Friday, 16 October 2020

বই আলোচনা, অমিতাভ মৈত্র, আলোচক- সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 

 


কবিতা সংগ্রহ/ কবি অমিতাভ মৈত্র

 

 কবিতা সংগ্রহঃ অমিতাভ মৈত্র

প্রচ্ছদ রাজীব দত্ত

দাম ২৫০ টাকা

প্রকাশক তবুও প্রয়াস

 

"আমার কাছে একটি ছবি আসে, আমি সেই ছবিকেই ভাষায় অনুবাদ করতে করতে এগিয়ে যাই"

 

কবি অমিতাভ মৈত্রের এই স্বীকারক্তিই হয়ত প্রমাণ কতটা নিষ্ঠা ও নেশায় এক বুদবুদকে সমুদ্র করে তুলতে পারেন তিনি। তার কবিতাগুলি চিরপরিচিত গন্ডীর বাইরে নিজেকে খুঁজে নেওয়ায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাষার প্রয়োগে তিনি যে ব্যতিক্রমী শুধু তাই নয়, কবিতার গঠনশৈলী ও বক্তব্যে তার দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া অসম্ভব।

 

পতনকথা, টোটেম ভোজ, ষাঁড় ও সূর্যাস্ত, পিয়ানোর সামনে বিকেল ও পরিশিষ্ট এইকটি বিভাগে কবিতাসংগ্রহকে সাজিয়েছেন সম্পাদক সেলিম মন্ডল।

 

"যদি চিতা বল, আমি দুই হাতে ছুঁয়েছি আগুন

হাড়ের গভীর মাংস মেলে দাও শস্যে ঘাসে ঘাসে

ছড়াও শরীরময় স্বেদ রক্ত রাত্রিবীজগুলি

দ্যাখো কত স্পর্শসহ আমি আর আমার অঙ্কুশ"

 

মৃত্যুর অতীত থেকে উড়ে চলেছে নীলঘুড়ি। কবির হাতে সেই অলীক সুতো। অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে অতিকৃত কালো কালো কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত মুখ। তারা হাঁটতে হাঁটতে নির্মাণ করছে পথ। বেজে উঠছে অস্ত্রের ছনছন। তৃষ্ণার ছুরি হাতে নত হচ্ছে ক্রমশ কবির শরীর। তবু ব্যর্থতায় বেঁচে থাকা। এ যেন এক তুমুল আত্মপ্রতারণা। যে সমস্ত পাপের কথা বিশ্বাস করেনা ঝরনার জল, তারা জানে আসলে পাপ বলে কিছু নেই। সবটাই ঘটমান, বর্তমান। সময়ের সুকৌশল কারচুপি। যে হাত ডুবে আছে বহুদিন জলে, যে চোখে বহুযুগ জ্বলেছে আগুন, কাপাস তুলোর মতো যে শরীর ভেসেছে কেবল, মাটি ও গাছের কাছে তার সব ঋণ আজ শেষ। গুমোট বমির মতো মাংসের কুয়াশা এলেও মৃত্যু আজ প্রস্তুত সমস্ত অন্ধকার পিছনে ফেলে।

 

টোটেম ভোজ কবির এমন এক সৃষ্টি যাতে ধরা পড়েছে এক তীব্র যন্ত্রণা। শুরুতেই কবি লিখছেন,

 

" অস্বাভাবিক সব চোখ, আর এক অদ্ভুত

গোল মাংসমাখা ভাষায় কথা বলা হয়েছে

তার বিষয়ে

যে ভাষায় 'আলো' শব্দটি নেই, এবং

কোন বিস্ময়চিহ্ন নেই…" 

 

এ কোন অন্ধকার। এ কোন ভালোবাসা তবে? কেঁচোর মতো পিছল ঠোঁট যার গাল ছুঁয়ে বলছে, ' তোমার ধর্মান্তরণ হল। এখন তোমার মুখে আমার রক্ত। শোনো, লাল থকথকে সেই জলাভূমির ওপারে সাদা হাড়ের ক্রুশকাঠে, আড়ষ্ট শরীর, এখন থেকে ঝুলে থাকবে তুমি।'

তবে কি শুধু শরীর! শুধুই জ্বলন্ত মশাল ও ঘোড়াটিকে নিয়ে স্নানঘরের বন্ধ দরজা? নাকি নগ্নতাকে গ্রহণ করা মাংসের বিরুদ্ধে? এমনই এক জটিল দর্শন বারবার দেখা দিয়েছে টোটেম ভোজের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে।

নিজের মৃতদেহের পিঠ হেলান দিয়ে যেন লেখা হয়েছে কবিতাগুলি। থমথমে বাতাসে শুধু ঘৃণা। কাঁধে হালকা কামড় দিচ্ছে পিশাচিনী। না খাওয়া অংশগুলো বাক্সে তুলে রাখছেন দুজন। বাঁচার তাগিদ নেই, তবু বেঁচে থাকা। প্রেরণাহীনভাবে কামড়ে ধরা তার গলা। নিষ্প্রাণ জলে, রক্তরসে ভরে উঠছে মুখ, কবি লিখছেন,

 

" দরজার ওপারে কোন মাংস ডাকছে, আলো হাতে নিয়ে"।

 

ক্রমশ পাগল হচ্ছে সব চরিত্ররা। সম্বিতহারা আত্মহত্যাপ্রবণ। প্রতি দু মিনিটে মৃত্যু আবার স্বাভাবিক শ্বাস। আলোহীন নাচঘরে ধূসর পোশাকের নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা। শূন্য চেয়ার থেকে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা এবং তারপরেই বসে পড়া, তার মাঝের যেটুকু সময়, তা যেন এক নাচেরই সমান। কখনো শূন্যে ভেসে ওঠে সেই রাজকীয় চেয়ার, কখনো বা ঠান্ডা স্পর্শযোগ্য এক আলোয় ম্যাডাম এম কে মৃতদেহের মতো তুলে ধরা ভারী রক্তের বোতলগুলোর ভেতর।

অবেশেষে সময় আত্মহত্যা করে। 'not understanding, not living either, not even aware of life trapped deep inside'   ( Michel Joiret)

আপেল চিবোতে চিবোতে ঝলসে উঠে রুটি। কবিতার চরিত্র ম্যাডাম এম ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে উঠছেন। দেশলাই নিতে পারছেন না। লাল সিলিন্ডার ও তার আপেল যেন মিশে যাচ্ছে একই বিন্দুতে। দরজার ফাঁক দিয়ে সাদা কাপড় হাতে এগিয়ে আসছে মৃত্যু। তিনি বাকরুদ্ধ। ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধ। দেশলাই ভিজে গেছে তবু মাংস মুক্তি চাইছে যন্ত্রণা থেকে।

 

ষাঁড় ও সূর্যাস্ত বইটির কবিতাগুলির গঠন আবার একটু আলাদা। বস্তুকে তার অর্থ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া কিংবা অন্ধকারে ছুটে চলা কোন ট্রেন, গতির মধ্যে পাক খাচ্ছে এমন কোন বিষয়, রাত্রি কিংবা চোখ সবকিছুকেই কবি রূপদান করেছেন অনন্য ভাষায়। ঘন বাষ্প আর বালির স্তর সরিয়ে উঠে আসা ঘড়ি কিংবা কোন বিস্মিত বারান্দায় ফুটে ওঠা কোন ছায়া ধরা দিয়েছে তার বহমানতায়।

 

" আমার সাদা কুকুরটা আবার যেদিন নিজেকে ভাবতে শুরু করবে

আর আরাম চেয়ারটায় বসে ঢুলতে ঢুলতে হঠাৎ দম আটকে আসার কারণ যেদিন থেকে খুঁজে পাব না আমি

 

সেদিন কেউ এসে যদি বলে যে আমার ঝগড়াগুলো নিয়ে,

কাগজপত্রগুলো নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই

এমনকী আমার বাসন ধোয়াকেও সে আর বাসন ধোওয়া বলে মনে করে না

তখন তাকে বোকা বানানোর জন্য এই একটা ঝরঝরে হাসি

আমি ভেবে রেখেছি

এক জায়গায় খানিকটা হলদে, মরা ঘাস দেখিয়ে বলব

এখানে তোমার জন্য একদুপুর লম্বা একটা ঘন্টার শব্দ রাখা আছে। তোলো!"  (বোকা)

 

লাল ধুলোর শরীর। অপেক্ষারত লাল বাঘ। জাদুকর আসলে সেই নারী যিনি রক্তমাংসের প্রশাসক। কিংবা এই চোখ মুখ নেমে আসা হাসিরা যেন একএকটি খোলা রাস্তা। সূর্যাস্তের মধ্যে গাঢ় হয়ে ওঠা সিংহরা যেমন কখনো জলের ধারে এসে দাঁড়ায় অবিশ্বাস্য কোন প্রতিবিম্বের কাছে, মৃত্যু থেকে না উদ্ধার হওয়া কোন বিভ্রান্তি যেমন রক্তাক্ত হয়ে থাকে চিরকাল, এ যেন সেই না জানা সূর্যাস্তেরই ছবি যা বারবার প্রতিভাত হয় অবচেতনের পর্দায়।

 

ভেসে যাওয়া বাড়িগুলো যে ভয় থেকে কথা বলে কুয়াশার সাথে কিংবা দরজা খোলার শব্দে বোবা মেয়েটি কামড়ে ধরে তার বিড়ালকে এমনিই সব অদ্ভুত দৃশ্যকল্প বারবার ওঠে আসে তার কবিতার কায়া গঠনের জন্য।

 

পিয়ানোর সামনে বিকেল কাব্যগ্রন্থটি আর একটি গভীর জীবনদর্শনের প্রমাণ। খোলা ওয়ার্ডরোবের সামনে মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যকল্প যেমন অতি সাধারণ হলেও গভীর তেমনই মসৃন হলুদ হাত যা একটু দেরি করে পৌঁছায় সবসময়, এই পংক্তিগুলি পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে কবিতার আসল উৎস তবে কোথায়! ক্যানভাসে কি দর্শন এঁকেছেন কবি। বহুপঠন দাবী করে প্রতিটি কবিতা। সাদা গজ এগিয়ে যায় কোনাকুনি যেন শেষ হয় দীর্ঘ অপেক্ষা। মৃত্যু পর্যন্ত শুধু ঝড়। কখনোই ঘুমিয়ে পড়া চলবে না। এমন সব পংক্তির আলোয় ঘিরে থাকে পাঠক।

 

' সমুদ্রের দিকে ব্লেড আসছে। বৃষ্টি আসছে শূন্যতা, সাইকেলের চাকায়।

দেয়াল ঘেঁষে নিয়ে চল। কেন মিথ্যে বলছ আমাকে?

তিন মাইল জুড়ে কোথাও ঠিকানা নেই।

আলো কমে আসছে। নৌকা বানানো হল না। নীরবতা থেকেও হয়তো রক্ত পড়বে এবার।

গা শিরশির করছে। ব্লেড সরানো দরকার।

তোমার হাসি কি আগের মতোই অবর্ণনীয় এখনো।'(ব্লেড)

 

কবিতাটির ভেতর এক অদ্ভুত অন্ধকার। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নিচ্ছে হতাশা। এই ছায়ার কারণ হয়ত অস্পষ্ট। হয়ত বা জানলার কাচে লাগা অর্থহীন বৃষ্টি। তবুও তা বিধ্বংসী। তবুও তা কালো আঙুরের মতো লোভনীয়। যা মানুষকে ধ্বংস করে তার দিকে ছুটে চলার প্রবৃত্তি বড়ো স্বাভাবিক। এ মৃত্যু যেন তেমনই এক বিস্ময়। মোটরবাইকের নীচে চাপা পড়া শেষ আর্তনাদ। তবুও জলহীন কঠিন দুচোখ, আত্মহত্যা চায় বাঁচার আশায়।

 

পরিশিষ্টেও বেশ কিছু কবিতা গুণমানের বিচারে আলোচনার দাবী রাখে। শিউরে উঠে 'যতক্ষণ টগর থাকবে'

কবিতাটি পড়ে। কী কঠিন বাস্তব সত্য কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অনবদ্য ভাষায়।

 

' মেয়েটিকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মিলিটারি ব্যারাকে

নাচের জন্য। ভিতরে মাংসের গন্ধ, আগুন

আর জড়ানো গলায় হই হল্লা।

 

নতুন দখল হওয়া এই শহরে

কোথাও আলো জ্বলছে না আজ।

ধোঁয়া উঠছে এখানে সেখানে---

আর অন্ধকারে একটানা বেজে যাচ্ছে বলির বাজনা।'

 

 

অভ্রকণার মতো আলো পড়ছে চাঁদের। আর তাতেই দৃশ্যমান একপাটি রক্তাক্ত জুতো। কেঁপে উঠি শেষ লাইনে যেখানে কবি লিখছেন, ' কালো ওই মেয়েটিকে ঈশ্বর নিজের হাতে আজ অনুচ্ছিষ্ট মাংস খাওয়াবেন।'

 

আরো বেশ কিছু কবিতায় কবি তুলে এনেছেন এমন সব চিত্র যা অননুকরণীয় তো বটেই, নিজ বৈশিষ্ট্য ভাস্বর। এমন সব বাস্তব দৃশ্যকল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে কবিতার কায়া যাতে তারা নিজস্ব ভাবধারায় ধরা দেয় বারবার, নানা ভাবে পাঠকের মননে। বহুস্তরী এই লিখনের ভেতর মৌলিকত্ব শুধু নয়, উন্নত ও গভীরতার ছাপ সুস্পষ্ট।

 

সবুজ আলোয় ভরে উঠছে মাঠ। গ্রামীন মেয়ের হাতে এখন শুধু জল। হত্যা নয়। এ যেন এক ধর্মবিজয়। ভরে উঠছে ধানক্ষেত। কবি লিখে চলেছেন এক অনন্য বিজয়গাথা শৃঙ্খলমোচনের।

 

সবশেষে কবি সেলিম মন্ডলের প্রতি পাঠকের কৃতজ্ঞতা বেড়ে যায় এমন একটি সংকলনের জন্য। সম্পাদক হিসাবে 

নিঃসন্দেহে এটি সেলিমের একটি ভীষন ভালো কাজ।

 

 

 

        

 

  

 

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,










ভুলে যেতে শেখো





ভুলে যাও, ভুলে যেতে শেখো
ভুলে যাও, ভুলে যেতে শেখো

মনে রাখলেই মনে মনে
ছড়িয়ে পড়বে হাজার ডালপালা
শিকড় যাবে গভীর থেকে আরও গভীরে
লক্ষ লক্ষ খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়বে

এখন তো গুটিয়ে নেবার পালা
চারপাশ আজ বড় ছোটো হয়ে আসছে
এক উঠোন ভেঙে বার ঘরে ভাগ হয়ে যায়
কোথায় তুমি আর কোথায় তোমার
ফেলে আসা শৈশবের মার্বেল,
বেনেপুকুরের পারে সারি সারি আমগাছ,
গামছায় ধরা বেলেমাছ আর
হাঁটুকাদা কৈশোরের উঠোন ?

এসব আজ আর কেউ মনে রাখে না
মনে রাখলেই ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাবে
ছড়িয়ে গেলেই বেড়ে যাবে মায়া

ভুলে যাও, ভুলে যেতে শেখো
ভুলে যাও, ভুলে যেতে শেখো ।

তৈমুর খান, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 

 


 

 শুনতে পাও নীলাঞ্জন



 নীলাঞ্জন আমাকে ডেকেছিল

 শুধু একটি রাস্তার পার্থক্য বলে

 ওপারে দাঁড়িয়ে ছিলাম


 অনেক কাল থেকেই আমরা

 এপার ওপার হয়ে আছি


 রাতের ব্ল্যাকবোর্ড অনেক কিছু লিখে দিয়ে গেছে

 দিনের হইচই আমাদের ডাক শুনতে দেয়নি

 পার্থিব আর পরমার্থিব আজও রহস্যময়


 একটা সোনালি বল

         গড়াতে গড়াতে

              চলে গেছে পাশ দিয়ে

 একটা বিনম্র সাপ

                      কৌতূহলে ছুটে গেছে

 আমরা বিষাদ মস্তিষ্ক নিয়ে আজও একাকী


 নীলাঞ্জন, সোনালি বলটা কি প্রত্নযুগের কোনও ফল?

 সাপটা কি আমাদেরই উন্মুখ প্রবৃত্তির দৌড়?


 শুনতে পাও নীলাঞ্জন ?

 পার্থক্য শুধু রাস্তার এপার ওপার…



স্বপনকুমার বিজলী, ছড়া, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


মেলার ছবি

     

গাঁয়ের মেলা সারাবেলা
দেখছি আমি ঘুরে
হাজার ঘুড়ি ওড়াউড়ি
করছে কাছে দূরে ।

ছ'টা ছেলে হেসে খেলে
কিনছে চানা-মুড়ি
ক'জন খুকি দিচ্ছে উঁকি
পরছে কাচের চুড়ি ।

গুড়ের জলে দলে দলে
জিলাপি সব ভাসে
গরম তেলে নেচে খেলে
পাঁপড় ভাজা হাসে ।

পুকুর ঘাটে তিলক কাটে
ন্যাড়া করে মাথা
চটে বসে হাঁকছে কষে
বেচছে নকশি কাঁথা ।

নিচ্ছে ঝুলে রুমাল তুলে
চড়ছে নাগরদোলা
ভরা প্রীতি মেলার স্মৃতি
যায় কখনও ভোলা 

 

উত্থানপদ বিজলী, ছড়া , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


পাখি সব করে রব

পাখি সব করে রব রাতি পোহায়িল
প্রভাতে জাগিয়া দেশ এমনি দেখিল
রামমন্দির নামে  দেবতার স্থান,,,,,,
ঠাকুরেরা পুরোহিত সেখানে প্রধান
জাতি নিয়ে বজ্জাতি চলে উদ্দাম
জয় জয় ধ্বনি ওঠে , জয় সিয়ারাম।

পাখি সব করে রব রাতি পোহায়িল 
দলিত জনেরা ঠিক তেমনি রহিল
অচ্ছুৎ আছে সব স্পর্শেতে পাপ 
কাছ থেকে দূর হঠো----গায়ে জাতি-ছাপ
বামুন পূজারী হবে ,  তোরা হনুমান---
পাহারায় থেকে কর রাম-গুণগান।

পাখি সব করে রব রাতি পোহায়িল 
তুড়ি মেরে মনু-নীতি সাম্য চাহিল 
চামার চাঁড়াল মুচি ----কেন হবে দাস
শোষণের পাতা ফাঁদ হীন অভিলাষ
রামের জনমভূমি ----পবিত্র ধাম
মন্দিরে ঢুকে সবে করিব প্রণাম।

সমুদয় হিন্দুর শুধু গুটিকয়
যদি সমাদর পায়, ভয় নিশ্চয়।
 
লেখকের মতামত তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব। 
 
 

Thursday, 15 October 2020

মিঠুন চক্রবর্তী, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


মন


প্রকাশ্য জনসভায় বলছিলে, আকাশ....

                     বলছিলে, পাখিদের ওড়া-উড়ি....

অথচ,যাবতীয় একাগ্রতা ফাঁকি দিয়ে

এখান থেকে সেখান থেকে 

                             নেমে এসেছে আনমনা ঝুরি 

কোনোটাতে দোল খাচ্ছে ফড়িং রঙের শৈশব,

কোনোটাতে কবেকার ছিঁড়ে যাওয়া বাসন্তী প্রেমের গন্ধ 

আরও কত টুকরো টুকরো মাটি আঁকড়ে ধরতে চাওয়া


দেখো, যেই তোমাকে আকাশ বললে ঘর বাঁধার কথা

অমনি তোমার বুকের ভেতরে মাথা নাড়িয়ে কিচিরমিচির করে উঠল

তোমার অজান্তেই গজিয়ে ওঠা কত রকমের পাখির বাসা

Wednesday, 14 October 2020

শ‍্যামাচরণ কর্মকার, ছড়া , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


পুজোর বাদ‍্যি

বর্ষা ফুরোলে যেমনটা করে শরৎ এখানে আসে
আকাশ  রাঙায় সোনালি আলোয় আর গুলে দেয় নীল
যেমনটা করে পেঁজা-তুলো মেঘ পাল তুলে ওড়ে, ভাসে
তেমন করেই শরৎ এসেছে, আছেও তেমন মিল।

বাগান ভরেছে শিউলি-টগরে, শিশির মেখেছে ঘাস
পদ্মকুঁড়ির ঘুমও ভেঙেছে, শালুক দিচ্ছে উঁকি
হিমেল বাতাসে তেমন করেই দুলছে দোদুল কাশ
জানালার ধারে চুপচাপ বসে দেখছে এসব খুকি।

দেখছে কিন্তু আনন্দ নেই অন‍্যবারের মতো
শরৎ এলে সে ঘুম ভুলে যেত পুজোর গন্ধ পেয়ে
ঠাকুরদালানে দুগ্গা সাজত দেখে কী মজাই হত
রঙ করা হয়, চোখ আঁকা হয় দেখত সে চেয়ে চেয়ে।

শরৎ এসেছে প্রকৃতি সেজেছে সাজছে না তবু খুকু
দুগ্গা গড়ার বরাত পায়নি তার জ‍্যেঠু-বাবা-কাকা
ঘরেতে অভাব কষ্টে চলছে খুশি নেই এতটুকু
দালানে কত না দুগ্গা থাকত এবার তা নেই, ফাঁকা।

পুজোর গন্ধ পায় না সে খুঁজে তবু মহালয়া এলো
আগমনী- গান বাজছে তবুও দিচ্ছে না মনে নাড়া
পাড়ায় পাড়ায় মহামারী আজ সব তাই এলোমেলো
দুগ্গাপুজোও হবে না এ-গাঁয়ে আতঙ্কে দিশেহারা!

শরৎ এলেই ঘুম ভুলে যেত মন হত উড়ুউড়ু
পুজোমণ্ডপে ঘুরত- ফিরত বন্ধুরা দলবেঁধে
পুজোয় এবার ক'টা জামা হবে গোনা হয়ে যেত শুরু-
জানালায় বসে ভাবছে এসব আর সে যাচ্ছে কেঁদে!

শরৎ এসেছে, পুজোও আসবে হবে না নতুন জামা
যদি পুজো হয় পুরোনো জামায় দেখতে হবে যে ঠাকুর
বাবার হাতেও কাজটাজ নেই, কাজ হারিয়েছে মামা
পুজোর বাদ‍্যি দুঃখের সুরে বাজবে তাকুড় নাকুড়!
                       ................

লেনে ও সুলিভান, অনুবাদ কবিতা, অনুবাদক মৌমিতা পাল, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


লেনে ও সুলিভান (আইরিশ)
তোমার ঘুমে 



যে মুহুর্তে লার্কপাখি অদৃশ্য হল
বনভূমির আকাশে, তুমি জেগে উঠলে।

তোমার ডানার গ্ৰহণ কিংবা স্বপ্নের ঋতু
কিংবা শুধুই ডানা তুমি দেখালে
আহত দু'হাত দেহের ওপর মেলে।

তোমার দু'হাতের অন্তরালে
তোমার বুক ও নিঃশ্বাস।
তোমার দুই-পা প্রস্তুত করছে
প্রথম মন্থর পদক্ষেপ চাদরের আড়ালে,
যেন শেষ শান্ত সূর্যরশ্মি-
আর ধর আমি দেখেছি তা।
প্রিয়, তুমি আর জাগবে না এমন মনে হল।

গ্ৰীষ্মের ক্ষেতে বেঁচে ওঠার পাখি তুমি?
তুমি যে লার্কের ডাক শুনেছিলে, তুমি কি সেই
লজ্জিত ধ্বনির মধ্যেকার অশীরিরি?

হ্যাঁ, আমি লার্কটিকে পালানোর সময় শুনেছি। 



• অনুবাদ প্রচেষ্টা : মৌমিতা পাল

মূল কবি পরিচিতি : লেনে ও সুলিভান মূলত আইরিশ কবি। প্রথম কবিতার বই ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। নাম 'ওয়েটিং ফর মাই ক্লোথস'। এটি প্রকাশিত হয় ব্লাডাক্স বুকস্ থেকে যখন ওনার বয়স ২১ বছর। এরপরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালেও ওনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় কবিতার বই প্রকাশিত হয়। উনি  ইরল্যান্ড লিটারেরি অ্যাওয়ার্ডের দ্বারা পুরস্কৃত হন, এমনকি রুনিফ প্রাইজ ফর আইরিশ লিটারেচারে ২০১০ সালে পুরস্কৃত হন। এছাড়া ২০০৯ সালে পেয়েছেন ইরল্যান্ড চেয়ার অফ পোয়েট্রি ব্রাশারি অ্যাওয়ার্ড।


শুভদীপ সেনশর্মা , কবিতা , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 


এপিটাফ
(প্রয়াত কবি বিকাশকুমার সরকার বন্ধুবরেষু)
 



মোমবাতি যতক্ষণ জ্বলবে ততক্ষণ আমাদের আয়ু
হে প্রথম দশক

শুরুতেই শেষ? নাকি শেষ হওয়ার জন্য এত আয়োজন?

বোবাকালা ঈশ্বরকে একা অন্ধকারে এমন প্রশ্ন
ছুঁড়ে মারি, স্বপ্নে দেখা দেন, চোখ খুলতেই
                                    আলোকিত সমন্বয়

তাহলে আমরা কি বুঝে নেব --
একটা মোমবাতি জ্বলবে যতক্ষণ
ততক্ষণই আমরা আলোকিত!
তারপর অন্তর্বর্তী শূন্যতা
নাকি কিছু গন্ধ দেবে, 
নাকি ঘন্টাধ্বনি!



সুভান , কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 

 


একলা দ্বীপ


 

আসলে সমস্ত দ্বীপ একদিন ডুবে যায় একা,

জলস্তর বাড়ে, বাড়তে বাড়তে গলা পর্যন্ত উঠে আসে জল

শ্বাস থেমে থেমে আসে আর উঁচু হতে হতে জলের আঁচড় 

গিয়ে পড়ে বালি শরীরে, ক্ষততে

এত দীর্ঘকালের খোলা আকাশটাও ডুবে যায় চোখের সামনেই

 

নির্জন দ্বীপ আসলে কবির মতো, একলা...

মাঝে মাঝে গাছ বেড়ে ওঠে বুকে; ছায়া দেয়,

মন মেঘলা করে আসে, বৃষ্টি নামে চতুর্ভুজ।

পরিযায়ী পাখিদের ঙ্গে প্রেম হয় সাময়িক, বিরহ হাসে দীর্ঘকাল।

 

আবার ঢেউ এলে ভেসে যায় মেঘ, জমানো গল্পের নোঙর মাটি খোঁজে।

দ্বীপের চতুর্দিকে জল; জলের অতলে ভিজে চটি। শান্ত ডুবুরির মৃতদেহ

 

তবু ঢেউ আসবেই...

মরা ঝিনুক খোলস ভাসে হাওয়ায়,

ঢেউ আসে তার ভেতরে ভেতরে নোনারাগ... সমুদ্রঝড়...

 

জলের নিচে একলা দ্বীপ তার একলা শরীর ছুঁয়ে থাকা ঠান্ডাজল,

গভীর জন্ম-অন্ধকার, তার পাশে ভাঙা ভাঙা কাঠের প্রাসাদ,

তারও আগে ডুবে যাওয়া কোনো একলা দ্বীপ...

সারি সারি অতল না-বলা কথা, অন্তিম বিশাখাসঙ্গম বালিয়াড়ি। 

একলা দ্বীপের বুকের ওপর দিয়েই 

প্রত্যহ পার হয়ে যায় হাজারো নাবিকজাহাজ...   

Tuesday, 13 October 2020

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 

 


 

মৃন্ময়ী



 

এই আধো অন্ধকার মায়ার আধারে

আছে মাত্র ধক ধক চোখের আলোটুকু

তাকে হৃদয়ে জ্বেলে বসে আছি

খিড়কি খুলে বসে আছি

বয়স্ক হচ্ছ তুমি, বয়স্ক হচ্ছি আমি

তবু হাতে হাত রেখে মুখোমুখি বসে আছি

হরপ্পা মহেঞ্জোদারো!



এখন সব মাস যুদ্ধমাস একটাই ঋতু

পুড়ছে সবুজ পুড়ছে জলছবি

পুড়ছে খেলনাবাটি

পুড়ছে আমার মৃৎপাত্র অক্ষর ধান সবই

এই তীব্র ক্ষুরধারে

চোখের আলোর সম্বলে হাটদোর বসে আছি

কবে তোমার কাঁখকলসে

ভরে দিতে পারব শ্বেত পারাবতের স্নানের জল

উষ্ণতায় গড়ে তুলব মৃদঙ্গ স্বভাব তোমার

 

অভিমান ভোলো এসো হাত ধরো ঘরেতে ফেরাই

বৃন্দগানে বটঝুড়ি শিকড় নামাই

ভস্ম হয়ে উড়ে যাক কাকজ্যোৎস্নার আভরণভার