Saturday, 3 October 2020

রাখী নাথ কর্মকার , ছোটগল্প , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 


 

 

চ্যাম্পিয়নশিপ

 

আর তো মোটে একটা মাস...তারপরেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! চারিদিকে কানফাটানো হাততালির শব্দ আর জাতীয় সঙ্গীতের গায়ে কাঁটা দেওয়া সুরেলা, সোনালি মুহুর্তে গলায় সোনার মেডেল ঝুলিয়ে ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে আর কেউ নয়, সোনার মেয়ে বুনাই!      

হ্যাঁ, বুনাইএর শয়নে-স্বপনে-জাগরণে এখন একটাই প্রতীক্ষা-এশিয়ান সাব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ ! অনেক, অনেক কষ্টে মায়ান্মারে এই ট্রিপে যাওয়ার টাকাটা জোগাড় হয়েছে বাবা মুখে কিছু স্পষ্ট করে না বললেও বাবার চোখের কোণে হতাশার নীল ছায়া বুনাইএর নজর এড়ায় নি। একটামাত্র মেয়ে তাঁর, চাহিদাও তার সামান্য  কিন্তু জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তে অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া বোধহয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের আর কিছু করারও থাকে না  একটা ছোটোখাটো প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেন তিনি সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে জীবন থেকে মূল্যবান কিছু মুহূর্ত আর শরীর থেকে অমূল্য কিছু প্রাণশক্তি বাঁধা রাখতে হয় যেখানে  সম্প্রতি মায়ের একটা বড় অপারেশনের পর থেকেই হু হু করে জলের মত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে  আর তার পরে পরেই এই চ্যাম্পয়নশিপের জন্যে এতগুলো টাকা জোগাড় করা-যাতায়াতের খরচ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অনেক খরচই আছে, সেটা খুব একটা কম নয়! নিঃসঙ্গ, আঁধারাচ্ছন্ন রাতে অসহায়ভাবে পথ খুঁজে গেছেন অনিলবাবু বাবার চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ছুঁয়ে গভীর হত।  এক একসময় তো বুনাইএর মনে হচ্ছিল - এমন সুযোগটা এবার বোধহয় হাতছাড়াই হয়ে গেল!                

ক্রমাগত জমতে থাকা বিষণ্ণতার ধূসর বাষ্প যখন বুনাইকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে,  কোথাও একবিন্দু সতেজ বাতাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিল না ও - অফিস থেকে ফিরে এসে অনিলবাবু একদিন আধো আলো, আধো অন্ধকারে এক ঝাঁক জোনাকির মত উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে স্ত্রীকে বলেছিলেন-“দেশের শরিকি জমিটা বিক্রিই করে দেব ভাবছি, বুঝলে! ইচ্ছে-অনিচ্ছের দোলাচলের মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন মিতাদেবী ঐটুকুই তো সম্বল ছিল, ভাড়াবাড়ির অসহায়তার মাঝে ঐ এক্টুকুনি নিশ্চিন্ততার আশ্বাস-সেটুকুও হারিয়ে গেলে… ! পাশের ঘরে হলুদ বাল্বের আলোয় খাটের ওপর বইএর মাঝে মুখ গুঁজে থাকা বুনাইএর মনটা প্রথমে একটু দমে গেলেও পরক্ষণেই মনে হয়েছিল যেন টেনিস রুমের মতই টুপটাপ লাইন দিয়ে ফ্লুরোসেন্ট আলো জ্বলে উঠেছে ঘরের মধ্যে! ভাড়াবাড়ির নোনাধরা দেওয়ালে ছিটকে যাওয়া স্পিড ড্রাইভের একটা আক্রমণাত্মক স্ট্রোক...আর স্ট্রেট সেটে ও হারিয়ে দিতে চলেছে প্রতিপক্ষকে! সেদিন, সেই সন্ধ্যায়, জলভরা চোখে সেই মুহূর্তটাকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে বুনাই ঠিকই করে নিয়েছিল- নাহ, এবার কিছুতেই খালি হাতে ফিরবে না ও               

এমনিতেই এই খেলার জন্যে কম লড়াই করতে হয়নি ওকে  নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অনিলবাবু্র বড় ইচ্ছে ছিল মেয়ে তাঁর ডাক্তার হবে মধ্যমেধার বুনাই পড়াশুনোয় কিন্তু কোনোকালেই খুব একটা আহামরি কিছু ছিল না বুনাইর খুড়তুতো দাদা বুড়োদা টেবিল টেনিস খেলত ওদের পাড়ারই  ক্লাবে কোথা থেকে যেন সে খেলার নেশাটা চারিয়ে গিয়েছিল মেয়েটার মধ্যেও! মিতাদেবীর অসুস্থ বিকেলটা যখন একদলা অন্ধকার হয়ে নেমে আসত অবশ দুচোখের ফাঁকে, একাকী বুনাই স্কুলফেরত তখন প্রায়ই বুড়োদার টিটি ব্যাটবল হাতে বুড়োদারই সঙ্গে ক্লাবে গিয়ে জুটত ! ফলে, যখন তখন গার্জেন কল, ক্লাসটিচারের চোখ রাঙানি ! বাবার বকুনি ! এর মাঝেই ওকে সাহস জুগিয়েছিল ওদের গেমটিচার মিলিন্দস্যারের সাহচর্য  স্যার বলতেন, সব কাজ কিন্তু সবার জন্যে নয়  প্রতিটি শিশুর মধ্যেই কিছু না কিছুর সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছেসেই সম্ভাবনাটিকেই খুঁজে বের করতে হবে, তারপর তাকে চারাগাছের মত যত্ন করে বড় করে তুলতে হবে! মিলিন্দস্যার বাবাকেও সেকথা বুঝিয়েছিলেন নিতান্ত অবুঝ মানুষটাও সেদিন থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন মিলিন্দস্যারের ঐকান্তিক চেষ্টাতেই কম খরচে এই টিটি কোচিং সেন্টারে বড় বড় কোচেদের তত্ত্ববধানে আজ এতোদূর এগোতে পেরেছে ও, এতবড় সুযোগটা আজ ওর সামনে এসেছে !   

আজকাল তাই বেশ কিছুদিন ধরেই ওর জন্মদিনের কেক, পায়েস কিংবা পুজোর পছন্দের জামা-সবেতেই স্বেচ্ছায় বিস্তর কাটাছেঁড়া করে চলেছে মেয়েটা  এমনকি বিভিন্ন ট্যুর্নামেন্টে জেতা প্রাইজমানি যা ও এতদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিল-বড় কোন স্বপ্নের পিছনে খরচ করার জন্যে, সে টাকাও নির্দ্বিধায় বাবার হাতে তুলে দিয়েছে বুনাই  অসুস্থ মায়ের বুকে মাথা রেখে মেয়েটা খুঁজে বেরিয়েছে শুধু একটা  পথের দিশা!   

এখন শুধু সেই স্বপ্নটাকে সফল করার অপেক্ষা দুবছর আগে চেন্নাইতে ইন্টারন্যাশনাল ওপেন টিটিতে ব্রোঞ্জ পেলেও গতবছর ইন্দোরে সাব জুনিয়র সিঙ্গলসে বুনাই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি ওকে। এছাড়াও সিঙ্গলস, ডাবলস, জুনিয়র টিমের বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিক সাফল্যের মধ্যে তো ও আছেই। ও জানে, যত বেশী ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট খেলতে পারবে ও, তত ওর অভিজ্ঞতা বাড়বে সেই সঙ্গে এও জানে, এই হার্ডলটা টপকালে ওর মাথার ছোট্ট মুকুটে যে পালকটা যোগ হবে, সেই পালকের ডানায় ভর করেই ওকে পার হয়ে যেতে পারবে হাজার প্রতিবন্ধকতার কাঁটা তারের বেড়া, বাধার সুউচ্চ পাঁচিলএই চ্যাম্পিয়নশিপটা জিতলে ওর সামনে খুলে যাবে বন্ধ দরজার কপাটগুলো এককালের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন অখিলেশস্যারের কাছে অ্যাডভান্সড কোচিং নেওয়ার সুযোগটা অনেক অনেক সহজ হয়ে যাবে আর অখিলেশ ফাউন্ডেশনের বৃত্তিটার জন্যে যদি একবার মনোনীত হয়ে যেতে পারে-তাহলে আর ওকে পিছনে ফিরে তাকাতেই হবে না!   

                                                                                         

টেবিল টেনিস কোচিং থেকে বাড়ি ফিরেই খাটের ওপর এসে উপুড় হয়ে পড়েছিল ক্লান্ত বুনাই ! মিতাদেবী রান্নাঘরে রাতের রান্নার জোগাড় করছিলেন  অনিলবাবু তখনো অফিস থেকে ফেরেননি          

হঠাৎই খাটের পাশে পড়ে থাকা ছেঁড়া খবরের কাগজের ঠোঙার গায়ে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল বুনাইএর  দিগন্তবিস্তৃত জলছবি বানভাসি ঘোলা জলে খেলনার মত জেগে থাকা বাড়িঘরগুলোর মাথায় দাঁড়িয়ে অধীর অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকটি ছোট ছেলে !      

নীচে ছোট ছোট অক্ষরে সীমাহীন কষ্টের সাতকাহন! গত কয়েকদিনের তুমুল বৃষ্টিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছে  সেখানকার বন্যা পরিস্থিতির টুকরো টুকরো খবর আজ সারা দিন ধরেই কানে আসছিল ওর, যদিও দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে সেসব নিয়ে আর সেভাবে ভাবার সময় পায় নি বুনাই ! কিন্তু পড়ন্ত বিকেলের ঝিমিয়ে আসা আলোয় এই একটা ছবিই যেন ওর সামনে হাজার গল্পের অমনিবাস খুলে দিল !     

ছবিতে অসহায় ছেলেগুলোর কাতর দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ম তীরের ফলার মত! এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় বুকের ভিতরটা পশ্চিম মেদিনীপুর আর হাওড়ার শখানেক কিলোমিটারের ব্যবধান যেন মুহূর্তে ঘুচে যায়  উতলা হয়ে চেয়ে দেখে বুনাই, বাচ্চাগুলোর চোখে একরাশ প্রতীক্ষা-কখন হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ ফেলা হবে ওদের জন্যে, কখন উদ্ধারকারী দল আসবে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে ! কিংবা কখন একটা ছেঁড়া ত্রিপল, একমুঠো শুকনো চিঁড়ে হাতে উঠে আসবে ওদের,  কখনই বা থই থই জলের মাঝে একফোঁটা খাবার জলের প্যাকেট ঝুপুস করে এসে পড়বে স্কুলের ছাদহা পিত্যেস করে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলোর রুক্ষ, ফাটা ঠোঁটে  স্বস্তির রেখা ফুটে উঠবে    

কেন জানি না, আজ হঠাৎ বীণামাসির কথা মনে পড়ে গেল বুনাইর  বীণামাসি ওদের পাশের বাড়িতে ঠিকে কাজ করত  বছরখানেক আগে, এমনই এক বর্ষায় অসুস্থ মাকে দেখতে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়েছিল মাসি সঙ্গে ছিল মাসির একমাত্র ছেলে, বারো বছরের ছোট্টু  সেবারও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নদী ছাপিয়ে উঠে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে গ্রামের সবকিছু বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়েছিল গ্রামের অগুনতি মানুষ মাসির ছেলেটি নাকি ত্রাণের খোঁজে বেরিয়েছিল বুকডোবা জলে আর ফেরে নি বীণামাসির ছেলেটা সাঁতার জানত না!      

বীণামাসি অবশ্য কিছুদিন পরে ফিরে এসেছিল একা ! পাগলের মত অবস্থা তখন তার তারপরএকদিন সেও কোথায় হারিয়ে গেল

 

-“মা !”

রান্নাঘরের টিমটিমে হলুদ আলোয় মাথা নিচু করে বসে মিতাদেবী সবজি কুটছিলেন মেয়ের ডাকে মাথা না তুলেই প্রশ্ন করেন -“কী রে কিছু বলবি? খিদে পেয়েছে? টেবিলের ওপর বাটিতে দেখ, ছোলা ভেজানো রয়েছে…”  

মিতাদেবীর মুখের কথা শেষ হয় না, মেয়ে খসখসে গলায় বলে ওঠে -“মা, এ বছর আমি চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেব না !”

মিতাদেবী প্রবল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকান মেয়ের দিকে অর্থহীন শব্দগুলো পাঁচ বাই চারের আলোআঁধারি রান্নাঘরে ঝোড়ো হাওয়ার মত পাক খেতে থাকে যে মেয়ের সকালসন্ধে খালি একটাই স্বপ্ন, একটাই আশা, একটাই অপেক্ষা - চ্যাম্পিয়নের শিরোপা, সেই মেয়ে আজ বলছেটা কী ?  

-“মা, আমার ট্রিপের টাকাটা ওদের হাতে তুলে দিতে চাই মা…”  

মিতাদেবীর বিহ্বল, বিমূঢ় চোখের অতলে অবাধ্য প্রশ্নেরা হাবুডুবু খেতে থাকে 

-“মা, চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার জীবনে হয়ত আবার আসবে, কিন্তু …” ইতিমধ্যেই মনস্থির করে নিয়েছে বুনাই বুকের ভিতর মোচড় দিচ্ছে না বলা শব্দগুলো ধরা গলায় ফিস ফিস করে ওঠে মেয়েটা-“ঐ বন্যার্ত মানুষগুলো- যাদের প্রাণটুকু নিয়ে জীবন আর মৃত্যু আজ দড়ি টানাটানিতে চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করে দিয়েছে, তাদের জীবনে হয়ত এ সুযোগ আর আসবে না …”  

                                                     -------------------------------------------------------

                                           

সঞ্জয় কর্মকার , অণুগল্প, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

  


 

 

পাগলটা

                                                                                

রেল বস্তির পাগলটা সেই সন্ধে থেকে বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে । কে যেন একজন তাড়াতে গেছিল, তাও যায়নি। রূপকবাবুর ছেলের  আজ অন্নপ্রাশন । আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বাড়ির  চারদিক । অথচ পাগলটা নিজেকে আড়াল করার জন্য একটু অন্ধকার খুঁজছে। অকস্মাৎ  রূপকবাবুর  চোখে পড়ল পাগলটা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভাঁড়ার ঘরের দিকে। রূপকবাবু পাগলটার কাছে গিয়ে কিছুটা বিরক্তির ভঙ্গিতে বলে উঠলেন , ' এখানে কী চাই রে তোর? সেই থেকে এভাবে কী দেখছিস? বলি, মানুষকে বিরক্ত করা ছাড়া তোদের কি আর কোন কাজ নেই?'

রূপকবাবুর মুহুর্মুহু প্রশ্ন শুনে পাগলটা ভয় পেয়ে   দু-হাত পিছনে সরে গেল। তারপর মুহূর্ত খানিক নীরব থেকে শেষে একটু যেন  সংকোচের সুরে বলল, ' খুব খিদা লাগছে। আমারে কিছু খাবার দিবেন?'

'উফ্ জ্বালিয়ে খাস একেবারে! এখানেই দাঁড়া । দেখছি।' কথাটা বলেই দ্রুতপায়ে আবারও বাড়ির  ভিতরে ঢুকে গেলেন রূপকবাবু।

খাওয়া- দাওয়ার লাস্ট ব্যাচ উঠে গ্যাছে। পাগলটাকে এখনও  বাড়ির গেটে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রূপকবাবু বললেন, ' ঈশ , একদম ভুলে গেছি রে!' 

কিছুক্ষণ  পরই রূপকবাবু একটা থার্মোকলের থালায় কিছু খাবার - দাবার এনে পাগলটার হাতে তুলে দিলেন। খাবার পেয়ে পাগলটা বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই রূপকবাবু বলে উঠলেন, ' যাচ্ছিস কেন ,খেয়ে নে!'

'এই খাবারটা ও বাবা- মাকে দিয়ে খাবে। সব অনুষ্ঠান বাড়ি থেকেই এভাবে ও বাবা- মায়ের জন্য  খাবার নিয়ে যায়।' পাশ থেকে বলে উঠল শুভম ক্যাটারার্সের একটা ছেলে।

ছেলেটার কথা শুনে বুকের ভিতরটা  হঠাৎই মোচড় দিয়ে উঠল রূপকবাবুর। স্ত্রী বৈশালীর চরম আপত্তিতে শেষ দু-বছর একটা বারের জন্যও  বাবা - মায়ের খোঁজ নেয়নি ও। তারা এখন কী খেয়ে যে ...  
                      ............................

পারমিতা মালী, প্রবন্ধ, একটি রূপকথার কাহিনী, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 

 


 

 একটি রূপকথার কাহিনী 


      
                 

         তারপর হলো কি, খৃষ্টজন্মের দেড় থেকে দুই হাজার বছর আগে, এক শ্রাবণ মাসের ঝড়জলের রাতে একটি খোকা হলো। রাজার ঘরের ছেলে। সে ছেলের ভবিতব্য ছিলো মরেই যাওয়া। কিন্তু কপালে মৃত্যু না থাকলে কার সাধ্য তাকে মারে? ওই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য গোপনে প্ল্যান ছকা হয়ে গেছিল। বেশ কিছু রাজ কর্মচারী এক নিশ্ছিদ্র শলা করে শিশু অদলবদল করে ফেললো জন্মের ঠিক কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। কাকপক্ষীতেও টের পেলো না। বদলিতে যে শিশুটি এলো, সে ফরসা, চোখা চোখা নাকমুখের সুন্দর দেখতে একটা কন্যা। যাতে লোকের সন্দেহ না হয়। যাতে রাজার মেয়ে বলে সহজেই বিশ্বাস হয়ে যায়। আর ছেলেটি হাওয়া হয়ে গেলো রাতারাতি। বড় হলো নিশ্ছিদ্র এক সুরক্ষিত ঘেরাটোপে। এমনটা আমাদের অনেক হয়। রাজাগজাদের জন্য বলি যায় বহু গরীব। 


               এবার ধীরেধীরে বড় হচ্ছে সে ছেলেটি। একটি শ্যামবর্ণ ছেলে, যে তার রূপ গুণ আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মোহিত করে রেখেছে চারপাশ।  একটা গোটা যুগকে দুই কাঁধে বহন করেছে এসেছে। আর আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি তাকে। একটা মানুষ গোটা জীবনে যে এত কিছু করতে পারে, এটা অসম্ভব ছিলো আমাদের চোখে। তার জীবনরহস্য  বিশ্বাসযোগ্য হয়নি আমাদের । আর তাই লোকে বার বার তাকে দেবতা ভেবেছে। 

             যে দেশে,যে সমাজে প্রেমের ওপর চোখ রাঙানি এসেছে , যে দেশে এখনো খাপ পঞ্চায়েত আছে, সেই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সে ছেলে কি করে এমন করল? বয়সে বড়ো অগম্যা এক নারীর প্রতি এমন খুল্লমখুল্লা প্রেম?  একি মানুষের সাধ্য? নির্ঘাত এ কোনো দেবতা।    
          এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে এ ছেলেটির নাম পরিচয়। হ্যাঁ, আমি  কৃষ্ণ, বাসুদেবের কথাই বলেছি। 
               তাঁর ওপর  বার বার দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায় পরেছিলেন দেবত্বের মুকুট।  নিজে হাতে তিনি কুরুক্ষেত্রের ঘুঁটি সাজিয়েছেন, গোটা আর্যাবর্তের রাজনীতির নিয়ন্ত্রন করেছেন একা হাতে, আর তারপর এক দু পয়সার ব্যাধের তীর খেয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে মরে পড়ে থেকেছেন। কি অদ্ভূত এই বৈপরীত্য!  দেবতা হলে কেউ এমনভাবে মরে? অন্তত কিছুটা রহস্য করে তো মরতে পারতেন!  গ্যাংগ্রিন কিন্তু এখনো ঘাতক রোগ। সুতরাং দু হাজার বছর আগে এ রোগ হলে মৃত্যু হবে,সেটাই স্বাভাবিক। 
         

        তাঁর কাজের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা আছে, কিন্ত দেবত্ব নেই কোত্থাও। কিন্তু ভক্তিবাদী  মন তা মানে না। এতো ক্ষমতা নিয়েই যদি কেউ জন্মাবে,তাহলে অন্তত মানুষ নয়, দেবতা হয়েই জন্মাক !  তাতে অন্তত মন কে চোখ ঠারা যায়! কৃষ্ণ তাঁর যৌবনের প্রথম দিন থেকে শুধু নিয়ম ভেঙে গেছেন একের পর এক। তা এমন নিয়ম ভাঙা লোক কি ইতিহাসে আসেনি?নাকি তাঁদের এমন তুখোড় বুদ্ধি ছিলো না? তা তাঁরা যদি দেবতা না হন,খামোকা কৃষ্ণই বা দেবতা হতে যাবেন কেন? পর্দা সরিয়ে ওই ঝকঝকে আকর্ষনীয় পুরুষটিকে আর একবার খুঁজে দেখলে কেমন হয়?


            গোপ জাতিরা পেশায় দুধ বিক্রেতা। এই তাদের রুটিরুজি।  সহজ সরল কিছু গ্রাম্য মানুষের মধ্যে বড় হচ্ছে দুটি ক্ষত্রিয় ছেলে। যুদ্ধ যাদের জিনে। বছরের পর বছর তাদের পূর্বপুরুষেরা কতরকম অস্ত্রবিদ্যা চর্চা করেছে।   তীরচালনা, ভল্ল, গদা, তলোয়ার,  রথচালনা এসব তাদের নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতন কাজ। সেই বংশের ছেলেদের বাগে আনা কি সামান্য গোপদের পক্ষে সম্ভব? তাদের চোখে তো এ ছেলে বিস্ময়ই !

          আর যারা বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, তাদের শরীর ও মনের বৃদ্ধি খুব তাড়াতাড়ি হয়। মানসিক ম্যাচিওরিটি আসে দ্রুত। এ কিশোরের রূপ তো ছিলোই, আর সাথে যোগ হয়েছিল ক্ষুরধার উপস্থিত বুদ্ধি। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করার মতো অদ্ভূত ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল সে। খুব ছোটবেলা থেকেই তার প্রখর স্মৃতিশক্তি।  দুরন্ত, বুদ্ধিমান, শক্তিমান  কিন্তু স্বাভাবিক এক বালক। গোপবালকরা আচার্যের কাছে যেত না, তাদের মধ্যে পড়াশোনার পাট নেই। তাই কানাই আর বলাইয়েরও গুরুগৃহে যাওয়া হয়নি। এমন কিচ্ছুটি করা যায় নি যা সাধারণের নজরে আসে। তবে গোপনে প্রশিক্ষণ কিন্তু শুরু হয়ে গেছিল। দামিল্য, অক্রুর  ওই বালকদের গোপনে তৈরি করছিলেন মল্ল বিদ্যায় আর ধনুর্বিদ্যায়। 

      শুধুমাত্র দ্রুত পরিস্থিতি বোঝা, আর আত্মরক্ষার এক সহজাত প্রবৃত্তি তাঁকে আলাদা করেছে অন্য সকলের থেকে। যুদ্ধকালে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে তিনি অন্যদের চোখে ধুলো দিয়েছেন বার বার। লোকের মনে হয়েছে এ ম্যাজিক। এ দৈবী শক্তি । কৃষ্ণর আর এক নাম গিরিগোবর্ধনধারী। তিনি গোবর্ধন পাহাড় নাকি কড়ে আঙুলে তুলেছেন। গল্পের গরুকে খুঁটিতে বেঁধে খুঁজলে দেখা যাবে সে সত্যিই হিরো।

              কৃষ্ণ  প্রথমবার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এই পাহাড় কে নিয়েই। গোকুলের নিয়ম ছিলো, প্রতিটি বর্ষায় ইন্দ্রের পুজো করতে হবে। ইন্দ্রদেব বৃষ্টির দেবতা। সাথে তার বজ্র-বিদ্যুৎ সহ হাবিজাবি আরো কিছু  সঙ্গীসাথী আছে। কথা না শুনলে ধনেপ্রাণে শেষ করে দেবেন তাঁরা। সোজা কথায় তোলা দিতে হবে তাদের। ঠিক সময়ে এসে হপ্তা নিয়ে যাবে। নেহি তো গব্বর আ যায়েগা। বড় ধরণের গুন্ডা অথবা দেবতা, যাই বলুন না কেন তারা আসলে তাইই। গোপবাসীদের সংসার চলে  গোরুর দুধ আর দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রয় করে। বৃষ্টির ওপর কারুর হাত নেই। তা সে যত বড় নেতাই হোক না কেন!  কিন্ত যদি যমুনা নদীর বাঁধ তুলে নেওয়া হয়? যদি গতিপথ কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রিত করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর পাড়ের গোচারণভূমি?বহতী নদী যদি হঠাৎ করে বিপুলা হয়ে যায়?ভেসে যায় ক্ষেত, বা গোচারণক্ষেত্র? তাহলে?বোকাসোকা গ্রাম্য গোয়ালাদের ভয় পাওয়াতে এই তো যথেষ্ট ! হয়তো তেমনই কিছু হয়েছিল। এই কঠিন  সময়েও কিন্তু  শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলেছিল ওই কিশোর বালক। সমস্ত ব্রজবাসী আর গাভীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল ওই গোবর্ধন পাহাড়ের গুহায় বা কোটরে। আঙুলে করে কেউ কখনো পাহাড় তুলতে পারে না। সেটা অসম্ভব। কিন্তু, ওই বিশাল জনগণকে বাঁচিয়ে ছিল,এটা তো সত্যি! ওই কিশোর মাথা নোয়ায়নি সেদিন ইন্দ্র নামক গুন্ডার কাছে!  এরপরেও সে দেবতা হবে না?  

        সেই প্রথম সে আঘাত আনে প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে,তাই ঠিক নয়।  নিজের বুদ্ধি ও পুরুষাকার যদি থাকে,তাহলে পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রনে। অন্ধ, বোকা, ভীরু, অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের সে আগলেছে বুক দিয়ে। আর এটাই তো ক্ষত্রিয়ের কাজ ! 

             কালিয় নাগ বিষাক্ত করে দিয়েছিল কালিয়াদহের জল। সেই জল খেয়ে গরুরা মারা যাচ্ছে, মাছ মারা যাচ্ছে। সে দহের আশেপাশে কেউ যেতেই পারছে না। ওটা ছিলো কালিয়র নিজস্ব  প্রপার্টি। কিন্তু সাপের বিষে কোনোকালে জলাশয়ের জল বিষাক্ত হতে পারে কখনো ? সে তো অসম্ভব!  সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী এই কাহিনী। তবে জলে বিষ মেশানো আর কি এমন কঠিন কথা! এ তো হামেশাই হয়। আর জলের মধ্যে লড়াই করে সাপকে হারিয়ে, সেই সাপের মাথায় উঠে ধেইধেই করে নাচা ?ওসব যে গপ্পকথা, সে তো শিশুরাও বুঝবে। তবে মানুষের থেকে ক্ষতিকারক বা বিষধর সাপ কি জন্মেছে এদ্দিনেও? কালিয় মানুষ হলেই বা ক্ষতি কি? বুদ্ধিমান কৃষ্ণ কি তাকে পরাস্ত করতে পারে না?  

      এইভাবে  একের পর এক শত্রু আক্রমণ থেকে গ্রামের লোকদের বাঁচিয়েছে এ কিশোর। এর পরও যদি দেবতা না হয়,তবে কাকে বলবো আমরা দেবতা? যে রক্ষা করে, সেই তো দেবত্ব পাওয়ার অধিকারী ! আর এমন পুরুষের জন্য নারীকুল পাগল হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘ নারীপ্রেমেও অবসাদ আসে বীরের। ক্লান্তিকর লাগে ওই অর্থহীন বাক্যালাপ। প্রেম তার জন্য নয়। গোটা পৃথিবী তার অপেক্ষায়। 

           এ ব্যক্তির সাথে তুলনা করতে গেলে আমার শুধু একটা লোককেই মনে পড়ে। রাসবিহারী বোস। ভারতের যুগসন্ধিক্ষনের এক অবতার পুরুষ। ঠিক অতখানিই মেধা, রূপ, গুণ, আর ক্ষমতা নিয়ে, আমাদের পরম পুণ্যবলে জন্মে গেছিলেন এই পোড়া দেশে। গোপনে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন এক বিশাল স্বাধীনতার যুদ্ধ। দেশ পেয়েছিল তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা। এর আগেপিছেও অনেক কাহিনী আছে বটে। লোকটির মেধা বটে!  অবহেলার ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোই পাস করে রেখেছিলেন কোন ফাঁকে। আমাদের কপাল খারাপ, তাই সে দেবতাকে কাছে রাখতে পারিনি। ১৯১৫ সালে, পাকাপাকিভাবে জাপান চলে যান তিনি ।  শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবি' তে যে ডাক্তারকে আমরা পাই সেও কিন্ত এই রাসবিহারীই।

       আমাদের পোড়া কপালে দেশ। বিদ্যেবুদ্ধি নেই, তাই অবতার চিনতে ভুল করি বার বার। যেখানে সেখানে বাবাজিদের পায়ে ধুপ ধাপ করে মাথা ঠুকি। আর আসল অবতারেরা রয়ে যায় অন্তরালে।  

            
                  *          *          *  

Tuesday, 7 July 2020

সম্পাদকীয, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০,



সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০

সম্পাদকীয়

এলবার্ট কামুর মতে 'আত্মহনন একটি দার্শনিক সমস্যা'। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আত্মহনন বলতে আমরা কী বুঝব? তা কি শুধুই ব্যক্তিগত? আমাদের পৃথিবী, আমাদের পরিবেশকে নিরন্তর হত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছি যে আমরা, সেও কি একধরণের আত্মহননের প্রচেষ্টা নয়? সভ্যতা এগিয়ে চলেছে, কিন্তু কোনদিকে? আরও একটু আয়াসের অর্থ কি মৃত্যুর আরও একটু কাছাকাছি যাওয়া? আরও একটু স্বার্থপরতার অর্থ অন্যকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া? ২০২০ আমাদের ভাবনার গতিপথ বদলে যাওয়ার বছর।নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখারও। মৃত্যু এবং খিদে, এই দুটি সত্য আমাদের জড়িয়ে রখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। সাহিত্য কি প্রলেপ হয়ে উঠবে? নাকি সে হয়ে উঠবে এই সময়ের দর্পণ, যার অমোঘ স্বর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে ভয়ের বিরুদ্ধে আমাদের আপসহীন সংগ্রামের কথা?
 
এইসংখ্যাটি বিশেষ অনুবাদ সংখ্যা। বেশ কয়েকটি বিদেশি কবিতার অনুবাদ করলেন শ্রদ্ধেয় কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য, উজ্জ্বল ঘোষ, সুজিত মান্না প্রমুখ। আশা করি পাঠকের ভাল লাগবে। সেইসঙ্গে গল্প, কবিতা, পুস্তক আলোচনায় নবীন এমং প্রবীনদের কলম স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকল। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা 'বাসন্তী' র ভিডিও প্রকাশ করা হল। এই সংখ্যার কবি মিঠুন চক্রবর্তী। তাঁর কবিতারও ভিডিও প্রকাশিত হল । এই প্রয়াস যাদের জন্য, বিচারের দায়ভার থাকল সেই প্রিয়  পাঠকের ওপর।






Monday, 6 July 2020

রাজীব মৌলিকের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০





মুখ 

রাজীব মৌলিক  




যে মুখে তুমি কথা বলে হেসে ওঠো 
ও মুখ আদতে আঁশটে গন্ধের পাতাবাহার

দহন শেষে ছাই যেমন বিজ্ঞাপন দেয়
ওই মুখও উনুনের কালোয় ভরে যায় 
পোষা বেড়ালের মতো জাত ভুলে
মালিক কেন্দ্রিক হয়ে
সকলে বোঝাতে চায় 
হাসি একটি উপহার

আর উপহার, 
কন্যাদানের মতো শর্তহীন

ভাস্কর পালের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




ব্ল্যাক চাইল্ড

ভাস্কর পাল


আমি অবসন্ন হয়ে গেলে
ঝুঁকে পড়ি আরও
বিষন্ন হৃদয় নিয়ে
আমি ছুঁতে চাই মাটির ভালোবাসা।
বিধ্বস্ত ঝড় যদি আসে
তোলপাড় করে
আমার মন আঙিনা
উড়ে যাওয়া যন্ত্রণা থেকে
আমি কুড়িয়ে নেই বিন্দু বিন্দু স্বেদ
 হাত তুলে দেই আকাশে
প্রশংসায় ভরিয়ে নেই আমার স্মৃতির ধারাপাত
আমি প্রশংসা করি সূর্যের
প্রতিটি সকালে আলোকস্নানের জন্য
অতিবেগুনী রশ্মি আমায় ছুঁয়ে চলে যায়
আমি আদরে হাত তুলি
আমার স্পর্শ সীমানায় তুমি কালো শিশু।
আমি তোমাদের ধার করা অহংকার দিয়ে
পুরুষকারের দিকে তাকাই, হাসি
নিস্পন্দিত ধার করা পেশী, তাদের দীর্ঘ এবং সংক্ষিপ্ত বন্দুকগুলি
ক্রমধাবমান উজ্জ্বলতম মৃত্যু গোলক
আমায় আপন করে নেয়।

শ্যামশ্রী রায় কর্মকারের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, Shyamashri Ray Karmakar



গল্প
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

পথের ওপর একা মানুষ, ক্ষোভের ভারে ন্যুব্জ
ঝোলার ভেতর শুকনো রুটি এবং ভীরু উদ্বেগ
নীরবতার হাত ধরেছেন, নীরব মানে কান্না
পথ বেড়ে যায় পথ বেড়ে যায় মনের সাথে যুদ্ধেই

গ্রামের ঘরে বৃদ্ধ বাবা, অর্ধভুক্ত সন্তান
অদর্শনে সন্ধ্যা সকাল নিজের ছায়া দীর্ঘ
কুসুম আজও শুধুই শরীর, কুসুম অর্থ অন্ন
পথ বেড়ে যায় পথ বেড়ে যায় খিদের সাথে যুদ্ধেই

পর্দা জুড়ে সেলিব্রিটির দিগ্বিজয়-আখ্যান
দেশের কাছে শ্রমিক এখন খিদেয় মৃত সংখ্যা
কোনটা হবে অনন্ত আর কাদের মৃত্যু পলকা
এ বিতর্কে ক্লান্ত তিমির, তারারা বাকরুদ্ধ
একা মানুষ মরতে থাকেন বাড়ি ফেরার গল্পে
রাজ্য থেকে রাজ্যে কেবল মুখের ভাষা বদলায়

তৈমুর খান, কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা,২০২০




শ্রীমতী বর্ষা

তৈমুর খান


 'আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর,

 দুরন্ত পবন অতি—আক্রমণ তার

 অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার।

 বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘভার

 খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া॥'

        ( 'মেঘদূত': রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 কতবার দেখা হল তবুও দেখি তাকে। উন্মুখ চেয়ে থাকি। চুল সরাও খোলো আঁখি। ঘন হয়ে এল নীলিমা তোমার। দুলে ওঠে ওই মেঘভার। বৃষ্টি চৈতন্যের ইঙ্গিত বাজে প্রকৃতির চতুর্দিক জুড়ে। হৃদয় উথলে ওঠে। নদীও যৌবনবতী হয়। প্রাণ ভরে পান করে জল। অন্তরঙ্গ কোনো বাউল গেয়ে ওঠে যেন। কতদূর পথ হেঁটে সে ফিরছে এই বৃষ্টির দেশে। গৈরিক ধুলোমাখা শরীর সে জুড়িয়ে নিতে চায়। খোলা আকাশের নিচে তার একতারা তুলে ধরে। আজ মনের মাটি তার ভিজিয়ে নেবার দিন।

       বাউল তো আমরাও। কলমটা তুলে ধরেছি এই জানালার ধারে। বৃষ্টি ও হাওয়া এসে চুলে দিয়ে যাচ্ছে কোমল স্পর্শ। একখণ্ড মেঘের রুমালে মুছে নিচ্ছি মুখ। আজ সব এলোমেলো ভাঙচুর। দূরের পাখিরা দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। তারাও কি ভিজিয়ে নিচ্ছে ডানা? আমারও খাতা ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে শব্দও। আজ সব বৃষ্টিমাখা অনুভব।

       দূরে গাছের পাতায় পাতায় কী উচ্ছল হাসি ! মর্মর শব্দে ছড়িয়ে দিচ্ছে কাঁপন।এক একটি  কাঁপন কুড়িয়ে নিচ্ছি নিভৃতে। শব্দ-তরঙ্গে পাঠাতে চাই তাকে। যে আমাকে গাছ হতে বলে চলে গেছে অন্যকোনো পরাগ মিলনে। কেমন আছে ওর বাগান? শুধু মাটির গন্ধ। পাতার গন্ধ আজ প্লাবিত করে।  আত্মাকে মুক্তি দিই আমি ; সে বাগানে যদিও সে নিষিদ্ধ আপেল খেতে চায়।

        কে বাজায় বাঁশি? আমি তার নাম জানি নাকো। শুধু সুর এসে ধাক্কায়। তরঙ্গে তরঙ্গে নাচে জল। জলের লীলায় ভাসি। জলের লীলায় হাসি। জলে জলে বিকেল গড়াই। জগতে আজ শুধুই বাজে জলবাঁশি। হৃদয়ের স্রোতে গঙ্গা-যমুনা জেগে ওঠে। তীরে কি নেমেছে ঈশ্বরী? ভাসিয়ে দিলাম নৌকা তবে। সাবধানে পেরিয়ে যাও। এই স্রোত বড় ভয়ঙ্করী। কেবল উদ্দাম আর উদ্যত উল্লাস। দুই কানা ভাঙতে থাকে জলের বিলাস।

        নিসর্গের ভাষা জেনে নেয় আজ কত কালিদাস। যক্ষপুরীর দিকে চলে যাচ্ছে মেঘ। চিরন্তন এ পৃথিবী মেঘের শতক। বিরহ লেখা কালের নিয়মে যক্ষ সবাই। প্রিয়ার কাছে তাদেরও বাণী পৌঁছে দিতে চায়। হে বিরহ কাল, হে বিরহ বাণী, আমরাও দূত চিনি। আমাদের এসএমএস নিয়ে যায় মেঘ। আমাদের টাওয়ার ওই  বিশাল উঁচু গাছ। বৃষ্টির অক্ষরে  মেশাই অশ্রুজল। তারপর শব্দ-বাক্য-পদ…. সর্বনাম-ক্রিয়া-অব্যয়। তারপর আমাদের ক্ষমা করে আকাশ :

'Only a Cock stood on the rooftree

    co co rico co co rico

In a flash of lighting then a damp gust

         Bringing rain.'

                              ( T.S.  Eliot)

    কালো মেঘ। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির কণ্ঠস্বর। আমাদের পাপ ধুয়ে দেয়। নেমে আসে ধারাবর্ষণ। যে ধারায় আজও আমরা স্নাত, পবিত্র এবং উৎফুল্ল। সেই বৃষ্টি তো ভিত্-হারাও করে। ঘরে ঘরে বন্যা পাঠায়। ঘরে ঘরে হাহাকার তোলে। পাপের মুক্তি এবং মুক্তির পাপ দুইই আমাদের প্রার্থনা করতে শেখায়। প্রণাম করতে শেখায়। তখন তো সেকথাও লিখতে হয়:

 'ঘোররাতে আমাদেরই শুধু

 বারেবারে করো  ভিৎহারা ?

 সকলেই আছে বুকজলে

 কেউ জানে কেউ বা জানে না

 আমাকে যে সহজে বোঝালে

 প্রণাম তোমাকে বৃষ্টিধারা।'

       ( 'বৃষ্টিধারা': শঙ্খ ঘোষ)

       সৃষ্টির, মুক্তির, সাম্যের প্রতীক হে বৃষ্টিধারা, আজ শুধু তোমার ভাষায় তোমাকেই ডাকি। বৃষ্টি হোক অন্তরে বাহিরে। আর ভিজতে ভিজতে আমাদের দিন, আমাদের রাত। আর ভিজতে ভিজতে তুলে নিই কোলে ভেজা দুই হাত। সেইতো চিরন্তনি! ঘোরের ভেতর জেগে ওঠে তার মুখ। ঠোঁটের পাপড়ির কী স্নিগ্ধতা! স্ফুরিত ব্যাকুল! আর নীলশাড়ি ভেজা নিঙাড়ি নিঙাড়ি একাকী চলেছে পথে। আজ তার অভিসার। বৈষ্ণব যুগ থেকে এই মোবাইল যুগ— দীর্ঘ রাস্তায় তার পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে। এলোমেলো চূর্ণ কুন্তলে ঢেকে আছে মুখ। তবু তার ফর্সা হাত, কী সুন্দর গভীর কালো চোখ আর উজ্জ্বল শ্বেত-শুভ্র দাঁতের ঝিকিমিকি দেখতে পাই। আলতা কি ধোয়া গেল তোমার? শুধু পা, পায়ের ওঠানামা। বৃষ্টির অঙ্গনে শুধু তোমার পদধ্বনি!

'হৃদয়-রূপক কিছু নেই, কিছু নেই,

নেই বেলফুল, রজনীগন্ধা, জুঁই,

চুপ করে শুধু চেয়ে থাকি তার মুখে,

চোখ দিয়ে শুধু কালো চোখ দুটি ছুঁই।

চিরন্তনীর অলক্ষ্য অভিসার 

পার হয়ে এসে তুচ্ছের বঞ্চনা

বলে কানে কানে, 'আমার অঙ্গীকার

ভুলবো না আমি, কোনোদিন ভুলবো না!'

       ('বর্ষার দিন' : বুদ্ধদেব বসু)

     অবশেষে অন্ধকারে ফিরে আসা বাসার পাখি। প্রদীপ জ্বেলে মুখ দেখা। শূন্য মনে স্বপ্নের রেখাপাতে রাঙিয়ে দেওয়া। সুপ্তির গহীনে তলিয়ে যাওয়া। বর্ষা মানে সেই ইচ্ছে, হৃদয় দিয়ে হৃদয় নিচ্ছে। পালিয়ে যাচ্ছে, ফিরেও আসছে। যন্ত্রণায় আনন্দ পাচ্ছে। সীমার মাঝে অসীম হচ্ছে। আর অসীম এসে সীমায় ঢুকছে। বাংলার কদম্ব বনে বনে চলো খুঁজে আনি বর্ষাকে। শ্রীমতী বর্ষা আজ নামুক ঘরে ঘরে।





চন্দন বাসুলীর কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




আশ্রয়ের অবর্তমানে 

চন্দন বাসুলী


এখানে কোনো পাহাড় নেই
কোনো নদী নেই
কোনো জঙ্গলও নেই

আছে বিস্তীর্ণ একটা মাঠ 
কোথাও সবুজ 
কোথাও ধু-ধু ফাঁকা 

অদ্ভুত নির্জনতায়
যেন সঙ্গীহীন দাঁড়িয়ে আছে 
আকাশের মুখে চেয়ে 

এসবের কাছেই বার-বার যাই 
আর ফিরে আসি,ফিরে আসতেই হয় 
একা কোনো জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা যায়না 

যখনই গিয়েছি ওদের কাছে
আমি চেয়েছি 
শুধু চেয়েছি 

কেউ তো আসুক - একেবারে নতুন কেউ
যার কাছে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে 
অসুখী বিকেল গুলোতে
বাবা নামের আশ্রয়ের অবর্তমানে !

বাপ্পাদিত্য রায়বিশ্বাসের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



আবার 
বাপ্পাদিত্য রায়বিশ্বাস 

চলেছ...
পায়ের ছাপ মুছতে মুছতে 
             আমি পেছন পেছন 
এভাবেই 
           লুকিয়ে পড়া বারান্দা 
           জংলা বাগান 
           ধসা মন্দিরের রাধামাধব 
           আর একা হওয়া নদীর স্রোত 
                                    আমাকে চিনিয়েছ
জানোই তো কত কষ্টে আটপৌরে মেঝেটুকু 
                                                  শুকিয়েছি
অথচ সে-ই মাথায় আকাশ নিয়ে 
                                  তোমায় ঢুকতে হ'লো 
চলেছ...
পায়ের ছাপ মুছতে মুছতে 
             আমি পেছন পেছন 
উঠোন 
বারান্দা 
কলতলা
ঘর...
একটু দাঁড়াও, এবার শেকলটা তুলে দিয়ে আসি।

Sunday, 5 July 2020

সায়নের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




আমার গীতবিতান কোথায়? 
সায়ন

কবরের অপেক্ষায় শুয়ে থাকে মাটি
তোমার পেটে একটা গাছের চারা- টব, রক্তসার মাটি
প্রাণে বেঁচে যাওয়া
মুন্ডহীন জন্মের অভিশাপ
গান গাইতে গাইতে শকুনের ঠোঁটে সমর্পণ করে শিশু
পাথরভাঙা কবি খোঁজে মৃত গণসংগীতের প্রাণ
নরম হাতের মুঠোয় কাঠ ফাটা গালঠোঁট
একটা পুকুরের প্রশান্তির মতো
একটা ঘাসের প্রথম পৃথিবী দেখার মতো
একটা পাখির কথা বলার মতো কোমল
ভালো করে তোমার চুলে ডুবে থাকা
পৃথিবীবাড়ির ছায়া, চোখে লিখে রাখা গীতবিতানের সকাল ।


নবকুমার পোদ্দারের কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






নবকুমার পোদ্দারের কবিতা 

এলোমেলো 

রুদ্ধশ্বাসে তছনছ হতে পারছি না
হে জীবন
মহার্ঘ মহাজন
পোষা পিয়ানোর কাছে আমার মেধা,তালু,মেঘ
বুলডোজার দিয়ে কে ভেঙে দিচ্ছে তবে?
আয়নার বিষাদময় গর্ভে একটা গোটা দিন জলে ডুবে রইল
এও কি ট্রাজেডির লুন্ঠন  নয়!


বায়ু

অসুখ দিয়ে বেঁধে রেখছ
রোগ ছড়াচ্ছে গাছের ছালে
স্বপ্নে স্বপ্নে মেদ খাই
যৌনটিকা এঁকে কাম অরণ্যে 
আমার কাব্যভাষা সতী নয়
যেমন তোমার ঠোঁটের কোতল!
ফেনায় ফেনায় ফূর্তি মূর্তি 
দাহ হয় অনন্ত ছোবল
 জিভ কবুতর ছোঁয়
সমতল মলাট ধোয় দাঁতের 
সুপ্ত ব্যঞ্জনে শরীর শরীর বায়ু যায়।

মহুয়া মিত্রের গল্প, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



গল্প  

মল্লিকার চিঠি
মহুয়া  মিত্র

" শ্রীচরণেষু মা,
                      আমার প্রণাম নিও । জানো, আমার জন্মদিনে তোমার জামাই আমাকে হীরের গয়না উপহার দিয়েছে । এই বাড়ির সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে । শাশুড়িমা আমার পছন্দ মত রান্না করেন, শ্বশুরমশাইয়ের কাছে আমি নিজের মেয়ের চাইতেও বেশি । আর দেওর তো নিত্যনতুন উপহার আনে আমার জন্য ।
         আমি খুব ভালো আছি । তুমিও ভালো থেকো মা ।
                                             ইতি,
                                             তোমার মল্লিকা ।। "

চিঠি শেষ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল মল্লিকা । বলা হল না, অফিস কলিগের সাথে স্বামীর অবৈধ সম্পর্কের কথা বা পণের দাবিতে শাশুড়ীমায়ের অকথ্য গালিগালাজের কথা । শ্বশুরের কুদৃষ্টি বা টাকা চেয়ে না পেয়ে দেওরের দু'ঘা মারার কথাও বলতে পারল না । কারণ চিঠির ঐ মিথ্যাগুলোই যে মল্লিকার জীবনের চরমতম সুখ ।

পুস্তক আলোচনাঃঃ নারী ও পুরুষ, আলোচনায় মনীষা শেখ, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




পুস্তক আলোচনা  
নারী ও পুরুষ
লেখকঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়  
আলোচনায় মনীষা শেখ 

 এই লকডাউনে আমাদের মন  এখন বিষাদগ্রস্ত।  কবে পৃথিবী স্বাভাবিক হবে, কবে ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে ভরে উঠবে স্কুল প্রাঙ্গণ, কেউ জানে না।  হাতে অঢেল সময় পাওয়াতে ভাবলাম বইয়ের আলমারি গোছানোর কাজটা করে রাখি। আর এই গোছাতে গিয়েই পেয়ে গেলাম একটা অসাধারণ বই।  অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারী ও পুরুষ।

বইখানি আগে পড়েছি।  তবে সময়ের ধুলোবালি পড়ার ফলে অনুজ্জ্বল হয়ে গেছিল ছবিটা। এখন এই মধ্যবয়সে এসে বইটা নতুন করে পড়লাম এবং আবারও মুগ্ধ হলাম। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খুবই প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষও।  মানুষটির কথা ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। ছিন্নমূল হয়ে ভারতে এসে জীবিকা ও জীবিকা অর্জনের জন্য কি না করেছেন! কখনো কখনো জাহাজের ডেকে নাবিক হয়ে সারা পৃথিবী পর্যটন, কখনো কোন কারখানার ম্যানেজার শিক্ষক সাংবাদিকের ভূমিকা পালন। সব ভূমিকাতেই  তিিনি সমান উজ্জ্বল   ।
 এখন বইটার কথা বলি।  মানুষের মনের বিপন্নতার নানা দিক তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর অসামান্য সব উপন্যাসে আমরা সবাই তা জানি। কিন্তু ভারতবর্ষে নারীদের যে সমস্যা বর্তমানে আমাদের প্রত্যহ হতাশ্‌ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ করে , এমনকি লকডাউনের ভারতেও যে পাপ আমাদের ছেড়ে যায় না, সেই ধর্ষণের কথাই বলছি।

নারী ও পুরুষ গল্পটি ধর্ষণের প্রেক্ষাপটে লেখা।  এক বন্ধের দিনে একটি খুন হয়। ধর্ষিতা মেয়েটি আশ্রয় নেয় অনিল তথা মেজদার বাড়িতে।  এখান থেকেই লেখক বুনতে থাকেন তার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন আমাদের আচ্ছন্ন করে দেয়।
  নিজেদের অজান্তেই আমরা ঢুকে পড়ি মেজদার সহেলী কুঞ্জে,  যে কুঞ্জে আছে সারি সারি পর্যটন কুটির ।আছে শাল, সেগুন, পিয়ালের সারি,  আছে অজস্র ফুলের সমারোহ।  মেজদার লাগানো কৃত্রিম বনাঞ্চল।  মাঝে সরু সরু রাস্তা, বড় পুকুর্‌ মনোরম ঝিল, দেশি-বিদেশি গাছের সমারোহ। একবার চেয়ে সহজে এসেছে সে বারবার না এসে পারে না মনে হয় স্বপ্নের পৃথিবী।  অনিল তথা মেজদা সারাদিন এই কুঞ্জে ঘুরে বেড়ায় । কীভাবে কোথায় কোন গাছ লাগালে, কোন ফুল ফুটলে প্রিয় হয়ে উঠবে এই কথা মাথায় অনবরত পাক খায়। তাকে দেখলে মনে হবে সে যেন জীবনভর এক ঘোরের মধ্যে আছে।
 
একটি ধর্ষিতা মেয়েকে জীবনে ফিরিয়ে আনার এই  কাহিনী  পড়লে মনে হয় এইতো! পুরুষ তো এমনই হওয়ার কথা। এই বইয়ে অনেক চরিত্র । সেঁজুতি, অমিয় কপালী, ধীরে্‌ লোকনাথ কাকা , সুশান্ত, শ্রাবণ্‌ পল্লবী- সব বলতে গেলে লেখাটা বিরাট হয়ে যাবে।  মেজদারও বিপন্নতা আছে।  সেই বিপন্নতার নাম সহেলী। আমরা সবাই কোন না কোন সহেলীর জন্য বড় হয়ে উঠছি। আমরা লেখাপড়া করছি।  সাইকেলে জ্যোৎস্নায় মাঠ পার হয়ে যাচ্ছি , বালির চড়ায় নির্জন রাতে তার কথা ভাবতে ভাবতে আকাশের নক্ষত্র গুনছি । বইটি পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হয় উপন্যাস নয়, কোনও কবিতা পড়ছে বুঝি।
 উপন্যাসের শেষে মেজদা তথা অধীর সেঁজুতিকে বলেন,  "বোঝা যা , সবকিছু আমাদের বয়ে নেবার সুযোগ দিয়ে দেখ না, পারি কিনা !" পুরুষের এমন কাম্য ছবিই তো মেয়েরা গোপনে লালন করে। এমন নরম উষ্ণতার কথাও নারীকে শেষ পর্যন্ত পুরুষই বলতে পারে। পুরুষ ছাড়া কে আছে নারীর, যার পাশে গাছ হয়ে ফুল হয়ে ফুটে থাকা যায়!

 মানুষের ভালোবাস্‌ মানুষের প্রতারণা , নারী-পুরুষের আশ্চর্য এক সম্পর্কের কথা বলেছেন লেখক। একইশরীর, একই  অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ , একই কামনা। অথচ  কখনো মিলন মধুর, কখনো পাশবিকতার স্মৃতি। এই উপন্যাসে নারী পুরুষের সম্পর্কের উপর নতুন করে আলো ধরেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।  তুলে ধরেছেন জীবনের ইতিবাচক দিকটিকেও।