Tuesday, 29 December 2020

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় ,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


আনন্দ বড়ো ক্ষণজন্মা





আনন্দ বড়ো ক্ষণজন্মা

আঁকড়ে ধরি যে মাটি মজবুত ভেবে

তার ওপর আরো আরো গাছ

আগাছার শরীর উপড়ে ফেলে দাও, ভাবতে ভাবতে 

কেঁপে ওঠে ভিত!

মনে হয় ছিনিয়ে নিয়ে যাই হাওয়ার মুঠি ধরে

লাভার মতো জ্বলে ওঠে অগ্নিনিঃশ্বাস

টের পাও না কিছুই।

জানো যদি একটা উত্তরে শান্ত হয় উত্তাল সমুদ্র

তবে কেন এত না বোঝার ভান?

যতবার ভাবি আশা রাখব না কোন

কেন বারবার চোখ যায় ভোরের কাছে?

বরং দু চোখ বন্ধ থাক।

আমি দেখতে চাই না আর, ভাবতে চাই না 

শুধু চাই একটা ঢেউ এসে বলে দিক, 

এই তো দুটো পা ভিজিয়ে দিয়েছি এবার, 


হেঁটে যাব সোনালি বালির বুকে

দুহাত ছড়িয়ে জড়িয়ে ধরব আকাশ

যেখানে আমাদের সঙ্গম নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে

শুরু হবে সেই অনন্ত চুম্বন!





হৃদয় হোম চৌধুরী,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


মৃত্যু


মৃত্যু থেকে ফিরে
জীবনিশক্তির বাকে ঢুকে পড়ি অবিরাম।
আবারো মৃত্যু এলে
অহমিকা তীব্র করে নিশ্চুপ হই।

তখনই
জীবনের আঁচলে মৃত্যুকাঠি জড়ানো হয়।
তবুও
আমি তটভূমি ভেঙে সালোকসংশ্লেষের রসদ খুঁজি

মাহমুদ নোমান, কবিতা, সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


 

 কার্তিকের ফুঁ


কার জন্য মন কাঁদছে,
ছায়া মাড়াতে বুকে চিনচিন
সূর্য উদয়ের 'পরে...
পর্দা টেনে দিলে
মধ্যাহ্নের রোদে,
জানলার গ্লাসে
চিকমিকি দ্যোতনায় ;
ভেবেছ কী রাস্তায় —
পোড়া পোড়া পালক,
পেরেকবিদ্ধ মাথার খুলি
বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে
বিচ্ছিন্ন এক কাক ...



ট্রেন ছাড়লে


ঘুম তাড়িয়ে চলেছে ট্রেন
আকাশের বিপুলা অর্গাজমে,
যেন জলোচ্ছ্বাসের উচ্চাশা —
সমুদ্রের বেহাগ গর্জনে
হঠাৎ দেয়াশলাইয়ের কাঠি
জেদ করে জ্বলে ওঠেছে
অভিমানের তামাশা নিয়ে
ঠোঁটে ঠোঁটে এলিয়ে পড়া
চুমুর দগ্ধ গা,
যেন এই একটিবার কারো কান্নার চিৎকার
সূচের মতোন ফুঁড়ে যাচ্ছে
কেউ কোথাও কারো হাত ছেড়ে দিচ্ছে
চিরতরে একাই একা —
তোমরা কেবল একটি শিশুর জন্ম দেখলে

Sunday, 27 December 2020

অমিত পাটোয়ারী, কবিতা,সাহিত্য এখন শীত সংখ্যা ২০২০-২১,

 

পাপ – তাপ , নশ্বর ,ঈশ্বর 

একবেলা তুলি হাতে শারীরিক চুরি
একবেলা এক পাতে ডিমের পাতুরি
আমরা তো চেয়ে থাকা ভুলে থাকা লোক
দু’হাতে জড়িয়ে ধরি সমাস কারক

একবেলা একই বই ভাগ ক’রে পড়ি
নাম রাখি সুগ্রীব , সুগ্রীব - বানরী
আমার চলছে কুড়ি ; তোমার একুশ
আমাদের দুই বাবা লব আর কুশ

একবেলা মেসেজেই সকাল কাবার
একটু সময় নেই কবিতা ভাবার
ইমোজি ঝগড়া করি , ঠাস ক’রে চড়
গলে যাই পাতালেতে — ভেসে ওঠে খড়

একবেলা দিঘা প্ল্যান , একবেলা পুরী
দুই দিকে ঘাড় নাড়ে উত্তরসূরি
আমরা টেনিসকোর্ট বানিয়েছি ঘরে
প্রতিবেশী হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরে

একবেলা ধান ভানি , পাড় পড়ে বুকে
বন্ধু কমেন্ট করে। ভীষণ অসুখে
তখন বেতাল হয় দু-অক্ষর নারী
আমি তো তুলসীপাতা , ভিজে জামা ছাড়ি

একবেলা ধুলো খাই পায়ে ধ’রে সেঁধে
চিরকাল রেখে দেব দোঁহা দিয়ে বেঁধে
আমাদের সব বেলা লোহা আর সোনা
ভাত দিয়ে , চটি দিয়ে , রিপু দিয়ে বোনা





অরিজিৎ বাগচী,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 



দশমী



সব কথা সেই বাকি থেকে যায় বলা,

'বুক' মানে; সেই মন'কে চেরাই শব্দ!

মেমরি কার্ড'টা বাতিল চেয়ার পাশে,

'দশমী' মানে'ই একলা চলার শর্ত।


ইশতেহারে ধুয়ে গেছে সব খুশি,

লাল শাড়িতে ভাঙা আলোর সাজ;

পেঁজা তুলো আকাশ ঢেকেছিল, 

চিয়ার্স করেছি দুঃখ বারোমাস।


'মাতৃপক্ষ শখের দামে কিনে,

শহরের ছাদে ট্যাক্সি, অটো তারা-

তবুও যারা ছন্দ ভেঙে হাঁটে;

'দশমী' তাদের সঙ্গ হয়নি ছাড়া ।

দেবাশিস তেওয়ারী কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


কালীয়দমন



একদা কৃষ্ণের মতো আমিও কালীয়নাগ
                                           নিয়ে ব্যস্ত হই
ভাবি তাকে বধ করব বলে,
তারপর আবার তাকে ছুঁড়ে দেব যমুনার জলে।
কিন্তু সে কপালগুণে মরবার আগেই----
ছুঁড়ে-ছুঁড়ে বিষ দিচ্ছে গা-য়,


মরার আগের এই তেজটুকু দেখে
                                        আমি চলে যাই


পরের রাত্তিরে সেই তীব্র রূপ
                                   ফের ফিরে আসে
ফিরে আসে শত্রু নয়, গোটা একটা
                                          'কালীয়দমন' 


ফিরে এসে বলে 'প্রভু এই,
       যেটুকু সর্বস্ব ছিল সব দিয়ে গেছি
       এর বেশি কি আছে আমার
       তোমাকে দেবার মতো
                                          ভাই'! 





কাক



এই একটা সাদা মেঘ, তার কালো চুল দিয়ে
আঁকা ওই কাকের মস্তক,
আর ক্রূর চালাকির চোখ
হিসেব-রক্ষক হয়ে মাঠে নামছে, মাঠের আঘাত
কাকের দর্শন নিয়ে একপাশে কাত-
হয়ে পড়ে-পড়ে যাচ্ছে, আর শব্দগুলো কোনও গাছে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গুপ্ত আগুন জ্বালায়
যে-আঘাত টুকরো হয়ে ফিরে যাচ্ছে
                                         মেঘেদের গা-য়


সাদায়-কালোয় মিশে ওরই মাঝখান দিয়ে
                         কাকের কর্কশ খেলে যায়



 
ডিভোর্স ক্লাস্টারিং



সর্দি-কাশির মতো ডিভোর্সও সংক্রামক ব্যধি
সংসার শান্তিতে রাখতে ডিভোর্সির কাছ থেকে
                                        অন্তত নিজেকে
দূরত্ব রাখুন। 


তার প্রতি সমব্যথী হন ক্ষতি নেই
কিন্তু কেন ডিভোর্সটি হল,
কী কী নিয়ে মতানৈক্য, যাবতীয় খুঁটিনাটি
ইত্যাদির দু'এক ঝলকও
              খোঁজ নিয়ে দেখার দরকার নেই
হোক কান্নাকাটি।


নব্বই সালের থেকে এ-যাবৎ মার্কিনী রিসার্চ
'ডেলি মেল'-এ প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়
                  যাকে বলে ডিভোর্স ক্লাস্টারিং
অন্যথায় এই রোগ ৭৫% ঘটে অন্যের ক্ষেত্রে


সংসারের জটিল বাঁধনও এর ফাঁকে
                           কখন ক্ষয়াটে হয়ে যায়, 
শুধু সার
                        উড়ে আসে একগুচ্ছ চিঠি
তাতে লেখা----অনুষঙ্গঃ শুষ্ক নিরাশার


এহেন সময় তাকে প্রেতপ্রেম বলি।




পদ্মনাভ অধিকারী, কবিতা, সাহিত্য এখন শীত সংখ্যা ২০২০-২১,

 



দুরূহ জেনেও



দুরূহ জেনেও  বিশ্বাসে ভর করে
পরিখা ডিঙিয়ে যাই

পথের দু'পাশে সার সার মানুষের
উচ্চস্বরে কথা বুঝি কিন্তু, 
বিষয়ের ভেদ বুঝি না!
যারা ওখানে আছে 
বাস্তবায়নাধীন কাজের নেশায়

তবুও, মেঘমালার ভেতরদিয়ে 
হেঁটে যাই ওদের না বুঝেই।
এই ভাবে রাত্রি-দিন,
অস্পষ্টতায় নগর জীবন
মানুষ না-অমানুষ!
তা  নিজেই বুঝি না

শ্যামল শীল, কবিতা, সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 

আত্মজিজ্ঞাসা


দূরত্ব রচে ব্যবধান

বাতাসে উড়ছে স্মৃতিরা

স্তব্ধ রয়েছে অভিমান


নামছে সন্ধ্যার ছায়া

আকাশে দু একটি তারা

দেহ কি সমাকীর্ণ মায়া ?


                                             

Saturday, 26 December 2020

সৌমাল্য গড়াই, কবিতা, সাহিত্য এখন, শীতসংখ্যা ২০২০-২১,




 সৌরজাল


স্মৃতি ও শরীর, 
তোমাকে পেয়েছি আমি সূর্যাস্ত বেলায়  
যেভাবে জলেরা ফেরে সন্তরণ শেষে 
যেন সেও এক মাঝি নিজের ভেতর 
ডুবো জাল ফেলে দেখে প্রকৃত বন্দর
এমনই অতল দেশে আলো নিভে গেলে
 সীমানা পেরিয়ে জাহাজেরা ডুবে যায় সমুদ্র প্রবাহে 
 
সেইসব সুষুপ্তি পেরিয়ে মনে পড়ে  
ছিলাম সূর্যের দেশে, লক্ষ লক্ষ জীবাশ্ম কণায়  
আকাশের অমূল্য শূন্যতা চুরি করে   
স্বয়ং ব্রহ্ম ও আমি
অন্ধকার লোভে পালিয়ে এসেছি 
যুগ যুগ ধরে তাই সূর্যকণাদূত হন্যে হয়ে খোঁজে প্রতিটি অনন্তে আমাদেরই লুপ্ত পদছাপ
সৌরকণাদের এই অন্বেষণ  হেতু 
সূর্যের আলোক এসে পৃথিবীতে পড়ে...
 
ছবিঃ শুভব্রত চৌধুরী

অসিকার রহমান, কবিতা, সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 



কর্মপন্থা  


না চটজলদি নয় 
খুব ধীর মন্থর গতিতে চলে গেলো জীবন থেকে 
অথচ আমাকে অবাক করে চকিতে এসেছিলো
জীবন জড়িয়ে ছিলো। 

সে গেলো 
যেমন করে রাতের শরীরে গড়িয়ে যায় মধ্যরাত 
                                       মায়াবী গোধূলি হয়ে। 
তার চলে যাওয়ার ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল
সে আর কোথাও থামবে না 
ঠিক যেন স্পেন নগরী এক ব্যস্ত রেলওয়ে স্টেশন। 

জীবনের গতি সে কমিয়ে গেলো 
নাকি বাড়িয়ে গেলো 
কিংবা বিজয়ী হলো সে ত্রিশঙ্কু সময়ে ! 
এ শহরের গলিঘুঁজি পেরিয়ে 
সে কি গেলো শহর থেকে শহর 
কিংবা খুঁজে পেলো 
ফেলে আসা কোনো এক রাজপথের ঠিকানা? 

ধীরে ধীরেই সে চলে গেলো 
অথচ আমি ছুটেও তার কাছে পৌঁছতে পারিনি, 
"ফিরে এসো" বলেছি কিন্তু মুখরিত সেই শব্দ
কানে তার বিঁধেছে কি? 
সে এখন কদ্দূর গেলো? বড়জোর পাশের শহর, 
তার যা হাঁটার গতি 
একটা বড়ো রকমের চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে 
শুরু করা যেতে পারে 
ফের একটা দমবন্ধ ছুট, চটজলদি..... 

বৈদূর্য্য সরকার , গল্প, সাহিত্য এখন শীত সংখ্যা ২০২০-২০২১,

 


প্রান্তিক



শীতের ছুটি চলছে ।  পাড়ার চায়ের দোকানে বেলায় আড্ডা দিতে গেছি, রাজাদা উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে ।  তার রবি ঠাকুর মার্কা দাড়ি হাওয়ায় এবং উত্তেজনায় ছটফট করছে । 
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সত্যি কি কোনও ডক্যুমেন্ট আছে ? রাজাদা চটে বলল, ডক্যুমেন্ট আবার কি... সবাই এতকাল ধরে জানে – নেতাজীর মামার বাড়ি । 
ওর ধাত জানি বলেই শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম, সে ঠিক আছে...কিন্তু প্রোমোটিং যে হচ্ছে, তাদের কাগজপত্র পাশ হল কী করে ! 

পাশ থেকে খিটকেল ভটচাজ বলে উঠল, টাকা রে ভাই, সব টাকার খেলা...গোটা দেশটা বেচে দিল । আর এ হচ্ছে নেতাজী – মরার খবর পর্যন্ত চেপে দিয়েছে । 
এমন সময় ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে পুরুত বলে উঠলো, মানুষের আয়ু যত বাড়ছে... মানুষের কচি সাজাও যেন বেড়ে চলছে। বিরক্ত হয়ে তাকালাম । তখনই  ঝলমলে ক্যাবলাদা হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালো । মুখে কিছু বলে না বটে তবে অঙ্গভঙ্গি করে হাসে আর চোখ পিটপিট করে । পানও চেবায় অবশ্য। আজ লাল রঙের পায়জামা পাঞ্জাবি জুতো টুপি মুখোশ পরে এসেছে । অদ্ভুত এক মূর্তি। 
রাজাদা রেগে লাল হয়ে বলে চলেছে, নেতাজীর ভূত নিয়ে সিনেমা করে হাউসফুল করে দিলে... তার জ্যান্ত মামারবাড়ি নির্দ্বিধায় ভেঙে ফেলছে! 
 সেই সময়েই কোথা থেকে টুপি পরা পাগলা বাজিয়েটা মাটি ফুঁড়ে এসে মাউথ অর্গান নিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ বাজাতে লাগল । 
শুনে আমরা একটু থমকে গেলেও  পুজোয় ওর অ্যাসিটেন্ট হয়েছে বলে রোগাভোগা ভটচাজ পুরুতের সেই আগের কথাটা ধরে ততক্ষণে বকতে শুরু করেছে, মানুষ আগে চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের আগেই সটকে পড়তো । আর এখন আশি নব্বই আকচার। পাশ থেকে কে যেন বলেছিল, একশো বছর বাঁচলে নাকি ডবল পেনসান দেয় ।   

চায়ের দোকানে বসা লোকগুলোর আদৌ কোনও মিল নেই । না চেহারায় না বয়সে কিংবা কাজকর্মে । তবে মিল ভেতরে ভেতরে একটা আছে বটে – সবাই মোটের ওপর ব্যর্থ । সমাজে কোনও দাম নেই । তেমন কোনও পরিচিতিও নেই বটে। সবার মনের ভাবটা খানিকটা এর’ম – দুনিয়ার লোক ষড়যন্ত্র করে বিপাকে ফেলেছে । বিশ্বায়নের মতো সেই গভীর ষড়যন্ত্রে যাবতীয় ভাল ব্যাপার বন্ধ হয়ে গেছে । পুরুত যেমন বলে, দেবদ্বিজে ভক্তি চলে যাওয়াটাই আসল কারণ । রাজাদা বলে- সব ওপারের লোকেদের চক্রান্ত । আমি নতুন কিছু বলার মতো মুখে বলে বসি – পলিউশান, চারদিকে সব দরকচা মারা অবস্থা । পরিবেশ প্রকৃতির মতো মানুষগুলোও সব কেমন যেন হয়ে গেছে ।

আমাদের মতো সামান্য লোকের দল কি এসব ব্যাপারে আদৌ কিছু করতে পারবে ? জিজ্ঞেস করার আগেই দেখলাম রাজাদার মুখচোখে কেমন যেন একটা তেড়েফুঁড়ে ওঠা দৃষ্টি । 
কীভাবে এগোনো যেতে পারে সেটাও তো পরিষ্কার নয় । আমাদের না আছে দল, না অন্য কোনও বল । নেহাৎ পুরনো পাড়া বলে দু’চারটে নিস্কম্মাকে আড্ডায় পাওয়া যায় । এসব নিয়ে যদিও মাথা ঘামায় না কেউ আজকাল। 

চায়ের দোকানে অধিকাংশ সময় কাটানো অন্যান্য লোকের মতো আমার অবস্থা না হলেও রাজাদার সাথে সখ্যতার কারণেই ওখানে জুটে গেছিলাম । রাজাদা এককালে পদ্য লিখেটিখে নাম করেছিল । কীভাবে যেন জাতীয় পুরস্কার পেয়েওছিল একবার । কিন্তু তারপর থেকে ক্রমে কেষ্টবিষ্টুদের অবহেলায় কর্নার হয়ে গেছে । এমনকি ওয়েবসাইটে তখনকার পুরস্কৃত লোকগুলোর নাম পর্যন্ত নেই । আছে তার পরের সময় থেকে, যখন থেকে প্রবল প্রতাপান্বিত প্রেসিডেন্ট তার নিজের সিস্টেমের লোকেদের পুরস্কার দিয়েছে । রাজাদার মুখে শুনেছি, উনি নাকি পূর্ববঙ্গীয় গরীব বামুনদের প্রেফার করতাম । সেদিকে রাজাদা একেবারে মিসফিট । বাড়ির অবস্থা ভাল, এপারের বেণে । তবে এখন তেমন দাপদাপট নেই, বুঝতে পারি । এখন ও লেখালিখির থেকে এনজিও নিয়ে বেশি ব্যস্ত। বাইরে না যাওয়ার কারণে চাকরি ছেড়ে কিছু টুকটাক ফ্রিলান্স করে। একা মানুষ- তেমন কীই বা খরচ ! 

আমার অবস্থা ঠিক উল্টো – বিয়ে থা করে ল্যাজেগোবরে । যদিও সংসারে থিতু হওয়ার বদলে এসব উ্তপটাং ব্যাপারে বেশি টান । চাকরি নাম কা ওকয়াস্তে করলেও মন নেই । গায়ের জোরে লেখালিখির চেষ্টা করলেও বড় জায়গায় তেমন সুযোগ পাই না – মুরুব্বির জোর নেই বলে । ঘরে আশান্তি – গঞ্জনা । সমবয়স্ক বন্ধুরা বাইরে গিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে – গাড়ি বাড়ি বিলিতি বউ । আমি সেই এক জায়গায় পড়ে আছি – হেরিটেজ নিয়ে যাদের গর্ব, বর্তমানে কোনও আশা নেই ।

প্রোমোটার নয়তো রামকৃষ্ণ মিশন –এখানকার পুরনো বাড়িগুলো গিলে খাচ্ছে । টাকার লোভে অধিকাংশ লোক বাস্তুভিটে ছেড়ে চলে যাচ্ছে শহরতলিতে । সেখানে একজন ভুলে যাওয়া দেশনায়কের মামার বাড়ি ! আদৌ কিছু হবে ? বুঝতে পারছিলাম না । তবে সবার আগ্রহে যে কিছুটা জড়িয়ে পড়েছি- তা বুঝতে পারছিলাম ।
ওই চায়ের দোকানে বসার সূত্রে ভটচাজ এসে কথা বলে । ভাল বংশের হলেও সহায় সম্বলহীন লোক –একটা বন্ধ দোকানে থাকে । কাজকর্ম নেই । খাওয়া জোটে কী করে কে জানে ! পুরুতের পুজোর ব্যবস্থা থাকলেও তাতে আর কত । তবু ভটচাজটা ভিড়েছে কলাটা মুলোটার লোভে । তুলনায় অবস্থা ভাল ক্যাবলাদার । ওদের কী একটা ছোট কারখানা আছে । সেখানে না বসলেও কিছু মাসহারা পায় বটে । খরচ বলতে জামাকাপড়ের । একই স্টাইলের শেরওয়ানি পাজামা পাঞ্জাবি – ওর কমপক্ষে ত্রিশটা আছে বলে মনে হয় আমার । রোজ আলাদা রঙের । সাথে ম্যাচিং টুপি । ফক্কুড়ি করে জিজ্ঞেস করতাম, কাকে ইম্প্রেস করতে চাও ? শুনে রাগতো না, মৃদু হাসত আর চোখ পিটপিট করতো ।    

একটু আলাদা ছিল পাগলা বাজিয়েটা । ছোট থেকে ওকে মাউথঅর্গান বাজাতে দেখতাম এলাকার ছোটখাটো অনুষ্ঠানে । তখন থেকেই ন্যালাখ্যাপা । বয়স বাড়ার সঙ্গে পাগলামি বাড়ে আর এসব সুযোগও জুটতো না ওর । তবে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে বাজনা বাজাতে ক্লান্তি ছিল না । প্লাটফর্ম চায়ের দোকান কিংবা গলির মোড়ে সে আপন মনে বাজনা বাজাতো । কেউ বিরক্ত হয়ে কিছু বলত হয়ত । ও ভ্রূক্ষেপ করতো না। আমার মনে হতো – অনেকসময় অজান্তেই ও ঠিক মিউজিক বাজিয়ে আবহটা তৈরি করে দিয়ে যায় । 

রাজাদার আগ্রহে নেট ঘেঁটে বের করেছি, হেরিটেজ কথাটার সঠিক মানে - belonging to the culture of a particular society, such as traditions, languages, or buildings, which come from the past and are still important... রাজাদা ভাবতে শুরু করেছে কাকে দিয়ে কাকে কাঠি করানো যায় । শাসক দলের অনেক লবি... তাদের কাউকে ধরেই এসব ভাঙন আটকাতে হবে । কিন্তু কীভাবে ? রাজাদা বলছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।
বিধায়ক মন্ত্রী এমপি সব নিয়ে যখন কথাবার্তা চলছে তখন ফোকলা পুরুত আশ্চর্য একটা সমাধানসূত্র দিল । রবিবার সে একদল পুরোহিত নিয়ে আমাদের বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রীর সাথে দেখা করবে । মোদ্দা কথাটা হচ্ছে – চারিদিকে পুজো নিয়ে যে অনাচার... তার কিছু একটা ব্যবস্থা করা। এর খেই ধরে রাজাদা ওই বাড়ির ব্যাপারটাও বলে বসবে । তারপর দেখা যাবে । শুনতে কীর’ম অদ্ভুত লাগছে আমার । কিন্তু সবার উৎসাহে ওটাই ফাইনাল হল ।  
যেদিন এই আশ্চর্য মিটিং সেদিন আমি অবশ্য যেতে পারিনি । শুনেছি রাজাদার ক্যারিশ্মায় নাকি মন্ত্রী ব্যাপারটা শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য মেয়রের সাথে কথা বলা দরকার । এতো সহজে তো আর কাজকর্ম বন্ধ করবে না প্রোমোটার।

রাজাদা বেশ সেজেগুজে মেয়রের ঘরে গেছিল একদিন । তিনি চা খাইয়ে অনেক প্রশংসাও করেছে । শুনে আমাদের বেশ গর্ব হল বটে। পুরুতের ওর পুজোর ব্যাপারে দরবারের কতটা কী হয়েছিল জানি না, তবে সে বেশ খুশি মনেই রাজাদাকে পৈতে তুলে সাবাসি দিয়েছে । ভটচাজও বেশ বিগলিত মুখে বলছে, একখানা যা কাজ করলে না... । জিজ্ঞেস করলাম, কাজটা বন্ধ হবে কবে ? সেটা নিয়ে অবশ্য রাজাদা খুব কিছু বলতে পারলো না । 
পরের দিন বেলার দিকে রাজাদার কাছ থেকে একটা অদ্ভুত মেসেজ পেলাম – ‘মহাবিপদ...ফোন বন্ধ রাখছি... দরকার হলে কল করে নেবো... আপাতত গা ঢাকা দিতে হবে’। আগাগোড়াটাই বোঝার মতো কোনও বিষয় নয় । তবে কল করে দেখলাম, ফোন সুইচড অফ । কিছু বুঝতে পারলাম না ।

নানা হাবিজাবিতে ব্যাপারটা খেয়ালও ছিল না । ক'দিন পর হঠাৎ একদিন বিকেলে ওর ফোন পেলাম । আমার অফিসের কাছাকাছি কোথাও একটা দেখা করবে । যাইহোক, গিয়ে দেখি অবিন্যস্ত চেহারায় কাঁধে ঝোলা নিয়ে রাজাদা । অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বলল, ক’দিন এলাকাছাড়া । ওইদিন রাতে নাকি একদঙ্গল ছেলেপুলে ওর বাড়ির সামনে খিস্তিখেউড় করেছে । ঢিল পাটকেলও ছুঁড়েছে । তাদের উন্মত্ত চিৎকার থেকে যা উদ্ধার হয়েছে – ওই বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে ব্যাগড়া দেওয়ার কারণেই প্রোমোটারের উৎপাত । তবে ভাগ্যিস ওকে কেলানে কবি ভেবেছিল, তাই পেটো বা খুনজখমের প্রয়োজন মনে করেনি তারা ।

আমি হতবাক হয়ে ততক্ষণে ভাবতে শুরু করেছি – এটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাপার ! এই সামান্য ব্যাপারে লোকের ওপর এর’ম অত্যাচার হতে পারে ? আমার মনের কথা পড়ে রাজাদা বলল... কয়েক কোটি টাকার ব্যাপার, এতো সহজে কি ছেড়ে দেবে ! একটু থেমে বলল, এখন বুঝতে পারছি... মন্ত্রী কেন বলেছিল বেশ অনেক লোক সাথে নিয়ে মেয়রের কাছে দরবার করতে যেতে । তাহলে আর আমি একা মার্ক হতাম না । কিন্তু কেই বা যাবে ! আমাকে বলেছিল, নানা ঝামেলায় যেতে পারিনি । আর কে নিজের কাজকর্ম ছেড়ে যাবে ? থাকার মধ্যে পুরুত ভটচাজ ক্যাবলাদা আছে বটে... কিন্তু ওদের চেহারাছবি যা ! আমি রাজাদাকে থামিয়ে বললাম, ওদের দিয়েই হবে । মিছিলে ইন্ডিভিজুয়াল মুখগুলো বড় বিষয় নয় ।

পরিকল্পনা অনুযায়ী জানুয়ারির ২৩ তারিখ এলাকার কয়েকটা ছোটখাটো ক্লাব পতাকা আর নেতাজীর ছবি নিয়ে মিছিল বের করলো । তাদের সাথে আমরা জুড়ে গেলাম । ক্রমে স্লোগানের অভিমুখ ঘুরে গেল ‘নেতাজীর স্মৃতি’ তার মামার বাড়িটাকে বাঁচানোর দিকে । আগে থেকে অবশ্য কিছু লোক ঠিক ছিল । যাদের ব্যক্তিগতভাবে তেমন কোনও গুরুত্ব না থাকলেও দলগতভাবে অস্বীকার করা যায় না । 
মানুষের সে নদী নানা দিক থেকে আসা লোকের শক্তিতে বিপুলা হয়ে বইতে লাগলো রাজপথ জুড়ে । সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং স্বতঃসফূর্ত মিছিলের ছবি তোলার কিছু লোক আমাদের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল অবশ্য । গন্ধে গন্ধে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এসে গেল । স্বাভাবিকভাবে বিধায়কের বিবৃতি দাবী করা হল । তিনি আগে থেকেই খবর পেয়েছিলেন, ফলে মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী ঐ বাড়িটাকে হেরিটেজ হিসেবে মেনে নিতে দেরি করেনি । ওখানে নেতাজীর মূর্তি স্থাপনের কথাও দিয়ে ফেললেন । মুহূর্তের মধ্যে নেতাজীর ছবিতে মাল্যদান এবং পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করে তার দলের লোকেরা যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তির পরিচয়ও দিল । ততক্ষণে লোক জমেছে অনেক । বেলা পড়ে এসেছে । দু’একটা ফুচকা ভেলপুরি বেলুনওলা জমতে দেখে রাজাদা নিশ্চিন্ত হল । ওর মুখ দেখে বুঝলাম আমাদের দায়িত্ব ফুরিয়েছে । থাকার দরকারও নেই আর । এবার নদী যথানিয়মে মোহনায় যাবে ।

ভিড় ভেঙে পিছোতে লাগলাম । সঙ্গে ভটচাজ ক্যাবলাদা আর পুরুতও ফেরার পথ ধরেছে । ভটচাজ বলল, এভাবে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে... সব যখন মিটেই গেল । রাজাদা মৃদু হেসে বলল, যার জন্মদিন তার কথা জানো না... প্রেসিডেন্ট হয়েও ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে গিয়ে অজানার পথে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন যে। শুনে ক্যাবলাদাও বেশ মজা পেয়ে হাসতে লাগলো । ঠিক সেই মুহূর্তেই পাগলা বাজিয়েটা বাজাতে শুরু করেছে -‘একলা চলো রে ...’। 
 
শীতের ছোট বেলা ফুরিয়েছে। তখনই ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করলো না। চায়ের দোকানে আগডুম বাগডুম কথাবার্তায় মেতে উঠলাম আমরা। উনুনে আঁচ বেশ গনগনে । মনে হল, ছাই চাপা আগুন ঠিক সময়ে বেরোবেই । 







শুভনীতা মিত্র, কবিতা, সাহিত্য এখন শীত ২০২০-২০২১,

 


সবুজ দ্বীপ

যদি পারো আবার এসো এতটা বলে চলে যেতে হতো। যে বৃষ্টি দাঁড়িয়ে ছিল অপেক্ষায়, উবু হয়ে বসা চাঁদ হাতছানি দেয় তাকে। ইচ্ছের অতৃপ্ত নিঃশ্বাস গাঢ় করে আঁধারের মৌনতা। সবকিছু ওই একটা যদির ভরসাতেই এদিক ওদিক হয়ে যায়। সাঁকো জোড়া লাগে বা ভেঙে যায়। টুকরো অভিমান বাক্যালাপ সেরে নেয় প্রতিফলনে। শহর সমাপ্ত হলে বিভাজিকা বাঁচিয়ে রাখে উত্তাপ।সম্মোহনের অপর নাম বৃষ্টি। জামার ক্লিপ ময়লা বিকেল হয়ে হঠাৎ উড়ে যায় সবুজ দ্বীপে। ঘন নির্জনের আদরে সাজে বেনামী ঠোঁট...

উজান

আজ মন বড় অশান্ত। ঘন ঘন বৃষ্টি আর বিদ্যুতের চমক... কোথাও একটা ছেলে সুর করে পড়া মুখস্থ করছে। টিমটিমে আলোয় রাস্তা খানাখন্দ লুকিয়ে হয়ে উঠেছে মায়া হরিণী। বিশতলা মহলে সে কি বিভোর নিজের গন্ধে না উঁচু থেকে চোখ পড়ে এখনও সাধারণ হাফ শার্ট পুরনো ছাতার দিকে। ছায়া লম্বা হতে হতে একসময় সরে যায় পাঁচিলের ওপারে। জানা হয় না অভিসারের গোপন ইচ্ছা বুকে নিয়ে কেন সে সাবলীল অভিনয় করে গেল! বৃষ্টিও নেভাতে পারে না চিতার আগুন। প্রিয়জনের বিদায় গলার কাছে দলা পাকানো নরম শোক হয়ে বিচরণ করে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে যায় জীবনে... উজানে।

সমাধি

এই মুহূর্তে ঘোষিত হলো বিদায়
যে এসেছিল সাড়ম্বরে আজ তার নিঃশব্দ পদস্খলন
কোথায় যেন দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে আমাকেও
বলার নেই কিছুই
তৃষ্ণা মিটবে না জেনেও কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়া
বানানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিচ্ছেদ সঙ্গ দেয়
করিডোরের ফালি আলোতে খুলে বসি
ষড়যন্ত্রের বাক্স
আঁধারে ভূমিষ্ঠ জল সমাধির অপেক্ষায়...


Tuesday, 1 December 2020

বাংলা লিরিক, শ্যামশ্রী রায় কর্মকার




আইসক্রিমের মতোন চাঁদ

শ্যামশ্রী রায় কর্মকার 


যদি উঠতো রাতে আজ আইসক্রিমের মতোন চাঁদ

কোল্ড কফির কাপে ঝরতো রূপকথা

এই তরুণ অগাস্ট মাস চিঠিতে লিখতো মেঘের শ্বাস 

বন্ধ কাচের গায়ে জলের চুপকথা

নিকনের লেন্সে জুম ইন ছাদ, ভাঙা কার্নিশ, ঠোঁটের প্রমাদ

হাতব্যাগের ভেতর টাটকা কবিতায় 

উড়ুউড়ু চুল, ভোরে বাইপাস, গাড়িতে হাতের ওপর হাত

আর নিরুদ্দেশের সঙ্গে বন্ধুতা

পকেটের গোপন সাবমেরিন, দুফোঁটা বেহিসাবের দিন

কথাদের পিঠের ওপর উড়ুক্কু বাওবাব 

খামের ভেতর মনখারাপ, ওপরে সমুদ্র নীল ছাপ

ডুবজলের এ গান তোমাকেই দিতাম 


Friday, 20 November 2020

লুইস গ্লিক, ভাষান্তরঃ ইউসুফ মোল্লা

 



লাল পোস্তদানা

লুইস গ্লিক 

ভাষান্তর: ইউসুফ মোল্লা


দুর্দান্ত জিনিসটির মন নেই।

অনুভূতি: ওহ, আমার সেগুলি আছে; 

তারা আমাকে শাসন করে। 

আমার স্বর্গের এক প্রভু আছেন

যাকে সূর্য বলা হয়,

এবং তাঁর জন্য উন্মুক্ত করে, 

তাকে আমার উপস্থিত হৃদয়ের আগুন, 

তাঁর উপস্থিতির মতো আগুন দেখাচ্ছে। 

হৃদয় না থাকলে এ জাতীয় গৌরব কি হতে পারে? 

ওহে আমার ভাই ও বোনেরা, 

তুমি মানুষ হওয়ার আগে অনেক আগে, 

তুমি কি আমার মতো ছিলে?

তুমি কি নিজেকে একবার খোলার অনুমতি দিয়েছ, 

যে আর কখনও খুলবে না? 

কারণ সত্যের সাথে আমি এখন, 

তুমি যেভাবে কথা বলছো তা বলছি। 

আমি কথা বলি কারণ আমি ছিন্নভিন্ন।


              __________



Monday, 16 November 2020

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ, কানাইলাল জানা

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ

কানাইলাল জানা 



২০০৬ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আলিপুরের বাড়িতে এলেন সাহিত্যের আড্ডায়। অনুষ্ঠান সন্ধে ৬ টায় এসে আটটা সাড়ে আটটায় চলে যাবেন বলে এলেন ৬ টা বাজতে ২ মিনিট বাকি এবং গেলেন রাত পৌনে ১১ টায়,  এমনই জমেছিল সেবারের 'মহল'। আর ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  সন্দীপণ চট্টোপাধ্যায় দিব্যেন্দু পালিত শুভাপ্রসন্ন পার্থ ঘোষ গৌরী ঘোষ রাজা সেন রাজা মিত্র কংকাবতী দত্ত প্রমুখ গুণীজন। কবি হিসেবে এসেছিলেন সৌমিত্রদা তাই তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়তে থাকলেন একের পর এক কবিতা। সবাই মুগ্ধ।  অনিবার্যভাবে আলোচনায় এল নাটক অভিনয় গান গাওয়া  রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমার সৌরভ গাংগুলি তনুজাসহ অন্যান্য নায়িকারা এবং বিশেষ ভাবে তুলসী চক্রবর্তী। যাওয়ার সময় তাঁর ভালোলাগার কথা জানিয়ে বলে গেলেন 'তোমার নতুন বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে রইল ' কারণ আলিপুরের বাড়ি তথা কোয়ার্টার্সে এটাই ছিল শেষ অনুষ্ঠান। 

আমরা তাঁর নানা গুনের কথা বলি কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সরকারের সরস্বতী সম্মান (৬ লক্ষ টাকা)   পেয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আনেয়ার শা রোডের মার্লিন হাউসে মজলিশ পার্টিতে আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন এবং সেখানে স্ন্যাকস নিতে নিতে সৌমিত্রদা যখন বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বলছিলেনঃ' ভাবো লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মধ্যে একসঙ্গে এত প্রতিভার সমাবেশ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি পাবে না কিন্তু। ' শুনে ভাবছিলাম সময় পেলে সৌমিত্রদা হয়তো ভাস্কর হওয়ার চেষ্টাটাও  ছাড়তেন না। 



আমার শ্রেষ্ঠ মুগ্ধতা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে তাঁর ৭০ তম জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে। ঢুকতেই পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর দাদার সংগে। লম্বায় একটু কম কিন্তু দেখতে অপরূপ যেন স্বর্গ থেকে এইমাত্র নেমে এলেন স্বয়ং দেবদূত! 


অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে রেহাই দিতে কয়েক বছর আগে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বড় অংকের অর্থ দিতে চায় শুনে তাঁর বাড়িতে গিয়ে  জিজ্ঞেস করতে বললেনঃ 'কোথায় বিশ্রাম?  বরং যত দিন যাচ্ছে তত নানা কাজে জড়িয়ে পড়ছি। '

যে কাজেই আত্মনিয়োগ করুন কবিতা চর্চা তাঁকে ছেড়ে যায়নি কখনো তাই বরাবর আমার আশা ছিল তাঁর এই গুণটা অন্য অভিনেতা কেউ না কেউ অনুসরণ  করবেন। স্বাধীনতার পর পরই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় যেভাবে বহু ফাঁকা জমি পেয়েছিলেন অনেক কিছু করার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবনে সেরকম ফাঁকা জমি না পেয়েও নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সারাজীবনটাই  তাঁর নির্মাণের কাহিনি যা ফল্গু ধারার মতো মানুষকে প্রেরণা দেবে নিজেকে প্রস্তুত করার। 

কয়েক দিন আগে তাঁর মোবাইলে ফোন করলে ছেলে সৌগত উদ্বেগ হীন কন্ঠে জানানঃ 'বাবা এখন স্টেবল্। ' শুনে একটু হলেও আশা জেগেছিল সম্ভব হলেও হতে পারে অন্তত কিছু দিনের জন্য ফিরলেন মিরাকল ঘটিয়ে 'ময়ূরবাহন '। 


এখন আমাদের সামনে থাকল শুধু সীমাহীন উদারতা ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষের আঙ্গিকে তিলে তিলে গড়া এক অসাধারণ সহজিয়া জীবন যিনি যে কোনো প্রলোভন ও মোহকে দূরে সরিয়ে মাতৃভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষাতেই সোনার ফসল ফলিয়ে  বাঙালি জাতির গৌরব এতটাই বৃদ্ধি করলেন সে যেন খ্যাতির এক পূর্ণ কুম্ভ। পিপাসার জল গড়িয়ে খেতে খেতে  যেমন চলে আমাদেরও তেমনি চলবে অনেক দিন...

Tuesday, 20 October 2020

অজিত বাইরী কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 



দাঁড়ের পাখি

 

দাঁড়ের পাখি, তুমি কি উড়তে চাও?

ডানায় ভর করে পার হতে চাও আকাশের পর আকাশ?

তুমি কি জান না, আকাশেও হানা দেয় ঝড়-বাদল?

বজ্রবিদ্যুতে ছিঁড়ে ফেলে আকাশের বুক?

তুমি স্বপ্ন দেখেছ সুদূর নীল আকাশের

স্বপ্ন দেখেছ অনন্ত মুক্তির

নেই শিকলের বেড়ি, নেই সারি সারি গরাদের শিক

দাঁড়ের পাখি, দ্যাখো কী নিশ্চিন্ত জীবন তোমার!

না আছে দানাপানির অভাব, না আচ্ছাদনের

সুখের সমস্ত উপকরণ সাজানো থরেথরে

তবুও মন বসে না দাঁড়ে!

আকাশ কি দেবে নির্ভরতা?

আকাশ কি দেবে নিশ্চয়তা জীবনযাপনের?

সকালের উজ্জ্বল আকাশ বদলে যায় বিকেলের ঝঞ্ঝায়

নিবিড় নক্ষত্রের রাত মুছে যায় মেঘের কালো পোঁচে

এত অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিতে চাও

আমি ভেবেছি, যা যা চাও, সব দেব

অলংকারে ভরে দেব গা 

ভ্রমণের আনন্দ দেব

সংসার ভরা স্বাচ্ছন্দ্য দেব

শুধু আকাশ চেও না

দাঁড়ের পাখি, তুমি আমার কাছ আকাশ চেও না


শারদীয় সাহিত্য এখন ১৪২৭,সাহিত্য এখন শারদ ২০২০, সম্পাদকীয়,

 শারদীয় সাহিত্য এখন ১৪২৭

 সম্পাদকীয় 

 




শারদীয় সাহিত্য এখন  ১৪২৭

সম্পাদকীয় 

অক্টোবর কথাটার মধ্য একটা অদ্ভূত পেলবতা আছে। প্যাস্টেল হলুদ রোদ, বুড়ো পরির চুলের মতো মেঘ। অনেক দশক আগে কেউ বুঝি নৌকা থেকে নেমে ছুটিতে বাড়িতে এলো।পায়ে, কাদা, হাতের তোরঙ্গে ভরা নতুন কাপড়। অক্টোবর ঘরে আসার মাস। অক্টোবর কানে ফুস মন্তর। বন্ধুর হাত ধরে মাঠঘাট পার হয়ে ঢাকের শব্দের দিকে ছুট ছুট ছুট… ১৪২৭ সেই রাক্ষস যেন। রাজকন্যাকে ধরে বেঁধে পুরে রেখে দিয়েছে গুহার ভেতরে, অন্ধকারে। আমরা আশায় আছি। সেই অন্ধকারে রাজকন্যার তৃতীয় নয়ন জেগে উঠবে এবার। সোনালি দরজা খুলে সিঁড়ি উঠে যাবে আলোর দিকে।  

সাহিত্য এখন বেশ কিছু নতুন মুখ নিয়ে এল এবার। পড়বেন তাদের। অগ্রজদের আশীর্বাদ এই পত্রিকার স্তম্ভ। তারুণ্যের ভালোবাসা জড়িয়ে রেখেছে বরাবর। আমরা যারা মাঝপথে সেতুর মতোন, তারাও রইলাম নিভৃত অক্ষরমালা নিয়ে। এবারের প্রচ্ছদ এঁকেছে তরুণ শিল্পী মঙ্গলদীপ সর্দার। প্রবীণ ভাস্কর রামকুমার মান্নাও জড়িয়ে রইলেন তাঁর স্নেহচ্ছায়া নিয়ে। শুভ চতুর্থী। সব অন্ধকার কেটে যাক