Showing posts with label সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়. Show all posts
Showing posts with label সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়. Show all posts

Thursday 31 December 2020

সৌমিত্র 'অপরাজিত' চট্টোপাধ্যায়, সুমিত নাগ ,গদ্য ,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


 

সৌমিত্র ‘অপরাজিত’ চট্টোপাধ্যায়

সুমিত নাগ

 

“মহান অভিনেতার অভিনয়ে শুধুমাত্র মানুষের হাসিকান্না, শোকতাপের নিপুণ প্রকাশই থাকে না, মানবজীবনের ও সমাজের পরিচয়ও ফুটে ওঠে অভিনয়শিল্পীর অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধ থেকে...”

                                                                (গদ্যসংগ্রহ ১, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)

 

 

শেষ থেকেই শুরু করা যাক। সাংস্কৃতিক জগতের এক বাঙালি আইকনের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে, তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, আমেরিকা-ফ্রান্স-ইংল্যান্ড-জাপান-ইতালির মতো দেশে—আক্ষেপের সঙ্গেই স্বীকার করতে হয়, এমন ঘটনা সাম্প্রতিক কালের বাঙালির ইতিহাসে সচরাচর দেখা যায় না। এর অর্থ এটা নয় যে, আন্তর্জাতিক মানের বাঙালি ব্যক্তিত্ব আমাদের সংস্কৃতি জগতে দীর্ঘদিন আসেননি, বা এখনও নেই;  অথচ তাঁদের সৃজন ও মননশীল কাজগুলি সারা বিশ্বে প্রচারিত হয় কতটা? হয় না, এর স্বাভাবিক কারণই হল, ভাষা-নির্ভর শিল্প-সৃষ্টি যথাযোগ্য অনুবাদের মাধ্যমে প্রকাশিত ও পরিবেশিত হয় না, বাঙালিয়ানার গণ্ডি অতিক্রম করে।  

 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখানেই ব্যতিক্রম। সেটাও স্বাভাবিক কারণেই। যে-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সারা পৃথিবী চিনবে একদিন, যাঁর কাজ আলোচিত হবে চলচ্চিত্র জগতের আন্তর্জাতিক মহলে, তিনি জন্মলগ্ন থেকেই আন্তরজাতিক— যাঁর প্রথম ছবিই সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)।

 

এই আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পর্কে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও বলেছেন পরে। ‘দাদাসাহেব পুরস্কার’-এ সম্মানিত হবার কিছুদিন পর, জাতীয় টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় টক-শোতে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বাংলায় এমন সাফল্যের পরও মুম্বাইতে এলেন না কেন? জাতীয় স্তরে কাজ করার কোনও ইচ্ছেই কি তাঁর ছিল না, বিশেষত, আঞ্চলিক স্তরের প্রায় সমস্ত জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই যখন এই স্বপ্নলালন করেন? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জানান, বলিউডে কাজ না-করলেও, তিনি যেসব চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন সে-সময়, সবই তাঁকে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি, যা বলিউডের অনেক ঊর্ধ্বে। পরেও, তিনি অকপটে জানিয়েছিলেন একই কথা— যশলাভ করতে তিনি চিরকালই চেয়েছেন, এবং তা যথেষ্টই লাভ হয়েছিল। তাই, আর কোনও হাতছানি থাকার প্রশ্নই নেই।

 

তবে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলতে শুধুই সত্যজিৎ রায় নন। সাম্প্রতিক কালে, ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ফেলুদা, হীরক রাজার দেশে’র ‘উদয়ন পণ্ডিত’ এবং অবশ্যই, ‘অপুর সংসার’-এর ‘অপু’, একেবারে ‘মিলেনিয়াল’ প্রজন্মের কাছেও কাল্ট স্ট্যাটাস পাওয়ায়, তাঁর মৃত্যুর আগে ও পরেও, বারবার উল্লেখিত হতে দেখা গেছে এই ছবি গুলিতে তাঁর অভিনয়ের প্রসঙ্গ। সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের এমনই কিছু ছবির দৃশ্য যেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্বমহিমায় উপস্থিত। এটা ঠিক যে, সত্যজিৎ রায়ের মতো মহান পরিচালকের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক (সত্যজিৎ রায়ের মোট উনত্রিশটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির চোদ্দটিতে সৌমিত্র উপস্থিত, এবং একটি তথ্যচিত্র ‘সুকুমার রায়’তেও)  ছবিতে অভিনয় করার ফলে, সত্যজিৎ-সৌমিত্র কোল্যাব একটু বেশিই উল্লেখিত হওয়া স্বাভাবিক। সেই কারণেই, কুরোসাওয়ার তোসিরো মিফুনে, ফেলিনির মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ান্নি, বার্গম্যানের মাক্স ভন সিডো অথবা পরবর্তীতে স্করচেজির রবার্ট ডি নিরো’র মতো আইকনিক পরিচালক-অভিনেতা ডুয়োর পাশাপাশি ওই দুই বিখ্যাত বাঙালির নাম আসবেই। কিন্তু, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মানেই শুধু সত্যজিৎ-এর ছবি নয়। আরও বেশি কিছু। এমনিতেও, সত্যজিতের বাইরে মৃণাল সেনের মাত্র তিনটি ছবিতেই কাজ করেছেন সৌমিত্র—‘প্রতিনিধি’ (১৯৬৫) ও ‘আকাশকুসুম’ (১৯৬৫) এবং এর দীর্ঘকাল পরে, মহাপৃথিবী (১৯৯১)। ঋত্বিক ঘটকের কোনও ছবিতেই তিনি নেই। সত্যজিৎ রায়ে মৃত্যু ১৯৯২ সালে। অর্থাৎ, বাংলা চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ত্রয়ীর জীবদ্দশা, এবং তাঁদের কর্মজীবন শেষ হবার পরেও বহু-বহু কাজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে করেছেন—তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যাই দ্বিশতাধিক! এবং এই ছবিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না-থাকলে—যার মধ্যে বেশিরভাগই বাণিজ্যিক ধারার ছবি, যা জনপ্রিয় হওয়াই মূল সার্থকতা—তাঁর চলচ্চিত্র জীবন আদৌ এত দীর্ঘায়িত হত কিনা, সন্দেহের অবকাশ থাকে। সন্দেহ হয়, জনমানসে তাঁর পরিচিতিও ঠিক ততটাই হত কিনা।

 

কিন্তু, পথটা কি সহজ ছিল? ‘না’ বলেই মনে হয়। ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র জানিয়েছিলেন, তিনি যা করতে চেয়েছিলেন তা হল, ‘জীবন সদৃশ অভিনয়’। একই সঙ্গে এও জানিয়েছিলেন যে, এই ‘জীবন সদৃশ অভিনয়’ করতে গিয়ে উনি কিছুটা হলেও বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন তাঁর অত্যন্ত সুপুরুষ চেহারার জন্য। যা অতিক্রম করার চেষ্টাও করেছেন তিনি, দরকার মতো, মেক আপের সাহায্যে নিজেকে ডি-গ্ল্যামারাইজড করার মাধ্যমে। ব্যাপার হল, দুটোই জনপ্রিয় ধারার পরিপন্থী। প্রথমত, ‘ম্যানারিজম’, নায়কোচিত ‘ম্যানারিজম’—এদেশের বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে সফল ও কিংবদন্তী হবার জন্য আবশ্যিক ছিল, এখনও আছে এবং এটি ‘জীবন সদৃশ অভিনয়’-ধারার বিপ্রতীপে অবস্থান করে, নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। মহানায়ক উত্তম কুমার তুলনারহিত অভিনেতা হলেও, ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর অভিনয়ে ম্যানারিজিম ভালরকম ভাবেই এসেছে; সৌমিত্রের সমসাময়িক রাজ কাপুর, দেবানন্দ এই ম্যানারিজমকেই অভিনয়ের হাতিয়ার করে তুলেছিলেন; একইভাবে, দক্ষিণের রাজকুমার, এম জি আর কিংবা এন টি আর প্রমুখও। সম্ভবত, দিলীপ কুমারই, যাঁকে খোদ সত্যজিৎ ‘দি আল্টিমেট মেথড অ্যাক্টর’ অভিহিত করেছিলেন, কিছুটা মুক্ত ছিলেন এই অভিনয়-ধারা থেকে। কিন্তু, সম্পূর্ণ ম্যানারিজম-বিহীন হয়েও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কীভাবে সফল হলেন? বিশেষত, এমন একজন যিনি নিজেকে চরিত্রের প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে গিয়ে নিজের সৌন্দর্য মুছে ফেলতেও দ্বিধা করেন না?     

 

একটা কারণ, অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পূর্বোল্লেখিত ত্রয়ী’র চলচ্চিত্র ধারার বাইরেও যে-সমস্ত দুর্দান্ত কাজ করেছেন, তাতেও যথেষ্ট উঁচুমানের পরিচালক ও চিত্রনাট্য তিনি পেয়েছেন। তপন সিংহ, যাঁকে অনায়াসে ওই ত্রয়ীর পাশে চতুর্থ সিংহাসনটি দেওয়া যায়, দেওয়া উচিত—দেয় না উন্নাসিক বোদ্ধারাই হয়ত—তাঁর ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় অত্যুচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করেছে বলাই যায়। ‘ঝিন্দের বন্দী’ (১৯৬১) তপন সিংহের সঙ্গে সৌমিত্র’র দ্বিতীয় ভেঞ্চার, খোদ মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে অতীব সুদর্শন ‘ভিলেন’ রূপে একটি মাইলস্টোন। মনে পড়ে, ঘোড়ার পিঠে ‘ময়ূরবাহন’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখে উত্তম কুমারের চরিত্রটি স্বগতোক্তি করে, চেহারা দেখে মনে হয় সত্যিই ময়ূরবাহন! বলাই বাহুল্য, এই ছবিতে সৌমিত্রের গ্ল্যামার বিশেষ ভাবেই সাহায্য করেছিল তাঁকে, এবং একটু সাহস করেই বলা যায়, খোদ উত্তম কুমারকেও ম্লান করে দিয়েছিলেন ‘ভিলেন’রূপী সৌমিত্র। অনেক পরে, ‘আতঙ্ক’-এর মতো দুর্দান্ত সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তখন মধ্য বয়সে, নিজেকে সম্পূর্ণ ডি-গ্ল্যামারাইজড করে ফেলবেন—এতটাই রেঞ্জ!

 

তপন সিংহ বাদে অসিত সেন, অজয় কর, তরুণ মজুমদার—বাংলা চলচ্চিত্রের ‘স্বর্ণযুগ’-এর শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের সঙ্গে বহু ছবিতে কাজ করে গেছেন সৌমিত্র; এবং বারবার স্বীকার করেছেন, এঁদের মতো দক্ষ পরিচালক ছিল বলেই অমন উঁচু মানের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, একের পর এক। এঁদের এবং আরও অনেক যোগ্য পরিচালকের ছবি, যেমন, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘পরিণীতা’, ‘গণদেবতা’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘মণিহার’, ‘জোড়া দিঘির চৌধুরী পরিবার’, ‘বাঘিনী’, ‘বাক্স বদল’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কোনি’ ইত্যাদি তাঁকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় করে তুলেছে।

 

তবে, এখানেই শেষ নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আরও একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, প্রথম জীবনে, তাঁর নিজের ছবিরই একটি শুটিং দৃশ্য দেখে তিনি হেসে ফেলেছিলেন। এবং যে-কোনও ভাবেই হোক, দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী হয়ে, সিনেমার ফাইনাল-কাটেও থেকে যায় (বোঝায় যাচ্ছে, কেমন এডিটিং)! এই দৃশ্যটি সত্যজিৎ রায়ের নজরে আসে, এবং উনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করেন, তিনি এভাবে হাসছিলেন কেন? সৌমিত্র জানান, দৃশ্যটি এতই অস্বাভাবিক যে, হাসি পেয়েচ গিয়েছিল—ওরকমও আবার হয় নাকি! উত্তরে সত্যজিৎ বলেন, সে যাই হোক, যে-সিনেমার যে-দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে, সেটি বাস্তব ধরেই করা উচিত—নাহলে, ভাল অভিনয় হবে কী করে? অবশ্যই, একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, যা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শিখে নিয়েছিলেন বলেই তিনি জানিয়েছিলেন।

 

এবং এটিই সম্ভবত তিনি, সজ্ঞানে বা অবচেতনে, প্রয়োগ করবেন তাঁর বহু অভিনয়ে। নাহলে, যে-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকৃত অর্থে শিল্প ও সংস্কৃতি-মনস্ক ও রুচিশীল বাঙালি, যিনি নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দকে, নিজেও কবি ও সামগ্রিক বিচারে দক্ষ সাহিত্যিক—তাঁর পক্ষে কি সহজে সম্ভব হত একেবারে ‘কমার্শিয়াল’ বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করা? জীবিকার প্রশ্নে তিনি কাজগুলি করেছেন, যুক্তিটা ভুল নয়; কিন্তু, শুধুই কি তাই? তার মধ্যেও যতটুকু অভিনয়ের সুযোগ ছিল, স্টিরিওটাইপ অস্বীকার করে বা না-করে সফল ভাবে করেছেন—এটাও বড় কথা। ‘প্রতিশোধ’ থেকে ‘আগুন’ কিংবা অঞ্জন চৌধুরীর ‘বউ-সিরিজ’-এও অভিনয় করার জায়গা থাকলে, ভুলচুক করতে করতে দেখা যায়নি।   

 

একটা কথা অবশ্য না-বললেই, নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিন্তু প্রবল অভিযোগ ছিল সিরিয়াল বিষয়ে। চূড়ান্ত কমার্শিয়াল ও জঘন্য বাংলা ছায়াছবিও সিরিয়ালের থেকে ভাল—এটা সরাসরিই বলেছেন, বাংলাদেশের একটি সাক্ষাৎকারে (তাতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আরেক বাঙালি আইকন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়)। সেই কারণেই নিশ্চয় সিরিয়াল অভিনয় থেকে সচেতন দূরের থাকার প্রয়াস তিনি নিয়েছিলেন। হতে পারে, চূড়ান্ত কমার্শিয়াল বাংলা ছবিতেও অভিনয়ের যে-টুকু সুযোগ তিনি পেতেন, মোটা দাগের, স্থুল রুচির, মেকআপ চর্চিত বাংলা সিরিয়ালগুলিতে তিনি সেটুকুও পাবেন না বলেই।

 

মার্লন ব্র্যান্ডো, তর্কাতীত ভাবে, হলিউডের সর্বকালের অন্যতম সেরা, জনপ্রিয় ও বিতর্কিত নায়ক ও অভিনেতা। অথচ পাঁচের শুরুতে টেনেসি উইলিয়ামস রচিত বিখ্যাত নাটক ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’-এর চলচ্চিত্ররূপ থেকে তাঁর উল্কার গতিতে উত্থান, এবং সেই দশক জুড়ে একের পর এক ছবিতে তাঁর ‘মেথড অ্যাক্টিং’ খোদ অভিনয় শিল্পে চিরকালীন প্রভাব ফেললেও,  তাঁর কেরিয়ার, বিভিন্ন কারণে, ষাটের দশকেই একপ্রকার শেষ হয়ে গিয়েছিল। স্টার ব্র্যান্ডো, নায়ক ব্র্যান্ডোকে কাস্ট করার কথাই ভাবত না কেউই। কিন্তু, একটা মাত্র সুযোগ, এবং ‘দ্য গডফাদার’—তাঁকে আবার খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়।  সেই থেকেই, এই কামব্যাক হয়ে গিয়েছিল কোনও সুপারস্টার অভিনেতার, বেশি বয়সে গুরত্বপূর্ণ মুখ্য কিংবা পার্শ্বচরিত্রে ফিরে আসা  সেকেন্ড ইনিংসে ফিরে আসার টেম্পলেট। ভারতীয় চলচ্চিত্রে দেখা যাবে, বহু জনপ্রিয় নায়কই তাঁর ‘ইমেজ’ ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেননি। কিংবা সময় নিয়েছেন ঢের। আশ্চর্যজনক ভাবে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এই বিবর্তন-পথ বিশেষ জটিল হয়নি। ‘নায়ক’ স্ট্যাটাসের থেকেও অভিনেতা, এবং ‘জীবন সদৃশ অভিনয়’—এই দু’টি কারণেই সম্ভবত পার্শ্বচরিত্রে খুব সহজেই মানিয়ে নিয়ে পেরেছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে বাংলা সিনেমা জগতের চরম দুর্দশার পর যখন, এই একবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সিনেমা আবার দাঁড়াতে শুরু করল তখন তাঁকে প্রায়ই পাওয়া গেল চমৎকার কিছু ছবিতে। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার এটাই, তাঁর প্রথম জাতীয় পুরস্কার এল ২০০১ সালে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘দেখা’ ছবিতে, পার্শ্ব অভিনেতার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য। এত, এত দীর্ঘদিন পর, এত দুর্দান্ত ছবিতে অভিনয় করার পর, কিংবদন্তীতে পরিণত হবার পর জাতীয় পুরস্কার! ভাবতেও অবাক লাগে। সেই কারণেই, তিনি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যানও করেন। তবে, এর পাঁচ বছর পরে ফের, ‘পদক্ষেপ’ ছবির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হলেন, এবার ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’র পুরস্কার। এরপর আর তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে, শুধু পুরস্কারই নয়, গত দশকের একাধিক ছবিতে অভিনয়, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও, প্রবল শারীরিক ধকল সহ্য করেও তাঁকে একেবারে এই প্রজন্মের কাছে কাছের করে তুলেছিল। ‘বেলাশেষে’ কিংবা ‘বরুণবাবুর বন্ধু’র মতো ছবিতে তিনিই মুখ্য চরিত্রে থাকলেন, এত বছর পরেও। পার্শ্বচরিত্রে থেকেও প্রবল জনপ্রিয় ‘প্রাক্তন’ ছবিতে তাঁর ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের মুহূর্তগুলি ভুলতে পারবে কি কেউ?

 

লেজেন্ডদের জীবনাবসানে আমরা সহজেই বলে ফেলি অপূরণীয় ক্ষতি। কথাটা সহজ, বহুল ব্যবহৃত; কিন্তু, কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সবসময় গভীরে তলিয়ে দেখি না হয়ত। কোনো কর্মক্ষম কৃতি মানুষের মৃত্যুতে আমরা বলতেই পারি, আরো অনেক কিছু করার ছিল, দেওয়ার ছিল তাঁর। কিন্তু, যখন কোনো বৃদ্ধ কিংবদন্তির মৃত্যু হয় এক মুহূর্তে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে হয়, আর কি কিছু দেওয়ার ছিল তাঁর?  ক্ষতি তো বটেই, যেকোনো কৃতি মানুষের মৃত্যুই ক্ষতি, পরিবারের এবং অবশ্যই, সমাজের কাছে। কিন্তু, যাঁর নতুন কিছু দেবার থাকে না, তাঁদের সম্পর্কেও ’অপূরণীয় ক্ষতি’ শব্দবন্ধ কতটা প্রযোজ্য হয়? প্রশ্ন উঠতেই পারে।

 

উত্তরটা খুব সহজ। যখন একজন লেজেন্ড জীবিত থাকেন, কর্মক্ষম থাকুন বা না-থাকুন—মাথার ওপর ছাদের মতো, আশ্রয়স্থলের মতো অনুভূত হয়। ইতিহাসে যখন ফিরে তাকাই, যখন মনে করি অমুক সময়ে আমাদের সমাজে জীবিত ছিলেন এক একাধিক মস্ত নেতা, শিল্পী কিংবা খেলোয়াড়— সেই সময়কে আমরা তখন ঈর্ষা করি। মনে হয়, কেন তাঁদের সময়ে আমরা জন্মাইনি কিংবা আমাদের সময়ে কেন এমন একজনের দেখা পেলাম না। একের বেশি প্রজন্ম, সর্বোপরি গোটা সমাজ ধনী অনুভব করে তাঁদের উপস্থিতিতে—মনে হয় এই সময়েও উনি আছেন, এও সৌভাগ্য আমাদের, এও অনুপ্রেরণা আমাদের।

 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুই-ই ছিলেন। কর্মক্ষম এবং জীবন্ত কিংবদন্তি—বিরল যুগলবন্দীতাই, ’অপূরণীয় ক্ষতি’ বলতে কোনো দ্বিধা থাকে না। তবে, কিংবদন্তি পর্যায়-ভুক্ত এ শিল্পীর লেগ্যাসি যে চিরকালীন। তিনি সত্যিই অপরাজিত।

 

Monday 16 November 2020

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ, কানাইলাল জানা

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ

কানাইলাল জানা 



২০০৬ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আলিপুরের বাড়িতে এলেন সাহিত্যের আড্ডায়। অনুষ্ঠান সন্ধে ৬ টায় এসে আটটা সাড়ে আটটায় চলে যাবেন বলে এলেন ৬ টা বাজতে ২ মিনিট বাকি এবং গেলেন রাত পৌনে ১১ টায়,  এমনই জমেছিল সেবারের 'মহল'। আর ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  সন্দীপণ চট্টোপাধ্যায় দিব্যেন্দু পালিত শুভাপ্রসন্ন পার্থ ঘোষ গৌরী ঘোষ রাজা সেন রাজা মিত্র কংকাবতী দত্ত প্রমুখ গুণীজন। কবি হিসেবে এসেছিলেন সৌমিত্রদা তাই তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়তে থাকলেন একের পর এক কবিতা। সবাই মুগ্ধ।  অনিবার্যভাবে আলোচনায় এল নাটক অভিনয় গান গাওয়া  রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমার সৌরভ গাংগুলি তনুজাসহ অন্যান্য নায়িকারা এবং বিশেষ ভাবে তুলসী চক্রবর্তী। যাওয়ার সময় তাঁর ভালোলাগার কথা জানিয়ে বলে গেলেন 'তোমার নতুন বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে রইল ' কারণ আলিপুরের বাড়ি তথা কোয়ার্টার্সে এটাই ছিল শেষ অনুষ্ঠান। 

আমরা তাঁর নানা গুনের কথা বলি কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সরকারের সরস্বতী সম্মান (৬ লক্ষ টাকা)   পেয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আনেয়ার শা রোডের মার্লিন হাউসে মজলিশ পার্টিতে আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন এবং সেখানে স্ন্যাকস নিতে নিতে সৌমিত্রদা যখন বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বলছিলেনঃ' ভাবো লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মধ্যে একসঙ্গে এত প্রতিভার সমাবেশ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি পাবে না কিন্তু। ' শুনে ভাবছিলাম সময় পেলে সৌমিত্রদা হয়তো ভাস্কর হওয়ার চেষ্টাটাও  ছাড়তেন না। 



আমার শ্রেষ্ঠ মুগ্ধতা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে তাঁর ৭০ তম জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে। ঢুকতেই পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর দাদার সংগে। লম্বায় একটু কম কিন্তু দেখতে অপরূপ যেন স্বর্গ থেকে এইমাত্র নেমে এলেন স্বয়ং দেবদূত! 


অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে রেহাই দিতে কয়েক বছর আগে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বড় অংকের অর্থ দিতে চায় শুনে তাঁর বাড়িতে গিয়ে  জিজ্ঞেস করতে বললেনঃ 'কোথায় বিশ্রাম?  বরং যত দিন যাচ্ছে তত নানা কাজে জড়িয়ে পড়ছি। '

যে কাজেই আত্মনিয়োগ করুন কবিতা চর্চা তাঁকে ছেড়ে যায়নি কখনো তাই বরাবর আমার আশা ছিল তাঁর এই গুণটা অন্য অভিনেতা কেউ না কেউ অনুসরণ  করবেন। স্বাধীনতার পর পরই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় যেভাবে বহু ফাঁকা জমি পেয়েছিলেন অনেক কিছু করার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবনে সেরকম ফাঁকা জমি না পেয়েও নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সারাজীবনটাই  তাঁর নির্মাণের কাহিনি যা ফল্গু ধারার মতো মানুষকে প্রেরণা দেবে নিজেকে প্রস্তুত করার। 

কয়েক দিন আগে তাঁর মোবাইলে ফোন করলে ছেলে সৌগত উদ্বেগ হীন কন্ঠে জানানঃ 'বাবা এখন স্টেবল্। ' শুনে একটু হলেও আশা জেগেছিল সম্ভব হলেও হতে পারে অন্তত কিছু দিনের জন্য ফিরলেন মিরাকল ঘটিয়ে 'ময়ূরবাহন '। 


এখন আমাদের সামনে থাকল শুধু সীমাহীন উদারতা ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষের আঙ্গিকে তিলে তিলে গড়া এক অসাধারণ সহজিয়া জীবন যিনি যে কোনো প্রলোভন ও মোহকে দূরে সরিয়ে মাতৃভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষাতেই সোনার ফসল ফলিয়ে  বাঙালি জাতির গৌরব এতটাই বৃদ্ধি করলেন সে যেন খ্যাতির এক পূর্ণ কুম্ভ। পিপাসার জল গড়িয়ে খেতে খেতে  যেমন চলে আমাদেরও তেমনি চলবে অনেক দিন...