Wednesday 24 October 2018

সাহিত্য এখন শারদ সংখ্যা, ২০১৮


সাহিত্য এখন শারদ সংখ্যা,২০১৮

সম্পাদকীয়

 

এই অক্টোবরে ‘সাহিত্য এখন’এর বয়স একবছর হল। গতবছর ঠিক এই সময়ে পথচলা শুরু করেছিল ‘সাহিত্য এখন’ ব্লগজিন। নতুনের উত্তেজনা তো ছিলই, তার সাথে সাথে সংশয়ও কম ছিল না। সাহিত্য এখন পারবে তো আপনাদের মন জয় করতে? পারবে নিজের পথে অবিচল হয়ে এগিয়ে যেতে?
আজ এই বর্ষপূর্তি সংখ্যায় এসে মনে হল, আপনারা সত্যিকারের বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই আজ এই পথটুকু এগিয়ে যেতে পেরেছে এই পত্রিকা। আরও অনেক কিছু করা বাকি। সামনে এখনও অনেকটা পথ। কিন্তু ভরসা আছে, আপনাদের পাশে পাব।
সাহিত্য এখনের এই সংখ্যাটি শারদ সংখ্যা। যদিও দুর্গাপুজো পার হয়ে গিয়েছে। তবু উৎসবের আবহ এখনও বর্তমান। সকলকে বিজয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। চরৈবেতি।

পুজোর কথা 

কপোতাক্ষ পাড়ের দুর্গাপুজো
মৈত্রেয়ী সরকার  

ষষ্ঠীর ভোরে মা একমাত্র প্যান্ডেলে গিয়ে দুর্গাঠাকুরের মুখ দেখতেন। পুজোর পাচ ছয়দিন আর তিনি ঘর থেকে বেরোতেন না।আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশাপাশি একটা পুরো গোলাকৃতি মাঠ ছিলো। সেখানে মহালয়ার দিন থেকেই বাশে দড়ির গিট পড়তো।আমরা সকাল বিকেল ওই বাশে গিয়ে চড়তাম,মারামারি করতাম, ছোঁয়াছুয়ি খেলতাম।তারপর পঞ্চমীর মাঝরাতের দিকে প্রবল ঢাকের বাজনার শব্দ এলে ঘুম ভেঙ্গে নেচে উঠতাম।মা বলতেন  এবছর কৈলাশ থেকে দোলায় করে মা এলেন।যদিও আমরা জানতাম ছোটো শম্ভুর চারশো সাতে করে কচুয়ার সুবীর পালের কুমোর ঘর থেকেই দুর্গা প্রতিমা আসে,তবুও চুপ করে মাঝরাতে মায়ের কথা শুনতাম।কল্পনা করতাম, সাদা পেঁজা তুলোর মেঘের  ভেতর থেকে পাল্কী চড়ে নতুন বৌএর মতো বেনারসি পরে সালঙ্কারা মা নেমে আসছেন গোলমাঠের প্যান্ডেলে, পেছনে লাইন দিয়ে আসছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গনেশ, কার্তিক।

      ষষ্ঠীর ভোরে আমি আর মা প্রথমে সাঝি ভোরে শিউলি ফুল কুড়োতাম।অভাবের সংসারে মা তন্তুজের লালপাড় সাদা পাটের কাপড়ই বেশি পরতেন।সেই অলৌকিক ভোরে মায়ের কাপড় আর শিউলিতলা এক সাজে একাকার হয়ে যেতো।মা আচল ভরে শিউলি কুড়িয়ে নিতেন। হাল্কা শীত শীত কুয়াশায় আর শিউলির মিষ্টি গন্ধে মাকে কেমন দেবী দেবী মনে হতো।
   
       আমি আর মা ঝাপসা কুয়াশার চাদর মেখে প্যান্ডেলে যেতাম ঠাকুর দেখতে।মা তখনো অস্ত্রসজ্জিত হন নি,বোধন হয় নি।মা সেই মুর্তি দেখেই ফিরে আসতেন।চোখে জল থাকতো মায়ের। দুর্গাপুজো মায়ের এটুকুই। মা দেশছাড়া হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কখনো পুজো দেখবেন না। বাংলাদেশের গ্রামে জন্মদাত্রী মা, ভবঘুরে বাউন্ডুলে বৈষ্ণব বাবা আর ছোটো ছোটো কোলে পিঠের আট ভাইবোন ফেলে দেশ ছেড়েছিলেন মা।লীগের কিছু মানুষের অত্যাচারে মেয়েদের গ্রামে থাকাই তখন দায়। এমনই এক ষষ্ঠীর সকালে কপোতাক্ষের ঘাটে নৌকায় উঠেছিলেন মা।স্রোতের টানে যেতে যেতে শুনেছিলেন চন্ডী মন্ডপে ঢাক বাজছে,সরোজ ঠাকুর বোধনের মন্ত্র পড়ছেন। দূরে আরো  দুরে ঝাপসা ভাই বোনগুলো নদীর সাদা বালির চরে লুটোপুটি খাচ্ছে অবুঝ আনন্দে কিম্বা বিষাদে। বোধনের মায়ের চক্ষুদানের কাজলমাখা অশ্রু গাঙের কূলের জলে।

    চন্ডী মন্ডপে কাঠাম আসতো সোজা রথের দিন।কাঠাম পুজোর পর হতো গ্রামের মানুষের হাতে প্রসাদ বিতরণ।তারপর কাদা খেলা।নদীর চরে কাদায় বালিতে ছেলেরা মেয়েরা আলাদা আলাদা কাদা মাখামাখি করতো।স্নান সেরে এসে জুড়োন।তারপর বিকেলে কুমিরায় রথের মেলা দেখা।চুড়ি,আলতা,ডয়া কলা, খুলনার বিখ্যাত প্যাঁড়া, এক হাতী ছানার জিলিপি আর। মাটির পুতুল।  রাধাঅষ্টমী থেকে মায়ের প্রতিমা বানানোর কাজ শুরু হতো।আর ওই দিন থেকে শুরু হতো পুজোর স্পেশাল যাত্রার মহড়া।চন্ডী মন্ডপের জমিটা মায়ের দশবিঘে বাড়ির গায়ে লাগোয়া ছিলো। একসময় ওই পুজো করতো দেওয়ান পুণ্য কর তার নিজের বাড়িতে।তিনি আমার দাদুর বাবা।কিন্তু বহুবছরের বংশ পরম্পরার পুজা চালাতে পারেন নি দাদুমশাই।তিনি ছিলেন ভবঘুরে, ধর্মপাগল পথিক।তীর্থ করে বেড়াতেন ।।ফলে পুজো চলে যায় বাড়ির জমি থেকে কিছু অংশ নিয়ে চন্ডীমন্ডপে।সারা বারুইপাড়ার একটিই পুজো।

  মহালয়ার দিন থেকে দেবী অলঙ্কারে সজ্জিত হতেন।গোপালপুর থেকে সোলা শিল্পীরা এসে সোলার গয়নায় মাকে সাজাতেন।যাকে এখন বলে ডাকের সাজ। তারা তিন চারদিন পাত পেড়ে খেতেন মায়ের রান্নাঘরে,শুদ্ধাচারে পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করতেন মায়েরা।সারারাত মাথুর পদাবলী গাইতে গাইতে তারা দেবীকে সাজাতেন।ষষ্ঠীর দিন গ্রামভর লোক চন্ডীমন্ডপে সকালে কলাপাতায় ফলাহার করতেন।জমির চিড়ে মুড়ি খই দই আর কাঁঠালি কলা।দই আসতো চরের গোয়ালা পাড়া থেকে।রাতে গানের অনুষ্ঠানের থাকতো বিজয় সরকার,আব্বাসউদ্দিনের ভাটিয়ালি আর বাউল গান।প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত সারা গ্রাম অন্ধকারে মুড়ি দিয়ে বসে হ্যাচাকের আলোয় গান শুনতো।
 সপ্তমীর সকালে গ্রামের মেয়েদের পুজোর আয়োজন।কেউ ফুল তুলতে যাচ্ছে তো কেউ আনারস বাগানে ফল পাড়তে।এদিন সারা গ্রামের রান্না চন্ডী মন্ডপে।খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, ডাটার ঘন্ট,গরুর দুধের পায়েস আরো কতো কি!রাতে যাত্রা শুরু। সপ্তমীতে গ্রামের দলের পালা।বিশু কাকা খেপ খাটছে একবার রানি আর একবার মন্ত্রীর।শেষে ফলস গোফ নিয়েই রানি সেজে স্টেজে উঠে পড়লে রাজা বলে ওঠে
""একি একি অরাজক/ রানির মুখেতে গোফ/ যাও যাও রানি অন্তঃপুরে/ ফেলে এসো দাড়ি গোফ।"" সমস্ত গ্রাম তখন হেসে লুটোপুটি।
অষ্ঠমী মানেই সারাদিন ধান চালের খাবার বারণ।সকালে কপোতাক্ষের জলে স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরে সকলে যাবে মন্ডপে।অঞ্জলি হবে।তারপর লুচি,বাগানের কুমড়োর ছক্কা,গাছের জলপাইয়ের চাটনি। যতো পারো ততো খাও।রাতে ফুলতলার যাত্রাদল '।দুদিন আগেই তারা স্কুল ঘরে এসে উঠেছে বিরাট বিরাট বাক্স প্যাটরা নিয়ে।তিনটে মেয়ে এসেছে,কি তাদের ঢঙ।সারা গ্রামের  মেয়েদের ওই নিয়েই সে কি আলোচনা।অষ্টমী মানেই ফুল নাইট যাত্রা।সকালে ঘুম ঘুম চোখে সবাই মিলে আবার শুরু পুজোর জোগাড়।এদিন পাঠাবলি।পাঠা দেয় গ্রামের সবচেয়ে সম্পন্ন গৃ্হস্থ দত্তবাড়ি।সুন্দর বনে এদের কয়েক হাজার বিঘে ধানো জমি।ধান আসে গহনার নৌকা ভরে কপোতাক্ষের ঘাটে।তো পাঠার মাংশ আদা জিরে ঝাল বাটা দিয়ে আর জুই ফুলের মতো দীঘা ধানের ভাত কলাপাতায়।আহা।সে অমৃতের তৃপ্তি লেগে থাকতো বিকেল পর্যন্ত গ্রামের লোকের চোখে মুখে।রাতে বাউল গান।গান গাইয়ে আসতো কুষ্টিয়া 'থেকে,ওরা নাকি লালনের কোন চ্যালার আখড়ার গায়ক।শেষে গ্রামের দু এক গায়ক ও গাইয়ে হয়ে যেতো।

দশমীর পুজো শেষে বাজার।গ্রামের সবাই বাচ্চাদের হাতে পয়সা দেয় বাজার খরচ।বাচ্চারাও সেই পয়সা দিয়ে মন্ডা মিঠাই কিনে খায়।দুপুরে চন্ডী তলায় ভাত নিরিমিশ তরকারি,ডাল আর ক্ষেতের মাকড়ি বেগুন ভাজা।বিকেলে চোখের জলে মাকে বিদায়।লাল নীল রঙের নিশান বানিয়ে রাস্তার দুধারে   পুতে দেবী বিসর্জন যায় কপোতাক্ষের ঘাটে।গ্রামের মা বোনেরা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফেরে।সেই জল আজো আমার মায়ের চোখে।একাত্তর  তাকেও বিসর্জন দিয়েছে।পরবাসের এই বিরাট মন্ডপ,আলোর ঝলকানি,লাইনের ঠেলাঠেলি তার সয় না।সে অপেক্ষায় আজ ও বসে।হয়তো আবার কপোতাক্ষের গ্রাম তাকে বোধন করে নেবে।
               

গল্প




চম্পা
কৃষ্ণা দাস
সারাদিন ট্রেনে মোবাইল কভার চার্জার বিক্রী করে রাতে স্টেশনে নেমেই প্রথমে বিশে চাকলাদারকে পাওনা বুঝিয়েই বিপুল তড়িঘড়ি স্টেশন ছেড়ে বেরল । স্টেশনের ঘড়িতে তখন ন’টা পঁয়ত্রিশ।
স্টেশনের পাশেই বুড়ো মন্টার সাইকেল সারানোর দোকান । তারই পাশে কচু গাছের জঙ্গলের ধার ঘেঁসে রাঙচিত্তের বেড়া দেওয়া এক ফালি জমিতে আজ বছর পাঁচেক সাইকেল জমা রাখার উপরি ব্যবসা ফেঁদেছে মন্টা । সাইকেল জমা রাখার দরুন মাস গেলে বিপুলকে পঁচিশ টাকা ভাড়া দিতে হয় । দোকানের পাশে এখন শুধু বিপুলের সাইকেলটাই দাঁড়িয়ে । মন্টার দোকান এখন টিমটিমে হলুদ আলোয় যেন ঝিমুচ্ছে । সামনে নীল প্লাসটিকের পর্দার ফাঁক দিয়ে ভেতরের কুপির আলো দপদপ করছে ।
“কাকা ঘুমুলে নাকি গো?” বিপুল পকেট থেকে তড়িঘড়ি চাবি বের করল ।
বিপুলের ডাকে বুড়ো গলা খ্যাঁকারি দিল ঘুপচি টালির চালের দোকান থেকে, এটি তার আস্তানাও বটে ।
“হারামজাদা রোজ ইত্ত রাইত কইরে সাইকিল নিতে আইসিস তুর জ্বালায় ঘুমোনোর জো আছে বটে?”
বিপুল চাবি দিয়ে তালা খুলে চেন খুলে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলো ।
 “কী করবো সবই পেটের দায়গো গো কাকা। নইলে কে বলো রাত বিরেতে সাইকেল নিতে আসে?”
প্রত্যুত্তরে বুড়ো কাশতে কাশতে কী যেন বলল, কিন্তু বুড়োর কথা দাঁড়িয়ে শোনার মতো তখন বিপুলের সময় আর আগ্রহ কোনটাই নেই । সে খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে দিল ।
আকাশের দিকে তাকাল বিপুল । আকাশ যেন মিশমিশে কালো । তারা দেখা যাচ্ছে না । শ্রাবণ মাস কখন বলতে কখন হুড়মুড় করে নামে তার কী কোন ঠিক আছে? তাড়াতাড়ি ঘর পৌঁচ্ছালে হয় । বউটা না খেয়ে জেগে আছে ।
রাস্তায় জনপ্রাণী নেই । এ রাস্তায় ভ্যান রিকসা সন্ধে সাতটার পর বন্ধ হয়ে যায় । শুধু গোটা দুই ঘি’য়ে ভাজা কুকুর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে রাস্তার এ পার থেকে ওপার হল । পিচঢালা বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে ঘুরে খোয়া ঢালা রাস্তা ধরে সন-সনিয়ে চলেছে বিপুল । রাস্তার দু’দিকে নিচু জমি এখন জলে টইটুম্বুর । এই রাস্তায় পিচ হবে তাই জায়গায় জায়গায় স্টোনচিপ খোয়া ডাঁই করা তা প্রায় দু’মাস ধরে । পথচারী বা পিডব্লুডি কারুরি যেন কোন গা নেই । হচ্ছে হবে মনভাব । অথচ রোজ এই পথে সাইকেল চালাতে যে কী অসুবিধা হয় সে শুধু ভুক্তভুগিই জানে । তার ওপর রাতের দিকে আলো নেই, যদিও লাইটপোষ্ট আছে । সাইকেলের ডায়নামো লাইটই ভরসা । বিপুল মিনিট কুড়ি জোরে সাইকেল চালালেই ঘরে পৌঁছাবে । তাই সে যতটা সম্ভব জোরে সাইকেল চালাতে থাকল ।
ঘামে পরণের সার্টটা ভেজা । লম্বা, সুস্বাস্থ্য, টিকালো নাক, এক মাথা বড় বড় চুল, ও কায়দা গোঁফে তাকে বেশ ভারিক্কিই লাগে । বয়সটা যে সাতাস আঠাশের আসে পাশে দেখে মনে হবার জো নেই । কেতাদুরস্ত চুলে সময় সময় হাত দিয়ে আঁচড়ে নেয় হিন্দি সিনেমার নায়কের কায়দায় । নীল জিনসের পিছন পকেটে চিরুণি থাকলেও তার বড় একটা ব্যবহার হয় না । পায়ে সস্তার স্নিকার, আর গায়ে বডি স্প্রে দিয়ে সে যখন ট্রেনে মোবাইল চার্জার, কভার বিক্রি করে তখন লোকে দু’একটা না নিয়ে পারে না ।
একটু দূর থেকেই একটা দুটো পাকা নতুন বাড়ি উঠেছে । কিন্তু এখন গৃহস্থের বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ । তাদের বাড়িগুলো যেন অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ । এর পর বটতলা পর্যন্ত দু’পাশে শুধু ধান খেত । আর কোন বাড়ি নেই ।
বাড়ি ফেরার এই সময়টা বিপুল যেন নিজেকে খুঁজে পায় । দূরে কোথায় কদম গাছে ফুল ফুটেছে তারই গন্ধে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে । সেই সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে এই ঘরে ফেরা । ছ’মাসের পুরোনো তার কিশোরী বউটা ভাতের থালা নিয়ে বসে আছে । গনগনে খিদের আঁচটা রোজ স্টেশন ছাড়ালেই পেটের মধ্যে দাউদাউ করে । তাকে ধামাচাপা দিতেই সে পুরো পথটা নিজের সাথে নিজে কথা বলতে বলতে আসে । কখনো বা জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার গান গুনগুন করে দু’কলি গায়ও।
কিন্তু আজ তার মনটা ভালো নেই । সব মিটিয়ে আজ হাতে মাত্তর দুশো কুড়ি টাকা থাকল । অন্য দিন নিদেন পক্ষে তিনশো থাকে, কখনো কখনো চারশো সাড়ে চারশোও হয় । সারাদিনের এত পরিশ্রমের মূল্য মাত্তর দুশো কুড়ি, এর চেয়ে কুলিগিরীও যে ভালো । ভাবল আর এ লাইনে থাকবে না । যদি কিছু টাকা থাকত তবে স্টেশনের ধারে এই রাস্তার পাশে একটা গুমটিঘর বানিয়ে চায়ের দোকান দিত । এ তল্লাটে চায়ের দোকান যতই হোক তবু কারো কখনও লস হয় না ।  কথাটা অবশ্য মনু বাড়ুজ্জে মাথায় ঢুকিয়েছে । তবে মিথ্যে বলেনি সে, বিপুল নিজের চোখেই দেখেছে চা পান দোক্তা বিড়ি সিগারেট গুটখার দোকানগুলোর সামনে সবসময়ই খদ্দের থাকে। ওই একটাই ব্যাবসা যা কোনদিন পুরনো হয় না ।
মনু বাড়ুজ্যে তো বলেইছে “বেশি নয় তুই হাজার তিরিশেক দিস তাতেই হবে, আমার বাড়ির সামনেটাতেই দোকান করিস, আমি লিখে দেব”। কিন্তু হাজার তিরিশ কি আর চাট্টিখানি কথা? রোজ নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তার ওপর বউটার দিনদিন খাঁই যেন বাড়ছে। বাড়ি ঢুকলেই এটা নেই সেটা নেই, চাল নেই, ডাল নেই, তেল নেই, আলু নেই, সেসব জোগাড় হলেই কাপড় চাই, ব্লাউস চাই, মাথার ফিতে, কাজল পেনসিল, লিপিসস্টিক, শ্যাম্পু, সাবান, চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। পয়সাটা আর জমবে কেমনে? বিক্রির টাকার ষাট ভাগই মালিক নেয়, দশ ভাগ এলাকার দালাল, আর পাঁচ ভাগ রেল পুলিশ । তবে আর বাকি রইল কী? ওই সামান্য পঁচিশভাগ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া উপায় কিছু নেই । এই জন্যই বিপুল বিয়ে করতে চাইছিল না, জ্যাঠা ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে নিজেই পালিয়ে গেল। এখন তুমি মরো।
মা বাপের কথা মনে পড়ে না আর। স্টেশনে ঘুরে ঘুরে মনিহারি জিনিষ বিক্রি করতো হরেন জ্যাঠা  । বন্যায় হরেন জ্যাঠার বউ ছেলে যে বছর ভেসে যায় সে বছরেই তাকে নাকি স্টেশন চত্তরেই ঘুরঘুর করতে দেখে সবাই মিলে গছিয়ে দিয়েছে হরেন জ্যাঠার গলায় । বিপুল নামটাও হরেন জ্যাঠারই দেওয়া যখন সে বছর চারেক । তাতে যেন দু’জন দু’জকে পেয়ে বেঁচে যায় । ওই হরেন জ্যাঠা নেহাত বললে, “আমি আর কতদিন, ওরে বাউন্ডুলে, মেয়ের বাপ নেই মা নেই, মামার ঘরে দুরছাইএ মানুষ, ওকে বে কর। তোরও ঘর আগলাবার লোক হবে আর মেয়েটাও জেবন পাবে”। তাই করা । নইলে সুখে থাকতে কি কেউ খরচা বাড়ায়? তা এমনই কপাল বিয়ে দিয়েই হরেন জ্যাঠা পুট করে মরে গেল । কী? না এসস্ট্রোক, দিব্যি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কখন মরে গেল, না কাউকে জ্বালাল না নিজে জ্বলল । আর অমনি পুরো সংসার মাথায় এসে পড়ল, একেই বলে ভাগ্য ।
অন্যমনস্ক হয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল বিপুল, হঠাৎ কানে এল আর্তনাদ, “বাবা গো!”
কয়েক সেকেন্ডে বিপুল বুঝল রাস্তার ধার থেকে শব্দটা এসেছে । সাইকেলের ডায়নামো লাইটে দেখল শালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে রাস্তার ধারে বসে পড়ে গোঁঙাচ্ছে । সাইকেল থেকে নেমে কাছে গিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
মেয়েটি আধো অন্ধকারে মুখ তুলে তাকাল । তার ডাগর চোখে চিকচিক করছে জল। সাইকেলের আলো ফেলতেই বিপুলের ঠোঁট দিয়ে অস্ফূট শব্দ বের হল ।
“চম্পা!”  
চম্পাও ব্যাথা ভুলে অপলকে তাকায় বিপুলের দিকে । বিপুল দেখল তার শৈশবের খেলার সাথী,  মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া, তার না বলা প্রথম প্রেম, অপরূপা চম্পা । যদিও একই গ্রামে বসবাস তবুও তার সাথে শেষ কথা বহুদিন আগে, যখন সে “বিদ্যা সুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়”এ একই ক্লাসে পড়ত । এমনিতেই সে একটু বড় বয়েসেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল তার ওপর কোনও কোনও ক্লাসে দুবারও পড়েছে । তার পর মাধ্যমিকে অঙ্ক, ইংরাজি, আর বিজ্ঞানে ব্যাক পেয়ে যেমন পড়াশোনাও ছেড়ে দিল, তেমন লজ্জাতে চম্পার সামনেও আর যায়নি কখনো।
আজ এত বছর পর চম্পাকে দেখে বিপুল বিষ্ময়ের সাথে বলল “তুমি”?
চম্পা সে সবে উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে বসে পড়ল । বিপুল সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে পাশে বসে দেখল চম্পা বাঁ পাটা ধরে যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাচ্ছে ।
 “কী হয়েছে বলবে তো”?
 “পা মুচকে গেছে” । চম্পার মুখ যন্ত্রণা কাতর ।
বিপুল দেখল পাশে চম্পার হিল জুতোটা পড়ে আছে ।
 “এই অসমান এবড়োখেবড়ো খোয়া ওঠা রাস্তায় এই ভাবে রাতে হিল জুতো পরে কেউ হাঁটে? পা তো মচকাবেই । আমাকে ধরে দাঁড়াও তো দেখি”। বিপুল যেন আদেশ করল ।
 “পারবো না, আমি পারবো না” চম্পা ডুকরে উঠল ।
 “আরে তা হলে কি সারা রাত এখানেই পড়ে থাকবে?
বিপুল জুতো দুটো মুহুর্তে সাইকেলের রডে ঝুলিয়ে দিল।
 “আমাকে ধরে আস্তে আস্তে সাইকেলের সামনেটায় বসো আমি বাড়ি পৌঁচ্ছে দিচ্ছি” ।
চম্পা চেষ্টা করল বিপুলের শরীরের সাহায্যে উঠে দাঁড়াতে কিন্তু কোন রকমে দাঁড়িয়েই বলল, “নাঃ আমি সাইকেলে বসতে পারবো না”।
বিপুল এক ঝটকায় চম্পাকে পাঁজাকোলা করে তুলে সাইকেলের রডে বসিয়ে দিল । ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে চম্পা বিপুলের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল । রডে বসেও সে গলা না ছেড়ে শক্ত হয়ে থাকল ।
বিপুলও শক্ত হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডেই । বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা লাফাতে লাগল এমন জোরে যে বাইরে থেকেও বুঝি তার আওয়াজ পাওয়া যাবে । তীব্র শ্বাসের আওয়াজে যখন সে নেশাগ্রস্থ তখনই দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । দু’জনেই শশব্যস্ত হয়ে উঠল । বিপুল দেখল এত কিছুর মাঝেও চম্পা কাঁধের মাঝারি মাপের ফুলকারি কাজ করা ব্যাগটি ছেড়েনি । সে সিটে বসে সাইকেল ছেড়ে দিল ।
চম্পা কিছুই বলছেনা । তার খোঁপা ছাড়া চুল গুলো বিপুলের চোখে নাকে লাগছে । অদ্ভূত এক সুগন্ধ চম্পার গা থেকে বেরিয়ে বিপুলকে ঘিরে রেখেছে । বিপুল ঘাড় থেকে মাথাটা যথাসম্ভব সামনে এগিয়ে এনেছে যেন সাইকেল চালানোর ভারসাম্য বজায় রাখতেই । কেবলই মনে হচ্ছে এ বুঝি স্বপ্ন, বাস্তব নয় ।
 “এত রাতে এলে কেন”? বিপুল জানে চম্পা কোলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে ।
 “এম এস সি ফাইনাল এগ্জাম ছিল আজ, আজই শেষ । পরীক্ষা দিয়ে আসছি । তাই লেট । মা অসুস্থ”।
 “কী হয়েছে”?
 “বমি পায়খানা কাল থেকে, ডাক্তার দেখেছে, কিন্ত ওষুধ ধরছে না, কাল সকালে হসপিটালে ভর্তি হবে । বাবা ফোনে করল” ।
চম্পা বড় ঘরের মেয়ে । তাদের জ্যাঠা কাকা মিলে বনেদি পরিবার । কেউ কলকাতায় ডাক্তার, কেউ বিডিও, কেউ বড় ব্যাবসায়ী । এমন এক পরিবারের মেয়েকে না বুঝে ভালোবাসা যায় কিন্তু ভালোবাসার কথা বিপুলের মত ছেলের মুখে শোভা পায় না । তাই সে কখনো চেস্টাও করেনি সে কথা জানানোর ।
দু’জনে আবার চুপ, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বড় হচ্ছে । বিপুল ভাবল এ ভাবে গেলে পুরো ভিজে চান হতে সময় লাগবে না । রাস্তার ধারে কোথাও কোনও বাড়িও নেই । কোথাও যদি একটু দাঁড়ানো যেত !
 “বাড়ি যেতে যেতে পুরো ভিজে যাব যে”? চম্পা বলল ।
 “কোথায় দাঁড়াবে বল? কিছুতো নেই?”
 “তুমি দুর্গাবাড়ি চল” ।
দুর্গাবাড়ি রাস্তা থেকে ডান দিকের বটতলার মুখেই । বিপুল চম্পার কথামত দুর্গাবাড়ির চাতালে পৌঁছে যেতেই চম্পা বলল “আমি নামবো না, পায়ে জোর নেই । তুমি সেডের তলায় সাইকেল নাও” ।
বিপুল তাই করল । ঝমঝম করে বৃ্ষ্টি নামল ঠিক তখনই । চম্পা বলল “কটা বাজে?”
বিপুল রুমাল পেঁচানো হাতের কবজি কায়দা করে উল্টে বলল, “দশটা পাঁচ” ।
তাতে চম্পার কোন তাপ উত্তাপ নেই । সে তার ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সুইচ অফ করে দিল ।
বিপুল ভেবেছিল চম্পা বুঝি বাড়িতে ফোন করছে । একটু পরে মোবাইলটা ফের ব্যাগে ঢোকাতে দেখে বলল, “কি হল লাইন পেলে না”?
চম্পা কিছু না বলে হাসল । হাসলে ওর থুতনিতে একটা আদুরে টোল পড়ে । আগে আগে বিপুল  হাঁ করে তাকিয়ে থাকত ওর মুখের ওই টোলের দিকে, খুব অসহায় হয়ে যেত এমন হাসি মুখ দেখলে । আজ সে একপলক দেখেই বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হতে চাইল । কিন্তু ঘুরে ফিরে তার পুরনো কথাই মনে পড়ছে । ছোট বেলা পাড়ায় চরকের মেলায় হরেন জ্যাঠাকে বলে বলে একটা কাঠের খেলনা ট্রেন কিনিয়েছিল । মেলায় চম্পা যখন ওর ট্রেনটা দেখল ওমনি সে তার মার কাছে বায়না ধরল অমন একটি ট্রেন কিনে দেবার জন্য, দোকানদার জানায় অমনটি ওইটিই শেষ, সব বিক্রি হয়ে গেছে । ব্যাস মাটিতে পড়ে চম্পার সেকি কান্না । সবাইকে অবাক করে বিপুল তখন নিজেরটি ওর হাতে তুলে দেয় । সবাই হাঁ, শুধু বাড়ি ফিরে হরেন জ্যাঠা খুব পিটিয়েছিল । তিন চার দিন সে ব্যাথা টনটনিয়েছিল ।
বিপুলের মনে পড়ল সে যখন স্কুলে এইট তখন দোলের সময় চম্পা লুকিয়ে তাকে আবির ছুড়েছিল ছাদ থেকে, সেই থেকে দঙ্গলের মধ্যে থেকেও বিপুল একা । বন্ধুরা তাকে ঠেলে ঠুলে বাড়ি এনে বলেছিল “জ্যাঠা বিপুলের কী হয়েছে গো? কথা বলে না, দোল খেলে না, দেখো”।
তখন বিপুল রোজ বিকেলে বাড়ির কাছের মাঠ ছেড়ে কাছারি মাঠে ফুটবল খেলতে যেত আর মাঝে মাঝে মাঠের পাশে হলদে পাকা দোতলা বাড়ির দিকে তাকাত । এমনিতে সে মোটেই ভালো ফুটবল খেলতো না কিন্তু যেই চম্পা এসে ছাদে দাঁড়াতো তখন বিপুলকে পায় কে? মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে বিপক্ষ দলকে কাটিয়ে কুটিয়ে বল একে বারে গোলে । হঠাৎ হঠাৎ তার এই অদ্ভূত উন্নতির কোনও কারণ বন্ধুরা খুঁজে না পেয়ে সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। আর সে তখন মাথা নীচু করে লজ্জা পেত ।
 “কী এত ভাবছো?” চম্পার ডাকে বিপুল যেন একটু কেঁপে উঠল ।
 “কই না, কিছু না”।
 “শুনলাম বিয়ে করেছ”।
বিপুল লজ্জা পেল, বলল, “জ্যাঠা জোর করে………”
 “বউ এর নাম কী?”
বিপুলের মুখ ফসকে বেড়িয়ে যাচ্ছিল ‘ভোঁদর’ । সামলে নিয়ে বলল, “লক্ষ্মীমনি সোরেন” । বউটা তার পুকুরে নামলে সহজে ডাঙায় ওঠে না । কখনো পা দিয়ে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে তো কখনও ছাঁকনা জালে মাছ ধরে । মাছ খেতে এত ভালবাসে দেখে বিপুল তাকে ভোঁদর বলেই ডাকে । তাতে রাগ তো মোটেই করে না উল্টে হিহি করে হাসে ।
 “অ তুমি সাঁওতাল বিয়ে করেছ বুঝি” ?
 “কেন আমিও তো সাঁওতাল, বিপুল মুন্ডা” । বিপুল বুক চিতিয়ে বলল ।
 “মুন্ডা তো তোমার হরেন জ্যাঠার পদবি, তুমি তো…………………..”।
বিপুল চম্পার অসমাপ্ত কথার অর্থ বুঝল । দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আমিও মুন্ডা, এই পদবি আমার কাছে আশির্বাদ ।”
বিপুলের মনে পড়ল ছোটো বেলায় তার টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট, আর গৌর বর্ণ দেখে পাড়ার লোকে বলতো, “এ নিশ্চই কোন উচ্চ বংশের ছেলে ছিল গা । ভাগ্যের পরিহাস দেখো!”
এসব নিয়ে কখনো ভাবেনি বিপুল । সে হরেন মুন্ডার স্নেহের ছায়াতেই তরতর করে বেড়ে উঠছিল ।
বৃষ্টিটা ধরে এল । এতক্ষণ সাইকেলটা দু’হাতে ধরেছিল বিপুল কারণ চম্পা এক দিকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । বিপুল বলল, “এবার চলি, বৃষ্টি ধরে গেছে” ।
চম্পা হ্যাঁ না কিছু বলল না ।
বিপুল সাইকেলটা সেডের বাইরে এনে দেখল রাস্তায় জল জমে গেছে । উপায় না দেখে সে সিটে না বসে দু’হাতে সাইকেল ধরে পাশে পাশে হেঁটে চলল ।
চম্পা হঠাৎ বলল, “তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে”?
 “কই নাতো?”
 “তবে এত চুপ কেন”?
 “আমি?”
“হ্যাঁ”,
“কই?”
 “তবে কিছু বলছো না যে”?
 “কী বলবো”?
“যা খুশি”।
কী বলবে বুঝতে না পেরে বিপুল ফস্ করে জিজ্ঞাসা করে বসল-
 “তুমি বিয়ে করবে না?”
চম্পা অদ্ভূত হেসে উঠল।
 “কী হল? ভুল কিছু বললাম” বিপুল অস্বস্থিতে পড়েছে ।
 “নাঃ”।
 “তবে?”
 “ছেলে কই”?
এবার বিপুল হাসল, তবে মনে মনে। মুখে বলল “ছেলের অভাব”?
 “অভাব ঠিক নয়, তবে তোমার মত কই”?
কেঁপে উঠল বিপুল । নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না । সে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ ।
চম্পা বিপুলের দিকে তাকাল, বিপুল চোখ নামিয়ে নিল । চারিদিকে ব্যাঙ ঝিঁঝিঁ ডাকছে, গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে জল ঝরে পড়ছে, সব মিলিয়ে এ এক অন্যরকম জগৎ মনে হচ্ছে বিপুলের ।
মনে পড়ল কিশোর বয়েসে শালডিহির মাঠে পৌষ মেলায় লুকিয়ে উল্কি করিয়েছিল ঘাড়ে, ‘চম্পা’ । চুল বড় থাকায় কেউ তেমন দেখতে পায়নি, কিন্তু জ্যাঠা মরলে ন্যাড়া হতেই তা বেরিয়ে পড়ল । তার পর সেকি লজ্জা । কানাই নাপিত হেসে বলেছিল, “দাদা গো, তোমার চম্পা যে বেরিয়ে পড়ল গো, এখন কি হবে”? মুহুর্তে বিপুল মাথায় কাছার প্রান্ত জড়িয়ে নেয় । চম্পা যে কখন তার শরীরের সাথে মিশে গিয়েছিল তা সে নিজেই বোঝেনি ।
আকাশে মেঘ কেটে কখন যেন চাঁদ উঁকি দিয়েছে । তার আলোয়  বিপুল আবিষ্কার করল চম্পা দু’হাতে তার মাথা কাছে টেনে ঘাড়ের চুল সরিয়ে উল্কির ওপর তার তপ্ত ঠোঁট চেপে ধরেছে । বিপুল গলে যেতে যেতে শুনতে পেল চম্পা ফিসফিস করে বলছে, “সারা জীবন এভাবেই চম্পাকে মনে রেখ” ।
কয়েক মুহুর্ত, তার পরই বিপুল সোজা হয়ে দাঁড়াল । গম্ভীর হবার ব্যর্থ চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল উল্কির কথা চম্পা কী করে জানল?
চম্পার দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই চম্পা বিপুলের চোখ দেখে প্রশ্নটা বুঝে গেল।মৃদু স্বরে বলল, “আমি সওব জানি। কানাইদা সব আমাকে বলেছে। পাগল ছেলে এ ভাবে কেউ ভালোবাসে?”
হঠাৎ বড় অভিমানে বিপুলের দু’চোখ ভিজে গেল। সে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে ধরা গলায় জোর এনে বলল, “রাত হয়েছে, এবার ঘর যেতে হবে,বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে”।
চম্পা কি আহত হল? ঠিক বুঝলো না বিপুল, সে জল ভেঙে এগুতে থাকল কাঁছারি বাড়ির পথে । দুজনেই চুপ । একটু পরেই চম্পাদের বাড়ি দেখা গেল । বিপুল তাদের গাড়ি বারান্দায় চম্পাকে নামিয়ে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিল । চম্পা বলল, “সাবধানে যেও” ।
বিপুল অস্ফূটে বলল, “ভালো থেকো”, কিন্তু তা এতই আস্তে যে চম্পার কান পর্যন্ত পৌঁছল না ।

বাড়ির কাছে এসে আজ আর কানে এলনা টিভির উচ্চ আওয়াজ । বছর খানেক হল স্টেশনের পাশে টিভি সারাই এর দোকান থেকে সেকেন্ডহ্যান্ড টিভিটা দু’হাজারে কিনেছিল । ওটা নিয়ে বউটা সারাদিন একাই কাটিয়ে দেয় । বিপুল বাগানের চাঁচারির গেট খুলে দাওয়ায় সাইকেল তুলে হাঁক দিলো, “ভোঁদর?” মাটির ঘরের ভেতর থেকে কোন আলো বা আওয়াজ এলো না । বিপুল গলা আরো চড়িয়ে বলল, “ভোঁদর দরজা খোল”। তাও কোনও শব্দ নেই । বিপুল ভেজানো দরজায় হাত দিতেই খুলে গেল হাট করে। ভেতরে ঢুকে দেখে টিভি চলছে শব্দহীন ভাবে আর ভোঁদর টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে কাদা তক্তপোষের ওপর । তার মুখ ঢেকেছে নরম চুলের ঢল, তার আলুথালু বেশ, আলতা পরা কালো নিটোল দুটি পা লাল শাড়ির নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে । বিপুল বুঝল অপেক্ষা করতে করতে বউ তার ঘুমিয়ে পড়েছে । মনটা বড় নরম হয়ে গেল । সাইকেলটাকে ঘরে ঢোকাতে গিয়ে দরজায় মাডগার্ড লেগে আওয়াজ হতেই ভোঁদর ধরমড় করে উঠে বসল । “হাই দিখো এই ইত্ত রাইতে তুমার আসার সময় হইল গো” ?
 “কী করবো পেটের দায় যে!”
 “তাই বুলে ইত্ত রাত? বলি ইমন তো হয় নাই আইগ্যে” ।
 “কী করবো ? ট্রেন লেট করল যে” ।
 “কিনও বটে”?
 “আর কেন? ট্রেনে কাটা পড়ল কিনা”।
 “কী বটে”?
 “এক জোড়া ছেলে মেয়ে”।
 “হাই দিখঅ! কিনঅ বটে”?
 “কেন তা কী করে জানবো? তবে প্রেম পিরিতি হবে বোধ হয়”।
অমনি বউ তার গালে হাত দিয়ে ডাগর ডাগর চোখে ছলছলা । বিপুল জানে তার এই মিথ্যেগুলো সত্যি ভেবে বউ তার কাল্পনিক চরিত্রগুলোর ব্যথায় জজ্জরিত । বউটা যে তার বড্ড সরল ।
বিপুল তাকে বেশি কষ্ট দিতে চায় না, তাই তড়িঘড়ি বলল, “ভাত দে রে ভোঁদর, খিদেয় নাড়ী জ্বলছে” ।
বউ বলে, “হাত ধুকে আইসঅ কেনে?”
বিপুল প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে । হাত ধুয়ে উদলা গায়ে পিঁড়ির ওপর উবু হয়ে বসল। সামনে এক কাঁসি ঠান্ডা ভাত, পাশে নুন, দুটো কাঁচালঙ্কা, কাঁচা পিঁয়াজ আর আলু ভাজা ধরে দেয় লক্ষ্মীমনি । এই মুহূর্তে এর চেয়ে লোভনীয় খাবার বিপুলের কাছে আর কিছু নেই ।
 “তুই খেয়েছিস”?
 “হ, বড় খিদা লাগছিল, তুমার তরে বইসে বইসে কুখন চোখ লেইগ্যে গেল…………” ।
বিপুল ভাত খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে তক্তপোষে গিয়ে বসল । লক্ষ্মীমনি এঁটো পেড়ে দরজা লাগিয়ে কাছে আসতেই বিপুল তাকে দু’হাতে কাছে টেনে বলল, “আমি তোকে আজ থেকে যদি চম্পা বলি তুই কি রাগ করবি”?
 “হাই দিখঅ ! আবার কী হইল? লক্ষ্মীমনি হইল ভোঁদর । ইখন ভোঁদর হইবেক চম্পা”?
বিপুল তাকে বিছানায় পেড়ে ফেলে সোহাগ সোহাগে পাগল করতে করতে ফিস ফিসিয়ে বলে উঠল, “ চম্পা, চম্পা, চম্পা”।
               অমনি বউ তার খিল খিলিয়ে হেসে উঠল ।
               বাইরে তখন খটখটে জ্যোৎস্নায় গাছপালা, পুকুর, উঠোন পথ, ঘাট সব সাদা, যেন ভরা জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে, সবকিছু ভাসিয়ে ধুইয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।
                                                 সমাপ্ত




এবার কাঠে কপাটে
রেখা রায়

নতুন পাড়ার নীলু চক্কোত্তি একটা মেশিন কিনেছে। অমন মেশিনের কথা কেউ কখনও শোনেনি। চোখে দ্যাখা তো দূর অস্ত। পাড়ার মোড় মাথায় বাঁশের মাচায় বসে উঠতি বয়সের যে সব ছেলে ছোকরা বিড়ি ফোঁকে..গুরুজন দেখলে গলা খাঁকারি দ্যায়..স্কুল ফেরত শাড়ি পরা মেয়েদের ফ্রক পরে টিউশানি পড়তে যাওয়া ফলো করে, ফ্রকের ভিতর আরও কিছু দেখতে পায়, পাড়ার সব ঘরের হাঁড়ির খবর তাদের নখ দর্পণে..তারাও বুঝতে পারেনি মালটা কি.. আর ...সেঁদোবে কোথায় !!!
সন্ধ্যের মুখে যখন মেশিনটা এল, তারা পরস্পর চোখ চাওয়া চাওয়ি করে এগিয়ে গিয়ে উমেদারি করে বুঝে  নিল। এবার তারাই চাউর করে দিল নীলুদার বাড়িতে এঁটো সঁকড়ি বাসন মাজার একটা মেশিন এসেছে। নীলুদা কোলকাতায় পার্টির এক নেতার বাড়ি দেখে উত্সাহী হয়ে কিনেই ফেলেছে।
পরের দিন পাড়ার পদি পিসি,পুঁটি দিদা,কুঞ্জ কাকি,হাজি ঠাকুমা..পাড়া ঝেঁটিয়ে বউ ঝি-রা লাইন দিল নীলু চক্কোত্তির কলতলায়। হাতে..রাতের সঁকড়ি বাসন কোসন..কেলে কুষ্টি তেলচিটে কড়া..হাঁড়ি.. তোবড়ান ঢেয়ো ঢাকনা সমেত।
মাজা ঘষা চলছে। বৌদি সে সব সামাল দিচ্ছে..নাইটির উপরে পাতলা একটা নতুন গামছা জড়িয়ে। অতি উত্সাহীরা শিখতেও চায় !!
এদিকে এখন ফ্ল্যাট বাড়ি হয়ে ঝি-দের বড্ড আকাল !!!
সকলেই নীলুদার গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ !!!
এসব শুনতে শুনতে নীলুদাই চায়ের জল চাপিয়েছে। চারটে বাজতে চলল কিনা !!এখন মনটা" চা চা"..করে। পাড়ার ঠাকুমা দু হাত তুলে আশীর্বাদ করতে করতে চা বিস্কুট খেয়ে ঝকঝকে বাসন বাঁ হাতের তেলোয় সাজিয়ে উঁচু করে তুলে নাচের ভঙ্গিতে বাড়ি গেল। এবার এক খিলি পান গালে দিয়ে "বিবি নাম্বার ওয়ান" দেখতে বসবে।
এদিকে বিকেল চারটের সময় টাইম কলে জল এসে গেল। দেরি হচ্ছে দেখে গজগজ করতে করতে কেউ কেউ সেদিকে ছুটল। সিরিয়াল মিস করা চলবে না কি না !!
নীলুদার কড়া নির্দেশ..রাগা যাবে না। তাই বউদি হাসি হাসি মুখে পাড়াকে এঁটো মুক্ত করছে। প্রথম দিন এইভাবে কাটল।
পাড়ার ছেলেরা কাল থেকে তেরপল খাঁটিয়ে একটা মাইক লাগাবার কথা ভাবছে !!!বেশ একটা মোচ্ছব মোচ্ছব ভাব আসবে। দু একটা ফুচকাওলাকে খবর না দিলেই নয় !!! মাইকটা বাড়াবাড়ি ধরনের বেশি হয়ে যাবে !! তাই ওটা বন্দই রইল।

পরের দিন সক্কাল সক্কাল নীলুদা মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে মাখনের দোরে হাঁক পাড়ল ....
হ্যাঁ রে মাখনা,পাড়ার সব্বায়ের এঁটো সঁকড়ি ধুয়ে দিচ্ছে তোর বৌদি..আর তুই কোন লাটের বাঁট বে ?? কাল থেকেন মেশিনটা দেখতে পর্যন্ত গেলি নি ???
তা সত্যি কথা বলতে কি..মাখনা বউটাকে একটু সমঝে চলেও !! বড্ড গায়ে পড়া !!!
এক সময় তার সাথে একটু আধটু আসনাই ছিল ঠিকই, পয়সা দেখে নীলুর সাথে ভেগেছে। প্রথম প্রথম কদিন বুকে বড় বাজত !! নিজেকে ফেকলু ফেকলু লাগত !!
তা ছাড়া ক-দিন ঘরেই ছিল না মাখনা !! কুটুম বাড়ি গেসল..শালাদের সাথে ব্যবসা ফাঁদতে.. তেজারতির নতুন ব্যবসা !!! নীলুর থেকে সব শুনে টুনে সে বেশ মজাই পেল। মহাজন বলেছে...
"যেখানে দেখিবে ছাই
উড়াইয়া দেখ তাই...."

মেয়েটা সেদিন পড়ছিল...
বিশাল ডানাওলা বুড়োর গল্প। বুড়োটাকে দেখতে টিকিট ছিল পাঁচ টাকা করে..। তাই বিক্রি করে কত বড় লোক হয়ে গেল গরীব গেরস্থ !!
তো সেটা দেখে কোন উপকারটা হল প্রতিবেশীর ???
আর এ তো অনেক বড় কাজ !! ঘরের বউ ঝি শান্ত.. তো ঘরের ঝামেলা ঝক্কি কম।
কুড়ি টাকা করে টিকিট গেরস্থ পিছু দু দিনের জন্য.. কিনতে কারুর অসুবিধা হবার কথা নয় !!!!
অতএব মাখনা একটা সাইনবোর্ড লেখালো..নীলুবৌদির হাসি মুখ সমেত। এক সিভিক পুলিশকে তার ডিউটি সারা হতে,তাকে বগলদাবা করে চলল নীলুদার বাড়ি..বিকেল তিনটে বাজতে না বাজতেই।

মাখনাকে দেখে কান এঁটো করা হাসিতে..নাইটির ওপর গামছা ঢাকা দিতে দিতে ছুটে এল বৌদি..
মুখের ভাব....আস্তে আজ্ঞা হোক...বস্তে আজ্ঞা হোক !! ঠাকুরপো এলে তবে !! পুঁটকিটা বারো ক্লাসে উঠবে..নূতন কারবার ভাল চলছে..তোমার গ্যাদা বেড়েছে..বলছিল..তোমার দাদা !! এখন কোলকাতার দিকে মন..বলি..কি ভাগ্যি !! মেশিনটা এল বলে !!
তারপর সামনে পুলিশ আর সাইনবোর্ড দেখে দশ পা লাফিয়ে পিছু হটল...
ওগো শুনছ ?? দ্যাকো গো..মাখনা ঠাকুরপো পুলিশ নে এয়েচে..ও মা গো !!!
 তারপর সঁকড়ি বাসন হাতে একহাট লোকজন !!
ওই এঁটো হাতেই মাখনাকে এ্যাইসান ক্যালান ক্যালালো যে..সিভিক পুলিশ কিচ্ছুটি করতে পারল না !! মুখে কি সব কাঁচা খিস্তি !!!
এখন নে মাখনা..ক্যালানি খেয়ে দিন সাতেক বিসনায় হেদিয়ে মর !!!!
মাখনা এখনও বোঝেনি ..তার দোষটা ঠিক কোথায় !!! দু পয়সা কামিয়ে ভাগ তো সে দিতই !!
আসলে মাখনা জানবে কি করে যে...
নীলু এবার পঞ্চাত ভোটে দাঁড়াবে বলেই আগাম এই কৌশল ধরেছে !!!!
"মা বোনেদের করলে হাত
কর্তা হবে কুপোকাত।"
তাই প্রচারটা ঘর থেকেই শুরু করেছে !!!
এইট পাশ মাখনা জানেই না..
চ্যারিটি বিগিনস এ্যাট হোম !!!
এবার সে সিদ্ধান্ত করল পাড়ায় মা বোনেদের জন্য নিখরচায় একটা বিউটি পার্লার খুলবেই খুলবে !!!

গায়ের জ্বলুনিটা কোনও ভাবেই যাচ্ছে না 
সেই আইবুড়ো বেলা থেকে !!


একটি অতি সাধারণ গল্প
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার 



অজস্র চেরীফুল ঝরে ঝরে পড়ছিল তিতিরের মাথার উপর, মেঘফুলের মত ফুটে থাকছিল ওর চারপাশে। দুহাতের আঙুলে ধরে থাকা নীলাভ কাগজখানা তিরতির করে কাঁপছিল হাওয়ায়। বুকের ভিতর গলতে থাকা সমস্ত অনুতাপ তিতিরের দুগাল বেয়ে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছিল। মিশে যাচ্ছিল বাতাসের সাথে।


বহুদিন পর সোনাঝুরি গ্রামে ফিরে এসেছিল তিতির। অনেক স্মৃতি ভীড় করেছিল এতদিন। স্বপ্নের পরতে পরতে মিশে থাকা এই গ্রামের পাখপাখালির ডাক, পুকুরের জলে বাতাসের হেঁটে যাওয়া... বর্ষাকালে সারারাত টিনের চালে বৃষ্টিপড়ার শব্দ তিতিরের ডায়েরীর পাতায় কবিতা হয়ে উঠেছে। একটা অদ্ভূত মাদকতা ছিল এই সোনাঝুরির পরিবেশে। কতদিনই বা ছিল এখানে ওরা, মাত্র দুই বছর। কিন্তু এই দুটো বছর তিতিরের জীবনের সবচেয়ে স্বপ্নিল সময়।


আজ সেই হারিয়ে যাওয়া সময়কেই খুঁজতে এসেছিল তিতির, ফিরে পেতে চেয়েছিল তার কৈশোরের সাথীদের। বিশেষ করে নির্বাণকে। নির্বাণ তার মনের সবটুকু দখল করেছিল সেইসময়। খুব সাধারণ চেহারার একটা রোগা ক্যাংলা ছেলে, কিন্তু ওর চোখদুটোতে যেন সারা বিশ্ব সংসারের মায়া এসে জড়ো হয়েছিল। কি অদ্ভূত ভাবে ওর দিকে তাকাতো নির্বাণ! যেন তিতির জগতের সবচাইতে দুখী এক কিশোরী, আর তার দুঃখ মেটানোর সব দায় নির্বাণের রোগা কাঁধে এসে পড়েছে। এমন ভাবে আগলে রাখতো ছেলেটা, ওই দুই বছর তিতিরের জীবনে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে সুখের সময়।


সোনাঝুরি হাইস্কুলের সবচেয়ে শেষ বেঞ্চিতে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতো নির্বাণ। এতই কুঁকড়ে থাকতো ছেলেটা, স্যার ম্যাডামরাও ওকে ঠিক মনে করে উঠতে পারতেননা। আর তিতির! সে ছিল ক্লাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। শহর থেকে হঠাত করে আসা এক স্বর্গীয় ফুল, যার চারদিকে ভ্রমরের মতো ভীড় করে থাকতো বাকী ছেলেমেয়েরা। তিতিরের ঝকঝকে নতুন ইউনিফর্ম, সাদা ধবধবে জুতো মোজা , কপালের উপর ঘূর্ণী হয়ে থাকা থোপা থোপা চুল... সবটুকুই বিস্ময়ের, সবটুকুই তাকিয়ে দেখার... দেখতে থাকার।


তিতিরও হয়তো নির্বাণকে দেখতে পেতনা, খেয়াল করতো না... যদিনা সেদিন ক্লাশরুমে হঠাত করে একটা সাপ ঢুকে পড়তো। 

ক্লাশ ইলেভেনে সেদিন সুলেখাদির অঙ্ক ক্লাশ চলছে।টিফিনের পর প্রথম পিরিয়ড। অনেকেরই চোখে ঢুলুনি, তার কতটা প্রবল গ্রীষ্মের দাক্ষিণ্যে... আর কতটা অঙ্ক বিষয়টির ঘুমপাড়ানি ক্ষমতার, তা অবশ্য বলা মুশকিল।

 তিতির মন দিয়ে বোর্ড থেকে পরিমিতির অঙ্ক টুকে নিচ্ছিল। হঠাত করে পিঠের ওপর বরফ শীতল হিলহিলে একটা স্পর্শ... তিতির কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ যেন নিপুণ হাতে তার শরীর থেকে ওই শীতল স্পর্শটুকু আলাদা করে দিল। তিতির শুধু দেখল, একটা হিলহিলে চেহারার ধান রঙা হাতের মুঠোয় ধরা কুচকুচে কালো সাপ।  

ক্লাশ শুদ্ধ ছেলেমেয়ে দমবন্ধ করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে, আর ছেলেটা নির্বিকার ভাবে ক্লাশরুম পেরিয়ে বারান্দা পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে স্কুল লাগোয়া এঁদো পুকুরটার দিকে।

“কে ও?”

“ও তো নির্বাণ”।

সেই প্রথম নাম জেনেছিল তিতির। 
সম্ভ্রমে কৃতজ্ঞতায় বুক ভার হয়ে উঠেছিলো। 

পরদিন নিজে থেকে আলাপ করেছিল নির্বাণের সাথে, আর চমকে গেছিলো। আপাদমস্তক গোবেচারা চেহারার নির্বাণের মধ্যে এক অদ্ভূত আগুনের খোঁজ পেয়েছিলো তিতির।

“তোমার ভয় করেনা নির্বাণ?”

“কিসের ভয় তিতির?”

“সাপের ভয়!”

“সাপ আমার ভালো লাগে”।

“বিপদ হতো যদি?” শিউরে উঠেছিলো তিতির।

“বিপদ আমি ভালোবাসি। বিপদ আমায় টানে”- হা হা করে হেসে উঠেছিলো নির্বাণ। “যেমন তুমি টানো আমায়, মূর্তিমতী বিপদ!”

“আমি! বিপদ কেন?”

“বা রে! বিপদ নয়? তুমি হলে স্বর্গের পরী, আমি খড়ের চালের নীচে মাথা গুঁজে থাকা বাপে খেদানো ছেলে। তবু আমি তোমার স্বপ্ন দেখি। তুমি আমার বিপদ নয়?” তিতিরের আঙুলে আঙুল ছুঁইয়েছিল নির্বাণ।

এমন নয় যে এর আগে কোনো ছেলে তিতিরের আঙুল স্পর্শ করেনি, প্রেম নিবেদন করেনি কখনো। বরং কৈশোরের প্রথম স্পর্শ বোঝার আগেই স্তাবকের ভীড় জমতে শুরু করেছিল তিতিরের চারপাশে। কিন্তু নির্বাণের মত এরকম অদ্ভূত ভাবে কেউ তাকে ভালোলাগার কথা বলেনি কখনো। 


ভালো লাগছিল নির্বাণকে। অন্যরকমের ভালো... একেবারে অন্যরকম। প্রেম হয়েছিল কিনা, হলেও তার গভীরতা কতটা ছিলো... তা বোঝার ক্ষমতা ছিলো না তিতিরের। তবে এটুকু বুঝেছিলো, নির্বাণের সাথে থাকতে ভালো লাগে, ওর কথা শুনতে ভালো লাগে।বিশেষ করে যখন নির্বাণ ওর আশ্চর্য সব নেশার কথা বলে,সেইসময় নির্বাণের দূরদূরান্তে চলে যাওয়া দৃষ্টি কি ভীষণ টানে তিতিরকে। 

নির্বাণ একা একা বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, পোড়োবাড়ীর রহস্য খুঁজে বেড়ায়... মাটির তলায় পুঁতে রাখে তিতিরের বাঁ পায়ের রূপোর তোড়া ... বলে , ওগুলো নাকি কেউ হাজার বছর পরে খুঁজে পাবে , আর জানতে চাইবে তোড়ার মালকিনের কথা। ইতিহাস হয়ে থাকবে তিতির। এসব শুনলে অদ্ভূত ভালো লাগায় ভরে যায় তিতিরের বুক। 


“তুমি কি কবি নির্বাণ?”

“আমি প্রেমিক”।

“তুমি অন্যরকম”।

নির্বাণ হাসে। পোড়োবাড়ীর ভাঙা পাঁচিলের পাশে হাজার হাত ছড়িয়ে থাকা চেরীফুলের গাছটায় হেলান দিয়ে একদিন তিতিরের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে, দুইহাতে তিতিরকে ছুঁয়ে থাকে সেতারে সুর তোলার ঢঙে।


একদিন হঠাত করেই সবাই জানতে পেরে যায় ওদের কথা। 

বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারে না তিতির। মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। বিডিওর মেয়ে এমন একটা ছেলের সাথে ভিড়ল, যার বাপের ঠিক নেই! গ্রামে কান পাতা যায় না। ক্লাশরুমে বসে থাকা যায় না।


হেডস্যারের সাথে কথা বলেন বাবা। তিতিরদের আর মাত্র একমাস ক্লাশ হবে। তারপরেই টেস্ট। একটা দিন আর মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে চান না বিকাশবাবু। রাজী হলেন হেডমাস্টারমশাই। এত ভাল মেয়ে একটা উটকো ছেলের জন্য তার ভবিষ্যত নষ্ট করুক, তিনিও চান না।

 নির্বাণকে একমাসের জন্য সাসপেণ্ড করা হল। তবে পরীক্ষায় বসতে পারবে সে। নির্বাণের বাড়ী থেকে অবশ্য কেউ আসে না। তার মা অসুস্থ।


টেস্ট পরীক্ষার সময় সমস্ত মাস্টারমশাই দিদিমণিদের শ্যেন দৃষ্টি থাকে তিতিরের ওপর। নির্বাণ পরীক্ষা দেয় হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে। 

তবুও যেন কি করে একদিন দেখা হয়ে যায় ওদের। ঈশ্বর চাইছিলেন? হবেও বা।


“আমি পরীক্ষা দেব না তিতির”।

“কেন নির্বাণ? তোমাকে বড় হতে হবে, সবার মুখের ওপর যোগ্য জবাব দিতে হবে”।

“জবাব!” আগুন জ্বলে নির্বাণের চোখে। “আমাকে কে জবাব দেবে শুনি? বাবা কেন মা কে ছেড়ে চলে গেল? কষ্ট পেতে পেতে মা টা আমার বিছানার সাথে মিশে যাচ্ছে। ছটফট করে উঠলো নির্বাণ।

  কেউ দেখেনা, কেউ দুটো ভালো কথা বলে না। কেবল আমার মামা ছিলেন বলে আমরা বেঁচে রয়েছি এখনো। পড়াশুনো করতে পেরেছি এতদিন। 

 মামা আর নেই, জান তিতির! মামা কাল রাতে মারা গেছেন। এখন আমি ছাড়া মায়ের আর কেউ নেই।দুুুই হাতেে মুুুঠ করে ধরল কপালের চুুুলগুলো ।


মাকে বাঁচাতে গেলে আমায় কাজ খুঁজতে হবে”।

“তুমি হেডমাস্টারমশাইকে বলছো না কেন?”

“কেউ বোঝেনা তিতির। আমি কারও কাছে যেতে চাইনা। ভিক্ষা চাইনা আমি। শুধু তোমাকে চাই তিতির। তুমি থাকবে তো?”

“থাকবো "। গলা ধরে এলো তিতিরের।  

কথা রাখা হয়নি। বাবা বদলি হয়ে গেলেন মুর্শিদাবাদে। তারপর তাকে পাঠিয়ে দিলেন ব্যাঙ্গালোর,বড় মাসীর তত্ত্বাবধানে। 

মাসীর কড়া পাহারার সুফল ফলেছে। ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করেছে তিতির। বিদেশে ভাল চাকরী পেয়েছে। নির্বাণের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সে। 

ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দিন পনেরোর ছুটিতে কোলকাতায় এসেছিল নিজেদের পুরনো বাড়ীতে। হঠাত করেই এক সোনাঝুরি হাইস্কুলের এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো এসপ্ল্যানেডে কেনাকাটা করার সময়। 

কেন যে দেখা হলো! হুড়মুড় করে একগাদা স্মৃতি ভেঙে পড়লো মাথার ভিতর... 

নির্বাণ... কি করে ভুলে গেলো তিতির! 
কেমন আছে সে? 
বন্ধু কিছুই বলতে পারলোনা নির্বাণের কথা।

 কিন্তু তিতির কেন যেন আর স্থির থাকতে পারছেনা। সোনাঝুরি যেতেই হবে ওকে। যেতেই হবে।


সোনাঝুরি এসে অনেক খোঁজ করলো তিতির। কিন্তু কিছুতেই নির্বাণের কোনো খবর জোগাড় করতে পারলো না। 

কেউ জানেনা ওরা কোথায় গেছে। অনেকে তো চিনতেই পারলো না। প্রায় দশ বছর কেটে গেছে। এত বছর ধরে ওদের কেউ দেখেনি। কাউকে কিছু বলে যায়নি ওরা।


খুব অসহায় লাগছিলো তিতিরের। 

তবে কি আর কোনোদিন দেখা হবে না? 

সেই পোড়ো বাড়ীটার কাছে গেলো তিতির। খুব ইচ্ছা করছিল মাটি খুঁড়ে দেখতে... 

তোড়াটা কি আছে এখনো? খুঁড়তে পারলো না। নির্বাণ চেয়েছিল, তিতির ইতিহাস হোক। কিন্তু কার জন্য ইতিহাস হবে তিতির? 

পাঁচিলের ধারে চেরী  গাছটা এখনো আছে। ফুলে ফুলে নুইয়ে এসেছে তার ডাল। 

গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসলো তিতির। ব্যাগ খুলে একটা অনেক পুরনো রঙচটা নীল কাগজ বার করলো। ভাঁজে ভাঁজে প্রায় ছিঁড়ে এসেছে কাগজটা। নির্বাণের শেষ চিঠি...


“ যদি কোনোদিন বহুদূরে চলে যাও, যদি কোনদিন ভুলে যাও সবকিছু...
আমি মেঘফুল হয়ে ছুঁয়ে দেব চোখ, নদী হয়ে যাব তোমার নরম গালে...”


তিতির দুচোখ বন্ধ করে মেঘফুলের ঘ্রাণ নিলো, চোখের ভিতর শিরশির করে উঠল স্রোত।


 ফিরে দেখা  কবিতা


আমি কিম্বদন্তীর কথা বলছি

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ


আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মা’য়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মা’য়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
আমরা কি তা’র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা’র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
তিনি মৃত্তিকার গভীরে
কর্ষণের কথা বলতেন
অবগাহিত ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
সবত্সা গাভীর মত
দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।
যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
যূথবদ্ধ হলাম।
বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপে
মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
বারিসিক্ত ভূমিতে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
আনিঃশ্বাস গ্রহণ করলাম।
তখন বিষসর্প প্রভুগণ
অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যখন কবিকে হত্যা করা হল
তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।
তখন আমরা দুঃখকে ক্রোধ
এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।
নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্সারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।
আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
অভ্যূত্থানের কথা বলছি
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত
কমলের চোখের কথা বলছি
প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
আমি বহ্নমান মৃত্যু
এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।
যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের মত
ঋজু এবং সংহত হলাম।
পর্বত শৃংগের মত
মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
দিকচক্রবালের মত
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উত্পাটিত করলাম।
তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের
উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের
অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃংখলিত বৃক্ষের
উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
নিঃসঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
স্মরণ করলাম।
প্রপিতামহের বীর গাঁথা
স্মরণ করলাম।
আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
স্মরণ করলাম।
তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।
স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।
যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
সে কবি
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
সে কবি
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।
খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
শস্যের পরিচর্যা করছি।
আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমার সন্তানেরা
আমি তোমাদের বলছি।
যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
সূর্যের মত সত্য হবে
সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।
আমি বিষসর্প প্রভুদের
চির প্রয়াণের কথা বলছি
দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
পরিসমাপ্তির কথা বলছি
সুতীব্র ঘৃণার
চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।
আমি সুপুরুষ ভালবাসার
সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।
যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মত্স্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো ?


কবিতা



শব্দহীন সাঁতার

মৃণাল বসুচৌধুরী 

বালিমাখা ঝাউ জানে কখন দুর্যোগ
  কখন উন্মত্ত ঝড়ে উড়ে যায় সন্ধিপত্র
              ভেঙে যায় বালির পাহাড়
  ঢেউ জানে নষ্টচন্দ্রে
             কখনই বা নৌকো ডোবে
             ডুবে যায় প্রতীকী পাথর
  তোমার উঠোন জানে
          কোন ঘরে কে কখন জ্বালায় প্রদীপ
  অস্পষ্ট অক্ষর জানে
             না লেখা চিঠির কাছে কতটুকু ঋণ
  লোভহীন ঠোঁট জানে ‘ভালোবাসা’ শব্দটির
                 শুদ্ধ উচ্চারণ

    আমি প্রায় কিছুই জানি না
         দায়মুক্ত স্মৃতিজলে
                    শব্দহীন আমার সাঁতার

একটি হিরণ্ময় দুঃখের জন্য

মিঠুন চক্রবর্তী

শহুরে কাকের ডানা গুটিয়ে নিয়ে গেছে
আমাদের লাল রাস্তা, মন খারাপ করিনি, 
শহরগামী বাসের জানালায় খুলে রেখেছি
আমাদের মাটির সোনালী আত্মীয়তা। 

কালুদার পান দোকানের সবুজ আলো ছিঁড়ে
অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছে 
বোতলবন্দী লাল আলো। 
সেদিন আমাদের চোখে বিজ্ঞাপন আঁকা থাকলেও
বাবার অন্ধত্ব সরিয়ে সরিয়ে ঢুকে পড়েছে
নার্সিংহোমের সবুজ আলোর শুশ্রুষা। 

নদীর পাড়ে উৎসবের মঞ্চে নিয়ন আলোর নীচে
ভেসে গেছে বাউলের গান...
একা একতারা , বোবা। 
দুঃখ পাইনি। চেয়েছি বাউলের বুকে কেউ
সেফটিপিন দিয়ে গেঁথে যাক হাসির মুদ্রা। 

আজ, ঘাসে মেলে রাখতে চাইছি আমাদের শোক,
 
আজ, বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে কাঁদতে চেয়েছি সারাদিন

অথচ, কিছুতেই মনে করতে পারছি না
 
একটি হিরণ্ময় দুঃখ লাভের মন্ত্র উচ্চারণ।

 


পাথরজন্ম

উজান উপাধ্যায়


পাথর খুঁজতেই তো জন্ম আমার এই একার দ্বীপপুঞ্জে। তোমার বুকে নিরন্তর পাথরের চাষ ।তোমার চোখেও তো অখন্ড স্ফটিক জ্বলেপুড়ে অমর্ত্য সোমরস , আমি তো অবশ হয়ে আছি -- বরফের থেকে আরও সুকঠিন ।


এও তো কাঙ্খিত। দূরাগত পথিকের ছায়াগন্ধে প্রচ্ছন্ন নিভৃত যে শোক , তাকে মুছে নিতে পাথুরে সংশয়ের ভাঁজে আর খাঁজে আমি তো তোমাকেই হত্যা করে গেছে নীলপাথরের কন্ঠনালিতে।


এখানেও নদী খুঁড়ে যে মুখ পেয়েছি আমাদের অকারণ বিরক্তি উৎপাদক অন্তরঙ্গ কথোপকথনে , হাড় জিড়জিড়ে দেওয়া নেওয়ার পরিকল্পিত প্রবন্ধে লিখেছি মাছেদের জল থৈ থৈ জন্মান্ধতায় নৈঋক সাঁকোর বিপুল উপেক্ষা।

আমরা যে সারাদিন সাজিয়ে গুজিয়ে নিজের অবিন‍্যস্ত মিথ্যাচারকে গয়না পরাই , সেখানে যে আতসকাচ গোকুলে বাড়ছে অনায়াস সম্ভাবনার তীব্র বিকিরণে-- 

কিভাবে গিলছি প্রিয়া এতো পরমাণুবিষ রোজ রোজ , কিভাবে ভাঙছি গুঁড়ো গুঁড়ো তেজস্ক্রিয়ায় !

ছায়াবৃত্তে  মায়াবী উঠোন একাই ছড়িয়ে আছে নিকোনো চতুষ্কোণে ।














মাধবী



সুশান্ত ভট্টাচার্য 


প্রথম স্তবকে লিখি নদী
দ্বিতীয় স্তবকে লিখি জল
নাভির সৃজন থেকে তুলি
শব্দের যত কোলাহল।

লিখেছি নতুন লেখা শুনবেন!
আমি বলি বেশ পড়ো পড়ো
লুপ্ত তারায় এতো আলো
সেলফোনে মেঘ জড়োসড়ো

সে একবারই এসেছিল একবার 
ভুলে গেছি কি নাম আর পদবি 
পড়ন্ত বেলায় এত গলি পথ
ফুটিয়েছি একটিই মাধবী।

অগ্নিশুদ্ধ হ’লে
 
অতুল রায়
 
চন্দনে চর্চিত
  কপালে তোমার  জ্বলে  ওঠে শিশিরের  কণা ;
যা পেতে
  আতুর   হয় গন্ডদেশ গ্রীবা
আর অধর কপোলে ভরে জল—ডালিম রসের মত,
এইসব অনুকূলে, আপ্লুত তুমি সেই আরাধ্য ভেনাস।
অনুরূপে,ও নম্র আঙুল ছুঁয়ে কতটা উথাল হয়
               প্রাণ সমুদ্রের জল ;
এই করতল কাল সায়াহ্নে জেনেছে
কতটা কোমল হয় সুমিত্রা কমল !

অগ্নিশুদ্ধ হ’লে জ্বলে একাদশ চন্দনের কাঠি ;
         আর দুই বুকের গহনে দু’টি দীপ ,
দ্যুতিঘন সত্ত্বায় জ্বেলে নেয় একটি প্রদীপ
           শুভ সৌরভের শুভ্র খুশিয়াল।
পার্থিব সব রীতি তুচ্ছ মেনে কখন সে মুক্ত হল ;
        সংযুক্ত হ’ল মূল প্রত্যয় ও প্রেমে !
স্বর্গ তুমি নেমে এসো, এসো এইখানে নেমে…..

এরপরও, কি কখনো হবে কীটানুদষ্ট
                   দুই দীপ্ত শতদল ,
কালের নিয়মে যেমন হয় কারো স্মৃতি লগ্ন ভ্রষ্ট !



যাওয়া তো নয়


শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়

আকাশ যদি কলম ধরে স্মৃতির টানে
অযুত দিনের অশেষ কথা
না ফুরোনো দুঃখব্যথা
পড়বে ঝরে মর্তলোকের প্রাঙ্গণে
তখন আমি নাই বা থাকলাম।

বাঁচবে মানুষ নিয়ে ক্ষত
বিহানবেলায় কাঁদবে কত
আকাশি সেই গল্প গুলো ছেনে নিয়ে
ভরবে কোঁচড় আমার মত,
আকাশ-মাটির সেতুই বাঁধলাম।

মাটিজলের হর পরতে
সামিল হতে সবার সাথে
অদর্শনে জুটব তাদের মাঝখানে।
সত্যি করে নাই বা ফিরলাম

আকাশ যদি কলম ধরে
ঝরব যে তার পাণ্ডলিপির বর্ষণে
অমরতায় এই তো ধারাস্নান!


অহম

অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী

কেবলই বিদ্বেষ চিহ্নিত হয়
মনের কথা পারতপক্ষে মুখে আনা জরুরী নয়....

পড়ে থাকে একা উপবীত
আমার ভীষণ লাগে শীত...মৃতদেহে লাগে শীত...

আমি লক্ষ্যে স্থির ধ্যানে পরমেয়।
জঠর আমাকে রাত্রি পরিয়ে আগুনে নেভায় দেহ।


বিষণ্ণতা

 কনিষ্ক দেওঘরিয়া

ভোরের স্বপ্নসমূহ প্রত্যাশিত
চায়ের কাপে চুমুক বাড়ে
বেলা বাড়তে থাকে
বাড়তে থাকে হিসেব নিকেশ
ভবঘুরে বেকার যুবক চোখে ঝাপসা দ্যাখে
বদলে যায় পাখির বাসা
শয়তানের জন্ম হয় বার বার
যেমন ধর্ষক অপরাধবোধ নিয়ে বাঁচে ,
তেমনি বিষাদ
ভবিষ্যত ভাবনায় কবিতা অন্ধকারে
এবং ধুঁয়ো ধুঁয়ো ধুঁয়ো
কুয়াশার কারাগারে সর্বদা গতিময় প্রাণ
বৃষ্টি দেখলে লোভ হয়
প্রেমিকার ফুরিয়ে যাওয়া কথা
রোদ নিয়ে আসে
যাকে আমি ভয় পাই
ঝাউগাছের শক্ত ছায়া জাপটে ধরে বিষন্নতা
আকাশের বুকে কান্না
আমিও আমার মতো কাঁদি
নিঃশব্দ - আশাহীন - অসফলতা
দীর্ঘদিন ব্যাপি সূর্যাস্ত চোখ মুখ আর ভাবনার সাথে একঘরে ৷৷

 কষ্ট 



গৌতম বিশ্বাস 


বুকের ভেতর হৃদয় পোড়া ছাই, 
তুষের আগুন তবুও আজ জ্বলে। 
দুচোখ জোড়া অমানিশার ঘোর, 
তীব্র পেষন সময় জাতাকলে। 
আপন যে জন দূর আকাশের তারা, 
আলোকবর্ষ ছুঁয়েছে ব্যবধান। 
মুখচোরা,তাই নীরব ব্যাথায় কাঁদি, 
হৃদয় ভেঙ্গে টুকরো হাজারখান। 
কাব্য লিখে রোজই ভরাই খাতা, 
 কষ্টটাকে সঙ্গী করে শুই। 
গভীর রাতে একলা উঠে ছাদে, 
কেবল শুধোই,"কোথায় গেলি তুই?" 
নির্জনতা শুধুই বিরাজ করে, 
আমার ডাকে দেয়না কেউই সাড়া। 
একলা আমি ছাদের ওপর জাগি, 
ঠিক তখনই জমিয়ে ঘুমোয় পাড়া।।


মন জানে না
গোপেশ দে 

মন জানে না মনের মাশুল
ডাক পাঠায় মগজে
ব্যালকনিতে বিষাদ হাঁটে
কাব্য লেখে কাগজে।


কোথাও কোন ভুল থেকে যায়
ভুল গুলো সব স্বেচ্ছাচারী
পেটের জ্বালায় ডিগ্রিধারী
জিনিস বেচছে বাড়ি বাড়ি।


উদাসীন আজ মনের আবেগ
স্বপ্ন ওড়ে ম্লান আকাশে
ইচ্ছে করে পদ্যগুলো
ছড়িয়ে দিই লোকাল বাসে।

                                  



আগামী বিবর্তন


আর্যতীর্থ

ডারউইন যদি ঠিক হন, মেয়েরা তাহলে আগামীতে শ্বদন্ত নিয়ে জন্মাবে এইদেশে।
দুই হাতে নখ হবে চোখ চিরে দিতে, বিষের থলির নল শেষ হবে ঐচ্ছিক জিভে, 
বিবর্তনবাদ সত্যি হলে, হরিয়ানা , ইউ পি বা মধ্যপ্রদেশে,
এরকম কন্যার জন্মানো শুধু সময়ের অপেক্ষা।
স্ত্রীকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে যে শরীর লুটেছে আত্মজার,
সেই বাবাকে ছোবলাতে,
 উনিশের ছেলেটাকে যারা দেখতে বাধ্য করলো বন্ধুর ওপর অত্যাচার,
তাদের চোখ খোবলাতে
হরিয়ানায় কিশোরী ছাত্রীকে দিনেদুপুরে ধর্ষণ করে যারা তার বাড়িতে ফোন করতে পারে,
তাঁদের নখে দাঁতে ছিঁড়তে ভারতীয় মানুষীর জেনেটিক কোড বদলে যাবে নিশ্চিত,
নয়তো হে ডারউইন, বড় নড়বড়ে হবে আপনার ফিটেস্টের সারভাইভাল থিওরির ভিত।

এখানে শাসকের দায় নেই কোনো, পুলিশেরা জাগেনি এখনো,
 
ধর্ষণ ঠিক কোথায় কবে এবং যথাবিহিত বিধিসম্মতভাবে হয়েছিলো কিনা, 
তাই নিয়ে চাপানউতোর হয়ে একটাই ধ্রুবতথ্য সব কাহিনীর শেষে পড়ে থাকে,
‘ অপরাধী পলাতক, বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী , পুলিশ ও প্রশাসন প্রবল খুঁজছে তাকে।’

আমরাও খুঁজছি, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার আগামীতে নারীর ভাগ্য নিয়ে কি লেখা আছে,
ডারউইন, আপনার ওপরে ভরসা করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই এদেশের কাছে।


কষ্টফুল

তুতেনখামেন-

কষ্টের রঙ বেদানার মত গাঢ় লাল 
এই রঙে চুবিয়ে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয় 

আমিও হাঁটতে থাকি মেঠো ফুল ,শালুকজল পেছনে রেখে

বিষক্রিয়ায় যখন গোটা শরীর নীল হতে থাকে
রাজহাঁসের উন্নত গ্রীবা নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি 
একমুঠো জল চেয়ে নিই উড়ে যাওয়া মেঘের কাছে।

 মায়াময়ী  
কেকা সেন 

আমি ভিজতে চাই, 
ভিজতে চাই ওই আটপৌরে, আজন্ম নদীর ধারে পরিচিত বৃষ্টির ভিতর
টুপটাপ ঝ'রে পড়া সহজ বিন্দুর মত মিশতে চাই অতল গভীরে
যেখানে নেই কোন রক্তাক্ত শিকারি বলয় 
কিংবা কোন হলুদ-কালো চতুর ছায়া
আছে শুধু কাদামাটি লুটোপুটি সবুজ সরলতা
আলোর বুদবুদ ছোঁয়া সোঁদা প্রেম খেলা করে পাপড়ি ঘেরা গোলাপি আভায়
আমি আটপৌরে সেই আজন্ম নদীর পরিচিত বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে 
গোলাপি আভায় স্নাত হতে হতে 
কখন যেন মিশে যাই মায়াময়ী মাতৃস্নেহতে














https://mail.google.com/mail/u/1/images/cleardot.gif