বয়সসীমা, নাকি মানসিকতা
মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে ঠিক কোন পরিবর্তনের দিকে জোর দিতে হবে আমাদের?
==============================
অষ্টাদশ শতকে নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট যে গভীর ভাবনা উপলব্ধি করে বলেছিলেন - ‘Give me an educated mother, I will give an educated nation’ আজ ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসে এসে আমাদের মনে হল দেশের মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন। মেয়েদের বিয়ের বয়স চিন্তাভাবনায় দেশ স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আবার নিয়ে এসেছে নারীর মর্যাদা ও তাঁর সম্পর্কে রাষ্ট্রের ভাবনা প্রসঙ্গ।বিয়ের ন্যূনতম বয়স,বিশেষত মহিলাদের জন্য এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে আইন এখন নির্ধারিত রয়েছে সেই অনুযায়ী বিয়ের সর্বনিম্ম বয়স ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১বছর এবং মেয়েদের জন্য ১৮বছর। যদিও ধর্মীয় এবং সামাজিক রক্ষণশীলদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে এই আইনকে। অনেকাংশের আবার মত বয়সের ক্ষেত্রে আইনের উচিত লিঙ্গ-নিরপেক্ষ থাকা। ভারতীয় ম্যারেজ আইন, ১৮৭৫ অনুসারে ১৮ বছর বয়সকে বিবাহের ন্যূনতম বয়স হিসেবে ধরা হয়েছে।
বিগত কয়েক সহস্রাব্দে ভারতীয় নারীর অবস্থা বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে তাদের অবস্থার অবনতি আর কয়েকজন সমাজসংস্কারকের প্রচেষ্টায় তাঁদের সমমর্যাদার অধিকারে উত্তরণের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নারীর অধিকারের অর্ন্তভুক্ত মূল বিষয়গুলি হল সাম্য,মর্যাদা। আজও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা লিঙ্গবৈষম্য ও অপরাধের শিকার।
বৈদিক যুগের আদিপর্বে নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার ভোগ করেছে। পতঞ্জলি বা কাত্যায়ণের মতো প্রাচীণ ভারতীয় বৈয়াকরণের লেখা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে আদি বৈদিক যুগে নারীরা শিক্ষিত ছিলেন। ঋক বেদের শ্লোক থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে নারীরা পরিণত বয়সে বিবাহ করতেন এবং সম্ভবত স্বয়ম্বরা নামক প্রথায় নিজের স্বামী নির্বাচনের বা গান্ধর্ব বিবাহ নামক প্রথায় সহবাসের স্বাধীনতা তাদের ছিল। ঋক বেদ, উপনিষদের মতো আদি গ্রন্থে বহু প্রাজ্ঞ ও ভবিষ্যদ্রষ্টা নারীর উল্লেখ আছে, গার্গী ও মৈত্রেয়ী তাঁদের নাম আমরা জানি।
মধ্যযুগীয় ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থার ভীষণ অবনতি ঘটে এবং বাল্যবিবাহের প্রচলন ও বিধবাদের পুনর্বিবাহের নিষেধাজ্ঞা ভারতে কিছু সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গেই ভারতীয় সমাজে পর্দা প্রথার প্রচলন ঘটে। রাজনৈতিক কারণে হিন্দু ক্ষত্রিয় শাসকদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল।
ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে নারী সম্পর্কে ধারনা অনেকটাই দুর্বল সংস্কারগ্রস্ত পুরুষ নির্ভর পরিবার সত্তা রূপেই ছিল। পরিবারের উন্নতির কথা ভেবেই মেয়েদের জন্য অন্তঃপুরের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সংস্কারপন্থী নব্য শিক্ষিত পুরুষেরা পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে সংগ্রাম করে বাইরের পৃথিবীতে মেয়েদের পরিচিত করে তুলতে চাইলে উনিশ শতক থেকেই অন্তঃপুরের আগল মুক্তির সূচনা হয়। পরবর্তীতে সতীদাহ রদ, বাল্য বিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ আইন তৈরি হল। জনচেতনা বৃদ্ধির ফলে নারীদের উপর থেকে সামাজিক ব্যভিচারের দায়ভার অনেকটাই কমে গেল।1876 এ কাদম্বিনী বসু উচ্চ শিক্ষার জন্য আবেদন করলেন। উনিশ শতকে উচ্চবিত্ত শ্রেণী ইউরোপীয় বিদুষী নারীকে যেরূপ সর্ব গুণান্বিত দেখে এলো বাঙালী মেয়েদেরও তেমনি মেমসাহেব মডেলে গড়ে তুলতে আগ্রহী হলো।
1913 য় শরৎচন্দ্রের “নারীর মূল্য” যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখনও মেয়েদের আপন কথা আপন ভাষায় প্রকাশ করা খুব সহজ ছিল না। আশাপূর্না দেবী যে প্রক্রিয়ার সূচনা দেখেছিলেন,আধুনিক কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত চেয়েছিলেন পুরুষ সর্বস্ব এই পৃথিবী উভলিঙ্গ হোক। সেই সময় লেখিকা মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় নারী আন্দোলনের ইতিহাস ও নারীবাদ শীর্ষকে লিখলেন “সমাজ এতটুকু বদলায়নি, বরং যে সব সুযোগ সুবিধে এখন আমরা পাই যেমন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া, চার দেওয়ালের বাইরে পা বাড়ানো , বিশাল বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা,শিক্ষার অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সেগুলি আমাদের পূর্বসূরীরা অনেক লড়াই করে অর্জন করেছে। সেই পথিকৃৎ দের পথ বেয়েই এযুগের মেয়েরা মেয়েমানুষ থেকে মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে পৌছেছি"।
প্রবাহমান সময়েও বাল্যবিবাহ এবং নাবালিকাদের উপর অত্যাচার এবং তার অতীত সেই ঘটনা রুখতেই বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, আইনে ১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে তাঁকে অবৈধ ঘোষণা করার কথাও বলা রয়েছে। যদিও বাল্যবিবাহকে এখনও আইনানুযায়ী অবৈধ ঘোষণা করা যায়নি।
একথা ভাবতে খুব অবাকই লাগে যে আইনে পুরুষ এবং মহিলাদের বিবাহের জন্য বয়স কেন আলাদা হবে এর কোনও সঠিক যুক্তি নেই। আইনের বেশ কিছু নীতি এবং ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী এই বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে।
বর্তমানে উদ্বেগজনক ভাবে শিশু মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়া ও সাথে মেয়েদের শারীরিক সমস্যার কথা ভেবেই এই আইন বদলানোর বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখা হচ্ছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক গর্ভাবস্থার ঝুঁকি কমাতে নারীদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স বাড়ানোর পক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে। প্রথম পর্যায়ের গর্ভাবস্থা শিশু মৃত্যুর হারের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং মায়ের স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে।
যদি বায়োলজিক্যাল ভাবনায় একজন নারীকে আমরা জানতে চাই তাহলে নারীর দেহ হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি, গোনাড, ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি নিয়ে অন্তক্ষরা প্রজননতন্ত্র গঠিত। সত্যিকারের বয়ঃসন্ধিকে কেন্দ্রীয় বয়ঃসন্ধি হিসেবে অভিহিত করা হয়, কারণ কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে এই পরিবর্তন শুরু হয়।
মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশ জিএনআরএইচ হরমোন ক্ষরণ শুরু করে এবং এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোন ক্ষরণ শুরু হয়, এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোনের প্রভাবে যথাক্রমে ডিম্বাশয় ও শুক্রাশয় কাজ করা শুরু করে। সেই সাথে এরা যথাক্রমে এস্ট্রাডিওল ও টেস্টোস্টেরন উৎপন্ন করা শুরু করে, শরীরে এস্ট্রাডিওল ও টেস্টোস্টেরনের বৃদ্ধি ঘটায় মেয়ে ও ছেলের মাঝে বয়ঃসন্ধিকালীন বৈশিষ্টগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।স্বাভাবিক ভাবেই আঠারোর আগে শারিরীক ও মানসিক কোন দিক দিয়েই একটি মেয়ে বিয়ে এবং গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয় না। আঠারো বছরের আগে যদি মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় তখন তার প্রপার গ্রোথ হয় না। এক্ষেত্রে গর্ভধারণ করলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির শঙ্কা থাকে। যেটি শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি করে। দেখা যাচ্ছে বাল্য বিবাহ মেয়েদের স্বাস্থ্যে সমস্যার পাশাপাশি শিশু মৃত্যুরও অন্যতম কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গর্ভকালীন 37 সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে বা 259 দিনেরও কম সময়ের পূর্বে জন্মগ্রহণ করা শিশুকে প্রিম্যাচিওর কথা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। বিশ্বজুড়ে ২০১০ সালের সমস্ত জীবিত জন্মের আনুমানিক ১১.১% প্রিম্যাচিওর জন্মগ্রহণ করেছিলেন।প্রিম্যাচিওর শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই পূর্ণ-মেয়াদী বাচ্চাদের চেয়ে অনেক ছোট এবং অনেক ওজন দুই পাউন্ডের চেয়েও কম। জন্মের আগে জন্মগ্রহণ, শিশুর অন্যান্য কারণের কারণে মারা যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়ায়, বিশেষত প্রসবকালীন জন্মের সাথে নবজাতক সংক্রমণ থেকে সমস্ত নবজাতকের মৃত্যুর কমপক্ষে ৫০% ঝুঁকির কারণ বলে মনে হয়।
বর্তমানে অনেকটাই বদলেছে বাংলার কিশোরীদের মানসিকতা। অনেক দৃঢ় হয়েছে তাদের চিন্তা। নিজের পায়ে স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ের কথা মাথাতেই আনছে না তাঁরা। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগেও তাদের বিয়ের কোনও ইচ্ছাই নেই। যেখানে সারা দেশে নাবালিকা ও কিশোরীদের বিয়ে দিয়ে পরিবারের লোকজন দায় ঝাড়তে চাইছে, সেখানে বাংলার ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। সবুজসাথী, কন্যাশ্রী ও মাধ্যমিকের আগে ও পরে স্কলারশিপের ফলেই এই পরিবর্তন বলে মনে করা যায়। আমাদের ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ,কেরল, তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ নারী উন্নয়নে এগিয়ে রয়েছে । সবথেকে পিছিয়ে আছে মধ্যপ্রদেশ। নানহি কলি নামক এক সংস্থার করা সমীক্ষায় যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সেখানে দেখা গেছে জেলার ৫৪ শতাংশ এবং কোলকাতার ৭৫ শতাংশ কিশোরী ঋতুকালীন সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নেয়। দেশের ৬০০ টি জেলায় এই সংস্থা কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট তৈরী করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে কোলকাতার ১৩ থেকে ১৯ বছরের মেয়েদের প্রায় ১০০ শতাংশ পড়াশোনা করছে। যেখানে দেশের গড় ৮০। চাকরি করতে আগ্রহী কোলকাতার ৫৯ ও পশ্চিমবঙ্গের ৭১ শতাংশ কিশোরী।
যুগের পরিক্রমায় নারী শিক্ষার গুরুত্ব বর্তমানে অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। নারীর অবস্থান সমাজে চিরকাল ধরেই অবহেলিত। নারীর এই অবস্থান থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা অর্জন করে নারী তার নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে, স্বাস্থ্য সচেতন হবে। তাই নারীর উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক উপাদান হলো নারী শিক্ষা।
নারীকে স্বাবলম্বী হতে হলে কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। কেননা কর্মসংস্থানই নারীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে। নারীর জন্য যুগোপযোগী কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারের একটি পরিবারের সুরক্ষায় একজন শিক্ষিত নারী একটি সুরক্ষিত দুর্গের মতো কাজ করে। কারণ একজন সুশিক্ষিত নারী স্বাস্থ্য সচেতন। একজন সুশিক্ষিত নারী সুরক্ষিত পরিবারের জন্য খুবই প্রয়োজন।
সন্তান জন্মের পর থেকে মায়ের সংস্পর্শেই বেশির ভাগ সময় থাকে। মায়ের আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা সব কিছুই সন্তানকে প্রভাবিত করে। মায়ের হাতে সন্তানের শিক্ষার প্রারম্ভিক আবর্তন। মা যদি শিক্ষিত হন তাহলে সন্তান অবশ্যই শিক্ষিত হবে। একজন নারী শিক্ষিত হওয়ার অর্থ ওই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে ওঠা।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই নারীকে সঠিক মানসিকতায় শিক্ষিত করে এবং শরীর ও স্বাস্থ্যের পরিপূর্ণতা এনেই বিয়ের ভাবনা প্রবাহিত করতে হবে। বর্তমানে একটি সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্য জানিয়েছে বিবাহের জন্য ২৩ বছর হল আদর্শ সময় । এই সময়ে একজন শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে পরবর্তী প্রজন্ম কে ধারণ করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলার জন্য । এক্ষেত্রে দায়িত্ব শুধুই নারীর নয় এই দায়িত্ব সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের,এই দায়িত্ব সমাজের সর্বোপরি দেশের। প্রয়োজন সঠিক আইন যে আইনের ভেতর আইনের ফাঁক থাকবেনা ।তবেই এই বিশাল জনসমষ্টিকে শিক্ষার মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া বর্তমানে সময়ের দাবী। নারীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করলে দেশ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ছবিঃ মঙ্গলদীপ সর্দার
No comments:
Post a Comment