Showing posts with label সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়. Show all posts
Showing posts with label সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়. Show all posts

Friday, 16 February 2024

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

 



লেখারা যখন পাল্টে যায়



প্রতিটা পর্বের পর নতুন অধ্যায়ে 

অভিজ্ঞতা বদলে দেয় ভাষা।

এ কি স্বঘোষিত মৃত্যুঘোষণা? 


ছটফট করে ধূসরতা,

রোদে ভেজা নিরীহ দুপুর 

ছেঁড়া ঘুড়ি হয়ে গেঁথে আছে।

পর্দার ফুটোয় অপেক্ষা চোখ !


বন্ধ দরজায় টোকা পড়ল?

সাতজন্মের ডাক-

মার্চ শেষ হতে চায় না আর,

আশ্চর্য ফুল হয়ে ফোটে নির্বাক সন্ধেরা। 


ভালোবাসা মরে গেলে যুদ্ধ বাধবে যে…

তুমি আছো তাই কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে আছে পথ,

কত শান্তি চারদিকে,

কবিতা লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছে যেন কোনও কবি!


 

Tuesday, 29 December 2020

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় ,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


আনন্দ বড়ো ক্ষণজন্মা





আনন্দ বড়ো ক্ষণজন্মা

আঁকড়ে ধরি যে মাটি মজবুত ভেবে

তার ওপর আরো আরো গাছ

আগাছার শরীর উপড়ে ফেলে দাও, ভাবতে ভাবতে 

কেঁপে ওঠে ভিত!

মনে হয় ছিনিয়ে নিয়ে যাই হাওয়ার মুঠি ধরে

লাভার মতো জ্বলে ওঠে অগ্নিনিঃশ্বাস

টের পাও না কিছুই।

জানো যদি একটা উত্তরে শান্ত হয় উত্তাল সমুদ্র

তবে কেন এত না বোঝার ভান?

যতবার ভাবি আশা রাখব না কোন

কেন বারবার চোখ যায় ভোরের কাছে?

বরং দু চোখ বন্ধ থাক।

আমি দেখতে চাই না আর, ভাবতে চাই না 

শুধু চাই একটা ঢেউ এসে বলে দিক, 

এই তো দুটো পা ভিজিয়ে দিয়েছি এবার, 


হেঁটে যাব সোনালি বালির বুকে

দুহাত ছড়িয়ে জড়িয়ে ধরব আকাশ

যেখানে আমাদের সঙ্গম নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে

শুরু হবে সেই অনন্ত চুম্বন!





Friday, 16 October 2020

বই আলোচনা, অমিতাভ মৈত্র, আলোচক- সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 

 


কবিতা সংগ্রহ/ কবি অমিতাভ মৈত্র

 

 কবিতা সংগ্রহঃ অমিতাভ মৈত্র

প্রচ্ছদ রাজীব দত্ত

দাম ২৫০ টাকা

প্রকাশক তবুও প্রয়াস

 

"আমার কাছে একটি ছবি আসে, আমি সেই ছবিকেই ভাষায় অনুবাদ করতে করতে এগিয়ে যাই"

 

কবি অমিতাভ মৈত্রের এই স্বীকারক্তিই হয়ত প্রমাণ কতটা নিষ্ঠা ও নেশায় এক বুদবুদকে সমুদ্র করে তুলতে পারেন তিনি। তার কবিতাগুলি চিরপরিচিত গন্ডীর বাইরে নিজেকে খুঁজে নেওয়ায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাষার প্রয়োগে তিনি যে ব্যতিক্রমী শুধু তাই নয়, কবিতার গঠনশৈলী ও বক্তব্যে তার দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া অসম্ভব।

 

পতনকথা, টোটেম ভোজ, ষাঁড় ও সূর্যাস্ত, পিয়ানোর সামনে বিকেল ও পরিশিষ্ট এইকটি বিভাগে কবিতাসংগ্রহকে সাজিয়েছেন সম্পাদক সেলিম মন্ডল।

 

"যদি চিতা বল, আমি দুই হাতে ছুঁয়েছি আগুন

হাড়ের গভীর মাংস মেলে দাও শস্যে ঘাসে ঘাসে

ছড়াও শরীরময় স্বেদ রক্ত রাত্রিবীজগুলি

দ্যাখো কত স্পর্শসহ আমি আর আমার অঙ্কুশ"

 

মৃত্যুর অতীত থেকে উড়ে চলেছে নীলঘুড়ি। কবির হাতে সেই অলীক সুতো। অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে অতিকৃত কালো কালো কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত মুখ। তারা হাঁটতে হাঁটতে নির্মাণ করছে পথ। বেজে উঠছে অস্ত্রের ছনছন। তৃষ্ণার ছুরি হাতে নত হচ্ছে ক্রমশ কবির শরীর। তবু ব্যর্থতায় বেঁচে থাকা। এ যেন এক তুমুল আত্মপ্রতারণা। যে সমস্ত পাপের কথা বিশ্বাস করেনা ঝরনার জল, তারা জানে আসলে পাপ বলে কিছু নেই। সবটাই ঘটমান, বর্তমান। সময়ের সুকৌশল কারচুপি। যে হাত ডুবে আছে বহুদিন জলে, যে চোখে বহুযুগ জ্বলেছে আগুন, কাপাস তুলোর মতো যে শরীর ভেসেছে কেবল, মাটি ও গাছের কাছে তার সব ঋণ আজ শেষ। গুমোট বমির মতো মাংসের কুয়াশা এলেও মৃত্যু আজ প্রস্তুত সমস্ত অন্ধকার পিছনে ফেলে।

 

টোটেম ভোজ কবির এমন এক সৃষ্টি যাতে ধরা পড়েছে এক তীব্র যন্ত্রণা। শুরুতেই কবি লিখছেন,

 

" অস্বাভাবিক সব চোখ, আর এক অদ্ভুত

গোল মাংসমাখা ভাষায় কথা বলা হয়েছে

তার বিষয়ে

যে ভাষায় 'আলো' শব্দটি নেই, এবং

কোন বিস্ময়চিহ্ন নেই…" 

 

এ কোন অন্ধকার। এ কোন ভালোবাসা তবে? কেঁচোর মতো পিছল ঠোঁট যার গাল ছুঁয়ে বলছে, ' তোমার ধর্মান্তরণ হল। এখন তোমার মুখে আমার রক্ত। শোনো, লাল থকথকে সেই জলাভূমির ওপারে সাদা হাড়ের ক্রুশকাঠে, আড়ষ্ট শরীর, এখন থেকে ঝুলে থাকবে তুমি।'

তবে কি শুধু শরীর! শুধুই জ্বলন্ত মশাল ও ঘোড়াটিকে নিয়ে স্নানঘরের বন্ধ দরজা? নাকি নগ্নতাকে গ্রহণ করা মাংসের বিরুদ্ধে? এমনই এক জটিল দর্শন বারবার দেখা দিয়েছে টোটেম ভোজের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে।

নিজের মৃতদেহের পিঠ হেলান দিয়ে যেন লেখা হয়েছে কবিতাগুলি। থমথমে বাতাসে শুধু ঘৃণা। কাঁধে হালকা কামড় দিচ্ছে পিশাচিনী। না খাওয়া অংশগুলো বাক্সে তুলে রাখছেন দুজন। বাঁচার তাগিদ নেই, তবু বেঁচে থাকা। প্রেরণাহীনভাবে কামড়ে ধরা তার গলা। নিষ্প্রাণ জলে, রক্তরসে ভরে উঠছে মুখ, কবি লিখছেন,

 

" দরজার ওপারে কোন মাংস ডাকছে, আলো হাতে নিয়ে"।

 

ক্রমশ পাগল হচ্ছে সব চরিত্ররা। সম্বিতহারা আত্মহত্যাপ্রবণ। প্রতি দু মিনিটে মৃত্যু আবার স্বাভাবিক শ্বাস। আলোহীন নাচঘরে ধূসর পোশাকের নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা। শূন্য চেয়ার থেকে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা এবং তারপরেই বসে পড়া, তার মাঝের যেটুকু সময়, তা যেন এক নাচেরই সমান। কখনো শূন্যে ভেসে ওঠে সেই রাজকীয় চেয়ার, কখনো বা ঠান্ডা স্পর্শযোগ্য এক আলোয় ম্যাডাম এম কে মৃতদেহের মতো তুলে ধরা ভারী রক্তের বোতলগুলোর ভেতর।

অবেশেষে সময় আত্মহত্যা করে। 'not understanding, not living either, not even aware of life trapped deep inside'   ( Michel Joiret)

আপেল চিবোতে চিবোতে ঝলসে উঠে রুটি। কবিতার চরিত্র ম্যাডাম এম ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে উঠছেন। দেশলাই নিতে পারছেন না। লাল সিলিন্ডার ও তার আপেল যেন মিশে যাচ্ছে একই বিন্দুতে। দরজার ফাঁক দিয়ে সাদা কাপড় হাতে এগিয়ে আসছে মৃত্যু। তিনি বাকরুদ্ধ। ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধ। দেশলাই ভিজে গেছে তবু মাংস মুক্তি চাইছে যন্ত্রণা থেকে।

 

ষাঁড় ও সূর্যাস্ত বইটির কবিতাগুলির গঠন আবার একটু আলাদা। বস্তুকে তার অর্থ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া কিংবা অন্ধকারে ছুটে চলা কোন ট্রেন, গতির মধ্যে পাক খাচ্ছে এমন কোন বিষয়, রাত্রি কিংবা চোখ সবকিছুকেই কবি রূপদান করেছেন অনন্য ভাষায়। ঘন বাষ্প আর বালির স্তর সরিয়ে উঠে আসা ঘড়ি কিংবা কোন বিস্মিত বারান্দায় ফুটে ওঠা কোন ছায়া ধরা দিয়েছে তার বহমানতায়।

 

" আমার সাদা কুকুরটা আবার যেদিন নিজেকে ভাবতে শুরু করবে

আর আরাম চেয়ারটায় বসে ঢুলতে ঢুলতে হঠাৎ দম আটকে আসার কারণ যেদিন থেকে খুঁজে পাব না আমি

 

সেদিন কেউ এসে যদি বলে যে আমার ঝগড়াগুলো নিয়ে,

কাগজপত্রগুলো নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই

এমনকী আমার বাসন ধোয়াকেও সে আর বাসন ধোওয়া বলে মনে করে না

তখন তাকে বোকা বানানোর জন্য এই একটা ঝরঝরে হাসি

আমি ভেবে রেখেছি

এক জায়গায় খানিকটা হলদে, মরা ঘাস দেখিয়ে বলব

এখানে তোমার জন্য একদুপুর লম্বা একটা ঘন্টার শব্দ রাখা আছে। তোলো!"  (বোকা)

 

লাল ধুলোর শরীর। অপেক্ষারত লাল বাঘ। জাদুকর আসলে সেই নারী যিনি রক্তমাংসের প্রশাসক। কিংবা এই চোখ মুখ নেমে আসা হাসিরা যেন একএকটি খোলা রাস্তা। সূর্যাস্তের মধ্যে গাঢ় হয়ে ওঠা সিংহরা যেমন কখনো জলের ধারে এসে দাঁড়ায় অবিশ্বাস্য কোন প্রতিবিম্বের কাছে, মৃত্যু থেকে না উদ্ধার হওয়া কোন বিভ্রান্তি যেমন রক্তাক্ত হয়ে থাকে চিরকাল, এ যেন সেই না জানা সূর্যাস্তেরই ছবি যা বারবার প্রতিভাত হয় অবচেতনের পর্দায়।

 

ভেসে যাওয়া বাড়িগুলো যে ভয় থেকে কথা বলে কুয়াশার সাথে কিংবা দরজা খোলার শব্দে বোবা মেয়েটি কামড়ে ধরে তার বিড়ালকে এমনিই সব অদ্ভুত দৃশ্যকল্প বারবার ওঠে আসে তার কবিতার কায়া গঠনের জন্য।

 

পিয়ানোর সামনে বিকেল কাব্যগ্রন্থটি আর একটি গভীর জীবনদর্শনের প্রমাণ। খোলা ওয়ার্ডরোবের সামনে মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যকল্প যেমন অতি সাধারণ হলেও গভীর তেমনই মসৃন হলুদ হাত যা একটু দেরি করে পৌঁছায় সবসময়, এই পংক্তিগুলি পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে কবিতার আসল উৎস তবে কোথায়! ক্যানভাসে কি দর্শন এঁকেছেন কবি। বহুপঠন দাবী করে প্রতিটি কবিতা। সাদা গজ এগিয়ে যায় কোনাকুনি যেন শেষ হয় দীর্ঘ অপেক্ষা। মৃত্যু পর্যন্ত শুধু ঝড়। কখনোই ঘুমিয়ে পড়া চলবে না। এমন সব পংক্তির আলোয় ঘিরে থাকে পাঠক।

 

' সমুদ্রের দিকে ব্লেড আসছে। বৃষ্টি আসছে শূন্যতা, সাইকেলের চাকায়।

দেয়াল ঘেঁষে নিয়ে চল। কেন মিথ্যে বলছ আমাকে?

তিন মাইল জুড়ে কোথাও ঠিকানা নেই।

আলো কমে আসছে। নৌকা বানানো হল না। নীরবতা থেকেও হয়তো রক্ত পড়বে এবার।

গা শিরশির করছে। ব্লেড সরানো দরকার।

তোমার হাসি কি আগের মতোই অবর্ণনীয় এখনো।'(ব্লেড)

 

কবিতাটির ভেতর এক অদ্ভুত অন্ধকার। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নিচ্ছে হতাশা। এই ছায়ার কারণ হয়ত অস্পষ্ট। হয়ত বা জানলার কাচে লাগা অর্থহীন বৃষ্টি। তবুও তা বিধ্বংসী। তবুও তা কালো আঙুরের মতো লোভনীয়। যা মানুষকে ধ্বংস করে তার দিকে ছুটে চলার প্রবৃত্তি বড়ো স্বাভাবিক। এ মৃত্যু যেন তেমনই এক বিস্ময়। মোটরবাইকের নীচে চাপা পড়া শেষ আর্তনাদ। তবুও জলহীন কঠিন দুচোখ, আত্মহত্যা চায় বাঁচার আশায়।

 

পরিশিষ্টেও বেশ কিছু কবিতা গুণমানের বিচারে আলোচনার দাবী রাখে। শিউরে উঠে 'যতক্ষণ টগর থাকবে'

কবিতাটি পড়ে। কী কঠিন বাস্তব সত্য কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অনবদ্য ভাষায়।

 

' মেয়েটিকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মিলিটারি ব্যারাকে

নাচের জন্য। ভিতরে মাংসের গন্ধ, আগুন

আর জড়ানো গলায় হই হল্লা।

 

নতুন দখল হওয়া এই শহরে

কোথাও আলো জ্বলছে না আজ।

ধোঁয়া উঠছে এখানে সেখানে---

আর অন্ধকারে একটানা বেজে যাচ্ছে বলির বাজনা।'

 

 

অভ্রকণার মতো আলো পড়ছে চাঁদের। আর তাতেই দৃশ্যমান একপাটি রক্তাক্ত জুতো। কেঁপে উঠি শেষ লাইনে যেখানে কবি লিখছেন, ' কালো ওই মেয়েটিকে ঈশ্বর নিজের হাতে আজ অনুচ্ছিষ্ট মাংস খাওয়াবেন।'

 

আরো বেশ কিছু কবিতায় কবি তুলে এনেছেন এমন সব চিত্র যা অননুকরণীয় তো বটেই, নিজ বৈশিষ্ট্য ভাস্বর। এমন সব বাস্তব দৃশ্যকল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে কবিতার কায়া যাতে তারা নিজস্ব ভাবধারায় ধরা দেয় বারবার, নানা ভাবে পাঠকের মননে। বহুস্তরী এই লিখনের ভেতর মৌলিকত্ব শুধু নয়, উন্নত ও গভীরতার ছাপ সুস্পষ্ট।

 

সবুজ আলোয় ভরে উঠছে মাঠ। গ্রামীন মেয়ের হাতে এখন শুধু জল। হত্যা নয়। এ যেন এক ধর্মবিজয়। ভরে উঠছে ধানক্ষেত। কবি লিখে চলেছেন এক অনন্য বিজয়গাথা শৃঙ্খলমোচনের।

 

সবশেষে কবি সেলিম মন্ডলের প্রতি পাঠকের কৃতজ্ঞতা বেড়ে যায় এমন একটি সংকলনের জন্য। সম্পাদক হিসাবে 

নিঃসন্দেহে এটি সেলিমের একটি ভীষন ভালো কাজ।

 

 

 

        

 

  

 

Saturday, 27 June 2020

পুস্তক আলোচনাঃ সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়


পুস্তক আলোচনা


সবর্ণা  চট্টোপাধ্যায়



নামঃ নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী 

প্রকাশকঃ ধানসিড়ি

মূল্যঃ ৪৫০ টাকা 






নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা একটি ফিলোজফিক্যাল থ্রিলার। তবে শুধু তাইই নয়। বৌদ্ধ জীবনচর্চার এক যাত্রাপথও বটে। উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবনপথকে কেন্দ্র করে। তবে উপন্যাসের মোচড় এখানেই যে, এখানে সময়কাল দশম একাদশ, ত্রয়োদশ ও একবিংশ শতাব্দীকে কেন্দ্র করে ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে। সেই সাথে বদলেছে ভাষার প্রয়োগ। তৎসম শব্দের প্রয়োগ ত্রয়োদশ শতকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করেছেন লেখক সন্মাত্রানন্দ শোভন। যদিও দীপঙ্কর বা চাগ লোচাবা কেউই হয়ত এভাবে কথা বলতেন না। তবু সময়কালকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে বাস্তবতা দান করার জন্যই লেখকের এই প্রয়াস। 

প্রথমেই আসি নামকরণে। নাস্তিক কেন? সাধারণ ভাবে দার্শনিকরা মনে করেন বৈদিক প্রমাণকে যারা স্বীকার করেন না তারাই নাস্তিক কিন্তু এখানে নাস্তিক অর্থে ব্যাপ্তিকে অস্বীকার। পারমার্থিক দিক থেকে বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘ সবকিছুকেই অস্বীকার করেন অতীশ। অথচ মানবতার গুণে অতীশের চেয়ে বড়ো আস্তিক বোধহয় কেও নেই। তবুও ইতিহাস তাকে এমনই ভূষণে অলংকৃত করেছে। লেখক হয়ত এই দুইভাবে অর্থাৎ খানিক বিদ্রুপাত্মক অর্থেও নাস্তিক শব্দের প্রয়োগের দ্বারা নামকরণ করেছেন উপন্যাসটির।


গল্প কেন্দ্রীভূত হয়েছে একটি পুঁথিকে ঘিরে। বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামে অনঙ্গ দাস নামে এক গরীব কৃষক মাটি খুঁড়তে গিয়ে চন্দনকাঠের এক বাক্স হাতে পায়। তাতে ছিল এক প্রাচীন পুঁথি, একটি মালা ও একটি বৌদ্ধ তারামূর্তি। এই পুঁথিকে ঘিরেই শুরু হয় আবিষ্কারের সন্ধান। 

সময় যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অমিতায়ুধ থেকে চাগ্ লোচাবা কিংবা চাগ লোচাবা থেকে চন্দ্রগর্ভ। এই চন্দ্রগর্ভ হল দীপঙ্করের পূর্বনাম। গল্পে শাসন করে তিন নারী স্বত্ত্বা। এরা যেন একই কায়া, একই ছায়া। তবু ভিন্ন সময়ে এদের অবতরণ। জাহ্নবী থেকে কুন্তলা, আবার কুন্তলা থেকে স্বয়ংবিদা এরা পরস্পর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা একই নারীর তিনরূপ। যার অদৃশ্য পরিচালনায় বয়ে চলেছে যেন অতীশের জীবন। সময়ের তিনপর্বেই প্রয়াণাসক্ত তরুণীরা কোথাও অপেক্ষায় অবহেলায় ধৈর্যে সংযমে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তারা পরিণতি চেয়েছে প্রিয় মানুষের কাছে। তারই রেশ থেকে যেন বারবার জন্ম। অবশেষে জাহ্নবী, মর্যাদা পেয়েছে স্ত্রীর। গল্পের নায়ক একবিংশ শতকের অমিতায়ুধ বিবাহ করে তাকে। এও কি কোথাও পূর্বের অসম্পূর্ণ মিলন নয়? উত্তর থাক পাঠকের কাছে। পাঠক বুঁদ হয়ে  থাকে গল্পের বিস্তারে।

কখনো বজ্রযোগিনীতে অতীশের ভিটা,কখনো কলকাতা, কখনো তিব্বত, কখনো নেপাল ঘুরে ফের বাংলাদেশে ফিরে আসা। কলকাতায় এসে সমাপ্ত হয় এই যাত্রা। উপন্যাসের ভিতরে, উপন্যাস লিখেন শাওন বসু নামের এক চরিত্র। সেই শাওন বসুই আসলে লেখক সন্মাত্রানন্দ নিজে। চরিত্ররা ক্রমশ ঘিরে ধরেছে যেন তাকেই।


আমরা দেখি দীপঙ্করের বাল্যকাল, শিক্ষা, তার বাল্যবন্ধবী কুন্তলা, তার আত্মহত্যা, আবার নানা ভাবে নানা যুগে তাদের ফিরে আসা। এর মাঝেই চন্দ্রগর্ভের দীপঙ্কর হয়ে ওঠা, বিহার পরিচালনা, নেপাল যাত্রা। ত্রয়োদশ শতকে চাগ লোচাবার অবতরণ। অতীশকে নেপাল হয়ে তীব্বতে নিয়ে চলে সে। সময়ের আস্তরণে জড়ানো এই চরিত্রের সাথে সাক্ষাত হয় স্বয়ংবিদার। যিনি দীক্ষা দেন তাকে। সবশেষে

দেখা দেয় অমিতায়ূধ। বর্তমান শতাব্দী। অমিতায়ূধ এক আর্কিওলোজিক্যাল রিসার্চার। যে বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামে আসে হাজার বছরের সেই পুরোনো পুঁথি নিয়ে গবেষণার জন্যে। সেখানেই তার পরিচয় জাহ্নবীর সাথে, যে এ শতাব্দীতে অনঙ্গ দাসের কন্যা। 


উপন্যাসটি অবশ্যই একটি গবেষণা কেন্দ্রিক উপন্যাস। লেখকের ভাষায়, প্রত্যাখ্যানের কবিত্বের মুগ্ধতায় পাঠকও যেন ক্রমশ এগিয়ে চলে সেই যাত্রাপথ্‌ যেখানে হয়ত লেখকের কলমে কোথাও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে অতীশের জীবন।  


পরিভাষামুক্ত দর্শনের প্রকাশ লেখক ঘটিয়েছেন তাঁর সুদক্ষ লিখন ভঙ্গিতে। সেই সাথে একাকার হয়ে গেছে জীবনের আকস্মিকতা অর্থাৎ থ্রিলার এলিমেন্ট। অন্তর্জীবনে বৌদ্ধতারামূর্তির প্রণয়ে নিজেকে নিবেদন অথচ বর্হিজগতে সেই আস্তিকতাকেই অস্বীকার- এ দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে গল্পের সর্বত্র। অতীশের জীবনে কুন্তলার অবস্থান কি এরই বহিঃপ্রকাশ নয়? 


স্তরে স্তরে আচ্ছাদিত একটি টিলা যেন ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ কালের বহমানতায়। মিশে যাচ্ছে এক সময়কাল অপরের সাথে। মিশে যাচ্ছে অহং, অস্তিত্ব। এক চরিত্র রূপ নিচ্ছে আর এক চরিত্রের সাথে। এ যেন দুটি নদীর মিলনপথ। সমস্ত আবহটিকে লেখক সাজিয়েছেন বাংলার প্রকৃতির অসাধারণ বর্ণনায়। এ কালের ভাষা মিশে গেছে পলিমাটির মতো নদীর গর্ভজলে। নিঃসন্দেহে উপন্যাসটি একটি সার্থক সাধনার ফল। পাঠক হৃদয় ছুঁয়ে যার বিস্তার আদি অনন্তকাল।



সন্মাত্রানন্দ