কাদের কূলের বউগো তুমি
আমরা সকলেই জানি শারদীয় দুর্গাপূজা
অকালবোধন। রাম-রাবণের যুদ্ধের আগে রাম দেবী দুর্গাকে আবাহন করেন,কারণ দেবী দুর্গা
শক্তির রূপ এবং একই সাথে অশুভ শক্তিনাশিনী। এই সময়টা ছিলো শরৎকাল। চারিদিক
কাশফুলের দোলা।আকাশে পেঁজা তুলোর রূপ এবং বাতাসে শিউলির গন্ধ। এ হলো পুরাণকাহিনি।
মহিষাসুরমর্দ্দিনী (অর্থাৎ মহিষাসুরকে দমনকারী) হল
১৯৩১ সাল থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আকাশবাণী বা All India Radio-তে সম্প্রচারিত একটি বাংলা প্রভাতী বেতার অনুষ্ঠান।
দেড় ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে রয়েছে শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দুর্গা সপ্তসতী থেকে গৃহীত দেবী
চণ্ডীর স্তোত্র বা চণ্ডীপাঠ, বাংলা ভক্তিগীতি, ধ্রুপদী সংগীত এবং পৌরাণিক কাহিনির
নাট্যরূপ। অনুষ্ঠানটির একটি হিন্দি সংস্করণও তৈরি করা হয়, এবং বাংলা অনুষ্ঠান
সম্প্রচার হওয়ার একই সময়ে সারা ভারতের শ্রোতাদের জন্য সম্প্রচার করা হয়। যেহেতু
মহালয়ার ভোরে তর্পণ করা হয় বলে, ওইদিন সকলকে ভোরবেলায় যারা তর্পণ করতে যাবেন
তাদের জাগানোর উদ্দেশ্যে প্রতি বছর মহালয়ার ভোরে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। আর এখনো
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ না শুনতে পেলে পুরো ফাঁকা লাগে...
"সর্বভূতা যদা দেবী স্বর্গমুক্তি
প্রদায়িনী।
ত্বং স্তুতি স্তুতয়ে কা বা ভবন্তি
পরমোক্তয়।
সর্বস্য বুদ্ধিরূপেন জনস্য হৃদি সংস্থিতে,
স্বর্গাপবর্গদে দেবী নারায়নী নমোহস্তুতে।
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তসৈ নমো
নমঃ।।"
দুর্গাপুজোর
অন্যতম আচার নবপত্রিকা স্নান। সপ্তমীর সকালে স্নান করানো হয় নবপল্লব। নবপল্লবের
আক্ষরিক অর্থ 'নয়টি পাতা'। এগুলি হল কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম্ব, অশোক,
মান ও ধান। একটি কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি গাছের পাতা বা ডাল বেঁধে দেওয়া হয়
অপরাজিতা লতা দিয়ে । তার পরে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি বা হলুদ শাড়ি জড়িয়ে তাকে ঘোমটাপরা
বৌটির মতো রূপ দেওয়া হয়। সিঁদুর পরানো হয়। নবপত্রিকার প্রচলিত নাম 'কলাবউ' হলেও
তিনি আসলেই কারও বউ নন।
শাস্ত্র মতে নবপত্রিকা, ন'জন দেবীর
প্রতীক__ ◑ কলা রূপে
ব্রহ্মাণী,
◑ কচু রূপে কালিকা,
◑ হলুদ রূপে উমা,
◑ জয়ন্তী রূপে কার্তিকী,
◑ বেল রূপে শিবানী,
◑ দাড়িম্ব রূপে রক্তদন্তিকা,
◑ অশোক রূপে শোকরহিতা,
◑ মান রূপে চামুণ্ডা, এবং
◑ ধান রূপে লক্ষ্মী।
শাস্ত্রানুসারে নবপল্লব হলো ৯ টি পাতায়
বাস করা "নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা"।
দুর্গার ডানদিকে তথা গণেশের পাশে রাখা হয়
নবপত্রিকাকে স্নান করিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে নিয়ে এসে। কলাবউকে অনেকে গণেশের বউ মনে
করলেও সেটা একেবারেই ভুল। পণ্ডিত নবকুমার ভট্টাচার্য তাঁর ‘দুর্গাপুজোর জোগাড়’
বইয়ে লিখেছেন— ‘সমবেতভাবে নবপত্রিকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা। নবপত্রিকা দেবী
দুর্গারই প্রতিনিধি। দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভবধ কালে অষ্টনায়িকার সৃষ্টি করেছিলেন এবং
দেবী স্বয়ং ছিলেন।’বাস্তবে অবশ্য ন'টি পাতার সঙ্গে সঙ্গে শিকড়ও থাকে। মহাসপ্তমীর
দিন সকালে জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নবপত্রিকাকে। পুরোহিত কাঁধে করে নিয়ে যান বা অনেকে
তাঁকে পালকি করে নিয়ে যান। পিছন পিছন ঢাকিরা যায় ঢাক বাজাতে বাজাতে। স্নানের পর
নবপত্রিকা বা কলাবউকে লালপেড়ে সাদা শাড়ি বা হলুদ শাড়ি পরানো হয় ও বৌ রূপে সিঁদুর
পরানো হয়।
আসলেই নবপত্রিকা মহামায়ার ন'টি রূপ।
"ওঁ কদলীতরুসংস্থাসি বিষ্ণুবক্ষঃ স্থলাশ্রয়ে।
নমস্যতে পত্রি ত্বং নমস্তে চন্ডনায়িকে।।
ওঁ হ্রীং রম্ভাধিষ্ঠাত্র্যে ব্রহ্মাণ্যৈ
নমঃ।"
মনে করা হয়, ন'টি উদ্ভিদের পুজো করা হয়।
যেহেতু, ভারতবর্ষ একমাত্র কৃষি প্রধান দেশ, তাই প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থার কথাই তুলে
ধরা হয়েছে। স্নান করানোর সময় এই মন্ত্রটি পাঠ করা হয় এবং এই মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য
দিয়ে নবপত্রিকার স্নানকাজ সম্পূর্ণ করা হয়---
“রম্ভা, কচ্বী, হরিদ্রা চ জয়ন্তী
বিল্বদাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।।"
এঁরাই (কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম্ব,
অশোক, মান ও ধান ) আবার নবদুর্গা রূপে পূজিতা হ’ন।
তাই দুর্গাপূজার মন্ত্রে দেখলে বা শুনলে
পাওয়া যাবে ---
“ওঁ পত্রিকে নবদুর্গে ত্বং
মহাদেব-মনোরমে”। “ওঁং চন্ডিকে চল চল চালয় চালয় শীঘ্রং ত্বমন্বিকে পূজালয়ং
প্রবিশ।
ওঁং উত্তিষ্ঠ পত্রিকে দেবী অস্মাকং
হিতকারিণি”
আসলে নবপত্রিকাকে জনসমাজের কল্যাণের জন্য
পুজা করা হয়। একই সাথে আমাদের জন্মভূমি কৃষিপ্রধান দেশ যাতে শস্যের ফলন ভালো হয়,
তাই ন'টি উদ্ভিদের পাতা ও শিকড়কে দেবী রূপে পুজো করা হয়।
✔
মার্কণ্ড পুরানে নবপত্রিকা পূজার বিধান কিন্তু নেই ।
✔ দেবী ভাগবতে নব
দুর্গার উল্লেখ থাকলেও নবপত্রিকার উল্লেখ নেই ।
✔ কালিকা পুরানে
এই নিয়ম না থাকলে সপ্তমীতে পত্রিকা পূজার কথা আছে ।
✔ কৃত্তিবাসী
রামায়নে এর উল্লেখ পাওয়া যায় --'বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস'।
মনে
করা হয়, সম্ভবত শবর জাতিরা ৯টি গাছ দিয়ে নব দুর্গার পুজো শুরু করেছিলেন ৷ সেই
থেকেই নবপত্রিকা দুর্গাপুজোর সঙ্গে মিশে যায় ৷ আসলে দেবী দুর্গার সঙ্গে শস্য
দেবীকে মিলিয়ে দেওয়ার রীতিই এই পুজো ৷ এটি কিন্তু গণেশের বউ নয়‚ দুর্গারই এক মূর্তি — ধরিত্রীমাতা বা শস্যবধূর
প্রতীক | পত্রিকাকে স্থাপন করে পুরোহিত আচমনাদি সমাপ্ত করে মণ্ডপের প্রতিমায় বা
ঘটে দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন | এক্ষেত্রে যোদ্ধা হিসেবে দুর্গার আত্মাকে জাগানো
হয় |
দুর্গাপূজার মন্ত্রে আছে---
“ওঁ পত্রিকে নবদুর্গে ত্বং মহাদেব-মনোরমে”
ভবিষ্যপুরাণে পাওয়া যায়..
"অথ সপ্তম্যং পত্রিকাপ্রবেশন
বিধিঃ"
কৃত্তিবাসী রামায়ণে পাওয়া যায়---
"অথ সপ্তম্যং পত্রিকাপ্রবেশন
বিধিঃ"
কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণে নবপত্রিকা
পুজোর কোনো উল্লেখ নেই।
অষ্টকলসের মন্ত্রপূত জল দিয়ে দেবীর
স্নানাভিষেকের সময় এই গানগুলি সেযুগেও ব্যাবহৃত হত এবং এখনো হয়। কালিকাপুরাণেই
এর উল্লেখ রয়েছে।
প্রথমে "মালবরাগং বিজয়বাদ্যং কৃত্বা
গঙ্গাজলপূরিতঘটেন " এই মন্ত্র বলে গঙ্গাজল পূর্ণ ঘট দ্বারা অভিষেক হয়। তখন
বিজয়বাদ্য বা কাঁসা-পিতল দ্বারা নির্মিত বাদ্য যন্ত্র অর্থাৎ কাঁসরঘন্টা সহযোগে গাওয়া হয়। গান গুলি মালব রাগের উপর তৈরি এবং চৌতাল তালে বাজনা বাজানো হয়।
এরপর "ললিতরাগং দুন্দুভিবাদ্যং
কৃত্বা বৃষ্টিজলপূরিতঘটেন " এই
মন্ত্র বলে বৃষ্টিরজল পূর্ণ ঘট দিয়ে অভিষেক কালে দুন্দুভির সাথে গান গুলি গাওয়া
হয় ললিত রাগে এবং চৌতাল তালে বাজনা বাজানো হয় ।
এবার "বিভাসরাগং দুন্দুভিবাদ্যং
কৃত্ব সরস্বতী-জলপূরিতঘটেন" এই মন্ত্র বলে সরস্বতী নদীর জলপূর্ণ ঘট দিয়ে
স্নানাভিষেক হয় এইসময়ের গান গুলি বিভাস রাগে গাওয়া হয় এবং চৌতাল তালে দামামা
জাতীয় রণ দুন্দুভি বাজানো হয় ।
এরপর "ভৈরবরাগং ভীমবাদ্যং কৃত্বা
সাগরোদকেন" এই মন্ত্র বলে ভীম
বাদ্য বা ভেরী বা চামড়ার তৈরী ঢাকের আওয়াজের সাথে সাগরের জল দ্বারা স্নানের সময়
গান গুলি ভৈরবী রাগে চৌতাল তালে বাজনা বাজে ।
এবার "কেদাররাগং ইন্দ্রাভিষেকং
বাদ্যং কৃত্বা পদ্মরজমিশ্রিতজলেন" এই
মন্ত্র বলে পদ্মরজ বা পদ্মফুলের রেণু মিশ্রিত জল দিয়ে, বীণার সাহায্যে উৎপন্ন
ধ্বনিতে কেদাররাগে গান গাওয়া
হয় এবং স্নানাভিষেকের বাজনা বাজে চৌতাল
তালে।
তারপর "বরাড়ীরাগং শঙ্খবাদ্যং কৃত্বা
নির্ঝরোদকপূরিতঘটেন"
এই মন্ত্র বলে, শঙ্খধ্বনি, তূর্য, বাঁশী, সানাই ইত্যাদির সাথে ঝর্ণার জল দিয়ে
স্নান এবং সংগীত গাইতে হয় বৈরাটি রাগে ও চৌতাল তালে বাজনা।
এবার "বসন্তরাগং পঞ্চশব্দবাদ্যং
কৃত্বা সর্বতীর্থাম্বুপূর্ণেন ঘটেন" এই
মন্ত্র বলে মানুষের সম্মিলিত ঐক্যতানের সঙ্গে পাঁচ রকমের ধ্বনি, সর্বতীর্থের জল
দিয়ে স্নান হয়। গান গুলি গাওয়া হয়
বসন্তরাগে ও চৌতাল তালে বাজনা ।
সবশেষে "ধানশ্রীরাগং বিজয়বাদ্যং
কৃত্বা শুদ্ধ জলপূরিত ঘটেন" এই
মন্ত্র বলে শীতল ও শুদ্ধ জল পূর্ণ ঘটের জল দিয়ে স্নানের সময় গান হয় ধানশ্রী
রাগে ও চৌতাল তালে বাজনা বাজানো হয়।
এই সুর বিজয়বাদ্যের সুর।
অর্থাৎ কাঁসরঘণ্টা দিয়ে শুরু ও শেষ হয় এই
মহাস্নান।
এই যে বিশেষ সমস্ত বিধি আমরা আমাদের
সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে পালন করি, মেনে চলি, এতে আর যাইহোক কোন ক্ষতি কারো হয় না। বরং
মনোবল বেড়ে যায়।
জীবনী-শক্তিকে এগিয়ে নিয়ে চলে। আর একটা বিষয় নারীশক্তি--- এই নারীই শক্তির
প্রধানমূল। কারণ পুরুষকে মানতেই হবে নারী ছাড়া তার জন্ম থেকে তাকে inspiration
দেবার কোন মাধ্যম নাই,তার যতই inner power থাকুক না কেনো একটি নারী ছাড়া সেই পুরুষ
কিন্তু সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাই সমস্ত প্রজাতিরই উচিত নারীকে সম্মান করা,তাকে
তার যোগ্যতা দেয়া। কারণ আমরা বাস্তবে এমনকি
অনেক গল্প বা সিনেমায় (বাস্তবে যা ঘটে তাই তো লেখা বা দ্যাখানো হয়) দেখে থাকি যে
ছেলে মেয়েদের পেট ভরে মা, নিজেকে অভুক্ত রেখে। আবার অন্যদিকে স্বামীর বিপদে বা
খারাপ সময়ে একমাত্র স্ত্রীই
নিষ্ঠার সাথে পাশে থেকে
উদ্ধার করে বা কাটিয়ে উঠতে
সাহায্য করে সেই খারাপ সময়, যাকে বলে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়ায়। যতই তার স্বামী তার
প্রতি অনীহা দেখাক,তবুও। সংসার সামলানোতেও এতোটাই পারদর্শী হয়ে ওঠে, দেখে মনে হয় যেন অন্নপূর্ণা, লক্ষী এবং সরস্বতী একসাথে। তাই
সবশেষে বলি, নারী শক্তি জিন্দাবাদ । নারী পুরুষ একে অপরকে সম্মান দিয়ে জীবনের
পথে এগিয়ে চলুক।