অভয়ের আপদ
অশীতিপর অভয়ের অনিদ্রাব্যাধি। বাতের ব্যথা বাতাস দিয়েছে তাতে। অনেক লড়াইয়ের পর সেই মাঝরাতে ঘুম আসে। নিদ্রা পুষ্ট হয় ভোরে। তাই বেশ বেলাতেই সকাল হয় অভয়ের। এইভাবেই দিন যাচ্ছিল চলে। ছন্দপতন হঠাৎ। কারণ জার্সি গরু।
অভয়ের ঠিক পাশের বাড়ির লোক নাড়ু ঘোষ। দুগ্ধ ব্যবসায়ী।
কারবারে জোয়ার আনতে নাড়ু খাটাল-রতনের কাছ থেকে জার্সি গরু কেনে,এবং খাল কেটে কুমির আনে।
নতুন পরিবেশে গাভীটি তখনও মানিয়ে নিতে পারেনি, শিং নেড়ে দেয় হুংকার। কাছে ঘেঁষে সাধ্য কার!
একদিন গো-দোহনের জন্য নাড়ু জার্সি গরুটির কাছে যায় এবং চাঁট খায়। ক্ষুরাঘাতে ক্ষত গভীর, প্রাণ যায় যায়। চিন্তিত নাড়ুর মা স্মরণ করে কুলগুরু অঘোর চন্দ্রকে। সশিষ্য গুরুদেব হাজির নাড়ুর বাড়িতে। বলে, নাড়ুর কালসর্প দোষ। তাই ভীষন বিপদ। প্রতিকার চাই। এখনই।
অর্ধনিমীলিত চোখের পাতায় বাহ্যজ্ঞানটুকু ঝুলিয়ে কাতর কন্ঠে নাড়ুর মা জিজ্ঞাসা করে, উপায় কিছু নেই বাবা? অঘোরচন্দ্র বলে, উপায় আছে মা। হরিনামে পাথর যায় গলে। তাই একমাস হরিনাম নিলে মুখে, নাড়ু থাকবে সুখে। সংকীর্তন শুনে গাভীটিও শান্ত হবে। দুশ্চিন্তা যাবে ঘুচে।
ব্যবস্থা হল তেমন। রোজ অষ্ট প্রহর হরিনাম-বর্ষন। টানা একমাস। অভয়ের নাভিশ্বাস।
ভোর বেলায় গভীর ঘুমে অভয়। দখিনা বাতাসে অঘোর চন্দ্রের হরিনাম ভেসে অভয়ের কর্ণকুহরে প্রবেশে, মরমে আঘাত হানে। ব্যস। ভোরের নিদ্রা চৌপাট। মেজাজ টং।
এমনিতেই হরিনামে এলার্জি। সেজন্য নাড়ু ঘোষের পূর্বপুরুষই দায়ী। সারা জীবন অভয় সয়েছে যন্ত্রণা কারণ উঠতে বসতে ঘোষেদের ' হরিস্মরণ ' । অভয় দিয়েছে গালি, বলেছে আপদ মরণ। ইদানিং বন্ধ ছিল সব। তাই ভোরের ঘুমে ছিল শান্তি। টিকল না আর। এসেছে গুরু অঘোর। ঘোষ বাড়ি যেন বৈকুণ্ঠধাম। অভয়ের অশান্তি। টানা একমাস।
এখন ফাঁড়া - মুক্ত নাড়ু। হরিনাম শ্রবণে জার্সি গরু মেনেছে বশ। বালতি উপচে দুধ। ফিরে গেছে গুরু। খুশি অভয়। আবার ঘুম জমাট। চনমনে শরীর।
আজ বিধি বাম। ভোর বেলায় ঘুম চটকে শেষ। ছি, হায় রাম!
ভোরে নিদ্রামগ্ন ছিল অভয়। হরিনামের হ্যাঁচকা টানে ঘুম ঘেঁটে ঘ। প্রথমে ভেবেছিল আতঙ্কের স্বপন। পরে দেখে না, সত্যি। সেই সুর যন্ত্রণা। অভয় হাঁটা দেয় নাড়ুর বাড়ি। অবাক কাণ্ড সেখানে। গোয়ালে ব্যস্ত নাড়ু। অভয় দাঁড়িয়ে উঠানে।
--- কী হল কাকা, এত সকালে?
--- আবার কেন নাড়ু? অনিদ্রায় মরবো যে অকালে!
--- আসলে...। শুরু করে নাড়ু।
খাটালের গরু। গান শুনিয়ে গো-দোহন নিয়ম। অভ্যাস তেমনই। রতন নাড়ুকে বলেছিল আগেই। আমল দেয়নি নাড়ু। এই একমাস মধুর হরিনাম শুনে শান্ত ছিল গাভীটি। নাড়ুর অজান্তেই। অঘোরচন্দ্র ফিরে যেতেই বন্ধ হরিনাম।স্বমহিমায় গরু। আবার শিং নাড়ে। নাড়ুর ভয়। তাই খাটাল-রতনের ডাক পড়ে। সব শুনে বুদ্ধি দেয় রতন। সেইমত রেকর্ড করে নিয়ে এসেছে নাড়ু গুরুদেবের কণ্ঠে হরিনাম সংকীর্তন। বাজানোর ব্যবস্থাও করেছে জব্বর। আবার শান্ত হয়েছে গরু। বালতি উপচে দুধ। তাই নাড়ুর সংসারে ফিরেছে সুখ।
সব কিছু দেখে বিমর্ষ অভয়। চোখে মুখে আতঙ্ক। মনে সেই পুরাতন অনিদ্রার ভয়।