একটি রূপকথার কাহিনী
তারপর হলো কি, খৃষ্টজন্মের দেড় থেকে দুই হাজার বছর আগে, এক শ্রাবণ
মাসের ঝড়জলের রাতে একটি খোকা হলো। রাজার ঘরের ছেলে। সে ছেলের ভবিতব্য ছিলো
মরেই যাওয়া। কিন্তু কপালে মৃত্যু না থাকলে কার সাধ্য তাকে মারে? ওই ছেলেকে
বাঁচানোর জন্য গোপনে প্ল্যান ছকা হয়ে গেছিল। বেশ কিছু রাজ কর্মচারী এক
নিশ্ছিদ্র শলা করে শিশু অদলবদল করে ফেললো জন্মের ঠিক কয়েক ঘন্টার মধ্যেই।
কাকপক্ষীতেও টের পেলো না। বদলিতে যে শিশুটি এলো, সে ফরসা, চোখা চোখা
নাকমুখের সুন্দর দেখতে একটা কন্যা। যাতে লোকের সন্দেহ না হয়। যাতে রাজার
মেয়ে বলে সহজেই বিশ্বাস হয়ে যায়। আর ছেলেটি হাওয়া হয়ে গেলো রাতারাতি। বড়
হলো নিশ্ছিদ্র এক সুরক্ষিত ঘেরাটোপে। এমনটা আমাদের অনেক হয়। রাজাগজাদের
জন্য বলি যায় বহু গরীব।
এবার ধীরেধীরে বড় হচ্ছে সে ছেলেটি। একটি শ্যামবর্ণ ছেলে, যে
তার রূপ গুণ আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মোহিত করে রেখেছে চারপাশ। একটা গোটা
যুগকে দুই কাঁধে বহন করেছে এসেছে। আর আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি তাকে।
একটা মানুষ গোটা জীবনে যে এত কিছু করতে পারে, এটা অসম্ভব ছিলো আমাদের চোখে।
তার জীবনরহস্য বিশ্বাসযোগ্য হয়নি আমাদের । আর তাই লোকে বার বার তাকে
দেবতা ভেবেছে।
যে দেশে,যে সমাজে প্রেমের ওপর চোখ রাঙানি এসেছে , যে দেশে এখনো খাপ
পঞ্চায়েত আছে, সেই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সে ছেলে কি করে এমন করল? বয়সে বড়ো
অগম্যা এক নারীর প্রতি এমন খুল্লমখুল্লা প্রেম? একি মানুষের সাধ্য?
নির্ঘাত এ কোনো দেবতা।
এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে এ ছেলেটির নাম পরিচয়। হ্যাঁ, আমি কৃষ্ণ, বাসুদেবের কথাই বলেছি।
তাঁর ওপর বার বার দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায়
পরেছিলেন দেবত্বের মুকুট। নিজে হাতে তিনি কুরুক্ষেত্রের ঘুঁটি সাজিয়েছেন,
গোটা আর্যাবর্তের রাজনীতির নিয়ন্ত্রন করেছেন একা হাতে, আর তারপর এক দু
পয়সার ব্যাধের তীর খেয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে মরে পড়ে থেকেছেন। কি অদ্ভূত এই
বৈপরীত্য! দেবতা হলে কেউ এমনভাবে মরে? অন্তত কিছুটা রহস্য করে তো মরতে
পারতেন! গ্যাংগ্রিন কিন্তু এখনো ঘাতক রোগ। সুতরাং দু হাজার বছর আগে এ রোগ
হলে মৃত্যু হবে,সেটাই স্বাভাবিক।
তাঁর কাজের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা আছে, কিন্ত দেবত্ব নেই কোত্থাও।
কিন্তু ভক্তিবাদী মন তা মানে না। এতো ক্ষমতা নিয়েই যদি কেউ জন্মাবে,তাহলে
অন্তত মানুষ নয়, দেবতা হয়েই জন্মাক ! তাতে অন্তত মন কে চোখ ঠারা যায়!
কৃষ্ণ তাঁর যৌবনের প্রথম দিন থেকে শুধু নিয়ম ভেঙে গেছেন একের পর এক। তা এমন
নিয়ম ভাঙা লোক কি ইতিহাসে আসেনি?নাকি তাঁদের এমন তুখোড় বুদ্ধি ছিলো না? তা
তাঁরা যদি দেবতা না হন,খামোকা কৃষ্ণই বা দেবতা হতে যাবেন কেন? পর্দা সরিয়ে
ওই ঝকঝকে আকর্ষনীয় পুরুষটিকে আর একবার খুঁজে দেখলে কেমন হয়?
গোপ জাতিরা পেশায় দুধ বিক্রেতা। এই তাদের রুটিরুজি। সহজ সরল
কিছু গ্রাম্য মানুষের মধ্যে বড় হচ্ছে দুটি ক্ষত্রিয় ছেলে। যুদ্ধ যাদের
জিনে। বছরের পর বছর তাদের পূর্বপুরুষেরা কতরকম অস্ত্রবিদ্যা চর্চা করেছে।
তীরচালনা, ভল্ল, গদা, তলোয়ার, রথচালনা এসব তাদের নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতন
কাজ। সেই বংশের ছেলেদের বাগে আনা কি সামান্য গোপদের পক্ষে সম্ভব? তাদের
চোখে তো এ ছেলে বিস্ময়ই !
আর যারা বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, তাদের শরীর ও মনের বৃদ্ধি খুব
তাড়াতাড়ি হয়। মানসিক ম্যাচিওরিটি আসে দ্রুত। এ কিশোরের রূপ তো ছিলোই, আর
সাথে যোগ হয়েছিল ক্ষুরধার উপস্থিত বুদ্ধি। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করার
মতো অদ্ভূত ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল সে। খুব ছোটবেলা থেকেই তার
প্রখর স্মৃতিশক্তি। দুরন্ত, বুদ্ধিমান, শক্তিমান কিন্তু স্বাভাবিক এক
বালক। গোপবালকরা আচার্যের কাছে যেত না, তাদের মধ্যে পড়াশোনার পাট নেই। তাই
কানাই আর বলাইয়েরও গুরুগৃহে যাওয়া হয়নি। এমন কিচ্ছুটি করা যায় নি যা
সাধারণের নজরে আসে। তবে গোপনে প্রশিক্ষণ কিন্তু শুরু হয়ে গেছিল। দামিল্য,
অক্রুর ওই বালকদের গোপনে তৈরি করছিলেন মল্ল বিদ্যায় আর ধনুর্বিদ্যায়।
শুধুমাত্র দ্রুত পরিস্থিতি বোঝা, আর আত্মরক্ষার এক সহজাত প্রবৃত্তি
তাঁকে আলাদা করেছে অন্য সকলের থেকে। যুদ্ধকালে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে
তিনি অন্যদের চোখে ধুলো দিয়েছেন বার বার। লোকের মনে হয়েছে এ ম্যাজিক। এ
দৈবী শক্তি । কৃষ্ণর আর এক নাম গিরিগোবর্ধনধারী। তিনি গোবর্ধন পাহাড় নাকি
কড়ে আঙুলে তুলেছেন। গল্পের গরুকে খুঁটিতে বেঁধে খুঁজলে দেখা যাবে সে সত্যিই
হিরো।
কৃষ্ণ প্রথমবার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এই পাহাড় কে
নিয়েই। গোকুলের নিয়ম ছিলো, প্রতিটি বর্ষায় ইন্দ্রের পুজো করতে হবে।
ইন্দ্রদেব বৃষ্টির দেবতা। সাথে তার বজ্র-বিদ্যুৎ সহ হাবিজাবি আরো কিছু
সঙ্গীসাথী আছে। কথা না শুনলে ধনেপ্রাণে শেষ করে দেবেন তাঁরা। সোজা কথায়
তোলা দিতে হবে তাদের। ঠিক সময়ে এসে হপ্তা নিয়ে যাবে। নেহি তো গব্বর আ
যায়েগা। বড় ধরণের গুন্ডা অথবা দেবতা, যাই বলুন না কেন তারা আসলে তাইই।
গোপবাসীদের সংসার চলে গোরুর দুধ আর দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রয় করে। বৃষ্টির
ওপর কারুর হাত নেই। তা সে যত বড় নেতাই হোক না কেন! কিন্ত যদি যমুনা নদীর
বাঁধ তুলে নেওয়া হয়? যদি গতিপথ কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রিত করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়
নদীর পাড়ের গোচারণভূমি?বহতী নদী যদি হঠাৎ করে বিপুলা হয়ে যায়?ভেসে যায়
ক্ষেত, বা গোচারণক্ষেত্র? তাহলে?বোকাসোকা গ্রাম্য গোয়ালাদের ভয় পাওয়াতে এই
তো যথেষ্ট ! হয়তো তেমনই কিছু হয়েছিল। এই কঠিন সময়েও কিন্তু শক্ত হাতে
পরিস্থিতি সামলেছিল ওই কিশোর বালক। সমস্ত ব্রজবাসী আর গাভীদের আশ্রয়ের
ব্যবস্থা করেছিল ওই গোবর্ধন পাহাড়ের গুহায় বা কোটরে। আঙুলে করে কেউ কখনো
পাহাড় তুলতে পারে না। সেটা অসম্ভব। কিন্তু, ওই বিশাল জনগণকে বাঁচিয়ে
ছিল,এটা তো সত্যি! ওই কিশোর মাথা নোয়ায়নি সেদিন ইন্দ্র নামক গুন্ডার কাছে!
এরপরেও সে দেবতা হবে না?
সেই প্রথম সে আঘাত আনে প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। যা বছরের পর বছর
ধরে চলে আসছে,তাই ঠিক নয়। নিজের বুদ্ধি ও পুরুষাকার যদি থাকে,তাহলে
পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রনে। অন্ধ, বোকা, ভীরু, অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের সে
আগলেছে বুক দিয়ে। আর এটাই তো ক্ষত্রিয়ের কাজ !
কালিয় নাগ বিষাক্ত করে দিয়েছিল কালিয়াদহের জল। সেই জল খেয়ে
গরুরা মারা যাচ্ছে, মাছ মারা যাচ্ছে। সে দহের আশেপাশে কেউ যেতেই পারছে না।
ওটা ছিলো কালিয়র নিজস্ব প্রপার্টি। কিন্তু সাপের বিষে কোনোকালে জলাশয়ের জল
বিষাক্ত হতে পারে কখনো ? সে তো অসম্ভব! সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী এই কাহিনী।
তবে জলে বিষ মেশানো আর কি এমন কঠিন কথা! এ তো হামেশাই হয়। আর জলের মধ্যে
লড়াই করে সাপকে হারিয়ে, সেই সাপের মাথায় উঠে ধেইধেই করে নাচা ?ওসব যে
গপ্পকথা, সে তো শিশুরাও বুঝবে। তবে মানুষের থেকে ক্ষতিকারক বা বিষধর সাপ কি
জন্মেছে এদ্দিনেও? কালিয় মানুষ হলেই বা ক্ষতি কি? বুদ্ধিমান কৃষ্ণ কি তাকে
পরাস্ত করতে পারে না?
এইভাবে একের পর এক শত্রু আক্রমণ থেকে গ্রামের লোকদের বাঁচিয়েছে এ
কিশোর। এর পরও যদি দেবতা না হয়,তবে কাকে বলবো আমরা দেবতা? যে রক্ষা করে,
সেই তো দেবত্ব পাওয়ার অধিকারী ! আর এমন পুরুষের জন্য নারীকুল পাগল হবে,
সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘ নারীপ্রেমেও অবসাদ আসে বীরের। ক্লান্তিকর
লাগে ওই অর্থহীন বাক্যালাপ। প্রেম তার জন্য নয়। গোটা পৃথিবী তার
অপেক্ষায়।
এ
ব্যক্তির সাথে তুলনা করতে গেলে আমার শুধু একটা লোককেই মনে পড়ে। রাসবিহারী
বোস। ভারতের যুগসন্ধিক্ষনের এক অবতার পুরুষ। ঠিক অতখানিই মেধা, রূপ, গুণ,
আর ক্ষমতা নিয়ে, আমাদের পরম পুণ্যবলে জন্মে গেছিলেন এই পোড়া দেশে। গোপনে
নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন এক বিশাল স্বাধীনতার যুদ্ধ। দেশ পেয়েছিল তার কাঙ্খিত
স্বাধীনতা। এর আগেপিছেও অনেক কাহিনী আছে বটে। লোকটির মেধা বটে! অবহেলার
ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোই পাস করে রেখেছিলেন কোন ফাঁকে। আমাদের কপাল
খারাপ, তাই সে দেবতাকে কাছে রাখতে পারিনি। ১৯১৫ সালে, পাকাপাকিভাবে জাপান
চলে যান তিনি । শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবি' তে যে ডাক্তারকে আমরা পাই সেও
কিন্ত এই রাসবিহারীই।
আমাদের পোড়া কপালে দেশ। বিদ্যেবুদ্ধি নেই, তাই অবতার চিনতে ভুল করি বার
বার। যেখানে সেখানে বাবাজিদের পায়ে ধুপ ধাপ করে মাথা ঠুকি। আর আসল অবতারেরা
রয়ে যায় অন্তরালে।
* * *