Showing posts with label ২০১৯( গদ্য). Show all posts
Showing posts with label ২০১৯( গদ্য). Show all posts

Wednesday, 30 October 2019

শারদীয় সাহিত্য এখন, ২০১৯( গদ্য)





সম্পাদকীয়

শেষ হয় এল উৎসবের মাস। আমরা শক্তির উপাসনায় মেতে থাকলাম মাসাধিককাল। যথাসম্ভব করতল পেতে ভিক্ষা করলাম শস্য, রূপ,যশ। ব্যর্থ হলাম আত্মশক্তিকে শক্তিকে উপলব্ধি করতে। আত্মিক দুর্বলতাই মানুষকে দ্বেষ ও হিংসার পথে, প্রলোভন ও ধর্ষনের পথে টেনে নিয়ে যায়। দেবীর আরাধনা প্রকৃতপক্ষে আমাদের অন্তঃস্থ শক্তিকে জাগিয়ে তোলার আরাধনা। এ কথা আমরা যত দ্রুত উপলব্ধি করি, ততই মঙ্গল। সৃজনের ইচ্ছা এক বৌদ্ধিক অঙ্কুরোদ্গম, শিল্প ও সাহিত্য সেই অঙ্কুরজাত শস্য। বাঙালির এই সৃজনশীলতা অক্ষুণ্ণ থাকুক। নিত্যনতুন সাহিত্য প্রতিভা উঠে আসুন সাহিত্যপত্রগুলির হাত ধরে।  
সৃজনশীলতা কেবল সাহিত্য বা শিল্পের অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। নতুনতর ভাবনার উন্মেষ, নতুনতর চেতনার অন্বেষণও এক সৃজনশীল মননের পরিচয় দেয়। মাত্র কদিন আগেই অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার স্বীকৃতি হিসাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, তাঁর কাজের চাইতেও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তাঁর ব্যক্তিজীবন। মানুষকে উদযাপন করব না তাঁর কাজকে, মেধাকে গুরুত্ব দেব নাকি স্খলনকে, এই নিয়ে আমাদের সংশয় সহজে মেটবার নয়।
বাংলায় শারদোৎসব যেন সাহিত্য উৎসবেরও সূচক। উপস্থাপনের আঙ্গিকে, রূপসজ্জায়, সাহিত্য সম্ভারে পত্রপত্রিকাগুলি বহু সাহিত্যপ্রেমীর কাছেই পুজামণ্ডপের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়। এ কথা ভেবেই সাহিত্য এখনের শারদসংখ্যার কাজ হাত দেওয়া। এই সংখ্যার কাজ যখন শুরু হয়, সদ্য প্রয়াত হয়েছেন কবি অগ্নি বসু। আমরা তাঁর আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলাম।  
                                                     শ্যামশ্রী রায় কর্মকার


স্মরণ
আত্মমগ্ন বাউল-পথের অভিযাত্রী অগ্নি বসু

তৈমুর খান

"আহা গো অতল জল,
আজও কেন তৃষ্ণার্ত থাকি?
কিছু 
ফেলে-যাওয়া আছে বাকি!
দিনান্ত দাঁড়িয়েছে
দোরে,
তুমি একা,
আমিও একাকী.."

 ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছিলেন, আমরা প্রত্যেকেই এক একটি নুনের পুতুল। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাই। এই দার্শনিক ভাবনাটিতে কত সহজেই বোঝা যায় অনন্তকে, পরব্রহ্মকে। উপরের কবিতাংশটি কি সেই দার্শনিক অনুভাবনারই পরিচয় দেয় না? জীবনের তৃষ্ণা কোনোদিন পূর্ণ হয় না, অথচ জীবন শেষ হয়ে আসে। কবির একটি দোঁহায় বলেছেন :

“শুনত শুনত লগে হাসি। 
পানিমে মীন পিয়াসি ॥"

মৃত্যুর পদধ্বনি প্রতিটি দার্শনিকের কাছেই অনুভবযোগ্য ।
দিনান্ত এসে জীবনের দোরে দাঁড়িয়েছে, তার তো প্রাণ ভিক্ষা চাই। তখন খুব একাকী মনে হয় নিজেকে। আলফ্রেড টেনিশনও উপলব্ধি করেছিলেন :

"Death is the end of life; ah, why Should life all labor be?
Let us alone. Time driveth onward fast,
And in a little while our lips are dumb.
Let us alone. What is it that will last?
All things are taken from us."

মৃত্যু জীবনকে স্তব্ধ করে দেয়। একা করে দেয়। ঠোঁট বন্ধ হয়ে যায়। বেঁচে থাকার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই শাশ্বত বোধটিই ক্লান্ত করে দেয় । সময় দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে আর তখন :

" তুমি একা 
 আমিও একাকী।"

মাত্র ৬৬ বছর বয়সেই চলে গেলেন কবি অগ্নি বসু(২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯) । তাঁর কবিতাতেই তাঁকে চিনতাম । দীর্ঘ পথের পথিক। বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদও করেছেন অনেক। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও কবিতা লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : চিঠি নেই কতদিন, নৌকা ভেসেছে জলে, ডাকছো নদী? যাই, মায়াহরিণ(কবিতাসংগ্রহ), পরাগ, তোমার চিঠি, দুচোখে অলীক স্পর্শ প্রভৃতি । অনুবাদ গ্রন্থগুলি হল : রিও কানের কবিতা “এসো, তথাগত", রুমির কবিতার বাংলা ভাষান্তর “রুমি", মৎসুও বাশোর হাইকুর বাংলা ভাষান্তর “কেন ভালো বাশো", এডোয়ার্ড লিয়ারের ছবি, অগ্নি বসুর লিমেরিক “যাচ্ছেতাই" এছাড়া “ভুবন ডাঙা", “তিতির পাখি", “দোঁহা" প্রভৃতি ।

          অগ্নি বসুকে বরাবরই এক উচ্চ আধ্যাত্মিক জগতের কবি বলেই মনে হয়েছে আমার। সুফিদর্শনের সঙ্গে এবং বাউল-মার্গের সাধনতত্ত্বের সঙ্গেও তাঁর চেতনালোকের গভীর সংযোগ উপলব্ধি করেছি। ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখলেও কবিতাকে কখনো দুর্বোধ্য ভারাক্রান্ত বা কৃত্রিম বলে মনে হয়নি। বুদ্ধিমত্তা থেকে তিনি উপলব্ধির অভিঘাতকেই ব্যঞ্জনাবহ করে তুলেছেন। কবিতাগুলির নির্মাণশৈলীও অসাধারণ । প্রতিটি কবিতাতেই একরকম ছন্দোবদ্ধ দোলুনি আছে। পাঠ করতে করতে দুলতে হয়। একান্ত ধ্বনিময় অভিনিবেশ । বাস্তব থেকে অতিবাস্তবে স্বয়ংক্রিয় একটা আত্মমগ্ন চলন। সহজ ও সারল্যতার মধ্যে দিয়েই তিনি গূঢ় জগতের ঠিকানা খুঁজেছেন । তাঁর প্রতিটি ইশারা, পথ অনুসন্ধান, উপলব্ধি আমাদের ভাবনায় ও বোধে এক প্রতিক্রিয়া জাগায়। হৃদয়ও নয়, মেধাও নয়, এক ভিন্ন রহস্যলোকের হাতছানি তাঁর কবিতায়। সব সময় তা ভাষায় বা শব্দে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। অথচ মনের ভেতর দারুণ এক আলোড়ন। ছোট ছোট কবিতায় মিত-কথনের নির্মেদ চিত্রলিপিতে ক্রিয়াগুলি নৈর্ব্যক্তিক সম্মোহন ধারণ করেই পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করে। অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে হয় আর বার বার অস্ফুটে উচ্চারিত হয় :

“পথ এসে লুটিয়েছে পায়, 
`আমাকে এভাবে ফেলে যায়!'

অথবা, 

“দুটি ঘুমের মধ্যিখানে 
একটু জেগে থাকা, 
এপথ চলা একা…"

অথবা, 

“দিনান্ত-আকাশে লেখা গান, 
এ আলোক, এতো দেবযান" 

জীবনের এপার ওপার জুড়ে আমাদের তুমুল বিমূঢ়তা, বাঁচা-মরার সন্দিহান পথে আমরা চলেছি সবাই জীবনযাত্রী। তিনি দার্শনিকের মতোই উত্তর খুঁজেছেন। কিন্তু উত্তর কি আছে? 
   না কোনো উত্তর নেই। “সাঁই" চলে গেছে। ব্যক্তি “আমি"টি ভাঙা সাঁকোর মতো। সেখানে জীবন কী করে পার হবে? কবি তখন সেই বাউল হয়েই বলেছেন :

“তোমার কথা 
অনুভবের ঘরে 
দুয়ার এঁটে 
একলা বসত করে…."

   এই একলাই তো জীবনের পরিণতি। আত্মিক নিঃসঙ্গতাই মানুষকে বাউল করে। কবিও বাউল হন। সর্বভূতেই নিজেকে দেখতে পান। তখন বলেন :

“এইভাবে 
ডাক দিলে, সাঁই! 
কী হবে বাঁধন দিয়ে, 
যদি মরে যাই…."

মরণ তো বাঁধন মানে না, তা হলে কেন এই মায়া? এই অসার আলোককে তুচ্ছ করে মরমিয়া আত্মিকপথেই কবির বার বার আত্মনিবেদন ।কবিতা স্বয়ংক্রিয় সেই পথেরই অনুগামী অভিযাত্রীর মন্ত্র হয়ে উঠেছে। মারিয়েন উইলিয়ামসনের কথায় বলা যায় :
“The spiritual journey is the unlearning of fear and the acceptance of love." 
(Marianne Williamson) 
অর্থাৎ আধ্যাত্মিক যাত্রা হ'ল ভয়কে প্রকাশ না করা এবং ভালবাসার স্বীকৃতি। অগ্নি বসু ভয়কে সরিয়ে রেখে ভালবাসারই স্বীকৃতি আদায় করেছেন। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এই শেষ লেখাটিতেও তিনি তাঁর বন্ধুদের উদ্দেশে বলেছেন :
“This misty morning is like your arrival, a shiver, and surprise. You haven't forgotten me, O Dear, Dear, Dear.." সেই না ভুলে যাবারই আবেদন এবং স্বীকৃতি উল্লেখযোগ্য হয়ে রইল। 





নিবন্ধ

তিলোত্তমা মজুমদারের উপন্যাসে নারীচরিত্রের জটিলতা
সতীশ বিশ্বাস

নারীবাদের পতাকাবাহী হয়ে নয়, তিলোত্তমা মজুমদারের উপন্যাসে নারীচরিত্রেরা এসেছে খালি হাতে, স্বাভাবিক অবয়বে। তারা কথা বলেছে মানবিক কন্ঠস্বরে। তাদের আচরণে কোথাও ধরা পড়েনি পক্ষপাতিত্বের প্রতি কোন পক্ষপাতিত্ব। লেখিকা নিজেও থেকেছেন অতন্দ্রপ্রহরীর মতো সতর্ক,যাতে নারী লেখিকা বলে নারীচরিত্রের প্রতি বাড়তি সমবেদনা প্রকাশ হয়ে না পড়ে বা পুরুষচরিত্রের প্রতি ধরে না পড়ে কোন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দোষারোপ।
আমাদের আলোচ্য তিলোত্তমা মজুমদারের ‘এসো সেপ্টেম্বর’ উপন্যাসটিতেও সে স্বাক্ষর রেখেছেন লেখিকা। এ উপন্যাসে, আমরা প্রথমেই পাই দুটি নারীচরিত্র অমলা ও কমলা। দুজনেই মিঠুর কাজের মেয়ে। 
অমলার বয়স ২০/২১। তার গায়ে গায়ে ৩টি বাচ্চা। ছেলের বয়স ৪,মেয়ের বয়স ৩ আর ছোট মেয়েটি ২ বছরের।  তার ঘরে আলো পাখা নেই। হ্যারিকেন জ্বলে।
কমলার বয়সও ২০/২১। একটি মেয়ে। ৪ বছরের। নাম পম্পি। সে নার্সারি স্কুলে পড়ে। ধারার বেড়ার বাড়িতে থাকে তারা। টিনের ছাদ,মাটির মেঝে।
কমলা নিজে ক্লাশ সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। বেশ বুদ্ধিমতী। রোজ খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো পড়ে। পত্র পত্রিকা বাড়ি নিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি পারে না; ধীরে ধীরে পড়ে। ক্লাশ সেভেনের বেশি আর পড়তে পারেনি
                                 
কারণ তার বাবার অসুখ হয়েছিল। চাষ কাজ করতে পারত না। যা সামান্য জমিজমা ছিল, তার কিছু মা জ্যাঠার কাছে দিয়েছিল। শর্ত ছিল-চাষবাষ করে তাদের অর্ধেক দেবে। আর বাকি জমি বন্ধক দিল তার বাবার চিকিৎসার জন্য। মাস তিনেক পরে তার বাবা মারা যায়। কমলা তখন এইটুকু। ঘরে পয়সা নেই। তার জ্যাঠা তাদের যথারীতি ঠকিয়েছে। অবশ্য জমি-বন্ধকের  ব্যাপারটা পঞ্চায়েতকে  জানানোয়, হাজার তিনেক টাকা দিয়ে জমিটা তারা  ছাড়াতে পেরেছিল। তবু ঠিকমতো তাদের  খাবার জুটত না। বাধ্য হয়ে তারা শহরে আসার কথা ভাবল ।  তাদের দেশের লোক যারা এখানে ছিল,তাদের ধরে একদিন চলে এল শহরে ।
শহরে এসে,তার মা ৩ বাড়ি রান্নার কাজ নিল। তাকেও ৩ বাড়ি বাসন মাজার কাজে ঢুকিয়ে দিল। মা সেই কোথায় কোথায় যেত রান্না করতে। গ্রাম থেকে এসেছে। রাস্তাঘাট ভাল চেনে না। একদিন হারিয়েও গেছিল। এমত অবস্থায়, কমলার হল সাংঘাতিক অসুখ। কিছুতেই আর সারে না! অথৈ নদীতে পড়ে যায় তার মা। যেসব বাড়িতে রান্নার কাজ করত, তাদের এক বাড়ির দাদু দিদা খুব ভাল মানুষ ছিল। ওরা পয়সা দিল মাকে। ডাক্তার দেখিয়ে, মা কমলাকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তোলে। তারপর স্থির করল- এবার অন্যদের বাড়ি বাড়ি তার কাজ করা বন্ধ করে দেবে। কমলাকে ওর মা বলল, ‘তোকে আর দশ বাড়ি কাজ করতে হবে না। তুই ঐ দাদু দিদার কাছে থাক।’ তখন থেকে মিঠুর কাছেই থাকত কমলা। মা সকালে দিয়ে যেত। সারাদিন কাজ করে বিকেলে ফেরার সময় নিয়ে যেত।
তাদের নর্দমার ধারে বাড়ি। বর্ষায় হাঁটু পর্যন্ত জল কাদা। তখন বিছানাতেই রান্না,খাওয়া, শোওয়া। বাড়িওয়ালিকে ভাঙা বেড়া সারিয়ে দিতে বললে দেয় না। বলে, ‘ঘর ছেড়ে চলে যাও’। যদি বলা হয় হাজার টাকা সেলামি নিয়েছ                     
                                   
কেন? তা শুনে বাড়িওয়ালি গজ গজ করে।বলে-বেশি তেল বেড়েছে। অনেকদিন ধরে থাকতে দিলেই এদের তেল বেড়ে যায়। দেব লাথি মেরে তাড়িয়ে। মিঠু কমলার মেয়ের ভর্তির সময় সাহায্য করেছিল। তাকে টাকা জমাতেও  পরামর্শ দেয়।
একদিন হিমাদ্রিস্যার একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসে। মিঠুকে বলে-খুব বিপদে পড়েছে। বাপটা অমানুষ। নেশাখোর। মা মেয়ের খাওয়া জুটছে না। কিছু একটা কর। ইতিহাসে মাস্টার্স। দীপকে বলে একদিনের মধ্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিল মিঠু। চাকরির এই মহার্ঘ্য জমানায় একদিনের মধ্যে কাজ পেয়ে যাওয়া অবিশ্বাস্য। কিন্তু দীপ করেছিল। শুরুতে ৫হাজার দেবে। প্রথম দিন কাজে গিয়েই মিঠুকে ফোন করে জানিয়েছে- সময়টা খুব বেশি। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা।
মিঠু তাকে বোঝায়--হ্যাঁ,৮ ঘন্টার জায়গায় ৯ ঘন্টা। তার তো কাজের কোন অভিজ্ঞতা নেই। তাই ওরা ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে। মাত্র ২৪ ঘন্টায় সে যে একটা চাকরি পেয়ে গেল-সেটা ভাবতে হবে না?। এসব হিসাব না করে তার কাজে মন দেওয়া উচিত।
দিন ১৫ পরে মিঠু শোনে- মেয়েটি কোন কিছু না জানিয়ে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বলেছে- সে নাকি ssc দেবে।    
মিঠু অমলা ও কমলা দুজনার জন্যই ভাবে। অমলার শরীর খারাপ হলে,মিঠূ   
কমলাকে ডেকে বলে-শোন,অমলার কিন্তু কিছুই হয়নি তবু ওকে কোন বেস্পতিবার হাসপাতালে নিয়ে যাও। জিষ্ণু আছে ওখানে। তাছাড়া সরকারি হাসপাতাল খরচ লাগবে না। শুনে ,কমলা চুপ করে থাকে। মিঠু জানতে চায়-তারা যে ঠোঙা বানায়,ওকে নেয়? কমলা উত্তর দেয়- নিতাম এখন শরীর খারাপ বলে আর কাজ করে না।
                                  
-ওকে কাজের মধ্যে রাখ,তাহলেই সেরে উঠবে।
তারপর অমলাকে ডেকে দুজনকে মিঠু বলে- শোন অমলা,আমি আর সাম্য ঠিক করেছি-আগামি ৩ মাস তোমাকে মাসের চাল আর সপ্তাহে ২ কেজি আলু দেব। এর মধ্যে তুমি ভাল করে খাও। সুস্থ হয়ে কাজ ধর।’ তারপর জানতে চায়- মাসে কতটা চাল লাগে তার ও বাচ্চাদের।
-হপ্তাহে ৫ কেজি।
-বেশ,কমলাকে টাকা দিয়ে যাব। ও তোমাকে চাল কিনে দেবে। আর দেখ,বাচ্চা বাড়িও না।
অমলা জানায়-তার অপারেশন করা আছে।
অমলার বর কাছে আছে কিনা জানতে চাইলে অমলা বলে- সে এসেছিল কিন্তু তার অসুখ দেখে পালিয়েছে। সঙ্গে মন্তব্য করে-তার বরটাই আসলে হারামি। নিজেও কাজ করবে না,অমলাকেও শহরে থাকতে দেবে না। বলে দেশে গিয়ে চাষ করবে। নয়তো মধু সংগ্রহ করবে। আর অমলাকে বলে বাগদার  মীন ধরতে। কিন্থ অমলার ভয় করে। কারণ জলে বড় কুমির,কামোট আর সাপ থাকে। ফি-মাসে ওখানে সাপের কামড়ে লোক মারা যাচ্ছে-কী কুমিরে টেনে নিচ্ছে। ও সাফ বলে দিয়েছে-ওখানে যাবে না। এখানেই থাকবে। তাই ওর বর রাগ করে চলে গেছে। মিঠু ওদের দুজনের উপরই খেয়াল রাখে। মানবিকতা।
সাম্য অমলাকে সিগারেট আনতে পাঠালে মিঠু আবার কমলার কাছে অমলার বরের খবর নেয়। কমলা বলে-জানি না। ওর বর আসে নিতো আর।
ওর সংসার চালাবার কথা ভেবেই মিঠূ চাল আলু দেয়। ওর বাপের বাড়ির
অবস্থা খারাপ না। কিন্তু এ ছাড়াও তো আরো খরচ আছে।
                                   
 মিঠু এও জানতে চায়-সে ৩ মাস পরে যখন চাল আর আলু দেওয়া  বন্ধ করে দেবে, তখন ও কী করবে? ‘কাজ খুঁজছে তো?’ কমলা বলে–কী জানি? সেদিন একজন বলল,এক বাড়িতে বাসন মাজবে আর রুটি করবে। ৩০০ টাকা।
–তা,সেখানে কাজ করতে চাইছে না কেন?
-- ওর সময় নেই। এদিকে, আমাকে সারাক্ষণ বলবে-তুই কত টাকা উপায় করিস। তোর বর কত টাকা পায়।
কমলা ঝাঁঝের সঙ্গে বলে-সে তো বলে দিয়েছে- অন্যের দেখে গলা শুকোলে হবে? রোজগার করতে গেলে খাটতে হবে। কমলা বলে-তার কী কম কষ্ট গেছে। যখন তার বিয়ে হল,তখন পম্পির বাবা জন খাটত। কতদিন একবেলা না খেয়ে থেকেছে। ৪ বাড়ি ঠিকে কাজ করত। তার মা ছিল। অনেক ঠেকো দিয়েছে। মিঠুকে এও জানায় যে তার বাড়িতে এই যে কাজ করছে, তাতেও অমলা হিংসা করে। মিঠুর দুশ্চিন্তা হয়-ও যদি খাটতে না চায়, তাহলে চালাবে কী করে? পরক্ষণে ভাবে-দেখি এইতো রান্না-পুজো আসছে। ওদের তো খুব বড় করে রান্না-পুজো হয়। গতবার ওরা রান্না-পুজোয় মোচ্ছব করেছিল। ১০০ জন লোক খাইয়েছিল। এবার রান্নাপুজোয় ওর বর হয়ত আসবে। কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। ওর শ্বশুর শাশুড়ি তো কাছেই থাকে। ওই খালের ওধারে। বাবা লোকনাথের মন্দির আছে, সেখানে। ওর বাচ্চাগুলোকে রোজ ওখানে পাঠিয়ে দেয়। মিঠু জিজ্ঞেস করে, পম্পির  যেদিন স্কুল থাকে না,কোথায় থাকে? ও বলে,ওই মায়ের বাড়িতে রেখে আসে,খেলা করে। মুখ নামিয়ে বলে, ‘বেঁধে রেখে আসি।’ এই সলজ্জতার কারণ হল,মিঠু বাচ্চা বেঁধে রাখা পছন্দ করে না। ও যখন মিঠুর কাছে আসে,পম্পি স্কুলে যাওয়া ধরেনি। ও পম্পিকে মিঠুদের ডাইনিং
                                 
টেবিলের পায়ার সঙ্গে বেঁধে কাজ করত। মিঠু খুব বকত। আবার ছেড়ে দিলেই পম্পি সারা বাড়িতে এত দুষ্টুমি করত যে,মিঠুর  আর সাম্যর বিরিক্তির সীমা থাকত না। কমলা পড়ত মুস্কিলে-কাজ করবে না মেয়ে সামলাবে? এখন সেই সঙ্কট নেই। কিন্তু বেঁধে রাখার কাজ ও চালিয়ে যাচ্ছে। ওকে বললাম-কেন বেঁধে রাখ? ও বলে,ভয় লাগে। যদি ছেলেধরা ধরে নিয়ে যায়? অন্য বাচ্চাদের দেখার লোক থাকে,ও তাদের সাথে খেলা করে। কিন্তু সামনে থাকে তো,এখানে ছাড়া পেয়ে ঊর মাটি চুর করে। সামলানো যায় না। তা,ওর হিসু পেলে বা হাগু পেলে,কী করে তখন? ওখানে বলা আছে-দড়ি খুলে দেয়,আবার বেঁধে দেয়।
শহরের তথাকথিত শিক্ষিত মহিলাদের মধ্যেও রয়েছে যত্নে লালিত কুসংস্কার।
মিঠু একদিন দেখে মাকালীর সামনে জবাফুল রাখা। অমলা রেখেছে। কিন্তু সে তো কোণদিন রাখে না। মানুষ সহজাতভাবে রহস্য বিলাসী। অলৌকিককে আঁকড়ে ধরতে চায়। আস্থা রাখে অতিপ্রাকৃতে। মিঠুর মধ্যেও যে তা আছে, সে তা স্বীকার করে। সারা বিশ্বেই চর্চা আছে পরামনোবিদ্যার । প্যারাসাইকোলজির। মিঠু তার জীবনে অসংখ্যবার টেলিপ্যাথির প্রমাণ পেয়েছে। সে ভাবল-তার ফুল দেবার ইচ্ছাতরঙ্গ অমলার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। 

শিল্পী একজন উচ্চবর্গীয় শিক্ষিত মহিলা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তন্ত্রমতে দীক্ষা নিতে সম্মত হয়েছে এক জ্যোতিষার্ণব সতীপুত্রের কাছে। দীক্ষা নেবার পথ সরল নয়। অমাবস্যার রাতে কালীপুজো করে পুজোর আসনে বসে দীক্ষা নিতে হয়। তার জন্য গোপনাঙ্গের চুল লাগে,বুকের রক্ত লাগে।                                       
                                
ঈশ্বর এবং গুরুর কাছে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হতে হয়। এ ছাড়া আরো কিছু
পদ্ধতি। এবার গুরুর আদেশ প্রয়োজন। আদেশ নেবার দিন শুদ্ধ রেশমি বস্ত্র পরতে হবে। শিল্পীও একটা সিল্ক পরে গেছিল। তারপর  জ্যোতিষার্ণবের ঘরে একা বসে থাকে। গুরু অস্থি হাতে নিয়ে দাঁড়ায়। শিল্পী আঁচল ফেলে দেয়। গুরু ক্লিভেজে অস্থি স্পর্শ করায়। নাভীতে, যোনিদেশেও। শিল্পী কাঠ দাঁড়িয়ে টের পাচ্ছে-ওর হাত কাঁপছে। সে ঘামছে। ঠোঁট জিভ শুকিয়ে গেছে। শুকনো জিভে সতীপুত্র শুকনো ঠোঁট চাটছেন। পর্ব শেষ হলে সে আঁচল তোলে। সতীপুত্র বলেন- গুরুর আদেশ পেয়েছি। শুভস্য শীঘ্রম। আগামী মঙ্গলবারই ভাল দিন।
এ উপন্যাসে অমরেন্দ্র সরখেল শিল্পীর বস। তার স্বভাব সবার উপকার করা। সে  শিল্পীকে ভালবাসে। শিল্পীর পরিবারের জন্য নিজে দায়িত্ব নিয়ে সব কিছু  করে। এটা হল আগ্রাসী ভালবাসা। দখলকামী রাক্ষসের প্রেম। শিল্পী সেই প্রেমের কাছে আত্মবিক্রয় করেছে।
এ উপন্যাসে মধুবালা এক বিশেষ চরিত্র। তার মত কাজের লোকের দাম- সারাদিনের জন্য ৩ হাজার টাকা। তবুও প্রশ্ন থাকে সে বিশ্বস্ত হবে কিনা।
একদিন মিঠু,সাম্য ও তার বাবার সংলাপ শোনে। শুনে বুঝতে পারে যে সাম্য কোন ফাইন্যান্স পারসনের কাছে যাচ্ছে যারা ওর বাবার কাছে  রীতিমত কৃতজ্ঞ। মিঠুর হঠাৎ রাগ হল সাম্য কোথায় যাচ্ছে সেটা তাকে না জানাবার জন্য। মিঠু বলল,ইন্টারভু নয়,
-তাহলে তুমি কেন যাচ্ছ?
সাম্য সপাট জবাব দেয়, ‘ শোন এটা নিয়ে আমার এখন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। ঠিক আছে?’
মিঠু চেঁচিয়ে ওঠে- ‘না,ঠিক নেই। তুমি এরকম করতে পার না আমার
                                 

সঙ্গে। কারণ তোমার সমস্ত ভালমন্দের দায় আমিই নিয়ে চলেছি দিনের
পর দিন। তোমার সমস্ত কিছুর সঙ্গে আমার জীবন জড়িয়ে গেছে।’
সাম্য বলে, কোন কাজ হবার আগে সে কারোকে কিছু বলে না। তাহলে ব্যর্থ হয়।
‘কারোকে’শব্দটা শুনেই মিঠু বলে, ‘ আমাকে তুমি রাস্তার দশটা লোকের মতো ট্রিট করবে? কেন আমি কি তোমাকে ঈর্ষা করব? আমাকে বলে যে কাজে তুমি গেছ,সফল হওনি? এটাও তোমাকে ৩ দিন আগে বলেছি।
–না বলনি। কেবল রাস্তার নাম জিজ্ঞেস করেছ। কার কাছে যাচ্ছ,কোথায় যাচ্ছ,কেন যাচ্ছ-কোনটা বলেছ আমাকে?
–বলিনি যখন,বলব না ব্যাস। তোমার ইচ্ছায় আমি চলব না। তুমি আমাকে পুতুলের মতো ব্যবহার কর। তোমার সমস্ত ইচ্ছা তুমি আমার উপর চাপিয়ে দিতে চাও।
-কখনো না। এরকম অভিযোগ করতে পার না তুমি।
পৃথিবীতে কারো উপর আমার ইচ্ছা চাপিয়ে দিই না আমি,কারণ,এটা আমার রীতিবিরুদ্ধ।
–হ্যঁ দাও,তুমি দাও। তুমি প্রচন্ড ডমিনেটিং।
-একজাম্পল দিতে হবে সাম্য।
সাম্য একজাম্পল দেয়-নখ কাটো,চুল কাটো,চুলে শ্যাম্পু দাও-ইত্যাদি।
মিঠু অবাক হয়ে বলে, ‘-এ গুলো তোমার কাছে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?’-অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
তাদের এই প্রায় দৈনন্দিন কথা কাটাকাটির কোন ‘ফুল-স্টপ’ নেই।
একদিন দীপ্তি কাকিমার সঙ্গে মিঠুর যে সংলাপ হয়,তা থেকে উঠে আসে                       
                                   

অন্য দুই শ্রেণীর নারী।
দীপ্তি কাকিমা মিঠূকে জিজ্ঞেস করে-তুমি নাকি রোজ মদ খাও?
মিঠু পত্রপাঠ উত্তর দেয়, ‘ঠিকই বলেছেন। রোজ না হলেও প্রায়ই খাই।
পরক্ষণেই কাকিমাটি ভোল পালটে বলেন, ‘তাতো খেতেই পারো। তার জন্য নিন্দের কী আছে? তোমরা একালে প্যান্ট পরে অফিস যাচ্ছ। রোজ়গার করছ। একটু মদ খেলে দোষের কী আছে?
মিঠু তখন ফিস ফিস করে বলে, ‘একদিন খাবেন নাকি কাকিমা?
-কী?
-হুইস্কি, মানে মদ। আমি খাওয়াতে পারি। মডার্ন জিনিস।  
কাকিমা জানাল-এক সময়ে খেতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কাকু এনে দেননি। উপরন্তু তাকে মারতে বাকি রেখেছিল শুধু। এক সময়ে নাকি কাকিমার নর্তকী হওয়ারও বাসনা ছিল। এমন সময়, ওর ঘরের মধ্যে শাঁখ বাজে। এক ছেলের বৌ ধুনো ঘুরিয়ে যায়। কাকিমা গলায় আঁচল পেচিয়ে প্রণাম সারেন।
আহা! কী অপূর্ব ভারসাম্য!
মিঠু উঠে পড়ে। সঙ্গে নিয়ে যায় সদ্যজাত এই উপলব্ধি- সুখের মধ্যে অসুখ   নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন কাকিমা।
মদ্যপানকে কোন কোন উচ্চবিত্ত পরিবার যে সাধারণ পানীয়ের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে,এই উপন্যাসে তার মজবুত প্রমাণ রয়েছে।
একদিন মাঝরাতে হঠাৎ দেবাশিস ফোন করে মিঠুকে।
মাস তিনেক আগেও সে এসেছিল। মিঠুর মতই সে মদ্যপ্রিয়। মিঠুকে দীপ সিঙ্গাপুর থেকে মদ এনে দিয়েছিল। সেই মদ তিন জনে অর্থাৎ
                                   

দেবাশিস,সাম্য আর মিঠু পান করে।
এদের জীবনের সব সুখ শান্তি এসে স্বেচ্ছায় বোতলবন্দি হয়েছে। আর কোন কিছুতেই এরা এমন তৃপ্তি পায় না।
                                    
অমরেন্দ্র ও শিল্পীর মধ্যে বিচিত্র সম্পর্ক। অমরেন্দ্র সব রকমভাবে সাহায্য করে শিল্পীকে। এ কথা সে মিঠুকে জানায়। শিল্পীকে অমরেন্দ্র মাঝে মাঝে মধুপুর রিসর্টে পৌঁছে দিত।
মিঠু জানতে চায়, ‘আপনি যাননি কখনো?’
–না রিসর্ট আমি পছন্দ করি না। অস্বীকার করব না,আমরা কয়েকবার আমার গেস্ট হাউস গিয়েছি কিন্তু প্রত্যেকবারই শিল্পীর প্রস্তাবে।’ শেষ ২ বছর ধরে।
এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মাঝে মাঝে রিসর্টে যাওয়া এই  শ্রেণীর মানুষের যাপনের অঙ্গবিশেষ।
গত ৫ বছরে শিল্পী ২ বার অনিবার্যভাবে, প্রেগন্যান্ট হয়েছে। মিঠু শুনে অবাক হয়। যদিও অমরেন্দ্র এর জন্য দায়ী ছিল না,তবু শিল্পীকে নিয়ে গিয়ে নার্সিং হোম থেকে সে এ্যাবর্শন করিয়ে নিয়ে এসেছে।
অথচ শিল্পী শশাঙ্ককে ভালবাসে। শশাঙ্কের বিয়ে হয়ে যাবার পরেও শশঙ্ককে পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে মন্দিরে মন্দিরে। কারণ জ্যোতিষী বলেছিল মন্দিরেই ওর সঙ্গে দেখা হবে। সব জেনেও অমরেন্দ্র শিল্পীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তথাকথিত চরিত্র বা দৈহিক শুদ্ধতার এদের কাছে এক কানাকড়িও গুরুত্ব নেই।
একদিন শিল্পীর ফোন পেয়ে মিঠু তার সঙ্গে দেখা করে প্যন্থার-এ। শিল্পী                                                                                                 
                                    ১০
সেদিন খুব সুন্দরভাবে সেজে এসেছে। শিল্পী এমনিতেই বেশ টিপটপ। সুন্দর করে চুল ছেটেছে। সুন্দর শাড়ি পরেছে। বোধহয় স্কিন কেয়ার ট্রিটমেন্ট নিয়েছে কিছু। গালটা মসৃণ লাগছে। সব মিলিয়ে এক ললিত মাধুর্য ওকে জড়িয়ে আছে। ওর ভেতরকার কষ্ট মিঠুকে জানতে দেয় নি।                                 
দিনের পর দিন মিথ্যে বলেছে। আর তার জন্য মিঠুর কোন রাগ হয় নি। কোন অভিমানও নয়। মিঠু ভাবে-সে কি তবে ওর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল? ওর অংশ রইল না আর?
মিঠু অবশ্য জানে- মানবমনের গতিবিধি জটিল। তাই কোন আচরণকেই দীর্ঘ বিচার না করে কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। শিল্পীকে সে তারই অন্য দৈহিক সত্তা ভাবে। এভাবে একটা সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে পারে কজন? শিল্পীর চিঠিগুলো পড়ে তার মনে হয়েছিল-অমরেন্দ্র সরখেল অবুঝ। আধিপত্যকামী ও উপকারী মানুষ। একজন প্রেমিকও। শিল্পী যখন বলে যে তার পুরনো প্রেমিক শশাঙ্ক কাল চ্যাট-এ এসেছিল, মিঠু চমকায় না।  মিঠুর অভিজ্ঞতার পাত্রটি এত পরিপূর্ণ যে আর কোন কিছুতেই সে বিস্মিত হয় না। যদি কাল সাম্য বলে,সে তাকে আর চায় না। বাবার সঙ্গেই থাকবে এখন থেকে,সে কেঁপে উঠবে না।
এক সময় শিল্পী কবি উদ্দালক নন্দী ও শশাঙ্কর সঙ্গে সমান্তরাল প্রেম চালিয়েছিল। উদ্দালকের সঙ্গে যখন শিল্পীর আর ভাল থাকছিল না, তখন ধীরে ধীরে সে শশাঙ্ককে কাছে টেনে নেয়। তবে,এ কথা সে কাউকে বলেনি। এমনকি যার কাছে সে সমস্ত কথাই বলে,সেই মিঠুকেও বলে নি। তারপর একদিন উদ্দালকের সঙ্গে সে সম্পর্কটা ভেঙে দেয়।
এই শ্রেণীর মহিলাদের মধ্যে থাকে স্বাধীনতার প্রতি দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। এই উপন্যাসে তেমন এক চরত্র শিল্পীর বৌদী অঞ্জনা। সে চাকরি করতে                                 
                                 ১১
চায়। দীপের মাধ্যমে মিঠুর চাকরি দেবার ক্ষমতা আছে। শিল্পীর চাকরিটাও মিঠুর মাধ্যমেই হয়েছিল। কিন্তু শিল্পী অদ্ভুতভাবে চায় না অঞ্জনা চাকরি করুক। মিঠু বলে,চাকরিটা যখন অঞ্জনা করবে,তখন অঞ্জনার মতামতটাই চূড়ান্ত। শিল্পী জানায়- এটা তাদের পারিবারিক ব্যাপার ।
চাকরি পাবার আগে কতদিন মিঠু আর শিল্পী একা একা আইসক্রীম ভাগ করে খেয়েছে। আজও খাচ্ছে।  কিন্তু আজ আইস্ক্রীমের এই অংশটায় বোধহয় কোকো বেশি হয়ে গেছিল। ভীষণই তেতো লাগল  মিঠুর। তারা সে সময়ে ভাল পোশাক ব্যবহার করেছে দু জনেই। শিল্পীর দাদার হারিয়ে যাওয়া, মায়ের অসুখ,মৃত্যু,বাবার পক্ষাঘাত, সবেতেই মিঠু ওর বাঁ-গালের তিলটির মতই উপস্থিত ছিল। ওর উদ্দালক,ওর শশাঙ্ক,ওর অমরেন্দ্র –সবাইকে মিঠু ধারণ করেছে ওর হাতের পান্নার আংটিপ মতো। এত হৃদ্যতা ছিল ওদের দুজনের মধ্যে।
মিঠু, আইইসক্রীমের শেষ কাজুটা চিবিয়ে বলে, ‘অঞ্জনা যদি নিজে আমায় বারণ করে,দেখব না।’
- বারণ করবে না। ও স্বাধীন হতে চায়।
-আর তুই ওর স্বাধীনতা চাস না?
‘নারীর যূপকাঠ নারীরই তৈরি ;
আপনা মাংসে-হরিণা বৈরি।’
-তুই আমাদের পরিবারে ভাঙন সৃষ্টি করছিস,মিঠু।
মিঠুর মাথায় রক্ত ছলকায়। প্রচন্ড রাগে কপালের দুপাশের শিরা দপ দপ করে। মিঠূ চাপা কঠিন গলায় বলে, মিঠু শিল্পীর ‘ফালতু সেন্টিমেন্টকে গ্রাহ্য করে না। একটা মেয়ে অথর্ব বৃদ্ধ আর অসহায় শিশুকে নিয়ে থাকছে। শিল্পীর তো কোন কিছুতে কম পড়ছে না।
                                ১২
-আমি বাড়ির জন্যে স্যক্রিফাইস করিনি?
-করেছিস,কিন্তু জীবনকে নিজের মত করে উপভোগও করেছিস। ওর কী আছে? ও কেন নিজের মত করে সাজিয়ে নেবে না ওর জীবন?
-ও যদি জড়িয়ে পড়ে কোথাও,যদি দাদা ফিরে আসে।
- গুণে দেখ-আর কবছর পর শাস্ত্রানুযায়ী দাদার শ্রাদ্ধ করতে হবে তোদের।
-কেউ কারো জন্যে অপেক্ষা করবে কিনা সেটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আর                           
অঞ্জনা তো শুধু একটা চাকরি করতে চায়। কেন তোর এতে আপত্তি? ও যদি নিজেই ওর সন্তানের দায়িত্ত্ব নিতে পারে,তোর নিজেরও কি সুবিধা হয় না?
-চাকরি করলে,ও এবাড়িতে থাকতে পারবে না।
–এ বাড়িতে ওর অধিকার তোর চেয়ে কম নয়।
এ কথার পর আর কথা এগোয় না।
জিষ্ণু ফোন করে জানায়-কাল পিউ রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। সন্ধ্যায় ফিরে এসেছে। সারাদিন কোথায় ছিল বলেনি। কোনও আত্মীয় বাড়ি যায়নি। কবির এসেছিল আজ সন্ধ্যায়। বলল,অপা প্রেগন্যান্ট। অপরাজিতা কবিরকে বলেছিল সে বরকে নিয়ে সুখী নয়। কবিরের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মিঠু বলে,’অসুখী দাম্পত্যও সন্তানের জন্ম দেয়।’ কবিরের গাল বেয়ে অশ্রু নামে। মিঠু বলে,অপরাজিতা ওর বরকে ভালবাসলেও কবিরের প্রতি ওর প্রেম মিথ্যে হয়ে যায় না। মানুষের হৃদয়ে অপার ভালবাসা। একবার দিলেই তা ফুরিয়ে যাবে কেন?
ইতিমধ্যে, সাম্যর ভিসা হয়ে গেছে। অবশ্য এখনো সে হাতে পায়নি। যে কোনদিন কুরিয়ারে চলে আসবে।
মিঠু বসে পড়ে বিছানায়। সাম্য তার মুখোমুখি বসে।  মিঠুর সজল দুটি
                                  ১৩
 চোখ দেখে,সাম্যর মনে হয়-পাসপোর্ট না এলেই ভাল হত।
শেষ হয়ে গেল অগাস্ট মাস। সেপটেম্বর আসছে। এল শরৎ নতুন মাস বা বছর এলে মিঠুর ভাল লাগে। কত কিছু অপেক্ষা করে থাকে একটা নতুন মাস বা বছরের জন্য।
এ উপন্যাসে যা দেখা গেল- এই পুরুষশাসিত সমাজে,মহিলাদের মধ্যে এক অর্থে, কোন প্রভেদ নেই। সবার মধ্যে কম বেশি সেই একই ঈর্ষা-সেই
একই কুসংস্কার, সেই একই নিয়তিকে বিশ্বাস। অমলা,কমলা,মিঠু,শিল্পী, অঞ্জনা সব একাকার। আপাতভাবে বা বাইরে কিছু বিভিন্নতা থাকলেও ভিতরে একই বঞ্চনার,একই নিঃশব্দে বা সশব্দে মেনে নেওয়ার চিরাচরিত
ইতিহাস।  


রাবনের মৃত্যু হয় না

ভাস্কর পাল

বাল্মীকিরআর্য প্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষ বশত শ্রীরামকে প্রদীপ্ত ও রাবণকে হীনপ্রভ করার  চিত্র অংকন করেছেন নিপুণ হাতে রামায়ণের পাতায়। কিন্তু তাঁর তুলির আঁচড়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ পাচ্ছে রাবণের কৌলিন্য, শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আসল কান্তির ছিটেফোঁটা  যার ঔজ্জ্বল্য নায়ক চরিত্রের উজ্জ্বলতার চেয়ে বহুগুণ বেশী উজ্জ্বল ।
রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণ বংশীয়। ব্রাহ্মণ’-এর সাধারণ সংজ্ঞা হলোব্রহ্মাংশে জন্ম যার, অথবা বেদ জানেন যিনি , কিংবা বেদ অধ্যয়ণ করে যে ব্যাক্তি , নতুন ব্রহ্মের উপাসনা করে যেসেই-ই ব্রাহ্মণ। ঋষিগণ সর্বত্রই উক্ত গুণের অধিকারী। তাই ঋষি মাত্রেই ব্রাহ্মণ। রাবণের দাদা পুলস্ত্য ছিলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র এবং স্বনামধন্য ঋষি। কাজেই তিনি ছিলেন বংশে ও গুণে উভয়ত ব্রাহ্মণ। পুলস্ত্য ঋষির পুত্র অর্থাৎ রাবণের পিতা বিশ্রবাও ছিলেন একজন বিশিষ্ট ঋষি। কাজেই তিনিও ছিলেন বংশগত ও গুণগত ব্রাহ্মণ।
রাবনের সৃজনশীলতার পরিচয় পাই  রাবণের রাজমহলের বর্নায় ।রাবনের লঙ্কা ছিল সোনার লঙ্কা ।  বলা হয়েছে স্বর্ণপুরীএতে রাবণের ঐশ্বর্য, শিল্প-নিপুণতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধ ইত্যাদি বহু গুণের পরিচয় মেলে।
অশোক কানন যা ছিলো রাবণের প্রমোদ উদ্যান, যেমন আধুনিক কালের কোনও প্রমোদ উদ্যান। সে বাগানটিতে প্রবেশ করলে কারও শোকতাপ থাকতো না। তাই তার নাম ছিলো অশোক কানন। সে বাগানটির দ্বারা রাবণের সুরুচি ও সৌন্দর্যপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। অধিকন্তু তিনি যে একজন উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ ছিলেন তা-ও জানা যায়। কয়েক  শত জাতের ফল-ফুল ও লতাগুল্মের বৃক্ষরাজির একস্থানে সমাবেশ ঘটিয়ে তা লালন-পালন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রাখা তার সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধ এর পরিচয় ই প্রকাশ করে ।
পৌরাণিক কাহিনির থেকে আমরা জানতে পারি লঙ্কা থেকে ভারতের দণ্ডকারণ্য তথা পঞ্চবটী বনে রাবণ যাতায়াত করেছিলেন পুষ্পকবিমানে আরোহন করে অতি অল্প সময়ে। রাবণ যে একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা বৈমানিক এবং কারিগরিবিদ্যা-বিশারদ ছিলেন এ ব্যাপারে আমাদের বিন্দু মাত্র সন্দেহ হয় না
রাবণ আবিষ্কার করেছিলেন এক অভিনব যুদ্ধাস্ত্র, যার নাম শক্তিশেল, তা শক্তিতে ছিলো ডিনামাইট। নিঃসন্দেহে এতে রাবণের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় মেলে।
রাবণ সে যুগের একজন রাজনীতি-বিশারদ ছিলেন। রামায়ণ মহাকাব্যে রাবণকে বলা হয়েছে দশাননকিন্তু বাস্তবে রাবণের দশটি মাথা নিশ্চয়ই ছিলো না। তবে তাঁর জ্ঞান ছিলো দশটা মাথার সমান। তা-ই রূপকে বিদ্রুপে অংকিত হয়েছে রাবণ দশমুণ্ডুরূপে।

অণু গল্প
অসূয়া
রবীন বসু

সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পর মৌসুমি দেখে গানের স্যার এসে গেছেন। তাদের বসার ঘরে ছোটবোন মৌমিতাকে গান তোলাচ্ছেন। সাধারণত সুদর্শনবাবু এত তাড়াতাড়ি আসেন না, অন্য টিউশন থাকে। কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি কেন? আর একটা ব্যাপারে মৌসুমির খটকা লাগল । মৌ যেন একটু বেশি ক্লোজ হয়েছে স্যারের। ওরা গানে ডুবে ছিল। কেউই মৌসুমিকে খেয়াল করেনি। রবীন্দ্র গানে বিভোর হয়ে ছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।  কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে আর এক শিক্ষার্থীর মনে চলছিল তুমুল আলোড়ন। নাক উঁচু মৌসুমি এতদিন কোন পাত্তাই দেয়নি সুদর্শন স্যারকে। সাদামাটা চেহারার সামান্য এক বেকার গানের গৃহশিক্ষককে কীইবা পাত্তা দেবে। পড়াশোনায় ভালো, ডিস্টিংশন নিয়ে ক্ল্যাসিক্যালে বি-মিউজিক পাশ করা মৌসুমির মনে কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য ভাবের উদয়। সে ছোটবোনের প্রতি জেলাস হল। অসূয়াপূর্ণ গলায় বলে উঠল, সেকি স্যার, আপনি আজ এত তাড়াতাড়ি?
গান বন্ধ হয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে সুদর্শন স্যার দেখেন মৌসুমিকে।
---হ্যাঁ, আজ একটু তাড়াতাড়িই এসেছি। আগামী কাল মৌমিতার স্কুলে শিক্ষক দিবস। ওকে একক এবং সমবেত ভাবে অনেকগুলো গান গাইতে হবে। তাই আজ ওকে একটু বেশি সময় নিয়ে গানগুলো তুলে দিতে তাড়াতাড়ি এসেছি।
---সেকি ! আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, কয়েক সপ্তাহ আগে আমার কলেজ সোশ্যাল ছিল, আপনাকে রবিবার আসতে বলেছিলাম, তখন আসেননি তো। মৌসুমির গলায় বিদ্রূপ।
---সেদিন আমার চাকরির ইন্টারভিউ ছিল, তোমাকে বলেও ছিলাম সে কথা। তারপর এসব কথা আসে কেন?

কী এক দুর্বোধ্য না-বোঝানো যন্ত্রণায় মৌসুমি তখন অস্থির। হিসহিসে গলায় বলে, বোনের প্রতি আপনার ফিলিংসটা বোধহয় একটু অন্যরকম স্যার।
---সাট আপ মৌসুমি। অপমানিত সুদর্শনবাবু ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
শান্ত আর নম্র স্বভাবের মৌমিতা দিদির এই ব্যবহারে হতবাক। লজ্জিত। দিদি তার আইডল, তবুও সে কঠিন গলায় বলল, কী বলছিস দিদি? তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ছিঃ!
সে কান্না চেপে একছুটে ভিতরের ঘরে মায়ের কাছে চলে যায়।


সেদিনের পর অপমানিত সুদর্শনবাবু আর গান শেখাতে এ বাড়িতে আসেননি। মৌসুমির অসূয়াভরা হিংস্র মনটা কিছুটা তৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু মৌমিতার সরল আর অমলিন মনে সেদিন তার দিদি যে কাদা লাগিয়েছিল, তার দাগ বেশ গভীর ছিল।


এমনই হয়
দেবায়ন চৌধুরী

দিদিরা এমনই হয় বোধহয়। ভাইফোঁটা দেবার পর পা এগিয়ে বলত- নে এবার প্রণাম কর।আমার লজ্জার মাথা খেয়ে প্রণাম নিতে চেষ্টা করত একাধিকবার।
বিয়ে হয়ে গেছে তখন, যাবার বেলায় আমি আর থাকিনি। ভর বিকেলে শয্যা নিয়েছিলাম। মা বললোকিরে কী হয়েছে? আমি কিছুই না ভেবে বসন্তের দিনে পুজো রঙের আকাশের খোঁজ করছিলাম। দিদিরা প্রতিবার আসবে পুজোয়। দুর্গা যেমন আসে সন্তানদের নিয়ে।
মায়ের পায়ে চিমটি কাটা যায়?   






চন্দনের গন্ধ 
সুদীপ ঘোষাল 

 মাষ্টারমশাই দীনেশবাবু সাদাসিধা মনের মানুষ। একটা সাধারণ প্যান্ট জামা পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ট্রেনে তার নিত্য যাওয়া আসা। ট্রেনে যাওয়ার সময় অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়। তারা হাসি মস্করায় ব্যস্ত থাকে। দীনেশবাবু নিজে জানালার এক কোণে বই নিয়ে বসে পড়েন। তিনি নিজেও অনেক বই লিখেছেন। কলকাতার নামীদামী প্রকাশনা থেকে তাঁর লেখা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাতে তার কোনো অহংকার নেই। ছাত্র ছাত্রীদের কি করে ভালভাবে প্রকৃত মানুষের মত মানুষ করা যায়, এই নিয়ে তাঁর চিন্তা। শিক্ষকতা শুধু পেশা নয় তার সঙ্গে মিশে থাকে বাড়তি দায়ীত্ববোধ। তিনি এইকথা ভাবেন মনে মনে। কি করে সর্বোত্তম সেবা প্রদান করা যায়, এই নিয়েই দিনরাত চিন্তাভাবনা করেন।  স্কুলে পৌঁছান। ঘন্টা পড়ে প্রার্থনা সভার। জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার পরে শুরু হয় ক্লাস। ক্লাসে গিয়ে তিনি কোনোদিন চেয়ারে বসেন না। ছাত্রদের কাছে গিয়ে সমস্যার সমাধান করেন। পড়াশোনার কাজে সাহায্য করেন। স্টাফরুমে বসেন। তারপর কুশল বিনিময়ের পরে তিনি চলে যান ক্লাসে। কোন ক্লাস ফাঁকা আছে রুটিন দেখলেই জানতে পারেন। কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই তাঁর ক্লাসে চলে যান নিয়মিত। টিফিনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটান। সদাহাস্যময় দীনেশবাবু নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। স্কুল থেকে ফেরার পরে নিজের লেখা নিয়ে বসেন। কোনোদিন ভাষাসদনে যান। সেখানে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটান। তারপর বাজার সেরে বাড়িতে ঢোকেন।

---আজকে ঠিক সকাল দশটায় অনুষ্ঠানে আসবেন। আপনাকে কিছু বলতে হবে। 

---- না না আমাকে বক্তা হিসাবে রাখলে হতাশ হবেন।

লোকে বলে, ভরা কলসি ঠগবগ করে না।
জ্ঞানী লোক কথা কম বলেন। তাঁরা প্রচারবিমুখ হন। দীনেশবাবু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কথা কম বলেন কিন্তু কর্মি লোক। লোকের ভাল ছাড়া মন্দ ভাবেন না কোনোদিন। তাঁর স্বভাব দেখলেই সকলের ভাল লেগে যায়।

সকালে নিমকাঠির দাঁতন ব্যবহার করেন। জনশ্রুতি আছে বারোবছর নিমকাঠির ব্যবহারে মুখে চন্দনকাঠের সুবাস হয়। কথা বললেই নাকি সুবাস বেরোয়। শুনে অনেকে নিমকাঠির ব্যবহার করতেন। কিন্তু ঠাকমা বলতেন, শুধু নিমকাঠির ব্যবহার নয়, তার সঙ্গে মানুষকে ভালবাসতে হয়। কারও অমঙ্গল কামনা করতে নেই। মিথ্যা কথা বলতে নেই। তাহলেই মানুষের মুখে সুগন্ধ হয়। এমনকি দেহের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। মানুষ তো দেবতার এক রূপ। 

দীনেশবাবু ছুটির দিনগুলোত ফুটপাতের অসহায় লোকগুলোর জন্য হোটেল থেক ভাত কিনে তাদের হাতে হাতে দেন। তাঁর ইচ্ছে আছে লোকগুলোকে প্রত্যেকদিন একমুঠো করে ভাত দেওয়ার। তিনি সংসারী লোক। তাই এগোতে হবে ধীরে ধীরে। এসব কাজে সবদিক চিন্তাভাবনা করে এগোতে হয়। তিনি ভাবেন, সামাজিক, আর্থিক, আইনগত সমস্ত  দিক দেখে তবেই কাজে নামা প্রয়োজন। 

আজ সকাল সকাল দীনেশবাবু ছেলেকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। ছেলেকে বললেন, পড়তে বোসো বাবু। সকালে পড়া মুখস্থ হয় ভাল। ছেলে বলে, বাবা তোমার মুখে চন্দনের সুন্দর গন্ধ। দীনেশবাবু বলেন, তোমার মুখেও সুন্দর গন্ধ।

রাস্তায়, স্কুলে যেখানেই দীনেশবাবু যাচ্ছেন সকলের মুখেই এক কথা,দীনেশবাবু আর একটু কথা বলুন। আপনার মুখে চন্দনের সুবাস। বসুন বসুন। সকলের আদরে দীনেশবাবু  নিজেও চন্দনের সুবাস অনুভব 
করছেন। একটা শিশু দৌড়ে দীনেশবাবুর কাছে এল চন্দনের সুবাস নিয়ে। দীনেশবাবু শিশুর  কপালে একটা চন্দন সুবাসের চুমু এঁকে দিলেন সস্নেহে.... 


পুজোর গান
রাজর্ষি বর্ধন 

[ ১ ]

তারা সবাই ছুটতে আরম্ভ করে দিয়েছে, খালি পায়ে মাঠের ওপর দিয়ে ! তাদের জামা-কাপড়ে লাগছে চোরকাঁটা, ছোট-ছোট পায়ে লাগছে কাঁদা- তবু তাদের সেদিকে হুশ নেই ! তারা সবাই ছুটতে ব্যস্ত, বেশি দেরী হলে তো সুজন মিত্রকে তো আর দেখাই যাবে না !
তাদের পাশের গ্রাম পলাশডাঙ্গায় প্রত্যেকবছরই পঞ্চমীর দিন পুজো উদ্বোধন করতে অনেক বড়-বড় শিল্পীরা আসেন। এবারে যেমন এসছেন সুজন মিত্র- বাংলার এক নম্বর গায়ক। তার সিনেমার গান লোকের মুখে-মুখে ঘোরে। উদ্বোধনেও গাইবেন, তাই পাশের সব গ্রাম থেকে ছাপিয়ে লোক আসছে।
যারা ছুটছে তারা সংখ্যায় সাত, বয়স তাদের দশ-এগারোর আশেপাশে। তাদের মধ্যে যে সব থেকে জোরে ছুটছে, তার নাম বিজয়, ডাক নাম বিজু। তাদের বস্তিতে তাকে সবাই ‘গায়ক বিজু’ বলে ডাকে ! এইটুকু বয়সেই কি গানের গলা ! তালিম ছাড়াই এমন, তালিম নিলে আর দেখতে হবে না- সবার এরকম মত! কিন্তু বিজুর বাবা কারখানার শ্রমিক, মা লোকের বাড়ি  আয়া! ঠিকমত  খাওয়াই জোটে না, গান শেখা তো তাদের কাছে বিলাসিতারও অধিক !
মঞ্চের সামনে উপচে পড়া ভিড় দেখে বোঝা গেলো যে সুজন মিত্র  এসে পড়েছেন ! একটু পড়েই তার গান আরম্ভ হবে, চারিদিকে কূল ধরানোর জায়গা নেই, এতো লোক ! তারা সবাই মঞ্চের পেছন দিকে গেলো, যদি সেদিক থেকে পৌঁছান যায় !
কিন্তু সেখানে একজন মোটা মতো লোক তাদের আটকাল! সে এই ক্লাবেরই একজন। কি বিশাল চেহারা! বাঁ গালে কাটা দাগ থাকায় আরও ভয়াবহ লাগছে ! গম্ভীর গলায় বলল, “কী চাই?”
বিজু এগিয়ে এসে বলল, “একবার সুজন মিত্রের সাথে-“
“হবে না- চল এখান থেকে !”
বিজু ব্যাকুল হয়ে বলল, “একবার দেখা করেই চলে যাবো! আমিও গান গাই !”
এবার কোন কথা না, সপাটে একট চড় ! বিজু পড়ে যায়! গালকাটা লোকটা বলে, “গান গাস বলে কি মাথা কিনে নিয়েছিস ! ফের যদি এখানে দেখি তো সব কটাকে পুলিশে দেবো ! হা-ঘরের দল যতসব !”
বিজুর গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ে। চারিদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়- সুজনকুমার মঞ্চে উঠেছেন......

[২]

পলাশডাঙ্গার পুজো এবার  পঁচাত্তর বছরে পড়েছে, তাই তাদের আয়োজনও বিশাল ! এবার তাদের দুজন অতিথি আসছে- টালিগঞ্জের এক নম্বর নায়ক কুমারজিৎ আর গায়ক বিজয়কুমার, যাকে দেশের লোক একডাকে চেনে ! এমনও সোনা যাচ্ছে, কুমারজিৎ থাকা সত্ত্বেও সব আলো নিয়ে যাবেন বিজয়কুমার !
মঞ্চ প্রস্তুত, বিজয়কুমার খানিকক্ষণ পড়েই মঞ্চে উঠবেন। লোকেদের ভিড়ে ব্যারিকেড ভেঙ্গে পড়ার জোগাড়! মঞ্চে ওঠার আগে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট গদ্গদ হয়ে বিজয়কুমারের সামনে আসলেন- তিনিও আজ দারুন সেজেছেন! হাতে সোনার চেন, গায়ে গিলে-করা পাঞ্জাবী ! শুধু বাঁ গালের কাটা দাগটাই বেমানান লাগছে !
এককথা-দুকথার পর বিজয়কুমার বললেন, “আমার একটা অনুরোধ রাখতে পারবেন ?”
গদ্গদ ভাবটা বাড়িয়ে প্রেসিডেন্ট বললেন, “নিশ্চয়ই ! এ তো আমার সৌভাগ্য !”
বিজয়কুমার বললেন, “আমার বাচ্চাদের জন্য যে গানটা গাইব, সে সময় এখানকার বস্তির যত ছেলেমেয়ে আছে, তারা যেন মঞ্চের ওপরে থাকে! এটাই আমার অনুরোধ !”
প্রেসিডেন্ট যেন আকাশ থেকে পড়লেন ! থতমত খেয়ে বললেন,”কী বলছেন স্যর! ওরা স্টেজে উঠবে !”
হাল্কা হেসে বিজয়কুমার বললেন, “প্রত্যেকবারই ওরা এসে গলাধাক্কা খাবে, এমনটাও কি হতে দেওয়া যায়!”
প্রেসিডেন্ট বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন, এদিকে দর্শকের সমবেত চিৎকার আকাশ ছাপিয়ে যেতে লাগল……
                    
লখিন্দরের বাসরঘর
অরিন্দম গোস্বামী
                         
  আমাদের বাড়ির চারপাশে তিনটে পুকুর । দুশো মিটার রেডিয়াসের মধ্যে আরও দুটো ।
  বছরে ন'মাস আমরা নানান উৎসবে-অনুষ্ঠানে , পুজোর ফুল-বিগ্রহ ভাসাতে পুকুরগুলোর কাছে যাই । বাকি তিনমাস পুকুরগুলোই এগিয়ে এসে আমাদের খোঁজখবর নেয় । বাড়ির কাছে এসে কলকল করে কথা বলে । কখনো কখনো উৎসাহ পেলে গ‍্যারেজে এমনকি বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়েও গল্প করতে আসে ।
  পুকুরগুলো রাস্তায় এলেই আমাদের বাড়ির পেছনের গলির নাড়ু , পুণ্যি আর তাড়ুদের যেন উৎসব শুরু হয়ে যায় । মাথায় পলিব‍্যাগ জড়িয়ে আর হাতে তিনকোনা দেড়-দুহাত মশারি লাগানো জাল হাতে ওরাও নেমে পড়ে ।
  প্রথম বৃষ্টিতে অবশ্য আমি নিজেও পাড়ার লোকজনকে দেখিয়ে আমাদের বাড়ির গেটের সামনের সিলি পয়েন্টে দাড়িয়ে ভাইপো-ভাইজিদের নিয়ে ভিজে ভিজে হুল্লোড় করি । তারপর পুরোদমে বর্ষা এসে গেলে আমি ফিল্ডিং করতে ফিরে যাই সামনের বারান্দার গ্রিলের পেছনে আমার পরিচিত পজিশনে ।
   কিন্তু এবারের নিম্নচাপের যেন ইন্দোনেশিয়া থেকে কী একটা নামকরণ  হয়েছে । দেখেছি এইসব বিদেশি নামের ঝড়ঝঞ্ঝা খবরের কাগজে বেশ কয়েকদিনের আগে জায়গা ছাড়ে না । গতকাল ওর মধ্যেই ভিজেভিজে হপ্তার বাজারটা করে এনেছি - আর এসেই ঠিক করেছি হাতে এখনো ছ'টা সি-এল যখন আছে তখন আর নো চিন্তা।  
আজকে সকালে দেখেছি বারান্দায় এসেই নাড়ু আর তাড়ু জাল হাতে ওপেন করতে রাস্তায় নেমে পড়েছে । আমি বললাম - কি রে স্কুলে যাবি না ? ওরা বললো , স্কুল ? সে এখন একমাসের জন্য নিশ্চিন্দি ! লোকজন ঢুকে পড়েছে ! কাল থেকে খিচুড়ি বিলোবে  বলছিলো বটে টিভিতে , কিন্তু এটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটবে,মাথাতেই আসেনি।
সে যাক গে! বললাম , মাছ পেলি ? বললো, পেলে তোমাকে দেখাব।
  দুপুরবেলায় খেতে বসেছি , দুই মূর্তিমান বেল বাজিয়ে এসে হাজির । বললো - পেয়েছি , দুটো ফলুই , তিনটে ল‍্যাটা আর গোটাকতক তেলাপিয়া ! নেবে ?
  মুহূর্তে পিছনে বৌদির চোখ গোলগোল হয়ে গেলো , চাপা গলায় বললো - খবরদার ! রান্নার লোক সকালেই আসেনি , বিকেলে জল ভেঙে ..... নিলে কিন্তু তোমাকেই বাছতে হবে ।
  আমি পাল্টি খেলাম । বললাম, কতোক্ষণ জলে ভিজেছিস রে ! হাত-পায়ের চামড়ার কী অবস্থা !
  বৌদি কাশির সিরাপের শিশিতে খানিকটা তেল দিয়ে বললেন - বাড়িতে গিয়ে ভালো করে তেল মেখে স্নান করে নিবি , আর জলে নামবি না ।
  তেলের শিশি ধরে তাড়ু খিকখিক করে হেসে বললো - এইটুকু !
  বৌদি অপ্রস্তুত হয়ে আরও একটু ঢেলে দিলেন । তাড়ু ফিসফিস করে আমাকে বললো - মাখবো না ছাই ! মাছগুলো ভেজে খেতে হবে না !
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে , এমন সময় দেখি ওরা আবার নেমে পড়েছে । ওরা কি আজকে রাতেও ভিজে ভিজে মাছ ধরবে ?
  হাফপ্যান্ট পরে ছাতা নিয়ে নামতে যাবো - বৌদি নো ডেকে দিলেন । বললেন - দরজাটা লাগিয়ে বাইরের আলোটা নিভিয়ে দাও , গরম গরম পকোড়া ভাজছি ।
  - আর হ‍্যা , দরজাটার নিচে ভালো করে কাপড় গুজে দাও - সাপখোপ ঢুকে পড়তে পারে !