মিঠুন চক্রবর্তীর কবিতা
অপাঠ্য
যখনই শহরে যাই, মনে পড়ে পলিদির কথা।
আগে গ্রাম ছিল।
বেখাপ্পা সারল্য সরিয়ে বুকের ঢালু পথে
আজও থেকে গেছে বহমান নদীটি ।
বিকেলের লঞ্চে বাড়ি ফিরি,
চলমান দূরে মানুষের টুকরো টুকরো তৈলচিত্রে
ক্রমশ কালো কালো ছোপ পড়ে আসে....
ভাবি, পলিদির সাথে শেষ কবে দেখা... মনে নেই
অজস্র কর্মব্যস্ততার মাঝে একা একলা নদীটিতে
সন্ধের আগে অপাঠ্য লাল লাল ঢেউ ওঠে....
অসুখ সময়ে
যেন কোন্ অসুখের মধ্যে আছি
ফুলের দিকে তেমন কোনো ফুল দেখিনা,
নদীর দিকে তেমন কোনো নদীও না
চরাচর জুড়ে ধূসর ঘোড়া এক ঘুমিয়ে রয়েছে ।
এইসব কুয়াশা পেরিয়ে কিছু বিলুপ্ত পাখি আসে,
ঠোঁটে খড়কুটো বয়ে এনে আমার ভেতরে বাসা বাঁধে।
আমি যেন শহুরে প্রাচীন বটের ভাঙাচুরো ছায়াটি
রোজ রাতে শেকড় থেকে এক বুনো চাঁদ উঠে এসে
একা একা চুপ করে বসে থাকে মাথার উপরে।
যে ভালোবেসেছে
ভাবনা জুড়ে স্পর্শ তোমার, আকাশ জুড়ে পথ....
ভালোবাসার কাছেই আছে মনে রাখার শপথ
মনের ভেতর সোনালি মাছ, বুকের ভেতর সুখ,
দখিন হাওয়ায় আলোর পালক এমনি করেই ভাসুক
এমনি করেই দিন কেটে যাক, এমনি করেই রাত
ঝিনুক-মহল সাজিয়ে রাখুক মুক্তো লেখা হাত
হাত ঘুরিয়ে বৃষ্টি নামাও.... হাত ঘুরিয়ে রোদ....
ভালোবাসা মানেই যেন আগুন পেল বারুদ।
আগুন দেখে উৎসাহীরা দেখতে এলে ছাঁই
দেখিয়ে দেবো পলাশ বনে ফুটেছে রোশনাই
মাঠ এবং ঘুমন্ত চাঁদ
সন্ধের মাঠটিতে ওরা এসে দাঁড়াল।
দু'পাশের গোলপোস্টের কোনোটিতেই তখন
কোনও বিষাদচিহ্ন ঝুলে নেই।
দাঁড়াতেই ঘাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মেঘ....
শান দেওয়া দু'ফোঁটা বৃষ্টি
বুকের রোমকূপে কতটা ধারালো হতে পারে
--- বুঝল পুরুষসঙ্গীটি
মেয়েটিও আগে কখনো দ্যাখেনি ,
পাথরের লকলকে জিভে লেগে থাকা নরম স্থাপত্য।
দূরে দিগন্ত নেই, রাস্তা.... নীল কুয়াশা চিরে
ঘুমন্ত চাঁদ কোলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে কাপাসতুলো
আলো
কচি নিমপাতার মত আঙুলে যখন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছ আমায়
তোমার হাতে রেখেছি আমার দীর্ঘ দিনের না সারা অসুখ
আহা! অসুখও কতখানি মনোরম হতে পারে
জ্যোৎস্না ছুঁয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে ইঁট- খসা প্রাচীন স্থাপত্য
এবং তুমি আঙুল নির্দেশ করে দেখাচ্ছ - 'ওই জানলা....
ফাটলে বটগাছ, ওখানেই তো এসে দাঁড়াত ইন্দুকুমারী
স্নান করে ছড়িয়ে দিত ভেজা লম্বা চুল, বেল ফুলের গন্ধ
আর, ঐ- ঐ যে দূরে চাঁপাগাছ ওখানে ব্রাহ্মণপুত্র চন্দ্রাহত
রোজ পূজোর ফুল তুলতে এসে সাজিতে ভরে নিত প্রেম... '
এখন আমি তোমার স্পর্শে আমাদমস্তক আলোর উৎসস্থল।
কিছুক্ষণ থেমে, কিছুটা অন্ধকার দেখিয়ে তুমি বলে উঠলে,
'ঐ - ওখানে কালো মোটা বীভৎস লোকটা অত্যন্ত গোপনে
একটা ধারালো অস্ত্র বাতাসে সবেগে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে
এসব সুগন্ধি দৃশ্যে ভারী পর্দা ফেলে নির্বিকার চিত্তে বলেছিল,
'রাজাদেশ একমাত্র সত্যি, বাকি সবকিছু ভ্রম, সত্যি ভেবো না '
মুচকি হাসলাম আমি, তুমিও বোধহয়
একঝাঁক বয়স্ক নক্ষত্রের নিচে অঙ্কুরিত আলোয় দেখছি,
প্রাচীন উঠোনে বসে হুবহু সবকিছু খাতায় তুলে নিচ্ছে
সাদা সালোয়ার-কামিজের পাশে হলুদ পাঞ্জাবী পর্যটক
কবি
পরিচিতি: বাঁকুড়া জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম ছাগুলিয়াতে জন্ম এবং বেড়ে
ওঠা।ছোটো থেকেই কবিতার প্রতি নিবিড় টান।বর্তমানে বিভিন্ন বাণিজ্যিক
পত্র-পত্রিকায় এবং লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত কবিতা প্রকাশিত হয়। পশ্চিম
মেদিনীপুরের একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতার সংগে যুক্ত।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
১ | যারা এখনও ভিজতে ভালোবাসে
২| যাপন কোলাজ
৩| রাতের কমলা রঙের মেয়েগুলি
৪| নীল প্রজাপতির উপত্যকা
৫| পঞ্চদর্শী ( পাঁচজন কবির কাব্য সংকলন)