চ্যাম্পিয়নশিপ
আর তো মোটে একটা মাস...তারপরেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! চারিদিকে কানফাটানো হাততালির শব্দ আর জাতীয় সঙ্গীতের গায়ে কাঁটা দেওয়া সুরেলা, সোনালি মুহুর্তে গলায় সোনার মেডেল ঝুলিয়ে ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে আর কেউ নয়, সোনার মেয়ে বুনাই!
হ্যাঁ, বুনাইএর শয়নে-স্বপনে-জাগরণে এখন একটাই প্রতীক্ষা-এশিয়ান সাব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ ! অনেক, অনেক কষ্টে মায়ান্মারে এই ট্রিপে যাওয়ার টাকাটা জোগাড় হয়েছে। বাবা মুখে কিছু স্পষ্ট করে না বললেও বাবার চোখের কোণে হতাশার নীল ছায়া বুনাইএর নজর এড়ায় নি। একটামাত্র মেয়ে তাঁর, চাহিদাও তার সামান্য। কিন্তু জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তে অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া বোধহয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের আর কিছু করারও থাকে না। একটা ছোটোখাটো প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেন তিনি –সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে জীবন থেকে মূল্যবান কিছু মুহূর্ত আর শরীর থেকে অমূল্য কিছু প্রাণশক্তি বাঁধা রাখতে হয় যেখানে। সম্প্রতি মায়ের একটা বড় অপারেশনের পর থেকেই হু হু করে জলের মত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। আর তার পরে পরেই এই চ্যাম্পয়নশিপের জন্যে এতগুলো টাকা জোগাড় করা-যাতায়াতের খরচ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অনেক খরচই আছে, সেটা খুব একটা কম নয়! নিঃসঙ্গ, আঁধারাচ্ছন্ন রাতে অসহায়ভাবে পথ খুঁজে গেছেন অনিলবাবু। বাবার চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ছুঁয়ে গভীর হত। এক একসময় তো বুনাইএর মনে হচ্ছিল - এমন সুযোগটা এবার বোধহয় হাতছাড়াই হয়ে গেল!
ক্রমাগত জমতে থাকা বিষণ্ণতার ধূসর বাষ্প যখন বুনাইকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে, কোথাও একবিন্দু সতেজ বাতাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিল না ও - অফিস থেকে ফিরে এসে অনিলবাবু একদিন আধো আলো, আধো অন্ধকারে এক ঝাঁক জোনাকির মত উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে স্ত্রীকে বলেছিলেন-“দেশের শরিকি জমিটা বিক্রিই করে দেব ভাবছি, বুঝলে!” ইচ্ছে-অনিচ্ছের দোলাচলের মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন মিতাদেবী। ঐটুকুই তো সম্বল ছিল, ভাড়াবাড়ির অসহায়তার মাঝে ঐ এক্টুকুনি নিশ্চিন্ততার আশ্বাস-সেটুকুও হারিয়ে গেলে… ! পাশের ঘরে হলুদ বাল্বের আলোয় খাটের ওপর বইএর মাঝে মুখ গুঁজে থাকা বুনাইএর মনটা প্রথমে একটু দমে গেলেও পরক্ষণেই মনে হয়েছিল যেন টেনিস রুমের মতই টুপটাপ লাইন দিয়ে ফ্লুরোসেন্ট আলো জ্বলে উঠেছে ঘরের মধ্যে! ভাড়াবাড়ির নোনাধরা দেওয়ালে ছিটকে যাওয়া স্পিড ড্রাইভের একটা আক্রমণাত্মক স্ট্রোক...আর স্ট্রেট সেটে ও হারিয়ে দিতে চলেছে প্রতিপক্ষকে! সেদিন, সেই সন্ধ্যায়, জলভরা চোখে সেই মুহূর্তটাকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে বুনাই ঠিকই করে নিয়েছিল- নাহ, এবার কিছুতেই খালি হাতে ফিরবে না ও।
এমনিতেই এই খেলার জন্যে কম লড়াই করতে হয়নি ওকে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অনিলবাবু্র বড় ইচ্ছে ছিল মেয়ে তাঁর ডাক্তার হবে। মধ্যমেধার বুনাই পড়াশুনোয় কিন্তু কোনোকালেই খুব একটা আহামরি কিছু ছিল না। বুনাইর খুড়তুতো দাদা বুড়োদা টেবিল টেনিস খেলত। ওদের পাড়ারই ক্লাবে। কোথা থেকে যেন সে খেলার নেশাটা চারিয়ে গিয়েছিল মেয়েটার মধ্যেও! মিতাদেবীর অসুস্থ বিকেলটা যখন একদলা অন্ধকার হয়ে নেমে আসত অবশ দুচোখের ফাঁকে, একাকী বুনাই স্কুলফেরত তখন প্রায়ই বুড়োদার টিটি ব্যাটবল হাতে বুড়োদারই সঙ্গে ক্লাবে গিয়ে জুটত ! ফলে, যখন তখন গার্জেন কল, ক্লাসটিচারের চোখ রাঙানি ! বাবার বকুনি ! এর মাঝেই ওকে সাহস জুগিয়েছিল ওদের গেমটিচার মিলিন্দস্যারের সাহচর্য। স্যার বলতেন, সব কাজ কিন্তু সবার জন্যে নয়। প্রতিটি শিশুর মধ্যেই কিছু না কিছুর সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। সেই সম্ভাবনাটিকেই খুঁজে বের করতে হবে, তারপর তাকে চারাগাছের মত যত্ন করে বড় করে তুলতে হবে! মিলিন্দস্যার বাবাকেও সেকথা বুঝিয়েছিলেন। নিতান্ত অবুঝ মানুষটাও সেদিন থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। মিলিন্দস্যারের ঐকান্তিক চেষ্টাতেই কম খরচে এই টিটি কোচিং সেন্টারে বড় বড় কোচেদের তত্ত্ববধানে আজ এতোদূর এগোতে পেরেছে ও, এতবড় সুযোগটা আজ ওর সামনে এসেছে !
আজকাল তাই বেশ কিছুদিন ধরেই ওর জন্মদিনের কেক, পায়েস কিংবা পুজোর পছন্দের জামা-সবেতেই স্বেচ্ছায় বিস্তর কাটাছেঁড়া করে চলেছে মেয়েটা। এমনকি বিভিন্ন ট্যুর্নামেন্টে জেতা প্রাইজমানি যা ও এতদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিল-বড় কোন স্বপ্নের পিছনে খরচ করার জন্যে, সে টাকাও নির্দ্বিধায় বাবার হাতে তুলে দিয়েছে বুনাই । অসুস্থ মায়ের বুকে মাথা রেখে মেয়েটা খুঁজে বেরিয়েছে শুধু একটা পথের দিশা!
এখন শুধু সেই স্বপ্নটাকে সফল করার অপেক্ষা । দুবছর আগে চেন্নাইতে ইন্টারন্যাশনাল ওপেন টিটিতে ব্রোঞ্জ পেলেও গতবছর ইন্দোরে সাব জুনিয়র সিঙ্গলসে বুনাই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি ওকে। এছাড়াও সিঙ্গলস, ডাবলস, জুনিয়র টিমের বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিক সাফল্যের মধ্যে তো ও আছেই। ও জানে, যত বেশী ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট খেলতে পারবে ও, তত ওর অভিজ্ঞতা বাড়বে। সেই সঙ্গে এও জানে, এই হার্ডলটা টপকালে ওর মাথার ছোট্ট মুকুটে যে পালকটা যোগ হবে, সেই পালকের ডানায় ভর করেই ওকে পার হয়ে যেতে পারবে হাজার প্রতিবন্ধকতার কাঁটা তারের বেড়া, বাধার সুউচ্চ পাঁচিল… এই চ্যাম্পিয়নশিপটা জিতলে ওর সামনে খুলে যাবে বন্ধ দরজার কপাটগুলো। এককালের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন অখিলেশস্যারের কাছে অ্যাডভান্সড কোচিং নেওয়ার সুযোগটা অনেক অনেক সহজ হয়ে যাবে। আর অখিলেশ ফাউন্ডেশনের বৃত্তিটার জন্যে যদি একবার মনোনীত হয়ে যেতে পারে-তাহলে আর ওকে পিছনে ফিরে তাকাতেই হবে না!
২
টেবিল টেনিস কোচিং থেকে বাড়ি ফিরেই খাটের ওপর এসে উপুড় হয়ে পড়েছিল ক্লান্ত বুনাই ! মিতাদেবী রান্নাঘরে রাতের রান্নার জোগাড় করছিলেন। অনিলবাবু তখনো অফিস থেকে ফেরেননি।
হঠাৎই খাটের পাশে পড়ে থাকা ছেঁড়া খবরের কাগজের ঠোঙার গায়ে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল বুনাইএর। দিগন্তবিস্তৃত জলছবি। বানভাসি ঘোলা জলে খেলনার মত জেগে থাকা বাড়িঘরগুলোর মাথায় দাঁড়িয়ে অধীর অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকটি ছোট ছেলে !
নীচে ছোট ছোট অক্ষরে সীমাহীন কষ্টের সাতকাহন! গত কয়েকদিনের তুমুল বৃষ্টিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছে। সেখানকার বন্যা পরিস্থিতির টুকরো টুকরো খবর আজ সারা দিন ধরেই কানে আসছিল ওর, যদিও দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে সেসব নিয়ে আর সেভাবে ভাবার সময় পায় নি বুনাই ! কিন্তু পড়ন্ত বিকেলের ঝিমিয়ে আসা আলোয় এই একটা ছবিই যেন ওর সামনে হাজার গল্পের অমনিবাস খুলে দিল !
ছবিতে অসহায় ছেলেগুলোর কাতর দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ম তীরের ফলার মত! এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় বুকের ভিতরটা। পশ্চিম মেদিনীপুর আর হাওড়ার শ’খানেক কিলোমিটারের ব্যবধান যেন মুহূর্তে ঘুচে যায়। উতলা হয়ে চেয়ে দেখে বুনাই, বাচ্চাগুলোর চোখে একরাশ প্রতীক্ষা-কখন হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ ফেলা হবে ওদের জন্যে, কখন উদ্ধারকারী দল আসবে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে ! কিংবা কখন একটা ছেঁড়া ত্রিপল, একমুঠো শুকনো চিঁড়ে হাতে উঠে আসবে ওদের, কখনই বা থই থই জলের মাঝে একফোঁটা খাবার জলের প্যাকেট ঝুপুস করে এসে পড়বে স্কুলের ছাদ…হা পিত্যেস করে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলোর রুক্ষ, ফাটা ঠোঁটে স্বস্তির রেখা ফুটে উঠবে…
কেন জানি না, আজ হঠাৎ বীণামাসির কথা মনে পড়ে গেল বুনাইর। বীণামাসি ওদের পাশের বাড়িতে ঠিকে কাজ করত। বছরখানেক আগে, এমনই এক বর্ষায় অসুস্থ মাকে দেখতে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়েছিল মাসি। সঙ্গে ছিল মাসির একমাত্র ছেলে, বারো বছরের ছোট্টু। সেবারও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নদী ছাপিয়ে উঠে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে গ্রামের সবকিছু । বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়েছিল গ্রামের অগুনতি মানুষ। মাসির ছেলেটি নাকি ত্রাণের খোঁজে বেরিয়েছিল বুকডোবা জলে । আর ফেরে নি । বীণামাসির ছেলেটা সাঁতার জানত না!
বীণামাসি অবশ্য কিছুদিন পরে ফিরে এসেছিল । একা ! পাগলের মত অবস্থা তখন তার । তারপর… একদিন সেও কোথায় হারিয়ে গেল ।
-“মা !”
রান্নাঘরের টিমটিমে হলুদ আলোয় মাথা নিচু করে বসে মিতাদেবী সবজি কুটছিলেন । মেয়ের ডাকে মাথা না তুলেই প্রশ্ন করেন -“কী রে কিছু বলবি? খিদে পেয়েছে? টেবিলের ওপর বাটিতে দেখ, ছোলা ভেজানো রয়েছে…”
মিতাদেবীর মুখের কথা শেষ হয় না, মেয়ে খসখসে গলায় বলে ওঠে -“মা, এ বছর আমি চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেব না !”
মিতাদেবী প্রবল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকান মেয়ের দিকে। অর্থহীন শব্দগুলো পাঁচ বাই চারের আলোআঁধারি রান্নাঘরে ঝোড়ো হাওয়ার মত পাক খেতে থাকে। যে মেয়ের সকালসন্ধে খালি একটাই স্বপ্ন, একটাই আশা, একটাই অপেক্ষা - চ্যাম্পিয়নের শিরোপা, সেই মেয়ে আজ বলছেটা কী ?
-“মা, আমার ট্রিপের টাকাটা ওদের হাতে তুলে দিতে চাই মা…”
মিতাদেবীর বিহ্বল, বিমূঢ় চোখের অতলে অবাধ্য প্রশ্নেরা হাবুডুবু খেতে থাকে…
-“মা, চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার জীবনে হয়ত আবার আসবে, কিন্তু …” ইতিমধ্যেই মনস্থির করে নিয়েছে বুনাই। বুকের ভিতর মোচড় দিচ্ছে না বলা শব্দগুলো…। ধরা গলায় ফিস ফিস করে ওঠে মেয়েটা-“ঐ বন্যার্ত মানুষগুলো- যাদের প্রাণটুকু নিয়ে জীবন আর মৃত্যু আজ দড়ি টানাটানিতে চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করে দিয়েছে, তাদের জীবনে হয়ত এ সুযোগ আর আসবে না …”
-------------------------------------------------------