Wednesday 28 February 2024

নিলয় নন্দী

 



কান্ট্রি রোড





জানি না, ফিরছি কার কাছে?
কার জন্য এই ভর সন্ধেবেলা দু'হাত ছড়িয়ে
পেরিয়ে যাচ্ছি জেব্রা ক্রসিং

তাকে চিনি? চিনতাম?
সে-ও বুঝি নদী আঁকে! শহর ছাড়িয়ে বুড়ো বট
ভবঘুরে গিটারের গায়ে থেমে থাকা ট্রাম
খুচরো পয়সা হারানো বাজার সিসিটিভি চোখ
টুপি খুলে বসে আছি প্রিয়তমা ফ্লেক্স
কেউ এসে দিয়ে যায় গান্ধী রুপি, চেরিফুল
ভুলে যাওয়া বাসরুটে পড়ে থাকে অস্তমিত ছায়া
বিকেল ফিরবে কার কাছে?

যতসব দাড়িকমা, দু একটি বিস্ময়
আমি জানালা খুলে দেখি...
নদী পাখি নারী মিছিলের প্রথম পতাকা
ফার্মহাউসের মোড়ে বসন্তের প্রিল্যুড
না বলা কথোপকথন বা নেহাতই চ্যাটজিপিটি
এসবই অলঙ্কার। ফিরে যাওয়ার বাহানা মাত্র।

"টেক মি হোম, কান্ট্রি রোডস..."

Saturday 24 February 2024

অর্ঘ্য কমল পাত্র

 




সফলতা



প্রত্যেকদিন রাত্রে হাতের শিরা কেটে ফেলি। আর গলগল করে শরীরের রক্ত বেরিয়ে যেতে থাকে। ভাবি, এইবার আত্মহত্যা সফল হবে। কিন্তু পরের সকালে অবশ্যম্ভাবী ঘুম ভাঙেই। এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই, আমি বুঝতে পারি — মৃত্যু আসলে এক স্বপ্নহীন ঘুম। তাই প্রত্যেক সকালে, এই পুনর্জন্ম পেয়ে, আমার মনে হয়— জন্ম এক সহজলভ্য বস্তু। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী মৃত্যু? অগত্যা প্রত্যেকদিন রাত্রে হাতের শিরা কেটে ফেলি ব্লেড দিয়ে। ভাবি, এইবার, ঠিক এইবার…


Sunday 18 February 2024

শুভঙ্কর দাস

 





সাধারণস্য


ভারাক্রান্ত ঈশ্বর সামান্য কীটের চোখরাঙানিতে
বসতবাটি বিক্রি করে দু'কামরার ফ্ল্যাট পেয়েছেন।
একটা রুমে রেখেছেন মরিচাপড়া যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র। আর একটি রুমে দুটি জানালা, একটা দিয়ে ইশারায় রোজ সূর্য ওঠান আর ডোবান। 
অন্যটির পাশে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করেন।হাহাকার করেন।কাঁদেন।
তারপর জানালা বন্ধ করে দিয়ে 
শ্বেতপাথরের ওপর ধুলো-পাথর ছড়িয়ে শুয়ে পড়েন। 
চোখের জলে সেইসব ধুলো পাথর গ্রহ-নক্ষত্র হয়ে উঠলে কাপড়-মেলা ছাদে গিয়ে মহাশূন্যে সেসব সেঁটে আসেন।
বড্ড গোলমাল হয়ে যায় আজকাল!
বাজার করতে গিয়ে পয়সা নিতে ভুলে যান।
ফুল তুলতে গিয়ে কয়লার খনিতে গিয়ে পৌঁছান।
রাস্তায় চলতে গিয়ে জুতো ছিঁড়ে যায়,কাঁধের ব্যাগ হতে নিয়তির কাগজপত্র সব রাস্তায় পড়ে যায়!

এইভাবে হেঁটে হেঁটে ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন,ঘুমিয়ে পড়েন,তখন ভোররাত... 

শুধু অস্ত্রগুলো জেগে ওঠে,যেভাবে অগ্ন্যুৎপাত...

Friday 16 February 2024

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়

 



লেখারা যখন পাল্টে যায়



প্রতিটা পর্বের পর নতুন অধ্যায়ে 

অভিজ্ঞতা বদলে দেয় ভাষা।

এ কি স্বঘোষিত মৃত্যুঘোষণা? 


ছটফট করে ধূসরতা,

রোদে ভেজা নিরীহ দুপুর 

ছেঁড়া ঘুড়ি হয়ে গেঁথে আছে।

পর্দার ফুটোয় অপেক্ষা চোখ !


বন্ধ দরজায় টোকা পড়ল?

সাতজন্মের ডাক-

মার্চ শেষ হতে চায় না আর,

আশ্চর্য ফুল হয়ে ফোটে নির্বাক সন্ধেরা। 


ভালোবাসা মরে গেলে যুদ্ধ বাধবে যে…

তুমি আছো তাই কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে আছে পথ,

কত শান্তি চারদিকে,

কবিতা লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছে যেন কোনও কবি!


 

Thursday 15 February 2024

তিলোত্তমা বসু

 



হলুদ পাতা  


বয়স আমাকে এখানে এনেছে 
অস্ত যাচ্ছি ধীরে খুব ধীরে
পৃথিবীর গলা জড়িয়ে ধরেছি 
নরম আবেগে 

এই যে শুনছি ‘ভজ গোবিন্দম্ ’
সর্বগানন্দের কন্ঠে এবং ডুবে আছি খুব !
শ্লোক-পথ ধরে শঙ্কর বুঝি স্বয়ং প্রকট 
মনের গুহায় , হাতে বরাভয়

প্রেম তার রঙ বদলে দিয়েছে
থৈ থৈ করি দারুণ জোয়ারে 
কি যেন কী মায়া টেনে রাখে 
গাঢ় …

‘নির্বাসনা’ শব্দটিকে এত ভালো লাগে !

মেঘ উড়ে আসে 
ঝিঁঝিঁপোকা ডাকে …

Tuesday 13 February 2024

রূপক চট্টোপাধ্যায়

 

 

 
কালান্তরে 
 


কালান্তরে যাই। 
পিছনে পড়ে থাকে সংসারের ঝুঁকি নিয়ে মধ্যবিত্ত কঙ্কাল। যার নখের হাড়ে এখনও 
রোহিণী নক্ষত্র জ্বালানো নাকছাবি। বর্ণময়!

মাথায় বটের চারা চাগিয়ে তুলেছে প্রাগৈতিহাসিক। 
ফাটলে ফাটলে সরীসৃপ ফণায় বিষ জন্মায়,
হেসে ওঠেন নস্ট্রাদামুস!

দুই হাতের তালুতে ভ্রমের মেঘ,
শ্রেণিবিন্যাস ভুলে যাওয়া আঙুল 
আবার একত্রিত হতে চায়।
নাব্যতার বয়স কই?

জগন্ময়ী হোটেলের বেড়ে ওঠা ভাতেই
তিনটে পথশিশু ঐশ্বরিক। যুদ্ধের শঙ্খধ্বনির অপেক্ষায়। তারাও স্থির হয়ে আছে। কৃপানিধি! 

কালান্তর কোথায়?
এই জন্মদোষে ফেরি করি আত্মবিলাপ শুধুই



Sunday 11 February 2024

দেশিক হাজরার কবিতা

 



জ্ঞানেনং গচ্ছামি 


যদি না পায় সে তোমার দেখা যদি না পায় সে তোমার

স্পর্শ। সূর্য প্রণাম সরে বাগিয়ে কাছা দৌড়াতে থাকে 

এদিক ওদিক একা। চুপিসারে যাও, বসো তারই পাশে 

বলো— কী কথা সাজিয়েছ মনে? এরপরে, ইষৎ মুচকি 

হেসে, তাঁর‌ কাঁধে হাত রেখে অতি কিছুক্ষণ থেমে, বলো 

গিয়েছিলে অন্ধকারে, গন্ধ গলির কোনে? তোমায় পেয়ে 

কলরবে বলিলো ধরো, সে সর্বত্র সব জানে। ভয় পেয়ো 

না ধীর করো মন, এ গলি তাঁর মনের মতো নয় এত 

চঞ্চল। বাহ্বা দাও তুলে ধরো আকাশে, উড়িতে দাও 

তাহাকে বলাকার পিছে পিছে। কানের কাছে চুপিসারে 

বলো তুমি যা জানো আমি তা জানিনেকো। মিটে গেলে 

সব, শীতল বাতাসের মতো শান্ত। ছাদ থেকে নেমে একা 

সে একান্তে আরাম কেদারার কোলে, শিশু ঘুমে মত্ত।

ঠিক এমনই সময় ফিরিয়া আসিতে হয় নিজস্থানে...

Thursday 8 February 2024

অমিতাভ দাশশর্মার কবিতা

 



চলে গেলে! যাও।

দায়ভার তুলে নাও।
তারপর সীমা এসে
কী ভীষণ ভালোবেসে 
জড়িয়ে ধরবে।
আকাশ মরবে।
বাণ্ডাকুয়া নদীগুলো
মনভুলো।
বদলাবে খাত
অকস্মাৎ ।
তোমার সীমানা ঘিরে
কাঁটাঝোপ ফিরে ফিরে
জোনাক জ্বালাবে।
সে আলোর ইশারায়
ভারি জ্বর গায়
আসবে কি, টলেটলে?
পায়ে দলে
সুগন্ধি ঘাস,
যা বারোমাস
ফুটে থাকে।
মাখে
উপেক্ষা দলন।
উচাটন মন
ঘাস ফেলে উড়ে যায়,
পায়,
প্রিয় পরমের গান?
নাকি শুনশান
ঘেরাটোপে
সীমায়িত খোপে
থেকে যাবে বরাবর?
আমার এ ঘর
আজীবন ভর
সাজিয়ে রাখব।
মাখব
স্মৃতি-ধুলো ক্রমাগত
দিন যাবে মত
উড়ে উড়ে
ঘুরে ঘুরে
পরতে পরতে জমে
হৃদয়ের ওমে
হয়ে যাবে প্রস্তর।
আমার সাজানো ঘর
আদরে রাখবে তাকে।
তারপর, কোনো এক ফাঁকে
তুলি ছেড়ে গেছে যাকে

সেই শিল্পীর

স্মৃতি ভিড়
তুলে দেবে তার হাতে
একই সাথে
ছেনি ও হাতুড়ি।
চাঁদবুড়ি
হেসে হেসে
ভালোবেসে
ব'লে দেবে কানে-কানে
"ইজেল-প্যালেট, তুলি ছেড়ে যাওয়া মানে
শিল্পীরা জানে।
ঐ স্মৃতি-পাথরের বুকে
হাতুড়ি ও ছেনি ঠুকে ঠুকে
ভেঙে ফেল আপনার সীমা,
গ'ড়ে তোল পাথর-প্রতিমা"…

Wednesday 7 February 2024

অসীম কুমার চক্রবর্তীর কবিতা

 



সন্তান

মনেমনে দিনেদিনে শক্ত হয়ে যাবে,
ছোট মুঠোয় আগামী দিনের ড্রাইভিং স্কিল,
তবু কেন জানি বড় হয় না!
এখনও মনে হয় মখমলের মতো ,
নরম তুলতুলে ওম দিই শীতের দিনে।
মনে হয় একছুট্টে দুহাতে জড়িয়ে ধরে,
পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে একগাল হাসি!
যেন আলোর ঝলকানি,
যেন বাঁধভাঙা কলকলরব,
শতায়ু ভব!

Shyamal Kanti Das

  


Shyamalkanti Das

The peacock's game 


The peacock has taken me for a snake, and 
The thought makes him rip my body into shreds with
Blows from his beak.
He is clawing through my belly,
Turning the innards out.  
Instead of tears, colloidal mud is all
That emerges from between my eyelids. 
The peacock has held my head tight against the ground; 
With a sudden pull, has severed
My shrivelled appendix of a cock 
And with my trivial profane heart
That resembles cockscomb flowers,
His periodic displays of wondrous sport continue !

While watching the peacock at his game 
I turn into a mere shadow of what I'd been, 
The prowess to raise a hood has long bygone !



Playhouse


Hiding in a corner I wished to witness coitus
You, my sworn enemy
Came from nowhere and turned my head around
Throwing every protest to the wind, you clawed and gnawed 
My lidless eye off its socket.
My cuffs betray the blood which now gurgles forth 
Even a thousand attempts won't yield to me 
The spectacle of a flower in bloom anymore.

I was not at fault 
I only wanted to gape at evens and odds 
And at nature -- no holds barred
Wished to know where Man's so many thrills find final rest 
Wished to know which are the exact beams that now 
Light up the best things that Man finds pleasure in
It was you who did not let me know 
In my learnings a huge, huge fissure prevailed 
Something I will forever regret !

Translated by Bappaditya Roy Biswas 

Chaitali Chattopadhyay

  




Afghanistan 2

Chaitali Chattopadhyay 

Translated by Shyamashri Ray Karmakar 


The Gun has aimed the quiet back. 

The  Gun is killing the songs. 

The  Gun is destroying abodes and

The  Gun is tearing apart truth. 

The  Gun is  erasing the story scripted on the celluloid. 

The  Gun is throwing away all the laughter, that are feminine. 

The  Gun has picked up the art, the art that once created the serene...

 The  Gun has spread the thorns on the wide road...

The  Gun will commence its speech, others will fall asleep...

 The Gun has kissed the dead forehead, an endless kiss...

Friday 2 February 2024

সোমা দত্তের কবিতা

 

 


নবজাগরণ

  

 

বলেছ অসুর, বলেছ রাক্ষস, বলেছ প্রেত, কালো নিগার–

সেই আঘাতের গর্ত ভরে, হিরণ্ময় আলো জ্বেলে,

হত্যার মন্ত্র গেয়েছ জন্ম থেকে জন্মান্তরে,

এক রং থেকে বর্ণাঢ্য প্রাকৃতিক দৃষ্টিহীনতায়।  

ভুলে গেছ নগর সভ্যতার আদিরস তাণ্ডব...!

অন্ধকার চিরে আলো জালিয়েছ আর্যসভ্যতার...!

ধ্বংসের আস্ফালনে স্ফীত রাজা তুমি

রক্তপথে বিজয়তোরন উড়িয়েছে তোমার মধুযামিনী।

কলিঙ্গফলকে তোমার বিলাপ শুনেছি রেশমের সংলাপে,

চাঁড়াল হৃদয় থেকে সরে গেছে চারণের গান–  

তবু ভালবাসা গাছের বুকে চাঁদের আলোর মতন জ'মে,

তবু ভালবাসা ক্ষীণ হাতে মায়ের শরীর ঢেকেছে কাপড়ে,

তবু ভালোবাসা পণ রাখে মুখোশের মুখটিকে দেবে শেয়ালের মুখে–

অতিগূঢ় লাঞ্ছনায় রক্তাক্ত শরীরে, শুরু হবে কৃষিকাজ।

 

 

Saturday 4 November 2023

সৌ র ভ ব র্ধ ন

 




অতিশিখা

ধরো, এমন দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়-প্রমাণ হয়ে!
মাটির মর্মোদ্ধার ----- সেও তো নজিরবর্জিত, স্বল্পপ্রাণ
ছেয়ে গেছে রূপ, তবু নিবেদন, অন্ধেতর পুষ্পের ন্যায়
এই বুঝি, অতিশিখা জ্বলে গেলো জীবনে...

একদিন ভালোবাসায়, ক্ষণকাল দীপ্ত মেধায়
আবদ্ধ পাগল হয়েছে গাছটা, এতো বাষ্পায়ন!
পরিচয় সেখানে বাহুল্য, বেদনা সেখানে উন্মুক্ত তার 
সশব্দ ঝরনার মতো অলকাবলি হৃদয়
কাঁপে, কাঁপে আর বিপাকে পড়ে যায় পড়ন্ত যুবক
তাকে ভালোবাসো, তার ভাবনার বীজ বড় গূঢ়
তার স্তনে ঠোঁট রেখে দ্যাখো 
সে পুরুষ এলোমেলো কিনা
কোন তলানিতে অধঃক্ষিপ্ত হয়ে সে আশায় আছে
এই বুঝি অতিশিখা ফ'লে গেলো জীবনে... 




Thursday 2 November 2023

অমিতাভ দাশশর্মা

 



এলোমেলো 


মধ্যবর্তী আমাদের

তিরিশটি বছরের

ট্র্যাজেডি, তার

বিপুল ডানার

ঝাপটায়, মরু দ্বার খুলে,

 ধুলোঝড় তুলে

ঢেকে দিয়েদিল পথ,

আর--- ছোঁয়ার শপথ।

অনুভব--- শুধু অনুভবে

অরবে 

অনর্গল করে চৈতন্যের দ্বার।

তোমার --- আমার


লাবন্যের সংসারে

শিশু ও কিশোরে

ছিল সোনাঝরা

মধুক্ষরা 

দিন ও রজনী।

কিন্তু, প্রেমমণি?

খুঁজে ফিরে ফিরে যাকে

বাতুলতা পাকে

জড়িয়েছি নিজেকে নিজেই,

তার নাম গন্ধ নেই

সংসার লাবন্যে।

এ জন অরন্যে

নিজের জন্যে 

বাঁচা খুব প্রয়োজন।

তাই ,

তোমাকে পাবার এত

আয়োজন।


বুঝলে না!

ফেলে দিলে!

বিশ্বাস হয় না।

উপেক্ষা গয়না

যত পরাও আমাকে---

বাঁধো পাকে পাকে

প্রেমের বাঁধনে।

জানে

মন , যথাযথ জানে,

প্রেম কাকে বলে, তার মানে।






Wednesday 30 August 2023

দেবশ্রী মজুমদারের অণুগল্প



 

 

  ক্রুশবিদ্ধ

 

একভাবে এতটুকু জায়গার মধ্যে কাঁহাতক আর শুয়ে থাকা যায়! এপাশ ওপাশ করলেও সস্তা কাঠের বাক্সটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে ওঠে। হাড়ের মধ্যেও ঠকঠক শব্দ হতে থাকে। তার চেয়েও মুশকিল হয়, বৃষ্টি হবার পর। বৃষ্টির জল আস্তে আস্তে মাটি ভিজিয়ে দেয়। কাঠের বাক্সটার উপরটা ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়। একটা অদ্ভুত বিদঘুটে দুর্গন্ধ বেরোতে থাকে। আর কতো ধরণের পোকামাকড় এসে আশ্রয় নেয় সব এখানেই। সব মিলিয়ে কেমন একটা গা ঘিনঘিনে ভাব। তার ভালো লাগে না। কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। এই ছয়মাস ধরে এটাই এলিজাবেথের চিরস্থায়ী ঠিকানা। এর থেকে মুক্তির উপায় নেই। নাকি জীবন থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়েই তার এই কবরস্থানে ঠাই হয়েছে? সে ভাবে, কিন্তু ভেবেও কূলকিনারা করতে পারে না।

  চার্চ থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তা, রাস্তা থেকে পুলিস স্টেশন,সেখান থেকে হাসপাতালের পোস্টমর্টেম ওয়ার্ড। সেখানেও অনেকক্ষণ ধরে কাটাছেঁড়া । তারও একদিন পর তাকে এখানে আনা হয়। আর তারপর থেকেই একটানা এলিজাবেথ এখানেই থাকে।

হোলি ফ্যামিলি চার্চ এর ট্রেজারার ছিল এলিজাবেথ রোজারিও। থাকদাড়ি রোডের উপর মিশন বাজারে ছিল ছোট্ট এই চার্চটা।

সেদিনটার কথা এখনও মনে পড়ে তার। সেদিন পাম স্যাটারডের আগের দিন । ইস্টার, ক্রিসমাস এর আগে সব সময়ই এলিজাবেথের কাজের চাপ বেড়ে যেত। নতুন করে সব কিছু রঙ করা, সাজানো গোছানো, লাইট, ক্যাণ্ডেল কেনা সব খাতেই অনেক খরচ এবং একইসাথে চার্চের সদস্যদের চাঁদার হিসাব মেলাতে মেলাতে চার্চ থেকে বেরোতেই প্রায় দশটা বেজে গেছিল। একটু রাত হয়ে গেলেও সেদিন সে ভয় পায়নি। ছোটবেলাতেই যারা মা বাবাকে হারায়, তাদের বোধহয় কোন কিছু নিয়েই আর চিন্তা ভাবনা হয় না। জমা খরচের হিসাব মিলিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরছিল সে। বাড়ি ফিরে চিকেন স্যুপ বানাবে,আর তার সাথে ভালো জমবে বলে একটা গার্লিক ব্রেড কেনার জন্য মিশন বাজারের কিন্স বেকারিতে ঢুকেছিল এলিজাবেথ।

তেত্রিশ বছরের যুবতী এলিজাবেথের মনটা সেদিন অকারণেই একটু বেশি রকমের ফুরফুরে ছিল। ইস্টারে তার কাজিন ভাই বোনদের জন্য কি কি কিনবে,মনে মনে সেই সব প্ল্যান করছিল। আচমকা তার খুব কাছ ঘেঁসে একটা আকাশী রঙের মারুতি ওমনি এসে দাঁড়াল। গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে দু-তিন জন মত্ত যুবক তাকে এক ঝটকায়  চলন্ত গাড়ির মধ্যে টেনে নিল।  এলিজাবেথ জীবনে প্রথমবার সেদিন একসাথে যৌবন আর মৃত্যুর স্বাদ পেল। তার মরে যাবার শেষ এক ঘণ্টার কথা সে আর মনে করতে চায় না। বেঁচে থাকতে মরণ যন্ত্রণা পাওয়া যেমন দুর্বিষহ, মরে গিয়েও জীবন যুদ্ধের তীব্র কিছু বেদনা ভুলে যাওয়াই ভালো।

  এলিজাবেথ ভাবল, এখন সে অনেক ভালো আছে। তার শরীরে এখন আর কোন মাংস নেই, মেদ নেই, স্তন নেই, যোনি নেই। শুধু আবছা আলো আঁধারে ঘেঁটে যাওয়া চেতনা বেঁচে আছে। সেজন্যই এখনও মাঝে মাঝে তার মন কেমন করে। অন্য কবরের সামনে যখন সে দেখে তাদের প্রিয়জনেরা এসে দুদণ্ড বসে, ভালোবাসে, চোখের জল ফেলে,কবরের সামনে ফুল রেখে চলে যায়,নির্জীব  হাড় সর্বস্ব এলিজাবেথের শরীরটার তখন কান্না আসে। শোভাহীন হয়ে পড়ে থাকে সে।

এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে এলিজাবেথ টের পায় হঠাৎ আকাশ কালো করে প্রবল ঝড়।  ঝড়ের তাণ্ডবে এলিজাবেথের কফিনটাতেও যেন কাঁপন লেগে যায়। কাছেই ছিল একটা তালগাছ । সেটার কয়েকটা তালপাতা এসে পড়ে এলিজাবেথের কবরের কাছে। পরম আনন্দে এবং দুঃখে এলিজাবেথের মনটা কানায় কানায় ভরে ওঠে। পাম সানডেতেই সে যে এখানে প্রথম এসেছিল।  

__________________________

 

 

 

 

Thursday 3 August 2023

কাজরী বসুর কবিতা

 





চিঠি আর গিনি


খুলি না সে এঁটে রাখা মুখ।
সত্যি তো চিঠি নয়,যেহেতু জানি
তুমি ভাবো ছুঁড়ে দেওয়াটুকু খানদানি
জলসাঘরের মতো ঠিক
মোহর গিনি ও কিছু পারিপার্শ্বিক... 
আজন্ম ভাঁজে ভাঁজে ধুকপুক আর ধুকপুক।

ভাবি তাই,যদি
পরিচয় বদলেই নামহীন নদী...
নদীরাই যেতে পারে বয়ে
ফুলপ্রুফ গর্ভিণী বেনিয়া না হয়ে।

পাশাপাশি আরও কথা, বাদবাকি সব
বলে ফেলি যতটুকু বলা সম্ভব...
তোমার আর তোমাদের ক্ষয়
জলসাঘরের মতো হয়।
হারিয়েছে দু হাতের জোর
ছুঁড়ে দেওয়া সোনা রঙ গিনি ও মোহর।

খামেরাও উড়ে যায় ফের
আজও বুঝি পথ চেনে ডাকবাক্সের...
অথচ সে জরা আর খরা...
ইদানীং অদৃশ্য  ডাকহরকরা। 

চিঠি আসে,ফের ফিরে যায়।
বদল লিখেছে তার নাম ঠিকানায়।

Saturday 22 April 2023

দেবশ্রী মজুমদারের গল্প

 




অপ্রয়োজনীয় 

 নীল রঙের চেক লুঙ্গিটায় পাক দিয়ে পেটের কাছে গুঁজতে গুঁজতে সাত পাঁচ ভাবছিলেন চিন্ময়বাবু । এই বাড়িটাতেই কেটে গেছে জীবনের বেশিরভাগ সময় ।  এক সময় বৌ, দুই মেয়ে, মা সবাইকে নিয়ে  একসাথেই কাটাতেন এখানে । অভাব, কম অভাব, বেশি অভাব – সব রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত সংসারের মতই সাদামাটা জীবন ছিল তাদের । একটা ধরা বাঁধা চাকরির শখ থাকলেও অকালে বাবা চলে যাওয়ায় বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারেননি তিনি । অগত্যা সেজ কাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া একটা চায়ের দোকানের মালিক হয়েই সারাটা জীবন বেশ কাটিয়ে দিয়েছেন । সকাল বিকালে জমজমাট আড্ডা বসত তার দোকানে ।  অনেকসময়ই লোকজনের গল্প গুজবে কানে তালা লেগে যেত তার । কারো কারো গল্প শুনতে ভারি মজাও লাগত ।  একবার পাড়ার বৃদ্ধ সনাতন বাবুর একটা কথা এখনও খুব মনে পড়ে ।  ভোজনরসিক বুড়োকে একবার তিনি ডাবল ডিমের মামলেট করে দিয়েছিলেন ।  অন্যমনস্কতায় নুনের পরিমাণটা খানিক বেশি হয়ে গেছিল । মুখে দিয়েই সনাতন বুড়োর চক্ষু চড়ক গাছ । সেদিন তৎক্ষণাৎ তিনি বলে ওঠেন, “ওহে চিনু, তোমার থেকে বয়সে আমি অনেক বড়, তাই একটা উপদেশ দিই, ভালো করে শুনে রাখ ভায়া, সারা জীবন তা মেনে চলার চেষ্টা কোরো । প্রয়োজনের থেকে কোন কিছুই বেশি দিতে নেই, যদি দাও, তাহলে তা বিস্বাদ হয়ে যায় । কথাটা মনে রেখো । ”

          সেই সময় কথাটার পুরো মানে তিনি বোঝেননি । বুঝেছেন অনেক পরে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে । যাক গে, এসব ভেবে এখন আর কাজ কি ! দুপুরে খাবার পর চিন্ময়বাবুর কোনদিনও ঘুম আসে না ।    তার এই একার জীবনে পুরনো স্মৃতি হাতড়ে যা একটু সময় কাটে । এই করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে আসে । 

 দিনের অনেকটা সময়ই এভাবে কেটে গেল । এবার তাহলে একটু লিকার চা করে খাওয়া যাক । ঢিলে হয়ে যাওয়া লুঙ্গিটা আবার একটু প্যাঁচ দিয়ে ঠিক করতে যাবেন, ঠিক তখনই দরজায় কে যেন একটা আলতো টোকা দিল । এ সময় কে আবার এলো রে বাবা ! বড় মেয়ে তো মালদায় থাকে। তার আসার প্রশ্নই নেই । আর ছোট মেয়ে পাশের পাড়াতে থাকলেও ও সবসময় দিনের বেলাতে এসে ঘণ্টা খানেক থেকেই বিদায় নেয় ।  এসব  ভাবতে ভাবতে চিন্ময়বাবু দরজাটা খুললেন ।  খুলে তো অবাক হয়ে গেলেন । “আরে হরি, তুই অ্যাদ্দিন বাদে ! আরে আয় আয় , ভেতরে ঐ চটি পরেই চলে আয় । ” তাড়াতাড়ি করে একটা স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার পেতে হরিকে বসতে দিলেন ।




- “আসলে এদিক দিয়ে ভাইপোর বাড়ি যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোর সাথে একবার দেখা করে যাই । কি খবর বল তোর ? আছিস কেমন ? ”

হরি চিন্ময়ের অনেক পুরনো বন্ধু । তার চায়ের দোকানে আগাগোড়া সে হরির কাছ থেকেই নেতাজী বেকারির কেক, বিস্কুট , পাউরুটি নিত । শীত, বর্ষা, গরম -যাই হোক না কেন রোজ সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে পৌনে সাতটায় ও ঠিক চলে আসত । তারপর  চা খেয়ে চটজলদি একটু গল্প সেরে আবার বেকারির ভ্যান চালিয়ে চলে যেত অন্য পাড়ায় । 

-“কি রে কি এত ভাবছিস ? তোর মেয়েদের খবর কি ? দাদুভাই, দিদিভাইরা কেমন আছে ? ”

-“কিছুই তেমন ভাবছি না রে ।  তুই বরং বল, তোর সেই নেতাজী বেকারির মালিক, কি যেন লোকটার নাম ? তার কি খবর ? ”

-“আর বলিস না, সে তো কবেই ঐ বেকারি বিক্রি করে দিয়ে দেশে চলে গেছে । তারপর আর খোঁজ রাখি না ।  শোন এবার উঠি তাহলে, ভাইপোর সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরতে হবে । এখন আর অন্ধকারে তেমন ঠাহর করতে পারি না । তুই একবার আসিস আমার বাড়ি । মিনিট দশেকের তো হাঁটা পথ । ”

                 দিন তিনেক পরে চিন্ময়বাবুর কুমড়োশাক খাওয়ার ইচ্ছে হল । ভাবলেন সকাল সকাল বাজারে গিয়ে একবার দেখা যাক , যদি মনমতো টাটকা শাক একটু পাওয়া যায় । ছোট একটা বাজারের থলি হাতে অশক্ত শরীরে বাড়ি থেকে বেরোলেন । আজকাল আর আগের মতো রোজ বেরোতে পারেন না । একটু হাঁটার পরই গলির মুখে দেখা হয়ে গেল হরির ছোট ছেলের সাথে । দেখামাত্র সাইকেল থেকে নেমে পড়ল ও । কি যেন ওর নামটা ? অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই মনে পড়ল না । হরি অনেকসময় ছুটির দিনে ওকে নিয়ে আসত তার চায়ের দোকানে । ডিমের পোচ খেতে ভারি ভালবাসত ছেলেটা । 

                                             ছেলেটা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল । বলল, “ কাকা একটা খবর আপনাকে জানানো হয়নি । আপনার বাড়ি ক’দিনের মধ্যেই যেতাম । আসলে আপনার শুনলে খুব খারাপ লাগবে । আজ দশদিন হল, বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । প্রায় একমাস বিছানায় পড়ে ছিলেন । ওই ওখানেই পেচ্ছাপ, পায়খানা সবই করতেন । আসলে বাবা বলে বলতে খুব খারাপ লাগছে । ওভাবে বেঁচে থাকা, চোখে দেখা যায় না । একদিকে ভালোই হয়েছে । ”

                                              চিন্ময় বাবুর মাথার ভেতরটা তোলপাড় করতে লাগল । অনেক কথা একসাথে বলতে চাইলেন । তাহলে গত পরশু নাকি তার আগের দিন হরি যে এল, গল্প গাছা করল । কিন্তু ওর ছেলে একি কথা বলছে ! সবকিছুই কেমন তালগোল  পেকে যাচ্ছে । একটা শব্দও তার মুখ থেকে বেরোল না । ছেলেটা আরও কত কি বলে চলল কিছুক্ষণ । সে সবের বিন্দু বিসর্গও তার কানে ঢুকল না । ওখানেই আরও কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি । কি যেন একটা কেনার জন্য বেরিয়েছিলেন , তাও মনে করতে পারলেন না । বাজারের থলিটাকে কোনভাবে খামচে ধরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন । হরিকে বসবার জন্য একটা স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার বার করে দিয়েছিলেন । বাড়ি পৌঁছে ওটা এখনও ওখানেই আছে কিনা তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন তিনি । 

                                                     ________________