Wednesday, 26 December 2018

'সাহিত্য এখন' নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ২০১৮









সম্পাদকীয়-
রোদ্দুর হতে চেয়েছিলেন কবি। বাংলা সাহিত্যের আকাশে রোদ্দুর হয়েই ছিলেন এতদিন। কবিতার ছত্রে ছত্রে আলোকপাত করেছেন সমাজের ত্রুটিবিচ্যুতির দিকে  বলেছিলেন, “যা দেখি, তাই লিখি”। নিরাসক্ত এক দর্শকের মতো চুপ করে দেখেছেন, দেখতে শিখিয়েছেন আমাদেরও।প্রয়োজনে আঙুল তুলে  সেই শিশুটির মতো দেখিয়ে দিয়েছেন, রাজা কেমন উলঙ্গ।
নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা খুঁজে পাই অসংখ্য প্রশ্ন। নির্দিষ্ট করে কোন উত্তরের কথা বলে যাননি কবি। বরং বলা ভালো, প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন। তাঁর কোন কবিতাই একমাত্রিক নয়। কবিতা কোনদিনই একমাত্রিক হয় না। প্রতিটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হয় ভাবনার বহুস্তর। তিনি যেন এক বিরাট বটগাছ। ভাবনার বীজ ছড়িয়ে দেন পাঠকের হৃদয়ে, শেকড় ছড়িয়ে দেন কবিতায়।
'কলকাতার যিশু'  আর নেই। কিন্তু তাঁর কবিতার মৃত্যু নেই। কবিতার মৃত্যু হয় না। যিশুর মতোই কবিতার ছত্রে ছত্রে পুনরুত্থিত হবেন কবি। অমর হয়ে থাকবে তাঁর কবিতারা। 
 
শিয়রে মৃত্যুর হাত
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
(নীল নির্জনে)

শিয়রে মৃত্যুর হাত। সারা ঘরে বিবর্ণ আলোর
স্তব্ধ ভয়। অবসাদ। চেতনার নির্বোধ দেয়ালে
স্তিমিত চিন্তার ছায়া নিভে আসে। রুগ্‌ণ হাওয়া ঢালে
ন্যাসপাতির বাসী গন্ধ। দরজার আড়ালে কালো-টুপি
যে আছে দাঁড়িয়ে, তার নিষ্পলক চোখ, রাত্রি ভর
হলে সে হারাবে।
                           সিঁড়ি-অন্ধকারে মাথা ঠুকে ঠুকে
কে যেন উপরে এল অনভিজ্ঞ হাতে চুপিচুপি
ভিজিট চুকিয়ে দিয়ে ম্রিয়মাণ ডাক্তারবাবুকে।

শিয়রে মৃত্যুর হাত। স্তব্ধীভূত সমস্ত কথার
মন্থর আবেগে জমে অস্বস্তির হাওয়া। সারা ঘরে
অপেক্ষা নিঃশ্বব্দ জটলা। যেন রাত্রির জঠরে
মানুষের সব ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভাসিয়ে শূন্য সাদা
থমথমে ভয়ের বন্যা ফুলে ওঠে। ওদিকে দরজার
আড়ালে আবছায়া-মূর্তি সারাক্ষণ যে আছে দাঁড়িয়ে,
নিষ্পলক চোখ তার। নিরুচ্চার মায়ামন্ত্রে বাঁধা
ক্লান্তির করুণ জ্যোৎস্না নেমেছে শয্যার পাশ দিয়ে।

শিয়রে মৃত্যুর হাত। জরাজীর্ণ ফুসফুসে কখন
নিশ্বাস টানার দীর্ঘ যন্ত্রণার ক্লান্তি ধীরে-ধীরে
স্তব্ধ হয়ে গেছে কেউ জানে না তা। ভোরের শিরশিরে
হাওয়ায় জানলার পর্দা কেঁপে উঠে তারপর আবার
শান্ত হয়ে এল। ছায়া অন্ধকার। মাঠ-নদী-বন
পেয়েছে নিদ্রার শান্তি। এদিকে রাত্রির অবসানে
সে-ও নেই। শান্তি! শান্তি! সে চলে গিয়েছে। সঙ্গে তার
কে গেছে জানে না কেউ, শুধু এই অন্ধকার জানে।


 প্রবন্ধ
 

মানবতাবাদে বিশ্বাসী জগজীবনপুরের তুলাভিটা আজও অমলিন

ভাস্কর পাল



ইতিহাসে ঘেরা এক অনবদ্য শহর মালদহ বা মালদা। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত একটি  জেলা শহর। মনে করা হয় যে  মলদনামে এক প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর নাম থেকে মালদহবা মালদানামটির উৎপত্তিআবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ফারসিমালযার অর্থ ধনসম্পদ ও বাংলা দহযার অর্থ হ্রদ বিশেষ। এই শব্দদ্বয়ের সম্মিলিত রূপ মালদহ। এই প্রিয় শহরটি আমের শহর হিসেবেও পরিচিত , আবার মসজিদের শহর হিসেবেও মালদহের বেশ পরিচিতি রয়েছে। তাছাড়া এখানকার আম, পাটের কাজ আর সিল্ক পৃথিবী বিখ্যাত।  মালদা শহরটিকে ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে রেখেছে বাংলার গর্বের দুই প্রাচীন শহর গৌড় ও পান্ডুয়া। একসময় মালদা এবং তার আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলটি পুন্ড্রবর্ধন নামেও পরিচিত ছিল। এই পুন্ড্রবর্ধন ও গৌড় গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
ঐতিহাসিক ডাঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ এই সময়ে গুপ্ত বংশীয় বুধ গুপ্ত ছিলেন উত্তর ভারতের সম্রাট , তিনি ছিলেন গুপ্ত বংশের শেষ সম্রাট বুধগুপ্তের রাজত্বকালে সোমপুর ধৰ্ম্মবিহার  গুহ নন্দী প্রমুখ  নিগ্রন্থদিগের বাসভূমি ছিল । বুধগুপ্তের পরবর্তী সময়ে কে উত্তর -ভারতের একচ্ছত্র সম্রাট হবে সেটা নিয়ে  নিদারুণ সংগ্রাম চলছিল
পরে পাল বংশ গুর্জর বংশ কে পরাভূত করে নিজ বংশের গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছিলেন এই সময়ে ছিন্ন ভিন্ন হতোদ্যম বাঙালি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে শৌর্য বীর্য ও দক্ষতার সাথে বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিল। যার যাদু মন্ত্র ছিল বৃহত্তর বাংলার ঐক্যবদ্ধ শক্তি। এই শক্তির ভিত্তি রচনা করে গিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতা শশাঙ্ক পাল সপ্তম শতকে গোপালের নেতৃত্বে পুরো অঞ্চলটিতে পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অঞ্চলটি গৌড় হিসেবে পরিচিতি পায়। এসময়ে অঞ্চলটিতে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

বাংলার ইতিহাসে পালবংশের আধিপত্যের এই চারশো বৎসর নানাদিক থেকে গভীর ও ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। বর্তমান বাঙালি জাতির গোড়াপত্তন হয়েছে এই যুগে। শশাঙ্ক যদিও শুরু করেছিলেন কিন্তু পাল আমলেই বাঙালির রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ লাভ করে বাংলা ভাষা ও লিপির গোড়া খুঁজতে হলে এই চারশো বৎসরের মধ্যে খুঁজতে হবে। এই লিপি, ভাষা, ভৌগলিক সত্ত্বা ও রাষ্ট্রীয় আদর্শকে আশ্রয় করে একটি স্থানীয়সত্ত্বাও গড়ে উঠে এই পাল যুগে।

পাল রাজাগণ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তারা নিজেরা ছিলেন বৌদ্ধ অথচ বৈদিক হিন্দু ধর্মও তাদের আনুকূল্য ও পোষকতা লাভ করেছিল। এমনকি একাধিক পালরাজা হিন্দু ধর্মের পূজা এবং যজ্ঞে নিজেরা অংশ গ্রহণ করেছেন, পুরোহিত সিঞ্চিত শান্তি জল নিজেদের মাথায় গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মে ব্রাহ্মণের নিয়োজিত করেছেন , এইভাবে পালবংশকে কেন্দ্র করে বাংলায় প্রথম সামাজিক সমন্বয় সম্ভব হয়েছিল।

পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে নালন্দা, বিক্রমশীলা, ও দন্তপুরী, সারনাথের বৌদ্ধ সংঘ ও মহাবিহারগুলিকে আশ্রয় করে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ জগতেও বাংলা ও বাঙালির রাষ্ট্র এক গৌরবময় স্থান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।এই সকলের সম্মিলিত ফলে বাঙলায় এই সময়েই অর্থাৎ এই চারশো বৎসর ধরে একটি সামগ্রিক ঐক্যবোধ গড়ে উঠে। এটাই বাঙালির স্বদেশ ও স্বজাত্যবোধের মূলে এবং এটাই বাঙালির একজাতীয়ত্বের ভিত্তি। পাল যুগের এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ দান ।

এই পরম্পরা মেনে রাজা মহেন্দ্রপাল, কুড্ডলখটকা এবং পুণ্ড্রবর্দ্ধন ভুক্তি প্রজ্ঞাপারমিতা এবং অন্যান্যদের পূজার জন্য বজ্রদেবকে দায়িত্ব দেন  বৌদ্ধবিহার গড়ে তোলার জন্য। মহাসেনাপতি বজ্রদেবের অনুরোধে গৌতম বুদ্ধের পুজো এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপাসনার জন্য রাজা মহেন্দ্র পাল মহাবিহার নির্মাণ করার জন্য ভূমি দান করেছিলেন। এই মহাবিহার পরেনন্দদীর্ঘিকা উদরঙ্গবৌদ্ধ মহাবিহার নামে পরিচিত হয়। গবেষকদের মতে, এই মহাবিহার নালন্দা মহাবিহারের থেকেও পুরনো।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে পাল শাসক মহাদেব পাল জায়গাটি বৌদ্ধদের দান করেন এবং পাল শাসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়  তৈরি এই নন্দদিঘি বিহার। এই বিহারে আবিষ্কৃত হওয়া নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমন, বিভিন্ন ধরনের পোড়ামাটির মূর্তি ও টেরাকোটার ফলক প্রভৃতি নিদর্শনগুলো মালদা মিউজিয়াম ও কলকাতার প্রত্নতাত্ত্বিক মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
নন্দদিঘি বিহার যা বর্তমানে মালদা জেলার হবিবপুর থানার বৈদ্যপুর অঞ্চলে অবস্থিত যে অঞ্চলের মাটির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের বিস্মৃত হওয়া অধ্যায় ।
মালদা শহর থেকে প্রায় ৪৬ কি.মি. দূরে অবস্থিত জগজীবনপুর পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র দেড় ঘন্টা। ওপারে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার সীমান্তের কাছেই এর অবস্থান। জগজীবনপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মহানন্দা ও ট্যাঙ্গন নামের স্রোতস্বিনী দুই নদী। হটাত আবিস্কার হওয়া তথ্যে  ইতিহাস কে নতুন করে উপস্থাপন করেছে আমাদের কাছে ।

১৩ ই মার্চ ১৯৮৭  সালের ঘটনা। “ তুলাভিটা” নামে এক জায়গার এক ব্যাক্তি  মহেন্দ্র গায়েন। তার কনিষ্ঠ পুত্র জগদীশ গায়েন ১২ ফুট উঁচু ঢিপির উপরে উঠে মাটি কাটতে গিয়েছিল , সেই সময় তার কোদালের গায়ে আঘাত লাগে একটি ধাতব বস্তুর। মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হলে দেখা  যায় সেটি একটি লম্বাটে তামার পাত, যার দুপিঠেই কিছু কথা খোদাই করা আছে।যাকে তাম্রলিপি বলা হয় । সেই তাম্রলিপিটির ওজন ১১ কিলো ৮০০ গ্রাম। লম্বায় ৫২.২ সেন্টিমিটার। চওড়ায় ৩৭.১ সেন্টিমিটার। আর ০.৫ সেন্টিমিটার পুরু। সামনের পিঠে ৪০ লাইন, আর উল্টোপিঠে ৩০ লাইন লেখা আছে সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে। নবম শতকে সংস্কৃত ভাষা লেখা হতো এই লিপির সাহায্যে। তাম্রলিপির তারিখ -- সম্বত ৭-এর ২রা বৈশাখ ( ৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ)
তাম্রলিপির উপরে লাগানো ছিলো রাজকীয় সিলমোহর। মিশ্রধাতুর তৈরি গোলাকার সিলমোহরের উপরের অংশে ছিলো সারনাথের প্রতীক, যা অবধারিত ভাবে পালযুগের রাজত্বের প্রমাণ। উপরে প্রস্ফুটিত পদ্মের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মচক্র, মাথায় ছত্র আর দুপাশে দুটি হরিণ, আর পুরো ছবিটিকে ঘিরে  রেখেছে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি। নিচে লেখা শ্রী মহেন্দ্র পাল দেব
এইসব খননকার্যের ফলে উদ্ধার করা হয়েছে নবম শতকের একটি বিশিষ্ট বৌদ্ধবিহারের অবস্থিতি। ছোট-বড় কক্ষ, বৌদ্ধস্তূপের দেয়াল ও ভগ্ন চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। পাওয়া গেছে আড়াইশোর বেশি বিভিন্ন মূর্তি-সম্বলিত পোড়ামাটির ফলক, যেখানে খোদিত আছে অবলোকিতেশ্বর, সূর্য, গরুড়, বিভিন্ন কিন্নরী ও ময়ূর। বৌদ্ধ দেবতা মরীচির মূর্তি।
মহেন্দ্রপাল দেবের তাম্র ফলক এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক দলিল। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে এটি ছিল একটি বুদ্ধ মহাবিহার। যা নন্দদীর্ঘীকা মহাবিহার নামে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলে অনেক গুলি উঁচু উঁচু ঢিবি এখনো বর্তমান। যার মধ্যে ৫মিটার উঁচু তুলাই ভিটা বা সালাইডাঙ্গা সবচেয়ে বড়। এছাড়া আখরিডাঙ্গা, নিমডাঙ্গা, রাজার মায়ের ঢিবি ও নন্দগড় উল্লেখযোগ্য। যদিও ৯৪৩২বর্গমিটার তুলাইভিটার খুব সামান্য অংশই এপর্যন্ত খনন করা হয়েছে।

খ্ৰীষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে, প্রচলিত আদিম বাংলা অক্ষরে স্তম্ভগাত্রে উৎকীর্ণ একটি  উৎসর্গ পত্র উদ্ধার হয়েছে তা  থেকে জানা যায় ত্রিরত্নের ধর্ম , বুদ্ধ ও সঙ্ঘ প্রীতি লাভের উদ্দেশ্যে একটি স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করে যা দশবলগর্ভ নামে পরিচিত ।  নন্দদীর্ঘীকা শুধু যে ইহা বৌদ্ধ বিহারে পরিণত হয়েছিল তাহাই নহে, খ্ৰীষ্টীয় নবম শতাব্দী অৰ্থাৎ পাল রাজত্ব হতে আরম্ভ করে দ্বাদশ শতাব্দী অর্থাৎ সেন বংশের শেষ পর্য্যন্ত ইহা বৌদ্ধ বিহারই ছিল। ১২০২ সালে তুর্কি সামরিক নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমণ করেন।  বাংলা তুর্কিদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন বাধা না দিয়ে নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান।  লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলায় সেন শাসন দুর্বল হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্ত বিদ্রোহের ফলে সেন রাজ্যের পতন ঘটে।  গৌড়ে মুসলমান রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার  পর যখন গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্রহণ করতে লাগিল ও উত্তর-বঙ্গ মুসলমানপ্রধান হয়ে উঠিল, তখন বোধ হয় বৌদ্ধবিহারগুলি তাহাদের প্রভাব হারাতে থাকে
এই সময় বৌদ্ধ ধর্ম ভীষণ ভাবে প্রতিমাসক্ত হয়ে পড়ে এর ফলে মুসলমানগন বৌদ্ধদিগের উপর
 নৃশংস ব্যবহার করিতে লাগিল। মুসলমানদিগের প্রবল আঘাতে বৌদ্ধগণ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে । রাজ কৃপালোভে ও ইসলামের বিশ্বাসের তেজ ও সাম্যবাদে মুগ্ধ হয়ে বহু বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে    প্রচলিত হিন্দুধর্মের সঙ্কীর্ণতা ও অন্ধত্ব গোঁড়াবাদী চিন্তা এতে   আবার ইন্ধন  যোগায় ।  এইভাবে বঙ্গদেশ তথা ভারত থেকে বৌদ্ধ ধৰ্ম্ম নিৰ্বাসিত হয়সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধবিহারগুলিও পরিত্যক্ত হয় ।
আজ থেকে কয়েক শত বছর আগে পাল রাজাদের বিচক্ষণ ভাবনায় ও সকল ধর্মের মানুষকে নিয়ে চলার যে অনুপ্রেরনা ও মানসিকতা দেখাতে পেরেছিলেন । আজ সুদীর্ঘ সময়ের চলার পথে সেই আদর্শ কে পুনঃ সিঞ্চিত করে আমরা আবারও মেতে উঠতে পারি মানবিকতার আদর্শে । এই ইতিহাসের শহর , মন্দির মসজিদের শহর কান পাতলে যেন শুনতে পাই বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি

তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া
কমল বসাক (ঐতিহাসিক)
গৌড়ের ইতিহাস, রজনী কান্ত চক্রবর্তী




কবি নীরেন্দ্রনাথ ও কলকাতার যিশু(১৩৭৬,২৪শে ভাদ্র)
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বললেই যে তিনটি কবিতা সব কবিতা-পাঠকদের  মনে ভেসে ওঠে, সেগুলি হল অমলকান্তি, উলঙ্গরাজা আর কলকাতার যিশু। কবির সঙ্গে নানা সাক্ষাৎকার পড়ে দেখেছি, এই ত্রয়ীই সব আলোচনার কেন্দ্রে বিশেষ ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এই ত্রবেণীসঙ্গম থেকে কলকাতার যিশু-কে বেছে নিলুম আজকের আলোচনায়।

       কবিতাবিষয়ক আলোচনায় কবি অকপটে বার বার বলেছেন, কবিতায় তিনি কল্পনাপ্রবণ নন। বড় মাপে কল্পনা করতে তিনি পারেন না। জীবনে চলার পথে যেখানে যতটুকু পেয়েছেন, কবিতায় তাদেরই সোজাসুজি ঠাঁই দিয়েছেন। তাই কবিতা-কল্পনালতায় তাঁর পদচারণা নেই। তবে অন্য কবিদের কল্পনাকে তিনি সমীহ করেন। এই পরিপ্রক্ষিতেই ‘কলকাতার যিশু’-কে দেখার চেষ্টা করব।

      কবির অন্যান্য কবিতার মত এখানে কোনও প্রচ্ছন্ন গল্প নেই। ধরে রাখা আছে কলকাতার একটি বিশেষ সময়কে ধরা আছে  কলকাতার চৌরঙ্গিপাড়ার একটি ব্যস্ত  রাজপথের ক্ষণিকের দৃশ্যময়তা,  কবি যাকে কবিতার চরণে নিজেই ব্যক্ত করেছেন-‘ যেন স্থির চিত্রটির মত শিল্পীর ইজেলে লগ্ন হয়ে আছে।’ আর আমরা দেখলুম – একটি অবোধ উলঙ্গ পথশিশু দুদিকে মূর্তিমান উদ্যত মৃত্যুকে উপেক্ষা করে রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে কি অক্লেশে হেঁটে চলে যাচ্ছে পথচলতি সমস্ত গাড়িকে স্তব্ধ করে দিয়ে। তার গায়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে সদ্য বৃষ্টিস্নাত রোদ্দুর! এই চিত্ররূপময়তায় পাঠক যখন ভরপুর, তখনই প্রথম স্তবক শেষ হল। জন কীটস-এর ‘ওড টু দি গ্রীসিয়ান আর্ন’ কবিতার মত বহমান সময়ের  একটি মুহূর্তকে  কবি অমরত্ব দিলেন। এই সময়টিকে আমার মত আরও যাঁরা দেখেননি, তাঁদের জন্য এক চমৎকার অ্যারকাইভ তিনি গড়ে দিয়ে গেলেন।

     
            এবার আসা যাক কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে। এখানে কবি একেবারে আ্ত্মগত। পাঠক-বৃত্ত থেকে অতর্কিতে বেরিয়ে এসে তিনি সরাসরি শিশুটির সঙ্গে একেবারে একাত্ম, যা কিছু বলছেন, তাকেই সম্বোধন করে। অন্তর্জগতের এই অবস্থানে কবির ব্যাবহৃত দুটি বাক্-প্রতিমা (ইমেজারি) আমাকে থমকে দাঁড় করায়। একটি ‘মূর্ত মানবতা’ , আর অপরটি ‘যিশু’। কল্পনার চরম উন্মেষ ছাড়া এমন ইমেজারি কিছুতেই আসেনা যে !! অনায়াসে এই কল্পনাজাত শব্দ দুটি কবিতার শেষ স্তবকটিকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেল, যে পুরো কবিতার অভিমুখ, তাৎপর্য- সব গেল বদলে।কবি আরও কল্পনা করলেন, শিশুটি সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দেই বিশ্বকে নিজের হাতের মুঠোয় ভরেছে। রাস্তার এপার ওপার নয়, পৃথিবীর এক কিনার থেকে সে আর এক কিনারে চলেছে। কবির কল্পনার এই ডানা মেলা মুন্সিয়ানার কাছে সব পাঠক মাথা নত করেছেন। ‘কবিতা কল্পনালতা’তে তিনি যে অনাস্থার কথা বলেছেন, সেটা সম্ভবত: কল্পনার অকারণ আধিক্যের বিড়ম্বনার  কথাই বলতে চেয়েছেন।  

       অন্য এক আলোচনায়  কবি একবার বলেছিলেন, কবিতা তাঁর কাছে সচেতন মনেরই প্রকাশ। কোনও অজ্ঞাত অনুপ্রেরণায় তিনি কখনও কোনও কবিতা লেখেন নি। তাই যদি হয়,  তাহলেও তাঁর কল্পনার তরী যে মোটেই ছোট মাপের নয়, তাতেও  আর সন্দেহ থাকেনা।

        কবি কোনও একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন – ‘একটা ঘটনা দেখলাম, সেটি মাথার মধ্যে গেঁথে রইল। - - - এরপর লিখতে বসলাম। আর লেখার সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবনাগুলো আমার মাথায় জড়ো হয়েছিল, ওই ভাবনার হাত থেকেও মুক্তি পেলাম। যতক্ষণ না লিখছি ততক্ষণ মুক্তি নেই, বুঝেছ?’(কবির সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের সাক্ষাৎকার-২০১১)। কিন্তু কলকাতার যিশুর ক্ষেত্রে এমন মুক্তি কবি পাননি বলেই মনে হয়। তাই এই কবিতা লেখার  আরো পনেরো বছর পর দেখি আর একটি কবিতায় আবার যিশুর স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি।

‘এক-একবার মনে হয় যে
এই জীবনের যাবতীয় ভ্রমণ বোধহয়
ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু
ঠিক তখনই
আমার চোখের সামনে হঠাৎ খুলে যায়
সেই রাস্তা,
যার ধুলো উড়িয়ে আমি কখনও হাঁটিনি।
. . . . . . . . . . . .  . . . . . . . .
কলকাতার এক রাজপথে
যাকে আমি দেখতে পেয়েছিলুম,
ভাদ্রমাসের আকাশ জুড়ে
উলঙ্গ সেই দৈবশিশুর মুখচ্ছবি তখন আমার
চোখের সামনে ভাসতে থাকে।’
              ‘যাবতীয় ভালবাসাবাসি’(১৩৯১, ২৭শে ভাদ্র)।


      শেষে, আজকের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে যে কথা ভাবনাতে এসেই যায়, তা হল- এখনকার কলকাতা শহরে যেখানে রোজকার বেপরোয়া পথদুর্ঘটনার সাক্ষী হতে হয় আমাদের, সেখানে দাঁড়িয়ে কি এমন কবিতা কোনও কবি  আর  লিখতে পারবেন , সঙ্গে নিয়ে এমন ঈশ্বরীয় বাক্-প্রতিমা? 


মনের কথা

একটি বৈদিক বিবাহ
মধুবণী চ্যাটার্জি

একটি বিশেষ প্রয়োজনে বইয়ের আলমারি ঘাঁটতে গিয়ে হাতে এলো বেদের কবিতা , গৌরী ধর্মপাল রচিত এক অসাধারণ বই । মনে পড়লো  সোম আর সূর্যার বিবাহের গল্প । খুব বিস্তারিত ভাবে বলার ক্ষমতা আমি রাখিনা একেবারেই । কিন্তু বিবাহ শব্দটির সঙ্গে নেতিবাচক যে ধারণা আমার মনে বাসা বেঁধেছে, তার থেকে কিছুটা হলেও  মুক্তি পেতে আবারও একবার বইটি খুলে বসলাম । 
আনন্দ দেবতা সোম আর সূর্যকন্যা সূর্যা ....তাঁদের প্রেম বিবাহে পরিণতি পেলো । কেমন ছিলো সেই বিবাহ ? সে এক অদ্ভুত কল্প কথা । তাকে পড়লে বোঝা যায় আজকের যুগ  কোন আলো থেকে কোন অন্ধকারে নিজেদের পিছিয়ে নিয়ে গেছে  ! 
সূর্যা তাঁর সোমের ঘরে গিয়েছিলেন কোনো উপঢৌকন নিয়ে নয় ! তিনি গিয়েছিলেন তাঁর প্রেমে ভরা হৃদয় নিয়ে,   বিশ্বাসে নির্ভর করে ! কারণ তিনি নিজেই ছিলেন সোমের শ্রেষ্ঠ উপহার ।  স্বামীর ঘরে যাবার সময় মন ছিলো তাঁর রথ যার বাহন ছিলো দুটি তারা ।  পৃথিবী ছিলো তাঁর রথাসন  , আলোয় ভরা আকাশ ছিলো চাঁদোয়া ....আর তাঁর চোখের কাজলে লেখা ছিলো , ' প্রথম দেখায় চিনেছি তোমায় ' ...। 
চার চোখের মিলনে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে সোম  শপথ নিলেন একে অন্যকে জড়িয়ে থাকার  সুখে দুঃখে , জীবনে মরণে ! শপথ নিলেন বহিরাগত শত্রুদের থেকে মিলিত ভাবে নিজেদের দাম্পত্যকে রক্ষা করার । শপথ নিলেন একে অন্যের সঙ্গে বার্ধক্যে প্রবেশ করার । প্রবল বীর্যে বলীয়ান সোম শপথ নিলেন সূর্যাকে পুত্রবতী করার । সবিতা দেবতা সূর্যাকে সম্প্রদান করলেন । অগ্নি প্রদক্ষিণের মন্ত্রে সূর্যাকে পাওয়ার আনন্দ ব্যক্ত হয়েছে প্রতি ছত্রে । সূর্যাকে রাণী হিসেবে গ্রহন করেন সোম । অবশেষে হয় হৃদয় বিনিময় ... তোমার হৃদয় আমার হৃদয় ...আমার হৃদয় তোমারই ...! 

আচার্য আশীর্বাদ করলেন শ্বশুরকুলের মহারাণী হও বোলে ....! আচার্য্য গৌরী ধর্মপাল তাঁর  এই অসামান্য বইটিতে  বেদের এই কাহিনী কবিতায় ব্যক্ত করেছেন ।   সূর্যা সত্যিই সুখী  হয়েছিলেন কিনা সে গল্প জানা নেই । কিন্তু যে মর্যাদায় এক কন্যা তার  স্বামীর ঘরে যায় , যে প্রেম যে বিশ্বাস নিয়ে ....তা কি সত্যিই রক্ষিত হয় ? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না বোধহয় । আসলে এই মন্ত্র শুধু মন্ত্র হয়ে থেকে গেছে যুগে যুগে । এর অর্থ যদি পুরুষরা বুঝতেন তবে হয়তো সমাজ কিছুটা হলেও  এগোতো ....হয়তো যৌতুকের জন্য  নারকীয় হত্যালীলা বন্ধ হোতো । সূর্যাদের  শরীর সোমেদের নখের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হোতো না ! পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তি হৃদয় ভাঙা সূর্যাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করতো না ....!  হৃদয় আদান প্রদানে যে সম্পর্কের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় সেখানে প্রথম যে সেই হৃদয়কেই ভাঙা হয় খণ্ড খণ্ড করে .....! মনে রাখতে হবে , সোমকেই শপথ নিতে হয় সূর্যাকে মর্যাদা দিয়ে ধারণ করার । তাই শপথ নেওয়ার আগে একবার জেনে নেওয়া প্রয়োজন ....মন্ত্রের ভিতর লুকিয়ে থাকা এক অপূর্ব আলোর গল্পকে  । 



অনুগল্প 

বংশ প্রদীপ
সুমন্ত কুণ্ডু

 দত্ত বাড়ির বড়বউয়ের পরপর যখন দুটোই মেয়ে হল শাশুড়ি মুখ কালো করে বলেছিল ‘মেয়ে বিয়োনো আর আঁটকুড়ী তো একই আমাদের আর বংশে প্রদীপ দেওয়ার কেউ রইল না’ বড়বউ কষ্ট পেয়েছিল, একা কেঁদেছিল নিজের মেয়ে দুটোকে এ বংশের কেউ বলে আর ভাবতে পারেনি কখনও
পরে ছোটবউয়ের যখন পরপর দুটি ছেলে হল শাশুড়ি গালভরা  হাসি নিয়ে বলেছিল ‘এতদিনে আমার বংশ রক্ষা হল ছোটবউয়ের জন্যই বংশে বাতি দেওয়ার কেউ এল’ ছোট বউ খুশীতে গদ গদ হয়েছিল এ বংশটা একমাত্র তার ছেলেরই বংশ এমন মনে হয়েছিল তার

আজ বেশ কয়েক বছর পর দেখা যায়  বড়বউ ঘুরেফিরে দুই মেয়ের বাড়িতে  ভালোই আছেন দুই জামাই খুব আন্তরিক নাতি-নাতনিদের সাথে সময় কেটে যায় ভালো কর্তা চলে যাওয়ার পর আর দত্তবাড়িতেও আসেন না খুব একটা । মেয়েদের বাড়িতেই বছর ঘুরে যায় ভালো
ছোটবউয়ের সংসারে শান্তি নেই দুই ভাই জমি-জায়গা, বাড়ি-ঘর, আর বিশয়-সম্পত্তির চুলচেরা ভাগ বাঁটোয়ারা করতে গিয়ে চুলোচুলি করে মরছে বিধবা মাকে নিয়েও এদিক ওদিক ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে ক্রমাগত ছোটবউও স্থিতু হতে পারছেন না কোথাও । তিনি এখন বংশের দুই জাজ্বল্যমান প্রদীপের নীচে জমে থাকা কালো অন্ধকারে আসা যাওয়া করে মরছেন রাতদিন


কবিতা 

জ্বর
কুমারেশ তেওয়ারী

মোহনীয় জ্বরের নিকটে কিছু
                                    কারুভাষ ফুল
জলের গভীরে ভাসে ফুলস্বর প্রিয়

আহা তিতিরউল্লাস কোতলের আর
আর কী কী ভাষা আছে বলো

শিমুলতুলোতে ওড়া ব্যাহত সাধন
জ্বর গায়ে সমুদ্র সিনানে গেলে
কেটে যাবে কবেকার মোহর বাঁধন?


সংখ্যামাত্র
 শুভদীপ পাপলু

মারাত্মক দিগ্বিজয়ী এক ভগ্নসকাল...হত্যার নেশা
উদযাপিত কলহগুচ্ছে-পরিবর্তিত,হীন পিছুটান।
তবু আয়ত্ত করেছি যাকে বঙ্গানুবাদে,সে পরিভাষা 
হস্তান্তর প্রক্রিয়ায়-এক পরাধীন স্নায়ু,পতঙ্গপ্রমান।

মায়াবিনী'র ঐ-রশিপথ ধরে হেঁটে চলি,অনেকাংশে
প্রতিশব্দের নভেলে;যে সৃষ্টিরহস্যে আবৃত,স্বয়ম্ভূ...
ধমণী ডাক পাঠালে,যে জন্মগ্রহন করে রাজবংশে-
আদপে সে ঔপনিবেশিক অত্যাচার,শেষার্ধে প্রভু। 

নিজে তো ধারালো কৃপান,ক্রিয়াপদের মনস্কামনা-
ত্রিভুজ,দশমিক,ভাগ করে দি-ই জ্যামিতির অঙ্গে।
অথচ কম্পাস অন্যের সাদা পৃষ্ঠা নিয়ে,আনাগোনা
করে সঞ্চয়;ওপাশে,বৃত্তের বিয়ে হয়,গণিতের সঙ্গে। 

এভাবে কবিতার ছাদ,আর সরাসরি পুলকিত নখে
সন্তান প্রতিপালিত হয়,পিতা-মাতা'র আলেখ্যে...

ব্ল্যাককফি
নীপবীথি ভৌমিক

  এক একটা করে ধোঁয়ার হরিণরা হারিয়ে যায়
 আকাশের মথ স্পর্শে।


 বা হাতের মুষ্টিবদ্ধ শরীর ছুঁয়ে 
  যে বিকেল নেমে আসে আজও...
সে চেনে, জানে,  ডাকবাস্ক অপেক্ষায় থাকে ফিকে হয়ে আসা মায়াবী ঘ্রাণে।

  উঁহু ! আমি ফিরি আবার সেই
    নেশাতুর অ্যালঝাইমারিক স্নানে।

কফি আনো, ভাঙুক ঘুম মাগ'এর
 ব্ল্যাক আর হরিণ'ধোঁয়া সুগন্ধে ।



ভালোবাসা।এক পা দু'পা
কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর

যে নারীর দেহে কোনোদিন পুরুষের গন্ধ ওঠেনি
অথচ রাত বাড়লেই, ঘড়ির কাটা জিরাফের গ্রীবার মতো
চাদরের ভাঁজে ভাঁজে জন্ম দেয় অসংখ্য ভালোবাসা
উত্তেজনাহীন শরীর মেপে নেয় লোমকূপের এনার্জিটিক নেচার
ছেঁড়া ছেঁড়া পাখির পালকের মতো ব্যালকনিতে সকাল আসে গোলাপ ভর্তি টবে
গুঁড়ো গুঁড়ো রাতভাঙা স্টেডিয়াম
স্লিপলেস।ঝুকে পড়া রেলিং -এ আটকে যায়,এ শহরের ট্রাফিক
তবু, রাতের স্থাপত্যে জন্মে যে ভালোবাসার জীবাশ্ম
স্ট্রিটলাইটের ফোকাসের সাথে কর্পোরেট ফিন্যান্সে মিস্কড হয়ে যায়
রাত।ভালোবাসা।গন্ধ। ভাগাভাগি। আর একটা সকাল



ঘড়ি

---সবর্না চট্টোপাধ্যায়


বারোটা থেকে কাঁটা সরে যায়
ঘুম নেই।
ঘুরন্ত ফ্যানে কাটা পড়ে চোখ
ট্রেন দুটো রোজ, একে অপরকে
ভেদ করে ছোটে।
চাপা পড়া শব্দের ভেতর খুন হয় দুটো মানুষ…
এভাবে ঢিঙিয়ে যেতে থাকি,  লাশ
চারদিকে শব্দের ঝড়।

তারপর ঢেউ আর ঢেউ...
জ্যোৎস্নায় কত ভেসে আসা কত জেলিফিস
একবার যদি কেউ ছেড়ে দিয়ে আসে,  আবার...


বীজ
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

বীজ বা ডিম শব্দদুটো
কেমন গোলমেলে
কখনও স্বপ্ন কখনও
উষ্ণতার ব্যাকরণ
খানিকটা পাপবোধ
কিছুটা ইচ্ছা আর ইচ্ছাভঙ্গ
প্রতিজ্ঞা আর ব্যর্থতা।

ঐতিহ্য

তাপসী  লাহা

সদর দরজা দিয়ে ঢুকে গেছে অপরিচিত আবহাওয়ারা,
 মরসুমি  পূর্ণতায় এক একটা পৃথিবী  ছড়িয়ে  দেয়   অকিঞ্চিৎ সারবত্তা।
নতুন ফুলের মতো অস্বস্তিরাও নজর কাড়ছে,
চিরন্তন  নবান্নতায় কিছুটা মিশে যাচ্ছে অব্যক্ত ধানক্ষেত।
অগুনতি শালুকেরা পুকুর খুঁজছে প্রস্ফুটনের প্রবল কামনায়।
অনভ্যস্ত পরিযায়ীরাও  ভীড় বাড়াচ্ছে চেনাগুলো
পালটে যাচ্ছে  তাই।
ধবল স্বপ্নদের  সৎ  হতে দেখে আমিও সব কিছুর পরেও বিশ্বাস রেখেছি অতীতবেলায়----
মায়ের প্রাকনবান্নের তোড়জোড়ে,
ভোরের শিশির আর আতপ চালের বিশ্বস্ত সুঘ্রাণে।

           
একটি লেটারবক্স ও আমি 
দেবব্রত রায়

একটি সরল রেখার উপর
এসে দাঁড়াতেই, আমার ছায়াটিও
দ্বিধান্বিত!
কারণ, সেই সমকোণের একটিতে
বিস্তৃত ছিল আমার নস্টালজিয়া----
অর্থাৎ, একটি স্বপ্নের লেটারবক্স।
আর, অন্য  কিনারাটির  
দখল নিয়েছিল বোধবুদ্ধি
  ঝলসে দেওয়া আড়াই বছরে
লোটা-কম্বল তিনগুণ হয়ে যাবার
মতো কিছু  টোপ। 
                           
  একটি দীর্ঘ Tug of war-এর পর
  চোখ বন্ধ  করতেই, দেখলাম,
  সেই রূপকথার রঙিন বাক্সটির থেকে বেরিয়ে  আসছে 
আমার  উড়ান-স্বপ্নগুলি

  স্বপ্নচিল 
চিরঞ্জিত সাহা

আবার দেখা তোর শহরে , নতুন কোনো গল্প হোক ,
বোধন ভোরের নতুন সকাল , কাশ মুছেছে ব্যর্থ শ্লোক ;
কবিতাতে মন আসে না , অটোগ্রাফে নেই তো ঝোঁক
পোস্ত যদি তুই নিতে চাস , হেমলকটা আমার হোক ।
অ্যালগির ওই প্যাঁচপয়জার হয়তো বা তোর বিষের ঘোর ,
ইনফ্লোরেসেন্স আনছি সখা , করতে রঙিন তোর শহর।
শরৎ তখন মাঝআকাশে , ঢ্যামকুরকুর ঢাকের রেশ ;
সন্ধিপুজোর অষ্টমীতে রংহেয়ালির নতুন দেশ ।
আর্দ্র দুপুর , খসখসিতে , তোর স্বরেরই নতুন শ্লোক ;
সিঁদুর রাঙা দশমী দিন , থমকে শহর তোর দু' চোখ ।
জল চিনেছে শালুক আলো , মৌ পেয়েছে পদ্মবিল ,
তোর আকাশে মন ভাসিয়ে উড়ল নতুন স্বপ্নচিল ॥

তোমার আমার ব্রিজ -
আকাশ সরকার


সকালগুলো বড্ড নিস্তব্ধ
রোদের তাপ গায়ে লাগিয়ে
তোমার আওয়াজ শুনি না আর,
তোমার আমার তর্কের দাপটে
সতর্ক হয়না কাকেরা,
বিকেলের ল্যাম্পপোস্টের আলোয়
তোমায় ভাবতে ভাবতে
চোখ ঝলসে যায় না,
তুমি জানো
তুমিও তো ছিলে আশেপাশের জড়বস্তুগুলোকে নিয়ে
যারা নিরন্তর ব্রিজ বানিয়ে গেছে,
তোমার আমার আঁকাবাকা রাস্তার
আমরা কি ব্রিজগুলোর এপারওপার করতে পারিনা আবার?
হেঁটে হেঁটে বানাতে পারিনা
আবার কতশত নতুন ব্রিজ
                          

No comments:

Post a Comment