আত্মজিজ্ঞাসা
দূরত্ব রচে ব্যবধান
বাতাসে উড়ছে স্মৃতিরা
স্তব্ধ রয়েছে অভিমান
নামছে সন্ধ্যার ছায়া
আকাশে দু একটি তারা
দেহ কি সমাকীর্ণ মায়া ?
আত্মজিজ্ঞাসা
দূরত্ব রচে ব্যবধান
বাতাসে উড়ছে স্মৃতিরা
স্তব্ধ রয়েছে অভিমান
নামছে সন্ধ্যার ছায়া
আকাশে দু একটি তারা
দেহ কি সমাকীর্ণ মায়া ?
সৌরজাল
কর্মপন্থা
প্রান্তিক
সবুজ দ্বীপ
যদি পারো আবার এসো এতটা বলে চলে যেতে হতো। যে বৃষ্টি দাঁড়িয়ে ছিল অপেক্ষায়,
উবু হয়ে বসা চাঁদ হাতছানি দেয় তাকে। ইচ্ছের অতৃপ্ত নিঃশ্বাস গাঢ় করে
আঁধারের মৌনতা। সবকিছু ওই একটা যদির ভরসাতেই এদিক ওদিক হয়ে যায়। সাঁকো জোড়া
লাগে বা ভেঙে যায়। টুকরো অভিমান বাক্যালাপ সেরে নেয় প্রতিফলনে। শহর সমাপ্ত
হলে বিভাজিকা বাঁচিয়ে রাখে উত্তাপ।সম্মোহনের অপর নাম বৃষ্টি। জামার ক্লিপ
ময়লা বিকেল হয়ে হঠাৎ উড়ে যায় সবুজ দ্বীপে। ঘন নির্জনের আদরে সাজে বেনামী
ঠোঁট...
উজান
আজ মন বড় অশান্ত। ঘন ঘন বৃষ্টি আর বিদ্যুতের চমক... কোথাও একটা ছেলে সুর
করে পড়া মুখস্থ করছে। টিমটিমে আলোয় রাস্তা খানাখন্দ লুকিয়ে হয়ে উঠেছে মায়া
হরিণী। বিশতলা মহলে সে কি বিভোর নিজের গন্ধে না উঁচু থেকে চোখ পড়ে এখনও
সাধারণ হাফ শার্ট পুরনো ছাতার দিকে। ছায়া লম্বা হতে হতে একসময় সরে যায়
পাঁচিলের ওপারে। জানা হয় না অভিসারের গোপন ইচ্ছা বুকে নিয়ে কেন সে সাবলীল
অভিনয় করে গেল! বৃষ্টিও নেভাতে পারে না চিতার আগুন। প্রিয়জনের বিদায় গলার
কাছে দলা পাকানো নরম শোক হয়ে বিচরণ করে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে যায় জীবনে...
উজানে।
সমাধি
এই মুহূর্তে ঘোষিত হলো বিদায়
যে এসেছিল সাড়ম্বরে আজ তার নিঃশব্দ পদস্খলন
কোথায় যেন দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে আমাকেও
বলার নেই কিছুই
তৃষ্ণা মিটবে না জেনেও কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়া
বানানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিচ্ছেদ সঙ্গ দেয়
করিডোরের ফালি আলোতে খুলে বসি
ষড়যন্ত্রের বাক্স
আঁধারে ভূমিষ্ঠ জল সমাধির অপেক্ষায়...
আইসক্রিমের মতোন চাঁদ
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
যদি উঠতো রাতে আজ আইসক্রিমের মতোন চাঁদ
কোল্ড কফির কাপে ঝরতো রূপকথা
এই তরুণ অগাস্ট মাস চিঠিতে লিখতো মেঘের শ্বাস
বন্ধ কাচের গায়ে জলের চুপকথা
নিকনের লেন্সে জুম ইন ছাদ, ভাঙা কার্নিশ, ঠোঁটের প্রমাদ
হাতব্যাগের ভেতর টাটকা কবিতায়
উড়ুউড়ু চুল, ভোরে বাইপাস, গাড়িতে হাতের ওপর হাত
আর নিরুদ্দেশের সঙ্গে বন্ধুতা
পকেটের গোপন সাবমেরিন, দুফোঁটা বেহিসাবের দিন
কথাদের পিঠের ওপর উড়ুক্কু বাওবাব
খামের ভেতর মনখারাপ, ওপরে সমুদ্র নীল ছাপ
ডুবজলের এ গান তোমাকেই দিতাম
লাল পোস্তদানা
লুইস গ্লিক
ভাষান্তর: ইউসুফ মোল্লা
দুর্দান্ত জিনিসটির মন নেই।
অনুভূতি: ওহ, আমার সেগুলি আছে;
তারা আমাকে শাসন করে।
আমার স্বর্গের এক প্রভু আছেন
যাকে সূর্য বলা হয়,
এবং তাঁর জন্য উন্মুক্ত করে,
তাকে আমার উপস্থিত হৃদয়ের আগুন,
তাঁর উপস্থিতির মতো আগুন দেখাচ্ছে।
হৃদয় না থাকলে এ জাতীয় গৌরব কি হতে পারে?
ওহে আমার ভাই ও বোনেরা,
তুমি মানুষ হওয়ার আগে অনেক আগে,
তুমি কি আমার মতো ছিলে?
তুমি কি নিজেকে একবার খোলার অনুমতি দিয়েছ,
যে আর কখনও খুলবে না?
কারণ সত্যের সাথে আমি এখন,
তুমি যেভাবে কথা বলছো তা বলছি।
আমি কথা বলি কারণ আমি ছিন্নভিন্ন।
__________
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ
কানাইলাল জানা
২০০৬ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আলিপুরের বাড়িতে এলেন সাহিত্যের আড্ডায়। অনুষ্ঠান সন্ধে ৬ টায় এসে আটটা সাড়ে আটটায় চলে যাবেন বলে এলেন ৬ টা বাজতে ২ মিনিট বাকি এবং গেলেন রাত পৌনে ১১ টায়, এমনই জমেছিল সেবারের 'মহল'। আর ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সন্দীপণ চট্টোপাধ্যায় দিব্যেন্দু পালিত শুভাপ্রসন্ন পার্থ ঘোষ গৌরী ঘোষ রাজা সেন রাজা মিত্র কংকাবতী দত্ত প্রমুখ গুণীজন। কবি হিসেবে এসেছিলেন সৌমিত্রদা তাই তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়তে থাকলেন একের পর এক কবিতা। সবাই মুগ্ধ। অনিবার্যভাবে আলোচনায় এল নাটক অভিনয় গান গাওয়া রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমার সৌরভ গাংগুলি তনুজাসহ অন্যান্য নায়িকারা এবং বিশেষ ভাবে তুলসী চক্রবর্তী। যাওয়ার সময় তাঁর ভালোলাগার কথা জানিয়ে বলে গেলেন 'তোমার নতুন বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে রইল ' কারণ আলিপুরের বাড়ি তথা কোয়ার্টার্সে এটাই ছিল শেষ অনুষ্ঠান।
আমরা তাঁর নানা গুনের কথা বলি কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সরকারের সরস্বতী সম্মান (৬ লক্ষ টাকা) পেয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আনেয়ার শা রোডের মার্লিন হাউসে মজলিশ পার্টিতে আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন এবং সেখানে স্ন্যাকস নিতে নিতে সৌমিত্রদা যখন বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বলছিলেনঃ' ভাবো লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মধ্যে একসঙ্গে এত প্রতিভার সমাবেশ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি পাবে না কিন্তু। ' শুনে ভাবছিলাম সময় পেলে সৌমিত্রদা হয়তো ভাস্কর হওয়ার চেষ্টাটাও ছাড়তেন না।
আমার শ্রেষ্ঠ মুগ্ধতা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে তাঁর ৭০ তম জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে। ঢুকতেই পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর দাদার সংগে। লম্বায় একটু কম কিন্তু দেখতে অপরূপ যেন স্বর্গ থেকে এইমাত্র নেমে এলেন স্বয়ং দেবদূত!
অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে রেহাই দিতে কয়েক বছর আগে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বড় অংকের অর্থ দিতে চায় শুনে তাঁর বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বললেনঃ 'কোথায় বিশ্রাম? বরং যত দিন যাচ্ছে তত নানা কাজে জড়িয়ে পড়ছি। '
যে কাজেই আত্মনিয়োগ করুন কবিতা চর্চা তাঁকে ছেড়ে যায়নি কখনো তাই বরাবর আমার আশা ছিল তাঁর এই গুণটা অন্য অভিনেতা কেউ না কেউ অনুসরণ করবেন। স্বাধীনতার পর পরই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় যেভাবে বহু ফাঁকা জমি পেয়েছিলেন অনেক কিছু করার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবনে সেরকম ফাঁকা জমি না পেয়েও নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সারাজীবনটাই তাঁর নির্মাণের কাহিনি যা ফল্গু ধারার মতো মানুষকে প্রেরণা দেবে নিজেকে প্রস্তুত করার।
কয়েক দিন আগে তাঁর মোবাইলে ফোন করলে ছেলে সৌগত উদ্বেগ হীন কন্ঠে জানানঃ 'বাবা এখন স্টেবল্। ' শুনে একটু হলেও আশা জেগেছিল সম্ভব হলেও হতে পারে অন্তত কিছু দিনের জন্য ফিরলেন মিরাকল ঘটিয়ে 'ময়ূরবাহন '।
এখন আমাদের সামনে থাকল শুধু সীমাহীন উদারতা ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষের আঙ্গিকে তিলে তিলে গড়া এক অসাধারণ সহজিয়া জীবন যিনি যে কোনো প্রলোভন ও মোহকে দূরে সরিয়ে মাতৃভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষাতেই সোনার ফসল ফলিয়ে বাঙালি জাতির গৌরব এতটাই বৃদ্ধি করলেন সে যেন খ্যাতির এক পূর্ণ কুম্ভ। পিপাসার জল গড়িয়ে খেতে খেতে যেমন চলে আমাদেরও তেমনি চলবে অনেক দিন...
দাঁড়ের পাখি
দাঁড়ের পাখি, তুমি কি উড়তে চাও?
ডানায় ভর করে পার হতে চাও আকাশের পর আকাশ?
তুমি কি জান না, আকাশেও হানা দেয় ঝড়-বাদল?
বজ্রবিদ্যুতে ছিঁড়ে ফেলে আকাশের বুক?
তুমি স্বপ্ন দেখেছ সুদূর নীল আকাশের
স্বপ্ন দেখেছ অনন্ত মুক্তির
নেই শিকলের বেড়ি, নেই সারি সারি গরাদের শিক
দাঁড়ের পাখি, দ্যাখো কী নিশ্চিন্ত জীবন তোমার!
না আছে দানাপানির অভাব, না আচ্ছাদনের
সুখের সমস্ত উপকরণ সাজানো থরেথরে
তবুও মন বসে না দাঁড়ে!
আকাশ কি দেবে নির্ভরতা?
আকাশ কি দেবে নিশ্চয়তা জীবনযাপনের?
সকালের উজ্জ্বল আকাশ বদলে যায় বিকেলের ঝঞ্ঝায়
নিবিড় নক্ষত্রের রাত মুছে যায় মেঘের কালো পোঁচে
এত অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিতে চাও
আমি ভেবেছি, যা যা চাও, সব দেব
অলংকারে ভরে দেব গা
ভ্রমণের আনন্দ দেব
সংসার ভরা স্বাচ্ছন্দ্য দেব
শুধু আকাশ চেও না
দাঁড়ের পাখি, তুমি আমার কাছ আকাশ চেও না
শারদীয় সাহিত্য এখন ১৪২৭
সম্পাদকীয়
সাহিত্য এখন বেশ কিছু নতুন মুখ নিয়ে এল এবার। পড়বেন তাদের। অগ্রজদের আশীর্বাদ এই পত্রিকার স্তম্ভ। তারুণ্যের ভালোবাসা জড়িয়ে রেখেছে বরাবর। আমরা যারা মাঝপথে সেতুর মতোন, তারাও রইলাম নিভৃত অক্ষরমালা নিয়ে। এবারের প্রচ্ছদ এঁকেছে তরুণ শিল্পী মঙ্গলদীপ সর্দার। প্রবীণ ভাস্কর রামকুমার মান্নাও জড়িয়ে রইলেন তাঁর স্নেহচ্ছায়া নিয়ে। শুভ চতুর্থী। সব অন্ধকার কেটে যাক
বন্ধু
৫ টি কুশলসংবাদ
১.
দ্বারদেশে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন , তার কাছে
যে কুশলসংবাদটি আছে , সেটির সঙ্গে
দরোজার কোনো সম্বন্ধ নেই ,পুরোটা-ই
জানলা-সম্পর্কিত , জানলার পর্দার রং যতই
যতই হলুদ করে রাখো না কেন
জানলার বাইরের বেড়ে ওঠা মাধবীলতার
সবুজ রং ছড়িয়ে পড়ে ঘরের মেজেতে
সেই সবুজজল টলটল করে ঘরময়
টমটমে ওঠার আগে চাবুকটির অবস্থান
জেনে নিতে হবে
এই চাবুকটি যতক্ষণ আপনাকে সঙ্গ দেবে
কুশলসংবাদগুলিও সঙ্গে থেকে যাবে
২.
দিকনির্ণয়ের যন্ত্রটির কাছে যে কুশলসংবাদটি
আছ, সে জানিয়ে দেবে
তটরেখা আর কতক্ষণের পথ
আর সেই কুশলসংবাদটি আত্মপ্রকাশের জন্য
ব্যবহার করে একটা ধাতবঘণ্টা
আমরা ধাতুবিদ্যা সম্পর্কে অজ্ঞ হতে পারি
কেননা আমরা জানি অজ্ঞতার অবস্থান বদল
হলে চোখ ফোটে , ফোটা চোখে
সে সব কিছুই নতুন দ্যাখে
কুশলসংবাদেরা কখনোই বাদানুবাদে
জড়িয়ে পড়ে না , তারা ভাঙা গ্রামোফোনের মতো
সুখী গৃহকোণে শুয়ে পড়ে
৩.
কুশলসংবাদটি থেকে যখন কোনো গুরুগম্ভীর
আওয়াজ শুনতে পাবেন কখনোই ' গর্জন '
শব্দটিকে কলমে ঢুকতে দেবেন না
নির্জনে বসে ' দশমূল ' -এর গুণবিচার
করুন আর পাঁচমিশালি চিন্তা নিয়ে
একটি প্রবন্ধ রচনার কথা ভাবুন
আমি পঞ্চব্যঞ্জনেই তৃপ্ত থাকতে চাই
' ক ' বর্ণটি কামরাঙা , ' জ ' থেকে জেব্রা ,
' প ' থেকে পুলক , ' ম ' থেকে মাছরাঙা
এবং ' স ' থেকে সংঘকে গ্রহণ করে
আমি আমার প্রোফাইল দেখিয়ে দিলাম
এই দ্যাখোনাটিকে কুশলসংবাদ বলে মেনে নিন
৪.
আমরা সম্ভবত জানি না কুশলসংবাদদের রান্নাঘরটি
একান্নবর্তী , আর সেই রান্নাঘরের দরোজায়
একটি ঘণ্টা আছে , খাবার তৈরি হয়ে গেলেই
সে নিজে নিজে বেজে ওঠে
তাকে বাজাতে হয় না , এসব অল্পকথাকে
কেউ যদি গল্পকথা বলেন
কুশলসংবাদ কখনোই প্রতিবাদ করবে না
কুশলসংবাদটি বিনাবাক্যব্যয়ে রান্নাঘর থেকে
বেরিয়ে এসে বৈঠকখানাঘরে
সেখানে অনেক গল্পকথার সঙ্গে দূরত্ব বাঁচিয়ে
বসে পড়বে
৫.
প্রতিটি ঝুলবারান্দার কিছু ব্যক্তিগত কুশলসংবাদ
থাকে , তার সন্ধান পাবার জন্য
কোনো টংকারের প্রয়োজন নেই
এমনকী কোনো ধর্মশালাতেও যেতে হবে না
সর্বনামগুলিকে পাশে সরিয়ে রাখুন
লক্ষ রাখুন নির্দিষ্ট সেই প্রতিফলনের দিকে
'মৃদঙ্গ যে একটি যথার্থ বাদ্যভাণ্ড '
এই কুশলসংবাদটিও কিন্তু
ঝুলবারান্দার অজানা নয়
কল্পলোকে তারা
পকেট ভর্তি মৃত্যুর গন্ধ আর আলো ছায়া নিয়ে
পালাতে পালাতে এক গাছের ওপর উঠে ঘর বানিয়েছ
নীচে অগুনতি কালো পিঁপড়ের দল
ছাতা মাথায় দাঁড়ানোর সদাহাস্য জল্লাদের ছেলে
একটা কাঠবিড়ালি জুলজুল চোখে দেখে নেয় সবকিছু
স্বর্গ থেকে দূরে ওই চিনতে না পারা নীল পাখির পালক
বইয়ের ছবি থেকে উঁকি দেয় অশ্রু চিহ্ন আঁকা মুখগুলি
হে ধূসর প্রিয়ভাজনাসু
গাছের স্তব্ধতা বেঁচে থাকে বুঝতে পেরেছো তুমি
ঘরের স্তব্ধতা গাছ বুঝে নিল আজ
অর্ধেক বানানো এই শহীদ ফলকে
কিছু আঁকি বুকি দেখেছেও শুধু আগামী আশ্বিনে।
কফি শপের কবিতা
কফির ফেনায় একটা চকোলেটে লাভ সাইন সার্ভ করে এখানে,
স্ট্র ডুবিয়ে ভেদ করো সে রহস্য, সেই পান পাতা;
যে জানেনা তার কথা বাদ দাও, যে জানে সে জানে
কতটা গাঢ় চুমুকে সাড়া দেয় সান্ধ্য কলকাতা
সাড়া দেয় ঠোঁটে জিভে, হাতের আঙুলে, সাড়া জেগে ওঠে গাছে বৃন্তে ফুলে।
উবেরের কালো কাঁচে জুলাইয়ের বৃষ্টি ছোঁড়ে তির
তারপর থেকে সেই বাড়ি ফেরবার পথে সন্ধ্যেবেলা রোজই ওঠে দুলে
গরম কফির মতো ধোঁয়া ওঠা দুখানা শরীর।
সুর
শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা আশাবরীর কোমল
আমার হেমন্তের মাঠ
ভিড় বা কোলাহলের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চলে যাই
পলাশ বনের নির্জনে
আলতো সুরে দুলে ওঠে প্রান্তরের নামাবলি
নিবিড় সুতোর টানে খুলে যায়
গুটিপোকার উল্লাস
ভুলে যাই অনালাপ, কুয়াশা, মেট্রোর এসি
ধুনি
কয়েক পশলা বৃষ্টির পর আকাশ সহজ হলো ; একদল তরুণ পাখির মতো
হইহই করতে করতে হঠাৎই
উড়ে এলো পালক - বাতাস
ছুঁয়ে গেলো জোড়াবট, পাতা,
নেমে আসা ঝুরি
নিকোনো মাটির দাগ, ঘন বনভূমি
টুকটুকে রঙ নেচে বেড়ালো
কিশোরী কুসুমবনে পাতার চিবুকে
হাওয়া এসে আলগোছে
উড়ে গেলো বকের পাখায়
নদীদের চরে চরে, পাতার মাথায়
রাতজাগা শ্লোক বলে গেলো আগমনী সুর
তারপর, আমাদের বাড়ির উঠোনে
ভোরের পূরবী মাখা
থোকা থোকা শিউলির ছাপ রেখে
উমা এলো ঘরে
ধুনি জ্বলে ধিকিধিকি ----
ঘরে এলো অকাল বোধন
জল নূপুর
জলপ্রিয়া তুই মল্লার নাচে দক্ষ
লিখে পাঠালাম ছোট ছোট দানা বৃষ্টি
ভিজে যায় যদি কাগজের আঁকা বিদ্যুৎ
কী নিখুঁত দ্যাখ অকালবেলার অক্ষর
কবিতার সুরে ভেজা কথা অনুষঙ্গ
জলের শব্দ এখনও লিখছে গল্প
দিগন্ত চিরে ছিটকে পড়ছে বজ্র
শব্দের জল ছুঁয়ে যাক নদী সঙ্গম
চোখের তারায় সংকেতে জ্বলে তিস্তা
প্রতিদিন লিখি শিরোনামহীন ছন্দ
নদীয়ালি চরে পুরাতন প্রেম বন্দিশ
জল নূপুরের টুং টাং সুর বিস্তার
তিনটি কবিতা
বোর্ডগেম
মৃত সন্তানদের নিয়েই আমরা এখন খেলা শুরু করতে পারি। এতদিন তো জানতামই না কীভাবে অন্ধকার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে আসে সিঁড়ি বেয়ে ? শরীরগন্ধ সনেট কীভাবে জুড়ে দেয় নেলকাটার, বেবিসোপ আর পুরনো সোয়েটার ? এইসব শুধুমাত্র জানতো ধারালো স্ক্যালপেল। এইসব জানতো স্টিলরং মর্গের টেবিল। ছক্কা আর ঘুঁটিদের নিরুদ্দেশ মিছিল শুধু হেঁটে যেতো স্কাই-ব্লু চাদর থেকে কাচদরজার করিডোর পেরিয়ে। হাসপাতালের পাশেই তাদের ঘরবসত দেখে ভয়ে জমে যেত মেরুদাঁড়া । ইড়া ও পিঙ্গলা ফেটে শ্যামশ্রী শীত নামত ভূমিতে, জবাকুসুম ড্রিপ নামত টুপটুপ টুপটুপ । আমরা ভুলে যেতাম আজ শান্তিনিকেতন শান্তিনিকেতন খেলার দিন । ভুলে যেতাম হলুদ স্কুলবাস আর আশিয়ানার স্টপেজে থামবে না। বরং একটু পরেই মেঘ নামবে টিফিনবক্সের গর্ভে । পর্দায় লেগে থাকা সন্তানের ময়লা হাতের ছাপেরা নিশান হয়ে উড়তে শুরু করবে উদ্ধারণপুরে। শিকারীদের বর্ণপরিচয় ভুলে, ছেঁড়া বোর্ড জুড়ে দলবদ্ধ সাপেরা পাক খাবে আর বমি করবে সংখ্যাদের। আলমারির পাশ থেকে ডানা মেলে উড়ে যাবে লাল বল আর ছেঁড়া ফয়েলের স্ট্রিপ। তিন ছক্কা পুটের সমস্ত মনোযোগ চুরমার করে একটা ভয়াবহ কণ্ঠস্বর বলে উঠবে, ‘বাপি, একটা ইঞ্জেকশন দাও। আমি আর সইতে পারছি না।’
এসো, তোমাকেও চাল দিতে হবে। কারণ, এতক্ষণে তুমি জেনে গেছ শিশুদের চেয়ে নিষ্ঠুর আর কেউ নেই…।
সম্পর্ক
অন্য কাউকে নয়, তোমাকেই বলছি শোনো। আমি এইমাত্র নেমে এলাম অন্ধকার সম্পর্কের ভেতরে। কালো খনিসুড়ঙ্গের মধ্যে গতকাল হঠাৎই ফেটে গিয়েছিল আষাঢ়স্য প্রশম দিবসের মেঘ। হিংস্র বৃষ্টিরা দলবেঁধে বেরিয়ে এসেছিল পঙ্গু জন্তুদের লালা থেকে। আমার সামনে কোন দরজা নেই, জানলা নেই, শুধু ঢালু জঙ্গল থেকে শোনা যাচ্ছে তীব্র ডাইনোসরদের শীৎকার। সেই ক্ষত বন্ধ করতে আজ আমি নেমে এসেছি হরিণদের ভেতরে। সেই ক্ষত উন্মোচন করতে আমি আজ নেমে এসেছি কচি বৈষ্ণবীদের অলকাতিলকায়। এখন আমার সামনে শুধু দুলক্ষ বছর ধরে বয়ে চলা গর্ভভার। সৌরঝড়ের ক্রমশ ফুলে ওঠা। ভবিষ্যৎ অক্ষরদের দিকে ঈশ্বরের চোখের মত তাকিয়ে রয়েছে হেলমেটে লাগানো হলুদ আলো। চারপাশ ক্রমশ চেপে ধরছে মধ্যবিত্ত জল। বেলজারের মধ্যে থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সিলভিয়া প্ল্যাথ। দূর থেকে ভেসে আসছে খোলামুখ বার্নারের সোঁসোঁ আওয়াজ। গুঁড়িয়ে যাচ্ছে আমার সমস্ত পাথর-ডায়েরি আর ট্যালিসম্যান। ডাকিনীবিদ্যা ভুলে তুমি কী এইমাত্র হেসে উঠলে একতারায়, গৌড় মলহারে ? দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন আর আমি ছটফট করছি আঁখিপাতে। কফিকাপ থেকে উঁকি মারছে তেকোনা পাখনা আর বলির আরতি। এইবার চার্চের গং ঘোষণা করবে জিরো আওয়ার আর আমাকে হত্যা করবে তোমার চোখের স্ট্রিকনিন।
কেননা একমাত্র আমাকেই তুমি একদিন প্রকৃত ভালবেসেছিলে…।
পাসওয়ার্ড
পাসওয়ার্ড চুরি হয়ে গেলে
পুরনো ছবিদের ধারণা বদলে যায়
বীজকোশ খুঁজতে খুঁজতে
রাফখাতায় উছলে ওঠে প্রজাপতিদের লাশ
গা ছমছম মেয়েমাছেদের কাছে গেলে দেখি
দুপুরের ছেঁড়া বোতামঘরে আটকানো আলোর সেফটিপিন
চাবি খুঁজতে খুঁজতে উঁকি দিই ভ্রমরকৌটোয়
দেখি স্বপ্নের রেলিং ধরে নেমে যাচ্ছে ধারাবাহিক পাথরেরা
হাওয়াদের ভারী পাছা জড়িয়ে চেক চেক শিফন
রোদের লটকন ঝুলছে একচিলতে ব্লাউজের পিঠে
সনাক্তকরণের মন্ত্র কোথায় যে লুকিয়ে রেখেছি
নিঃসঙ্গ নদীদের ডানা
অথবা মীনরাশির জানলায়
আজ আর কিছুতেই মনে পড়ছে না…