশে দেশে মুক্তি যুদ্ধ হয় কিন্তু বিদ্যাসাগরের শক্তি ক্ষয় হয়েছে অনবরত যুক্তি- যুদ্ধে যুক্ত থেকে। শুধু তো রাধাকান্ত দেব ও তাঁর দলবল নয়, বংকিমচন্দ্র -ঈশ্বর  
গুপ্ত- হরপ্রসাদ  শাস্ত্রী-ভূদেব মুখোপাধ্যায় -রমেশ চন্দ্র দত্ত- কৃষ্ণ কমল ভট্টাচার্য এবং কে নন ,যিনি বিদ্যাসগরকে আক্রমন করেন নি? 

 
 
এবার শেষ পর্ব। 
 

(১) মহাত্মা গান্ধীর জীবনে বিদ্যাসাগরের প্রভাবঃ
বিশ বছরের বেশি ( ১৮৯৩-১৯১৫) দক্ষিণ   আফ্রিকায় কাটিয়েছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। শেষ দুবছর প্রবাসী ভারতীয়দের অধিকার অর্জনে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে যখন শ্বেতাঙ্গ সরকার   ঘোষণা করল ইন্ডিয়ান রিলিফ আইন- ১৮১৪। 
১৯১৫ সালে দেশে ফেরার পথে জাহাজে বসে কতকিছু ভেবেও ঠিক করতে পারলেননা পরবর্তী কর্মসূচি। বোম্বাইতে নেমেই ছুটলেন গুরু গোপাল কৃষ্ণ গোখলের কাছে। (গোপাল কৃষ্ণ মহামতি ,তাই বলে তিনি কখনোই বলেননিঃ What Bengal thinks to-day India thinks to-morrow.  তিনি বলেছিলেনঃ What educated Indians think to-day, the rest of Indians to-morrow.  ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ আন্দাজ করলেন বাঙালিদের মতো শিক্ষিত আর কারা? তিনিই প্রচার শুরু করে দিলেন ,যেটা সব বাঙালি বলে তৃপ্তি পান আজও। 
গুরু শিষ্যকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য বললেনঃ মোহন তুমি বিয়ে করলে বড্ড কম বয়সে (১৩) । তাও স্ত্রী তোমার থেকে বড়ো, আইন ব্যবসায় ব্যর্থ, হাতের অক্ষরও বেশ খারাপ। শারীরিক ভাবেও দুর্বল। এদিকে দেখ বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা রাজপত রাই, ,সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিরা এগিয়ে রয়েছেন কতো বিপুল বিক্রম ও তেজ নিয়ে। এঁদের ওপরে যদি যেতে চাও তবে নতুন  কিছু পথ উদ্ভাবন করতে হবে নিজেকেই। ঐ বছরই মৃত্যু হয় গুরুর । 
নাটাল  প্রদেশ ও অন্যত্র যে করমচাঁদ গান্ধী কোট প্যান্ট পরতেন, মনে পড়ে গেল ১০ বছর আগে তাঁর বাংলার বিদ্যাসাগরের ওপর লেখা প্রবন্ধের কথা,   যেখানে তিনি সোৎসাহে উল্লেখ করেছেন  খাদির ধুতি চাদর পায়ে চটি মাথায় টিকি বিদ্যাসাগরের সরল জীবন যাপনের কথা।  পেয়ে গেলেন তিনি আগামী দিনে কী পোষাক হবে তার পরিষ্কার আভাষ।
: (২) তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য রকমের পদাতিকঃ 
তখনো তৈরি হয়নি ৬নং জাতীয় সড়ক। বীরসিংহ গ্রাম থেকে ঘাটাল ও আরামবাগ হয়ে হেঁটে কলকাতায় যাতায়াত তাঁর কাছে ছিল এক অনায়াসসাধ্য ব্যাপার। কলকাতা থেকে অম্বিকাকালনা,যাদবপুর, হাওড়া ২৪ পরগণা এবং আরো কতো জায়গায় হেঁটেই যেতেন অধ্যাপকের খোঁজে ও অন্য কাজে। মা ভগবতী দেবী কাশীতে মারা গেলে ( ১৮৭১) উপস্থিত থাকতে পারেননি,   তাই পরবর্তী এক বছর খালি পায়ে হেঁটে হেঁটেই সারা কলিকাতা   কাজকর্ম সারতেন। 
(৩) তাঁর হিন্দি শেখাঃ 
এতো ব্যস্ততার মাঝেও হিন্দি শিক্ষক রেখে হিন্দি ভাষা জানা ও আয়ত্ব করাও এক মূল্যবান বিষয় ।  না হলে কিন্তু এভাবে হিন্দি থেকে অনুবাদ করা যায় না 'বেতাল পঞ্চবিংশতি।  যদিও রেভারেন্ড কৃষ্ণমেোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে  আবার কিছু সংশোধন করার পর তা পাঠ্য পুস্তকের মর্যাদা পায়। 
(৪) অপরিমেয় তাঁর সহ্যশক্তিঃ
বিধবাবিবাহ প্রচলনে খুশি হয়ে শান্তিপুরের তাঁতিরা শাড়ি বুনলেনঃ'বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে '। তখন কলিকাতার  কবিকুল পাল্টা দিলেনঃ 'শুয়ে থাক্ বিদ্যাসাগর চিররুগি হয়ে। ' বিদ্যাসাগর কিন্তু কাউকেই আক্রমণ করেননি শুধু চেয়ে চেয়ে  দেখলেন। 
(৫) তাঁর ব্যর্থতা ও আক্ষেপঃ
বহুবিবাহ ও গৌরীদান (বাল্যবিবাহ) রদ করতে কতো পরিকল্পনা ও শ্রম উজাড় করে দিয়েছেন কিন্তু  আইন যে তিনি চালু করতে পারেননি তার জন্য শুধু বিরোধীরা দায়ী নন । সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংল্যান্ডের রানি নিজ হাতে শাসন ব্যবস্থা নিয়ে নিলে কোম্পানির লোকজন কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের চাকরি বাঁচাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদেশের আচার বিচার নিয়ে আর ভাবিত নন। এ দুঃখ বিদ্যাসাগরের থেকেই গেল আমৃত্যু। 
(৬) শেষ জীবন কর্মাটাঁড়ে বসবাসঃ
বর্ণপরিচয় প্রকাশ যদি বাঙালি জাতির জন্য তাঁর শ্রেষ্ঠ নির্মাণ হয় তবে কর্মাটাঁড়ে শেষ জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর সঠিক ও মৌলিক নির্বাচন। এখন দেখে নেওয়া যাক্ কেন মৌলিক। 
গ্রামে তিনি শেষ ১৯ বছর যাননি, সম্পত্তি ও প্রেস নিয়ে ভাইদের সঙ্গে কোর্ট কাচারি, ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা, মার ওপর অভিমান । যখন স্ত্রী দীনময়ী  স্লেট খড়ি নিয়ে বসলেন শিক্ষারম্ভ করবেন বলে, ভগবতী দেবী বেঁকে বসলেনঃ 'তাহলে সংসারে আমি একাই শুধু খেটে মরি '।  স্ত্রী দীনময়ী-র সঙ্গেও দূরত্ব রচনা হল যখন ত্যাজ্যপুত্র নারায়ণ চন্দ্র নিজেই মত দিলেন যে বিধবাবিবাহে তিনি রাজি। বিধবাবিবাহ চালু নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও বিরোধ। ভাই শম্ভুচন্দ্রের মেয়ের বিয়েতে হঠাৎ পাত্রের বাবা বেঁকে বসলেনঃ 'এই বিয়েতে সম্মতি নেই কারণ আপনার দাদাতো বিধবাদের বিয়ে দেন।' শম্ভুচন্দ্র বিয়ে সারলেন মিথ্যে বলে যে ' দাদার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। '
কলিকাতায় এলিট-সমাজ তো তির ছুড়েই চলেছেন। এমনকি মাইকেল মধূসূদনের ব্যবহারেও আহত হলেন। মাইকেল মধুসূদন ফ্রান্স থেকে ফিরে যাতে ভালোভাবে থাকতে পারেন , তার জন্য তিন তলা বাড়ি ভাড়া করেন। ঠিক ভাবে যাতে ব্যারিস্টারি করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে দশ হাজার টাকা ধার করেন।  বিদ্যাসাগর একবার  খামের ওপর  বাবু মধুসূদন দত্ত লিখে তাঁকে চিঠি পাঠান। । এই অপরাধে মধুসূদন চিঠি ফেরত পাঠালেন প্রেরকের হাতে। 
৬০ টি বিধবাবিবাহ দিতে ধার হল আশি হাজার টাকার বেশি। বর সেজে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে  টাকাপয়সা হাতিয়ে কতজন যে কতভাবে হেনস্তা করলো বিবাহিত  বিধবাদের! তাতে খুবই মর্মাহত ও বিপর্যস্ত  হলেন তিনি। উপলব্ধি, করলেন  গ্রামে কিংবা কলকাতায়  নিজের বলে কেউ পাশে নেই। 
এমন অবস্তায় শেষ দুদশক তিনি সাঁওতাল পরগণার কর্মাটাঁড়ে জমি ও বাড়ি কিনে 'নন্দনকানন 'এ বেশ ছিলেন। আমার ব্রহ্মপুরের বাড়ির পেছনে ইট ভাটার মালিক কিছু সাঁওতাল এনেছিলেন এক সময়। এখনো বয়স্ক সাঁওতালদের সরলতা দেখে  অবাক হই, তাহলে দেড়শ বছর আগে সাঁওতাল পরগণার সাঁওতাল ও অন্যান্য জনজাতি যে সরল জীবন যাপন করতো তা ধ্রুব সত্য। বিদ্যাসাগর তাদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে, কলেরার চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রূষা করে বাঁচিয়ে, নিজ হাতে গড়া আম বাগানের আম ও নানা ফল খাইয়ে ও বিতরণ করে দেহ মনে স্নেহের হাত বুলিয়ে তিনি যে তাদের নিজের লোক হয়ে বাঁচলেন তা ভাবতেও ভালো লাগে।

Saturday, 3 October 2020

পারমিতা মালী, প্রবন্ধ, একটি রূপকথার কাহিনী, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 

 


 

 একটি রূপকথার কাহিনী 


      
                 

         তারপর হলো কি, খৃষ্টজন্মের দেড় থেকে দুই হাজার বছর আগে, এক শ্রাবণ মাসের ঝড়জলের রাতে একটি খোকা হলো। রাজার ঘরের ছেলে। সে ছেলের ভবিতব্য ছিলো মরেই যাওয়া। কিন্তু কপালে মৃত্যু না থাকলে কার সাধ্য তাকে মারে? ওই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য গোপনে প্ল্যান ছকা হয়ে গেছিল। বেশ কিছু রাজ কর্মচারী এক নিশ্ছিদ্র শলা করে শিশু অদলবদল করে ফেললো জন্মের ঠিক কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। কাকপক্ষীতেও টের পেলো না। বদলিতে যে শিশুটি এলো, সে ফরসা, চোখা চোখা নাকমুখের সুন্দর দেখতে একটা কন্যা। যাতে লোকের সন্দেহ না হয়। যাতে রাজার মেয়ে বলে সহজেই বিশ্বাস হয়ে যায়। আর ছেলেটি হাওয়া হয়ে গেলো রাতারাতি। বড় হলো নিশ্ছিদ্র এক সুরক্ষিত ঘেরাটোপে। এমনটা আমাদের অনেক হয়। রাজাগজাদের জন্য বলি যায় বহু গরীব। 


               এবার ধীরেধীরে বড় হচ্ছে সে ছেলেটি। একটি শ্যামবর্ণ ছেলে, যে তার রূপ গুণ আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মোহিত করে রেখেছে চারপাশ।  একটা গোটা যুগকে দুই কাঁধে বহন করেছে এসেছে। আর আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি তাকে। একটা মানুষ গোটা জীবনে যে এত কিছু করতে পারে, এটা অসম্ভব ছিলো আমাদের চোখে। তার জীবনরহস্য  বিশ্বাসযোগ্য হয়নি আমাদের । আর তাই লোকে বার বার তাকে দেবতা ভেবেছে। 

             যে দেশে,যে সমাজে প্রেমের ওপর চোখ রাঙানি এসেছে , যে দেশে এখনো খাপ পঞ্চায়েত আছে, সেই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সে ছেলে কি করে এমন করল? বয়সে বড়ো অগম্যা এক নারীর প্রতি এমন খুল্লমখুল্লা প্রেম?  একি মানুষের সাধ্য? নির্ঘাত এ কোনো দেবতা।    
          এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে এ ছেলেটির নাম পরিচয়। হ্যাঁ, আমি  কৃষ্ণ, বাসুদেবের কথাই বলেছি। 
               তাঁর ওপর  বার বার দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায় পরেছিলেন দেবত্বের মুকুট।  নিজে হাতে তিনি কুরুক্ষেত্রের ঘুঁটি সাজিয়েছেন, গোটা আর্যাবর্তের রাজনীতির নিয়ন্ত্রন করেছেন একা হাতে, আর তারপর এক দু পয়সার ব্যাধের তীর খেয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে মরে পড়ে থেকেছেন। কি অদ্ভূত এই বৈপরীত্য!  দেবতা হলে কেউ এমনভাবে মরে? অন্তত কিছুটা রহস্য করে তো মরতে পারতেন!  গ্যাংগ্রিন কিন্তু এখনো ঘাতক রোগ। সুতরাং দু হাজার বছর আগে এ রোগ হলে মৃত্যু হবে,সেটাই স্বাভাবিক। 
         

        তাঁর কাজের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা আছে, কিন্ত দেবত্ব নেই কোত্থাও। কিন্তু ভক্তিবাদী  মন তা মানে না। এতো ক্ষমতা নিয়েই যদি কেউ জন্মাবে,তাহলে অন্তত মানুষ নয়, দেবতা হয়েই জন্মাক !  তাতে অন্তত মন কে চোখ ঠারা যায়! কৃষ্ণ তাঁর যৌবনের প্রথম দিন থেকে শুধু নিয়ম ভেঙে গেছেন একের পর এক। তা এমন নিয়ম ভাঙা লোক কি ইতিহাসে আসেনি?নাকি তাঁদের এমন তুখোড় বুদ্ধি ছিলো না? তা তাঁরা যদি দেবতা না হন,খামোকা কৃষ্ণই বা দেবতা হতে যাবেন কেন? পর্দা সরিয়ে ওই ঝকঝকে আকর্ষনীয় পুরুষটিকে আর একবার খুঁজে দেখলে কেমন হয়?


            গোপ জাতিরা পেশায় দুধ বিক্রেতা। এই তাদের রুটিরুজি।  সহজ সরল কিছু গ্রাম্য মানুষের মধ্যে বড় হচ্ছে দুটি ক্ষত্রিয় ছেলে। যুদ্ধ যাদের জিনে। বছরের পর বছর তাদের পূর্বপুরুষেরা কতরকম অস্ত্রবিদ্যা চর্চা করেছে।   তীরচালনা, ভল্ল, গদা, তলোয়ার,  রথচালনা এসব তাদের নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতন কাজ। সেই বংশের ছেলেদের বাগে আনা কি সামান্য গোপদের পক্ষে সম্ভব? তাদের চোখে তো এ ছেলে বিস্ময়ই !

          আর যারা বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, তাদের শরীর ও মনের বৃদ্ধি খুব তাড়াতাড়ি হয়। মানসিক ম্যাচিওরিটি আসে দ্রুত। এ কিশোরের রূপ তো ছিলোই, আর সাথে যোগ হয়েছিল ক্ষুরধার উপস্থিত বুদ্ধি। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করার মতো অদ্ভূত ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল সে। খুব ছোটবেলা থেকেই তার প্রখর স্মৃতিশক্তি।  দুরন্ত, বুদ্ধিমান, শক্তিমান  কিন্তু স্বাভাবিক এক বালক। গোপবালকরা আচার্যের কাছে যেত না, তাদের মধ্যে পড়াশোনার পাট নেই। তাই কানাই আর বলাইয়েরও গুরুগৃহে যাওয়া হয়নি। এমন কিচ্ছুটি করা যায় নি যা সাধারণের নজরে আসে। তবে গোপনে প্রশিক্ষণ কিন্তু শুরু হয়ে গেছিল। দামিল্য, অক্রুর  ওই বালকদের গোপনে তৈরি করছিলেন মল্ল বিদ্যায় আর ধনুর্বিদ্যায়। 

      শুধুমাত্র দ্রুত পরিস্থিতি বোঝা, আর আত্মরক্ষার এক সহজাত প্রবৃত্তি তাঁকে আলাদা করেছে অন্য সকলের থেকে। যুদ্ধকালে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে তিনি অন্যদের চোখে ধুলো দিয়েছেন বার বার। লোকের মনে হয়েছে এ ম্যাজিক। এ দৈবী শক্তি । কৃষ্ণর আর এক নাম গিরিগোবর্ধনধারী। তিনি গোবর্ধন পাহাড় নাকি কড়ে আঙুলে তুলেছেন। গল্পের গরুকে খুঁটিতে বেঁধে খুঁজলে দেখা যাবে সে সত্যিই হিরো।

              কৃষ্ণ  প্রথমবার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এই পাহাড় কে নিয়েই। গোকুলের নিয়ম ছিলো, প্রতিটি বর্ষায় ইন্দ্রের পুজো করতে হবে। ইন্দ্রদেব বৃষ্টির দেবতা। সাথে তার বজ্র-বিদ্যুৎ সহ হাবিজাবি আরো কিছু  সঙ্গীসাথী আছে। কথা না শুনলে ধনেপ্রাণে শেষ করে দেবেন তাঁরা। সোজা কথায় তোলা দিতে হবে তাদের। ঠিক সময়ে এসে হপ্তা নিয়ে যাবে। নেহি তো গব্বর আ যায়েগা। বড় ধরণের গুন্ডা অথবা দেবতা, যাই বলুন না কেন তারা আসলে তাইই। গোপবাসীদের সংসার চলে  গোরুর দুধ আর দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রয় করে। বৃষ্টির ওপর কারুর হাত নেই। তা সে যত বড় নেতাই হোক না কেন!  কিন্ত যদি যমুনা নদীর বাঁধ তুলে নেওয়া হয়? যদি গতিপথ কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রিত করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর পাড়ের গোচারণভূমি?বহতী নদী যদি হঠাৎ করে বিপুলা হয়ে যায়?ভেসে যায় ক্ষেত, বা গোচারণক্ষেত্র? তাহলে?বোকাসোকা গ্রাম্য গোয়ালাদের ভয় পাওয়াতে এই তো যথেষ্ট ! হয়তো তেমনই কিছু হয়েছিল। এই কঠিন  সময়েও কিন্তু  শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলেছিল ওই কিশোর বালক। সমস্ত ব্রজবাসী আর গাভীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল ওই গোবর্ধন পাহাড়ের গুহায় বা কোটরে। আঙুলে করে কেউ কখনো পাহাড় তুলতে পারে না। সেটা অসম্ভব। কিন্তু, ওই বিশাল জনগণকে বাঁচিয়ে ছিল,এটা তো সত্যি! ওই কিশোর মাথা নোয়ায়নি সেদিন ইন্দ্র নামক গুন্ডার কাছে!  এরপরেও সে দেবতা হবে না?  

        সেই প্রথম সে আঘাত আনে প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে,তাই ঠিক নয়।  নিজের বুদ্ধি ও পুরুষাকার যদি থাকে,তাহলে পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রনে। অন্ধ, বোকা, ভীরু, অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের সে আগলেছে বুক দিয়ে। আর এটাই তো ক্ষত্রিয়ের কাজ ! 

             কালিয় নাগ বিষাক্ত করে দিয়েছিল কালিয়াদহের জল। সেই জল খেয়ে গরুরা মারা যাচ্ছে, মাছ মারা যাচ্ছে। সে দহের আশেপাশে কেউ যেতেই পারছে না। ওটা ছিলো কালিয়র নিজস্ব  প্রপার্টি। কিন্তু সাপের বিষে কোনোকালে জলাশয়ের জল বিষাক্ত হতে পারে কখনো ? সে তো অসম্ভব!  সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী এই কাহিনী। তবে জলে বিষ মেশানো আর কি এমন কঠিন কথা! এ তো হামেশাই হয়। আর জলের মধ্যে লড়াই করে সাপকে হারিয়ে, সেই সাপের মাথায় উঠে ধেইধেই করে নাচা ?ওসব যে গপ্পকথা, সে তো শিশুরাও বুঝবে। তবে মানুষের থেকে ক্ষতিকারক বা বিষধর সাপ কি জন্মেছে এদ্দিনেও? কালিয় মানুষ হলেই বা ক্ষতি কি? বুদ্ধিমান কৃষ্ণ কি তাকে পরাস্ত করতে পারে না?  

      এইভাবে  একের পর এক শত্রু আক্রমণ থেকে গ্রামের লোকদের বাঁচিয়েছে এ কিশোর। এর পরও যদি দেবতা না হয়,তবে কাকে বলবো আমরা দেবতা? যে রক্ষা করে, সেই তো দেবত্ব পাওয়ার অধিকারী ! আর এমন পুরুষের জন্য নারীকুল পাগল হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘ নারীপ্রেমেও অবসাদ আসে বীরের। ক্লান্তিকর লাগে ওই অর্থহীন বাক্যালাপ। প্রেম তার জন্য নয়। গোটা পৃথিবী তার অপেক্ষায়। 

           এ ব্যক্তির সাথে তুলনা করতে গেলে আমার শুধু একটা লোককেই মনে পড়ে। রাসবিহারী বোস। ভারতের যুগসন্ধিক্ষনের এক অবতার পুরুষ। ঠিক অতখানিই মেধা, রূপ, গুণ, আর ক্ষমতা নিয়ে, আমাদের পরম পুণ্যবলে জন্মে গেছিলেন এই পোড়া দেশে। গোপনে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন এক বিশাল স্বাধীনতার যুদ্ধ। দেশ পেয়েছিল তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা। এর আগেপিছেও অনেক কাহিনী আছে বটে। লোকটির মেধা বটে!  অবহেলার ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোই পাস করে রেখেছিলেন কোন ফাঁকে। আমাদের কপাল খারাপ, তাই সে দেবতাকে কাছে রাখতে পারিনি। ১৯১৫ সালে, পাকাপাকিভাবে জাপান চলে যান তিনি ।  শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবি' তে যে ডাক্তারকে আমরা পাই সেও কিন্ত এই রাসবিহারীই।

       আমাদের পোড়া কপালে দেশ। বিদ্যেবুদ্ধি নেই, তাই অবতার চিনতে ভুল করি বার বার। যেখানে সেখানে বাবাজিদের পায়ে ধুপ ধাপ করে মাথা ঠুকি। আর আসল অবতারেরা রয়ে যায় অন্তরালে।  

            
                  *          *          *