Showing posts with label মনীষা শেখ. Show all posts
Showing posts with label মনীষা শেখ. Show all posts

Monday, 19 October 2020

মনীষা শেখ, গল্প, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০, ভাস্কর্যে রামকুমার মান্না,

 


একটি চেনাশোনা রূপকথা


আমাদের গাঁয়ে কোন নদী আছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন? 

আছে। নদীর নাম মধুমতী। গাঁয়ের নাম?  

মনে করুন গাঁয়ের নাম রানির বাজার। 

সেখানে বাপ মা ভাই বোনের সাথে থাকতাম। বাপের আমার কিছু জমি জায়গা ছিল। চাষবাস করে চলত। কিছু হাঁস-মুরগি পালতাম। বাড়ির উঠোনে মরশুমি  সব্জি।

 লেখাপড়া করেছি কিনা? তা একটু-আধটু করেছি। মাধ্যমিক পাস দিলাম। আরো পড়ার ইচ্ছে ছিল জানেন!

পড়লাম না কেন? 

বাবা খরচ চালাতে পারলোনা। মাধ্যমিকের পরে বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগল। ভাইটা বদসঙ্গে পড়ল। ছোট ছোট ভাই বোন আমি দেখতে কেমন বলুনতো?

কী বললেন? সুন্দরী!   সুতরাং গ্রামের ছেলেরাও পিছনে লাগবে। বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবা একে তাকে ধরে সম্বন্ধে আনতে লাগলো। সে একটা উত্তেজনার সময় জানেন! বয়সটা তো তখন কাঁচা তো! বিয়ে, স্বামী, নতুন জীবন সব কিছু নিয়ে একটা রঙিন জগতে যেন চলে গিয়েছিলাম। 

প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিন কোন না কোন পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসত জানেন! তারপর বাড়ীটা যেন বিয়ে বাড়ি হয়ে যেত বাবা-মা বসে বসে আলোচনা করত পাত্রের কি কি গুণ, বাড়ির লোকেরা কেমন, সেখানে আমার কেমন লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। 


মা আমাকে চুলোর ধারে যেতে দিত না আমার গায়ের রং ময়লা হয়ে যাবে বলে। বাবা অবসর সময় নানা উপদেশ দিত। শ্বশুর-শাশুড়িকে যত্ন করতে বলতো। এইভাবে কেটে যেত পনের দিন কি এক মাস। মনে করুন পাত্রপক্ষের গ্রামের বাজারে মুদির দোকান। এই কদিন আমি হয়ে যেতাম মুদির দোকানের বউ। কীভাবে চললে মুদি দোকানি খুশি থাকবে তাই ভাবলাম বসে বসে। নিশ্চয় দোকান থেকে দুপুরে  ভাত খেতে আসে। সুতরাং তাকে ভাল করে রান্না করে খাওয়াতে হবে। রান্না পছন্দ না হলে সে কি আমায় মারধর করবে? কল্পনায় মার খেয়ে কেঁদেছি কত! ভালোবাসার কথা, আদরের কথা ভাবতাম কিনা?

যাহ! আপনি না! 

এই আমি চুপ করলাম।

কী বললেন?  তারপর কি হল? তারপর মুদির দোকানীর পছন্দ হল না। এরপর হয়তো চালের আড়তদার।

তার বউ সাজার কল্পনা চলল আরও এক মাস। 

 এই ভাবেই নানা পেশার লোকজনের বউ সাজা চলতেই থাকল। কিন্তু বিনা পয়সায় বিয়ে করার লোক  পাওয়া গেল না। 

এভাবে বছর দুই গড়িয়ে গেল। বাবা-মার উৎসাহ অনেকটা কমে এলো। তারপর?  তারপর রোজ সূর্য উঠতে থাকলো আর ডুবতে  থাকলো। ছোট ছোট বোনেরা বড় হয়ে উঠল। পাত্রপক্ষের আনাগোনাও অনেক কমে গেল। যদিও বা আসে তারা আমার বদলে আমার বোনদের পছন্দ করতে চায়। আমার মা তাদেরকে লুকিয়ে রাখতে লাগলেন। তবু কি করে যেন তারা সব খবর পেতে থাকলো। এমনকি কেউ কেউ বিনা পয়সায় বিয়ে করতেও রাজি হয়ে গেল। কিন্তু বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না বড়কে বসিয়ে রেখে ছোটদের পাত্রস্থ করার কথা। 


তারপর? এরপরেও আপনাদের শোনার ইচ্ছা হচ্ছে?

এরপর আমার ভাই একটা মেয়েকে তুলে আনল। সেই নিয়ে দিনরাত অশান্তি। সেই মেয়ে কিছুদিন পরে স্ব মূর্তি ধরলো,  আর আমি হয়ে গেলাম দিন-রাতের দাসী। 


বিয়েটা কি করে হলো? সে এক গল্প। ভাইয়ের বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে একদিন এক লোক এলো। তার বউ নাকি এক বছর হল মরে গেছে। বাড়িতে মেলা বাচ্চাকাচ্চা। তার একটা বউ দরকার। বাড়িঘর দেখাশোনা করবে, বাচ্চা সামলাবে। বয়স বেশি হলে অসুবিধা নেই। এমনকি বিয়ের খরচ বাবদ কিছু টাকা দেবে বলেছে। 

বাবা খুঁতখুঁত করতে লাগলেন। দ্বোজবর, বাচ্চাকাচ্চা- কিন্তু আমি রাজি হয়ে গেলাম। বেঁচে থাকার জন্য তখন আমি খড়কুটো ধরতেও রাজি। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে জোগাড় যন্ত্র করে বিয়েটা চুকে গেল। 


তারপর? তারপর আর কি? লোকটা বলল, শিবানী! তোমার হয়তো আমাকে পছন্দ হচ্ছেনা। বুড়ো হয়ে গেছি তো। তা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে চলো দুজন কোথাও ঘুরে আসি। গেলে তো সেই সংসারের যাঁতাকলে পড়ে যাবে। তুমি কোনদিন সমুদ্র দেখেছ? একথা শুনে আমি লোকটাকে কেমন যেন ভালোবেসে ফেললাম।  

    আহারে! সদ্য বউ মরে গেছে। তাকে হয়তো এখনো ভুলতে পারেনি। এর মধ্যেই আবার আমার কথা ভাবছে। সমুদ্রে গেলাম কিনা? গেলাম তো। জায়গাটার নাম খুব সুন্দর। চাঁদিপুর। সেখানে স্বপ্নের মতো তিন-চার দিন চলে গেল। 

তারপর? তারপর আমার বর একদিন জরুরী কাজের শহরে গেল। সেদিন রাত্রে সেদিন রাত্রে চারটে লোক আমার ঘরে ঢুকে এলো। বললো, আমার স্বামী আমাকে তাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে এক লাখ টাকায়। এটাই নাকি তার পেশা। 

তারপর? তারপর আমি পালাবার চেষ্টা করলুম। চিৎকার-চেঁচামেচি করলুম। অনুনয়-বিনয় করলুম। কান্নাকাটি করেও পার পাওয়া গেল না 


তারপর? 

তার আর পর নেই। গলা শুকিয়ে গেছে। মালকড়ি কিছু ছাড়ো তো বাপু! তখন থেকে বকিয়ে মারছে। 

কী বললে? টাকা কম আছে? শালা হারামির বাচ্চা! পয়সা নেই, বসে বসে গল্প মারাচ্ছে।

এ নিতাই! মাল আন বাপু।  গলাটা শুইকে গেছে। 

 

 ভাস্কর্যে রামকুমার মান্না

Sunday, 5 July 2020

পুস্তক আলোচনাঃঃ নারী ও পুরুষ, আলোচনায় মনীষা শেখ, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




পুস্তক আলোচনা  
নারী ও পুরুষ
লেখকঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়  
আলোচনায় মনীষা শেখ 

 এই লকডাউনে আমাদের মন  এখন বিষাদগ্রস্ত।  কবে পৃথিবী স্বাভাবিক হবে, কবে ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে ভরে উঠবে স্কুল প্রাঙ্গণ, কেউ জানে না।  হাতে অঢেল সময় পাওয়াতে ভাবলাম বইয়ের আলমারি গোছানোর কাজটা করে রাখি। আর এই গোছাতে গিয়েই পেয়ে গেলাম একটা অসাধারণ বই।  অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারী ও পুরুষ।

বইখানি আগে পড়েছি।  তবে সময়ের ধুলোবালি পড়ার ফলে অনুজ্জ্বল হয়ে গেছিল ছবিটা। এখন এই মধ্যবয়সে এসে বইটা নতুন করে পড়লাম এবং আবারও মুগ্ধ হলাম। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খুবই প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষও।  মানুষটির কথা ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। ছিন্নমূল হয়ে ভারতে এসে জীবিকা ও জীবিকা অর্জনের জন্য কি না করেছেন! কখনো কখনো জাহাজের ডেকে নাবিক হয়ে সারা পৃথিবী পর্যটন, কখনো কোন কারখানার ম্যানেজার শিক্ষক সাংবাদিকের ভূমিকা পালন। সব ভূমিকাতেই  তিিনি সমান উজ্জ্বল   ।
 এখন বইটার কথা বলি।  মানুষের মনের বিপন্নতার নানা দিক তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর অসামান্য সব উপন্যাসে আমরা সবাই তা জানি। কিন্তু ভারতবর্ষে নারীদের যে সমস্যা বর্তমানে আমাদের প্রত্যহ হতাশ্‌ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ করে , এমনকি লকডাউনের ভারতেও যে পাপ আমাদের ছেড়ে যায় না, সেই ধর্ষণের কথাই বলছি।

নারী ও পুরুষ গল্পটি ধর্ষণের প্রেক্ষাপটে লেখা।  এক বন্ধের দিনে একটি খুন হয়। ধর্ষিতা মেয়েটি আশ্রয় নেয় অনিল তথা মেজদার বাড়িতে।  এখান থেকেই লেখক বুনতে থাকেন তার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন আমাদের আচ্ছন্ন করে দেয়।
  নিজেদের অজান্তেই আমরা ঢুকে পড়ি মেজদার সহেলী কুঞ্জে,  যে কুঞ্জে আছে সারি সারি পর্যটন কুটির ।আছে শাল, সেগুন, পিয়ালের সারি,  আছে অজস্র ফুলের সমারোহ।  মেজদার লাগানো কৃত্রিম বনাঞ্চল।  মাঝে সরু সরু রাস্তা, বড় পুকুর্‌ মনোরম ঝিল, দেশি-বিদেশি গাছের সমারোহ। একবার চেয়ে সহজে এসেছে সে বারবার না এসে পারে না মনে হয় স্বপ্নের পৃথিবী।  অনিল তথা মেজদা সারাদিন এই কুঞ্জে ঘুরে বেড়ায় । কীভাবে কোথায় কোন গাছ লাগালে, কোন ফুল ফুটলে প্রিয় হয়ে উঠবে এই কথা মাথায় অনবরত পাক খায়। তাকে দেখলে মনে হবে সে যেন জীবনভর এক ঘোরের মধ্যে আছে।
 
একটি ধর্ষিতা মেয়েকে জীবনে ফিরিয়ে আনার এই  কাহিনী  পড়লে মনে হয় এইতো! পুরুষ তো এমনই হওয়ার কথা। এই বইয়ে অনেক চরিত্র । সেঁজুতি, অমিয় কপালী, ধীরে্‌ লোকনাথ কাকা , সুশান্ত, শ্রাবণ্‌ পল্লবী- সব বলতে গেলে লেখাটা বিরাট হয়ে যাবে।  মেজদারও বিপন্নতা আছে।  সেই বিপন্নতার নাম সহেলী। আমরা সবাই কোন না কোন সহেলীর জন্য বড় হয়ে উঠছি। আমরা লেখাপড়া করছি।  সাইকেলে জ্যোৎস্নায় মাঠ পার হয়ে যাচ্ছি , বালির চড়ায় নির্জন রাতে তার কথা ভাবতে ভাবতে আকাশের নক্ষত্র গুনছি । বইটি পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হয় উপন্যাস নয়, কোনও কবিতা পড়ছে বুঝি।
 উপন্যাসের শেষে মেজদা তথা অধীর সেঁজুতিকে বলেন,  "বোঝা যা , সবকিছু আমাদের বয়ে নেবার সুযোগ দিয়ে দেখ না, পারি কিনা !" পুরুষের এমন কাম্য ছবিই তো মেয়েরা গোপনে লালন করে। এমন নরম উষ্ণতার কথাও নারীকে শেষ পর্যন্ত পুরুষই বলতে পারে। পুরুষ ছাড়া কে আছে নারীর, যার পাশে গাছ হয়ে ফুল হয়ে ফুটে থাকা যায়!

 মানুষের ভালোবাস্‌ মানুষের প্রতারণা , নারী-পুরুষের আশ্চর্য এক সম্পর্কের কথা বলেছেন লেখক। একইশরীর, একই  অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ , একই কামনা। অথচ  কখনো মিলন মধুর, কখনো পাশবিকতার স্মৃতি। এই উপন্যাসে নারী পুরুষের সম্পর্কের উপর নতুন করে আলো ধরেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।  তুলে ধরেছেন জীবনের ইতিবাচক দিকটিকেও।