Wednesday 27 June 2018

সাহিত্য এখন,আগস্ট সংখ্যা


সম্পাদকীয়

আমাদের দৈনন্দিন যাপনে আমরা বারবার হেরে যাচ্ছি যন্ত্রণার কাছে। আমাদের নানাবিধ ভ্রান্ত  নীতি এবং অদূরদর্শী আচরণের ফল স্বরূপ  অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে প্রকৃতি ,  দীর্ণ হচ্ছে মানব সত্তা। প্রার্থিত শব্দমালা অধরা রয়ে যাচ্ছে কলমে। তবু অনিঃশেষ জটিলতা থেকে মুক্তির হাতিয়ার লেখকের  নির্মোহ পর্যবেক্ষণ , প্রখর অন্তর্দৃষ্টি এবং সর্বোপরি মূল্যবোধ, যা ক্রমশ বিরল থেকে বিরলতর হয়ে উঠেছে আজকের দিনে। তারই অবিরাম খোঁজে  পথ হাঁটছে সাহিত্য এখন।
এবারের সংখ্যায় আছে সাহিত্যিক আফসার আহমেদকে নিয়ে স্মৃতিচারণা, চর্যাপদ নিয়ে একটি বিশেষ প্রবন্ধ,মনের কথা,ভ্রমণ এবং বেশ কয়েকজন কবির কবিতা।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে প্রখ্যাত শিল্পী ড্যান ট্যাং এর ছবি 

স্মৃতিচারণা

নিম্নবর্গ ও মুসলমান সমাজের শক্তিশালী রূপকার


চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

সময়টা সম্ভবত ১৯৮০। দিল্লিতে আফ্রো-এশিয়ান ইয়ং প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোশিয়েসনের একটা সম্মেলন হচ্ছে। কলকাতা থেকে পাঁচজনকে প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক সৌরী ঘটক। কবি অপূর্ব কর, আফসার আহমেদ, কেশব দাস, আমি আর একজন (মনে পড়ছে না নামটা) গিয়েছি। আফসারের 'ঘরগেরস্তি' উপন্যাস সেবারই 'শারদীয় কালান্তর'এ প্রকাশিত হয়েছে। চমকে দিয়েছে আমাদের। উদ্যোক্তা ভীষম সাহানি। বিজ্ঞান ভবনে উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতি আসবেন। আমরা ঢুকতে যাব, বডি সার্চিং হচ্ছে। চারজন পাস করলাম, আটকে গেলেন অপূর্ব কর। তার কোমরে যন্ত্র ছোঁয়ালেই ট্যাক ট্যাক প্যাক প্যাক আওয়াজ করছে। একে একে বস্ত্র উন্মোচন। এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। আমরাও উদ্বিগ্ন। না জানি কোমরে লুকিয়ে ছোরা টোরা এনেছে কিনা! শেষে দেখা গেল,  একটি মাদুলি। তাই দেখে হো হো করে হেসে উঠেছিল অত্যন্ত মৃদুহাসির সাহিত্যিক আফসার। তার পর দু দিন অপূর্ব দার শান্তি ছিলনা রসিক আফসারের চিমটিতে।

সেই আফসার চলে গেল! অবিশ্বাস্য! ফেস বুকে জালালদার পোস্টে জানলাম, বিকেলে চলে গেছে, এস এস কে এমে, একা অভিমানে। লিভারের সমস্যাই নাকি কারণ। 'ঘরগেরস্তি' ছেড়ে সত্যিই নিখোঁজ হল মানুষটা।

গ্রাম থেকে উঠে আসা তরুণ সংখ্যালঘু সাহিত্যিকদের মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল আফসার। যে জীবন আমাদের অচেনা, তাকে শিল্পীত মননে প্রকাশ করে গেছে নিয়ত। বয়সে আমার চেয়ে সামান্য ছোট হলেও সমবয়সী বন্ধু ছিলাম। দীর্ঘদিন রোজগারের সমস্যা, চাকরির স্থায়ীকরণের সমস্যা তাকে সাহিত্যের থেকে দূরে সরাতে পারেনি।

আমার সঙ্গে আলাপ সেই 'পরিচয়' আর 'কালান্তর' পত্রিকার মাধ্যমে। কেশব দা আর আমি তো কালান্তরেই ছিলাম। পরে আফসারের সঙ্গে দেখা হতো বাংলা আকাদেমি চত্বরে। অনেকেই ওকে কাছে পেতে চাইতো, তার মাঝে অল্পবিস্তর কথাই হতে পারতো।

১৯৭৮ সালে ‘‌পরিচয়’‌ পত্রিকায় বাঙালি মুসলমানের বিয়ের গান’‌ নামে একটি লেখা নিয়ে প্রথম এসেছিল‘‌। এই লেখা থেকেই রত্ন চিনে নে পরিচয় সম্পাদক জহুরী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন দেবেশ রায়, অমলেন্দু চক্রবর্তী। অমিতাভ দাশগুপ্ত তাকে নিয়ে এলেন কালান্তর-এ। সেখানে তেতলার ক্যান্টিনে লাল চা আর রুটি তরকারি খেতে খেতে কত আড্ডাই না হয়েছে।

দেবেশ রায় তখন প্রতিক্ষণ এর সম্পাদক। তিনি টেনে নিয়ে এলেন আফসারকে সেখানে। কয়েক বছর কাজও করল। জীবনানন্দ দাশের রচনাবলি খণ্ডে খণ্ডে সম্পাদনা করেন দেবেশ রায়। আফসারের ওপর ভার পড়েছিল জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে জীবনানন্দ-র যাবতীয় লেখা কপি করে নিয়ে আসার। এই কাজটা তাঁর কাছে ছিল একটা বড় অভিজ্ঞতা। তারপর আবার ছোট কাগজে লেখা আর 'যেখানে যা পাই' পেশা।

গত বছর এই মানুষটা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেল ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’ উপন্যাসের জন্য। এই স্বীকৃতি ওর অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল।  ২০১০ সালে একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত 'সেই নিখোঁজ মানুষটা উপন্যা বই হয়ে বেরোয় ২০১-র বইমেলায়। একে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানষ, তায় বাগনানের মতো দূর গ্রামের ছেলে। হয়তো একারণেই শুরুত অল্প কিছু মননশীল পাঠকেরসাড়া পেয়েছিল। সেই উপন্যাসই আফসারকে সাহিত্য আকাদেমি এনে দিলে বহু পাঠকের স্বীকৃত পেল। নিজেও তৃপ্তি পেয়েছিল সাহিত্যের ক্ষেত্রে আপোসহীন আফসার। বলেছিল, "মাথা পেতে এই পুরস্কার গ্রহণ করছি। অনেক পরিশ্রমের স্বীকৃতি পেলাম সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার-এ। এই পুরস্কার আমার পাঠকদের প্রাপ্য।"

তবে প্রকৃত অর্থে এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। প্রথমটি পেয়েছিল ২০০০ সালে, উর্দু কবি কলিম হাজিখের সঙ্গে যৌথভাবে উর্দু উপন্যাস অনুবাদের জন্য। আরেকটি পুরস্কার পেয়েছেন মৃণাল সেনের 'আমার ভুবন' চলচ্চিত্র দর্শকদের থেকে। তাঁর বনজ্যোৎস্না উপন্যাসই মৃণাল সেনের আমার ভুবন।

বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্তঃপুরের কথা বের করে নিয়ে আসতো আফসার, যার অর্থ সূর্য, যে অন্ধকার সরিয়ে প্রকাশ ঘটায়। এই উপন্যাসের পর সে আরও খ্যাতিমান হয়। বইপাড়ায় বাঁধাই ও অন্য কর্মীদের একদিন প্রতিদিনের দুঃখচরি লিখেছে ‘‌খণ্ড বিখণ্ড’‌ উপন্যাসে।

হাওড়া জেলার বাগনান থানার বাইনান কড়িয়া গ্রামে ১৯৫৯-এর ৫ এপ্রিল তার জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা সাহিত্যের স্নাতকোত্তর। পরে বাংলা অ্যাকাডেমিতে যুক্ত হন। মূলতঃ কথাসাহিত্যিক গল্প ও উপন্যাসে সমান দক্ষতা ছিল। প্রবন্ধ ও অনুবাদ কর্মেও ছিলেন সচ্ছল। ৩ খানি গল্পগ্রন্থ, ২২ টি উপন্যাস, প্রবন্ধ ও অনুবাদ গ্রন্থ ছিল বেশ কয়েকটি। নব স্বাক্ষর বয়স্কদের জন্য ও তিনি বই লিখেছেন।

সাহিত্য অ্যাকাডেমি ছাড়াও সোপান পুরস্কার, নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য পুরস্কার সহ রাজ্য স্তরের একাধিক সাহিত্য সন্মানে সন্মানিত হয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য রচনা দ্বিতীয় বিবি, প্রেমপত্র, ধানজোৎস্না ও ব্যাথা খুজে আনা,  হত্যার প্রমোদ জানি ইত্যাদি। তিনি ২০০৮ সালে নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার পান।

কিসসা লেখায় মাহির ছিল আফসার। বিবির মিথ্যা তালাক, মেটিয়াব্রুজের কিসসা, হিরে ও ভিখারিনী সুন্দরী রমণী কিসসা, এক আশ্চর্য বশীকরণ কিসসা, ‌তালাকের বিবি ও ‌হলুদ পাখির কিস্‌সা’ তার স্বাক্ষ্য বহন করছে।
অমর মিত্র বলেছেন, এই কিস্‌সা সিরিজ বাংলা উপন্যাসে একটি আধুনিক যাত্রাপথ, যা আফসারই খুঁজে বের করেছে। প্রচলিত লোককাহিনী, কিংবদন্তি, নানারকম কিস্‌সা— এগুলোকে অসম্ভব ভালভাবে ব্যবহার করেছে। তার কিসসা পড়ে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অমর মিত্রকে বলেছিলেন, আফসার আমেদ এক উদার মানবিক লেখক এবং নিম্নবর্গের মানুষ, মুসলমান সমাজের অসামান্য রূপকার।‌
( লেখক কবি ও সাংবাদিক)

প্রবন্ধ

চর্যাপদ বিতর্ক :

কেন এটা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন নয়!


জাহাঙ্গীর হোসেন

বাঙলা সাহিত্যের একজন ক্ষুদে শিক্ষার্থী হিসেবে জেনে এসেছি, পড়ে এসেছি, শুনে এসেছি, বলে এসেছি এবং পরীক্ষায় খাতায় লিখে এসেছি "চর্যাপদ হচ্ছে বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন ও ১ম নির্দশন" এবং এর ভাষা বাংলা। আমাদের এপার বাংলা আর ওপার বাংলার প্রায় সকল পন্ডিতগণ বলে গেছেন যে, "চর্যা বাঙলা ভাষার প্রাচীন নির্শন" যা মুখস্ত করে পরীক্ষা পাশ করেছি আমরা সকলে। কিন্তু চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, এটা বাংলা ভাষাভাষীরা ছাড়া আর কি কেউ বিশ্বাস করে? হিন্দি ভাষিকরা, অসমিয়ারা, উড়িয়ারা, নেপালিরা, বিহারিরা, তিব্বতি পন্ডিতগণ? না, কেউ বিশ্বাস করেনা যে চর্যার ভাষা বাংলা। কারণ আমরা তেমন কোন প্রমাণ দিতে পারিনি যে, চর্যা বাঙলাতে রচিত। এমনি দাবি করে মগহি, ভোজপুরিয়া আর নেওয়ারিরাও। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়চন্দ্র মজুমদার চর্যার কবিতাগুলির সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্বন্ধের দাবি পুরো নস্যাৎ করার চেষ্টা করেন নানাবিধ যুক্তি দিয়ে।
:
ব্যাকরণে না জানা তত্ত্বকে যেমন "নিপাতনে সিদ্ধ" বলে ধামাচাপা দেয়ার একটা রীতি প্রচলিত আছে, তেমনি চর্যার ভাষাকে বাংলা প্রমাণ করতে না পেরে আমাদের পন্ডিতগণ বলে গেছেন - "আলো আঁধারি ভাষা", "সান্ধ্য ভাষা", "প্রহেলিকাময় ভাষা" আরো কত কি? একজন বাঙালি ও বাংলা ভাষিক মানুষ হিসেবে চর্যা বাংলা ভাষার প্রাচীন নির্দশন হলে, ৭ম/৮ম বা নবম শতাব্দিতে বাংলা ভাষার কোন নিদর্শন পাওয়া গেলে খুব খুশি হতাম আমি। কিন্তু আমার ধারণা বাঙলা ভাষার আদি নির্দশন নয় চর্যাপদ। অসমিয়া, হিন্দি, নেপালি,ওড়িয়া, বিহারি, মৈথিলি ও তিব্বতি ভাষাবিদগণ চর্যাকে তাদের নিজ নিজ ভাষার বলে দাবী করেন। আমার কাছে তাদের দাবীকে অযৌক্তিক বলে মনে হয় না অন্তত বাঙালির দাবীর চেয়ে। যা নিচে বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানিক পরিমন্ডলে!
:
যুক্তি-১ : প্রাপ্তিস্থান
-----------------------
নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালার "অভিলিপিশালায়" পাওয়া যায় বাংলা দাবীকৃত চর্যার পুঁথি। এটা যদি বাংলা হতো, তবে পূর্ব বা পশ্চিম বাংলার কোথাও না পেয়ে নেপালে কেন পাওয়া গেল, তা যৌক্তিক প্রশ্ন নয় কি? নেপাল রাজদরবারে কোন বাংলা কবি কখনো ছিলেন এমন কথা ইতিহাস প্রমাণ করেনা। হুমায়ুন আজাদের লেখা ৫০০/৬০০ বছর পর বাঙলা অঞ্চলে না পেয়ে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে কি পাওয়া যাবে? কিংবা টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জের এ কালের কবি "ওতি মারাতুর" কাব্যগন্থ কি মিলবে ৬০০ বছর পর বীরভূম বা দিনাজপুরে? তাই হয়তো শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাই অঞ্চল থেকে এই ধরণের শতাধিক "নেপালি ভাষার" পদ উদ্ধার করেছেন ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে।
:
যুক্তি-২ : চর্যার কবিদের নাম
-----------------------------------
লক্ষ্যণীয় চর্যার কবিদের নাম। ঢেণ্ঢণ পা, চাটিল পা, ভুসুকু পা, লুই পা, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী হচ্ছে চর্যার কবি। বাংলা অঞ্চলে ৭ম/৮ম বা নবম শতাব্দীতে কি কখনো ছিল এমন নাম? না তখন ছিল, না এখন আছে! বাঙালিদের নাম কখনো এমন ছিলনা। হ্যা নেপালে পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে এখনো ঢেণ্ঢণ, চাটিল, ভুসুকু, লুই, গুণ্ডরী, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, দারিক, ভাদে প্রভৃতি নাম বিদ্যমান। সুতরাং ধরা যেতে পারে এ কবিরা কেউ বরিশাল, মালদহ, ঢাকা কিংবা বর্ধমানের ছিলনা। কবিরা কেউ কেউ ঝাড়খন্ড, বিহার,নেপালের অধিবাসি ছিলেন বলে মানা যেতে পারে। তো একজন নেপালি বা বিহারের কবি কেন বাংলাতে চর্যাপদ লিখবেন?
:
যুক্তি-৩ : চর্যার ভাষা
-----------------------------------
চর্যার ভাষাতে কিছু বঙ্গ-কামরুপি শব্দের দেখা মিললেও তসু, জৈসন, জিস, কাঁহি, পুছমি প্রভৃতি অনেক পশ্চিমা অপভ্রংশজাত শব্দ দৃশ্যমান। ভাষাবিদ ম্যাক্সমুলার ‘সন্ধ্যা’ ভাষার অর্থ করেছেন ‘প্রচ্ছন্ন উক্তি’ (‘hidden saying’)। আহ্মে, কাহ্ন, দিঢ় ইত্যাদি এবং ওড়িয়া-সুলভ ‘ল’ (l)-ধ্বনির খোঁজ মিলবে চর্যার পাতায় পাতায়। সুতরাং বাংলা শব্দ কমই বিদ্যমান চর্যাতে। তবে ‘বঙ্গাল দেশ’, ‘পঁউয়া খাল’ (পদ্মানদী), ‘বঙ্গালী ভইলি’ ইত্যাদির উল্লেখ থাকায় এটা বাঙালির রচনা এমনটা পুরো প্রমাণ করেনা। নেপালি বা তিব্বতি কবিরাও এ কথা বলতে পারেন। যেমন আমরা উপমায় "জিপসি রমণী" কিংবা "মরু বেদুইন" বা "কৃষ্ণ সাগর" ইত্যাদি চিত্রকল্প উল্লেখ করি।

যুক্তি-৪ : উপমা জীবনচিত্র
-----------------------------------
উঁচু পর্বতে মযূরপুচ্ছ পরিহিত যে শবরী বালিকার কথা বলা হয়েছে চর্যাতে, যে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় আর গলায় পরে গুঞ্জা ফুলের মালা। ‌‌'গুঞ্জা' নামে কোন ফুল নেই বাংলাতে কিংবা ছিলনা। বাঙালি মেয়েরা চুলে কখনো ময়ূরপুচ্ছ পরেনা, ময়ূর পাওয়া যায়না বাংলা অঞ্চলে। আর সমতল বাংলায় পাহাড় কই? বরং এ দৃশ্য নেপাল, তিব্বত বা ঐ জাতীয় পাহাড়েই হওয়া সম্ভব! বেশির ভাগ চর্যার ডোম-ডোমনি, শবর-শবরী, নিষাদ-কাপালিক এদের কথা বলা হয়েছে। এরা সমতল বাংলার দৃশ্যপটের বাইরে হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
:
যুক্তি-৫ : চর্যার জীবনবোধ ও প্রজ্ঞাময়তা
--------------------------------------------------
বাঙালিরা যখন মধ্যযুগে মাত করেছিল "রূপবান রহিম বাদশা তাজেলের কিসসা" কিংবা "গহর বাদশা বানেছা পরীর" রূপকথায়, "রাখালের পিঠাগাছের" গল্পের বাইরে যখন বাঙালির চিন্তন ছিলনা, তখন কিভাবে চর্যার মত এতো উচ্চমার্গের সাহিত্য রচিত হতে পারে বাঙালির হাতে! চর্যার কবিরা যুক্তিবাদী ও মননধর্মী নির্ধামিক নাস্তিক ছিলেন বলে উপমা-রূপকের ব্যবহারে চমকপ্রদ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন অতলান্তিক নিপুণতায়। তাঁদের রচনাশৈলী শিল্পসৌকর্যের অভিমুখী। তাঁদের বাকরীতি সংক্ষিপ্ত, অথচ নিগূঢ় অর্থবাহী। চর্যাপদের লৌকিক জগৎ, উপমা ও রূপক, মানবপ্রেমিক অভোগবাদি ধর্মমত, ভাষাগত বিশেষত্ব এবং এর অনুবৃত্তি এক পুষ্পিত মার্গের চিত্র উপস্থাপন করে। এর আলংকারিক, ভাষিক, কাব্যিক ও দার্শনিক প্রবণতায় রয়েছে কালোত্তর সেই সব লক্ষণ, যা বিভাষী ও বিজাতি হৃদয়কেও অভিভূত করে। চর্যার প্রভাবসঞ্চারী বহুস্তরী অর্থের ব্যঞ্জনা, গভীর কাব্যবোধ, উপমা ও রূপকের আলংকারিক প্রাচুর্য। চর্যাপদের মূল সৌন্দর্য বাচ্যার্থের প্রচ্ছন্নতায়, দার্শনিকতা ও তান্ত্রিক সাধনাকে উপমা ও রূপকের আশ্রয়ে প্রকাশের জটিলতায়। আর এর আত্মা সতত স্পন্দিত কাব্যের সৌন্দর্যবোধে।
:
ডোম্বীপার ১৪নং পদ - "বাহতু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা। সদ্গুরু পাঅ পসাএ জাইব পুণু জিনউরা" মানে "ডোমনি নদী পারাপার করছে, আর তারই মাধ্যমে সহজ সাধনার তীর্থধামে পৌঁছানোর আভাস সূচিত হচ্ছে"। কুক্কুরীপাদের মতে, এক কোটি লোকের মধ্যে একজন চর্যার গূহ্যার্থ অনুধাবনে সক্ষম। চর্যার কথা লৌকিক অর্থের বদলে সংকেতে আবৃত হওয়ায়, তা সর্বসাধারণের বুদ্ধির অগম্য। এর দ্বৈতার্থের কয়েকটি নিদর্শন হলো: নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অর্থে 'চন্দ্র', চিত্ত অর্থে 'হরিণ', জ্ঞানমুদ্রা অর্থে 'হরিণী', মহাসুখকায় অর্থে 'নৌকা', শবরী অর্থে 'দেবী নৈরাত্মা' ইত্যাদি। কাহ্নপার ১০ নং চর্যায় পাই "নগর বাহিরে যে ডোম্নী তোহেরি কুড়িয়া। ছোই ছোই যাইসি ব্রাহ্ম নাড়িয়া। অর্থাৎ রে ডোম্নী নগরের বাইরে তোমার কুঁড়েঘর, ব্রাহ্মণ নেড়াকে তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। আবার সমাজ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদও আধুনিক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চর্যায়। ঢেণ্ঢণের পদে দেখা যায়– “টালত মোর ঘর নাহি পরবেষী। / হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।” অর্থাৎ- "টিলার উপর আমার ঘর, কোনও প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতেও ভাত নেই, তবু নিত্য অতিথি আসে"।
:
চর্যার কোন কোন পদে নিছক দর্শনকথা অসামান্য চিত্ররূপের মাধ্যমে বর্ণিত উঠেছে। চাটিলপা যখন বলেন– “ভবণই গহণগম্ভীরা বেগেঁ বাহী। দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন ঠাহী।” ("ভবনদী গহন ও গম্ভীর অর্থাৎ প্রবল বেগে প্রবহমান। তার দুইতীর কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল")। আবার এ চর্যাতেই কখনও বা তত্ত্বের ব্যাখ্যায় যে প্রহেলিকার অবতারণা করা হয়েছে, সেগুলিও অসামান্য সাহিত্যগুণমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। যেমন: কুক্কুরীপাদের পদ– “দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই। / রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ।।” ("মাদী কাছিম দোহন করে দুধ পাত্রে রাখা যাচ্ছে না। গাছের তেঁতুল কুমিরে খাচ্ছে"।) কাহ্নপাদের দু’টি পঙ্ক্তি- "মন তরূ পাঞ্চ ইন্দি তসু সাহা॥ আসা বহল পাত ফল বাহা"॥ (মন হলো তরু, পঞ্চ ইন্দ্রিয় তার শাখা, আশা বহুবিধ পত্রের ও ফলের বাহক)। আহ! কি নান্দনিক দর্শনতাত্ত্বিক কথা! বাঙালিরা বলেছে এসব? তাহলে এখন বাঙালির বোধে এতো তুচ্ছতা আর ঋণাত্মকতা কেন?
:
চর্যায় কোন যুদ্ধ কিংবা রাজা-রানীর কিসসা নেই, প্রেমাশ্রয়ী; চর্যাপদ সেখানে প্রেম নয়, বরং শরীরী অভিব্যক্তিকে আশ্রয় করেছে তান্ত্রিক সাধনার উপায় হিসেবে। আধুনিক মননের কবি অক্টাবিও পাসের ভাষায় - ‘আমরা যাকে প্রেম বলি, তন্ত্রবাদ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ, তার যৌনকামনা হচ্ছে এক ধরনের ধর্মীয় আচার। ’ (Octavio Paz, Conjunciones y disyunciones, Editorial Joaquin Mortiz, Mexico, Febrero 1986, P 80)। অর্থাৎ প্রেম ও আখ্যাননির্ভরতা, যে সময় প্রায় সব ভাষার ক্ষেত্রেই ছিল ধ্রুবাচার, চর্যাপদ সেই পথ এড়িয়ে প্রবেশ করেছিল দেহের জটিল অরণ্যে, কায়া যেখানে ‘তরুবর পঞ্চবি ডালি’। যেখানে পরস্পর আলিঙ্গনে প্রস্ফুটিত (তিঅড়া চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী), যেখানে একে অপরকে চুম্বন করে কমলরস পানে (তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি) তৃপ্ত হয়। চর্যাপদগুলোতে দেহ ফিরে এসেছে বারবার মানবিক কামজ বাসনা নিয়ে, আর প্রতিবারই তা অর্থের নতুন ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়েছে মানবিক সুখবাদে। হয়তো চর্যার ধর্মমুক্ত কবিদের জন্যেই এমনটা হয়ে থাকবে।
:
শবরপাদের একটি পদে দেখা যায়, নরনারীর প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রায়ণ- "উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী/ মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।/ উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি। /ণিঅ ঘরনি ণামে সহজ সুন্দারী।। /ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী"। যা আধুনিক বাংলাতে বলা যায় - "উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো"। সন্দেহ নেই যে দৈহিক সম্ভোগের বিষয়টি চর্যাগীতিতে এসেছে তান্ত্রিক ঐতিহ্যের সূত্রে, চর্যার কবিরা এক আদিতম দেবতার শরীরী সম্ভোগকে সংস্কারের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, হয়তো তারা মুক্তমনা নাস্তিক ছিলেন বলেই। পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাচীন লিরিকে এমন শরীরী সংরাগ উন্মোচনের নজির দুর্লভ, যা চর্যাতে দিপ্তমান পদে পদে।
:
চর্যাপদ শুধু আধেয়-বৈভবেই নয়, এর আলংকারিক নৈপুণ্য ও বাচনিক কুশলতা বাস্তব ও বিভ্রমকে অভিন্ন কররেখায় দার্শনিক প্রতীতি বয়ানেও কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। চর্যার কবি যখন বলেন, ‘উদক চান্দ জিম সাচ না মিচ্ছা’ (জলের চাঁদ যেমন না সত্য না মিথ্যে), তখন আধুনিক জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ কিংবা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার উপমা উৎপ্রেক্ষাকে এক জলান্তিক দ্যোতনায় উদ্ভাসিত করে। জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতি ও নেতির এক পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসকে বন্ধনের মাধ্যমে চর্যাপদ বাস্তবের অদৃশ্য স্তরকে আবিষ্কারে অগ্রণি ভূমিকা পালন করেছে এর কবিরা। আলংকারিক সৌন্দর্যে মোড়ানো ভাবুকতার বিরল দীপ্তি নক্ষত্রের মতো বিকিরিত হতে দেখি চর্যার শরীর থেকে। চর্যাপদর প্রবাদপ্রতিম একটি পংক্তি হচ্ছে, ‘অপনা মাংসে হরিণা বৈরী’, আরেকটি প্রবাদপ্রতিম নয় কিন্তু আলংকারিক বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ : ‘জোইনি জালে রঅনি পোহাই’। প্রথম উদ্ধৃতিটিতে ব্যক্তির সৌন্দর্য ও দৌলত যে নিজেরই বিনাশের বীজ হয়ে ওঠে তা এই চিত্রকল্পটি অসামান্য সহজতায় তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটিতে আমরা এমন একটি রূপকের মুখোমুখি হচ্ছি, যার কাব্যিক সুষমা আমাদের অভিভূত না করে পারে না।
:
চর্যাপদই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র প্রাচীন কাব্য, যা সরাসরি তান্ত্রিক দর্শনকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল। তান্ত্রিক নিয়মাবলি আড়ালে রেখে দর্শনপ্রবণ হয়ে ওঠার মধ্যে মুক্তি খুঁজেছিল চর্যাপদের কবিরা। যে নিহিলিজম (Nihilism) পশ্চিমে ঊনবিংশ শতকে চিন্তাজগতে আলোড়ন তুলেছিল, তা হয়তো আবিষ্ট করেছিল চর্যাপদের কোনো কোনো কবিকেও, বিশেষ করে সরহপা কিংবা কাহ্নপাকে। চর্যাপদের আরেক কবি কৃষ্ণাচার্যপাদানাম নিহিলিজমকে আরো ব্যাপক ও প্রগাঢ় করে তুলেছেন, যখন তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘স্বপণে মই দেখিল তিহুবণ সুণ,/ঘোরিঅ অবণাগবণ বিহুণ (স্বপ্নে আমি দেখিলাম ত্রিভুবন শূন্য,/ঘুরিয়া আনাগোনা বিহীন)। চর্যাপদ দার্শনিক দৌলতে যতটা ঐশ্বর্যময়, ঠিক ততটাই ঋদ্ধ ভাষা সম্পর্কিত দার্শনিক ভাবুকতায়। এক সমাজ বৈরি কালের উজান ঠেলে চর্যাপদের কবিরা কালোত্তর স্বভাবগুণে সমকালীন হয়ে আছে আজও। সুতরাং এর কবিরা বাঙালি হলে কিভাবে এমন বোধ আর প্রজ্ঞাময়তার মাঝে রচিত হতে পারে "রূপবান চিন্তক" বাঙালি!
:
এবং এই ক্লাসিক জীবন কিংবা শিল্প এবং বৌধ্যিক স্লোগানের শৈল্পিকতার মানদণ্ডে চর্যা অবশ্যই উচ্চমার্গের এক সাহিত্য, যার দেখা পাইনা আমরা পয়ারছন্দের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলাকাব্য, গীতি কবিতা কিংবা ইসুফ জোলেখায়'। সুতরাং বাঙালির প্রাচীন যুগের সাহিত্য শূন্য এ দুঃখের শ্লোকে বাঁধা অতলান্তিক জীবন বৃক্ষকে না ঢাকি আমরা চর্যার মত এক হৃদয়ঘন ভালবাসাময় পাঁচিলঘেরা স্বর্ণদেয়ালে। যে দেয়ালের অলিন্দে হাঁটে চর্যাকে নিজ সম্পদ দাবী করার নষ্ট বীজের ভ্রষ্ট চতুরতা। তাই চর্যাকে বাদ দিয়েই রচিত হোক বাঙলা ভাষা আর বাঙলা সাহিত্য! চর্যাকে থাকতে দেই তার আপন ভুবনে চর্যার মতই!
( লেখক বাংলাদেশ শিক্ষামন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর)

মনের কথা

সারাংশ

সম্পূর্ণা চ্যাটার্জী

             সৌখিন চোখের নীচে একফালি সরু নদী। এমনি চোখেরা নদীমাতৃকই। বড় অল্প সঞ্চয়েও ওর ভেতরে জমে মেঘ। কখনও আবার মেঘের খোঁজে হাপিত্যেশের খরা! নদীতে স্রোতে উল্টেপাল্টে ভেসে যায় কাগজের ছোট ছোট নৌকো। ওগুলো আমার অসমাপ্ত উপন্যাসের পাতা দিয়ে বানানো।  বুঝতে পারিনা, যতোটা লিখেছি সবই  ভুল ? না! কয়েকটা অধ্যায় শুধু কাঁচা রয়ে গেছে! ছিঁড়ে ফেলি ; ওগুলো নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিই জোয়ারে । বয়ে যায় ভেতর থেকে বাইরে।

             নতজানু হয়ে শরীরের কাছে বসে বয়েস হাতড়াই। বলিরেখার গায়ে গায়ে ক্লান্তি জমে আছে। কঠিন পৃথিবীর আঘাত, আঁচড়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নিজের মধ্যে আস্ত একটা পাথর বানিয়ে রেখেছি। বেশ কিছুটা আসতে পারে সবাই। কিন্তু ওই দুর্গম পাথর তারপরে পেরোনো যায়না! ছোট ছোট জঙ্গলে ওটায় অসংখ্য  দুর্বোধ্য গর্ত। কেউ পৌঁছতে পারেনি আজও। আমিই শুধু যাই! বসি বেশ কিছুক্ষণ। তখন নরম সবকিছুতে হাত দিই। ছুঁয়ে দেখি মনটা! আমার ভালোলাগা, উপলব্ধি ঝর্ণার জলে বয়ে যায়! নামিদামী ফুল নয়, অজস্র বুনোফুলের গন্ধ হৃদপিণ্ডে ! উড়ে যায় পাখি, ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুধু বুকে!

             তখন কিছু মুখ ভেসে ওঠে সামনে! যাদের কাছে ছুটে যাইনি কোনোদিন! ওরাও সেভাবে আসেনি।  যাদের জন্য হয়তো করেছি সবচেয়ে কম! ভালোবাসি বলেছি কোনোদিন? না মনে পড়েনা!ওরা আমার আত্মীয়-স্বজন -প্রেম? কিছুই না! কখনও কোনো কথা দিয়েছিল? তাও দেয়নি! তবু মনেমনে নিঃসাড়ে ওদের কাছে গেলে কৃত্রিম গন্ধ পাইনা। তখনই আমার চারপাশটা নিঃস্বার্থ সবকিছুতে ভরে ওঠে। ঝাঁ ঝাঁ রোদ সরে যায়, মাথার ওপর মায়াময় ছায়া! অমন সময় কতোদিন আছে ওদের কোলে রেখেছি মাথা! শুধু জল তখন,  সপসপে হয়ে কোল ভিজিয়ে দিয়েছি! বলেনি কিছু! শুধু পেতে রেখেছে কোল! এগিয়ে দিয়েছে হাত অদৃশ্যে!  জানতে চায়নি সঙ্গে কেন নেই কেউ! এমন পাহাড়ে সন্ধ্যেয় আসেনা তো কেউ কখনও ! সেসময় মুঠো খুলে দেখি, যেখানে যতোটুকু ছিল দিয়ে বসে আছি! ওরা চায়না, আমার তবু দিতে ইচ্ছে করে! অঝোর বর্ষায় ভিজি তখন স্বেচ্ছায় মেঘ ডেকে এনে! নিঃশব্দ কৃতজ্ঞতারা ফোঁটা ফোঁটা জল হয়ে পড়ে সেই ভালোবাসার আঘাতহীন জমি বাড়িগুলোতে।

             কখনও আবার পাথরটা ঠেলে সরিয়ে সরিয়ে দেখি! সেখানে সব কেমন উল্টো! ঝমঝমে বৃষ্টির রাতে খুঁজছি জয় গোস্বামীর একটা প্রেমের  কবিতা!  শরৎচন্দ্রের মেজদিদি পড়তে পড়তে কাঁদছি! একলা চলতে চলতে খুঁজছি অমলিন গল্পের কোনো সঙ্গী ! ঝড়ের রাতে চাঁদকে আগলে নেয়ার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি নিরাপদ কোনো আকাশের খোঁজে! হঠাৎ বুঝতে পারি পা ফসকে গড়িয়ে পড়ছি একটু করে খাদে! ভয় করছে! বাঁচার জন্য খুঁজছি একটা বেয়ে ওঠার মজবুত শিরদাঁড়া! হ্যাঁ, ভয় করে আমারও! ভীষণ ভয় করে! অন্ধকারে ঘুমের ভেতর কতো কতো রাতে গুটিসুটি মেরে বসি। হাতড়াই খালি পাশটায় আঁকড়ে ধরার জন্য!  অসহায় জড়োসড় আমিটাকে বাঁচাব বলে! বাঁচব বলে! এই আমিকে কেউ চেনেনা। কেউ দেখেনি বা দেখতে দিইনি কাউকে! এ সেই দুর্লভ আমি! অকপট আমি!

             তারপরেই আবার পাথরটা ভেতরে এসে আরো চেপে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। কোনোসময় কেউ বলেছিল, "একবার ঠকলে ঠগির দোষ। বারবার ঠকলে দোষী তুমি!" ঠিক তখনই, কেমন একটা পাথর পাথর গন্ধ পাই আবার নিজের মধ্যে। হেসে তাকাই চারিদিকে! আমায় ভরসা করাদের নিশ্চিন্ত করে বলি , 'ভয় কি! এই তো পাশে আছি!' কিম্বা 'আমার জন্য চিন্তা কোরোনা কেউ! আমি একাই সব পারি! ' সেই রোজের আমি! সহজ করে পাওয়া আমি! অপূর্ণ সত্ত্বায় বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ আমি।

               ওই স্বার্থহীন ভালোবাসাদের, চিৎকার করে কোনোদিন বলতে পারবনা, ---' তোমাদের জন্যই অন্ধকার করে আসা ঝড়ের উত্তাল স্রোতেও বেঁচে থাকা নৌকাটার হাল ধরে থাকতে পেরেছি।'  ছোট হয়ে আসা মনগুলোকে স্পষ্ট করে বলতে পারবনা, -- 'মানুষ শুধু পা, হাঁটু আর মগজে ভর দিয়েই চলেনা। মনও চালায়। তাই মনটার একটু যত্ন নিও। ছ্যাৎলা পড়া আকাশে আর বেশিদিন নিঃশ্বাস নেয়া যায়না।' ছোটবেলার মাঠে দৌড়ের সময় পাশে দাঁড়ানো বন্ধুদের বন্ধুই ভেবেছি! দৌড় শুরুর পর পা বাড়িয়ে ছিটকে ফেলে দেয়ার পর যখন প্রথম হয়ে দৌড় শেষ করেছে, কঁকিয়ে যাওয়া যন্ত্রণায় দেখেছি  বন্ধুত্বের চোখে নিখাদ প্রতিদ্বন্দ্বী!!! বিশ্বাস, ভরসা ভেঙে টুকরো করা বন্ধুদের বলতে পারবনা, --- 'সময় বড় নির্দয়! জেতার নেশায় দূরে দাঁড়ানো তোমার হারটা চোখে পড়েনা। কিছু হেরে যাওয়ায় আবার কান্নাটুকু মুছে দেয়ারও বাড়ানো রুমাল পাওয়া যায়না।' শোক আর অনুশোচনার বয়ে যাওয়া মিথ্যের জ্বলন্ত স্তুপদের ফিসফিসিয়ে কানেকানে জানাতে পারবনা,  -- 'আমিও তোমাদের জন্য জ্বালিয়ে রেখেছি নিরুত্তাপ মোমবাতি। যত্ন করে দিয়ে গেছি কবরের সাদা গোলাপ।'  জানতে দেবনা, মানুষজন ভরতি অনুষ্ঠানে বারেবারে ছুঁড়ে দেয়া অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের চোখদুটোকে, --  ' এতো বেশি অন্ধকারে ছিলে দেখতে পাওনি আমার চোখদুটো! কবেই তোমায় ক্ষমায় আর ফিরে দেখিনি! আলো ফিরলে বুঝবে,  সামনের আয়নার সুখের মুখটায় আমারই সব হাসি রেখে গেছি। স্মৃতিচারণে ভেজেনা আর বিরুদ্ধ বর্ষনের ভিটেমাটি। '

            পারব না এগুলো বলতে। পারবনা বলেই আজও হয়তো চারপাশের চকচকে ভিড়টা কতোটা নির্জন তা জেনেও একটু একটু করে এগিয়ে গেছি। আজকাল যে যেমন করে আসে তার মতো করেই তাকে দিয়ে যাই আমি! শুধু ওই না বলা ভালোবাসাদের ছাড়া। জীবনের মঞ্চে সময়ের চিত্রনাট্যে চড়া মেকাপে সবার মতো আমিও  নিখুঁত অভিনেত্রী। সংসার, সম্পর্কে সেরা অভিনয়টাই রোজ করে গেছি।



আমার রাখি

মধুবনী চ্যাটার্জি

গতকাল অনেক রাতে জাহ্নবীর নৃত্য প্রাঙ্গণে প্রদীপের আলোয় জগন্নাথের হাতে রাখী পরিয়ে বড় নিশ্চিন্ত লাগলো এই প্রথম। এতো দিন নানান সম্পর্কে রাখী পরাতে পরাতে কেন যে এতো ক্লান্তি এলো কে জানে।  চিরকাল নির্ভরতার হাতে রাখী বেঁধেছি। সম্পর্কের হাতে নয়। প্রথম রাখীটি থাকতো আমার বন্ধুর জন্য। ওই যে বললাম, নির্ভরতা, বিশ্বাসের সূত্রে বেঁধে সম্পর্ক স্থাপন। আজ বুঝি, মালতী লতার ঝাড় যে সুপুরি গাছটিকে জড়িয়ে উঠে প্রতিদিন ফুল ফুটিয়ে রাখী পরায় পরম বিশ্বাসে , ভরসায় আর নির্ভরতায়, তার মান সুপুরি গাছটি দিতে জানে, মানুষ জানে কই ? রাখী .... কাকে রাখি, কেমন ভাবে রাখি, বিশ্বাসে রাখি না অবিশ্বাসে রাখি, ভালোয় রাখি না মন্দে রাখি , আলোয় রাখি না অন্ধকারে রাখি ..... একেই কি বলে রাখী ??? ভালো মন্দ সব মুখ যাঁর মুখে মিলে গেছে, যিনি আমায় রেখেছেন বিনা শর্তে ,বিনা বিচারে , ওই সুপুরি গাছটির মতন  ধরে রাখেন প্রতি নিয়ত ঝড়ে ঝঞ্ঝায়,  তাঁরই হাতে  কাল গভীর রাতে আমার সব আলো ,সব অন্ধকার রেশমের সুতোয় গেঁথে রাখী বন্ধনে বেঁধে দিলাম।


ভ্রমণ

নিদ্রাহারা_রাতের_এ_গান

        মণিমেখলা মাইতি

                              (আইসল্যাণ্ড)
                              05/06/2018
                                    পর্ব-3

স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একটা বড় বৈশিষ্ট্য দেখলাম শহরের কোন এক অংশে, বিশেষত শহরের পুরানো এলাকায় বেশ কিছু বিভিন্ন রঙের বাড়ি পাশাপাশি হাতধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে স্হানুবৎ। সেগুলো দেখতে একইরকম-- ঢালু ছাদ, দৈর্ঘ্যে-প্রস্হে সমান। কোনটা লাল, কোনটা সবুজ, কোনটা নীল। ঠিক যেন রঙের প্যালেট। তবে কোন দুটো পাশাপাশি বাড়ি একই রঙের নয়। বড্ড চোখের আরাম হয়। ইওরোপের দেশগুলো আমার বেশী ভালো লাগে তাদের মধ্যযুগীয় স্হাপত্যের জন্য। প্রায় প্রত্যেক শহরে old town আছে। সেখানকার সমস্ত সৌধ, বাড়িঘর তাক লাগানো। কেমন এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে সেগুলোর। এত দৃষ্টিনন্দন যে আধুনিক ধাঁচের পেল্লায় পেল্লায় কাঁচ পরিবেষ্টিত ইমারতগুলিকে বড্ড মেকি মনে হয়। মনে পড়ছে  লণ্ডনে টেমস এর বুকে যখন ফেরীতে করে টাওয়ার ব্রিজ যাচ্ছিলাম, গাইড লণ্ডনের  কাঁচের তৈরি 95 তলা আধুনিকতম টাওয়ার 'Shard of Glass' কে লণ্ডনের কুৎসিততম বাড়ি বলে অভিহিত করেছিল অথচ যার স্হপতি ছিলেন রেনজো পিয়ানো।
      রিইকাভিকে বেশকিছু বাড়ি কালো রঙের। তাতে সাদা সাদা জানালা। মন্দ লাগেনা দেখতে। রাস্তা ধরে হাঁটছি। লোকের বেশি আনাগোনা নেই। গাড়ি ছুটছে। পাবলিক বাস কদাচিত দেখা যায়। Directorate of Health এর বাড়ির ছাদটি খুব পছন্দ হল। বেশ অভিনব। একটা গলিতে দেখলাম সবুজ বাদামী খয়েরী রঙের সেই বিখ্যাত স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান স্টাইলে বাড়িঘর।  এখানে রাস্তার এক বৈচিত্র্য আছে। কালো  পিচঢালা নয় একেবারে। সারা রাস্তায় মোজাইকের মত সাদা সাদা ছোট ছোট পাথর যেন উঠে আছে।আস্তে আস্তে সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছি। মিষ্টিন আগে আগে এগোচ্ছে। তার গন্তব্য ডোমিনো'জ। বেচারা পিৎজা খাবে। বেড়ানোর অন্যতম এক মূল আকর্ষণ খাওয়াদাওয়া। ইতালি, লণ্ডনে যেমন এসপ্ল্যানেডের মত ঘনঘন ভারতীয় রেস্তোঁরা যেখানে ভাত, ডাল তরকারি পাওয়া যায়,বাংলাদেশী কর্মচারীভরা সে তুলনায় স্ক্যাণ্ডিনেভিয়া বা ইস্ট ইওরোপে এমন রেস্তোঁরা বেশ কম এবং একটু দূরে দূরে। তাই তথাকথিত সাহেবদের সব অদ্ভুত খাদ্যই আমাদের খাদ্য। বেচারি আর কত সহ্য করতে পারে। গ্রীন ম্যাকডোন্যাল্ড ( যেখানে শুধু চিকেন আর ভেজ পাওয়া যায়। অবশ্য ওদেশে চিকেন ভেজ ক্যাটিগরিতেই পড়ে) দেখলেই বলছে --" মা প্লিজ আর ম্যাক নয়। অথচ কলকাতায় আমাকে জ্বালিয়ে মারে। তাই মাঝে মাঝে ও পিৎজা খেয়ে মুখ পাল্টাচ্ছে। নরওয়ের ভসে(Voss) লোকাল রেস্তোঁরায় এমন একথালা চাঁদের মত বড় পিৎজা দিয়েছিল তা দেখে আমি প্রায় অজ্ঞান হতে বসেছিলুম। কী সাইজ রে বাবা!! যেন আস্ত পূর্ণিমার চাঁদ। মোটেও পিৎজাটিকে গদ্যময় লাগেনি। রেস্তোঁরায় বসে চমৎকার সমুদ্র দেখা যায়। আমি ক্যামেরা হাতে রাস্তা পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে চলে গেলাম।

     খুব সম্ভবত সমুদ্রটা ফাজা বে। ওরা উচ্চারণ করে ফাক্সা বে। খুব সুন্দর এ উপসাগর। তীরের উল্টোদিকে বে এর উত্তর দিক বরাবর সব পাহাড় যেন জলে ভাসছে। মাথায় তাদের বরফের রেখা। গ্রীষ্মের সূচনা হতে দ্রুত বরফ গলে যাচ্ছে। বুঝলাম শীতকালে এ জায়গা কী ছিল!! চোখ ফেরানো যায়না। ফাজা বে র মধ্যে কেমনযেন রহস্য আছে। রিইকাভিকের এও এক জীবন্তসত্বা। শহরের জীবনে সমুদ্রও ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শহরের সুখ- দুঃখের সঙ্গে। হয়তো কোন ক্ষতি করেনা তবে শাসন করে। খুব Aran Island এর কথা মনে পড়ছিল। সেওতো অতলান্তিকের ধারে। অতলান্তিকও সে দ্বীপের ভাগ্য নির্ধারণ করে। সমুদের ধারে বড় বড় পাথর তার মধ্যে বেশ কয়েকটি রংবেরঙের ন্যাচারাল বিশাল বিশাল গ্র্যানাইট। শহরকে তারা সুরক্ষিত রেখেছে।
    সমুদ্রের ধারবরাবর যে রাস্তাটি মেখলার মত রিইকাভিকের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে গেছে তার পোশাকি নাম Saebraut Road. a আর eটা জোড়া। গাড়ি যাওয়ার আপ ডাউন রাস্তা আলাদা। হাঁটার  রাস্তা আলাদা। তার ধারে সবুজ বেঞ্চ পাতা। ইচ্ছে করলে খাওয়াও যায় বসে। তবে রাস্তার ধারে কোন দোকান নেই। শুধু দুচোখ ভরে সমুদ্র দেখতে দেখতে সমুদ্র পাহাড়কে সঙ্গী করে পথচলা। কতজন জগিং করছে। ইওরোপিয়ানদের ঘাম ঝরাতে দেখে কেমন যেন হাঁদাভোঁদা হয়ে গেছি। এজন্যই এরা শারীরিকভাবে অনেক ফিট আমাদের চেয়ে। আকাশ যথারীতি মেঘলা। তবে মাঝে মাঝে মেঘের বুক চিরে সূর্য পাহাড় আর বরফের বিশেষ বিশেষ জায়গায় যে লাইট শো দেখাচ্ছে। পিৎজা খেয়ে শুরু হল আমাদের শহর ভ্রমণ। ম্যাপ বরাবর হাঁটছি।  প্রথম গন্তব্য hofdi।

   Hofdi হল সেই ঐতিহাসিক বাড়ি যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ এর মধ্যে 1986 সালে ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে বিশ্ববিখ্যাত " ঠাণ্ডা লড়াই " এর সমাপ্তি হয়েছিল। এটি আসলে প্রখ্যাত আইসল্যাণ্ডের কবি Einaar Benediktsson এর বসতবাড়ি। বাড়ির একদম সামনে গিয়ে ছবি তুললাম। আমাদের দেশে হলে এতক্ষণে কালো পোশাকের রক্ষী AK 47 নিয়ে তেড়ে আসত। আমি একবার পাকামো করে রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে ব্ল্যাক ক্যাটদের ছবি তুলতে গেছিলাম। আরেকটু হলে বোধহয় ইন্দিরা গান্ধীর মত শহীদ হতাম। রেগন আর গর্বাচেভ বোধহয় অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে চুক্তি করে ফেলেছিলেন। তখন আমরা ছোট ছিলাম কিন্তু বড়রা বেশ ঠাণ্ডা লড়াই নিয়ে অনেক  মতামত দিত একথা মনে আছে। আমাদের মহিষাদলের বাড়িতে নিয়মিত SPAN পত্রিকা আসত American Embassy থেকে। খুব সম্ভবত ওই SPAN এই দেখেছিলাম দুই দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রনায়কের একসঙ্গে বসা ছবি। এমন ঐতিহাসিক বাড়ির দর্শন পাওয়া বেশ ভাগ্যের ব্যাপার।

     হাঁটছি। ঠাণ্ডা হাওয়া নাকে মুখে সূঁচ ফোটাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সামনেই পড়ল The Sun Voyager-- John Arnason এর তৈরি বিশ্ববিখ্যাত প্রতীকী অ্যালুমিনিয়ামের  নৌকো ভাস্কর্য। এ নৌকো স্বাধীনতা, অগ্রগতির প্রতীক। আইসল্যাণ্ডের এ এক অন্যতম দ্রষ্টব্য। যেন যে কোন সময় পাড়ি দেবে অজানিতের পথে। আরেকটু এগোতে পথ আটকাল রঙিন কালো কাঁচের বিশাল বিচিত্র ইমারত HARPA। রিইকাভিকের কনসার্ট হাউস। কীসব রঙবেরঙের কাঁচ। নয়নসুখ নয়। সমুদ্রকে পেছনে ফেলে শহরের পথ ধরলাম। একটু এগোতেই সিটি সেন্টার। হরেকরকম সুন্দর সুন্দর রেস্তোঁরা, ছোট ছোট পার্ক। তাতে নানা স্হাপত্য। বসার জায়গা আছে। লোকেরা খাওয়াদাওয়া সারছে, গল্প করছে। একটা হ্রদের ধারে রিইকাভিকের বড় বড় থামওয়ালা জলের ওপর অবস্থিত টাউন হল। ইওরোপের প্রত্যেকটা শহরের কেন্দ্রস্হলে থাকে বিশাল বিশাল দৃষ্টিনন্দন গথিক স্হাপত্যে তৈরি টাউন হল। যেমন তাদেল গঠনশৈলি তেমন তাদের আকার। রিইকাভিকের টাউন হল আধুনিক। হ্রদের অপরপ্রান্তে বার্চের মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর লাল মাথা একতলাবাড়ি ছবির মত দাঁড়িয়ে। হ্রদের মাঝে সবুজ টিপের মত বড় ক্ষুদ্র এক দ্বীপ মাথা তুলে আছে। হ্রদের মধ্যে ছোট বড় হাঁস। খাওয়ারের লোভে কাছে চলে আসছে। মিষ্টিন শব্দ করে ডাকতে ওরাও ডাকছে। কিছুক্ষণ খেলা চলল এমন। রাস্তার ধারে ধারে নাম না জানা ফুল। বড় বড় সিমেন্টের গামলায় মাটি তৈরী হচ্ছে। গাছ বসবে। কোথাও কোথাও টিউলিপের ঢলাঢলি। হ্রদের ওপাশে ফোয়ারা। পাশেই ন্যাশনাল মিউজিয়াম। ঘড়ির কাঁটায় রাত নটা। দিনের আলোর কোন তফাত নেই। আমরা ফেরার পথ ধরলাম সেই গীর্জাকে ধ্রুবতারা ধরে।

      ফেরার সময় আমার ট্রাউট খাওয়ার কথা Loki তে।  আমাদের দিনের আলোয় তো ঘড়ি দেখার সময় থাকেনা। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁতে যাচ্ছে। ছেলেটি বলল --' sorry, our kitchen is going to be closed shortly'.   ট্রাউটের বিরহে বিরহী যক্ষিণীর মত হোটেলের পথ ধরলাম। সেখানে তখন রাস্তায় স্হানীয় বাচ্চারা জোর ফুটবল খেলছে। খুব মজা করছে। অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে তাপসের কিনে আনা  চালে  ভাত বসিয়ে দিলাম। এবারে এসে এই প্রথম ইওরোপে রান্না বসালাম। আগেরবার এসে সুইৎজারল্যাণ্ডের বিটেনবার্গে বরফঢাকা  আল্পসে সূর্যের অস্তরাগ দেখতে দেখতে রান্না করেছিলাম। এবার উত্তর মেরুতে এসে আমার কাছে ফুটন্ত ভাতের আঘ্রাণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুগন্ধ বলে মনে হল।
                   


                                                     ( ক্রমশ)

কবিতা



কালীপদ

কনিষ্ক দেওঘরিয়া
শক্তি বাবু রাতেই কবিতা লেখেন -
রাতের অন্ধকারে জোনাকীরা বিছানা পাতে
জীবনানন্দ সরণীর গলি থেকে হঠাৎ উধাও কালিপদ -
সেও কোন এক রাতে
অভিশপ্ত বলবো না -
হয়তো জীবন সংগ্রামের বিপর্যয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে বাস্তুতন্ত্র
লড়াই লড়াই লড়াই
কালিপদর নেশাতুর রাত ছিল প্রত্যেকটা সময়
কালিপদ নেশা ধরেছিল
নেশা ধরে রাখতে পারেনি তার উন্মাদনা
রাতের খুঁটিনাটি সব জানে কালিপদ -
কিভাবে কোথায় গেল
শক্তি বাবুও কি জানেন কিছু ?
জানলে ঠিকানা দিন --
পথ ফুরানোর আগে পথে আনবো তাকে ৷৷

নামাঙ্কিত বিদ্রোহী

                      সুনন্দ মন্ডল

বিদ্রোহের কান্ডারী, পুঁতে দেওয়া গাছ
প্রতিবেলা জল ছিটে।
অন্নের প্রতিপালন, বিরুদ্ধ মনের খুপরিতে।
পা ছুঁয়ে জল পানের রীতি সেযুগের মতোই
আমি ও আমার চেতনার গালিচা,
সতেজ বিতর্কের ছায়া থেকে দূরে।
তুমি, একাধিকবার স্মরণে মননে আত্মগোপনে
শিকড় ছড়িয়েছ লাল পাথুরে মাটিতেও!
ভোলাভালা ছন্দ তুলিতে ঝাপরি চুলের বন্দিয়ানায়।
আগুনের ফুলকি, দাবানল প্রতিস্থাপন,
মজ্জায় বিদ্রোহ, সাম্যের পক্ষে লড়াই
বুকের চামড়া ভেদ করে দু'ইঞ্চি নীচে খোদাই।
নীরবের নীতি গিলে ঝড় তোলা সংসার
সেদিন তোমারই পাশে ছিল।
আজও পায়ে পায়ে ফিরে আসো, বিদ্রোহী!
অনুপস্থিতি! কোথায়?
এই তো প্রতি লোমকূপে তোমার নামাঙ্কিত।
প্রতিঘুম ভেঙে দেখি বিদ্রোহের সত্ত্বাধিকারীকে!



           

ভুল আয়না

আর্যতীর্থ

আয়নাটা ভীষণ মিথ্যে কথা বলতে শিখেছে আজকাল।
তাকালেই একটা আধবুড়ো ভাঙাচোরা লোককে দেখা যায়, যার বৈষয়িক চোখে কোনো পাগলামি বেঁচে নেই।
অথচ কাল বিকেলেও ছাতা বন্ধ করে সারা গায়ে বৃষ্টি মেখে আমি পাড়ার সবকটা গাছের সাথে আড্ডা মেরে এসেছি।

 ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে আয়নামানুষটা, প্রেম অপছন্দ করা বুড়োরা যেমন হয় অবিকল তেমন।
 জুঁইফুল গোঁড়ে মালা রাস্তা থেকে  দুম করে কিনলাম গত রবিবার,
স্নান করে কাঁচাপাকা খোঁপায় সে জড়াবে বলে ,
অথচ এইসব ইতিহাস আয়নার ওপারে যায়না কখনো।
নাকি জেনেও না জানার ভান করে সে?

  মনে হয়, রাজনীতির কুটকচালি আর ট্যাক্সের প্যাঁচঘোঁচ ছাড়া ব্যাটা কিছুই বোঝে না।
রোজ বাড়া স্থূলতাকে সন্তর্পণে মেপে নিয়ে যথারীতি ব্যস্তসমস্ত ভাবে চুল আঁচড়ায়,
যেন কোনো কেউকেটা নিয়েছেন পৃথিবীর যাবতীয় দায়।
অথচ এখনো আমি আকাশের মেঘে খুঁজি রবিঠাকুরের আদল,
দুম করে দিনের ঝাঁপ বন্ধ করে চলে যাই নাটক দেখতে কোনো অনামী দলের,
এদিক ওদিক তাকিয়ে গোটা দশেক ফুচকা খেয়ে ফেলি লোভাতুর কোনো বিকেলবেলাতে।
আয়নাটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না এই আসল আমিটাকে।

নাকি আমিই ভুল আয়নায় মুখ দেখছি?

রাত ডেকে যায় 

পিনাকী দত্ত গুপ্ত 

ছায়ার মধ্যে দুলছে ছায়া দুলছে ছায়া, 
বাইরে এখন সন্ধানী চোখ খুঁজছে কাকে? 
অন্ধকারের গভীর কোণে জীর্ণ মায়া 
আমায় যেন দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রাখে 
 এমন সময় ইমামবাড়ার ঘন্টা বাজে, 
ইস্টিশনের লাল বাতিটা দোদুল দোলে, 
রাত বারোটার রেলগাড়িটা শ্রান্ত দেহে, 
পথের শিশু অঘোর ঘুমে মায়ের কোলে... 
পশ্চিমেতে ঘরপোড়াদের কয়েক ভিটে, 
আগুন আঁচে দুলছে দেহ, বাজছে মাদল,
 লাল-মহুয়ার গন্ধ আসে হালকা-মিঠে, 
হঠাৎ যেন মূষলধারে নামল বাদল... 
দরজা খুলে এখন আমি বৃষ্টি মাখি, 
গ্যাসের আলোয় চাঁদটাকে খুব রুগ্ন লাগে, 
দমকা বাতাস হিজল গাছের মগডালেতে 
রাতপ্রহরী প্যাঁচার সাথে রাত্রি জাগে... 
ঠিক তখনি নীল-দিঘিতে চাঁদের ছায়া 
বিমূর্ত এক রত্নাকরের স্বপ্ন আঁকে, 
দূরন্ত এক মৌন-মুখর অরণ্যানী 
অলক্ষ্যে আজ হাত বাড়িয়ে আমায় ডাকে...



পণ্য

দেবেন্দ্রনাথ দাস

বৈশাখী ঝড়ের ঘায়ে আকাশের গায়ে লেগে তার আলুথালু চুলের বিন্যাস
কিছু আগে পশলায় কংসবণিকের ঢং ঢং কাঁসার শব্দ
ধুয়ে গেছে বিশ বাঁও জলে

বিজ্ঞাপনের মেয়ে রাস্তার তে-মাথায় ভিজে গায়ে দাঁড়িয়ে এখনো
তার নাভিকুণ্ডের জল দূর থেকে চেখে নেয় তৃষার্ত ফচকে ছেলেটা
তার চোখে মৈথুন।অসম্ভবের খেলা শুরু হয় রাতে
সেও জানে

দুঃস্বপ্নের কালে কংসবণিক ফিরে গেলে মুছে যায় শব্দের প্রতিটি রণন

ঝলমলে র‍্যাম্পের ক্যাটওয়াক শেষে স্নানঘরে তন্বীরা ধুয়ে ফেলে আঙুলের ছাপ
ক্যামেরার নীল ফ্ল্যাশে তে-মাথার মোড়ে উঁকি দেয় আবেদন
ভিজে অন্তর্বাস
বিকিকিনি শেষ হলে আকাশের গায়ে লেগে থাকে শুধু তার
আলুথালু চুলের বিন্যাস।  





অভিমানী_বৃষ্টি

সৌমি শাঁখারী

দীর্ঘকালীন মেয়াদে বিদায় বড়ো নিঠুর..
বর্ষা পথে অভিমানী মেয়ের চোখের জল রুখে দাঁড়ালো!
কথা দিয়েও মেঘের ভারে নামলো না সে চকিতে..
পদ্মাবতীর গোপন প্রেম ভাঙ্গলো তপ্তবেলায়!
ঝড়ের খেয়া উড়লো অবাধ্য দিশায়..
পাতাদের বুক চিরে আজন্ম লালিতের অভিশাপ বুঝি নামলো!
স্নিগ্ধ স্নানের অপেক্ষায় মুখিয়ে আছে শহরের কোণ মেঘসারিতে..
মানুষের দায়ভার পড়লো হঠাৎ রিক্তবেলায়!
ঘূর্ণি আঁধার মুখ ঢাকে লজ্জায়..
আধো লালিমায় সঙ্গোপনে দাঁড়িয়ে আমার রুখাশুখা বেগবতী চন্দ্রললনা!
সেই কবে প্রবাহমান স্রোতে মিশে গেছে আকুল হাহাকার..
যন্ত্রচালিতের মতো বৃষ্টিকে কানেকানে পাই!
পথ ভুলে অভিমানী কেয়াপাতায় বৃষ্টি..
কোনো বাউলের মনগীতি পারেনা ফেরাতে তার ঘর সংসার!
নিরুত্তাপ দখিনা বায়ুতে মন্দ মিঠে শোক উথলে ওঠে..
বড়ো প্রয়োজন বৃষ্টির আঁখিজল মোছানোর!!


আরও একবার

প্রত্যূষ কর্মকার

চলো আরও একবার হেঁটে আসি লাভা'র পাহাড়ে
ওখানে ঝাউগাছ গুলো মাঝে মাঝে লাল হয়ে আছে
যেন কেউ গোধূলির সূর্য পেয়েছে,বাকিরা বঞ্চিত
তোমার হাত ধরে নেমে যাবো ঝর্ণার ভেতর
চলে যাব লাভা'র ঝুলন্ত সেতুটির কাছে
ওখানে গ্রীষ্মেও শিশির পড়ে,ঘাসে জড়িয়ে থাকে কুয়াশার ওম
আমরা হেঁটে যাব নীলার্দ্র কুয়াশার ভেতর
ভেজা ঠোঁটে নীচু স্বরে বলবো অরণ্য,বলবো সময়,বলবো ঝুঁকে থাকা পাহাড়ের অন্য রকম
এমন গোধূলিতে আমাদের যাত্রাপথের ধারে ধারে
কাঁকড় নয়
বিদ্যুতের ধারালো চমক খেলা করে
পাহাড়ের উপত্যকায় দুলতে থাকে নীলাভ সন্ধ্যা
আমরা পাশাপাশি দুটো জল থইথই মেঘ,বৃষ্টির মত ভিজে পা ফেলি
আমাদের সমস্ত কবিতায় ঝিকমিক করে চাঁদ





যেভাবে আজ বৃষ্টি এলো

শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

যেভাবে আজ বৃষ্টি এলো
ভিজিয়ে দিয়ে গেলো আমার রূপনগরের বাসা
জলীয় কারুকাজ মেলে ঘুরে বেড়ালো খানিক,
এদিক সেদিক চলকে উঠলো তার লীলাপদ্মের বীজ
চশমাটা খুলে রেখে সে চায়ের কাপে ডুবিয়ে দিলো ছলাৎ অধর
কাঁচবয়ামের ঢাকনা খুলে দিল নরম হাতে
ছড়িয়ে দিলো আমার দীর্ঘশ্বাসের পালকগুলো
শ্রাবণ পাড়ের বাঁশিখানা খুলে রাখলো খোঁপা থেকে
গচ্ছিত  রেখে গেল খড়ের বাতায়
তার পায়ের শব্দ গুনতে গুনতে
আকুল হয়ে উঠলো আমার একসা ভেজা গেরস্থালী
তাকে ধরব বলে
অথৈ ঘরের জানলা থেকে ঝুলিয়ে দিলাম স্পর্শনদী
হাতের পাতায় বাড়িয়ে দিলাম সব খোয়ানোর চাবি
দেখল না সে
শুনল না সে
জবুথুবু ডানার থেকে নিষেধ খুলে এগিয়ে গেলাম
খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলাম যোজনগন্ধা মাটির বুকে
দেখলাম, তার আঁচল খসে থমকে আছে নিবিড় ক্ষমায়
দিঘির জলে ঘনিয়ে আছে অসংবৃত মেঘের মতো