কবিতা সংগ্রহ/ কবি অমিতাভ মৈত্র
কবিতা সংগ্রহঃ অমিতাভ মৈত্র
প্রচ্ছদ রাজীব দত্ত
দাম ২৫০ টাকা
প্রকাশক তবুও প্রয়াস
"আমার কাছে একটি ছবি আসে, আমি সেই ছবিকেই ভাষায় অনুবাদ করতে করতে এগিয়ে যাই"
কবি অমিতাভ মৈত্রের এই স্বীকারক্তিই হয়ত প্রমাণ কতটা নিষ্ঠা ও নেশায় এক বুদবুদকে সমুদ্র করে তুলতে পারেন তিনি। তার কবিতাগুলি চিরপরিচিত গন্ডীর বাইরে নিজেকে খুঁজে নেওয়ায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাষার প্রয়োগে তিনি যে ব্যতিক্রমী শুধু তাই নয়, কবিতার গঠনশৈলী ও বক্তব্যে তার দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া অসম্ভব।
পতনকথা, টোটেম ভোজ, ষাঁড় ও সূর্যাস্ত, পিয়ানোর সামনে বিকেল ও পরিশিষ্ট এইকটি বিভাগে কবিতাসংগ্রহকে সাজিয়েছেন সম্পাদক সেলিম মন্ডল।
"যদি চিতা বল, আমি দুই হাতে ছুঁয়েছি আগুন
হাড়ের গভীর মাংস মেলে দাও শস্যে ঘাসে ঘাসে
ছড়াও শরীরময় স্বেদ রক্ত রাত্রিবীজগুলি
দ্যাখো কত স্পর্শসহ আমি আর আমার অঙ্কুশ"
মৃত্যুর অতীত থেকে উড়ে চলেছে নীলঘুড়ি। কবির হাতে সেই অলীক সুতো। অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে অতিকৃত কালো কালো কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত মুখ। তারা হাঁটতে হাঁটতে নির্মাণ করছে পথ। বেজে উঠছে অস্ত্রের ছনছন। তৃষ্ণার ছুরি হাতে নত হচ্ছে ক্রমশ কবির শরীর। তবু ব্যর্থতায় বেঁচে থাকা। এ যেন এক তুমুল আত্মপ্রতারণা। যে সমস্ত পাপের কথা বিশ্বাস করেনা ঝরনার জল, তারা জানে আসলে পাপ বলে কিছু নেই। সবটাই ঘটমান, বর্তমান। সময়ের সুকৌশল কারচুপি। যে হাত ডুবে আছে বহুদিন জলে, যে চোখে বহুযুগ জ্বলেছে আগুন, কাপাস তুলোর মতো যে শরীর ভেসেছে কেবল, মাটি ও গাছের কাছে তার সব ঋণ আজ শেষ। গুমোট বমির মতো মাংসের কুয়াশা এলেও মৃত্যু আজ প্রস্তুত সমস্ত অন্ধকার পিছনে ফেলে।
টোটেম ভোজ কবির এমন এক সৃষ্টি যাতে ধরা পড়েছে এক তীব্র যন্ত্রণা। শুরুতেই কবি লিখছেন,
" অস্বাভাবিক সব চোখ, আর এক অদ্ভুত
গোল মাংসমাখা ভাষায় কথা বলা হয়েছে
তার বিষয়ে
যে ভাষায় 'আলো' শব্দটি নেই, এবং
কোন বিস্ময়চিহ্ন নেই…"
এ কোন অন্ধকার। এ কোন ভালোবাসা তবে? কেঁচোর মতো পিছল ঠোঁট যার গাল ছুঁয়ে বলছে, ' তোমার ধর্মান্তরণ হল। এখন তোমার মুখে আমার রক্ত। শোনো, লাল থকথকে সেই জলাভূমির ওপারে সাদা হাড়ের ক্রুশকাঠে, আড়ষ্ট শরীর, এখন থেকে ঝুলে থাকবে তুমি।'
তবে কি শুধু শরীর! শুধুই জ্বলন্ত মশাল ও ঘোড়াটিকে নিয়ে স্নানঘরের বন্ধ দরজা? নাকি নগ্নতাকে গ্রহণ করা মাংসের বিরুদ্ধে? এমনই এক জটিল দর্শন বারবার দেখা দিয়েছে টোটেম ভোজের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে।
নিজের মৃতদেহের পিঠ হেলান দিয়ে যেন লেখা হয়েছে কবিতাগুলি। থমথমে বাতাসে শুধু ঘৃণা। কাঁধে হালকা কামড় দিচ্ছে পিশাচিনী। না খাওয়া অংশগুলো বাক্সে তুলে রাখছেন দুজন। বাঁচার তাগিদ নেই, তবু বেঁচে থাকা। প্রেরণাহীনভাবে কামড়ে ধরা তার গলা। নিষ্প্রাণ জলে, রক্তরসে ভরে উঠছে মুখ, কবি লিখছেন,
" দরজার ওপারে কোন মাংস ডাকছে, আলো হাতে নিয়ে"।
ক্রমশ পাগল হচ্ছে সব চরিত্ররা। সম্বিতহারা আত্মহত্যাপ্রবণ। প্রতি দু মিনিটে মৃত্যু আবার স্বাভাবিক শ্বাস। আলোহীন নাচঘরে ধূসর পোশাকের নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা। শূন্য চেয়ার থেকে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা এবং তারপরেই বসে পড়া, তার মাঝের যেটুকু সময়, তা যেন এক নাচেরই সমান। কখনো শূন্যে ভেসে ওঠে সেই রাজকীয় চেয়ার, কখনো বা ঠান্ডা স্পর্শযোগ্য এক আলোয় ম্যাডাম এম কে মৃতদেহের মতো তুলে ধরা ভারী রক্তের বোতলগুলোর ভেতর।
অবেশেষে সময় আত্মহত্যা করে। 'not understanding, not living either, not even aware of life trapped deep inside' ( Michel Joiret)
আপেল চিবোতে চিবোতে ঝলসে উঠে রুটি। কবিতার চরিত্র ম্যাডাম এম ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে উঠছেন। দেশলাই নিতে পারছেন না। লাল সিলিন্ডার ও তার আপেল যেন মিশে যাচ্ছে একই বিন্দুতে। দরজার ফাঁক দিয়ে সাদা কাপড় হাতে এগিয়ে আসছে মৃত্যু। তিনি বাকরুদ্ধ। ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধ। দেশলাই ভিজে গেছে তবু মাংস মুক্তি চাইছে যন্ত্রণা থেকে।
ষাঁড় ও সূর্যাস্ত বইটির কবিতাগুলির গঠন আবার একটু আলাদা। বস্তুকে তার অর্থ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া কিংবা অন্ধকারে ছুটে চলা কোন ট্রেন, গতির মধ্যে পাক খাচ্ছে এমন কোন বিষয়, রাত্রি কিংবা চোখ সবকিছুকেই কবি রূপদান করেছেন অনন্য ভাষায়। ঘন বাষ্প আর বালির স্তর সরিয়ে উঠে আসা ঘড়ি কিংবা কোন বিস্মিত বারান্দায় ফুটে ওঠা কোন ছায়া ধরা দিয়েছে তার বহমানতায়।
" আমার সাদা কুকুরটা আবার যেদিন নিজেকে ভাবতে শুরু করবে
আর আরাম চেয়ারটায় বসে ঢুলতে ঢুলতে হঠাৎ দম আটকে আসার কারণ যেদিন থেকে খুঁজে পাব না আমি
সেদিন কেউ এসে যদি বলে যে আমার ঝগড়াগুলো নিয়ে,
কাগজপত্রগুলো নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই
এমনকী আমার বাসন ধোয়াকেও সে আর বাসন ধোওয়া বলে মনে করে না
তখন তাকে বোকা বানানোর জন্য এই একটা ঝরঝরে হাসি
আমি ভেবে রেখেছি
এক জায়গায় খানিকটা হলদে, মরা ঘাস দেখিয়ে বলব
এখানে তোমার জন্য একদুপুর লম্বা একটা ঘন্টার শব্দ রাখা আছে। তোলো!" (বোকা)
লাল ধুলোর শরীর। অপেক্ষারত লাল বাঘ। জাদুকর আসলে সেই নারী যিনি রক্তমাংসের প্রশাসক। কিংবা এই চোখ মুখ নেমে আসা হাসিরা যেন একএকটি খোলা রাস্তা। সূর্যাস্তের মধ্যে গাঢ় হয়ে ওঠা সিংহরা যেমন কখনো জলের ধারে এসে দাঁড়ায় অবিশ্বাস্য কোন প্রতিবিম্বের কাছে, মৃত্যু থেকে না উদ্ধার হওয়া কোন বিভ্রান্তি যেমন রক্তাক্ত হয়ে থাকে চিরকাল, এ যেন সেই না জানা সূর্যাস্তেরই ছবি যা বারবার প্রতিভাত হয় অবচেতনের পর্দায়।
ভেসে যাওয়া বাড়িগুলো যে ভয় থেকে কথা বলে কুয়াশার সাথে কিংবা দরজা খোলার শব্দে বোবা মেয়েটি কামড়ে ধরে তার বিড়ালকে এমনিই সব অদ্ভুত দৃশ্যকল্প বারবার ওঠে আসে তার কবিতার কায়া গঠনের জন্য।
পিয়ানোর সামনে বিকেল কাব্যগ্রন্থটি আর একটি গভীর জীবনদর্শনের প্রমাণ। খোলা ওয়ার্ডরোবের সামনে মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যকল্প যেমন অতি সাধারণ হলেও গভীর তেমনই মসৃন হলুদ হাত যা একটু দেরি করে পৌঁছায় সবসময়, এই পংক্তিগুলি পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে কবিতার আসল উৎস তবে কোথায়! ক্যানভাসে কি দর্শন এঁকেছেন কবি। বহুপঠন দাবী করে প্রতিটি কবিতা। সাদা গজ এগিয়ে যায় কোনাকুনি যেন শেষ হয় দীর্ঘ অপেক্ষা। মৃত্যু পর্যন্ত শুধু ঝড়। কখনোই ঘুমিয়ে পড়া চলবে না। এমন সব পংক্তির আলোয় ঘিরে থাকে পাঠক।
' সমুদ্রের দিকে ব্লেড আসছে। বৃষ্টি আসছে শূন্যতা, সাইকেলের চাকায়।
দেয়াল ঘেঁষে নিয়ে চল। কেন মিথ্যে বলছ আমাকে?
তিন মাইল জুড়ে কোথাও ঠিকানা নেই।
আলো কমে আসছে। নৌকা বানানো হল না। নীরবতা থেকেও হয়তো রক্ত পড়বে এবার।
গা শিরশির করছে। ব্লেড সরানো দরকার।
তোমার হাসি কি আগের মতোই অবর্ণনীয় এখনো।'(ব্লেড)
কবিতাটির ভেতর এক অদ্ভুত অন্ধকার। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নিচ্ছে হতাশা। এই ছায়ার কারণ হয়ত অস্পষ্ট। হয়ত বা জানলার কাচে লাগা অর্থহীন বৃষ্টি। তবুও তা বিধ্বংসী। তবুও তা কালো আঙুরের মতো লোভনীয়। যা মানুষকে ধ্বংস করে তার দিকে ছুটে চলার প্রবৃত্তি বড়ো স্বাভাবিক। এ মৃত্যু যেন তেমনই এক বিস্ময়। মোটরবাইকের নীচে চাপা পড়া শেষ আর্তনাদ। তবুও জলহীন কঠিন দুচোখ, আত্মহত্যা চায় বাঁচার আশায়।
পরিশিষ্টেও বেশ কিছু কবিতা গুণমানের বিচারে আলোচনার দাবী রাখে। শিউরে উঠে 'যতক্ষণ টগর থাকবে'
কবিতাটি পড়ে। কী কঠিন বাস্তব সত্য কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অনবদ্য ভাষায়।
' মেয়েটিকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মিলিটারি ব্যারাকে
নাচের জন্য। ভিতরে মাংসের গন্ধ, আগুন
আর জড়ানো গলায় হই হল্লা।
নতুন দখল হওয়া এই শহরে
কোথাও আলো জ্বলছে না আজ।
ধোঁয়া উঠছে এখানে সেখানে---
আর অন্ধকারে একটানা বেজে যাচ্ছে বলির বাজনা।'
অভ্রকণার মতো আলো পড়ছে চাঁদের। আর তাতেই দৃশ্যমান একপাটি রক্তাক্ত জুতো। কেঁপে উঠি শেষ লাইনে যেখানে কবি লিখছেন, ' কালো ওই মেয়েটিকে ঈশ্বর নিজের হাতে আজ অনুচ্ছিষ্ট মাংস খাওয়াবেন।'
আরো বেশ কিছু কবিতায় কবি তুলে এনেছেন এমন সব চিত্র যা অননুকরণীয় তো বটেই, নিজ বৈশিষ্ট্য ভাস্বর। এমন সব বাস্তব দৃশ্যকল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে কবিতার কায়া যাতে তারা নিজস্ব ভাবধারায় ধরা দেয় বারবার, নানা ভাবে পাঠকের মননে। বহুস্তরী এই লিখনের ভেতর মৌলিকত্ব শুধু নয়, উন্নত ও গভীরতার ছাপ সুস্পষ্ট।
সবুজ আলোয় ভরে উঠছে মাঠ। গ্রামীন মেয়ের হাতে এখন শুধু জল। হত্যা নয়। এ যেন এক ধর্মবিজয়। ভরে উঠছে ধানক্ষেত। কবি লিখে চলেছেন এক অনন্য বিজয়গাথা শৃঙ্খলমোচনের।
সবশেষে কবি সেলিম মন্ডলের প্রতি পাঠকের কৃতজ্ঞতা বেড়ে যায় এমন একটি সংকলনের জন্য। সম্পাদক হিসাবে
নিঃসন্দেহে এটি সেলিমের একটি ভীষন ভালো কাজ।
Nice
ReplyDeleteNice
ReplyDelete