Sunday 28 January 2018

সাহিত্য এখন,জানুয়ারি ২০১৮

সাহিত্য এখন,বইমেলা সংখ্যা


সম্পাদকীয় 
বইমেলা আসছে।সাজো সাজো রব চারদিকে।অসংখ্য নতুন বইয়ের খবর পাচ্ছি। তাদের মধ্যে কেউ কি বেস্ট সেলারের দলে নাম লেখাতে পারবে?পুরনো বেশ কিছু বই এখনও সেরাদের তালিকায় স্বমহিমায় বিরাজমান।  এবছরও কি বজায় থাকবে তাদের দাপট? এইসব হাজারো প্রশ্ন মনের কোণায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছে।বইমেলা যতই স্থান বদল করুক, আমরা পুরোদস্তুর মেলাতেই আছি।

মেলার কথা ভাবলে এখনো ময়দানের সেই পুরনো ধুলো ধুলো গন্ধটা নাকের ডগায় এসে সুড়সুড়ি দেয়। সেই ভস্তকের দরজায় কেমন হুড়োহুড়ি করে  ভীড় জমাতাম সস্তায় গোগোল,তুর্গেনিভ,টলস্টয়কে পকেটে পুরব বলে... স্টলে দাঁড়িয়ে অর্ধেক বই শেষ করে ফেলতাম।নতুন বই পড়ার আনন্দে দিব্যি হজম করে ফেলতাম বোম্বাই গুঁতোগাঁতা। আচ্ছা,এখনো কি কম বয়েসীরা এভাবেই বই পড়ে? ছোটরা? খুব জানতে ইচ্ছে করে।কিন্তু আগের মত প্রতিদিন বইমেলা চষে ফেলার সময়টা কখন যেন বাড়ির কচিকাঁচাদের পরীক্ষার সিলেবাসের তলায় চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে পড়ে আছে।সাধ থাকলেও তাকে উদ্ধার করার সাধ্য নেই।

তবু এরই মধ্যে যেটুকু খবর কানে আসছে, মানুষ আবার বইমুখো হচ্ছেন। অনেক বেশি মানুষ কলম ধরছেন,পড়ছেনও। আমার আপনার মত বইপোকাদের জন্যে এসব খবর সুসংবাদ বইকি।তবে ছোটদের জন্যে তেমন করে কলম ধরছেন কি কেউ? তাদের বোকাবাক্সের আর ভিডিও গেমের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য সুপারম্যানের মতই একজন সুপার অথরের অপেক্ষায় রইলাম।বইমেলা ভাল কাটুক।দেখা হবে।



মনের কথা(৫)
সৌরভ ভট্টাচার্য

‘দেশ’ পত্রিকার এবারের সংখ্যাটা হাতে পেলাম। রামকৃষ্ণদেবের অপূর্ব একটা ছবিতে মন আটকালো। লেখাগুলো মন দিয়ে পড়লাম। প্রথম লেখাটা নিয়ে কিছু বলার নেই, অর্থাৎ মার্টিন কেম্পশেনের লেখাটা, কথামৃতের অনুবাদ সংক্রান্ত।
     পরের লেখা দুটো ভাবালো। রামকৃষ্ণদেবের ছবি বাঙালী পরিবারে জন্মসূত্রে ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি। মাঝখানে মা-কালীর দু’পাশে রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী আর সামনে বিবেকানন্দ। বাবা প্রণাম করে অফিস বেরোতেন। মা স্নান করে প্রণাম করতেন। তারপর ঠাকুমার লেজুড় হয়ে থাকার সুবাদে বাংলা সিনেমায় রামকৃষ্ণের চরিত্রায়ণ দেখলাম। বুঝলাম ঈশ্বর এক, এই ওনার সব চাইতে বড় উপলব্ধি – যত মত তত পথ। তারপর স্কুলের কর্মশিক্ষা পরীক্ষায় প্লাস্টার অব প্যারিসে সবচাইতে পপুলার ছিলেন রামকৃষ্ণদেব। তাই লাগানো হল। শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কেন বিখ্যাত ছিলেন? উত্তর দিলাম, যত মত তত পথ বলেছিলেন। কিন্তু সেইটা উপলব্ধি করে জগতে যে কি উপকার হল তা বুঝিনি। শিক্ষক বললেন, শুধু তাই নয়, তিনি মা কালীর দর্শন পেয়েছিলেন। সেই কথা শুনে যতটা না শ্রদ্ধা জন্মালো, তার চাইতে বেশি জন্মালো কৌতুহল।
    তারপর পড়াশোনা বাড়ল। ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে। অবশ্যই আউট অব সিলেবাসের পড়া সেগুলো, কারণ নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সেদিন পড়েছিলাম, রামকৃষ্ণদেব ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ করেছিলেন; আজও ‘দেশ’-এ সেই কথাটার উপরেই সব চাইতে বড় জোর দেখলাম। সেদিনও বুঝিনি, আজও বুঝলাম না, তাতে কি লাভ হল? কথামৃত ভারতের নানা ভাষায় অনূদিত হল, প্রচুর রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা-উপশাখা খোলা হল। কত বড় বড় নামধারী শিক্ষিত কৃতী সন্তানেরা সন্ন্যাসী হল, কত লেকচার হল, কত অধিবেশন হল, কত বই লেখা হল, কত সেই বইগুলোর উপর বই লেখা হল...
     তাতে কি হল?
     ভারতের আজকের অবস্থানটাই কি তার যথেষ্ট নিষ্ফলতার প্রমাণপত্র নয়? কতগুলো দাঙ্গা হয়ে গেল ধর্মের নামে। আজও কত জায়গায় গনগনে আগুনের তাপ - ফুঁসছে সব। সলতে পাকানোই আছে, শুধু ফুলকির অপেক্ষা। কোথায় ‘যত পথ তত মত’-এর নমুনা? সেকি শুধু পাণ্ডিত্যের আর লেকচারের বিষয়? তবে গোলমালটা কোথায় হল?
     অনেকেই দোষটা রাজনীতির ঘাড়ে চাপিয়ে দায় এড়াতে চাইবেন। কিন্তু অতটা সরলীকরণের জায়গায় দাঁড়িয়ে কি আমরা? নয় তো। গোড়ায় গলদটা তো রয়েই যাচ্ছে। সেটা কি?

     প্রথম কথা, ধর্মে কি কোনোদিন সমন্বয় সম্ভব? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ দুটোই। যা লালন পারেন, কবীর পারেন, সেই অর্থে রামকৃষ্ণ ব্যর্থ হন। তার কারণ, রামকৃষ্ণ যতই পৃথক ধর্মমত প্রবর্তন না করে থাকুন, কিন্তু তাঁকে নিয়ে একটা সম্প্রদায়, ‘মিশন’ তৈরি হয়েছে। একটা সম্প্রদায় ‘সব সম্প্রদায়’ সমান প্রচার করতে পারেন, কিন্তু সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ হতে পারেন কি? হতে পারে সেখানে খ্রীষ্টানের মত পঁচিশে ডিসেম্বর, বৌদ্ধের মত বুদ্ধপূর্ণিমা, প্রাচীন হিন্দুর মত দূর্গাপূজা ইত্যাদির প্রচলন আছে; তাতে করে পাঁচমিশালি একটা সংস্কৃতি হয়, যার কোনোটাই আসল নয়, কিম্বা কোনটা আসল এই প্রশ্নে মানুষ বিভ্রান্ত হয়; কারণ সবক’টাই যে ‘মতো’, আসল তো নয়। যে খাঁটি খৃষ্টান সে চার্চে যাবে, যে খাঁটি মুসলিম সে মসজিদে যাবে, সে কেন বেলুড়ে যাবে? সময় কাটাতে, কৌতুহল মেটাতে, বা একজন দু’জন হয়ত বা আসতে পারেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেটা একটা ‘মতো’, আসল নয়।
     রামকৃষ্ণদেব কি তাই চাইতেন? তার নামে মন্দির হয়ে এরকম একটা পাঁচমেশালি কিছু হোক? সর্বোপরি তিনি কি রামকৃষ্ণ মিশন চাইতেন? মনে হয় না। আমি কোনো মিস্টিক তথ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু তিনি কোনোদিন এই সব তিথি পালনের মাধ্যমে খুব সরলীকরণের মাধ্যমে ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর বার্তা পৌছাতে চেয়েছিলেন? এটা কিরকম সেই রাজনৈতিক কৌশলের মত না? রামকৃষ্ণদেব কিন্তু এরকম কোনো বাহ্যিক সমীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। এমনকি তাকে মার্কেটিং করতে যে এই ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর ব্র্যাণ্ড করা হয়, এটা সারদাদেবীরও খুব অপছন্দ ছিল। তিনি বলেছেন, কোন মতলব এঁটে উনি এগুলো করেননি, ওটা হয়ে গিয়েছিল, ওনার প্রধান শিক্ষা ছিল ‘ত্যাগ’।
     মিশন কিন্তু সে পথে হাঁটেনি। তারা আমাদের মন্ত্রীদের মত বড়দিনে যীশুর ফটো, শঙ্করাচার্যের জন্মদিনে শঙ্করাচার্যের ফটো, আর বুদ্ধের জন্মদিনে বুদ্ধের ফটো টাঙ্গিয়ে উৎসব করার চেষ্টা করে আসছে। পাশাপাশি কালী-দূর্গা-সরস্বতীও চলছে। আমাদের বোঝানো হচ্ছে, এটাই রামকৃষ্ণদেবের ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’; কিন্তু তিনি এত সস্তা পথে হেঁটেছিলেন কি? না। রামকৃষ্ণ মিশনের স্টলে আপনি কোরাণ, বাইবেল, ত্রিপিটক পাবেন কি? না। কারণ রামকৃষ্ণ ‘অবতার-বরিষ্ঠায়’, অর্থাৎ সুপারলেটিভ ডিগ্রি লেগে গেল। তিনি সব অবতারের ফুল প্যাকেজ, প্রচারিত হতে শুরু হল; এমনকি তিনি সব দেব-দেবীর মূর্তির প্রকাশ – তাও প্রচারিত হতে শুরু করল। অর্থাৎ আমাদের বোঝানো হচ্ছে, একটু ঘুর পথে, কে শ্রেষ্ঠ বুঝে নাও। সুবিধা করে দিল কথামৃত – আকবরী আমলের টাকা এখন চলে না, এখন ফিভার মিক্সচার, পাঁচন না – ইত্যাদি উপমারাই রামকৃষ্ণের শিক্ষার উপর পুরো পাথর হয়ে বসল। শেষ পেরেকটা মারল রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষা পদ্ধতি। সেখানে যতই সর্বধর্মের সমন্বয়ের গল্প শোনানো হোক, মন্ত্র হয় রামকৃষ্ণদেবের নামেই প্রধান, কদাপি সারদাদেবীর নামে। সে আপনার যে দেবতাতেই অভিরুচি হোক। কারণ রামকৃষ্ণই সব – প্রধান। কি ভাবে একটা উদারতার ছদ্মবেশে গোঁড়ামি বাসা করছে দেখুন। ধর্মের ক্ষেত্রে এটাই চিরটাকাল হয়ে এসেছে, old wine in new bottle. তাই এবারের ‘দেশ’-এও যখন সুমন সেনগুপ্ত তার লেখার শেষ লাইন লিখছেন – “শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই এর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। শ্রীরামকৃষ্ণেই তাই মানবমুক্তি”, আমার কষ্ট হয় রামকৃষ্ণদেবের জন্যেই। এতটাই কি বোকা আমরা? কিসের ছদ্মবেশে কি বিষ গেলানো হচ্ছে বুঝি না? কবীর, শিরডির সাঁই, লালন – এরা কি শিক্ষা দিলেন তবে এই ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে?
     এতেই যত ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। রামকৃষ্ণ ক্যালেণ্ডারে এলেন, প্লাস্টার অফ প্যারিসে এলেন, সিনেমায় এলেন - কিন্তু জন-চেতনার গভীরে এলেন না। কারণ তাঁকে নিয়েই যে দল আজ। মঠ আজ। আরেকটা কথা বলে প্রসঙ্গের ইতি টানি – জীবসেবা যতই রামকৃষ্ণের শিক্ষা বলে চালানো হোক, আদতে তা নয়। পুরো কথামৃতই তার সাক্ষী। তিনি প্রাচীন ভারতের প্রধান ধারায় যে ভক্তি-জ্ঞানমার্গের কথা, তার পথচারী। নারদীয় ভক্তি, অদ্বৈতজ্ঞান ইত্যাদির পরিচায়ক, সমন্বয়কারী তো বটেই। একজন ভক্ত যখন সব অর্থ দিয়ে হাসপাতাল বানাবার কথা বলেন, রামকৃষ্ণদেব তাকে বিরত করেন। বলেন, ওসবের জন্য মানুষের জীবন না, তুমি ভক্তিলাভের সাধনা করো। এর অর্থ এই নয় যে উনি সেবার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু তাকেই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য করার পক্ষপাতী ছিলেন কি? ‘জীবেসেবার মাধ্যমেই আত্মার মুক্তি’ এটা পাশ্চাত্যের ধর্মের মূল সুর, যা তার প্রধান শিষ্যদ্বারা প্রচারিত। একসময় মঠে এই নিয়ে মেলা সমস্যাও হয় গুরুভাইদের মধ্যে। সারদাদেবী একটা মধ্যস্থতা করেন।
     তাই মনে হয়, আদতে রামকৃষ্ণদেব বলতে যা বুঝি তা দক্ষিণেশ্বরের ঘরে গেলে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে। তার নামে যে মিশন সে একটা পাঁচ-মিশালী সুকৌশলী প্রতিষ্ঠান। মোড়কটা অত্যন্ত উদার, ভিতরে তাই কি? সেইখানেই হল বিভ্রান্তির চূড়ান্ত। সত্যের যে জোর, কৌশলের সে জোর কি আছে?
     ‘Fact’-এর ব্যাখ্যা বদলে দিলে মাঝে মাঝে তা ‘আলোকে যে লোপ করে খায়, সেই কুয়াশা সর্বনেশে’ হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় রামকৃষ্ণদেবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কোথায় যেন একটা গোঁজামিল।

 মনের কথা(৬)
চিঠি
সুরাইয়া বেগম

 অভিমানী,
আজকাল কেউ আর চিঠি লিখেনা । উতল মনে কেউ আর থাকেনা চিঠির প্রতীক্ষায় । একটা সময় ছিলো যখন হোস্টেলে থাকতাম- উদগ্রীব হয়ে থাকতাম এই বুঝি ডাকপিয়ন ডেকে বলবে- ২২ নম্বর রূমের চিঠি এসেছে । নারে , আজকাল মানুষ ভুলেই গেছে চিঠি লেখার কথা । কেন লিখবে বল- ইচ্ছে করলেই মুঠোফানে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যায়, ফেসবুক ইনবক্সে চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যায় । তবুও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে শুয়ে শুয়ে চিঠি পড়ি । কাউকে দু' কলম লিখি মন খুলে । আজ তোকেই লিখছি । পড়িস সময় করে ।
কতগুলো বসন্ত চলে গেল জীবন থেকে , তাই নারে ! মনে হয় এইতো সেদিন জন্মেছিস । মেঘনার তীরে - আমাদের বাল্যস্মৃতির সবটুকুন নিয়ে যেই বাড়িটি চিরদিনের মতন তলিয়ে গেল , সেই বাড়িতে তোর জন্ম। ঠিক কোন এক বছরের এই দিন সন্ধ্যায় তোর জন্ম হলো । ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত, দুটো পা , ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা ছোট্ট একটা মানুষ ! কি বিস্ময় , কি বিস্ময় ! ছোট্ট আমি নেড়েচেড়ে দেখি তোর হাত , ধরে দেখি তোর পা । আহা ! এতো ছোট বুঝি মানুষ হয় ? একটু ক্ষিধে পেলেই চিৎকার করে ওঠে ওই ছোট্ট মানুষ ! ভীষণ ভড়কে যাই ছোট্ট আমি । সেই পুঁচকে মানুষটা বড় হতে লাগলো আমার হাত ধরে । খুব শখ করে কোলে নিতে চাইলে - বড়রা কেউ খাটে আমাকে বসিয়ে দিতো । তারপর তোকে আমার কোলে তুলে দিতো । ছোট্ট তুই আমার কোলে হাত পা নেড়ে জানান দিতি তোর অস্তিত্ব ।
খুব অভিমানী ছিলি সেই ছোট্টবেলা থেকে । বাবা তোকে ডাইনিং টেবিলের কোণায় তার বা পাশে তুলে বসাতেন । তারপর প্লেটে ভাত মেখে তোকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন । ভীষণ আহ্লাদী ছিলি , কথায় কথায় মুখ ভার হয়ে যেত । মাঝে মাঝে খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যেতি না খেয়ে । তোর উঠে যাওয়া দেখে বাবারও যে খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত ! আম্মা খুব একটা পাত্তা দিতেন না এসব রাগের । বলতেন- ক্ষিধে পেলে ঠিক খাবে ।
একবার কি হলো তোর মনে আছে ? মেঘনা নদী দেখতে যাবো বলে পুরো একটা পুঁচকের দল নানা বাড়ি থেকে রওয়ানা করলাম । আমাদের সাথে তুইও আছিস । তুই সাঁতার শিখিস নি । পানিতে তোর ভীষণ ভয় ! অথচ সেই মানুষ কিনা সবার সাথে চললো নদী দেখতে ! আমরা বাকিরা সবাই সাঁতার জানি । হাঁটছি তো হাঁটছি ! হঠাৎ সামনে পড়লো ছোট্ট একটা খাল । খালের উপর বাঁশের সাঁকো । সেই সাঁকো পেরিয়ে নদী বুঝি আর দেখা হবেনা আমাদের ! সাঁকো তো পাড় হওয়া সম্ভব নয় ! ওতোদূর পথ যেয়ে ফিরে আসবো , সবার খুব মন খারাপ হলো । শেষে একটা সিদ্ধান্ত হলো- নৌকা দিয়ে আমরা খালটা পার হবো । সবাই নৌকায় উঠে বসলো । মাঝি নৌকা অন্যপাড়ে ভিড়াবার আগেই পুঁচকের দলের কেউ একজন লাফঝাঁফ দিয়ে টালমাটাল করে দিলো নৌকা । সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করে উঠলো ভয়ে । আমি তো ভীষণ ভড়কে গেলাম ! তুই সাঁতার জানিস না । চিৎকার করে কাঁদতে লাগলি। পানিতে পড়ে গেলে ঠিক ডুবে যাবি । তোকে তো আর খুঁজে পাবোনা । তোকে হারানোর ভয়ে লাফ দিয়ে আমিই পানিতে নেমে গেলাম । দু' হাত দিয়ে শক্ত করে নৌকাটা ধরে রাখলাম । কোন রকম সেই যাত্রায় রক্ষা পেল নৌকা । তীরে ভেড়ানো হলো । সবাই নৌকা থেকে নেমে গেল । আমি ভেজা শরীরে তোকে জড়িয়ে ধরলাম । সেই দিনের মতন ভেস্তে গেল নদী দেখা । প্রচন্ড শীতে ভেজা কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ফিরলাম- না জানি আম্মা বুঝি আজ মেরেই ফেলবেন ! কিন্তু না । আম্মা দুজনকেই কাছে টেনে নিলেন । একটুও বকলেন না আমাকে ।
যেদিন ছোট ভাইটার জন্য সাইকেল কেনা হলো - কি যে আনন্দ আমাদের পুরো পরিবারে । দুই চাকার সাইকেলে আরো দুটো সাহায্যকারী চাকা । তাই নিয়ে তুমুল হুটোপুটি । কিছুক্ষণ তুই চালাস, কিছুক্ষণ ভাই চালায় । আস্তে আস্তে সাহায্যকারী চাকাদুটো ভেঙ্গে গেল । কি মুশকিল ! এখন আর তোরা দুজন সাইকেল চালাতে পারিস না । তোদের সাইকেল চালানো শেখাবার দায়িত্বটা আমিই নিলাম । সিটে বসিয়ে পেছন থেকে সাইকেল ধরে রাখি । তুই চালাতে থাকলি , আমি সাপোর্ট দিয়ে গেলাম । বলতাম- সামনে তাকিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যা , আমি ধরে আছি । তুই প্যাডেল মেরে যেতি - জোরে ছুটতো সাইকেল । আমি পিছনে পিছনে দৌড়ে দৌড়ে একসময় ছেড়ে দিতাম । তুই ঠিক চালিয়ে যেতিস নির্ভয়ে । কারণ তুই জানতি- তোর পেছনে তোর বড় বোন তোকে ধরে আছে, কিছুতেই তোকে পড়তে দেবেনা । যাতে সাইকেল থেমে গেলে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে না যাস তাই দৌড়ে দৌড়ে তোর সাইকেলের সাথেই থাকতাম। একদিনেই শিখে ফেললি সাইকেল চালানো । তোকে, ভাইকে আমি সাইকেল চালানো শিখিয়েছি- অথচ দেখ ! আমি নিজে সাইকেল চালাতে জানিনা । খুব আফসোস হয় আজ !
কত কিছুই না আজ মনে পড়ছে ! নারে সব লিখতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে । যেদিন তুই বেনারসি জড়িয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলি- আমার বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল । সারারাত এক ফোটা ঘুমাইনি আমি । রান্না ঘরের জানালা ধরে কত দিন যে অঝরে কেঁদেছি ! ঘরের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল । আমিও সব কিছুর মাঝে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম ।
এখনো কি সেই রকম অভিমানী আছিস ? একটু দুঃখ পেলে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলিস ? বুঝিরে ! সন্তান লালনপালন, সংসারের ঝক্কি ঝামেলা সামলে কখন আর অভিমান করবি ? হয়তো যখন বারান্দায় বসে থাকিস কোন একলা বিকেলে অথবা বৃষ্টিভেজা কোন সন্ধ্যায় - চোখের সামনে ঠিক শৈশব এসে ডানা ঝাপটায় । তাই নারে ? হয়তো মেঘনার অতলে হারিয়ে যাওয়া নানা বাড়িটা - যেটা আমাদের দু' জনেরই জন্মস্থান , খুব মনে পড়ে । ভালো থাকিস, খুউব ভালো ।
আপু

রম্য রচনা
গুরুত্ব
প্রদীপ গুপ্ত

কারা যেন তাদের গুরুত্ব নিয়ে খুব চিন্তান্বিত থাকে। বেশী বেশী করে  নিজেদের উপস্থিতির প্রদর্শন করে বোঝাতে চায় তাদের অপরিসীম গুরুত্বের কথা। তুমি ধরো ফুলের দোকানে দাঁড়িয়ে আছো, ফুল নেবে বলে, ধরো তোমার সামনে আরও জনাকয়েক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। দোকানি এক এক করে সব্বাইকে কার গাঁদা ফুলের মালা লাগবে, কার রজনীগন্ধার, কার আমসরা লাগবে তো কার পান আর কলা, সেসব জনে জনে জিজ্ঞাসা করে ক্যারিব্যাগে ভরে এগিয়ে দিচ্ছেন, এমনি সময় তিনি এলেন,
" কিরে স্যপন্ আজ কি দেরি করে এস্যেচিস নাকি? এত্তো লোক দাঁড়িয়ে লাইনে? "
দোকানি তার কাজ করে চলেছেন, মানুষজনেরা তাদের মতোন দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি হামলে পড়লেন দোকানে। একটা আমসরার বান্ডিল খুলে চারিদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে নিখুঁত পল্লব বাছতে লাগলেন।বেলপাতার ডাল থেকে বেলপাতা ছিঁড়ে নিয়ে খালি ডালটা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের দিকে ফেলে ডায়লগ দিলেন -
" নে নে, -- তাড়াতাড়ি দেতো , দশটার ভেতর আবার অপিস ঢুকতে হবে, এইনে -"
                  বলে হাতে ধরা বেলপাতা, আমপাতা এগিয়ে দিলেন। মানুষজন একটু এ ওর দিকে তাকালেন, মুখ থেকে চুকচাক শব্দ করলেন, কেউ একটু বদন বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসার চেষ্টা করলেন, দোকানি হাত বাড়িয়ে পাতাগুলো নিতে যেতেই একজন মানুষ ঠান্ডাকঠিন গলায় বলে উঠলেন --" স্বপন, লাইন অনুযায়ী দাও, এখানে কেউ ঘোড়ার ঘাস কাটতে আসেনি। সব্বারই হাতে কাজ আছে, তাড়া থাকলে কাল সকাল সকাল আসতে বলো। "
লাইনটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। মুখ বাঁকানো লোকটা অস্ফুটে কিছু একটু বললেন, দোকানী র হাত ফের আগের মতই চলতে লাগলো।

             একদিন বাজার করে ফিরছি রাস্তায় মুকুন্দের সাথে দেখা। আরে সেই মুকুন্দ যে আমাকেও তারই মতো পাগল না ভেবে তার মতোই সুস্থ মানুষ মনে করে।
--" কি একটু ঠান্ডা পড়ছে মনে হচ্চে? "
আমি শুধোই।
--" তা একটু তো বটেই। এখন অর্জুনগাছের ছাল ফাটতে শুরু করবে বুঝেছো? "
--" তাই? "
আমি উত্তর করি। যেন একটা খুব গূঢ় কথা বলছে এভাবে সামনে এগিয়ে এলো মুকুন্দ --
" সূর্যটা দেখবে এখন একটু ইচ্ছে করেই মিঠেকড়া রোদ ঢালবে, যেমনি গ্রীষ্মকালে শীত ডানা মেলে সাইবেরিয়া পালায়, আসলে প্রকৃতিও জানেন কাকে কখন কতটুকু গুরুত্ব দিতে হয় বুঝেছো? "
-- " তুমি বলবে আর আমি বুঝবো না? "
আমি হাঁদারামের মতো মাথা নেড়ে তাল মারি।
--" এই আমি চলি বুঝেছো? আমার আবার --"
বলে মুকুন্দ হনহন করে হাঁটা লাগায়। আমি পরিস্কার বুঝতে পারি মুকুন্দও তার গুরুত্ব বুঝেই হাঁটা লাগালো। আমি হাঁ করে তার চলে যাওয়ার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করি।

অনুগল্প

শিরদাঁড়া
দিব্যায়ন সরকার


“ আলো - আঁধারির খেলা, তীব্র উৎকট দুর্বোধ্য গান আর বিলিতি মদের উগ্র গন্ধ - সব মিশিয়ে একটা অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়েছিল সৌমেন। সমস্ত ডিস্কো বারটা যেন বিদ্রুপ করছে তাকে ! অ্যালকোহল বারৈর সুদৃশ্য কাউন্টারের ওপারে সুন্দরী অ্যাটেন্ডার, তারও ওপারে দামী মদের বোতলগুলো - সবাই মিলে একসঙ্গে চতুর্দিক থেকে চেপে ধরছে তাকে।

এই ডিস্কো ব্যাপারটার সঙ্গে প্রথমবার পরিচয় সৌমেনের। মফঃস্বলের ছেলে চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালোরে আর বন্ধু সূত্রে এখানে। গৌরব আর শ্যামানুজের চাপাচাপিতে কিছুটা কৌতুহলি হয়েই এসেছে। গৌরব আবার বদান্যতায় তার ভাড়াটাও দিয়ে দিয়েছে ঢোকার সময়। এক রাতের ফুর্তির জন্য অতগুলো টাকা ঢেলে দেওয়া দেখে কিছুটা শিউরেছিল সৌমেন, কিন্তু টাকাটা তার পকেট থেকে যায়নি জন্য চেপে গিয়েছিল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই অ্যালকোহল, সোডা আর রকমারি পারফিউমের ঝাঁঝালো গন্ধে নাক কুঁচকে গেলেও সহ্য করে নিয়েছে।

ঢোকার পর হয়তো মিনিট পাঁচেক বসেছে একটা টেবিলে, হঠাৎ দুজন 'স্বল্প বসনা'র আগমন। গৌরব ও শ্যামানুজের সঙ্গে বেশ রসিয়ে গল্প শুরু করেছিল। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল তারা পূর্বপরিচিত। সৌমেনের সাথে পরিচয় করিয়েছিল শ্যামানুজ। কিছুক্ষণ সৌমেনকে আগপাশতলা মেপে একটা অর্থপূর্ণ হাসি হেসেছিল দুজনে। সৌমেন প্রথমে কথা বলেছে দু একটা, তারপর নিজেই আগ্রহ হারিয়েছে।

বারের সামনে দাঁড়িয়ে ড্যান্সবারের দিকে তাকিয়েছিল সৌমেন।  তার দুই বন্ধুকেই চোখে পড়ছে, দুই সুন্দরীর কোমর জড়িয়ে নেচে যাচ্ছে দু'জনে। কিছুটা দেখেই চোখ ক্লান্ত হয়ে গেল, বুঝে এল ধীরে ধীরে।

আচমকা পিঠে এক আলতো টোকায় ফিরে দাঁড়াল সৌমেন। উজ্জ্বল নীল দুটি চোখ যেন গিলে খেতে চাইছে তাকে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাবেনা।  চোখ দুটির মালকিন আরও কিছুটা সরে এসে নাকিসুরে প্রশ্ন করে -
- “ আর ইউ সিঙ্গল ? ”
বিভ্রান্ত লাগে সৌমেনের। এতটা কাছ থেকে অচেনা এই অল্প পোশাক পরিহিতাকে দেখে কিছুটা থ' খায়। চোখে মুখে উগ্র মেকআপে, পারফিউমের জ্বালাময়ী গন্ধে দিশেহারা লাগে তার।
- “ হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ' সিঙ্গল' ?  আই কেম হেয়ার উইথ টু অফ মাই ফ্রেন্ডস।”
বেগুনি ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এসেই মিলিয়ে গেল, যেন বলতে চাইল - 'ন্যাকা !  বোঝে না কিছুই।'  কিন্তু দ্বিতীয় কথাটি বলার আগেই গৌরবরা এসে পড়ল সদলবলে।
- “ ওহ রিমলি ইউ আর লুকিং গরজিয়াস টুডে।”
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ঝড়ে পড়ল শ্যামানুজের গলায়। “ ইউ মেট সৌমেন? মাই ফ্রেন্ড অ্যান্ড কলিগ।”
সুতীক্ষ্ণ কটাক্ষের দৃষ্টিতে সৌমেনকে আর একবার মেপে নেয় রিমলি। তারপর পরিস্কার বাংলায় বলে,
- “তোমাদের এই খোকাটি তো কিছুই নিচ্ছে না। তাই আমিই এগিয়ে এলাম মানুষ করতে।”
হো হো হাসির হুল্লোরে ভেসে যাচ্ছে ওরা। সৌমেন কিছুই বলল না। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের একনিষ্ঠ পাঠক, চারপাশের পরিবেশ থেকে লক্ষ যোজন দূর তার দুনিয়া।
- “ কাম অন সৌমেন, এবার একটা হুইস্কি নিতেই হবে কিন্তু। মান বাঁচাতে।”
গৌরবের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল একবার সৌমেন। তার দিকে এগিয়ে আসা হাতের গ্লাসটিতে সোনালী তরল। হাতের আঙুলগুলির বাঁকানো ভঙ্গী, নখ থেকে ঠিকরে আসছে নেলপালিশের নকল রঙ। সাদা ফ্যাকাশে হাতে একটা দামী সোনার বালা। সৌমেনের হঠাৎ মনে হল ঐ রঙটার মতো এই দুনিয়াটাও নকল। বিরক্তর ভঙ্গিতে ঠেলে গ্লাসটিকে সরিয়ে দিল এক ধাক্কায়।
- “ লেট ইট গো গৌরব, অনেক আগেই বুঝেছি তোমাদের বন্ধুটি পুরোপুরি অক্ষম।”
আর একবার হাসির লহরে ভেসে যায় ওরা। গৌরব - শ্যামানুজও গলে পড়ে। হাসি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল গৌরব। তারপর স্থির অথচ দৃঢ় গলায় বলল,
- “ আমার অক্ষমতা ক্ষমা করিস গৌরব। সত্যি আর পারছি না দাঁড়িয়ে থাকতে। আর আমার মান এত সহজে যায় না আর তা রাখতে মদ গিলতেও হয় না।  ইউ এনজয় ইওর পার্টি। থ্যাংকস। ”
মাথা উঁচু করে সোজা হেঁটে বেড়িয়ে যায় সৌমেন। বাকিদের বিদ্রুপ করা দৃষ্টিগুলি পেছনে ফেলে রেখে..... ”

  না ! কেন জানি না গল্পগুলো আর মিলছে না অপ্রতিমবাবুর। বইমেলা সংখ্যায় এত এত লেখার অনুরোধ কিন্তু আজব ব্যাপার দুধের মতো গল্পগুলোকে ক্ষীর আর করা যাচ্ছে না। শেষে এসে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে । তাহলে কি মা সরস্বতী  তার ওপর রুষ্ট, না তার সমস্ত লেখা ফুরিয়ে গেছে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মীরাকে এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দিলেন অপ্রতিমবাবু। নতুন উদ্যমে আবার শুরু করতে হবে যে।

কবিতা

সিন্দুক
বিশ্বজিৎ মাইতি

ঘূর্ণাবর্তে ধুয়ে গেল আরো একটা চাঁদ,
মন খারাপের গল্পটা আজ তবে থাক।
সিন্দুকে কটা অক্ষর তুলে রেখেছি,
চলো বরং তোমাকে গিয়ে দেখাই-
এই দেখো বাদামি রঙের অক্ষরগুলো,
অনেকটা ঠিক ঝরে যাওয়া মেইপল পাতার মতন দেখতে,
তাই না?
তুমি চাইলে ছুঁয়ে দেখতে পার,
আজ বিকেলে পথের ধারে কুড়িয়ে পেলাম আবার কয়েকটা-
ওদের নাম দিয়েছি অবসাদ।
ওই কোণে লাল দোয়াতের পাশে রাখা অক্ষরগুলো
তুমি দেখতে চেয়ো না,
ওগুলো গোছানো হয় নি এখনো।
ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে ‘শেষের কবিতা’ লিখব,
দেখো তোমার দেওয়া ঝর্ণাকলম হলুদ মলাটের খাতা
সব গুছিয়ে রেখেছি,
ওরা আমার অভিমান।
চোখ বন্ধ করে এবার হাত রাখ এখানে-
তোমার শীত করছে বোধ হয়,
শুনতে পাচ্ছ,
সরবতি লেবুর কচি পাতা বেয়ে
ঘাসের উপর গড়িয়ে পড়ছে হেমন্তের শিশির-
হরিণ শিশুর দল সানন্দে ছিঁড়ে খাচ্ছে সেই সুগন্ধি ঘাস,
বড় অদ্ভুত তার স্বাদ।
দেখেছো তোমার জানালার ফাঁকে
রোদ মেখে চেয়ে আছে অপলক
দুটি আকাশ রঙের ঘাস ফুল,
দেখেছো কি?
ও দুটি এই অধমের আঁকা,
ওদের নাম রেখেছি সুখ।

সন্তান
জগন্নাথদেব মণ্ডল

হীরাসায়রের অতল জলে গর্ভপাত হয় রাঙাবৌয়ের।নাকে নথ পরা কালবোশ মাছ নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে দিয়েছিল।পাঁকের নীচে তলিয়ে যায় সদ্যোজাত সন্তান।
জাল ফেলেও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

রানিদি রাঙাবৌয়ের বড়ো মেয়ে।দিদি সারারাত মরা জ্যোৎস্নায় গা চুবিয়ে 'ভাই ভাই' করে কেঁদে মরেছে হীরাসায়রের পাড়ে।

মৃত সন্তানটির পুরুষাঙ্গ মিশে গিয়েছে গেঁড়ি- গুগলির চোখের জলে।ওই গুগুলি ঠুকরে খায় হলুদ পায়ের ধলা হাঁস।

পুরুষাঙ্গ বাদে  কাদায় ঢাকা পড়া  নতুন নাভি অার নাসারন্ধ্র থেকে জন্ম নয় শাপলা ফুল।কুড়ানী মাসি ওই শাপলা ফুল দিয়ে ঢ্যাপের খই ভেজেছে।

রানিদি কোঁচড় ভর্তি খই নিয়ে দত্তদের বাড়ি চলে গেছে।ওদের সাদাকালো টিভিতে ' জন্মভূমি' দেখতে দেখতে মুঠো মুঠো ভাই-খই খাবে রানিদি।

সন্ধ্যের অাঁধার যেন প্রসব যন্ত্রণায় চুপ।সন্তান শোক অতিক্রম করা, স্থির রাঙাবৌ হাঁস তুলতে এসেছে হীরাসায়রের কিনারে।বৌয়ের একঢাল চুলে ছোট্ট একটু গিঁট বাঁধা।

সন্তানস্পর্শ মাখা গুগলি খেয়ে পেট ভারী হয়ে গেছে হাঁসগুলোর।কিছুতেই উঠে অাসছে না হলদে পায়ের ধলা হাঁস।

জলের ভেজাভেজা বাতাসে শুধু মৃত পুত্রের ঘ্রান।কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে রাঙাবৌয়ের চৈ চৈ ডাক।
জলপাই গাছ পেরিয়ে বুড়ো পিটুলি গাছের পাশ দিয়ে স্নান করতে অাসছে মালোপাড়ার গর্ভবতী লবঙ্গবউ।

   


  ফ্যাসিস্ট
  আর্যতীর্থ

দাও, পিষে দাও, চাপ দাও আরো।
ঘাড় গুঁজে দাও যতখানি পারো।
এদিকে ওদিকে সাবধানে দেখো, প্রশ্নরা কার চোখে।
কিভাবে সে জিভে লাগাম টানবে আগে থেকে ফেলো ছকে।

আভূমি করছে কুর্নিশ যারা,তারাই কেবল প্রজা। বাকিরা সবাই বিপজ্জ্বনক, নীতি এ সাপ্টা সোজা। তোমার খেয়ালে তালে তাল দিলে সেইজন ভারী প্রিয়। বিরুদ্ধমত অন্ধকূপের আঁধারেই রাখা শ্রেয়।

শিরদাঁড়াটির বদলে চেয়েছো কেঁচো ।
সঙ্গী সাথীও সেভাবেই বেছেছো।
অষ্টপ্রহর গুণকীর্তণে ভরিয়ে রেখেছো ঘর।
স্বভাবত তাই বিরোধীকণ্ঠ স্বপ্নের অগোচর।

অথচ সেসব দোষারোপ নয়, ছিলো শুধু অভিযোগ। দিনগত পাপে নিত্যকালের লেগে থাকা দুর্ভোগ।
সে সব নালিশ লেগে থাকে সব যাপনের ভাঁজে ভাঁজে। খামোখা তাদের চেপে রেখে দিলে তোমার হুকুমরাজে।

সিংহাসনকে জীবন ভেবেছো, স্বয়ংকে ভগবান।অমৃতজ্ঞানে তাই ভালো লাগে ক্ষমতার বিষপান। বিরোধী কথাকে বিদ্রোহ ভেবে পায়ের তলায় পেষো। কবে ভুলে গেছো সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের অভ্যেসও।

বড্ড দুঃখ, ইতিহাস পড়ো নি।
আঁধারের দিকে গিয়েছে ও সরণী।
সত্যি জানাবে কখনো তোমায় আয়না ।
সব শিরদাঁড়া ওভাবে নোয়ানো যায় না।


শুধু তোমার লেখার অপেক্ষায়
প্রত্যূষ কান্তি কর্মকার

কিছুই যদি না লেখা যায় তবে আবার বৈঠা ধরো কবি
পালের ডগায় বাতাস ভরে ঢেউয়ের সাথে মিতালী করো
যেমন ভাবে বইবে তোমায় তেমন তেমন ভাসতে থাকো,বাঙ্ময়তায় ভরিয়ে তোলো বেঁচে থাকার দিগন্ত রঙ,মুহূর্তের অবিন্যস্ত দীঘি
আমার সুন্দর নদীর পাহাড়িয়া জল তল পাবে বলে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমেছে
তোমার নৌকো বাওয়া সাগরের কাছে,ভাবি
মিটে যাবে বহু বছরের অবিশ্রান্ত জমে ওঠা ঋণ
তোমার বুকের ভেতরে ফানুসের মত কূল আলোময় ভেসে থাকে
জেগে থাকে একশ পাতার কলকাকলি, হাজার পাতার ছল,দূরে বসে দেখতে দেখতে
দুঃখ আর মায়ার ভরে যায় বিকেলের গোধূলি রঙিন হাত
হলুদ ঠোঁটের থেকে প্রয়োজন ঝরে যায় ধূ ধূ শোওয়া মাঠের কোণায় কোণায়
আমি প্রতি বসন্তে জমিয়ে রাখা রাত্রির কণা জুড়ে গড়ে ফেলি দীর্ঘ উঠোন
শুধু তোমার লেখার অপেক্ষায়,কবি,আমার অঙ্গনে সন্ধ্যার ধূপের গন্ধ ওড়ে না

মাথুর
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

বনপলাশীর বনে তোমার ছাতিম গন্ধ মনে পড়ে
এখনি কি ফিরে যাবে হৃদি?
ছন্নদেহ বসে আছি বিষণ্ণ বনে
দূরাগত আমার বঁধুয়া,
আতুর পাখিটি দেখ ডাক দিল কার নাম ধরে
কাঁখের কলসে ভরে আকুলা নদীটি ঘরে গেল
অতসী অমিয়মাখা মুখখানি আহা
গ্রামের বধূটি,পায়ে চুম্বনের দাগ
কবে তুমি ডাক দেবে
দেহি পদ পল্লব বলে...