বহুক্ষণ চেয়ে বসে আছি। এ কমাস কয়েকশো
বার ওপর নীচ করেছি, বাহাত্তরটা সিঁড়ি,ঝকঝকে মুখস্থ। জুতোর তলায় লাগা
ধৈর্য্যটা কয়েকবার ছিঁড়ে গেছিল পেরেক লাগিয়ে মেরামত করে নিয়েছি। খুব
দৌড়াদৌড়ি করছি, যেখানেই যাচ্ছি পাশের টেবিল দেখিয়ে দিচ্ছে, বা পাঠিয়ে
দিচ্ছে ওপর তলায়! আমার মতো আম আদমির জন্য লিফট নয়! অগত্যা...! চৌত্রিশের
দাদা থেকে ছসাত বছরের দিদি, আন্দোলন, পরিবর্তন সব একই! দেয়ালের রঙ গুলোয়
শুধু বদলের নতুন গন্ধ শুঁকে নেয়া।
বাবার পেনশন নিয়ে ছোটাছুটি। বড়দা আছে বেশ! গর্ভমেন্ট অফিসার, সত্যি অর্থে
সোনার টুকরো ছেলে । প্রতি বছর পে-কমিশন আর বোনাসে বদলে যাচ্ছে ওর রোগা
গিলগিলে চেহারাটা! তবু অসম্ভব সংযমী পকেট, নেই নেই লেগেই আছে। আর বাড়িতে
বেকার ভাই থাকলে তো "আপনার আজকের দিনটি"তে সবসময়ই থাকবে খোঁচা, চিমটি আর
হাহুতাশ! এইবার লোকটা তাকিয়েছে! আজ তিনমাস আসছি, এতোদিন পড়তে পারিনি চশমার
পেছনে আড়াল করা ইচ্ছেটা। চকচক করছে চোখ,বোধহয় বলতে চাইছে, প্রাইভেট টক আছে!
কাজ শেষ, ফিরছি! ঝিমলিকে একটা ফোন করতে ইচ্ছে করছে। সেই ঝিমলি, যাকে দেখার
জন্য রোজ দুপুরে ঠা ঠা রোদে ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেছি, বৃষ্টিতে ভিজে চুবচুবে
হয়ে ওর কোচিংয়ের পাশের গলিতে অপেক্ষা করেছি! ওর একবার চাউনিতে লুকোনো ইচ্ছে
গুলো রোজ একটু করে সেঁকে নিয়েছি! ওই কালভার্টটার সোঁদা সন্ধ্যে গুলোয়
ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে বারবার বলেছি,'আমি শুধু তোমারই সোনা!' কতোবার বাবার
মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে ওকে সিনেমা দেখিয়েছি! না, সততার বাতিক ছিল না
কোনোদিনই! প্রেমিককে সৎ হলে চলে না, প্রেমিক মানেই ব্র্যান্ডেড মিথ্যেবাদী,
অসৎ; সব চলে। ওটায় নরক দর্শন হয় না, শ্রীকৃষ্ণ থেকে জন লিলি একই কথা বলে
গেছেন।
সবাই বলত পড়াশোনায় মাথাটা আমার বেশ ভালোই! ঝিমলিও হয়তো তাই
ভেবেছিল! কিন্তু বরাবরই আমার গড়পরতা কিছুই ভালোলাগে না। দাদা খুব হিসেব করে
চলত। কলেজে থাকতেই ছাত্র-রাজনীতি, ভোট, মিছিল, মিটিং, সাথে রঙবেরঙের
স্বপ্ন বুনে দেয়া তরুণ পলিটিসিয়ান! তারপরে আখের গুছিয়ে কাট্টুস! আমার ওসব
আসে না! তাই ঝিমলিকেও বোধহয় ঠিকঠাক স্বপ্ন দেখাতে পারিনি। বেকার বাউন্ডুলে
প্রেমিকের থেকে, গান্ধীর হাসি ভরা নোট গোনা অফিসার অনেক দামি। প্রেমও
হরেদরে সেই ডারউইনের থিওরি, "সার্ভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট "।এখন তাই ইংলিশ
ফন্টে বাংলা ভালোবাসা ভরা মেসেজ গেছে কমে। হাড়হাভাতে ফোনটা তবু অপেক্ষায়
থাকে। তবু আজো বুকপকেট ভরতি ঘামে ভেজা প্রাইভেট টক!
ভীষণ ঘুম
পাচ্ছে! আজ ফিরেছি দেরিতে। খাবার গুছোনো ছিল টেবিলে, খেয়ে নিয়েছি। একবছর
আগে পর্যন্ত মা বসে থাকত। তখনো পর্যন্ত বাড়ির কিছু নির্বিরোধ সমস্যা
জানাত। হয়তো আশা ছিল কোথাও আমিও কালেকালে দাদা হয়ে উঠব। মশা ধূপ জ্বলছে,
অভ্যস্ত মশা গুলো তাও বার করে নেবে জীবনের নির্যাসটা! কড়া ধোঁয়ায় দেখছি
কিছু মুখ, ঝাপসা । ওরা কারা? মা বাবা দাদা ঝিমলির মতো লাগছে! দেখতে আলাদা,
কিন্তু সেই চেনা গন্ধ একেক জনের! আমার হাতে অনেক গুলো মুখোশ! ছড়িয়ে পড়ে আছে
মায়ের তেলচিটে আঁচলটা, বাবার পেন, দাদার গিটার , ওই তো ঝিমলির সেই বুকের
কাছের লাল তিলটা! রোজ সূর্যাস্ত দেখতাম, ওটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! সেই
পুরনো মিলটা,তেলকলটা ! বিকেলে পাড়ার মোড়ের ক্যারামবোর্ড! চারিদিক নিশ্চুপ!
কথাগুলো, শব্দগুলো ফুরিয়ে গেছে! মাথার করিডোর অন্ধকার, মোমবাতিগুলো
মিছিলে যাচ্ছে হেঁটে! বুকের কষ্টটা নিঃশ্বাসে চেপে বসছে। উফফ! স্বপ্নটাও
বলছে, সব প্রাইভেট টক শেষ, শেষ, শেষ.....!