Sunday, 5 July 2020

পাওলো পাসোলিনি-র কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, অনুবাদঃ হিন্দোল ভট্টাচার্য


পাওলো পাসোলিনি-র কবিতা 
অনুবাদ- হিন্দোল ভট্টাচার্য

যুদ্ধের দিনগুলির কবিতা

পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্র যত রক্তহীন তত ঠান্ডা। যেন মর্গ থেকে উঠে এসেছে। যেন তাদের কোনও ঈশ্বর নেই, মা-বাবা নেই, প্রেমিক-প্রেমিকাও অপেক্ষা করছে না। পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্রের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে আদিম সরীসৃপ। তাদের শীতল জিভে কী প্রবল খিদে! মানুষ নিজের ছায়ার উপরে ঢেলে দেয় প্রতিহিংসাগুলো। আমরা অপেক্ষা করি।

আমাদের চোখের সামনে থেকে সরে গেল পর্দা। জ্বলে উঠল আলো। আমরা সেই আলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী ঠান্ডা আলো! যেন যুদ্ধের সার্চলাইট। আজ সমস্ত ক্ষুধার্ত নেকড়ের মুখ আমি মানচিত্রের মতো দেখি। কে এক এসেছে আমাদের শহরে আজ, নরকের আত্মা থেকে কী বিশাল হাঁমুখ এক আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আমাদের চোখের সামনে এত আলো! এত আলো, তবু তার অন্ধকার তত বেশি উজ্জ্বল এখন!

অপমানগুলোর কথা মনে রেখো। মনে রেখো, আমরা কেউ সৈন্য হয়ে জন্মাইনি। একটি ফুলের কথাও মনে রেখো। মনে রেখো, ঘাসের লনের কথা। পাহাড়ের গায়ে এঁকে বেঁকে উঠে যাওয়া রাস্তাটির কথা। মেয়েটার কথাও মনে রেখো, যার একটা বাচ্চা ভেড়া ছাড়া আর কেউ নেই।

বিশ্বাস করি না তবু, নতমস্তকে স্বীকার করি, তুমিই ঈশ্বর। বলি, তুমিই ঈশ্বর। আরও চিৎকার করে বলি, হ্যাঁ, তুমিই ঈশ্বর। নিজের গলা নিজেই দুহাতে চেপে ধরে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই ঈশ্বর। আত্মহত্যা করতে করতে বলি, তুমিই একমাত্র ঈশ্বর। বিশ্বাস করি না, তবু,মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও বলি, হে ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও। ঈশ্বর মৃদু হাসেন। সেফটি ক্যাচের শব্দ হয় ঘড়ির ভিতর।

ব্রিজের উপরে ঠান্ডা মেয়েটি

একটা গাঢ় অন্ধকার বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে আসত প্রতিদিন। কী শীতল যে তার চোখদুটি! ভাগ্যিস তুমি নিজের দিকে তাকাওনি কোনওদিন, বলতাম। সে হেসে ফেলত। তার হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ত বিষাক্ত হেমন্ত। আমি বলতাম, আমি তো সুন্দরের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সে একটা আগুনের পরিখার মধ্যে দিয়ে এসে দাঁড়াত এই ব্রিজে। যার তলা দিয়ে বয়ে গেছে রক্তাক্ত এক নদী। আমি বলে উঠতাম কেন আমার দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে গেলে! সে এসব শুনে আমাকে চুমু খেতে এগিয়ে আসত। আমি তার মুখের ভিতর ঢুকে পড়তাম। সে আমাকে শুষে নিত এক ভেজা অন্ধকারের ভিতর। আলো ছিল না কোনও। আর তার পর হো হো করে হেসে আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিত। আমি শ্বাস নিতাম। আমি দেখতাম একটা খেলনার পৃথিবী তার খেলনার মতো মানুষজন নিজেদের দিকে বেয়নেট উদ্যত করে আছে। কেউ ভালো নেই, কেউ ভালো থাকবে না, এমন তো কথা ছিল না বিয়াত্রিচে! সে ফিরে যেত তার অদ্ভুত বাড়ির দিকে। অন্ধকার বাড়ি। চারিদিকে আশ্চর্য বাগান। সেখানে কিছু অন্তর্বাস হাওয়ায় উড়ছে। আমি চেষ্টা করেও এই ব্রিজ পেরোতে পারিনি। সেও এপারে আসেনি কখনও। একটি গাঢ় অন্ধকার বাড়ি আমাদের অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে প্রতিদিন।


(পাওলো পাসোলিনি একজন ইতালিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯২২-১৯৭৫। চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন প্রচুর প্রবন্ধ, কবিতা এবং গল্প। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।)
  

3 comments: