Showing posts with label ছোটগল্প. Show all posts
Showing posts with label ছোটগল্প. Show all posts

Wednesday 1 July 2020

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প 'শরণাগত' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০


শরণাগত

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

কাঁদতে-কাঁদতে পথের ধূলোয় লুটিয়ে পড়েছে সারণ্যা ।

ধম্মপাদের আজ অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । সারণ্যার পিতামাতা তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে আর ফেরেনি । না ফেরার কারণ সকলের অজানা । প্রত্যেকে অনুমান করে নিয়েছে তারা দুজনেই জীবিত নেই । সারণ্যাকে ধম্মপাদের মাতার কাছে রেখে তীর্থে গিয়েছিল সারণ্যার পিতামাতা । তাই ছেলেবেলা থেকে তার আর সারণ্যার একসঙ্গে বেড়ে ওঠা । কত খুনসুটি । কঠিন অসুখে একদিন ধম্মপাদের মাতা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল । তখন ধম্মপাদের বয়স নয় ও সারণ্যার সাত ।

সারণ্যার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে ধম্মপাদ তার বেণী ধরবার চেষ্টা করলেই তারস্বরে কান্না জুড়ে দিত । আর তার পিতা পুঁথিতেই চোখ নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর স্বরে বলে উঠতেন, ‘সুবোধ ছেলেদের এহেন কর্ম্ম শোভা পায় না ধম্মপাদ ।’ কথাটা শুনেই ধম্মপাদ সংকুচিত হয়ে পড়ত । আর সেই সুযোগে সারণ্যা একছুটে কিছুটা দূরে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ তুলে বনানীর আড়ালে লুকিয়ে পড়ত । আর রাগে ধম্মপাদ শূন্যে আপন দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছুঁড়ে দিত ।

আবার সারণ্যা যখন নিজে না খেয়ে পাথরের খোরায় তার জন্য অন্ন সাজিয়ে অপেক্ষা করত, তখন ধম্মপাদের মন সারণ্যার সব দুষ্টুমিকে ক্ষমা করে দিত । পুঁথি অধ্যয়ন করতে-করতে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সারণ্যা তার পুঁথি সযত্নে কুঠুরীতে তুলে রেখে তার মাথায় উপাধান দিয়ে দিত । সারণ্যার করুণাময়ী রূপ ধম্মপাদকে তার মাতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতো ।

   আজ ধম্মপাদের অনেক পুরনো কথা স্মরণে আসছে । নাহ্‌, সে আজ অশ্রুপাত করে অন্তর ভারি করবে না । আজ আসক্তি, মায়া, স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার স্পৃহাকে সে পরাস্ত করতে পেরেছে । পিতার আর্তি, সারণ্যার কোমল বাহুডোর উপেক্ষা করেছে । মস্তকের উপর নিশ্চিত ছাদ, সম্মুখে সজ্জিত অন্নের মায়া ত্যাগ করে সে আজ পথে বেরিয়েছে । সে আর সংসারজীবনের ক্ষুদ্র মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারবে না ।

সারিপুত্র স্বহস্তে তাকে পাঠদান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একসময়ে সংসারের আসক্তিতে আচ্ছন্ন ধম্মপাদের আজ সংসারকে বিষবৎ লাগে । সে আজ প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে অনন্ত মুক্তির আলো সেই সুকোমল পাদপদ্মে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে । কর্ণে দিবানিশি ভেসে আসে ...

“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

ধম্মং শরণং গচ্ছামি

সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ।।”

Saturday 14 October 2017

প্রাইভেট টক/ সম্পূর্ণা


বহুক্ষণ চেয়ে বসে আছি। এ কমাস কয়েকশো বার ওপর নীচ করেছি, বাহাত্তরটা সিঁড়ি,ঝকঝকে মুখস্থ। জুতোর তলায় লাগা ধৈর্য্যটা কয়েকবার ছিঁড়ে গেছিল পেরেক লাগিয়ে মেরামত করে নিয়েছি। খুব দৌড়াদৌড়ি করছি, যেখানেই যাচ্ছি পাশের টেবিল দেখিয়ে দিচ্ছে, বা পাঠিয়ে দিচ্ছে ওপর তলায়! আমার মতো আম আদমির জন্য লিফট নয়! অগত্যা...! চৌত্রিশের দাদা থেকে ছসাত বছরের দিদি, আন্দোলন, পরিবর্তন সব একই! দেয়ালের রঙ গুলোয় শুধু বদলের নতুন গন্ধ শুঁকে নেয়া।
বাবার পেনশন নিয়ে ছোটাছুটি। বড়দা আছে বেশ! গর্ভমেন্ট অফিসার, সত্যি অর্থে সোনার টুকরো ছেলে । প্রতি বছর পে-কমিশন আর বোনাসে বদলে যাচ্ছে ওর রোগা গিলগিলে চেহারাটা! তবু অসম্ভব সংযমী পকেট, নেই নেই লেগেই আছে। আর বাড়িতে বেকার ভাই থাকলে তো "আপনার আজকের দিনটি"তে সবসময়ই থাকবে খোঁচা, চিমটি আর হাহুতাশ! এইবার লোকটা তাকিয়েছে! আজ তিনমাস আসছি, এতোদিন পড়তে পারিনি চশমার পেছনে আড়াল করা ইচ্ছেটা। চকচক করছে চোখ,বোধহয় বলতে চাইছে, প্রাইভেট টক আছে!
কাজ শেষ, ফিরছি! ঝিমলিকে একটা ফোন করতে ইচ্ছে করছে। সেই ঝিমলি, যাকে দেখার জন্য রোজ দুপুরে ঠা ঠা রোদে ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেছি, বৃষ্টিতে ভিজে চুবচুবে হয়ে ওর কোচিংয়ের পাশের গলিতে অপেক্ষা করেছি! ওর একবার চাউনিতে লুকোনো ইচ্ছে গুলো রোজ একটু করে সেঁকে নিয়েছি! ওই কালভার্টটার সোঁদা সন্ধ্যে গুলোয় ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে বারবার বলেছি,'আমি শুধু তোমারই সোনা!' কতোবার বাবার মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে ওকে সিনেমা দেখিয়েছি! না, সততার বাতিক ছিল না কোনোদিনই! প্রেমিককে সৎ হলে চলে না, প্রেমিক মানেই ব্র্যান্ডেড মিথ্যেবাদী, অসৎ; সব চলে। ওটায় নরক দর্শন হয় না, শ্রীকৃষ্ণ থেকে জন লিলি একই কথা বলে গেছেন।
সবাই বলত পড়াশোনায় মাথাটা আমার বেশ ভালোই! ঝিমলিও হয়তো তাই ভেবেছিল! কিন্তু বরাবরই আমার গড়পরতা কিছুই ভালোলাগে না। দাদা খুব হিসেব করে চলত। কলেজে থাকতেই ছাত্র-রাজনীতি, ভোট, মিছিল, মিটিং, সাথে রঙবেরঙের স্বপ্ন বুনে দেয়া তরুণ পলিটিসিয়ান! তারপরে আখের গুছিয়ে কাট্টুস! আমার ওসব আসে না! তাই ঝিমলিকেও বোধহয় ঠিকঠাক স্বপ্ন দেখাতে পারিনি। বেকার বাউন্ডুলে প্রেমিকের থেকে, গান্ধীর হাসি ভরা নোট গোনা অফিসার অনেক দামি। প্রেমও হরেদরে সেই ডারউইনের থিওরি, "সার্ভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট "।এখন তাই ইংলিশ ফন্টে বাংলা ভালোবাসা ভরা মেসেজ গেছে কমে। হাড়হাভাতে ফোনটা তবু অপেক্ষায় থাকে। তবু আজো বুকপকেট ভরতি ঘামে ভেজা প্রাইভেট টক!
ভীষণ ঘুম পাচ্ছে! আজ ফিরেছি দেরিতে। খাবার গুছোনো ছিল টেবিলে, খেয়ে নিয়েছি। একবছর আগে পর্যন্ত মা বসে থাকত। তখনো পর্যন্ত বাড়ির কিছু নির্বিরোধ সমস্যা জানাত। হয়তো আশা ছিল কোথাও আমিও কালেকালে দাদা হয়ে উঠব। মশা ধূপ জ্বলছে, অভ্যস্ত মশা গুলো তাও বার করে নেবে জীবনের নির্যাসটা! কড়া ধোঁয়ায় দেখছি কিছু মুখ, ঝাপসা । ওরা কারা? মা বাবা দাদা ঝিমলির মতো লাগছে! দেখতে আলাদা, কিন্তু সেই চেনা গন্ধ একেক জনের! আমার হাতে অনেক গুলো মুখোশ! ছড়িয়ে পড়ে আছে মায়ের তেলচিটে আঁচলটা, বাবার পেন, দাদার গিটার , ওই তো ঝিমলির সেই বুকের কাছের লাল তিলটা! রোজ সূর্যাস্ত দেখতাম, ওটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! সেই পুরনো মিলটা,তেলকলটা ! বিকেলে পাড়ার মোড়ের ক্যারামবোর্ড! চারিদিক নিশ্চুপ! কথাগুলো, শব্দগুলো ফুরিয়ে গেছে! মাথার করিডোর অন্ধকার, মোমবাতিগুলো মিছিলে যাচ্ছে হেঁটে! বুকের কষ্টটা নিঃশ্বাসে চেপে বসছে। উফফ! স্বপ্নটাও বলছে, সব প্রাইভেট টক শেষ, শেষ, শেষ.....!