Monday, 16 November 2020

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ, কানাইলাল জানা

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ

কানাইলাল জানা 



২০০৬ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আলিপুরের বাড়িতে এলেন সাহিত্যের আড্ডায়। অনুষ্ঠান সন্ধে ৬ টায় এসে আটটা সাড়ে আটটায় চলে যাবেন বলে এলেন ৬ টা বাজতে ২ মিনিট বাকি এবং গেলেন রাত পৌনে ১১ টায়,  এমনই জমেছিল সেবারের 'মহল'। আর ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  সন্দীপণ চট্টোপাধ্যায় দিব্যেন্দু পালিত শুভাপ্রসন্ন পার্থ ঘোষ গৌরী ঘোষ রাজা সেন রাজা মিত্র কংকাবতী দত্ত প্রমুখ গুণীজন। কবি হিসেবে এসেছিলেন সৌমিত্রদা তাই তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়তে থাকলেন একের পর এক কবিতা। সবাই মুগ্ধ।  অনিবার্যভাবে আলোচনায় এল নাটক অভিনয় গান গাওয়া  রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমার সৌরভ গাংগুলি তনুজাসহ অন্যান্য নায়িকারা এবং বিশেষ ভাবে তুলসী চক্রবর্তী। যাওয়ার সময় তাঁর ভালোলাগার কথা জানিয়ে বলে গেলেন 'তোমার নতুন বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে রইল ' কারণ আলিপুরের বাড়ি তথা কোয়ার্টার্সে এটাই ছিল শেষ অনুষ্ঠান। 

আমরা তাঁর নানা গুনের কথা বলি কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সরকারের সরস্বতী সম্মান (৬ লক্ষ টাকা)   পেয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আনেয়ার শা রোডের মার্লিন হাউসে মজলিশ পার্টিতে আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন এবং সেখানে স্ন্যাকস নিতে নিতে সৌমিত্রদা যখন বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বলছিলেনঃ' ভাবো লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মধ্যে একসঙ্গে এত প্রতিভার সমাবেশ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি পাবে না কিন্তু। ' শুনে ভাবছিলাম সময় পেলে সৌমিত্রদা হয়তো ভাস্কর হওয়ার চেষ্টাটাও  ছাড়তেন না। 



আমার শ্রেষ্ঠ মুগ্ধতা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে তাঁর ৭০ তম জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে। ঢুকতেই পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর দাদার সংগে। লম্বায় একটু কম কিন্তু দেখতে অপরূপ যেন স্বর্গ থেকে এইমাত্র নেমে এলেন স্বয়ং দেবদূত! 


অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে রেহাই দিতে কয়েক বছর আগে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বড় অংকের অর্থ দিতে চায় শুনে তাঁর বাড়িতে গিয়ে  জিজ্ঞেস করতে বললেনঃ 'কোথায় বিশ্রাম?  বরং যত দিন যাচ্ছে তত নানা কাজে জড়িয়ে পড়ছি। '

যে কাজেই আত্মনিয়োগ করুন কবিতা চর্চা তাঁকে ছেড়ে যায়নি কখনো তাই বরাবর আমার আশা ছিল তাঁর এই গুণটা অন্য অভিনেতা কেউ না কেউ অনুসরণ  করবেন। স্বাধীনতার পর পরই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় যেভাবে বহু ফাঁকা জমি পেয়েছিলেন অনেক কিছু করার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবনে সেরকম ফাঁকা জমি না পেয়েও নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সারাজীবনটাই  তাঁর নির্মাণের কাহিনি যা ফল্গু ধারার মতো মানুষকে প্রেরণা দেবে নিজেকে প্রস্তুত করার। 

কয়েক দিন আগে তাঁর মোবাইলে ফোন করলে ছেলে সৌগত উদ্বেগ হীন কন্ঠে জানানঃ 'বাবা এখন স্টেবল্। ' শুনে একটু হলেও আশা জেগেছিল সম্ভব হলেও হতে পারে অন্তত কিছু দিনের জন্য ফিরলেন মিরাকল ঘটিয়ে 'ময়ূরবাহন '। 


এখন আমাদের সামনে থাকল শুধু সীমাহীন উদারতা ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষের আঙ্গিকে তিলে তিলে গড়া এক অসাধারণ সহজিয়া জীবন যিনি যে কোনো প্রলোভন ও মোহকে দূরে সরিয়ে মাতৃভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষাতেই সোনার ফসল ফলিয়ে  বাঙালি জাতির গৌরব এতটাই বৃদ্ধি করলেন সে যেন খ্যাতির এক পূর্ণ কুম্ভ। পিপাসার জল গড়িয়ে খেতে খেতে  যেমন চলে আমাদেরও তেমনি চলবে অনেক দিন...

No comments:

Post a Comment