Showing posts with label ২০২২. Show all posts
Showing posts with label ২০২২. Show all posts

Thursday 19 May 2022

ঋণ/ দেবজ্যোতি দাশগুপ্ত

 



জন্মের পর জেনেছি,

এক পৃথিবী ভাব বন্ধক রয়েছে আমার।

অক্ষর থেকে শব্দ , শব্দ থেকে বাক্য হয়ে জমেছে তার সুদ।

চক্রবৃদ্ধি হারে সময় জুড়েছে তাতে।

একটু একটু করে বুঝেছি সবাই যে যার নিজের ঋণে জর্জরিত।

শিক্ষা ও শোধের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে কেউ।

কেউ সাহায্যের নামে ঝড়িয়েছে রক্ত।

তাই হাল ছাড়বো না !

একদিন ঠিক সব ঋণ শোধ করে দেবো বাংলা ভাষা দিয়ে।

Thursday 20 January 2022

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকারঃ প্রভাত চৌধুরী

 



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকারঃ প্রভাত চৌধুরী  

প্রশ্নোত্তর পর্ব

আমিঃ আপনারছেলেবেলা/বাল্যকাল/শৈশব সম্পর্কে আপনি যা যা ইতিপূর্বে লিখেছেন,তার বাইরে এমন কিছু বলুন, যা আমরা জানি না।

তিনিঃ সমস্যায় ফেলে দিলে।এমনটা তো কথা ছিল না।তবে কথার পিঠে কথা গেঁথে যাওয়াটাই তো আমার কাজ। তবে পুরনো সেই দিনের কথা শুনতে তোমাদের ভালো লাগবে।
(আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম,তিনি বলতে লাগলেন)
 আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমার একটা নিজস্ব ঘুলঘুলি ছিল,ছেলেবেলায়, এতে কখনো কোন চড়ুই এসে বসেনি,বাসাও বাঁধেনি।ঘুলঘুলিটি ছিল ঘোরানো সিঁড়ির এক স্থানে। আমি ওই ঘুলঘুলিতে সঞ্চয় করতেম আমার যাবতীয় সম্পদকে।আমার বেশ মনে পড়ছে ওই ঘুলঘুলির ভেতর আমি রেখেছিলেম ময়ূরের পালক,রঙিন মারবেল,ঝাড়লণ্ঠনের একটা তেকোনা কাচ,এমনকি একটা কাগজের নৌকোও। কাগজের নৌকোটি সেজোদাদা বানিয়েছিলেন,সেটাও বেশ মনে আছে। ‘কুমকুম’এর একটা শিশি,খুবই ছোট,তাও রেখেছিলেম ওই ঘুলঘুলিতে। রাখার সময় মনে হত এগুলি খুবই দুর্লভ বস্তু,মহামূল্যবান।এগুলিকে গোপনভেবে না রাখতে পারলে খুবই ক্ষতি হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
কিন্তু বড়ো হয়ে যাবার পর কোনদিনই খোঁজ করিনি ওই মহার্ঘ্য জিনিষগুলির। এমনকি ঘুলঘুলিটিও হারিয়ে গিয়েছিল স্মৃতির অর্গল থেকে।তুমি না লেখা তথ্য চাইলে বলেই বললেম।

আমিঃ আচ্ছা,যদি হারিয়ে না যেত তাহলে ওগুলিও আপনার লেখার বিষয় হতে পারত।

তিনিঃ হয়তো,হত। আবার না হবারও সম্ভাবনা ছিল।

আমিঃ আজ ২০১৭র ২৯শে মার্চ,দুপুর ১২টা ৪৮এ যদি আপনাকে অনুরোধ করি – আপনার ছেলেবেলার সেই হারিয়ে যাওয়া ময়ূরের পালকটি নিয়ে কিছু বলার জন্য

তিনিঃ বেশ বিপদে ফেললে দেখছি।তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ঠিক করিনি। বুঝতে পারছি। শোন তাহলে-
ময়ূরপাখির পালকে একাধিক চোখ আছে,প্রতিটি চোখ
স্বাধীন ভাবে আলাদা আলাদা দৃশ্য এবং শব্দকে দেখতে সমর্থ হয়,যেমন প্রথম চোখটি দ্যাখে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল।
দ্বিতীয় চোখটি শোনে শান্তিনিকেতনের কাচমন্দিরের নিকটবর্তী গাছগাছালির ওপর জ্যোৎস্না পতনের শব্দ।
তৃতীয় চোখ নিস্পন্দ থাকে শিলাইদহের বোটের একটি আরামকেদারায়।
চতুর্থ চোখ একটি রক্তকরবীকে ফুটতে দ্যাখে।
পঞ্চম চোখটি কিছুই দ্যাখে না,অন্য চোখগুলির গতিবিধি লক্ষ্য রাখে।

আমিঃ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।কথা দিচ্ছি,আর কখন আপনাকে এই বিপদে ফেলব না। আপনি বরং আপনার একটি গানের কথা বলুন,গানের উৎসের কথা বলুন। যা আমরা জানি না।

তিনিঃ ২৬শে চৈত্র ১৩১৬,আমি তখন বোলপুরে,তখন শান্তিনিকেতনের এত রমরমা ছিল না। সেকারণেই বোলপুর বললেম। একটি গান লিখেছিলেম, যার প্রথম লাইনটি ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’।
তুমি গানটি শুনতে পাচ্ছ তো? তুমি শুনতে থাকো,আর আমি ফিরে যাই ১৩১৬র চৈত্র মাসের সেই নির্দিষ্ট তারিখে। সকালটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।কিছুটা হেঁটে আসার বাসনা হল ।রোদের তাপ ততটা তীব্র নয়। তখনই কালবোশেখি হয়ে গেছে।সঙ্গে ২/১০ ফোঁটা বৃষ্টিও।
খুব কাছ থেকে একটা কোকিল ডাকছিল।এই ডাক কি তার সঙ্গিনীকে কাছে আসার ডাক! তা তো বলতে পারছিনে ,তবে এটুকু বলতে পারি- কোকিলরা আমাদের জন্য ডাকে না, অর্থাৎ আমাদের ডাক শোনাবার জন্য ডাকে না। কোকিলের ডাক তার স্বজনের উদ্দেশ্যে ডাক।আমাদের শ্রবণ-ইন্দ্রিয় আছে বলেই আমরা সে ডাক শুনতে পাই। ডাকের অর্থ বুঝি কি!
কোকিলের ডাকের উত্তরে কিছুক্ষণের মধ্যেই আর একটা কোকিল ডেকে উঠল,পূর্বপল্লির দিক থেকে। বোঝা গেল কোকিলের ডাকটি কার্যকরী হল।

তিনিঃ তোমরা তো জানো শিলাইদহে আমার একটি কুঠি-বাড়ি ছিল।ওকে আবার কাছারিবাড়িও বলতে পারো।আর ছিল সেই বোটটি ,যে গেটে আমার যাতায়াত এবং লেখার ঘর বা দ্যাখার ঘরও বলতে পারো।
তুমি নিশ্চয় জানো, একটি জায়গা থেকে সব কিছু দ্যাখা যায় না। সূর্যোদয় দ্যাখার জন্য যদি হিমালয়কে বেছে নাও, তবে সূর্যাস্ত দ্যাখার জন্য যেতে হবে সমুদ্রে। আর নিজেকে দ্যাখার জন্য চাই গোঁসাঘর। ‘গোঁসাঘর’ শব্দটি পছন্দ না হলে একে ‘নিজ নিকেতন’ নামেও ডাকতে পা্রো। নামে কিছু এসে যায় না, লক্ষ্যে স্থির থাকাটাই হল মূলমন্ত্র ।
শিলাইদহের বোট থেকে নিস্তরঙ্গ নদীর ওপরে যে ফুটফুটে জ্যোৎস্না দেখেছি,তার জুড়ি মেলা ভার। ওই নদীর ধারে একবার পশ্চিমদিকে সোনার সূর্যাস্ত আর একবার পূর্বদিকে রূপোর চন্দ্রদয় দ্যাখার কথা তো তোমরা জানো। কিন্তু যা তোমরা জানো না, আমি কখনো জানাইনি বলেই। আজ তোমার কাছে যে গোপন প্রকাশ করব,তার কোন সাক্ষী নেই। স্বার্থও নেই।
আমি ত আগেই একটি চিঠিতে লিখেছিলেম- মেয়েতে ও জলেতে বেশ মিশে যায়।এই উপলব্ধিতে পৌঁছোবার  অলক্ষ্যে একটি ঘটনা আছে। সে এক ভরা জ্যোৎস্নার রাত।ঘুম আসছে না।বাইরে এলেম।এসেই মনে হল এমন রাত তো আমার আগে দ্যাখা হয়নি।  চরের ওপর একটা টিটি পাখি ডাকছে।এত রাতে টিটি কেন ডাকে?একা একা।নৌকো স্থির।ভালো করে লক্ষ করে দেখলেম, টিটি একা নয়, এক সাধারণ মেয়ে চর থেকে জলের দিকে,বোটের দিকে হেঁটে আসছে। মেয়েটি কি কোন বিপদে পড়েছে! সে কি সাহায্যের আশায় এদিকপানে আসছে!কিন্তু আমি তো নিরুপায়। আমি কীভাবে তার দিকে বাড়িয়ে দেব আমার সাহায্যের হাত! মেয়েটি বোটে পৌঁছোবার জন্য জলে নেমে পড়ল।হাত নেড়ে আমাকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করল।আমি ওর হাতের ভাষা বুঝতে পারলেম নে।বোটের কিনারার দিকে এগিয়ে গেলেম।মেয়েটিকে বোটে উঠতে সহায়তা দেবার বাসনায়।
হঠাত কুব করে একটা শব্দ হল।মেয়েটিকে আর দ্যাখা গেল না। জলের ভেতর বুড়বুড়ি কাটতে দেখলেম যেন।সে কি তলিয়ে গেল জলে! বাতি নিয়ে এসে দেখলেম।জলে কোন তরঙ্গ নেই। এত রাতে কাকে ডাকব।কী হবে? মেয়েটির ডুবে যাবার কোন চিহ্ন নেই। জ্যোৎস্না থইথই নদীজল। দক্ষিণ দিক থেকে আসা একটা বাতাস কেমন যেন হু হু করে উঠল।সাহায্যপ্রার্থী মেয়েটির কথা পরদিনও কাউকে বলতে পারিনি। বললে ওরা সবাই অভিযোগ করত সে সময় ওদের ডাকিনি কেন।একটা চরম পাপবোধ আমাকে নিথর করে রেখেছিল।
এখন মনে হচ্ছে তুমি বলতে পারো,আমি মেয়েটিকে একা পেতে চেয়েছিলেম।এজন্য লোক জানাজানি করিনি। চরাচরের যাবতীয় ঘটনা মিথ্যে হতে পারে কিন্তু ওই মেয়েটির জলের অতলে তলিয়ে যাওয়াটা মিথ্যে নয়।
তবে পরের দুচারদিনের মধ্যে কোন মেয়ের নিরুদ্দেশ হবার কথাও কানে আসেনি। না কাছারিঘরে, না বোটে।
এর কী ব্যাখ্যা দিতে পারো তুমি!

এসেছিলাম প্রশ্ন নিয়ে।এখন তাঁর প্রশ্নের কী উত্তর দেব আমি। এর কোন সর্বজনগ্রাহ্য উত্তরও আমার কাছে নেই।
তাকিয়ে দেখি তিনিও নেই। জ্যোৎস্নায় মিশে যাবার কোন শব্দ হয় না। এ এক নির্জন নিরপেক্ষ মিশে যাওয়া। মনে মনে উচ্চারণ করি-
তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি