Tuesday, 14 July 2020
Tuesday, 7 July 2020
সম্পাদকীয, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০,
সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০ |
সম্পাদকীয়
এলবার্ট কামুর মতে 'আত্মহনন একটি দার্শনিক সমস্যা'। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আত্মহনন বলতে আমরা কী বুঝব? তা কি শুধুই ব্যক্তিগত? আমাদের পৃথিবী, আমাদের পরিবেশকে নিরন্তর হত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছি যে আমরা, সেও কি একধরণের আত্মহননের প্রচেষ্টা নয়? সভ্যতা এগিয়ে চলেছে, কিন্তু কোনদিকে? আরও একটু আয়াসের অর্থ কি মৃত্যুর আরও একটু কাছাকাছি যাওয়া? আরও একটু স্বার্থপরতার অর্থ অন্যকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া? ২০২০ আমাদের ভাবনার গতিপথ বদলে যাওয়ার বছর।নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখারও। মৃত্যু এবং খিদে, এই দুটি সত্য আমাদের জড়িয়ে রখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। সাহিত্য কি প্রলেপ হয়ে উঠবে? নাকি সে হয়ে উঠবে এই সময়ের দর্পণ, যার অমোঘ স্বর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে ভয়ের বিরুদ্ধে আমাদের আপসহীন সংগ্রামের কথা?
Monday, 6 July 2020
ভাস্কর পালের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
শ্যামশ্রী রায় কর্মকারের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, Shyamashri Ray Karmakar
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
পথের ওপর একা মানুষ, ক্ষোভের ভারে ন্যুব্জ
ঝোলার ভেতর শুকনো রুটি এবং ভীরু উদ্বেগ
নীরবতার হাত ধরেছেন, নীরব মানে কান্না
পথ বেড়ে যায় পথ বেড়ে যায় মনের সাথে যুদ্ধেই
গ্রামের ঘরে বৃদ্ধ বাবা, অর্ধভুক্ত সন্তান
অদর্শনে সন্ধ্যা সকাল নিজের ছায়া দীর্ঘ
কুসুম আজও শুধুই শরীর, কুসুম অর্থ অন্ন
পথ বেড়ে যায় পথ বেড়ে যায় খিদের সাথে যুদ্ধেই
পর্দা জুড়ে সেলিব্রিটির দিগ্বিজয়-আখ্যান
দেশের কাছে শ্রমিক এখন খিদেয় মৃত সংখ্যা
কোনটা হবে অনন্ত আর কাদের মৃত্যু পলকা
এ বিতর্কে ক্লান্ত তিমির, তারারা বাকরুদ্ধ
একা মানুষ মরতে থাকেন বাড়ি ফেরার গল্পে
রাজ্য থেকে রাজ্যে কেবল মুখের ভাষা বদলায়
তৈমুর খান, কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা,২০২০
তৈমুর খান
'আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর,
দুরন্ত পবন অতি—আক্রমণ তার
অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার।
বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘভার
খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া॥'
( 'মেঘদূত': রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কতবার দেখা হল তবুও দেখি তাকে। উন্মুখ চেয়ে থাকি। চুল সরাও খোলো আঁখি। ঘন হয়ে এল নীলিমা তোমার। দুলে ওঠে ওই মেঘভার। বৃষ্টি চৈতন্যের ইঙ্গিত বাজে প্রকৃতির চতুর্দিক জুড়ে। হৃদয় উথলে ওঠে। নদীও যৌবনবতী হয়। প্রাণ ভরে পান করে জল। অন্তরঙ্গ কোনো বাউল গেয়ে ওঠে যেন। কতদূর পথ হেঁটে সে ফিরছে এই বৃষ্টির দেশে। গৈরিক ধুলোমাখা শরীর সে জুড়িয়ে নিতে চায়। খোলা আকাশের নিচে তার একতারা তুলে ধরে। আজ মনের মাটি তার ভিজিয়ে নেবার দিন।
বাউল তো আমরাও। কলমটা তুলে ধরেছি এই জানালার ধারে। বৃষ্টি ও হাওয়া এসে চুলে দিয়ে যাচ্ছে কোমল স্পর্শ। একখণ্ড মেঘের রুমালে মুছে নিচ্ছি মুখ। আজ সব এলোমেলো ভাঙচুর। দূরের পাখিরা দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। তারাও কি ভিজিয়ে নিচ্ছে ডানা? আমারও খাতা ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে শব্দও। আজ সব বৃষ্টিমাখা অনুভব।
দূরে গাছের পাতায় পাতায় কী উচ্ছল হাসি ! মর্মর শব্দে ছড়িয়ে দিচ্ছে কাঁপন।এক একটি কাঁপন কুড়িয়ে নিচ্ছি নিভৃতে। শব্দ-তরঙ্গে পাঠাতে চাই তাকে। যে আমাকে গাছ হতে বলে চলে গেছে অন্যকোনো পরাগ মিলনে। কেমন আছে ওর বাগান? শুধু মাটির গন্ধ। পাতার গন্ধ আজ প্লাবিত করে। আত্মাকে মুক্তি দিই আমি ; সে বাগানে যদিও সে নিষিদ্ধ আপেল খেতে চায়।
কে বাজায় বাঁশি? আমি তার নাম জানি নাকো। শুধু সুর এসে ধাক্কায়। তরঙ্গে তরঙ্গে নাচে জল। জলের লীলায় ভাসি। জলের লীলায় হাসি। জলে জলে বিকেল গড়াই। জগতে আজ শুধুই বাজে জলবাঁশি। হৃদয়ের স্রোতে গঙ্গা-যমুনা জেগে ওঠে। তীরে কি নেমেছে ঈশ্বরী? ভাসিয়ে দিলাম নৌকা তবে। সাবধানে পেরিয়ে যাও। এই স্রোত বড় ভয়ঙ্করী। কেবল উদ্দাম আর উদ্যত উল্লাস। দুই কানা ভাঙতে থাকে জলের বিলাস।
নিসর্গের ভাষা জেনে নেয় আজ কত কালিদাস। যক্ষপুরীর দিকে চলে যাচ্ছে মেঘ। চিরন্তন এ পৃথিবী মেঘের শতক। বিরহ লেখা কালের নিয়মে যক্ষ সবাই। প্রিয়ার কাছে তাদেরও বাণী পৌঁছে দিতে চায়। হে বিরহ কাল, হে বিরহ বাণী, আমরাও দূত চিনি। আমাদের এসএমএস নিয়ে যায় মেঘ। আমাদের টাওয়ার ওই বিশাল উঁচু গাছ। বৃষ্টির অক্ষরে মেশাই অশ্রুজল। তারপর শব্দ-বাক্য-পদ…. সর্বনাম-ক্রিয়া-অব্যয়। তারপর আমাদের ক্ষমা করে আকাশ :
'Only a Cock stood on the rooftree
co co rico co co rico
In a flash of lighting then a damp gust
Bringing rain.'
কালো মেঘ। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির কণ্ঠস্বর। আমাদের পাপ ধুয়ে দেয়। নেমে আসে ধারাবর্ষণ। যে ধারায় আজও আমরা স্নাত, পবিত্র এবং উৎফুল্ল। সেই বৃষ্টি তো ভিত্-হারাও করে। ঘরে ঘরে বন্যা পাঠায়। ঘরে ঘরে হাহাকার তোলে। পাপের মুক্তি এবং মুক্তির পাপ দুইই আমাদের প্রার্থনা করতে শেখায়। প্রণাম করতে শেখায়। তখন তো সেকথাও লিখতে হয়:
'ঘোররাতে আমাদেরই শুধু
বারেবারে করো ভিৎহারা ?
সকলেই আছে বুকজলে
কেউ জানে কেউ বা জানে না
আমাকে যে সহজে বোঝালে
প্রণাম তোমাকে বৃষ্টিধারা।'
( 'বৃষ্টিধারা': শঙ্খ ঘোষ)
সৃষ্টির, মুক্তির, সাম্যের প্রতীক হে বৃষ্টিধারা, আজ শুধু তোমার ভাষায় তোমাকেই ডাকি। বৃষ্টি হোক অন্তরে বাহিরে। আর ভিজতে ভিজতে আমাদের দিন, আমাদের রাত। আর ভিজতে ভিজতে তুলে নিই কোলে ভেজা দুই হাত। সেইতো চিরন্তনি! ঘোরের ভেতর জেগে ওঠে তার মুখ। ঠোঁটের পাপড়ির কী স্নিগ্ধতা! স্ফুরিত ব্যাকুল! আর নীলশাড়ি ভেজা নিঙাড়ি নিঙাড়ি একাকী চলেছে পথে। আজ তার অভিসার। বৈষ্ণব যুগ থেকে এই মোবাইল যুগ— দীর্ঘ রাস্তায় তার পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে। এলোমেলো চূর্ণ কুন্তলে ঢেকে আছে মুখ। তবু তার ফর্সা হাত, কী সুন্দর গভীর কালো চোখ আর উজ্জ্বল শ্বেত-শুভ্র দাঁতের ঝিকিমিকি দেখতে পাই। আলতা কি ধোয়া গেল তোমার? শুধু পা, পায়ের ওঠানামা। বৃষ্টির অঙ্গনে শুধু তোমার পদধ্বনি!
'হৃদয়-রূপক কিছু নেই, কিছু নেই,
নেই বেলফুল, রজনীগন্ধা, জুঁই,
চুপ করে শুধু চেয়ে থাকি তার মুখে,
চোখ দিয়ে শুধু কালো চোখ দুটি ছুঁই।
চিরন্তনীর অলক্ষ্য অভিসার
পার হয়ে এসে তুচ্ছের বঞ্চনা
বলে কানে কানে, 'আমার অঙ্গীকার
ভুলবো না আমি, কোনোদিন ভুলবো না!'
('বর্ষার দিন' : বুদ্ধদেব বসু)
অবশেষে অন্ধকারে ফিরে আসা বাসার পাখি। প্রদীপ জ্বেলে মুখ দেখা। শূন্য মনে স্বপ্নের রেখাপাতে রাঙিয়ে দেওয়া। সুপ্তির গহীনে তলিয়ে যাওয়া। বর্ষা মানে সেই ইচ্ছে, হৃদয় দিয়ে হৃদয় নিচ্ছে। পালিয়ে যাচ্ছে, ফিরেও আসছে। যন্ত্রণায় আনন্দ পাচ্ছে। সীমার মাঝে অসীম হচ্ছে। আর অসীম এসে সীমায় ঢুকছে। বাংলার কদম্ব বনে বনে চলো খুঁজে আনি বর্ষাকে। শ্রীমতী বর্ষা আজ নামুক ঘরে ঘরে।
চন্দন বাসুলীর কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
বাপ্পাদিত্য রায়বিশ্বাসের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
Sunday, 5 July 2020
সায়নের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
আমার গীতবিতান কোথায়?
নবকুমার পোদ্দারের কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
মহুয়া মিত্রের গল্প, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
" শ্রীচরণেষু মা,
আমার প্রণাম নিও । জানো, আমার জন্মদিনে তোমার জামাই আমাকে হীরের গয়না উপহার দিয়েছে । এই বাড়ির সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে । শাশুড়িমা আমার পছন্দ মত রান্না করেন, শ্বশুরমশাইয়ের কাছে আমি নিজের মেয়ের চাইতেও বেশি । আর দেওর তো নিত্যনতুন উপহার আনে আমার জন্য ।
আমি খুব ভালো আছি । তুমিও ভালো থেকো মা ।
ইতি,
তোমার মল্লিকা ।। "
চিঠি শেষ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল মল্লিকা । বলা হল না, অফিস কলিগের সাথে স্বামীর অবৈধ সম্পর্কের কথা বা পণের দাবিতে শাশুড়ীমায়ের অকথ্য গালিগালাজের কথা । শ্বশুরের কুদৃষ্টি বা টাকা চেয়ে না পেয়ে দেওরের দু'ঘা মারার কথাও বলতে পারল না । কারণ চিঠির ঐ মিথ্যাগুলোই যে মল্লিকার জীবনের চরমতম সুখ ।
পুস্তক আলোচনাঃঃ নারী ও পুরুষ, আলোচনায় মনীষা শেখ, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
পুস্তক আলোচনা
নারী ও পুরুষ
লেখকঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
আলোচনায় মনীষা শেখ
এই লকডাউনে আমাদের মন এখন বিষাদগ্রস্ত। কবে পৃথিবী স্বাভাবিক হবে, কবে ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে ভরে উঠবে স্কুল প্রাঙ্গণ, কেউ জানে না। হাতে অঢেল সময় পাওয়াতে ভাবলাম বইয়ের আলমারি গোছানোর কাজটা করে রাখি। আর এই গোছাতে গিয়েই পেয়ে গেলাম একটা অসাধারণ বই। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারী ও পুরুষ।
বইখানি আগে পড়েছি। তবে সময়ের ধুলোবালি পড়ার ফলে অনুজ্জ্বল হয়ে গেছিল ছবিটা। এখন এই মধ্যবয়সে এসে বইটা নতুন করে পড়লাম এবং আবারও মুগ্ধ হলাম। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খুবই প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষও। মানুষটির কথা ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। ছিন্নমূল হয়ে ভারতে এসে জীবিকা ও জীবিকা অর্জনের জন্য কি না করেছেন! কখনো কখনো জাহাজের ডেকে নাবিক হয়ে সারা পৃথিবী পর্যটন, কখনো কোন কারখানার ম্যানেজার শিক্ষক সাংবাদিকের ভূমিকা পালন। সব ভূমিকাতেই তিিনি সমান উজ্জ্বল ।
এখন বইটার কথা বলি। মানুষের মনের বিপন্নতার নানা দিক তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর অসামান্য সব উপন্যাসে আমরা সবাই তা জানি। কিন্তু ভারতবর্ষে নারীদের যে সমস্যা বর্তমানে আমাদের প্রত্যহ হতাশ্ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ করে , এমনকি লকডাউনের ভারতেও যে পাপ আমাদের ছেড়ে যায় না, সেই ধর্ষণের কথাই বলছি।
নারী ও পুরুষ গল্পটি ধর্ষণের প্রেক্ষাপটে লেখা। এক বন্ধের দিনে একটি খুন হয়। ধর্ষিতা মেয়েটি আশ্রয় নেয় অনিল তথা মেজদার বাড়িতে। এখান থেকেই লেখক বুনতে থাকেন তার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন আমাদের আচ্ছন্ন করে দেয়।
নিজেদের অজান্তেই আমরা ঢুকে পড়ি মেজদার সহেলী কুঞ্জে, যে কুঞ্জে আছে সারি সারি পর্যটন কুটির ।আছে শাল, সেগুন, পিয়ালের সারি, আছে অজস্র ফুলের সমারোহ। মেজদার লাগানো কৃত্রিম বনাঞ্চল। মাঝে সরু সরু রাস্তা, বড় পুকুর্ মনোরম ঝিল, দেশি-বিদেশি গাছের সমারোহ। একবার চেয়ে সহজে এসেছে সে বারবার না এসে পারে না মনে হয় স্বপ্নের পৃথিবী। অনিল তথা মেজদা সারাদিন এই কুঞ্জে ঘুরে বেড়ায় । কীভাবে কোথায় কোন গাছ লাগালে, কোন ফুল ফুটলে প্রিয় হয়ে উঠবে এই কথা মাথায় অনবরত পাক খায়। তাকে দেখলে মনে হবে সে যেন জীবনভর এক ঘোরের মধ্যে আছে।
উপন্যাসের শেষে মেজদা তথা অধীর সেঁজুতিকে বলেন, "বোঝা যা , সবকিছু আমাদের বয়ে নেবার সুযোগ দিয়ে দেখ না, পারি কিনা !" পুরুষের এমন কাম্য ছবিই তো মেয়েরা গোপনে লালন করে। এমন নরম উষ্ণতার কথাও নারীকে শেষ পর্যন্ত পুরুষই বলতে পারে। পুরুষ ছাড়া কে আছে নারীর, যার পাশে গাছ হয়ে ফুল হয়ে ফুটে থাকা যায়!
মানুষের ভালোবাস্ মানুষের প্রতারণা , নারী-পুরুষের আশ্চর্য এক সম্পর্কের কথা বলেছেন লেখক। একইশরীর, একই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ , একই কামনা। অথচ কখনো মিলন মধুর, কখনো পাশবিকতার স্মৃতি। এই উপন্যাসে নারী পুরুষের সম্পর্কের উপর নতুন করে আলো ধরেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। তুলে ধরেছেন জীবনের ইতিবাচক দিকটিকেও।
পাওলো পাসোলিনি-র কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, অনুবাদঃ হিন্দোল ভট্টাচার্য
পাওলো পাসোলিনি-র কবিতা
পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্র যত রক্তহীন তত ঠান্ডা। যেন মর্গ থেকে উঠে এসেছে। যেন তাদের কোনও ঈশ্বর নেই, মা-বাবা নেই, প্রেমিক-প্রেমিকাও অপেক্ষা করছে না। পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্রের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে আদিম সরীসৃপ। তাদের শীতল জিভে কী প্রবল খিদে! মানুষ নিজের ছায়ার উপরে ঢেলে দেয় প্রতিহিংসাগুলো। আমরা অপেক্ষা করি।
আমাদের চোখের সামনে থেকে সরে গেল পর্দা। জ্বলে উঠল আলো। আমরা সেই আলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী ঠান্ডা আলো! যেন যুদ্ধের সার্চলাইট। আজ সমস্ত ক্ষুধার্ত নেকড়ের মুখ আমি মানচিত্রের মতো দেখি। কে এক এসেছে আমাদের শহরে আজ, নরকের আত্মা থেকে কী বিশাল হাঁমুখ এক আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আমাদের চোখের সামনে এত আলো! এত আলো, তবু তার অন্ধকার তত বেশি উজ্জ্বল এখন!
অপমানগুলোর কথা মনে রেখো। মনে রেখো, আমরা কেউ সৈন্য হয়ে জন্মাইনি। একটি ফুলের কথাও মনে রেখো। মনে রেখো, ঘাসের লনের কথা। পাহাড়ের গায়ে এঁকে বেঁকে উঠে যাওয়া রাস্তাটির কথা। মেয়েটার কথাও মনে রেখো, যার একটা বাচ্চা ভেড়া ছাড়া আর কেউ নেই।
বিশ্বাস করি না তবু, নতমস্তকে স্বীকার করি, তুমিই ঈশ্বর। বলি, তুমিই ঈশ্বর। আরও চিৎকার করে বলি, হ্যাঁ, তুমিই ঈশ্বর। নিজের গলা নিজেই দুহাতে চেপে ধরে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই ঈশ্বর। আত্মহত্যা করতে করতে বলি, তুমিই একমাত্র ঈশ্বর। বিশ্বাস করি না, তবু,মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও বলি, হে ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও। ঈশ্বর মৃদু হাসেন। সেফটি ক্যাচের শব্দ হয় ঘড়ির ভিতর।
একটা গাঢ় অন্ধকার বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে আসত প্রতিদিন। কী শীতল যে তার চোখদুটি! ভাগ্যিস তুমি নিজের দিকে তাকাওনি কোনওদিন, বলতাম। সে হেসে ফেলত। তার হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ত বিষাক্ত হেমন্ত। আমি বলতাম, আমি তো সুন্দরের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সে একটা আগুনের পরিখার মধ্যে দিয়ে এসে দাঁড়াত এই ব্রিজে। যার তলা দিয়ে বয়ে গেছে রক্তাক্ত এক নদী। আমি বলে উঠতাম কেন আমার দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে গেলে! সে এসব শুনে আমাকে চুমু খেতে এগিয়ে আসত। আমি তার মুখের ভিতর ঢুকে পড়তাম। সে আমাকে শুষে নিত এক ভেজা অন্ধকারের ভিতর। আলো ছিল না কোনও। আর তার পর হো হো করে হেসে আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিত। আমি শ্বাস নিতাম। আমি দেখতাম একটা খেলনার পৃথিবী তার খেলনার মতো মানুষজন নিজেদের দিকে বেয়নেট উদ্যত করে আছে। কেউ ভালো নেই, কেউ ভালো থাকবে না, এমন তো কথা ছিল না বিয়াত্রিচে! সে ফিরে যেত তার অদ্ভুত বাড়ির দিকে। অন্ধকার বাড়ি। চারিদিকে আশ্চর্য বাগান। সেখানে কিছু অন্তর্বাস হাওয়ায় উড়ছে। আমি চেষ্টা করেও এই ব্রিজ পেরোতে পারিনি। সেও এপারে আসেনি কখনও। একটি গাঢ় অন্ধকার বাড়ি আমাদের অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে প্রতিদিন।
Friday, 3 July 2020
পৃথা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
ঘন হয়ে ছেয়ে গেলে সমস্ত আকাশ
ধানখেতে মেলে দাও
সজল শরীর
দূর বন্য অন্তরাল থেকে
জেগে ওঠো তুমি
সুঠাম আলস্য ভাঙা দেহ
এই কি প্রথম দেখা জীবনের পর্যটক তটে !
আমার শরীর ভেঙে কবিতার প্রেম
কুচোকুচো মেঘ এসে মিশে যায়
কদমের ফুলে
দিশেহারা হয়ে যায় নিয়মেরা
মেঘের অলক থেকে
আলটুসি খসে পড়ে
অলস দুপুর
বৃষ্টিরেণু মেখে
Thursday, 2 July 2020
সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, উইসলাওয়া সিমবোরস্কা,
এই সংখ্যার কবিঃ মিঠুন চক্রবর্তী, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
মিঠুন চক্রবর্তীর কবিতা
Wednesday, 1 July 2020
প্রত্যূষ কর্মকারের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষাসংখ্যা, ২০২০
অপেক্ষা
প্রত্যূষ কর্মকার
নিভৃত সাঁকোর নীচে যেখানে মূর্তি নদীটি,ক্ষীণ দেহ,
পাথরে পাথরে ক্ষত বিক্ষত,তবুও বহমান,
অনন্ত থেকে নেমে এলে তুমি,হাতে কারু সাজি,
আঁচলে জড়িয়ে আছো আদুরে বাতাস,
তর্জনী ছুঁয়ে আছে প্রিয়মুখ স্নেহ;
বলেছিলে একদিন ধীর চোখে,'যেতে পারি,আপনি যদি যান'-
আজ মূর্তি নদীর মত ম্রিয়মাণ মুখ নিয়ে ছুঁয়ে আছি শ্রান্ত সোপান
কাঞ্চন ফুলে ঢেকে আছে মায়াপথ
গেস্ট হাউসের লনে সন্ধ্যা ঝুঁকে পড়ে নিবিড়ের মগ্নতা নিয়ে
এখানে প্রেম বহে জারুলের গন্ধের মত
এখানেই লিখে রাখি অনন্ত শয়ান
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প 'শরণাগত' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
শরণাগত
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়
কাঁদতে-কাঁদতে পথের ধূলোয় লুটিয়ে পড়েছে সারণ্যা ।
ধম্মপাদের আজ অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । সারণ্যার পিতামাতা তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে আর ফেরেনি । না ফেরার কারণ সকলের অজানা । প্রত্যেকে অনুমান করে নিয়েছে তারা দুজনেই জীবিত নেই । সারণ্যাকে ধম্মপাদের মাতার কাছে রেখে তীর্থে গিয়েছিল সারণ্যার পিতামাতা । তাই ছেলেবেলা থেকে তার আর সারণ্যার একসঙ্গে বেড়ে ওঠা । কত খুনসুটি । কঠিন অসুখে একদিন ধম্মপাদের মাতা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল । তখন ধম্মপাদের বয়স নয় ও সারণ্যার সাত ।
সারণ্যার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে ধম্মপাদ তার বেণী ধরবার চেষ্টা করলেই তারস্বরে কান্না জুড়ে দিত । আর তার পিতা পুঁথিতেই চোখ নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর স্বরে বলে উঠতেন, ‘সুবোধ ছেলেদের এহেন কর্ম্ম শোভা পায় না ধম্মপাদ ।’ কথাটা শুনেই ধম্মপাদ সংকুচিত হয়ে পড়ত । আর সেই সুযোগে সারণ্যা একছুটে কিছুটা দূরে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ তুলে বনানীর আড়ালে লুকিয়ে পড়ত । আর রাগে ধম্মপাদ শূন্যে আপন দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছুঁড়ে দিত ।
আবার সারণ্যা যখন নিজে না খেয়ে পাথরের খোরায় তার জন্য অন্ন সাজিয়ে অপেক্ষা করত, তখন ধম্মপাদের মন সারণ্যার সব দুষ্টুমিকে ক্ষমা করে দিত । পুঁথি অধ্যয়ন করতে-করতে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সারণ্যা তার পুঁথি সযত্নে কুঠুরীতে তুলে রেখে তার মাথায় উপাধান দিয়ে দিত । সারণ্যার করুণাময়ী রূপ ধম্মপাদকে তার মাতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতো ।
আজ ধম্মপাদের অনেক পুরনো কথা স্মরণে আসছে । নাহ্, সে আজ অশ্রুপাত করে অন্তর ভারি করবে না । আজ আসক্তি, মায়া, স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার স্পৃহাকে সে পরাস্ত করতে পেরেছে । পিতার আর্তি, সারণ্যার কোমল বাহুডোর উপেক্ষা করেছে । মস্তকের উপর নিশ্চিত ছাদ, সম্মুখে সজ্জিত অন্নের মায়া ত্যাগ করে সে আজ পথে বেরিয়েছে । সে আর সংসারজীবনের ক্ষুদ্র মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারবে না ।
সারিপুত্র স্বহস্তে তাকে পাঠদান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একসময়ে সংসারের আসক্তিতে আচ্ছন্ন ধম্মপাদের আজ সংসারকে বিষবৎ লাগে । সে আজ প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে অনন্ত মুক্তির আলো । সেই সুকোমল পাদপদ্মে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে । কর্ণে দিবানিশি ভেসে আসে ...
“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
ধম্মং শরণং গচ্ছামি
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ।।”সুবিৎ ব্যানার্জীর কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
ভাঙন
কতখানি মাটি গেল ঝুপ ঝুপ
গড়ান বানের রাতে,
উঠে দেখতে হয় বারে বার।
বড় মশা ও মাছির উপদ্রব হয় এ সময়।
কাঠের তক্তাপোষ আড় হয়ে দোলে
তিনটে ঠ্যাঙের দাগে।
চন্ডাল ! আলো জ্বালো আগে...
হিম হিম বর্ষার রাত ,
যেকোন কাজে জানোইতো বড় করে আগুন লাগে।
বিপ্র সনাতন গান ধরো ভাই , প্রাণ ভোলে সুরে সুরে
ভোর হবার খানিক আগে।
মাতলা নদীর বাঁক... নেতা ধোপানির ঘাট
সোমত্ত নারীর মত ডাকে , অন্ধকার ফাঁক।
নিজের ছায়ার গায়ে কতক্ষণ হাত বোলানো যায় আর এভাবে!
শুভনীতা মিত্রের কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০
আপনজন
শুভনীতা মিত্র
বাবার কাছে শুনেছি পিসিঠাম্মার গল্প
মাঝেমধ্যেই তিনি চলে আসতেন তার দাদাদের কাছে
ছোট ভাইপো ভাইঝি দের সোহাগ করতে
না, তার কোন নিজের সন্তান ছিল না
প্রকৃত সঙ্গিনী নাকি তিনি হয়ে উঠতে পারেননি
তার স্থান ছিল মাটিতে চাটাইয়ে
মারধোরের সাথে মিলে যেত কিছুটা খাবার
আবার কিছুদিন পর বলতেন ফিরে যাওয়ার কথা...
মাঝরাতে উঠে বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে
বসে থাকতেন ভোরের আলোর অপেক্ষায়
আসবাবে ঠাসা ঘরে জায়গা হয়েছিল ওঁর
খুব বেশি আলো ঢুকতো না সেখানে
তবু কোন এক ইচ্ছেয় ভর করে তিনি ঠিক
খুঁজে নিতেন আপনজন