রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকারঃ প্রভাত চৌধুরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকারঃ প্রভাত চৌধুরী
কাগজের নৌকা
ছাদবৃষ্টির প্রহরে
শহরের ছাদে বৃষ্টিরা আসে, ফেরে না
ছাদের গল্পে পাদটীকা হয়ে থেকে যায়
সিঁড়ির জ্যামিতি শিখে নেয়,বুকে হাঁটতেও
তোমাকে গোপনে আরেকটু ভালবাসতেও
এই শহরের বুলেভার্ড জানে, প্রতিদিন
রোদ্দুর কার পাশে হেঁটে হল বেদুইন
হাওয়া কাদেরকে ভেজা চোখ দিয়ে ছুঁয়ে যায়
কাকে বৈশাখে একলা করেছে ইশারায়
কতদিন আগে ছেড়ে এসেছিলে বাসস্টপ
ঠোঁটের প্রহরে থমকে দাঁড়ানো হার্ড রক
গ্রুপ থিয়েটার, কথার বাক্সে রাখা মন
স্ট্রবেরি বিকেল, সুমনের গানে গ্লাসনস্ত
সময়টা হোক মার হাতে বোনা সোয়েটার
শ্রাবণের মেঘে রশিদ খানের বন্দিশ
শঙখ ঘোষের কবিতার মতো চুপ-রঙ
জলের ওপরে দু এক লহমা গাঙচিল
মাছ ধরা
হুইল ছিপে মাছ ধরা বাঙালির সুবর্ণযুগ দীর্ঘকাল আগেই গত হয়েছে। বাড়িতে বাবাকে দেখতাম একসময়। ছুটির দিন মানেই হয় অমুকের বড় শালা, নয় তমুকের মামাশ্বশুরের পুকুরে দলবেঁধে মাছ ধরতে যেত। যাওয়ার সময় কত উৎসাহ, তোড়জোড়। আর ফেরার পরে মায়ের মুখে অমোঘ প্রশ্ন, "কিনে আনলে?" সকালের সেই উদ্দীপনা ততক্ষণে বাবার মুখ থেকে উধাও!
সেইসময় বাবা মামারবাড়ি যাওয়া মানেই মাছধরার বিরাট আয়োজন। হাড়িয়ার পচা ভাত, পাঁউরুটি, চারের মশলা ইত্যাদি যোগাড় হয়ে যেত অবিলম্বে। বাগানে খুঁজে খুঁজে জামরুল গাছের মগডালে ঝুপসি পাতার ভিতর থেকে পেড়ে আনা হত পিঁপড়ের ডিম। আড়ালে পরখ করে দেখেছি অবশ্য সেই পচা ভাতের মতোই সাদা সাদা ডিমও বেজায় টক। তাই আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল মাছেরা টক স্বাদ বোধহয় পছন্দ করে। যাইহোক দুপুরে খাওয়ার পাট সেরে তিন-চারটে হুইল পাতা হল পুকুরে। আমার কাজ যোগানদারের। জল আনা, পান আনা, এইসব।
আয়োজনের শুরুতেই পুকুর ঘাটে কাঁকড়া ধরে এই মার খাই কী ওই মার খাই! প্রথমে কাঁকড়া দর্শন নাকি চরম অশুভ। এদিকে সময় বয়ে যায়, মাছ আর টোপ গেলে না। সবাই মিলে আমাকেই কালপ্রিট সাব্যস্ত করে বসল। অবশেষে কেজি দেড়েকের রুই মাছ ধরা পড়ল ঘন্টাখানেক বাদে। দু'হাত দিয়ে কানকোর কাছে জাপটে ধরে পুকুরপাড় দিয়ে নিয়ে আসার সময় সেই মাছ যে আমাকে নতুন করে বিড়ম্বনায় ফেলবে তা আগে বুঝিনি। যখন মালুম হল ততক্ষণে সেই পিছল রুই ঝটকা মেরে হাত ফসকে জলের গভীরে ভাগলবা। এরপরে আমার কর্ণযুগলের মর্মবেদনার কথা আর সর্বজনসমক্ষে না বলাই শ্রেয়।
যাইহোক, সে সময় গ্রীষ্মের ছুটি মানে সব মাসতুতো ভাই বোনেদের জমায়েত মামারবাড়িতে। গাছ থেকে আম-কাঁঠাল-নারকেল পাড়ানো হত। পুকুরে জাল দেওয়া হত। এই জালে মাছ ধরা দেখা আর এক আনন্দের স্মৃতি। মেজমামা আগের দিন জেলেদের সাথে কথা ফাইনাল করে এসেছে। তাই ভোর না হতেই তাদের আগমন। জলের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে চালের কুঁড়ো, সাথে বোধহয় আরও কিছু। এতে জলে অক্সিজেনের পরিমান দ্রুত কমে আসে। ফলে একটু পরেই উপরে ভেসে উঠতে থাকে মাছ। পাড়ের কাছে এসে খাবি খায়, ছটফট করে। এবার জালটানার কাজ শুরু। গলা অবধি ডুবে চারদিক থেকে জেলেরা জাল গুটিয়ে আনে ক্রমশ। মাঝখানে আটকে পড়া মাছেদের ছটফটানি চোখে পড়ে।
জেলেরা পুকুর ছাড়তেই আমাদের অপারেশন শুরু হয়। আনাচে কানাচে ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঠিক কিছু খাবি খাওয়া মাছ রয়েই যায়। খুঁজে পেতে সেগুলো ধরার মাঝেই তখন আমাদের চরম আনন্দ। জীবনের পরম সার্থকতা।
এদিকে জেলেরা ততক্ষণে সব মাছ এনে ফেলেছে উঠোনে। ভাগাভাগি শেষে যা থাকে তাও যথেষ্টর চেয়ে অধিক। কিছু জ্যান্ত মাছ বড় গামলায় জলে জিইয়ে রাখা হয়। সেসময় ফ্রিজ নেই কোথাও। ফলে তেলে ভেজে দিন দুয়েক রাখা যায়। আর এরমধ্যে গুষ্টিশুদ্ধু গান্ডেপিন্ডে অবিরাম মাছভাজা খাওয়া চলতে থাকে।
মাঝে মাঝে গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে ছোটো হাতছিপ নিয়ে কেঁচো কিংবা ময়দার ডেলা বঁড়শিতে গেঁথে সেই বিরাট পুকুরের ঘাটে আঘাটায় অনুশীলন চালাতাম। প্রায়ই ফাৎনা নড়ে উঠত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টোপ খেয়ে বঁড়শিকে কলা দেখিয়ে কেটে পড়ত মাছ। আবার ট্যাংরা, পুঁটি কিংবা চারাপোনা ধরাও পড়ত অনেক সময়। তবে মাছ উঠলে এক দৌড়ে পুকুর ছাড়িয়ে বাগান পেরিয়ে চলে যেতাম বাড়ির ভিতরে। কারণ বিশেষ করে কাঁটাওলা মাছ বঁড়শি থেকে ছাড়ানোর সাহস তখনও রপ্ত করিনি।
সেইসব নিরালা দুপুরে বাগানের বুকে থমকে থাকত জমাট ছায়া। কোনো ঝাঁকড়া গাছের পাতার আড়ালে বসে ক্রমাগত ডেকে চলত বসন্তবৌরী পাখি। কালো দাঁড়াস সাপ সামান্য খসখসে আওয়াজ তুলে পেরিয়ে যেত পায়ে চলা পথ। একটা জাম গাছ ঝড়ে হেলে পড়েছিল পুকুরের জলে। শীতের দিনে নিস্তরঙ্গ দ্বিপ্রহরে জাম গাছের জল ছুঁয়ে ফেলা কাণ্ডের উপর রোদ পোয়াতো কয়েকটা গোঁয়াড়গেল আর শ্যাওলা রঙের কচ্ছপ। আমি দূর থেকে চুপিচুপি দেখতাম। আমার শৈশবের উপর শীতের শেষ বেলার অপার্থিব রোদ্দুর চুঁইয়ে পড়ত ফোঁটা ফোঁটা।
অলংকরণ - স্বরূপ দাস
জীবন
অশ্রু খুশি
ভোর হলেই আমি চোখ ফিরে পাই।
ধুলোর উড়ে যাওয়া দেখি, গ্রামের পথ জুড়ে
আর পাখি শব্দের হই।
আমার সমস্ত বালক-জীবন ,ধান ক্ষেতের মধুর উল্লাসে যেন নেচে নেচে ওঠে!
রবীন্দ্রগানের সুর ভেসে যাই, আর রঙিন হয়ে পড়ি।
স্মৃতি কিছু উসকে না-দেখাই ভালো ।
বুকের উপর দিয়ে পিষে যাওয়া চাকার গাড়ি
আমাকে রাস্তা দেখায়। সেই রাস্তায় আমি পথ হাঁটি।কবিতা ওড়াই। কষ্ট পাই খুব । আর
নোনা সময়ের সেই কষ্টেের ভিতর দিয়ে, হাসতে গিয়েও দেখি, অশ্রু-খুশির আমার জল নেমে আসে।তাই সময় পেলেই তোমাকে লিখি।
ভেতরের সমস্ত অন্ধকার কথাগুলি আমার ,
সত্যের পাথরে ঘষে - মেজে মস্তিষ্কে তুলে রাখি। আর কখন একটা নিজস্ব আলোর হয়ে যাই জীবন ।
ব্যথার জ্যোৎস্না
যদি আসো তোমার পাশে বসি
আমি তো সেই তোমার চেনা পড়শি।
এতদিনের জানাশোনা সব কি
হতে পারে এমনতর মেকি!
যদি আসো তোমার পাশে বসি
আগের মত গল্পগাছা করি,
সেই যে গেলে আর না কভু ফিরলে
দুঃখ নিয়ে তোমাকেই যে স্মরি।
সুজন আমার বন্ধু আমার, তুমি
ফিরে এসো আমার উঠোন পরে,
গলা ধরে গানের স্রোতে ভাসি
স্মৃতির ঘন্টা অন্ধাকারে নড়ে।
হাওয়া বয় পাতা খসে যেন
সময় শুধু পুরাতন হয় কেন?
বুকের মধ্যে কারা নড়ে চড়ে
আবছা সব ঠাওরে না পড়ে।
তোমার কথা তোমার ছবি জাগে
আমার সকল আকুলতার মাঝে,
শিউলি যেন অবহেলায় ঝরে
আমার শূন্য একলা উঠোন পরে।
তুমি এসো ফিরে এসো বুকে
আরোগ্য হও কঠিনতর অসুখে।
আমার পরান তোমার জন্যে কাঁদে
তুমি আমার ব্যথার জ্যোৎস্না চাঁদে!
না দেখা শঙ্খের শব্দ গুচ্ছ
সুপ্রতিম কর্মকার
যেমন ভাবে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ অনুভবে আপন হয়ে ওঠে, ঠিক তেমন এই লেখার সুর বাঁধা রইল আমার, "আমার শঙ্খ ঘোষ" - এই শব্দত্রয়ের বন্ধনে। যে বৃত্তান্তের বৃত্তের মধ্যেই দেবেশ রায় থাকেন। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-র লেখক।কোভিডের আক্রমনে তিনিও মারা যান। কোলকাতায় বেশির ভাগ সময় আস্তানা ছিল বাগুইহাটির বিনোদিনী সিনেমাহলের উল্টোদিকের গলিতে। দেবেশ রায়ের ফ্ল্যাট বাড়িতে। আমি গেলে খুব খুশি হতেন তিনি। আমি গেলে কলকাতা শহরের নানা প্রান্ত থেকে আসতেন অনেক গুলো মানুষ, আমাদের দুজনার সাথে দেখা করতে, এক সাথে। আসল লোভের বিষয়টা ছিল নদী নিয়ে নানা আড্ডা। আর ‘সেতু বন্ধন’ পত্রিকার জন্য নতুন লেখার প্রস্তুতি।পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন দেবেশ রায় নিজে।
এমন এক দিনেই দেবেশ রায় আর শঙ্খ ঘোষের কথপোকথন শুনেছিলাম।টেলিফোনে। আমি একা নয়, আরো কয়েকজন ছিলেন সেখানে। দেবেশ রায়ের থেকে একটু বয়সে বড় ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তাই দেবেশ বাবু দাদা বলে সম্বোধন করতেন শঙ্খ বাবুকে।
শঙ্খ ঘোষ আমার ঘরে এসেছিলেন আমার কোন এক জন্মদিনে। এক প্রিয় মানুষের হাত ধরে। উপহারের রূপ নিয়ে। প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন শঙ্খ বাবু। সেই বক্তৃতা ছাপা অক্ষরে বেরোয় ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ এই শিরোনামে গাংচিল থেকে। পাতলা চটি বই।সেই চটি বই পাল্টে দিিয়েছিল একটা মন।
সময়টা ১৫১৭-২০ সালের মধ্যে। ঠিক হলফ করে বলা যায় না। মার্টিন লুথারের লেখা একটা একটা পাতলা নরম পুস্তিকা। সেটা ছাপা হয়েছিল। আর ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা পৃথিবী জুড়ে।নাড়িয়ে দিয়েছিল চার্চ আর রোমান সাম্রাজ্য নামের দুই সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠানকে। '৯৫ থিসিস' নামে পরিচিত সেই পুস্তিকাটি। সম্ভবত বিশ্বের প্রথম চটি বই। চটি বই বিপ্লবের সেই সূচনা। যাক সে সব কথা।
চারিদিকের অভিজ্ঞতা একই সঙ্গে নানা ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু তার প্রকাশ হচ্ছে একজন বা দুজনের মধ্যে দিয়ে।তারা হয়তো জোর দিয়ে ‘আমি’ শব্দটাকে উচ্চারণ করতে পারে। বক্তাকেই বুঝতে হয়, যে 'আমার' পরিসর যত ছোট হয়ে আসবে, তাঁর দেশও হবে তত খন্ডিত।
রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের কথা মনে আছে? নিখিলেশ আর সন্দীপ। প্রতিদিনের এই চেনা চরিত্র দুটোকে আমরা উপন্যাসে পাই। একাধিকবার আমরা দেখি, নিখিলেশ চুপ করে থাকেন। নীরবতারও একটা ভাষা থাকে। সে ভাষা পড়তে ভুলে যাই আমরা। অনেক সময়ই ভুলে যাই।শুধু যে আমরা পড়তে ভুলি, তা নয়। তার ব্যবহারেও আমাদের ভুল হয়ে যায় ।আমরা ভুলে যাই, ‘নীরবতা একটা সামর্থ্য’।
এমন সময় পাখার বাতাসে উল্টে যায় রবীন্দ্র রচনাবলীর পাতা গুলো। চোখ যায় ‘কণিকা’-র দুটি লাইনে।
‘দয়া বলে, কেগো তুমি মুখে নাই কথা?
অশ্রুভরা আঁখি বলে, আমি কৃতজ্ঞতা’।
পারি না হয়তো। কিন্তু খুঁজে যেতে হয়। তবু খুঁজে যেতে হয় কৃতজ্ঞতার এক অভ্যন্তরীণ স্পর্শ।সেখানে বেজে ওঠে না দেখা শঙ্খ, একটি পাতলা বইয়ের মধ্যে অবিরাম বাজতে থাকে তাঁর বাণী ।
আঁকছি ছবি
একটি আধাগ্রাম্য উপাখ্যান
সুবিৎ বন্দোপাধ্যায়
বিস্তৃত মাড়ুয়া ক্ষেতের পাশে , বন মুর্গির ঝোল দিয়ে আলো চালের ভাত মেখে খেতে খেতে আমরা ভাষা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। পাশে পড়েছিল বহু ব্যবহৃত কান মোচড়ান থিওডোলাইট।
নিখিলেশ
ঢেলে দিচ্ছিল নীল ফুলদানির মত পাত্র থেকে তরল মধু জাতীয়।
আজিতেশ
উদাস চোখে পাশের বাঁশ বাগানে শালিখের হুটোপুটি দেখছিল। প্রচুর ধূলো ওদিকে।
আলোকেশ
দুপত্রের পর ইংরেজি ছাড়া বলেনা কখনো।
আমরা ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর খাঁটি বিলিতি উচ্চারণের ইংরেজিতে ,
একটি পিকনিকের মত কিন্তু রুক্ষ গ্রাম্য
পরিবেশে ,
নির্জলা মধু সহযোগে আলো চালের ভাত
নাড়তে নাড়তে ,
চাইছিলাম মাতৃ ভাষা দীর্ঘজীবি হোক !
সম্পাদকীয়
দুহাজার একুশে আমরা অনেকেই নিজের ভেতর এক নতুন সত্ত্বার সন্ধান নিয়ে এসেছি। গত বছর যত না কেড়ে নিয়েছে, শিখিয়েছে তার কয়েকগুণ বেশি।সেই শিক্ষা মনে রেখে আমরা নতুন পন্থায় জীবন গড়ে তুলব কিনা, তার অনেকটাই নির্ভর করছে আমাদের ওপর।
দেশও এক নতুন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। সাহিত্যেও কি নতুন কোনো বাঁক দেখব আমরা?
"Tell me again
When I've been to the river
And taken the edge of my thirst"
তৃষ্ণার প্রান্তে এসে দাঁড়ানো কিছু লেখা নিয়ে প্রকাশিত হল 'সাহিত্য এখন' ব্লগজিনের শীতসংখ্যা, ২০২০-২১।
পাঁচ বছরে পা দিল 'সাহিত্য এখন'।সে বড় হচ্ছে। তার পরিবারও। তার জন্মদিনে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, সকলের শুভকামনা মাথায় করে এবার মুদ্রিত সংখ্যার পথে পা দেবে সে। ব্লগজিনও চলবে তার নিজের মতো । শহর কেন্দ্রিক নয়, গ্রামকেন্দ্রিক নয়, আমাদের এই পত্রিকা হোক সৃজন-কেন্দ্রিক।
এই সংখ্যা নতুনের বিভাস নিয়ে এলো। অগ্রজরা আছেন তার স্তম্ভ হয়ে।
সাহিত্য এখন' এ যোগ দিলেন একদল তরুণ মুখ। তাঁরা পত্রিকার প্রাণ। পত্রিকার নতুন লোগোটি শিল্পী অশোক কাঞ্জিলালের করা। সাক্ষাৎকার পাতার লোগোটি করেছেন শুভদীপ রায়। তাঁদের আমার কৃতজ্ঞতা।
আপনাদের শুভেচ্ছা ও সক্রিয় সহযোগিতা আমাদের পাথেয় হোক 🙏
আলাপচারিতায় কবি শুভঙ্কর সাহা-র মুখোমুখি সাংবাদিক শুভদীপ রায়
∆ আচ্ছা শুভঙ্কর দা, প্রথমদিকে লেখালেখি করার সদিচ্ছা কীভাবে অর্জন করলেন যদি জানান--
• আসলে লেখালেখির আবহাওয়াটা পারিবারিকভাবেই পাওয়া। তবে পরিবারে লেখালিখির চলটা সেভাবে হয়তো ছিল না। কিন্তু বই পড়ার চলনটা বেশ ছিল। বরাবরই বাবা, মা, দাদা বেশ ভালো পাঠক। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বাড়িতে আসতো। আনন্দমেলা, শুকতারা এগুলোতো পড়বার সুযোগ বাড়ি থেকেই পেয়েছি। বড় হয়ে দেখেছি দেশ পত্রিকা আসছে, খবরের কাগজ আসছে, কখনো শনিবারের চিঠি আসতো এছাড়াও সত্যযুগ বলে একটি কাগজ ছিল, মোটামুটি সেই আশির দশকের প্রথম দিককার কথা মনে ভাসছে । সাহিত্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিনও আসতো তখন। বেশ কিছু ইংরেজি বইপত্রও বাড়িতে থাকতো , সেগুলো দেখতে পেতাম। শেক্সপিয়ার কমপ্লিট ওয়ার্ক বইটি তো বাড়িতেই দেখে আসছি আমার বুঝতে পারার বয়সকাল থেকে।
∆ তাহলে আপনি বলছেন লেখালেখির সৃজন আগ্রহটা আপনি পারিবারিক পড়াশোনার সূত্রেই পেয়েছেন!
• হ্যাঁ ঠিক তাই।
∆ আচ্ছা দাদা, আপনার লেখালেখির শুরুটা কাব্যসাহিত্য দিয়ে, নাকি গদ্যসাহিত্য ? কোন্ ধরনের লেখা দিয়ে আপনার সৃজন শুরু হয় যদি জানান--
• আর পাঁচজনের মতোই আমারও প্রথম ছড়া দিয়ে লেখাচর্চা শুরু হয়, তখন হয়তো একটা বটপাতা বা একটা গাছ অথবা একটা পুতুল এই নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত হয়েছিল। তারপর আমার পড়াশোনা করার স্কুলে অর্থাৎ উত্তর ২৪ পরগনার সিন্দ্রাণীতে তখন নিয়মিত 'স্পন্দন' বলে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো, ফলে ওখানে লেখা প্রকাশের একটা ইচ্ছে তৈরি হয় , তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশ হবে এই ভাবনাটি তখন ছিল তীব্র আনন্দের। ফলত এটাও কিন্তু লেখালেখি চর্চার একটা বিশেষ প্রেরণা।
∆ আচ্ছা শুভঙ্কর দা, আপনার কাছে সরাসরি মূল যে বিষয়টি জানতে চাই সেটি হলো -- আপনার কবিতায় সেভাবে অ্যাগ্রেসিভ কোন যৌনতার বিষয় বা সেক্সুয়াল শব্দের সেভাবে কোন প্রদর্শন প্রিয়তা নেই বা আপনি ওই জাতীয় শব্দ ব্যবহার করেননি। যৌনগন্ধী সিম্বলও খুব প্রগৌণ, একটি লক্ষণীয় বিষয় প্রতিষ্ঠিত অনেক কবি-সাহিত্যিকেরাই অথবা বর্তমান অনেক কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে একটা বিশেষ প্রবণতা থাকে, তাদের লেখালেখির মধ্যে যৌনতা নানারকমভাবে এসেছে, যেমন - মলয় রায়চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র বা তসলিমা নাসরিনের কথাই বলি না কেন, দেখা গেছে তারা যৌনতাকে অন্য একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন পাঠক সেগুলি গ্রহণও করেছে, কিন্তু আপনার কবিতার মধ্যে সেভাবে প্রকট যৌনতার গন্ধ প্রায় পাওয়া যায়ই না, তবে কি বলবেন - পাঠক সেভাবে আপনার কবিতায় সেক্সুয়ালিটি আবিষ্কার করতে চায়নি , না পারেনি , নাকি আপনি সত্যি সত্যি যৌনতা' বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন আপনার সৃজন ভাবনায়?
• দেখো শুভদীপ, যৌনগ্রন্থি লেখা বা যৌনতার কথা বলা আমার কবিতাতে সেভাবে নেই, এটা তুমি ঠিকই ধরেছ, সেটা খুঁজে পাওয়া যাবে না সেভাবে, তবে আমার মনে হয় আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই যৌনতাও একটি স্বাভাবিক জীবনচর্যার অঙ্গ। স্বাভাবিক জীবনবোধ থেকেই উঠে আসে মিলনের ইচ্ছা। প্রকৃতিতে তুমি যদি চারপাশে দেখো তাহলে দেখবে ওইভাবেই কিন্তু ফুল থেকে ফল হয়, মধু জমে। সেটা শুধুমাত্র যে মানুষের মধ্যে হতে হবে তাতো নয়, প্রকৃতির যেকোনো লিভিং অবজেক্টের এটা বোধহয় একটা বেসিক ইন্সটিংক্ট যে, পরবর্তী পুরুষে নিজেকে জাহির করে যাওয়া । যতই আমরা জানিনা কেন মানুষ মরণশীল। সকল প্রাণী একসময় মারা যাবে তা সত্ত্বেও অপত্য যোনিতে নিজের গুণাবলিকে প্রতিস্থাপন করে যাওয়া বোধহয় আমাদের পৃথিবীর ধর্ম। এভাবেই সভ্যতা এগিয়েছে, প্রাণ এগিয়েছে। সে কারণেই এটা আলাদা করে লেখার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়নি। কারণ এটা আমাদের বেঁচে থাকার মতই একটি স্বাভাবিক জিনিস।
∆ একটা ব্যাপার দাদা, আপনার লেখা পড়তে গেলে বেরিয়ে আসে প্রতিরক্ষার কথাও, যেমন - (মিছরির ছুরিতে আমিও শান দিতে শিখে গেছি / শিখে গেছি ডিলিট বাটনটাতে চাপ দিতে.../) সহজভাবে নিজেকে প্রকাশ করলে ব্যক্তির অস্তিত্বহানি ঘটতে পারে সেরকম কিছু থেকেই কি এমন বার্তা দেওয়া বা ফিরে দাঁড়ানোর - ঘুরে দাঁড়ানোর এই কথাগুলো এসেছে, কি বলবেন এই বিষয়ে শুভঙ্কর দা, এরকম কি কোন কিছু আপনার ব্যক্তিক জীবনে ঘটেছে?
• ঠিক এরকমটি নয়, ব্যক্তি জীবনে ঘটতেই হবে এবং সেটি লেখার মধ্যে আসতেই হবে এরকম কোন বাধ্যতামূলক বিষয় অন্তত সৃজন জগতে নির্দিষ্ট করা নেই ! ব্যক্তিমানুষ সমাজেরই একজন, ফলে সমাজ থেকে যদি তুমি চারপাশে একটু খেয়াল করে দেখো, এখানে মানুষের সারল্যকে বোকামি ভাবা হয়, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সরল বা সহজ কিন্তু তাকে আমরা বলি বোকা, এটা খুব ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে । ফলে বোকামি আর সারল্য এক জিনিস নয়। ফলত এইযে সহজ-সরল বোধে যে মানুষগুলো জীবন অতিবাহিত করেন , আসলে সহজ চলনের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে চায়, স্বাভাবিক আবেগ অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে চায়, আরো পাঁচজনকে নিয়ে একটু বেঁধে বেঁধে থাকতে চায়। আমাদের সমাজ ইদানিং এভাবে আর দেখতে চাইছে না ! বা সমষ্টিগতভাবে একসঙ্গে বাঁচবার আকাঙ্ক্ষাটা ফিকে হয়ে আসছে দিনদিন। প্রসঙ্গত বলতে হয় - লিটল ম্যাগাজিনের গ্রুপ হোক বা একটা নাটকের দল হোক সেখানে পাঁচজনকে বেঁধে বেঁধে থাকার যে বিষয়টা সেটাও ইদানিং কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে। আর সমাজও বাঁকা চোখে দেখছে। সেখানে কেউ না কেউ মতলব সন্ধান করছে। অর্থাৎ আমাদের সমাজ এখন চায় বিচ্ছিন্নতা, ভাবনা হয়, একতায় তাদের বিশ্বাস কমে আসছে! আমরা ইউনিটি ইন ডাইভারসিটির কথা বলি কিন্তু আসলে আমাদের বর্তমান সমাজ এবং শাসক চায় যত মানুষ বিচ্ছিন্ন হবে যত ডিভাইডেড হবে তাদেরকে শাসন করাটা অনেক সহজ হবে। ফলে সেই সহজ সরল মানুষগুলোর কাছে মনে হয় মিশ্রির ছুরির মতো একটা মুখোশ পরে থাকার প্রবণতা আর সেজন্যই ডিলিট বাটনটার প্রয়োজন এসেই যাচ্ছে। সেই কারণেই হয়তো কোন কবিতার মধ্যে এরকম লাইনগুলো এসেছে।
∆ আপনার কবিতার মধ্যে সরাসরি রাজনৈতিক বিষয়টিও সেভাবে নেই অথচ আপনি মানুষের কথা বলেছেন, গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, প্রতিবাদের ভাষা এঁকেছেন, আরেকটি বিশেষ উদাহরণ আমার সামনে এসে রয়েছে -- ( নিভু নিভু আলোয় গলায় জড়ানো দড়িকে / সাপ ভেবে ত্রস্তপাবলিক সরে যায় ঈশান কোণে / পড়ে থাকে মেলারমাঠ, শিবেন আর গাজন সন্ন্যাসী / ফাঁকা মাঠে হাঁক পাড়ে ভোলেবাবা পার করেগা / ঝাঁপ দেয় দেনাদায়ী চাষি অনন্ত কুয়োর জলে ) এখানে কোন জায়গায় কি আপনি শ্রেণি শোষণের ইঙ্গিত দিয়েছেন দাদা, মার্কস যেখানে শ্রেণির উদবর্তনের কথা বলতে গিয়ে সোচ্চার হওয়ার কথা প্রকাশ করেছেন, সেরকম বার্তাই কি প্রকাশ করতে চেয়েছেন? এখানে কি আপনার কোন আদর্শগতপন্থা যেটা আপনাকে বিশেষভাবে জারিত করে বা আপনাকে উৎসাহ যোগায়, এই বিষয়টি উত্থাপন করতে গিয়ে আপনার এই ধরনের বাক্য প্রয়োগ কি সেদিকেই ইঙ্গিত বহন করছে?
• দেখো, কবিতাতে তো কোন মিথ্যে কথা বলা যায় না ! আমি অন্তত এটা বিশ্বাস করি ! মানে যেটা আমি দেখি সেই ধরনের ভাবনা থেকেই তো আমার শব্দের প্রয়োগ, ফলে আমার গ্রাম্য জীবন, আমার মফঃস্বল, আমার চাষি ভাই, তারা কখনো ঋণ নেয়, সরকারি কোন ব্যবস্থাপনার কাছে দ্বারস্থ হয়, তারপরেও সে মূল্য পায় না ফসলের, সে পুরুৎ ঠাকুরের কাছে যায়, গাছের ডালে সুতো বাঁধে, মানত করে ভালো ফসলের আশায় । সে বাড়িতে চেষ্টা করে একটু নবান্ন করবার, চেষ্টা করে নতুন ধান উঠলে একটু পিঠেপুলির আয়োজন করার। এই সকল কিছুই কিন্তু তার ছোট ছোট চাওয়া। সে কিন্তু বড় বাড়ি-গাড়ি চায় এরকম কিছু নয়, স্বেচ্ছায় সেই চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার মতোই 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে' ভাবনার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে চায়। সেটাও যখন তার ফুলফিল হয়না, যখন সেগুলোর কিছুই পরিপূর্ণ করতে পারে না, তখনই সারা ভারতবর্ষের দিকে তাকালে কিন্তু আমরা সেই দৃশ্য দেখতে পাবো যে, প্রতিনিয়ত চাষিরা আত্মহত্যা করছেন। সরকারি নানান রকম প্রচার আছে, নানান রকম প্রতিশ্রুতি আছে, তা সত্ত্বেও এটা কিন্তু বাস্তব, এটা মেনে নিতেই হবে। তাইতো দেনার দায়ে দীর্ণ কৃষক পুকুরের জলে ডুবে আত্মহত্যা করে অথবা তার জমির পাশেই কোন গাছে নিতে পারে গলায় ফাঁস ।
∆ আপনার লেখালেখির মধ্যে বিশেষ কিছু জায়গায় আপনি এক শ্রেণির কবিদের স্ববিরোধী একটি জায়গায় উপস্থাপন করেছেন, বিশেষ করে যেমনভাবে জানি কবিদের, যারা অক্ষরচর্চা করেন, আপনার কথায় যেটা জানতে পারলাম যে কবিতায় মিথ্যে বলা যায়না, তবে কবিরাও পোশাক পাল্টে নিয়ে চলে, যে কথাটা আপনি লিখেছেন এবং নিজের দিকে ফেরা যাক বলে একটা কথা উপস্থাপন করছেন—
• যাদের কবি হিসেবে জামা পাল্টাতে দেখি, সেটা ক্ষমতার কাছে বিকিয়ে যাওয়া হোক বা রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে বিকিয়ে যাওয়া হোক, এসমস্ত যখন দেখি-শুনি তখন আর তাদেরকে ঠিক কবি ভাবতে দ্বিধা হয়ে ওঠে। যেটা আমি পূর্বের পয়েন্টে স্ট্যান্ড করে যাচ্ছি। কবিতার কাছে সৎ থাকতে হয় নিজের কাছে সৎ থাকতে হয়। না হলে তিনি আমাদের কাছে ভালো কোন কবিতা উপহার দিতে পারবেন না। পারবেনই না চিরন্তন সৃজনে ডুবতে।
∆ কখনো একান্ত হলে কি নিজেকে একাকী মনে হয় শুভঙ্কর দা, ভিড়ের মধ্যেও ভীষণ রকম একা লাগে কি কখনো দাদা? নাকি সঙ্গ সফল করার যোগ্য সঙ্গী খুঁজে পেলেন না!
• একাকীত্বের কথা যদি বলো তাহলে বলবো - না ! দেখো একা কখনো সেভাবে মনে হয় না, হয়নি। এই অর্থে কোনো আলাদা সঙ্গ নির্মাণেও সেরকম ব্যতিব্যস্ত হতে হয়নি।
∆ দাদা আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে , ব্যক্তি শুভঙ্কর সাহা এবং কবি শুভঙ্কর সাহা এই দুই সত্ত্বার ভেতর কখনো কি দ্বন্দ্ব আসে, নিজেকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে কি কোন প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন কখনো?
• আমি বরাবরই নিজের নাম বড় তালিকায় উঠবে কোথাও, নিজের নাম প্রকাশিত হবে বিশেষ পত্র-পত্রিকায় বা নিজের নাম ঘোষণা হবে মঞ্চে-কবিসম্মেলনে এই ধরনের বিষয় থেকে নিজেকে দূরেই রাখি। সে অর্থে দ্বন্দ্বের কথা এভাবে কখনও ভাবিনি' । এটা কখনোই আমার সেভাবে মনে হয়নি কোন ক্ষেত্রে কিছুর পেছনে তীব্র ছুটে চলতে হবে। ঠিক আমার পছন্দের বিষয় নয় ওটি। ওটাকে লক্ষ্য রেখে কিছু করতে হবে সেরকম কখনোই আমার ভেতরে কোনো ভাবনা জাগ্রত হয়নি।
∆ আমি আরো একবার আপনাকে উদ্দিষ্ট করছি অগ্রজ, কবি শুভঙ্কর সাহা নিজেকে কখনো কি নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে ভেবেছেন তিনি ভাববাদী / বস্তুবাদী নাকি অন্যকিছু... এ বিষয়ে কিছু বলুন--
• আমি সেভাবে কোন ক্যাটাগরিতে বিশ্বাস করিনা। আমি সেভাবে নিজেকে কোনো কিছুর মধ্যে নির্দিষ্টভাবে কেন্দ্রীভূত করতেও চাইছি না। তার কারণ কবি শুভঙ্কর সাহার সামনে যখন ব্যক্তি শুভঙ্কর সাহা দাঁড়ায় তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ওটা আয়নাতে নিজের প্রতিফলন দেখার মতোই। তাই এটাকে যে কোন্ ক্যাটাগরিতে ফেলবে সেটা সময় বা তোমরাই বলতে পারবে।
∆ বিশেষ কোনো প্রত্যাশা থেকে গেল কি অগ্রজ?
সে অর্থে বলতে হয় ব্যক্তি শুভঙ্কর কবি শুভঙ্করকে কখনো প্রশ্ন করেনি যে কেন তোমার ঐ লেখাটা অমুক পত্রিকায় ছাপা হয়নি ! কেন তুমি ওই পুরস্কারটি পাওনি! কেন তোমার দশটি বই হলো না ! এরকম কোন প্রশ্ন কখনো আসেনি। সেটা সময়ই বলে দেয়, যোগ্যতম নির্ণায়ক ঠিক করে সময়কাল।
∆ তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে আপনাকে নিয়ে কেন আলোচনা হচ্ছে না আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে না বা কেন আপনাকে নিয়ে লোকে ভাবছে না এরকম কোন বিষয় আপনাকে বিশেষভাবে নাড়া দেয় না, বা সেটি নিয়ে আপনার বিশেষ কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই?
• ঠিক তাই । সে বিষয়ে আমার কোন অভিমান বা অভিযোগ বা আবদার কোন কিছুই আমি রাখিনি।
∆ তারপরও জানতে চাওয়া শুভঙ্কর দা , এই যে একটা জীবনের বড় যাপিত সময় কাটিয়ে এলেন লেখালেখির জন্য, সাহিত্য চর্চার জন্য, সেখানে কোন আক্ষেপ অথবা কোন চাওয়া কখনো কি একান্ত একটুখানি হলেও কি আশার সঞ্চার করে নি? আশা থাকাটা কি স্বাভাবিক নয়! এই বিষয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাইছি --
• দেখো শুভদীপ, পাঠক প্রিয়তাকেই তো লেখার স্বীকৃতি বলা যায়। পাঠকই অনেকাংশে লেখকের মধ্যে পরবর্তী সৃজন ভাবনার বীজ বপনে সহায়ক আশা সঞ্চার করে। আমার ধারণা যারা লেখালেখি করেন তারা হয়তো নিজেরাও এটা ভাবেন , ভালো লেখা কিন্তু খুব কম ব্যক্তিই লিখতে পারেন, আর সমগ্র লেখক জীবনে প্রচুর পরিমাণে ভালো লেখা , এটা কিন্তু হয়ে ওঠে না। হয়তো সেই একটা বা দুটো বা তিনটে বিশেষ লেখা থাকে বাকিটা সারা জীবন ধরে আবিষ্কার করে যেতে হয়, বিশেষ লেখা হয়তো পাঠক পড়েন, পাঠক ভালোবাসেন, পাঠক মথিত হন এবং পরবর্তীতে ধারাবাহিক যে লেখালেখিগুলো থাকে সেগুলো হচ্ছে অনুসারী লেখা, সেই নামটাই পেছনে ছুটতে ছুটতে আরেকটি হয়তো লেখার জন্ম দিতে পারে, কিন্তু সেটা আর পূর্বেকার মত হয়ে ওঠে না, তবু আমরা সেই লেখকের বইটা কিনি, তার লেখা খুঁজি কখনো, ভালো লাগে, বিশেষ পছন্দের তালিকায় তার নাম রাখি। সেভাবেই হয়তো সৃজনশীল সঙ্গীত শিল্পীর গানটা শুনি অথবা বিশেষ পরিচালকের পরিচালনায় হয়তো ছবিটা দেখি, যে শিল্প মাধ্যমই হোক না কেন । সৃজন আবিষ্কারের নেশায় এগিয়ে চলা আশা সঞ্চয় হয় সন্ধানী পাঠকের উৎসাহে, সেই পাঠই তো তাকে বড় করে তোলে। তাই আশা থাকাটাই স্বাভাবিক।
∆ কবিতা লেখার পাশাপাশি আপনার জীবনের একটা বিশেষ সৃজন মাধ্যম আছে, সেটি হচ্ছে অনুবাদ সাহিত্য, আপনি একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতাও করেন, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাহলে অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি এই ভালোলাগাটা বা বিশেষ ঝোঁকটা কীভাবে এলো, উৎসাহটা পেলেন কীভাবে দাদা?
• এই বিষয়ে আমাকে বিশেষভাবে ইন্সপায়ার করেছিলেন, আমার কলেজের প্রফেসর ডক্টর জ্যোতি ঘোষ। যখন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কলেজে পড়ছি, স্যারের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা হতো, স্যার তখন স্প্যানিশ শিখছেন, স্পানিশ থেকে ইংরেজিতে বাংলায় অনুবাদ করবার চেষ্টা করছেন, সেটা দেখে এবং শুনে আমিও ইন্সপায়ার্ড হলাম। আমিও তো এভাবে কিছু চর্চা করতে পারি ভাবলাম। তার কারণ বিশ্বসাহিত্যের নানান ভাষায় সাহিত্য সৃজন ছড়িয়ে রয়েছে। সেভাবে হয়তো আমরা বাংলায় তার স্বাদ নিতে পারি না। হাতেগোনা কয়েকজন বিশেষ সাহিত্যিক ছাড়া অনুবাদ সাহিত্যে অন্যান্যদেরকে আমরা সেভাবে পাইনা। সে কারণে আমার ছাত্র-ছাত্রী হোক, বা অন্যান্য যারা বৃহত্তর পাঠক-পাঠিকা আছেন সেই লেখাগুলোকে যদি পৌঁছে দেওয়া যায়, সে কারণেই অনুবাদের প্রতি বিশেষ ভাল লাগা তৈরি হলো। আর যেহেতু ইংরেজি আমাদের কমন ল্যাঙ্গুয়েজ । তাই মনে হল যে সেই সম্ভারগুলো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছেও পৌঁছে দেওয়া যায়। কলেজে - ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সুবাদে আমাকে ইংরেজি সাহিত্যটা পড়তে হয়েছে, এবং নিজের ভাললাগার জায়গা থেকেই আমি সেটা পড়েছি এবং পরবর্তীতে আমার কর্মক্ষেত্রে। বিভিন্ন দেশের লেখা ও লেখকদের খুঁজে পড়ে সেই লেখাগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। গল্প বা কবিতা হোক অনুবাদের মাধ্যমে সেগুলো একটা যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছি। যদি দশজনও পড়তে পারে, সেই স্বাদ গ্রহণ করতে পারে তার জন্য এই চেষ্টা করে চলেছি।একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে আমাদের কলকাতাতেই প্রচুর নাটকের দল আছে যারা বিদেশি সাহিত্যনির্ভর নাটক করে থাকেন। সাংস্কৃতিক আন্তর্জাতিক যে বিনিময়টা তা অনুবাদের মাধ্যমেও কিন্তু একটা বিশেষ জায়গা নিতে পারে বলে আমার বিশ্বাস এবং এটি চর্চা করলে কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে ভাবনার আদান-প্রদান বৃদ্ধি পাবে এবং সাবলীল হতে পারে। ঠিক একই রকমভাবে শুধু ইংরেজি থেকে বাংলায় নয় বা অন্যভাষা থেকে বাংলায় অথবা বাংলা থেকে লেখাগুলো যাতে অনুবাদ হতে পারে অন্যান্য ভাষায় এবং পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে বা পৌঁছাতে পারে সেই চেষ্টাটাও কিন্তু রাখা দরকার। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আরও বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা নেওয়া যেতেই পারে।
∆ এবার আসি আপনার লেখালেখির অন্তর আবহ নিয়ে কিছু কথায়, (শীতের সিন্দ্রাণী সিমলা হবে কিনা জানিনা,/ আমার হাড়ে একটু রোদ্দুরের ভীষণ প্রয়োজন / খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে এলিয়ে পড়েছি / সকালের রোদ একই সাথে মিষ্টি আর বিচ্ছু / খালি সরে সরে যায় ...) আপনার কবিতার মধ্যে একটা বিনয় ইঙ্গিত বহন করে, অর্থাৎ প্রখ্যাত কবি বিনয় মজুমদারের কিছু লেখার মতো, তিনি যেমন তার কবিতার ডায়রিতে লিখেছিলেন, সেই কন্টেক্সচুয়াল টিউন আপনার কবিতার মধ্যে কি সতর্কভাবে এসেছে! কবি বিনয় মজুমদার কি আপনাকে আলাদারকমভাবে প্রভাবিত করেছে কখনো, নাকি আপনার লেখার ঘরানাটি এরকমই ? বিষয়টা যদি একটু খোলসা করেন --
• হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছ, আমার লেখার ধরনটি এরকমই। ওটাই আমার চলন। সচেতনভাবে কখনো ভাবিনি বিনয় আবহ। সেইভাবে বিনয় মজুমদারকে ছায়া করে আমি কিছু লিখব বা লিখেছি, মনে হয়নি। আবার আমি বিশেষভাবে বিনয় মজুমদার দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড রয়েছি এটাও কিন্তু নয়। এই ধরো পরশু দিন হয়তো আমার একটু লিখতে ইচ্ছে করল, তখন আমি ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঝুল ঝাড়ছি, আবার মাকড়সা ঝুল করছে, তারপর রাতের বেলা আমার মাথায় কয়টা লাইন ঘোরাফেরা করছিল সেগুলোকে খাতায় বন্দি করলাম -- (আমার বাসাতে আমরা দুজন থাকি আমি আর মাকড়সা / আমি তাকে দেখি , তার দ্রুত চলন তার শিকার, তার মৈথুন ,সবকিছু / আমি দেখি সেও নিশ্চয়ই আমাকে ঠিক একই রকমভাবে খেয়াল করে ) এই তো একদম আটপৌরে ঘরের কথা, কিন্তু এটুকু হয়তো গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়ে ওঠে না কিন্তু এটাও কবিতার অংশ হয়ে উঠল।
∆ (আমি তো আসলে বেদনাকে বন্ধক রাখতে এসেছিলাম / অবহেলার বর্ণমালা -- / তুমি জল দিলে, বাতাস দিলে, কোচর ভর্তি ফুল / কান্না জলের আধার দিলে, দিলে শরতের মাটি / মুগ্ধ বিস্ময়েকে পাশে নিয়ে পা ফেললাম নদীর ওপারে…) এই অবহেলার বর্ণমালা বলতে আপনি যে অনুভূতিগুলোকে ছুঁয়ে যেতে চান, ছুঁয়ে যেতে চান বাংলা ভাষা ২১ এবং ১৯ অথবা কাঁটাতার, এগুলোর ভিতর দিয়ে আপনার নিজস্ব যে জারিত জীবন সেখানে বর্ণমালার গুরুত্ব কতখানি , আপনার দৃষ্টিকোণ যদি জানান..
• হ্যাঁ, বৃহত্তর অর্থে আমার এই যে ভালোলাগা বর্ণমালা এবং বাংলা ভাষা সে তো অবশ্যই বিপদের মুখে আছেই , ভাষা আগ্রাসন বলে একটি কথা আছে, দীর্ঘদিন ধরেই পৃথিবীতে বড় ভাষিক অর্থাৎ সংখ্যায় যারা বড় তারা কিন্তু ছোট ছোট ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে গিলে খাচ্ছে । প্রতিনিয়ত ছোট ছোট ভাষাগুলো পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমার প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাও একটা সংকটের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সেই কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারি, সেই কারণেই উনিশে মে। এই বোধ বিশেষ জোরের সঙ্গেই বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা রাখি। জারিত করতে চাইছি অক্ষর অনুরণন। ভালোবাসবার জায়গা থেকে, দাবির জায়গা থেকে, অস্তিত্বের জায়গা থেকে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। আমরা ভারতীয় হিসাবে যে বৃহত্তর সংবিধানের অঙ্গীভূত সেখানেও কিন্তু বিশেষ কিছু ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বাংলা ভাষাকে কোন দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আছে, আমাদের দেশেরও নির্দিষ্ট রাষ্ট্রভাষা না থাকলেও সরকারি কাজে ব্যবহার উপযোগী ভাষা রয়েছে, আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে, সেখানে বাংলা ভাষার প্রতি অনেক রকম চাপ এসেছে পূর্বেও, এটা অস্বীকার করা যায় না, সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ভারতবর্ষে হিন্দিভাষীর সংখ্যা যতটা বেশি এবং সরকারি স্কীম আছে প্রমোশনাল হিন্দি ল্যাঙ্গুয়েজ সেটিও কিন্তু খানিকটা সেই ভাষা আগ্রাসনের একটি রূপকেই কিন্তু উপস্থাপন করে তারা। কিন্তু বাংলাকে ওইভাবে প্রমোট করবার জন্য কোন কিছু কিন্তু আমার সেভাবে নজরে আসেনি। সাঁওতালি তেলেগু ভাষাতেও কিন্তু প্রমাণ করবার চেষ্টা করা হয়েছে বা হচ্ছে।আবার দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকেই ছোট ছোট ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের প্রমাণের অভাবে তারাও কিন্তু আস্তে আস্তে অতলে ডুবে যাচ্ছে! নিজস্ব ভাষা সংকট তৈরি হচ্ছে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামনে সেদিন আসছে।
∆ আচ্ছা দাদা, আপনি প্রান্তিক কবি হিসেবে নিজেকে বলেছেন ইছামতির প্রভাব রয়েছে আপনার জীবনে, বিশেষ করে আপনি যে অঞ্চলে বেঁচে বেড়ে উঠেছেন, এই প্রান্তিক শব্দটির কাছে এসে আমার একটি প্রশ্ন জাগছে যে প্রান্তিক শব্দ দিয়ে কি কোন সৃজনশীল মানুষকে আটকে রাখা যায়?
• প্রান্তিক কবি নয়, প্রান্তিক জনপদ হতে পারে, তবে অঞ্চলভিত্তিক আমাদের বঙ্গে কবিদের শহুরে, মফস্বলের কবি বা অন্যান্য ভাবে দেখানোর একটা তীব্র চেষ্টা করা তো হচ্ছেই! এটা দুঃখজনক। তবে তাতে অনাবিষ্কৃত থেকে যান অনেকেই। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বঙ্গ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতাতে এই বিষয়টি অত্যধিক। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। একটি বিশেষ উদাহরণ তোমাকে বলতে পারি সেটা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে যাই একুশে ফেব্রুয়ারিতে তখন দেখতে পেলাম যে ঢাকা শহিদ মিনার অর্থাৎ যেখানে শহিদ দিবস পালিত হয়, তার নিকটবর্তী শহর বলা যেতে পারে নারায়ণগঞ্জকে, সেখান থেকেও প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়, অথচ কলকাতার এত কাছে বারাসাত, বারাকপুর, বা সোনারপুর এই সমস্ত জায়গা থেকে তো সেভাবে কোনো দৈনিক পত্রপত্রিকা বের করে না বা বের করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি এখনও। আমি এই কথা দিয়ে বোঝাতে চাইছি যে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীর যে সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চার যে আগ্রাসন । এদিক দিয়ে বলতে গেলে কলকাতামুখী পত্রিকায় যদি লেখা না ছাপা হয় তাহলে যেন ওই কবি-সাহিত্যিক তারা জাতে উঠতে পারছেন না বলে তাদেরকে প্রান্তিক বলে ঘোষণা করার একটা তীব্র চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশ যেভাবে সাহিত্যের বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করছে বা করে চলেছে সেটাও কিন্তু দেখার বিষয়।
∆ আচ্ছা শুভঙ্কর দা প্রতিষ্ঠানের কি প্রয়োজনীয়তা আছে? সৃজন চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান অন্তরায়, নাকি সেটি সুহৃদ ? আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি জানতে চাই।
• দেখো শুভদীপ, প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমার ভাবনা। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও দরকার আছে। একজন লেখক নিজেকে তুলে ধরবার জায়গা হিসাবে প্রতিষ্ঠান বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে । কবিরা তো কেউ নিজেকে নিয়ে জনে জনে তো আর বলতে পারেনা যে তার লেখাটা পড়া হোক, তার গানটা শোনা হোক, তাই বিশেষ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে। সেই দায়িত্বটা একটা প্রতিষ্ঠান নিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশিত কবিতা হোক বা শিল্পচর্চা হোক সমস্ত কিছুই কিন্তু খুব সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। ফলে প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করবার মতো ইচ্ছে আমার নেই, থাকাটাও কিন্তু বাস্তবসম্মত নয়। আবার প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকেও একা একজন লেখক নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছেন এরকম উদাহরণও খুব কম। তাদের মধ্যে যেমন আমি যদি বলতে পারি যিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছেন , তিনি হলেন সাহিত্যিক সুবিমল মিশ্র । তবে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হবারও বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই বলেই আমার ব্যক্তিগত ধারণা। এখানে একটা বিশেষ প্রশ্ন থেকে যায়, যদি সেই প্রতিষ্ঠানও অনিরপেক্ষ থাকে অর্থাৎ তার নিরপেক্ষতায় যদি প্রশ্ন চলে আসে , যদি পক্ষপাত দুষ্ট হয় এবং ভালো লেখাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিষ্ঠান যদি দ্বন্দ্বমূলক গোষ্ঠীতন্ত্রের শিকার হয় তাহলে সেটা সৃজন বিরোধী চিন্তার ফসল হিসাবে প্রকৃত চর্চাকে খর্ব করতে থাকে। এটিও কিন্তু সৃজনের জন্য ক্ষতিকারক একটি দিক। এখানেই হচ্ছে ক্ষমতা এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠী নির্মাণ এবং সেই গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে আরেকটা গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। এগুলি কোন রকম ভাবেই আমাদের সুস্থ সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে বিশেষ সহযোগী হয় না।
∆ দাদা আপনার প্রথম প্রকাশিত বই / কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে যদি কিছু বলেন –
• প্রথমে 'সমবায়ী কণ্ঠস্বর' নামে যৌথ কাব্যগ্রন্থ দিয়েই পথচলা শুরু। সেখানেই ছাপা হয় আরো কয়েকজনের সঙ্গে আমার কবিতাও , এ প্রসঙ্গে কবি লালমোহন বিশ্বাসের নামটি নিতেই হয় তিনিই বাল্মিকী পত্রিকার উদ্যোগে সংকলনটি প্রকাশ করেন। তারপরে আমার একটি বই প্রকাশিত হয় লহর প্রকাশনা এর উদ্যোগে অনুবাদ সাহিত্যের বই 'বিদেশি গল্প সংগ্রহ', ২০১৩ - ১৪। তারপর একটি প্রবন্ধের ছোট্ট বই প্রকাশিত হলো, একটা সময় সংবাদ প্রতিদিনে আমার বেশ কিছু পোস্ট এডিটোরিয়াল প্রকাশিত হয়েছিল এবং অন্যান্য পত্রপত্রিকায় যে গদ্যগুলি প্রকাশিত হয়েছিল সেখান থেকে নির্বাচিত গদ্যগুলি বনলতা পত্রিকার সম্পাদক তরুণ কবি সুশোভন দত্তের বিশেষ তত্ত্বাবধায়নে সীমান্ত বাংলা প্রকাশনী থেকে বই আকারে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় (এক দশকের এলোমেলো প্রবন্ধ) এবং সবশেষে আমার যে বইটি প্রকাশিত হলো ২০২০ সালের আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় তার নাম -- 'বিষণ্ন রাত্রির মিছিল' আগামী বাংলা প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন থেকে।
∆ এই যে আপনার প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ হয়ে উঠতে এতদিন সময় লেগে গেল এর নেপথ্যের বিষয়টি কী ছিল দাদা?
• কেউ কেউ যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কথা বলেনি তাতো নয়, অনেকেই উৎসাহ যুগিয়েছেন যে একটি বই করা উচিত বা একটি বই করলে করা যেতেই পারে। সেই বলার মধ্যে আমাদের শুভদীপ রায় রয়েছে, রয়েছেআমাদের বিনয় বিশ্বাস, রয়েছে আমাদের বিশ্বজিৎ কর্মকার । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেমন - দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, কবিতা আশ্রম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে , ভারত বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছে, বাল্মিকীতে প্রকাশিত হয়েছে আরো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমসাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একসময় চিন্তাভাবনা এলো যে এত পত্রিকায় তো লেখা ছাপা হলো তা এবার একত্রিত করে কিছু করা যেতে পারে।
∆ 'বিষণ্ন রাত্রির মিছিল' কাব্যগ্রন্থের শিরোনামটা এরকম হলো কেনো দাদা?
• বারাসাতের একটি ঘটনা আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল, সেটা নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। সেই সময়ের দলীল হিসাবে লেখাটি নাড়া দিয়েছিল। রাতে বারাসাতে অফিস ফেরত দিদির জন্য অপেক্ষা করছিল তার ভাই বাড়ি নিয়ে যাবে বলে, কিন্তু সে যখন প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রীজ পেরিয়ে যায় তার ভাইয়ের কাছে এবং সে যখন বারাসাতের অন্ধকার গলিগুলোর মধ্যদিয়ে পথ চলতে থাকে তখন একদল দুষ্কৃতী তাদের আক্রমণ করে, দিদির শ্লীলতাহানিরও চেষ্টা করে । ভাই তার প্রতিবাদ করে । এবং সে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারা যায়। এই ঘটনাটি আমাকে বিশেষভাবে আঘাত করে । তারপর এই বিষয়ে কবিতাটি ছাপা হয় এবং কবি বন্ধু বিভাস রায় চৌধুরীর-র সহমতে কাব্যগ্রন্থের নামকরণ রাখি ‘বিষণ্ন রাত্রির মিছিল'।
∆ (এ তল্লাটে গলা তলা বারণ -- / হাঁটতে হাঁটতে ওরা সাদা জামার হাতায় মুছে নেয় / চোখের জল, গড়িয়ে পড়া রক্ত, চুঁইয়ে নামা ঘাম / ওর অপেক্ষায় আছে -- / রাজার সাঙাতরা কখন মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যাবে! ) দাদা আপনি সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলকে বিদ্ধ করে কোনো কথা বলেননি, প্যাসিভ করেই শাসকশ্রেণির প্রতি বিশেষ বার্তা দিতে চেয়েছেন । মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যাবে এই ব্যাপারটাকে আসলে আপনি কিভাবে দেখাতে চেয়েছেন দাদা?
• হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছো! আমি সরাসরি কোন শাসককে বিদ্ধ করিনি কারণ শাসকের প্রতিমূর্তি বরাবরই একই রকম। ফলে রাজনৈতিক হিংসার বলি যারা হয়, রাষ্ট্রীয় শাসনের শিকার যারা হয়, রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় তাদের পাশে আবার সেই রাজনৈতিক নেতাদের কুম্ভীরাশ্রু বর্ষিত হয়, তারাও তখন এসে এদের পাশে দাঁড়াতে চায়, এসে স্বীকার করে না তার নিজস্ব ভুল, যার মধ্যে রয়েছে ঘূণ ধরে যাওয়া মেকি প্রর্দশন । তাই তো তারাও মোমবাতি জ্বালিয়ে দিতে চায়, সে কারণেই এরকম লাইনগুলো এসেছে ।
∆ দাদা, এই যে একজীবন লিখলেন এবং যতটা পাঠকের জন্য দিলেন এর ফলশ্রুতিতে কি পেলেন, যদি আপনার কাছে সরাসরি জানতে চাই আপনি কি বলবেন শুভঙ্কর দা!?
• মেটেরিয়ালিস্টিক পাওয়া বলতে তো অনেক কিছুই হয়, কেউ একটা ফুল দিতে পারে, মেডেল দিতে পারে, কেউ এক কাপ চা দিতে পারে আবার কেউ দেখা হলে বলতে পারে -- তোমার কবিতাটা পড়লাম ভালো লেগেছে ! অনেক রকম হয় পাওয়া সেঅর্থে, এমনিতেই আমার কোন বিশেষ আকাঙ্ক্ষা নেই ,তাই না পাওয়ার বেদনা টুকুও নেই । লেখার জন্য কোন ব্যক্তিগত দুঃখকে লালন করে নিয়ে যেতে হবে বা কিছু চাইতে হবে সেরকম কিছুও আমি ভাবি না ।
∆ প্রিয় কবি অশেষ ভালোলাগা এবং শুভকামনা রইল আপনার প্রতি, আপনার মূল্যবান সময় এবং গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেওয়ার জন্য নন্দিত হোলো এই মুহূর্ত!
• তোমাকেও শুভেচ্ছা রইলো। মঙ্গল প্রার্থনা করি সকলের।
প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার মতামত তাঁদের ব্যক্তিগত। পত্রিকা এ বিষয়ে দায়বদ্ধ নয়।
নির্মাণ ও বিনির্মাণের এক অপূর্ব অনুভবের কবিতা
কবি ও গদ্যকার সৌরভ বর্ধনের কবিতার স্নায়ুতন্ত্র হল নির্মাণ ও বিনির্মাণ।
এই তরুণ কবি প্রাত্যহিক জীবনের খুব সাধারণ বিষয় থেকে উপাদান সংগ্রহ করে
লিখে ফেলেন 'বাস্ততন্ত্রের ইতিহাসে'এর মত কবিতা। "শুধু ঈশ্বরের প্রতি উদ্ভিদ
হয়ে আকাঙ্ক্ষা ও উদাসীনতা্র কাছে এই বিস্ময় বরাবর" কবি অনায়াসে হেঁটে যান।
২০১৯ সালে কলকাতা বইমেলায় কবিতা পাক্ষিক থেকে প্রকাশিত হয় সৌরভ বর্ধনের
চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ "প্রসূতিকালীন পাঠ"। কবি সৌরভ মনে করে্ন , ধূম্র ও
মদ্যপান না করেও অনায়াসে কবিতা লেখা যায়, আবার ফুলে ফুলে প্রফুল্ল সরষে
খেতে দাঁড়িয়ে খাবি খাওয়া বাতাসকে তিড়িং পাখির মত চোখ মারা যায়। কবিতার
প্রচলিত পথ থেকে সরে এসে ভিন্ন পথের সন্ধান করেন যে সব কবি, সৌরভ বর্ধনের
কবিতায় তারই বনজ ঘ্রাণ আমরা পাই। "প্রসূতিকালীন পাঠ "এই কাব্যেগ্রন্থের
কবিতাগুলি ছয়টি শিরোনামে সন্নিবেশিত এবং তাদের নামকরণ- বাস্ততন্ত্রের
ইতিহাস, শুভরাগ ও বীর্যকথা,দ্বন্দ্বমূলক ছায়াবলোকন, স্ববিরোধ ও অপাবৃণু
দিন,প্রসূতিকালীন পাঠ,হাড়মণি ও তঞ্চক লিপি কবিতার পাঠককে আকৃষ্ট করে ।
"মাটি ধরে নিলো আমি হাঁটছি/আমি ধরে নিলাম মাটি- এই ধরে থাকা চিরন্তন " বলেই
কবি হাত ছেড়ে দেন । অনুভব করে্ন, "আমার ভিতর আছড়ে পড়ল কেউ"।মাটিতে হাত
দিয়ে তিনি ছুঁয়ে দেখেন "বাস্ততন্ত্রের ইতিহাস"। "ফুল যখন ফোটে/আমি তার
কেন্দ্রের দিকে চেয়ে থাকি" ফুলের কথা শোনার জন্য কবির রাত কেটে যায় আর তিনি
অনুভব করেন এক অদ্ভুত "আমি থেকে আমার প্রসব।" কোনো কোনো নেতিবাচক সঙ্কেত
কালের প্রবাহে বদলে গেছে ,সেকথা লিখে ফেলে্ন এই তরুণ কবি। যেমন " ...বুড়ো
আঙুল দেখাই,অথচ/ সবাই খুশি, ভালোবাসে/ বিনিময় বিনিময়ে কাছে আসে।" সৌরভ
বর্ধনের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় ভাবনার বহুমুখী উৎস ও শব্দের বহুরৈখিক
বিস্তার। আবার অনেক সময় সামঞ্জস্যবিহীন এক শূন্যবাদী অস্তিত্বের সংলাপ বলে
মনে হয় তাঁর লেখা ..." এভাবে সূর্য ডুবে গেলে আর কিছু বলার নেই আমার
"...তখন আলো অন্ধকারের বৈপরীত্যে কবি নিজেকে অন্বেষণ করেন। তিনি বিশ্বাস
করেন "চুম্বক ভাসতে ভাসতে একদিন এমন সময় আসবে " "একহাতে নিউক্লিয়াস অন্য
হাতে সাইটোপ্লাজম/...সেখানেই স্বতন্ত্র একটি শ্বাস এসে পড়ে" আর তখন " অজস্র
স্বাধীন উপন্যাস লেখা হয়"। কখনো কখনো পড়ে অদ্ভুত লাগে তাঁর কবিতার বিষয়হীন
বিষয়টি। মনিটর বুকে নিয়ে ফসলের খেতে দাঁড়িয়ে কবি দেখেন "পেকে যাওয়া
ধানখেতের ওপর দিয়ে/ক্যামেরা ছুটছে...অথবা বিস্তৃত কাশবনের চুল ছুঁয়ে ড্রোন"
। আবার কখনো তিনি সান্ধ্য ভাষার বেড়াজাল ভেঙে চর্যাপদের শবরী মেয়ের
ময়ূরপুচ্ছ ও গুঞ্জাফুলের মালা র সময় সময়কাল অতিক্রম করে এক অস্থির সময়ের
মুখোমুখি হয়ে উচ্চারণ করে ফেলেন " ভেঙেচুরে ফ্যালা কাস্তের মধ্যে/উচ্চকিত
জীবাণুর স্বাস্থ্যলাভ অবশ্যম্ভাবী ..." এইভাবে সৌরভ বর্ধনের "প্রসূতিকালীন
পাঠ" এই কাব্যের কবিতার ভাব ও ভাষা পাঠকের অন্তরে অনুরণিত হয়।
কাব্যগ্রন্থ- প্রসূতিকালীন পাঠ।
প্রকাশক- কবিতা পাক্ষিক | দাম- ১০০ টাকা
লকডাউনের কবিতা
১
গেড়ু একটি বাবার নাম। গেড়ুর একটি হাত নেই। গেড়ুর ঘরে বৃদ্ধ বাবা, বৌ আছে। লকডাউনে গেড়ুর সামান্য বেতনের কাজটা নেই। খিদে কি বোঝে লকডাউন? বাড়িতে মেয়ে-ছেলে না খেয়ে তাই গেড়ু এখন রাস্তা-ধারে বড় মহুল গাছটার নীচে বসে ফুল কুড়ায়। এক ব্যাগ মহুল ফুল কোন একজনকে দিলে সে গেড়ুকে কিছু টাকা দেয়।
২.
মৈনি ক্ষেপি। একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা; নামোপড়ায় থাকে। মানসিক ভারসাম্যহীন। মাচিস বাক্সর মতো একটা ঘরে বেঁচে আছে মৈনি। ঘরভর্তি পুটুলি। মৈনি সারাদিন পুটুলি বানায়। মানুষের কাছে হাত পেতে পেট চলে।
লকডাউনে রাস্তা-ঘাটে মানুষ নেই। খিদে পেলে মৈনি কার কাছে হাত পাতবে?
উল্লাস
বৈভবের আশ্চর্য প্রতিবেদন সাজিয়ে
রাখছে কেউ আর একটা দুটো
মানুষ ঘুরছে
আর ঘুরছে
তুমি কি ছুঁয়ে ফেলতে চাইছো আকাশ?
তাহলে ভালোবাসতে পারো আমার জেঠুর ছেলেকে!
শেষ রাতে
শেষ রাতে তার ঘরে ঈশ্বর এসেছিলেন
তখন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন
তাই তাঁকে বসতে দিতে পারেনি
কিছুই দিতে পারে নি
কেন না তিনি ঈশ্বর
তাঁকে বসতে দেওয়ার মতো পবিত্র অলঙ্কার
তার;
শেষ রাতেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল
রাবার জমিয়েছি চামড়ার নীচে