Showing posts with label ১৪৩০. Show all posts
Showing posts with label ১৪৩০. Show all posts

Saturday, 22 April 2023

দেবশ্রী মজুমদারের গল্প

 




অপ্রয়োজনীয় 

 নীল রঙের চেক লুঙ্গিটায় পাক দিয়ে পেটের কাছে গুঁজতে গুঁজতে সাত পাঁচ ভাবছিলেন চিন্ময়বাবু । এই বাড়িটাতেই কেটে গেছে জীবনের বেশিরভাগ সময় ।  এক সময় বৌ, দুই মেয়ে, মা সবাইকে নিয়ে  একসাথেই কাটাতেন এখানে । অভাব, কম অভাব, বেশি অভাব – সব রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত সংসারের মতই সাদামাটা জীবন ছিল তাদের । একটা ধরা বাঁধা চাকরির শখ থাকলেও অকালে বাবা চলে যাওয়ায় বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারেননি তিনি । অগত্যা সেজ কাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া একটা চায়ের দোকানের মালিক হয়েই সারাটা জীবন বেশ কাটিয়ে দিয়েছেন । সকাল বিকালে জমজমাট আড্ডা বসত তার দোকানে ।  অনেকসময়ই লোকজনের গল্প গুজবে কানে তালা লেগে যেত তার । কারো কারো গল্প শুনতে ভারি মজাও লাগত ।  একবার পাড়ার বৃদ্ধ সনাতন বাবুর একটা কথা এখনও খুব মনে পড়ে ।  ভোজনরসিক বুড়োকে একবার তিনি ডাবল ডিমের মামলেট করে দিয়েছিলেন ।  অন্যমনস্কতায় নুনের পরিমাণটা খানিক বেশি হয়ে গেছিল । মুখে দিয়েই সনাতন বুড়োর চক্ষু চড়ক গাছ । সেদিন তৎক্ষণাৎ তিনি বলে ওঠেন, “ওহে চিনু, তোমার থেকে বয়সে আমি অনেক বড়, তাই একটা উপদেশ দিই, ভালো করে শুনে রাখ ভায়া, সারা জীবন তা মেনে চলার চেষ্টা কোরো । প্রয়োজনের থেকে কোন কিছুই বেশি দিতে নেই, যদি দাও, তাহলে তা বিস্বাদ হয়ে যায় । কথাটা মনে রেখো । ”

          সেই সময় কথাটার পুরো মানে তিনি বোঝেননি । বুঝেছেন অনেক পরে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে । যাক গে, এসব ভেবে এখন আর কাজ কি ! দুপুরে খাবার পর চিন্ময়বাবুর কোনদিনও ঘুম আসে না ।    তার এই একার জীবনে পুরনো স্মৃতি হাতড়ে যা একটু সময় কাটে । এই করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে আসে । 

 দিনের অনেকটা সময়ই এভাবে কেটে গেল । এবার তাহলে একটু লিকার চা করে খাওয়া যাক । ঢিলে হয়ে যাওয়া লুঙ্গিটা আবার একটু প্যাঁচ দিয়ে ঠিক করতে যাবেন, ঠিক তখনই দরজায় কে যেন একটা আলতো টোকা দিল । এ সময় কে আবার এলো রে বাবা ! বড় মেয়ে তো মালদায় থাকে। তার আসার প্রশ্নই নেই । আর ছোট মেয়ে পাশের পাড়াতে থাকলেও ও সবসময় দিনের বেলাতে এসে ঘণ্টা খানেক থেকেই বিদায় নেয় ।  এসব  ভাবতে ভাবতে চিন্ময়বাবু দরজাটা খুললেন ।  খুলে তো অবাক হয়ে গেলেন । “আরে হরি, তুই অ্যাদ্দিন বাদে ! আরে আয় আয় , ভেতরে ঐ চটি পরেই চলে আয় । ” তাড়াতাড়ি করে একটা স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার পেতে হরিকে বসতে দিলেন ।




- “আসলে এদিক দিয়ে ভাইপোর বাড়ি যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোর সাথে একবার দেখা করে যাই । কি খবর বল তোর ? আছিস কেমন ? ”

হরি চিন্ময়ের অনেক পুরনো বন্ধু । তার চায়ের দোকানে আগাগোড়া সে হরির কাছ থেকেই নেতাজী বেকারির কেক, বিস্কুট , পাউরুটি নিত । শীত, বর্ষা, গরম -যাই হোক না কেন রোজ সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে পৌনে সাতটায় ও ঠিক চলে আসত । তারপর  চা খেয়ে চটজলদি একটু গল্প সেরে আবার বেকারির ভ্যান চালিয়ে চলে যেত অন্য পাড়ায় । 

-“কি রে কি এত ভাবছিস ? তোর মেয়েদের খবর কি ? দাদুভাই, দিদিভাইরা কেমন আছে ? ”

-“কিছুই তেমন ভাবছি না রে ।  তুই বরং বল, তোর সেই নেতাজী বেকারির মালিক, কি যেন লোকটার নাম ? তার কি খবর ? ”

-“আর বলিস না, সে তো কবেই ঐ বেকারি বিক্রি করে দিয়ে দেশে চলে গেছে । তারপর আর খোঁজ রাখি না ।  শোন এবার উঠি তাহলে, ভাইপোর সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরতে হবে । এখন আর অন্ধকারে তেমন ঠাহর করতে পারি না । তুই একবার আসিস আমার বাড়ি । মিনিট দশেকের তো হাঁটা পথ । ”

                 দিন তিনেক পরে চিন্ময়বাবুর কুমড়োশাক খাওয়ার ইচ্ছে হল । ভাবলেন সকাল সকাল বাজারে গিয়ে একবার দেখা যাক , যদি মনমতো টাটকা শাক একটু পাওয়া যায় । ছোট একটা বাজারের থলি হাতে অশক্ত শরীরে বাড়ি থেকে বেরোলেন । আজকাল আর আগের মতো রোজ বেরোতে পারেন না । একটু হাঁটার পরই গলির মুখে দেখা হয়ে গেল হরির ছোট ছেলের সাথে । দেখামাত্র সাইকেল থেকে নেমে পড়ল ও । কি যেন ওর নামটা ? অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই মনে পড়ল না । হরি অনেকসময় ছুটির দিনে ওকে নিয়ে আসত তার চায়ের দোকানে । ডিমের পোচ খেতে ভারি ভালবাসত ছেলেটা । 

                                             ছেলেটা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল । বলল, “ কাকা একটা খবর আপনাকে জানানো হয়নি । আপনার বাড়ি ক’দিনের মধ্যেই যেতাম । আসলে আপনার শুনলে খুব খারাপ লাগবে । আজ দশদিন হল, বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । প্রায় একমাস বিছানায় পড়ে ছিলেন । ওই ওখানেই পেচ্ছাপ, পায়খানা সবই করতেন । আসলে বাবা বলে বলতে খুব খারাপ লাগছে । ওভাবে বেঁচে থাকা, চোখে দেখা যায় না । একদিকে ভালোই হয়েছে । ”

                                              চিন্ময় বাবুর মাথার ভেতরটা তোলপাড় করতে লাগল । অনেক কথা একসাথে বলতে চাইলেন । তাহলে গত পরশু নাকি তার আগের দিন হরি যে এল, গল্প গাছা করল । কিন্তু ওর ছেলে একি কথা বলছে ! সবকিছুই কেমন তালগোল  পেকে যাচ্ছে । একটা শব্দও তার মুখ থেকে বেরোল না । ছেলেটা আরও কত কি বলে চলল কিছুক্ষণ । সে সবের বিন্দু বিসর্গও তার কানে ঢুকল না । ওখানেই আরও কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি । কি যেন একটা কেনার জন্য বেরিয়েছিলেন , তাও মনে করতে পারলেন না । বাজারের থলিটাকে কোনভাবে খামচে ধরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন । হরিকে বসবার জন্য একটা স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার বার করে দিয়েছিলেন । বাড়ি পৌঁছে ওটা এখনও ওখানেই আছে কিনা তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন তিনি । 

                                                     ________________

Sunday, 16 April 2023

মিঠুন চক্রবর্তীর কবিতা

 





একটি স্বপ্ন এবং বসন্ত


অনুপমা, শ্বাপদের নখে তোলপাড় হয়ে ওঠা
রাতের  সেই লালডিহি অরণ্যের ঘন বুকে 
যেমন করে জেগে ছিল পূর্ণিমার নীল চাঁদ

তেমনি কাল সারারাত তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি....

এই ভরা গ্রীষ্মের দুপুরেও তাই
শুকনো ঠোঁটের পাতাতে আমার
                         লেগে আছে জ্যোৎস্নার মায়া স্বাদ

আমি তো গাছের কাছে শিখেছি
শীতের রুক্ষতা আর গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যিখানে
বুকের ভেতর যত্নে ভাঁজ করে রাখা একচিলতে বসন্ত
সবারই থাকে, আমারও আছে.... আমারও আছে....

কেবল সব জায়গার মাটিতে রাঙা পলাশ ফোটে না।