Tuesday, 7 July 2020

সম্পাদকীয, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০,



সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০

সম্পাদকীয়

এলবার্ট কামুর মতে 'আত্মহনন একটি দার্শনিক সমস্যা'। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আত্মহনন বলতে আমরা কী বুঝব? তা কি শুধুই ব্যক্তিগত? আমাদের পৃথিবী, আমাদের পরিবেশকে নিরন্তর হত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছি যে আমরা, সেও কি একধরণের আত্মহননের প্রচেষ্টা নয়? সভ্যতা এগিয়ে চলেছে, কিন্তু কোনদিকে? আরও একটু আয়াসের অর্থ কি মৃত্যুর আরও একটু কাছাকাছি যাওয়া? আরও একটু স্বার্থপরতার অর্থ অন্যকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া? ২০২০ আমাদের ভাবনার গতিপথ বদলে যাওয়ার বছর।নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখারও। মৃত্যু এবং খিদে, এই দুটি সত্য আমাদের জড়িয়ে রখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। সাহিত্য কি প্রলেপ হয়ে উঠবে? নাকি সে হয়ে উঠবে এই সময়ের দর্পণ, যার অমোঘ স্বর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে ভয়ের বিরুদ্ধে আমাদের আপসহীন সংগ্রামের কথা?
 
এইসংখ্যাটি বিশেষ অনুবাদ সংখ্যা। বেশ কয়েকটি বিদেশি কবিতার অনুবাদ করলেন শ্রদ্ধেয় কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য, উজ্জ্বল ঘোষ, সুজিত মান্না প্রমুখ। আশা করি পাঠকের ভাল লাগবে। সেইসঙ্গে গল্প, কবিতা, পুস্তক আলোচনায় নবীন এমং প্রবীনদের কলম স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকল। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা 'বাসন্তী' র ভিডিও প্রকাশ করা হল। এই সংখ্যার কবি মিঠুন চক্রবর্তী। তাঁর কবিতারও ভিডিও প্রকাশিত হল । এই প্রয়াস যাদের জন্য, বিচারের দায়ভার থাকল সেই প্রিয়  পাঠকের ওপর।






Monday, 6 July 2020

রাজীব মৌলিকের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০





মুখ 

রাজীব মৌলিক  




যে মুখে তুমি কথা বলে হেসে ওঠো 
ও মুখ আদতে আঁশটে গন্ধের পাতাবাহার

দহন শেষে ছাই যেমন বিজ্ঞাপন দেয়
ওই মুখও উনুনের কালোয় ভরে যায় 
পোষা বেড়ালের মতো জাত ভুলে
মালিক কেন্দ্রিক হয়ে
সকলে বোঝাতে চায় 
হাসি একটি উপহার

আর উপহার, 
কন্যাদানের মতো শর্তহীন

ভাস্কর পালের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




ব্ল্যাক চাইল্ড

ভাস্কর পাল


আমি অবসন্ন হয়ে গেলে
ঝুঁকে পড়ি আরও
বিষন্ন হৃদয় নিয়ে
আমি ছুঁতে চাই মাটির ভালোবাসা।
বিধ্বস্ত ঝড় যদি আসে
তোলপাড় করে
আমার মন আঙিনা
উড়ে যাওয়া যন্ত্রণা থেকে
আমি কুড়িয়ে নেই বিন্দু বিন্দু স্বেদ
 হাত তুলে দেই আকাশে
প্রশংসায় ভরিয়ে নেই আমার স্মৃতির ধারাপাত
আমি প্রশংসা করি সূর্যের
প্রতিটি সকালে আলোকস্নানের জন্য
অতিবেগুনী রশ্মি আমায় ছুঁয়ে চলে যায়
আমি আদরে হাত তুলি
আমার স্পর্শ সীমানায় তুমি কালো শিশু।
আমি তোমাদের ধার করা অহংকার দিয়ে
পুরুষকারের দিকে তাকাই, হাসি
নিস্পন্দিত ধার করা পেশী, তাদের দীর্ঘ এবং সংক্ষিপ্ত বন্দুকগুলি
ক্রমধাবমান উজ্জ্বলতম মৃত্যু গোলক
আমায় আপন করে নেয়।

শ্যামশ্রী রায় কর্মকারের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, Shyamashri Ray Karmakar



গল্প
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

পথের ওপর একা মানুষ, ক্ষোভের ভারে ন্যুব্জ
ঝোলার ভেতর শুকনো রুটি এবং ভীরু উদ্বেগ
নীরবতার হাত ধরেছেন, নীরব মানে কান্না
পথ বেড়ে যায় পথ বেড়ে যায় মনের সাথে যুদ্ধেই

গ্রামের ঘরে বৃদ্ধ বাবা, অর্ধভুক্ত সন্তান
অদর্শনে সন্ধ্যা সকাল নিজের ছায়া দীর্ঘ
কুসুম আজও শুধুই শরীর, কুসুম অর্থ অন্ন
পথ বেড়ে যায় পথ বেড়ে যায় খিদের সাথে যুদ্ধেই

পর্দা জুড়ে সেলিব্রিটির দিগ্বিজয়-আখ্যান
দেশের কাছে শ্রমিক এখন খিদেয় মৃত সংখ্যা
কোনটা হবে অনন্ত আর কাদের মৃত্যু পলকা
এ বিতর্কে ক্লান্ত তিমির, তারারা বাকরুদ্ধ
একা মানুষ মরতে থাকেন বাড়ি ফেরার গল্পে
রাজ্য থেকে রাজ্যে কেবল মুখের ভাষা বদলায়

তৈমুর খান, কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা,২০২০




শ্রীমতী বর্ষা

তৈমুর খান


 'আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর,

 দুরন্ত পবন অতি—আক্রমণ তার

 অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার।

 বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘভার

 খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া॥'

        ( 'মেঘদূত': রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 কতবার দেখা হল তবুও দেখি তাকে। উন্মুখ চেয়ে থাকি। চুল সরাও খোলো আঁখি। ঘন হয়ে এল নীলিমা তোমার। দুলে ওঠে ওই মেঘভার। বৃষ্টি চৈতন্যের ইঙ্গিত বাজে প্রকৃতির চতুর্দিক জুড়ে। হৃদয় উথলে ওঠে। নদীও যৌবনবতী হয়। প্রাণ ভরে পান করে জল। অন্তরঙ্গ কোনো বাউল গেয়ে ওঠে যেন। কতদূর পথ হেঁটে সে ফিরছে এই বৃষ্টির দেশে। গৈরিক ধুলোমাখা শরীর সে জুড়িয়ে নিতে চায়। খোলা আকাশের নিচে তার একতারা তুলে ধরে। আজ মনের মাটি তার ভিজিয়ে নেবার দিন।

       বাউল তো আমরাও। কলমটা তুলে ধরেছি এই জানালার ধারে। বৃষ্টি ও হাওয়া এসে চুলে দিয়ে যাচ্ছে কোমল স্পর্শ। একখণ্ড মেঘের রুমালে মুছে নিচ্ছি মুখ। আজ সব এলোমেলো ভাঙচুর। দূরের পাখিরা দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। তারাও কি ভিজিয়ে নিচ্ছে ডানা? আমারও খাতা ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে শব্দও। আজ সব বৃষ্টিমাখা অনুভব।

       দূরে গাছের পাতায় পাতায় কী উচ্ছল হাসি ! মর্মর শব্দে ছড়িয়ে দিচ্ছে কাঁপন।এক একটি  কাঁপন কুড়িয়ে নিচ্ছি নিভৃতে। শব্দ-তরঙ্গে পাঠাতে চাই তাকে। যে আমাকে গাছ হতে বলে চলে গেছে অন্যকোনো পরাগ মিলনে। কেমন আছে ওর বাগান? শুধু মাটির গন্ধ। পাতার গন্ধ আজ প্লাবিত করে।  আত্মাকে মুক্তি দিই আমি ; সে বাগানে যদিও সে নিষিদ্ধ আপেল খেতে চায়।

        কে বাজায় বাঁশি? আমি তার নাম জানি নাকো। শুধু সুর এসে ধাক্কায়। তরঙ্গে তরঙ্গে নাচে জল। জলের লীলায় ভাসি। জলের লীলায় হাসি। জলে জলে বিকেল গড়াই। জগতে আজ শুধুই বাজে জলবাঁশি। হৃদয়ের স্রোতে গঙ্গা-যমুনা জেগে ওঠে। তীরে কি নেমেছে ঈশ্বরী? ভাসিয়ে দিলাম নৌকা তবে। সাবধানে পেরিয়ে যাও। এই স্রোত বড় ভয়ঙ্করী। কেবল উদ্দাম আর উদ্যত উল্লাস। দুই কানা ভাঙতে থাকে জলের বিলাস।

        নিসর্গের ভাষা জেনে নেয় আজ কত কালিদাস। যক্ষপুরীর দিকে চলে যাচ্ছে মেঘ। চিরন্তন এ পৃথিবী মেঘের শতক। বিরহ লেখা কালের নিয়মে যক্ষ সবাই। প্রিয়ার কাছে তাদেরও বাণী পৌঁছে দিতে চায়। হে বিরহ কাল, হে বিরহ বাণী, আমরাও দূত চিনি। আমাদের এসএমএস নিয়ে যায় মেঘ। আমাদের টাওয়ার ওই  বিশাল উঁচু গাছ। বৃষ্টির অক্ষরে  মেশাই অশ্রুজল। তারপর শব্দ-বাক্য-পদ…. সর্বনাম-ক্রিয়া-অব্যয়। তারপর আমাদের ক্ষমা করে আকাশ :

'Only a Cock stood on the rooftree

    co co rico co co rico

In a flash of lighting then a damp gust

         Bringing rain.'

                              ( T.S.  Eliot)

    কালো মেঘ। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির কণ্ঠস্বর। আমাদের পাপ ধুয়ে দেয়। নেমে আসে ধারাবর্ষণ। যে ধারায় আজও আমরা স্নাত, পবিত্র এবং উৎফুল্ল। সেই বৃষ্টি তো ভিত্-হারাও করে। ঘরে ঘরে বন্যা পাঠায়। ঘরে ঘরে হাহাকার তোলে। পাপের মুক্তি এবং মুক্তির পাপ দুইই আমাদের প্রার্থনা করতে শেখায়। প্রণাম করতে শেখায়। তখন তো সেকথাও লিখতে হয়:

 'ঘোররাতে আমাদেরই শুধু

 বারেবারে করো  ভিৎহারা ?

 সকলেই আছে বুকজলে

 কেউ জানে কেউ বা জানে না

 আমাকে যে সহজে বোঝালে

 প্রণাম তোমাকে বৃষ্টিধারা।'

       ( 'বৃষ্টিধারা': শঙ্খ ঘোষ)

       সৃষ্টির, মুক্তির, সাম্যের প্রতীক হে বৃষ্টিধারা, আজ শুধু তোমার ভাষায় তোমাকেই ডাকি। বৃষ্টি হোক অন্তরে বাহিরে। আর ভিজতে ভিজতে আমাদের দিন, আমাদের রাত। আর ভিজতে ভিজতে তুলে নিই কোলে ভেজা দুই হাত। সেইতো চিরন্তনি! ঘোরের ভেতর জেগে ওঠে তার মুখ। ঠোঁটের পাপড়ির কী স্নিগ্ধতা! স্ফুরিত ব্যাকুল! আর নীলশাড়ি ভেজা নিঙাড়ি নিঙাড়ি একাকী চলেছে পথে। আজ তার অভিসার। বৈষ্ণব যুগ থেকে এই মোবাইল যুগ— দীর্ঘ রাস্তায় তার পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে। এলোমেলো চূর্ণ কুন্তলে ঢেকে আছে মুখ। তবু তার ফর্সা হাত, কী সুন্দর গভীর কালো চোখ আর উজ্জ্বল শ্বেত-শুভ্র দাঁতের ঝিকিমিকি দেখতে পাই। আলতা কি ধোয়া গেল তোমার? শুধু পা, পায়ের ওঠানামা। বৃষ্টির অঙ্গনে শুধু তোমার পদধ্বনি!

'হৃদয়-রূপক কিছু নেই, কিছু নেই,

নেই বেলফুল, রজনীগন্ধা, জুঁই,

চুপ করে শুধু চেয়ে থাকি তার মুখে,

চোখ দিয়ে শুধু কালো চোখ দুটি ছুঁই।

চিরন্তনীর অলক্ষ্য অভিসার 

পার হয়ে এসে তুচ্ছের বঞ্চনা

বলে কানে কানে, 'আমার অঙ্গীকার

ভুলবো না আমি, কোনোদিন ভুলবো না!'

       ('বর্ষার দিন' : বুদ্ধদেব বসু)

     অবশেষে অন্ধকারে ফিরে আসা বাসার পাখি। প্রদীপ জ্বেলে মুখ দেখা। শূন্য মনে স্বপ্নের রেখাপাতে রাঙিয়ে দেওয়া। সুপ্তির গহীনে তলিয়ে যাওয়া। বর্ষা মানে সেই ইচ্ছে, হৃদয় দিয়ে হৃদয় নিচ্ছে। পালিয়ে যাচ্ছে, ফিরেও আসছে। যন্ত্রণায় আনন্দ পাচ্ছে। সীমার মাঝে অসীম হচ্ছে। আর অসীম এসে সীমায় ঢুকছে। বাংলার কদম্ব বনে বনে চলো খুঁজে আনি বর্ষাকে। শ্রীমতী বর্ষা আজ নামুক ঘরে ঘরে।





চন্দন বাসুলীর কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




আশ্রয়ের অবর্তমানে 

চন্দন বাসুলী


এখানে কোনো পাহাড় নেই
কোনো নদী নেই
কোনো জঙ্গলও নেই

আছে বিস্তীর্ণ একটা মাঠ 
কোথাও সবুজ 
কোথাও ধু-ধু ফাঁকা 

অদ্ভুত নির্জনতায়
যেন সঙ্গীহীন দাঁড়িয়ে আছে 
আকাশের মুখে চেয়ে 

এসবের কাছেই বার-বার যাই 
আর ফিরে আসি,ফিরে আসতেই হয় 
একা কোনো জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা যায়না 

যখনই গিয়েছি ওদের কাছে
আমি চেয়েছি 
শুধু চেয়েছি 

কেউ তো আসুক - একেবারে নতুন কেউ
যার কাছে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে 
অসুখী বিকেল গুলোতে
বাবা নামের আশ্রয়ের অবর্তমানে !

বাপ্পাদিত্য রায়বিশ্বাসের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



আবার 
বাপ্পাদিত্য রায়বিশ্বাস 

চলেছ...
পায়ের ছাপ মুছতে মুছতে 
             আমি পেছন পেছন 
এভাবেই 
           লুকিয়ে পড়া বারান্দা 
           জংলা বাগান 
           ধসা মন্দিরের রাধামাধব 
           আর একা হওয়া নদীর স্রোত 
                                    আমাকে চিনিয়েছ
জানোই তো কত কষ্টে আটপৌরে মেঝেটুকু 
                                                  শুকিয়েছি
অথচ সে-ই মাথায় আকাশ নিয়ে 
                                  তোমায় ঢুকতে হ'লো 
চলেছ...
পায়ের ছাপ মুছতে মুছতে 
             আমি পেছন পেছন 
উঠোন 
বারান্দা 
কলতলা
ঘর...
একটু দাঁড়াও, এবার শেকলটা তুলে দিয়ে আসি।

Sunday, 5 July 2020

সায়নের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




আমার গীতবিতান কোথায়? 
সায়ন

কবরের অপেক্ষায় শুয়ে থাকে মাটি
তোমার পেটে একটা গাছের চারা- টব, রক্তসার মাটি
প্রাণে বেঁচে যাওয়া
মুন্ডহীন জন্মের অভিশাপ
গান গাইতে গাইতে শকুনের ঠোঁটে সমর্পণ করে শিশু
পাথরভাঙা কবি খোঁজে মৃত গণসংগীতের প্রাণ
নরম হাতের মুঠোয় কাঠ ফাটা গালঠোঁট
একটা পুকুরের প্রশান্তির মতো
একটা ঘাসের প্রথম পৃথিবী দেখার মতো
একটা পাখির কথা বলার মতো কোমল
ভালো করে তোমার চুলে ডুবে থাকা
পৃথিবীবাড়ির ছায়া, চোখে লিখে রাখা গীতবিতানের সকাল ।


নবকুমার পোদ্দারের কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






নবকুমার পোদ্দারের কবিতা 

এলোমেলো 

রুদ্ধশ্বাসে তছনছ হতে পারছি না
হে জীবন
মহার্ঘ মহাজন
পোষা পিয়ানোর কাছে আমার মেধা,তালু,মেঘ
বুলডোজার দিয়ে কে ভেঙে দিচ্ছে তবে?
আয়নার বিষাদময় গর্ভে একটা গোটা দিন জলে ডুবে রইল
এও কি ট্রাজেডির লুন্ঠন  নয়!


বায়ু

অসুখ দিয়ে বেঁধে রেখছ
রোগ ছড়াচ্ছে গাছের ছালে
স্বপ্নে স্বপ্নে মেদ খাই
যৌনটিকা এঁকে কাম অরণ্যে 
আমার কাব্যভাষা সতী নয়
যেমন তোমার ঠোঁটের কোতল!
ফেনায় ফেনায় ফূর্তি মূর্তি 
দাহ হয় অনন্ত ছোবল
 জিভ কবুতর ছোঁয়
সমতল মলাট ধোয় দাঁতের 
সুপ্ত ব্যঞ্জনে শরীর শরীর বায়ু যায়।

মহুয়া মিত্রের গল্প, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



গল্প  

মল্লিকার চিঠি
মহুয়া  মিত্র

" শ্রীচরণেষু মা,
                      আমার প্রণাম নিও । জানো, আমার জন্মদিনে তোমার জামাই আমাকে হীরের গয়না উপহার দিয়েছে । এই বাড়ির সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে । শাশুড়িমা আমার পছন্দ মত রান্না করেন, শ্বশুরমশাইয়ের কাছে আমি নিজের মেয়ের চাইতেও বেশি । আর দেওর তো নিত্যনতুন উপহার আনে আমার জন্য ।
         আমি খুব ভালো আছি । তুমিও ভালো থেকো মা ।
                                             ইতি,
                                             তোমার মল্লিকা ।। "

চিঠি শেষ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল মল্লিকা । বলা হল না, অফিস কলিগের সাথে স্বামীর অবৈধ সম্পর্কের কথা বা পণের দাবিতে শাশুড়ীমায়ের অকথ্য গালিগালাজের কথা । শ্বশুরের কুদৃষ্টি বা টাকা চেয়ে না পেয়ে দেওরের দু'ঘা মারার কথাও বলতে পারল না । কারণ চিঠির ঐ মিথ্যাগুলোই যে মল্লিকার জীবনের চরমতম সুখ ।

পুস্তক আলোচনাঃঃ নারী ও পুরুষ, আলোচনায় মনীষা শেখ, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




পুস্তক আলোচনা  
নারী ও পুরুষ
লেখকঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়  
আলোচনায় মনীষা শেখ 

 এই লকডাউনে আমাদের মন  এখন বিষাদগ্রস্ত।  কবে পৃথিবী স্বাভাবিক হবে, কবে ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে ভরে উঠবে স্কুল প্রাঙ্গণ, কেউ জানে না।  হাতে অঢেল সময় পাওয়াতে ভাবলাম বইয়ের আলমারি গোছানোর কাজটা করে রাখি। আর এই গোছাতে গিয়েই পেয়ে গেলাম একটা অসাধারণ বই।  অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারী ও পুরুষ।

বইখানি আগে পড়েছি।  তবে সময়ের ধুলোবালি পড়ার ফলে অনুজ্জ্বল হয়ে গেছিল ছবিটা। এখন এই মধ্যবয়সে এসে বইটা নতুন করে পড়লাম এবং আবারও মুগ্ধ হলাম। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খুবই প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষও।  মানুষটির কথা ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। ছিন্নমূল হয়ে ভারতে এসে জীবিকা ও জীবিকা অর্জনের জন্য কি না করেছেন! কখনো কখনো জাহাজের ডেকে নাবিক হয়ে সারা পৃথিবী পর্যটন, কখনো কোন কারখানার ম্যানেজার শিক্ষক সাংবাদিকের ভূমিকা পালন। সব ভূমিকাতেই  তিিনি সমান উজ্জ্বল   ।
 এখন বইটার কথা বলি।  মানুষের মনের বিপন্নতার নানা দিক তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর অসামান্য সব উপন্যাসে আমরা সবাই তা জানি। কিন্তু ভারতবর্ষে নারীদের যে সমস্যা বর্তমানে আমাদের প্রত্যহ হতাশ্‌ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ করে , এমনকি লকডাউনের ভারতেও যে পাপ আমাদের ছেড়ে যায় না, সেই ধর্ষণের কথাই বলছি।

নারী ও পুরুষ গল্পটি ধর্ষণের প্রেক্ষাপটে লেখা।  এক বন্ধের দিনে একটি খুন হয়। ধর্ষিতা মেয়েটি আশ্রয় নেয় অনিল তথা মেজদার বাড়িতে।  এখান থেকেই লেখক বুনতে থাকেন তার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন আমাদের আচ্ছন্ন করে দেয়।
  নিজেদের অজান্তেই আমরা ঢুকে পড়ি মেজদার সহেলী কুঞ্জে,  যে কুঞ্জে আছে সারি সারি পর্যটন কুটির ।আছে শাল, সেগুন, পিয়ালের সারি,  আছে অজস্র ফুলের সমারোহ।  মেজদার লাগানো কৃত্রিম বনাঞ্চল।  মাঝে সরু সরু রাস্তা, বড় পুকুর্‌ মনোরম ঝিল, দেশি-বিদেশি গাছের সমারোহ। একবার চেয়ে সহজে এসেছে সে বারবার না এসে পারে না মনে হয় স্বপ্নের পৃথিবী।  অনিল তথা মেজদা সারাদিন এই কুঞ্জে ঘুরে বেড়ায় । কীভাবে কোথায় কোন গাছ লাগালে, কোন ফুল ফুটলে প্রিয় হয়ে উঠবে এই কথা মাথায় অনবরত পাক খায়। তাকে দেখলে মনে হবে সে যেন জীবনভর এক ঘোরের মধ্যে আছে।
 
একটি ধর্ষিতা মেয়েকে জীবনে ফিরিয়ে আনার এই  কাহিনী  পড়লে মনে হয় এইতো! পুরুষ তো এমনই হওয়ার কথা। এই বইয়ে অনেক চরিত্র । সেঁজুতি, অমিয় কপালী, ধীরে্‌ লোকনাথ কাকা , সুশান্ত, শ্রাবণ্‌ পল্লবী- সব বলতে গেলে লেখাটা বিরাট হয়ে যাবে।  মেজদারও বিপন্নতা আছে।  সেই বিপন্নতার নাম সহেলী। আমরা সবাই কোন না কোন সহেলীর জন্য বড় হয়ে উঠছি। আমরা লেখাপড়া করছি।  সাইকেলে জ্যোৎস্নায় মাঠ পার হয়ে যাচ্ছি , বালির চড়ায় নির্জন রাতে তার কথা ভাবতে ভাবতে আকাশের নক্ষত্র গুনছি । বইটি পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হয় উপন্যাস নয়, কোনও কবিতা পড়ছে বুঝি।
 উপন্যাসের শেষে মেজদা তথা অধীর সেঁজুতিকে বলেন,  "বোঝা যা , সবকিছু আমাদের বয়ে নেবার সুযোগ দিয়ে দেখ না, পারি কিনা !" পুরুষের এমন কাম্য ছবিই তো মেয়েরা গোপনে লালন করে। এমন নরম উষ্ণতার কথাও নারীকে শেষ পর্যন্ত পুরুষই বলতে পারে। পুরুষ ছাড়া কে আছে নারীর, যার পাশে গাছ হয়ে ফুল হয়ে ফুটে থাকা যায়!

 মানুষের ভালোবাস্‌ মানুষের প্রতারণা , নারী-পুরুষের আশ্চর্য এক সম্পর্কের কথা বলেছেন লেখক। একইশরীর, একই  অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ , একই কামনা। অথচ  কখনো মিলন মধুর, কখনো পাশবিকতার স্মৃতি। এই উপন্যাসে নারী পুরুষের সম্পর্কের উপর নতুন করে আলো ধরেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।  তুলে ধরেছেন জীবনের ইতিবাচক দিকটিকেও।

পাওলো পাসোলিনি-র কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, অনুবাদঃ হিন্দোল ভট্টাচার্য


পাওলো পাসোলিনি-র কবিতা 
অনুবাদ- হিন্দোল ভট্টাচার্য

যুদ্ধের দিনগুলির কবিতা

পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্র যত রক্তহীন তত ঠান্ডা। যেন মর্গ থেকে উঠে এসেছে। যেন তাদের কোনও ঈশ্বর নেই, মা-বাবা নেই, প্রেমিক-প্রেমিকাও অপেক্ষা করছে না। পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্রের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে আদিম সরীসৃপ। তাদের শীতল জিভে কী প্রবল খিদে! মানুষ নিজের ছায়ার উপরে ঢেলে দেয় প্রতিহিংসাগুলো। আমরা অপেক্ষা করি।

আমাদের চোখের সামনে থেকে সরে গেল পর্দা। জ্বলে উঠল আলো। আমরা সেই আলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী ঠান্ডা আলো! যেন যুদ্ধের সার্চলাইট। আজ সমস্ত ক্ষুধার্ত নেকড়ের মুখ আমি মানচিত্রের মতো দেখি। কে এক এসেছে আমাদের শহরে আজ, নরকের আত্মা থেকে কী বিশাল হাঁমুখ এক আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আমাদের চোখের সামনে এত আলো! এত আলো, তবু তার অন্ধকার তত বেশি উজ্জ্বল এখন!

অপমানগুলোর কথা মনে রেখো। মনে রেখো, আমরা কেউ সৈন্য হয়ে জন্মাইনি। একটি ফুলের কথাও মনে রেখো। মনে রেখো, ঘাসের লনের কথা। পাহাড়ের গায়ে এঁকে বেঁকে উঠে যাওয়া রাস্তাটির কথা। মেয়েটার কথাও মনে রেখো, যার একটা বাচ্চা ভেড়া ছাড়া আর কেউ নেই।

বিশ্বাস করি না তবু, নতমস্তকে স্বীকার করি, তুমিই ঈশ্বর। বলি, তুমিই ঈশ্বর। আরও চিৎকার করে বলি, হ্যাঁ, তুমিই ঈশ্বর। নিজের গলা নিজেই দুহাতে চেপে ধরে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই ঈশ্বর। আত্মহত্যা করতে করতে বলি, তুমিই একমাত্র ঈশ্বর। বিশ্বাস করি না, তবু,মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও বলি, হে ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও। ঈশ্বর মৃদু হাসেন। সেফটি ক্যাচের শব্দ হয় ঘড়ির ভিতর।

ব্রিজের উপরে ঠান্ডা মেয়েটি

একটা গাঢ় অন্ধকার বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে আসত প্রতিদিন। কী শীতল যে তার চোখদুটি! ভাগ্যিস তুমি নিজের দিকে তাকাওনি কোনওদিন, বলতাম। সে হেসে ফেলত। তার হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ত বিষাক্ত হেমন্ত। আমি বলতাম, আমি তো সুন্দরের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সে একটা আগুনের পরিখার মধ্যে দিয়ে এসে দাঁড়াত এই ব্রিজে। যার তলা দিয়ে বয়ে গেছে রক্তাক্ত এক নদী। আমি বলে উঠতাম কেন আমার দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে গেলে! সে এসব শুনে আমাকে চুমু খেতে এগিয়ে আসত। আমি তার মুখের ভিতর ঢুকে পড়তাম। সে আমাকে শুষে নিত এক ভেজা অন্ধকারের ভিতর। আলো ছিল না কোনও। আর তার পর হো হো করে হেসে আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিত। আমি শ্বাস নিতাম। আমি দেখতাম একটা খেলনার পৃথিবী তার খেলনার মতো মানুষজন নিজেদের দিকে বেয়নেট উদ্যত করে আছে। কেউ ভালো নেই, কেউ ভালো থাকবে না, এমন তো কথা ছিল না বিয়াত্রিচে! সে ফিরে যেত তার অদ্ভুত বাড়ির দিকে। অন্ধকার বাড়ি। চারিদিকে আশ্চর্য বাগান। সেখানে কিছু অন্তর্বাস হাওয়ায় উড়ছে। আমি চেষ্টা করেও এই ব্রিজ পেরোতে পারিনি। সেও এপারে আসেনি কখনও। একটি গাঢ় অন্ধকার বাড়ি আমাদের অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে প্রতিদিন।


(পাওলো পাসোলিনি একজন ইতালিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯২২-১৯৭৫। চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন প্রচুর প্রবন্ধ, কবিতা এবং গল্প। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।)
  

বর্ণালী কোলের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



দুটি কবিতা
বর্ণালী কোলে


গৃহবধূ

বিকেলে বারান্দায় দাঁড়াও তুমি
তোমার ম্লান চোখ

একদিন দরজা খুলে 
চলে যাবে দিগন্তে?

মেঘে কুটির বাঁধো

তোমার বর হোক
সন্ধের পথে হাঁটা জীবনানন্দ


তিরস্কার

কেন মেজাজ হারিয়েছিলে, কেন?

তোমার তো দরকার ধ্যান
তোমার তো অশ্বত্থের বৃক্ষ

Friday, 3 July 2020

পৃথা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০







মেঘের অলক
পৃথা চট্টোপাধ্যায়

ঘন হয়ে ছেয়ে গেলে সমস্ত আকাশ
ধানখেতে মেলে দাও
সজল শরীর
দূর বন্য অন্তরাল থেকে
জেগে ওঠো তুমি
সুঠাম আলস্য ভাঙা দেহ

এই কি  প্রথম দেখা জীবনের পর্যটক তটে !
আমার শরীর ভেঙে কবিতার প্রেম
কুচোকুচো মেঘ এসে মিশে যায়
কদমের ফুলে

দিশেহারা হয়ে যায় নিয়মেরা
মেঘের অলক থেকে
আলটুসি খসে পড়ে
অলস দুপুর
বৃষ্টিরেণু মেখে

Thursday, 2 July 2020

সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, উইসলাওয়া সিমবোরস্কা,




Wislawa Szymborska উইসলাওয়া সিমবোরস্কা (১৯২৩ - ২০১২) পোল্যান্ডের কবি। ১৯৯৬ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী ।

অনুবাদ : অভিজিৎ পালচৌধুরী

স্বপ্নকে ভালোবেসে ..

আমার স্বপ্নে আমি
ভারমির ভ্যান ডেলফ্টের মত আঁকি

অনর্গল গ্রিক বলি
এবং তা শুধু জীবিতদের সাথেই নয়

একটা গাড়ি চালাই
যেটা আমি যা করাতে চাই, করে

আমি নিজে প্রতিভাশালী
এবং শক্তিশালী মহাকাব্য লিখি

পরিষ্কার কন্ঠস্বর শুনি
যে কোনো শ্রদ্ধাভাজন সন্ন্যাসীর মতো

পিয়ানোবাদক হিসেবে আমার প্রতিভা
তোমাকে মুগ্ধ করবে

আমাদের যেভাবে ওড়া উচিত
সেভাবেই উড়ি, মানে নিজে নিজেই

ছাদ থেকে লাফিয়ে
ঘাসের ওপর ধীরে নেমে আসি

জলের নিচে শ্বাস নিতে
আমার কোন সমস্যা নেই

নালিশ জানাতে পারি না
অ্যাটলান্টিসকে খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছি

এটাই সন্তোষের যে মৃত্যুর আগে 
আমি সর্বদা জেগে উঠতে পারি

যুদ্ধ শুরু হলেই
আমার অন্যদিকে গড়িয়ে যাই

আমি আমার বয়সী একটি শিশু
কিন্তু আমার সেটা হবার দরকার নেই

কয়েক বছর আগে
দু'টো সূ্র্য দেখেছিলাম

এবং গতরাতের আগের রাতে 
একটি পেঙ্গুইন
দিনের মতো পরিষ্কার  ।।



মেঘপুঞ্জ

মেঘের বর্ণনা করতে
আমাকে খুব তৎপর হতে হবে 
তাদের জন্য একটা মুহূর্তের ভগ্নাংশ যথেষ্ট 
অন্য কিছু হয়ে যেতে 

তাদের ট্রেডমার্ক :
কোন একটি বিশেষ আকার, রঙ, ভঙ্গিমা 
এবং বিন্যাস যা তারা কখনো পুনরাবৃত্তি করে না 

কোনরকম স্মৃতি ভারে 
ভারাক্রান্ত না হয়ে তারা 
সহজেই বাস্তবের ওপর ভেসে বেড়ায় 

পৃথিবীর কোন ঘটনায় 
তাদের সাক্ষ্য বহন করতে হয় ? 
যখনই কিছু ঘটে, তারা ছড়িয়ে যায় 

মেঘের সাথে তুলনা করলে 
জীবন শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে 
বাস্তবিকই স্থায়ী, প্রায় চিরায়ত 

মেঘের পরে 
এমনকি একটা পাথরকেও ভাই মনে হয় 
যার ওপর তুমি নির্ভর করতে পারো 
যেখানে মেঘেরা শুধুমাত্র দূরে
ভেসে যাওয়া তুতো-ভাইয়ের দল 

মানুষকে থাকতে দাও, যদি তারা চায় 
এবং তারপরে মরতে দাও, একের পর এক 
মেঘেরা থোড়াই কেয়ার করে 
তারা কিসের জন্য সেখানে আছে 

এবং তাই তাদের উদ্ধত বাহিনী 
তোমার গোটা জীবনের ওপর 
মসৃণভাবে ভেসে বেড়ায় 
এবং আমার , এখনো অসম্পূর্ণ 

আমরা চলে গেলেও তারা উধাও হবে 
এমন কোনো দায় নেই তাদের 
ভাসমানতায় তাদের দৃশ্যমান 
হবার কোন প্রয়োজন নেই  ।।




এই সংখ্যার কবিঃ মিঠুন চক্রবর্তী, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০


মিঠুন চক্রবর্তীর কবিতা


অপাঠ্য

যখনই শহরে যাই, মনে পড়ে পলিদির কথা। 
আগে গ্রাম ছিল। 
বেখাপ্পা সারল্য সরিয়ে বুকের ঢালু পথে
আজও থেকে গেছে বহমান নদীটি । 

বিকেলের লঞ্চে বাড়ি ফিরি,
চলমান দূরে মানুষের টুকরো টুকরো তৈলচিত্রে
ক্রমশ কালো কালো ছোপ পড়ে আসে.... 

ভাবি, পলিদির সাথে শেষ কবে দেখা... মনে নেই
অজস্র কর্মব্যস্ততার মাঝে একা একলা নদীটিতে
সন্ধের আগে অপাঠ্য লাল লাল ঢেউ ওঠে....

 
 
অসুখ সময়ে

যেন কোন্ অসুখের মধ্যে আছি
ফুলের দিকে তেমন কোনো ফুল দেখিনা,
নদীর দিকে তেমন কোনো নদীও না

চরাচর জুড়ে ধূসর ঘোড়া এক ঘুমিয়ে রয়েছে । 

এইসব কুয়াশা পেরিয়ে কিছু বিলুপ্ত পাখি আসে, 
ঠোঁটে খড়কুটো বয়ে এনে আমার ভেতরে বাসা বাঁধে। 
আমি যেন শহুরে প্রাচীন বটের ভাঙাচুরো ছায়াটি

রোজ রাতে শেকড় থেকে এক বুনো চাঁদ উঠে এসে
একা একা চুপ করে বসে থাকে মাথার উপরে। 


 
 
যে ভালোবেসেছে



ভাবনা জুড়ে স্পর্শ তোমার, আকাশ জুড়ে পথ.... 
ভালোবাসার কাছেই আছে মনে রাখার শপথ

মনের ভেতর সোনালি মাছ, বুকের ভেতর সুখ, 
দখিন হাওয়ায় আলোর পালক এমনি করেই ভাসুক

এমনি করেই দিন কেটে যাক, এমনি করেই রাত
ঝিনুক-মহল সাজিয়ে রাখুক মুক্তো লেখা হাত

হাত ঘুরিয়ে বৃষ্টি নামাও.... হাত ঘুরিয়ে রোদ....
ভালোবাসা মানেই যেন আগুন পেল বারুদ।

আগুন দেখে উৎসাহীরা দেখতে এলে ছাঁই
দেখিয়ে দেবো পলাশ বনে ফুটেছে রোশনাই

 
 
মাঠ এবং ঘুমন্ত চাঁদ

সন্ধের মাঠটিতে ওরা এসে দাঁড়াল।
দু'পাশের গোলপোস্টের কোনোটিতেই তখন 
                            কোনও বিষাদচিহ্ন ঝুলে নেই। 
দাঁড়াতেই ঘাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মেঘ....

শান দেওয়া দু'ফোঁটা বৃষ্টি 
বুকের রোমকূপে কতটা ধারালো হতে পারে
                                           --- বুঝল পুরুষসঙ্গীটি
মেয়েটিও আগে কখনো দ্যাখেনি ,
পাথরের লকলকে জিভে লেগে থাকা নরম স্থাপত্য। 

দূরে দিগন্ত নেই, রাস্তা.... নীল কুয়াশা চিরে 
ঘুমন্ত চাঁদ কোলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে কাপাসতুলো


আলো


কচি নিমপাতার মত আঙুলে যখন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছ আমায়
তোমার হাতে রেখেছি আমার দীর্ঘ দিনের না সারা অসুখ

আহা! অসুখও কতখানি মনোরম হতে পারে
জ্যোৎস্না ছুঁয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে ইঁট- খসা প্রাচীন স্থাপত্য

এবং তুমি আঙুল নির্দেশ করে দেখাচ্ছ - 'ওই জানলা.... 
ফাটলে বটগাছ,  ওখানেই তো এসে দাঁড়াত ইন্দুকুমারী
স্নান করে ছড়িয়ে দিত ভেজা লম্বা চুল,  বেল ফুলের গন্ধ

আর, ঐ- ঐ যে দূরে চাঁপাগাছ ওখানে ব্রাহ্মণপুত্র চন্দ্রাহত
রোজ পূজোর ফুল তুলতে এসে সাজিতে ভরে নিত প্রেম... '

এখন আমি তোমার স্পর্শে আমাদমস্তক আলোর উৎসস্থল।

কিছুক্ষণ থেমে, কিছুটা অন্ধকার দেখিয়ে তুমি বলে উঠলে,
'ঐ - ওখানে কালো মোটা বীভৎস লোকটা অত্যন্ত গোপনে
একটা ধারালো অস্ত্র বাতাসে সবেগে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে
এসব সুগন্ধি  দৃশ্যে ভারী পর্দা ফেলে নির্বিকার চিত্তে বলেছিল, 
'রাজাদেশ একমাত্র সত্যি, বাকি সবকিছু ভ্রম, সত্যি ভেবো না '

মুচকি হাসলাম আমি, তুমিও বোধহয়

একঝাঁক বয়স্ক নক্ষত্রের নিচে অঙ্কুরিত আলোয় দেখছি,
প্রাচীন উঠোনে বসে হুবহু সবকিছু খাতায় তুলে নিচ্ছে 
সাদা সালোয়ার-কামিজের পাশে হলুদ পাঞ্জাবী পর্যটক 


কবি পরিচিতি: বাঁকুড়া জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম ছাগুলিয়াতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।ছোটো থেকেই কবিতার প্রতি নিবিড় টান।বর্তমানে বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায় এবং লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত কবিতা প্রকাশিত হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতার সংগে যুক্ত।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : 
১ | যারা এখনও ভিজতে ভালোবাসে
২| যাপন কোলাজ
৩| রাতের কমলা রঙের মেয়েগুলি
৪| নীল প্রজাপতির উপত্যকা
৫| পঞ্চদর্শী ( পাঁচজন কবির কাব্য সংকলন)
 
 

Wednesday, 1 July 2020

প্রত্যূষ কর্মকারের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষাসংখ্যা, ২০২০



অপেক্ষা
প্রত্যূষ কর্মকার 

নিভৃত সাঁকোর নীচে যেখানে মূর্তি নদীটি,ক্ষীণ দেহ,
পাথরে পাথরে ক্ষত বিক্ষত,তবুও বহমান,
অনন্ত থেকে নেমে এলে তুমি,হাতে কারু সাজি,
আঁচলে জড়িয়ে আছো আদুরে বাতাস,
তর্জনী ছুঁয়ে আছে প্রিয়মুখ স্নেহ;
বলেছিলে একদিন ধীর চোখে,'যেতে পারি,আপনি যদি যান'-
আজ মূর্তি নদীর মত ম্রিয়মাণ মুখ নিয়ে ছুঁয়ে আছি শ্রান্ত সোপান
কাঞ্চন ফুলে ঢেকে আছে মায়াপথ
গেস্ট হাউসের লনে সন্ধ্যা ঝুঁকে পড়ে নিবিড়ের মগ্নতা নিয়ে
এখানে প্রেম বহে জারুলের গন্ধের মত
এখানেই লিখে রাখি অনন্ত শয়ান

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প 'শরণাগত' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০


শরণাগত

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

কাঁদতে-কাঁদতে পথের ধূলোয় লুটিয়ে পড়েছে সারণ্যা ।

ধম্মপাদের আজ অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । সারণ্যার পিতামাতা তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে আর ফেরেনি । না ফেরার কারণ সকলের অজানা । প্রত্যেকে অনুমান করে নিয়েছে তারা দুজনেই জীবিত নেই । সারণ্যাকে ধম্মপাদের মাতার কাছে রেখে তীর্থে গিয়েছিল সারণ্যার পিতামাতা । তাই ছেলেবেলা থেকে তার আর সারণ্যার একসঙ্গে বেড়ে ওঠা । কত খুনসুটি । কঠিন অসুখে একদিন ধম্মপাদের মাতা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল । তখন ধম্মপাদের বয়স নয় ও সারণ্যার সাত ।

সারণ্যার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে ধম্মপাদ তার বেণী ধরবার চেষ্টা করলেই তারস্বরে কান্না জুড়ে দিত । আর তার পিতা পুঁথিতেই চোখ নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর স্বরে বলে উঠতেন, ‘সুবোধ ছেলেদের এহেন কর্ম্ম শোভা পায় না ধম্মপাদ ।’ কথাটা শুনেই ধম্মপাদ সংকুচিত হয়ে পড়ত । আর সেই সুযোগে সারণ্যা একছুটে কিছুটা দূরে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ তুলে বনানীর আড়ালে লুকিয়ে পড়ত । আর রাগে ধম্মপাদ শূন্যে আপন দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছুঁড়ে দিত ।

আবার সারণ্যা যখন নিজে না খেয়ে পাথরের খোরায় তার জন্য অন্ন সাজিয়ে অপেক্ষা করত, তখন ধম্মপাদের মন সারণ্যার সব দুষ্টুমিকে ক্ষমা করে দিত । পুঁথি অধ্যয়ন করতে-করতে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সারণ্যা তার পুঁথি সযত্নে কুঠুরীতে তুলে রেখে তার মাথায় উপাধান দিয়ে দিত । সারণ্যার করুণাময়ী রূপ ধম্মপাদকে তার মাতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতো ।

   আজ ধম্মপাদের অনেক পুরনো কথা স্মরণে আসছে । নাহ্‌, সে আজ অশ্রুপাত করে অন্তর ভারি করবে না । আজ আসক্তি, মায়া, স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার স্পৃহাকে সে পরাস্ত করতে পেরেছে । পিতার আর্তি, সারণ্যার কোমল বাহুডোর উপেক্ষা করেছে । মস্তকের উপর নিশ্চিত ছাদ, সম্মুখে সজ্জিত অন্নের মায়া ত্যাগ করে সে আজ পথে বেরিয়েছে । সে আর সংসারজীবনের ক্ষুদ্র মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারবে না ।

সারিপুত্র স্বহস্তে তাকে পাঠদান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একসময়ে সংসারের আসক্তিতে আচ্ছন্ন ধম্মপাদের আজ সংসারকে বিষবৎ লাগে । সে আজ প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে অনন্ত মুক্তির আলো সেই সুকোমল পাদপদ্মে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে । কর্ণে দিবানিশি ভেসে আসে ...

“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

ধম্মং শরণং গচ্ছামি

সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ।।”

সুবিৎ ব্যানার্জীর কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০





ভাঙন
সুবিৎ

শোকেরও তো রোমন্থন লাগে।
কতখানি মাটি গেল ঝুপ ঝুপ
গড়ান বানের রাতে,
উঠে দেখতে হয় বারে বার।

বড় মশা ও মাছির উপদ্রব হয় এ সময়।
কাঠের তক্তাপোষ আড় হয়ে দোলে
তিনটে ঠ্যাঙের দাগে।

চন্ডাল ! আলো জ্বালো আগে...
হিম হিম বর্ষার রাত ,
যেকোন কাজে জানোইতো বড় করে আগুন লাগে।

বিপ্র সনাতন গান ধরো ভাই , প্রাণ ভোলে সুরে সুরে
ভোর হবার খানিক আগে।
মাতলা নদীর বাঁক... নেতা ধোপানির ঘাট
সোমত্ত নারীর মত ডাকে , অন্ধকার ফাঁক।

নিজের ছায়ার গায়ে কতক্ষণ হাত বোলানো যায় আর এভাবে!



শুভনীতা মিত্রের কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






আপনজন

শুভনীতা মিত্র 



বাবার কাছে শুনেছি পিসিঠাম্মার গল্প
মাঝেমধ্যেই তিনি চলে আসতেন তার দাদাদের কাছে 

ছোট ভাইপো ভাইঝি দের সোহাগ করতে
না, তার কোন নিজের সন্তান ছিল না
প্রকৃত সঙ্গিনী নাকি তিনি হয়ে উঠতে পারেননি
তার স্থান ছিল মাটিতে চাটাইয়ে
মারধোরের সাথে মিলে যেত কিছুটা খাবার

আবার কিছুদিন পর বলতেন ফিরে যাওয়ার কথা...

মাঝরাতে উঠে বাক্স প‍্যাঁটরা গুছিয়ে
বসে থাকতেন ভোরের আলোর অপেক্ষায়

আসবাবে ঠাসা ঘরে জায়গা হয়েছিল ওঁর
খুব বেশি আলো ঢুকতো না সেখানে
তবু কোন এক ইচ্ছেয় ভর করে তিনি ঠিক 

খুঁজে নিতেন আপনজন