Thursday, 31 December 2020

সৌমিত্র 'অপরাজিত' চট্টোপাধ্যায়, সুমিত নাগ ,গদ্য ,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


 

সৌমিত্র ‘অপরাজিত’ চট্টোপাধ্যায়

সুমিত নাগ

 

“মহান অভিনেতার অভিনয়ে শুধুমাত্র মানুষের হাসিকান্না, শোকতাপের নিপুণ প্রকাশই থাকে না, মানবজীবনের ও সমাজের পরিচয়ও ফুটে ওঠে অভিনয়শিল্পীর অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধ থেকে...”

                                                                (গদ্যসংগ্রহ ১, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)

 

 

শেষ থেকেই শুরু করা যাক। সাংস্কৃতিক জগতের এক বাঙালি আইকনের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে, তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, আমেরিকা-ফ্রান্স-ইংল্যান্ড-জাপান-ইতালির মতো দেশে—আক্ষেপের সঙ্গেই স্বীকার করতে হয়, এমন ঘটনা সাম্প্রতিক কালের বাঙালির ইতিহাসে সচরাচর দেখা যায় না। এর অর্থ এটা নয় যে, আন্তর্জাতিক মানের বাঙালি ব্যক্তিত্ব আমাদের সংস্কৃতি জগতে দীর্ঘদিন আসেননি, বা এখনও নেই;  অথচ তাঁদের সৃজন ও মননশীল কাজগুলি সারা বিশ্বে প্রচারিত হয় কতটা? হয় না, এর স্বাভাবিক কারণই হল, ভাষা-নির্ভর শিল্প-সৃষ্টি যথাযোগ্য অনুবাদের মাধ্যমে প্রকাশিত ও পরিবেশিত হয় না, বাঙালিয়ানার গণ্ডি অতিক্রম করে।  

 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখানেই ব্যতিক্রম। সেটাও স্বাভাবিক কারণেই। যে-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সারা পৃথিবী চিনবে একদিন, যাঁর কাজ আলোচিত হবে চলচ্চিত্র জগতের আন্তর্জাতিক মহলে, তিনি জন্মলগ্ন থেকেই আন্তরজাতিক— যাঁর প্রথম ছবিই সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯)।

 

এই আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পর্কে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও বলেছেন পরে। ‘দাদাসাহেব পুরস্কার’-এ সম্মানিত হবার কিছুদিন পর, জাতীয় টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় টক-শোতে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বাংলায় এমন সাফল্যের পরও মুম্বাইতে এলেন না কেন? জাতীয় স্তরে কাজ করার কোনও ইচ্ছেই কি তাঁর ছিল না, বিশেষত, আঞ্চলিক স্তরের প্রায় সমস্ত জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই যখন এই স্বপ্নলালন করেন? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জানান, বলিউডে কাজ না-করলেও, তিনি যেসব চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন সে-সময়, সবই তাঁকে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি, যা বলিউডের অনেক ঊর্ধ্বে। পরেও, তিনি অকপটে জানিয়েছিলেন একই কথা— যশলাভ করতে তিনি চিরকালই চেয়েছেন, এবং তা যথেষ্টই লাভ হয়েছিল। তাই, আর কোনও হাতছানি থাকার প্রশ্নই নেই।

 

তবে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলতে শুধুই সত্যজিৎ রায় নন। সাম্প্রতিক কালে, ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ফেলুদা, হীরক রাজার দেশে’র ‘উদয়ন পণ্ডিত’ এবং অবশ্যই, ‘অপুর সংসার’-এর ‘অপু’, একেবারে ‘মিলেনিয়াল’ প্রজন্মের কাছেও কাল্ট স্ট্যাটাস পাওয়ায়, তাঁর মৃত্যুর আগে ও পরেও, বারবার উল্লেখিত হতে দেখা গেছে এই ছবি গুলিতে তাঁর অভিনয়ের প্রসঙ্গ। সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের এমনই কিছু ছবির দৃশ্য যেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্বমহিমায় উপস্থিত। এটা ঠিক যে, সত্যজিৎ রায়ের মতো মহান পরিচালকের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক (সত্যজিৎ রায়ের মোট উনত্রিশটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির চোদ্দটিতে সৌমিত্র উপস্থিত, এবং একটি তথ্যচিত্র ‘সুকুমার রায়’তেও)  ছবিতে অভিনয় করার ফলে, সত্যজিৎ-সৌমিত্র কোল্যাব একটু বেশিই উল্লেখিত হওয়া স্বাভাবিক। সেই কারণেই, কুরোসাওয়ার তোসিরো মিফুনে, ফেলিনির মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ান্নি, বার্গম্যানের মাক্স ভন সিডো অথবা পরবর্তীতে স্করচেজির রবার্ট ডি নিরো’র মতো আইকনিক পরিচালক-অভিনেতা ডুয়োর পাশাপাশি ওই দুই বিখ্যাত বাঙালির নাম আসবেই। কিন্তু, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মানেই শুধু সত্যজিৎ-এর ছবি নয়। আরও বেশি কিছু। এমনিতেও, সত্যজিতের বাইরে মৃণাল সেনের মাত্র তিনটি ছবিতেই কাজ করেছেন সৌমিত্র—‘প্রতিনিধি’ (১৯৬৫) ও ‘আকাশকুসুম’ (১৯৬৫) এবং এর দীর্ঘকাল পরে, মহাপৃথিবী (১৯৯১)। ঋত্বিক ঘটকের কোনও ছবিতেই তিনি নেই। সত্যজিৎ রায়ে মৃত্যু ১৯৯২ সালে। অর্থাৎ, বাংলা চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ত্রয়ীর জীবদ্দশা, এবং তাঁদের কর্মজীবন শেষ হবার পরেও বহু-বহু কাজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে করেছেন—তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যাই দ্বিশতাধিক! এবং এই ছবিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না-থাকলে—যার মধ্যে বেশিরভাগই বাণিজ্যিক ধারার ছবি, যা জনপ্রিয় হওয়াই মূল সার্থকতা—তাঁর চলচ্চিত্র জীবন আদৌ এত দীর্ঘায়িত হত কিনা, সন্দেহের অবকাশ থাকে। সন্দেহ হয়, জনমানসে তাঁর পরিচিতিও ঠিক ততটাই হত কিনা।

 

কিন্তু, পথটা কি সহজ ছিল? ‘না’ বলেই মনে হয়। ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র জানিয়েছিলেন, তিনি যা করতে চেয়েছিলেন তা হল, ‘জীবন সদৃশ অভিনয়’। একই সঙ্গে এও জানিয়েছিলেন যে, এই ‘জীবন সদৃশ অভিনয়’ করতে গিয়ে উনি কিছুটা হলেও বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন তাঁর অত্যন্ত সুপুরুষ চেহারার জন্য। যা অতিক্রম করার চেষ্টাও করেছেন তিনি, দরকার মতো, মেক আপের সাহায্যে নিজেকে ডি-গ্ল্যামারাইজড করার মাধ্যমে। ব্যাপার হল, দুটোই জনপ্রিয় ধারার পরিপন্থী। প্রথমত, ‘ম্যানারিজম’, নায়কোচিত ‘ম্যানারিজম’—এদেশের বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে সফল ও কিংবদন্তী হবার জন্য আবশ্যিক ছিল, এখনও আছে এবং এটি ‘জীবন সদৃশ অভিনয়’-ধারার বিপ্রতীপে অবস্থান করে, নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। মহানায়ক উত্তম কুমার তুলনারহিত অভিনেতা হলেও, ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর অভিনয়ে ম্যানারিজিম ভালরকম ভাবেই এসেছে; সৌমিত্রের সমসাময়িক রাজ কাপুর, দেবানন্দ এই ম্যানারিজমকেই অভিনয়ের হাতিয়ার করে তুলেছিলেন; একইভাবে, দক্ষিণের রাজকুমার, এম জি আর কিংবা এন টি আর প্রমুখও। সম্ভবত, দিলীপ কুমারই, যাঁকে খোদ সত্যজিৎ ‘দি আল্টিমেট মেথড অ্যাক্টর’ অভিহিত করেছিলেন, কিছুটা মুক্ত ছিলেন এই অভিনয়-ধারা থেকে। কিন্তু, সম্পূর্ণ ম্যানারিজম-বিহীন হয়েও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কীভাবে সফল হলেন? বিশেষত, এমন একজন যিনি নিজেকে চরিত্রের প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে গিয়ে নিজের সৌন্দর্য মুছে ফেলতেও দ্বিধা করেন না?     

 

একটা কারণ, অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পূর্বোল্লেখিত ত্রয়ী’র চলচ্চিত্র ধারার বাইরেও যে-সমস্ত দুর্দান্ত কাজ করেছেন, তাতেও যথেষ্ট উঁচুমানের পরিচালক ও চিত্রনাট্য তিনি পেয়েছেন। তপন সিংহ, যাঁকে অনায়াসে ওই ত্রয়ীর পাশে চতুর্থ সিংহাসনটি দেওয়া যায়, দেওয়া উচিত—দেয় না উন্নাসিক বোদ্ধারাই হয়ত—তাঁর ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় অত্যুচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করেছে বলাই যায়। ‘ঝিন্দের বন্দী’ (১৯৬১) তপন সিংহের সঙ্গে সৌমিত্র’র দ্বিতীয় ভেঞ্চার, খোদ মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে অতীব সুদর্শন ‘ভিলেন’ রূপে একটি মাইলস্টোন। মনে পড়ে, ঘোড়ার পিঠে ‘ময়ূরবাহন’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখে উত্তম কুমারের চরিত্রটি স্বগতোক্তি করে, চেহারা দেখে মনে হয় সত্যিই ময়ূরবাহন! বলাই বাহুল্য, এই ছবিতে সৌমিত্রের গ্ল্যামার বিশেষ ভাবেই সাহায্য করেছিল তাঁকে, এবং একটু সাহস করেই বলা যায়, খোদ উত্তম কুমারকেও ম্লান করে দিয়েছিলেন ‘ভিলেন’রূপী সৌমিত্র। অনেক পরে, ‘আতঙ্ক’-এর মতো দুর্দান্ত সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তখন মধ্য বয়সে, নিজেকে সম্পূর্ণ ডি-গ্ল্যামারাইজড করে ফেলবেন—এতটাই রেঞ্জ!

 

তপন সিংহ বাদে অসিত সেন, অজয় কর, তরুণ মজুমদার—বাংলা চলচ্চিত্রের ‘স্বর্ণযুগ’-এর শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের সঙ্গে বহু ছবিতে কাজ করে গেছেন সৌমিত্র; এবং বারবার স্বীকার করেছেন, এঁদের মতো দক্ষ পরিচালক ছিল বলেই অমন উঁচু মানের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, একের পর এক। এঁদের এবং আরও অনেক যোগ্য পরিচালকের ছবি, যেমন, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘পরিণীতা’, ‘গণদেবতা’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘মণিহার’, ‘জোড়া দিঘির চৌধুরী পরিবার’, ‘বাঘিনী’, ‘বাক্স বদল’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কোনি’ ইত্যাদি তাঁকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় করে তুলেছে।

 

তবে, এখানেই শেষ নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আরও একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, প্রথম জীবনে, তাঁর নিজের ছবিরই একটি শুটিং দৃশ্য দেখে তিনি হেসে ফেলেছিলেন। এবং যে-কোনও ভাবেই হোক, দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী হয়ে, সিনেমার ফাইনাল-কাটেও থেকে যায় (বোঝায় যাচ্ছে, কেমন এডিটিং)! এই দৃশ্যটি সত্যজিৎ রায়ের নজরে আসে, এবং উনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করেন, তিনি এভাবে হাসছিলেন কেন? সৌমিত্র জানান, দৃশ্যটি এতই অস্বাভাবিক যে, হাসি পেয়েচ গিয়েছিল—ওরকমও আবার হয় নাকি! উত্তরে সত্যজিৎ বলেন, সে যাই হোক, যে-সিনেমার যে-দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে, সেটি বাস্তব ধরেই করা উচিত—নাহলে, ভাল অভিনয় হবে কী করে? অবশ্যই, একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, যা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শিখে নিয়েছিলেন বলেই তিনি জানিয়েছিলেন।

 

এবং এটিই সম্ভবত তিনি, সজ্ঞানে বা অবচেতনে, প্রয়োগ করবেন তাঁর বহু অভিনয়ে। নাহলে, যে-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকৃত অর্থে শিল্প ও সংস্কৃতি-মনস্ক ও রুচিশীল বাঙালি, যিনি নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দকে, নিজেও কবি ও সামগ্রিক বিচারে দক্ষ সাহিত্যিক—তাঁর পক্ষে কি সহজে সম্ভব হত একেবারে ‘কমার্শিয়াল’ বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করা? জীবিকার প্রশ্নে তিনি কাজগুলি করেছেন, যুক্তিটা ভুল নয়; কিন্তু, শুধুই কি তাই? তার মধ্যেও যতটুকু অভিনয়ের সুযোগ ছিল, স্টিরিওটাইপ অস্বীকার করে বা না-করে সফল ভাবে করেছেন—এটাও বড় কথা। ‘প্রতিশোধ’ থেকে ‘আগুন’ কিংবা অঞ্জন চৌধুরীর ‘বউ-সিরিজ’-এও অভিনয় করার জায়গা থাকলে, ভুলচুক করতে করতে দেখা যায়নি।   

 

একটা কথা অবশ্য না-বললেই, নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিন্তু প্রবল অভিযোগ ছিল সিরিয়াল বিষয়ে। চূড়ান্ত কমার্শিয়াল ও জঘন্য বাংলা ছায়াছবিও সিরিয়ালের থেকে ভাল—এটা সরাসরিই বলেছেন, বাংলাদেশের একটি সাক্ষাৎকারে (তাতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আরেক বাঙালি আইকন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়)। সেই কারণেই নিশ্চয় সিরিয়াল অভিনয় থেকে সচেতন দূরের থাকার প্রয়াস তিনি নিয়েছিলেন। হতে পারে, চূড়ান্ত কমার্শিয়াল বাংলা ছবিতেও অভিনয়ের যে-টুকু সুযোগ তিনি পেতেন, মোটা দাগের, স্থুল রুচির, মেকআপ চর্চিত বাংলা সিরিয়ালগুলিতে তিনি সেটুকুও পাবেন না বলেই।

 

মার্লন ব্র্যান্ডো, তর্কাতীত ভাবে, হলিউডের সর্বকালের অন্যতম সেরা, জনপ্রিয় ও বিতর্কিত নায়ক ও অভিনেতা। অথচ পাঁচের শুরুতে টেনেসি উইলিয়ামস রচিত বিখ্যাত নাটক ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’-এর চলচ্চিত্ররূপ থেকে তাঁর উল্কার গতিতে উত্থান, এবং সেই দশক জুড়ে একের পর এক ছবিতে তাঁর ‘মেথড অ্যাক্টিং’ খোদ অভিনয় শিল্পে চিরকালীন প্রভাব ফেললেও,  তাঁর কেরিয়ার, বিভিন্ন কারণে, ষাটের দশকেই একপ্রকার শেষ হয়ে গিয়েছিল। স্টার ব্র্যান্ডো, নায়ক ব্র্যান্ডোকে কাস্ট করার কথাই ভাবত না কেউই। কিন্তু, একটা মাত্র সুযোগ, এবং ‘দ্য গডফাদার’—তাঁকে আবার খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়।  সেই থেকেই, এই কামব্যাক হয়ে গিয়েছিল কোনও সুপারস্টার অভিনেতার, বেশি বয়সে গুরত্বপূর্ণ মুখ্য কিংবা পার্শ্বচরিত্রে ফিরে আসা  সেকেন্ড ইনিংসে ফিরে আসার টেম্পলেট। ভারতীয় চলচ্চিত্রে দেখা যাবে, বহু জনপ্রিয় নায়কই তাঁর ‘ইমেজ’ ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেননি। কিংবা সময় নিয়েছেন ঢের। আশ্চর্যজনক ভাবে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এই বিবর্তন-পথ বিশেষ জটিল হয়নি। ‘নায়ক’ স্ট্যাটাসের থেকেও অভিনেতা, এবং ‘জীবন সদৃশ অভিনয়’—এই দু’টি কারণেই সম্ভবত পার্শ্বচরিত্রে খুব সহজেই মানিয়ে নিয়ে পেরেছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে বাংলা সিনেমা জগতের চরম দুর্দশার পর যখন, এই একবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সিনেমা আবার দাঁড়াতে শুরু করল তখন তাঁকে প্রায়ই পাওয়া গেল চমৎকার কিছু ছবিতে। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার এটাই, তাঁর প্রথম জাতীয় পুরস্কার এল ২০০১ সালে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘দেখা’ ছবিতে, পার্শ্ব অভিনেতার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য। এত, এত দীর্ঘদিন পর, এত দুর্দান্ত ছবিতে অভিনয় করার পর, কিংবদন্তীতে পরিণত হবার পর জাতীয় পুরস্কার! ভাবতেও অবাক লাগে। সেই কারণেই, তিনি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যানও করেন। তবে, এর পাঁচ বছর পরে ফের, ‘পদক্ষেপ’ ছবির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হলেন, এবার ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’র পুরস্কার। এরপর আর তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে, শুধু পুরস্কারই নয়, গত দশকের একাধিক ছবিতে অভিনয়, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও, প্রবল শারীরিক ধকল সহ্য করেও তাঁকে একেবারে এই প্রজন্মের কাছে কাছের করে তুলেছিল। ‘বেলাশেষে’ কিংবা ‘বরুণবাবুর বন্ধু’র মতো ছবিতে তিনিই মুখ্য চরিত্রে থাকলেন, এত বছর পরেও। পার্শ্বচরিত্রে থেকেও প্রবল জনপ্রিয় ‘প্রাক্তন’ ছবিতে তাঁর ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের মুহূর্তগুলি ভুলতে পারবে কি কেউ?

 

লেজেন্ডদের জীবনাবসানে আমরা সহজেই বলে ফেলি অপূরণীয় ক্ষতি। কথাটা সহজ, বহুল ব্যবহৃত; কিন্তু, কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সবসময় গভীরে তলিয়ে দেখি না হয়ত। কোনো কর্মক্ষম কৃতি মানুষের মৃত্যুতে আমরা বলতেই পারি, আরো অনেক কিছু করার ছিল, দেওয়ার ছিল তাঁর। কিন্তু, যখন কোনো বৃদ্ধ কিংবদন্তির মৃত্যু হয় এক মুহূর্তে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে হয়, আর কি কিছু দেওয়ার ছিল তাঁর?  ক্ষতি তো বটেই, যেকোনো কৃতি মানুষের মৃত্যুই ক্ষতি, পরিবারের এবং অবশ্যই, সমাজের কাছে। কিন্তু, যাঁর নতুন কিছু দেবার থাকে না, তাঁদের সম্পর্কেও ’অপূরণীয় ক্ষতি’ শব্দবন্ধ কতটা প্রযোজ্য হয়? প্রশ্ন উঠতেই পারে।

 

উত্তরটা খুব সহজ। যখন একজন লেজেন্ড জীবিত থাকেন, কর্মক্ষম থাকুন বা না-থাকুন—মাথার ওপর ছাদের মতো, আশ্রয়স্থলের মতো অনুভূত হয়। ইতিহাসে যখন ফিরে তাকাই, যখন মনে করি অমুক সময়ে আমাদের সমাজে জীবিত ছিলেন এক একাধিক মস্ত নেতা, শিল্পী কিংবা খেলোয়াড়— সেই সময়কে আমরা তখন ঈর্ষা করি। মনে হয়, কেন তাঁদের সময়ে আমরা জন্মাইনি কিংবা আমাদের সময়ে কেন এমন একজনের দেখা পেলাম না। একের বেশি প্রজন্ম, সর্বোপরি গোটা সমাজ ধনী অনুভব করে তাঁদের উপস্থিতিতে—মনে হয় এই সময়েও উনি আছেন, এও সৌভাগ্য আমাদের, এও অনুপ্রেরণা আমাদের।

 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুই-ই ছিলেন। কর্মক্ষম এবং জীবন্ত কিংবদন্তি—বিরল যুগলবন্দীতাই, ’অপূরণীয় ক্ষতি’ বলতে কোনো দ্বিধা থাকে না। তবে, কিংবদন্তি পর্যায়-ভুক্ত এ শিল্পীর লেগ্যাসি যে চিরকালীন। তিনি সত্যিই অপরাজিত।

 

Tuesday, 29 December 2020

রাজদীপ পুরী,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


দাম্পত্য 


আমাদের সারারাত খুনসুটি আর তুমুল ঝগড়াঝাটির পর

                        এই যে সূর্য ওঠে আর রোদ এসে ঝিলমিল করে 

আমাদের ছোট ঘরে... আমাদের ছোট ছোট সুখ, ছোট ছোট রাগ অভিমান— 

এই যে আমরা ভাগাভাগি করে নিই, কি নিই না বল?

আমাদের চারহাত দুহাত হয়ে যাওয়ার পরও এই যে

আমরা প্রেমিক প্রেমিকা সাজি, আর তালি বাজাতে বাজাতে

                         পার হয়ে যাই দিন মাস বছর, আস্ত ট্রাম লাইন...


হট প্যান্ট আর স্ট্রবেরী কন্ডোমে টগবগ করে আমাদের 

খেজুর রঙের দাম্পত্য!

 ছবিঃ মঙ্গলদীপ সর্দার

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় ,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


আনন্দ বড়ো ক্ষণজন্মা





আনন্দ বড়ো ক্ষণজন্মা

আঁকড়ে ধরি যে মাটি মজবুত ভেবে

তার ওপর আরো আরো গাছ

আগাছার শরীর উপড়ে ফেলে দাও, ভাবতে ভাবতে 

কেঁপে ওঠে ভিত!

মনে হয় ছিনিয়ে নিয়ে যাই হাওয়ার মুঠি ধরে

লাভার মতো জ্বলে ওঠে অগ্নিনিঃশ্বাস

টের পাও না কিছুই।

জানো যদি একটা উত্তরে শান্ত হয় উত্তাল সমুদ্র

তবে কেন এত না বোঝার ভান?

যতবার ভাবি আশা রাখব না কোন

কেন বারবার চোখ যায় ভোরের কাছে?

বরং দু চোখ বন্ধ থাক।

আমি দেখতে চাই না আর, ভাবতে চাই না 

শুধু চাই একটা ঢেউ এসে বলে দিক, 

এই তো দুটো পা ভিজিয়ে দিয়েছি এবার, 


হেঁটে যাব সোনালি বালির বুকে

দুহাত ছড়িয়ে জড়িয়ে ধরব আকাশ

যেখানে আমাদের সঙ্গম নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে

শুরু হবে সেই অনন্ত চুম্বন!





হৃদয় হোম চৌধুরী,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


মৃত্যু


মৃত্যু থেকে ফিরে
জীবনিশক্তির বাকে ঢুকে পড়ি অবিরাম।
আবারো মৃত্যু এলে
অহমিকা তীব্র করে নিশ্চুপ হই।

তখনই
জীবনের আঁচলে মৃত্যুকাঠি জড়ানো হয়।
তবুও
আমি তটভূমি ভেঙে সালোকসংশ্লেষের রসদ খুঁজি

মাহমুদ নোমান, কবিতা, সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


 

 কার্তিকের ফুঁ


কার জন্য মন কাঁদছে,
ছায়া মাড়াতে বুকে চিনচিন
সূর্য উদয়ের 'পরে...
পর্দা টেনে দিলে
মধ্যাহ্নের রোদে,
জানলার গ্লাসে
চিকমিকি দ্যোতনায় ;
ভেবেছ কী রাস্তায় —
পোড়া পোড়া পালক,
পেরেকবিদ্ধ মাথার খুলি
বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে
বিচ্ছিন্ন এক কাক ...



ট্রেন ছাড়লে


ঘুম তাড়িয়ে চলেছে ট্রেন
আকাশের বিপুলা অর্গাজমে,
যেন জলোচ্ছ্বাসের উচ্চাশা —
সমুদ্রের বেহাগ গর্জনে
হঠাৎ দেয়াশলাইয়ের কাঠি
জেদ করে জ্বলে ওঠেছে
অভিমানের তামাশা নিয়ে
ঠোঁটে ঠোঁটে এলিয়ে পড়া
চুমুর দগ্ধ গা,
যেন এই একটিবার কারো কান্নার চিৎকার
সূচের মতোন ফুঁড়ে যাচ্ছে
কেউ কোথাও কারো হাত ছেড়ে দিচ্ছে
চিরতরে একাই একা —
তোমরা কেবল একটি শিশুর জন্ম দেখলে

Sunday, 27 December 2020

অমিত পাটোয়ারী, কবিতা,সাহিত্য এখন শীত সংখ্যা ২০২০-২১,

 

পাপ – তাপ , নশ্বর ,ঈশ্বর 

একবেলা তুলি হাতে শারীরিক চুরি
একবেলা এক পাতে ডিমের পাতুরি
আমরা তো চেয়ে থাকা ভুলে থাকা লোক
দু’হাতে জড়িয়ে ধরি সমাস কারক

একবেলা একই বই ভাগ ক’রে পড়ি
নাম রাখি সুগ্রীব , সুগ্রীব - বানরী
আমার চলছে কুড়ি ; তোমার একুশ
আমাদের দুই বাবা লব আর কুশ

একবেলা মেসেজেই সকাল কাবার
একটু সময় নেই কবিতা ভাবার
ইমোজি ঝগড়া করি , ঠাস ক’রে চড়
গলে যাই পাতালেতে — ভেসে ওঠে খড়

একবেলা দিঘা প্ল্যান , একবেলা পুরী
দুই দিকে ঘাড় নাড়ে উত্তরসূরি
আমরা টেনিসকোর্ট বানিয়েছি ঘরে
প্রতিবেশী হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরে

একবেলা ধান ভানি , পাড় পড়ে বুকে
বন্ধু কমেন্ট করে। ভীষণ অসুখে
তখন বেতাল হয় দু-অক্ষর নারী
আমি তো তুলসীপাতা , ভিজে জামা ছাড়ি

একবেলা ধুলো খাই পায়ে ধ’রে সেঁধে
চিরকাল রেখে দেব দোঁহা দিয়ে বেঁধে
আমাদের সব বেলা লোহা আর সোনা
ভাত দিয়ে , চটি দিয়ে , রিপু দিয়ে বোনা





অরিজিৎ বাগচী,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 



দশমী



সব কথা সেই বাকি থেকে যায় বলা,

'বুক' মানে; সেই মন'কে চেরাই শব্দ!

মেমরি কার্ড'টা বাতিল চেয়ার পাশে,

'দশমী' মানে'ই একলা চলার শর্ত।


ইশতেহারে ধুয়ে গেছে সব খুশি,

লাল শাড়িতে ভাঙা আলোর সাজ;

পেঁজা তুলো আকাশ ঢেকেছিল, 

চিয়ার্স করেছি দুঃখ বারোমাস।


'মাতৃপক্ষ শখের দামে কিনে,

শহরের ছাদে ট্যাক্সি, অটো তারা-

তবুও যারা ছন্দ ভেঙে হাঁটে;

'দশমী' তাদের সঙ্গ হয়নি ছাড়া ।

দেবাশিস তেওয়ারী কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


কালীয়দমন



একদা কৃষ্ণের মতো আমিও কালীয়নাগ
                                           নিয়ে ব্যস্ত হই
ভাবি তাকে বধ করব বলে,
তারপর আবার তাকে ছুঁড়ে দেব যমুনার জলে।
কিন্তু সে কপালগুণে মরবার আগেই----
ছুঁড়ে-ছুঁড়ে বিষ দিচ্ছে গা-য়,


মরার আগের এই তেজটুকু দেখে
                                        আমি চলে যাই


পরের রাত্তিরে সেই তীব্র রূপ
                                   ফের ফিরে আসে
ফিরে আসে শত্রু নয়, গোটা একটা
                                          'কালীয়দমন' 


ফিরে এসে বলে 'প্রভু এই,
       যেটুকু সর্বস্ব ছিল সব দিয়ে গেছি
       এর বেশি কি আছে আমার
       তোমাকে দেবার মতো
                                          ভাই'! 





কাক



এই একটা সাদা মেঘ, তার কালো চুল দিয়ে
আঁকা ওই কাকের মস্তক,
আর ক্রূর চালাকির চোখ
হিসেব-রক্ষক হয়ে মাঠে নামছে, মাঠের আঘাত
কাকের দর্শন নিয়ে একপাশে কাত-
হয়ে পড়ে-পড়ে যাচ্ছে, আর শব্দগুলো কোনও গাছে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গুপ্ত আগুন জ্বালায়
যে-আঘাত টুকরো হয়ে ফিরে যাচ্ছে
                                         মেঘেদের গা-য়


সাদায়-কালোয় মিশে ওরই মাঝখান দিয়ে
                         কাকের কর্কশ খেলে যায়



 
ডিভোর্স ক্লাস্টারিং



সর্দি-কাশির মতো ডিভোর্সও সংক্রামক ব্যধি
সংসার শান্তিতে রাখতে ডিভোর্সির কাছ থেকে
                                        অন্তত নিজেকে
দূরত্ব রাখুন। 


তার প্রতি সমব্যথী হন ক্ষতি নেই
কিন্তু কেন ডিভোর্সটি হল,
কী কী নিয়ে মতানৈক্য, যাবতীয় খুঁটিনাটি
ইত্যাদির দু'এক ঝলকও
              খোঁজ নিয়ে দেখার দরকার নেই
হোক কান্নাকাটি।


নব্বই সালের থেকে এ-যাবৎ মার্কিনী রিসার্চ
'ডেলি মেল'-এ প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়
                  যাকে বলে ডিভোর্স ক্লাস্টারিং
অন্যথায় এই রোগ ৭৫% ঘটে অন্যের ক্ষেত্রে


সংসারের জটিল বাঁধনও এর ফাঁকে
                           কখন ক্ষয়াটে হয়ে যায়, 
শুধু সার
                        উড়ে আসে একগুচ্ছ চিঠি
তাতে লেখা----অনুষঙ্গঃ শুষ্ক নিরাশার


এহেন সময় তাকে প্রেতপ্রেম বলি।




পদ্মনাভ অধিকারী, কবিতা, সাহিত্য এখন শীত সংখ্যা ২০২০-২১,

 



দুরূহ জেনেও



দুরূহ জেনেও  বিশ্বাসে ভর করে
পরিখা ডিঙিয়ে যাই

পথের দু'পাশে সার সার মানুষের
উচ্চস্বরে কথা বুঝি কিন্তু, 
বিষয়ের ভেদ বুঝি না!
যারা ওখানে আছে 
বাস্তবায়নাধীন কাজের নেশায়

তবুও, মেঘমালার ভেতরদিয়ে 
হেঁটে যাই ওদের না বুঝেই।
এই ভাবে রাত্রি-দিন,
অস্পষ্টতায় নগর জীবন
মানুষ না-অমানুষ!
তা  নিজেই বুঝি না

শ্যামল শীল, কবিতা, সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 

আত্মজিজ্ঞাসা


দূরত্ব রচে ব্যবধান

বাতাসে উড়ছে স্মৃতিরা

স্তব্ধ রয়েছে অভিমান


নামছে সন্ধ্যার ছায়া

আকাশে দু একটি তারা

দেহ কি সমাকীর্ণ মায়া ?


                                             

Saturday, 26 December 2020

সৌমাল্য গড়াই, কবিতা, সাহিত্য এখন, শীতসংখ্যা ২০২০-২১,




 সৌরজাল


স্মৃতি ও শরীর, 
তোমাকে পেয়েছি আমি সূর্যাস্ত বেলায়  
যেভাবে জলেরা ফেরে সন্তরণ শেষে 
যেন সেও এক মাঝি নিজের ভেতর 
ডুবো জাল ফেলে দেখে প্রকৃত বন্দর
এমনই অতল দেশে আলো নিভে গেলে
 সীমানা পেরিয়ে জাহাজেরা ডুবে যায় সমুদ্র প্রবাহে 
 
সেইসব সুষুপ্তি পেরিয়ে মনে পড়ে  
ছিলাম সূর্যের দেশে, লক্ষ লক্ষ জীবাশ্ম কণায়  
আকাশের অমূল্য শূন্যতা চুরি করে   
স্বয়ং ব্রহ্ম ও আমি
অন্ধকার লোভে পালিয়ে এসেছি 
যুগ যুগ ধরে তাই সূর্যকণাদূত হন্যে হয়ে খোঁজে প্রতিটি অনন্তে আমাদেরই লুপ্ত পদছাপ
সৌরকণাদের এই অন্বেষণ  হেতু 
সূর্যের আলোক এসে পৃথিবীতে পড়ে...
 
ছবিঃ শুভব্রত চৌধুরী

অসিকার রহমান, কবিতা, সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 



কর্মপন্থা  


না চটজলদি নয় 
খুব ধীর মন্থর গতিতে চলে গেলো জীবন থেকে 
অথচ আমাকে অবাক করে চকিতে এসেছিলো
জীবন জড়িয়ে ছিলো। 

সে গেলো 
যেমন করে রাতের শরীরে গড়িয়ে যায় মধ্যরাত 
                                       মায়াবী গোধূলি হয়ে। 
তার চলে যাওয়ার ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল
সে আর কোথাও থামবে না 
ঠিক যেন স্পেন নগরী এক ব্যস্ত রেলওয়ে স্টেশন। 

জীবনের গতি সে কমিয়ে গেলো 
নাকি বাড়িয়ে গেলো 
কিংবা বিজয়ী হলো সে ত্রিশঙ্কু সময়ে ! 
এ শহরের গলিঘুঁজি পেরিয়ে 
সে কি গেলো শহর থেকে শহর 
কিংবা খুঁজে পেলো 
ফেলে আসা কোনো এক রাজপথের ঠিকানা? 

ধীরে ধীরেই সে চলে গেলো 
অথচ আমি ছুটেও তার কাছে পৌঁছতে পারিনি, 
"ফিরে এসো" বলেছি কিন্তু মুখরিত সেই শব্দ
কানে তার বিঁধেছে কি? 
সে এখন কদ্দূর গেলো? বড়জোর পাশের শহর, 
তার যা হাঁটার গতি 
একটা বড়ো রকমের চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে 
শুরু করা যেতে পারে 
ফের একটা দমবন্ধ ছুট, চটজলদি..... 

বৈদূর্য্য সরকার , গল্প, সাহিত্য এখন শীত সংখ্যা ২০২০-২০২১,

 


প্রান্তিক



শীতের ছুটি চলছে ।  পাড়ার চায়ের দোকানে বেলায় আড্ডা দিতে গেছি, রাজাদা উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে ।  তার রবি ঠাকুর মার্কা দাড়ি হাওয়ায় এবং উত্তেজনায় ছটফট করছে । 
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সত্যি কি কোনও ডক্যুমেন্ট আছে ? রাজাদা চটে বলল, ডক্যুমেন্ট আবার কি... সবাই এতকাল ধরে জানে – নেতাজীর মামার বাড়ি । 
ওর ধাত জানি বলেই শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম, সে ঠিক আছে...কিন্তু প্রোমোটিং যে হচ্ছে, তাদের কাগজপত্র পাশ হল কী করে ! 

পাশ থেকে খিটকেল ভটচাজ বলে উঠল, টাকা রে ভাই, সব টাকার খেলা...গোটা দেশটা বেচে দিল । আর এ হচ্ছে নেতাজী – মরার খবর পর্যন্ত চেপে দিয়েছে । 
এমন সময় ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে পুরুত বলে উঠলো, মানুষের আয়ু যত বাড়ছে... মানুষের কচি সাজাও যেন বেড়ে চলছে। বিরক্ত হয়ে তাকালাম । তখনই  ঝলমলে ক্যাবলাদা হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালো । মুখে কিছু বলে না বটে তবে অঙ্গভঙ্গি করে হাসে আর চোখ পিটপিট করে । পানও চেবায় অবশ্য। আজ লাল রঙের পায়জামা পাঞ্জাবি জুতো টুপি মুখোশ পরে এসেছে । অদ্ভুত এক মূর্তি। 
রাজাদা রেগে লাল হয়ে বলে চলেছে, নেতাজীর ভূত নিয়ে সিনেমা করে হাউসফুল করে দিলে... তার জ্যান্ত মামারবাড়ি নির্দ্বিধায় ভেঙে ফেলছে! 
 সেই সময়েই কোথা থেকে টুপি পরা পাগলা বাজিয়েটা মাটি ফুঁড়ে এসে মাউথ অর্গান নিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ বাজাতে লাগল । 
শুনে আমরা একটু থমকে গেলেও  পুজোয় ওর অ্যাসিটেন্ট হয়েছে বলে রোগাভোগা ভটচাজ পুরুতের সেই আগের কথাটা ধরে ততক্ষণে বকতে শুরু করেছে, মানুষ আগে চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের আগেই সটকে পড়তো । আর এখন আশি নব্বই আকচার। পাশ থেকে কে যেন বলেছিল, একশো বছর বাঁচলে নাকি ডবল পেনসান দেয় ।   

চায়ের দোকানে বসা লোকগুলোর আদৌ কোনও মিল নেই । না চেহারায় না বয়সে কিংবা কাজকর্মে । তবে মিল ভেতরে ভেতরে একটা আছে বটে – সবাই মোটের ওপর ব্যর্থ । সমাজে কোনও দাম নেই । তেমন কোনও পরিচিতিও নেই বটে। সবার মনের ভাবটা খানিকটা এর’ম – দুনিয়ার লোক ষড়যন্ত্র করে বিপাকে ফেলেছে । বিশ্বায়নের মতো সেই গভীর ষড়যন্ত্রে যাবতীয় ভাল ব্যাপার বন্ধ হয়ে গেছে । পুরুত যেমন বলে, দেবদ্বিজে ভক্তি চলে যাওয়াটাই আসল কারণ । রাজাদা বলে- সব ওপারের লোকেদের চক্রান্ত । আমি নতুন কিছু বলার মতো মুখে বলে বসি – পলিউশান, চারদিকে সব দরকচা মারা অবস্থা । পরিবেশ প্রকৃতির মতো মানুষগুলোও সব কেমন যেন হয়ে গেছে ।

আমাদের মতো সামান্য লোকের দল কি এসব ব্যাপারে আদৌ কিছু করতে পারবে ? জিজ্ঞেস করার আগেই দেখলাম রাজাদার মুখচোখে কেমন যেন একটা তেড়েফুঁড়ে ওঠা দৃষ্টি । 
কীভাবে এগোনো যেতে পারে সেটাও তো পরিষ্কার নয় । আমাদের না আছে দল, না অন্য কোনও বল । নেহাৎ পুরনো পাড়া বলে দু’চারটে নিস্কম্মাকে আড্ডায় পাওয়া যায় । এসব নিয়ে যদিও মাথা ঘামায় না কেউ আজকাল। 

চায়ের দোকানে অধিকাংশ সময় কাটানো অন্যান্য লোকের মতো আমার অবস্থা না হলেও রাজাদার সাথে সখ্যতার কারণেই ওখানে জুটে গেছিলাম । রাজাদা এককালে পদ্য লিখেটিখে নাম করেছিল । কীভাবে যেন জাতীয় পুরস্কার পেয়েওছিল একবার । কিন্তু তারপর থেকে ক্রমে কেষ্টবিষ্টুদের অবহেলায় কর্নার হয়ে গেছে । এমনকি ওয়েবসাইটে তখনকার পুরস্কৃত লোকগুলোর নাম পর্যন্ত নেই । আছে তার পরের সময় থেকে, যখন থেকে প্রবল প্রতাপান্বিত প্রেসিডেন্ট তার নিজের সিস্টেমের লোকেদের পুরস্কার দিয়েছে । রাজাদার মুখে শুনেছি, উনি নাকি পূর্ববঙ্গীয় গরীব বামুনদের প্রেফার করতাম । সেদিকে রাজাদা একেবারে মিসফিট । বাড়ির অবস্থা ভাল, এপারের বেণে । তবে এখন তেমন দাপদাপট নেই, বুঝতে পারি । এখন ও লেখালিখির থেকে এনজিও নিয়ে বেশি ব্যস্ত। বাইরে না যাওয়ার কারণে চাকরি ছেড়ে কিছু টুকটাক ফ্রিলান্স করে। একা মানুষ- তেমন কীই বা খরচ ! 

আমার অবস্থা ঠিক উল্টো – বিয়ে থা করে ল্যাজেগোবরে । যদিও সংসারে থিতু হওয়ার বদলে এসব উ্তপটাং ব্যাপারে বেশি টান । চাকরি নাম কা ওকয়াস্তে করলেও মন নেই । গায়ের জোরে লেখালিখির চেষ্টা করলেও বড় জায়গায় তেমন সুযোগ পাই না – মুরুব্বির জোর নেই বলে । ঘরে আশান্তি – গঞ্জনা । সমবয়স্ক বন্ধুরা বাইরে গিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে – গাড়ি বাড়ি বিলিতি বউ । আমি সেই এক জায়গায় পড়ে আছি – হেরিটেজ নিয়ে যাদের গর্ব, বর্তমানে কোনও আশা নেই ।

প্রোমোটার নয়তো রামকৃষ্ণ মিশন –এখানকার পুরনো বাড়িগুলো গিলে খাচ্ছে । টাকার লোভে অধিকাংশ লোক বাস্তুভিটে ছেড়ে চলে যাচ্ছে শহরতলিতে । সেখানে একজন ভুলে যাওয়া দেশনায়কের মামার বাড়ি ! আদৌ কিছু হবে ? বুঝতে পারছিলাম না । তবে সবার আগ্রহে যে কিছুটা জড়িয়ে পড়েছি- তা বুঝতে পারছিলাম ।
ওই চায়ের দোকানে বসার সূত্রে ভটচাজ এসে কথা বলে । ভাল বংশের হলেও সহায় সম্বলহীন লোক –একটা বন্ধ দোকানে থাকে । কাজকর্ম নেই । খাওয়া জোটে কী করে কে জানে ! পুরুতের পুজোর ব্যবস্থা থাকলেও তাতে আর কত । তবু ভটচাজটা ভিড়েছে কলাটা মুলোটার লোভে । তুলনায় অবস্থা ভাল ক্যাবলাদার । ওদের কী একটা ছোট কারখানা আছে । সেখানে না বসলেও কিছু মাসহারা পায় বটে । খরচ বলতে জামাকাপড়ের । একই স্টাইলের শেরওয়ানি পাজামা পাঞ্জাবি – ওর কমপক্ষে ত্রিশটা আছে বলে মনে হয় আমার । রোজ আলাদা রঙের । সাথে ম্যাচিং টুপি । ফক্কুড়ি করে জিজ্ঞেস করতাম, কাকে ইম্প্রেস করতে চাও ? শুনে রাগতো না, মৃদু হাসত আর চোখ পিটপিট করতো ।    

একটু আলাদা ছিল পাগলা বাজিয়েটা । ছোট থেকে ওকে মাউথঅর্গান বাজাতে দেখতাম এলাকার ছোটখাটো অনুষ্ঠানে । তখন থেকেই ন্যালাখ্যাপা । বয়স বাড়ার সঙ্গে পাগলামি বাড়ে আর এসব সুযোগও জুটতো না ওর । তবে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে বাজনা বাজাতে ক্লান্তি ছিল না । প্লাটফর্ম চায়ের দোকান কিংবা গলির মোড়ে সে আপন মনে বাজনা বাজাতো । কেউ বিরক্ত হয়ে কিছু বলত হয়ত । ও ভ্রূক্ষেপ করতো না। আমার মনে হতো – অনেকসময় অজান্তেই ও ঠিক মিউজিক বাজিয়ে আবহটা তৈরি করে দিয়ে যায় । 

রাজাদার আগ্রহে নেট ঘেঁটে বের করেছি, হেরিটেজ কথাটার সঠিক মানে - belonging to the culture of a particular society, such as traditions, languages, or buildings, which come from the past and are still important... রাজাদা ভাবতে শুরু করেছে কাকে দিয়ে কাকে কাঠি করানো যায় । শাসক দলের অনেক লবি... তাদের কাউকে ধরেই এসব ভাঙন আটকাতে হবে । কিন্তু কীভাবে ? রাজাদা বলছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।
বিধায়ক মন্ত্রী এমপি সব নিয়ে যখন কথাবার্তা চলছে তখন ফোকলা পুরুত আশ্চর্য একটা সমাধানসূত্র দিল । রবিবার সে একদল পুরোহিত নিয়ে আমাদের বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রীর সাথে দেখা করবে । মোদ্দা কথাটা হচ্ছে – চারিদিকে পুজো নিয়ে যে অনাচার... তার কিছু একটা ব্যবস্থা করা। এর খেই ধরে রাজাদা ওই বাড়ির ব্যাপারটাও বলে বসবে । তারপর দেখা যাবে । শুনতে কীর’ম অদ্ভুত লাগছে আমার । কিন্তু সবার উৎসাহে ওটাই ফাইনাল হল ।  
যেদিন এই আশ্চর্য মিটিং সেদিন আমি অবশ্য যেতে পারিনি । শুনেছি রাজাদার ক্যারিশ্মায় নাকি মন্ত্রী ব্যাপারটা শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য মেয়রের সাথে কথা বলা দরকার । এতো সহজে তো আর কাজকর্ম বন্ধ করবে না প্রোমোটার।

রাজাদা বেশ সেজেগুজে মেয়রের ঘরে গেছিল একদিন । তিনি চা খাইয়ে অনেক প্রশংসাও করেছে । শুনে আমাদের বেশ গর্ব হল বটে। পুরুতের ওর পুজোর ব্যাপারে দরবারের কতটা কী হয়েছিল জানি না, তবে সে বেশ খুশি মনেই রাজাদাকে পৈতে তুলে সাবাসি দিয়েছে । ভটচাজও বেশ বিগলিত মুখে বলছে, একখানা যা কাজ করলে না... । জিজ্ঞেস করলাম, কাজটা বন্ধ হবে কবে ? সেটা নিয়ে অবশ্য রাজাদা খুব কিছু বলতে পারলো না । 
পরের দিন বেলার দিকে রাজাদার কাছ থেকে একটা অদ্ভুত মেসেজ পেলাম – ‘মহাবিপদ...ফোন বন্ধ রাখছি... দরকার হলে কল করে নেবো... আপাতত গা ঢাকা দিতে হবে’। আগাগোড়াটাই বোঝার মতো কোনও বিষয় নয় । তবে কল করে দেখলাম, ফোন সুইচড অফ । কিছু বুঝতে পারলাম না ।

নানা হাবিজাবিতে ব্যাপারটা খেয়ালও ছিল না । ক'দিন পর হঠাৎ একদিন বিকেলে ওর ফোন পেলাম । আমার অফিসের কাছাকাছি কোথাও একটা দেখা করবে । যাইহোক, গিয়ে দেখি অবিন্যস্ত চেহারায় কাঁধে ঝোলা নিয়ে রাজাদা । অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বলল, ক’দিন এলাকাছাড়া । ওইদিন রাতে নাকি একদঙ্গল ছেলেপুলে ওর বাড়ির সামনে খিস্তিখেউড় করেছে । ঢিল পাটকেলও ছুঁড়েছে । তাদের উন্মত্ত চিৎকার থেকে যা উদ্ধার হয়েছে – ওই বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে ব্যাগড়া দেওয়ার কারণেই প্রোমোটারের উৎপাত । তবে ভাগ্যিস ওকে কেলানে কবি ভেবেছিল, তাই পেটো বা খুনজখমের প্রয়োজন মনে করেনি তারা ।

আমি হতবাক হয়ে ততক্ষণে ভাবতে শুরু করেছি – এটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাপার ! এই সামান্য ব্যাপারে লোকের ওপর এর’ম অত্যাচার হতে পারে ? আমার মনের কথা পড়ে রাজাদা বলল... কয়েক কোটি টাকার ব্যাপার, এতো সহজে কি ছেড়ে দেবে ! একটু থেমে বলল, এখন বুঝতে পারছি... মন্ত্রী কেন বলেছিল বেশ অনেক লোক সাথে নিয়ে মেয়রের কাছে দরবার করতে যেতে । তাহলে আর আমি একা মার্ক হতাম না । কিন্তু কেই বা যাবে ! আমাকে বলেছিল, নানা ঝামেলায় যেতে পারিনি । আর কে নিজের কাজকর্ম ছেড়ে যাবে ? থাকার মধ্যে পুরুত ভটচাজ ক্যাবলাদা আছে বটে... কিন্তু ওদের চেহারাছবি যা ! আমি রাজাদাকে থামিয়ে বললাম, ওদের দিয়েই হবে । মিছিলে ইন্ডিভিজুয়াল মুখগুলো বড় বিষয় নয় ।

পরিকল্পনা অনুযায়ী জানুয়ারির ২৩ তারিখ এলাকার কয়েকটা ছোটখাটো ক্লাব পতাকা আর নেতাজীর ছবি নিয়ে মিছিল বের করলো । তাদের সাথে আমরা জুড়ে গেলাম । ক্রমে স্লোগানের অভিমুখ ঘুরে গেল ‘নেতাজীর স্মৃতি’ তার মামার বাড়িটাকে বাঁচানোর দিকে । আগে থেকে অবশ্য কিছু লোক ঠিক ছিল । যাদের ব্যক্তিগতভাবে তেমন কোনও গুরুত্ব না থাকলেও দলগতভাবে অস্বীকার করা যায় না । 
মানুষের সে নদী নানা দিক থেকে আসা লোকের শক্তিতে বিপুলা হয়ে বইতে লাগলো রাজপথ জুড়ে । সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং স্বতঃসফূর্ত মিছিলের ছবি তোলার কিছু লোক আমাদের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল অবশ্য । গন্ধে গন্ধে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এসে গেল । স্বাভাবিকভাবে বিধায়কের বিবৃতি দাবী করা হল । তিনি আগে থেকেই খবর পেয়েছিলেন, ফলে মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী ঐ বাড়িটাকে হেরিটেজ হিসেবে মেনে নিতে দেরি করেনি । ওখানে নেতাজীর মূর্তি স্থাপনের কথাও দিয়ে ফেললেন । মুহূর্তের মধ্যে নেতাজীর ছবিতে মাল্যদান এবং পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করে তার দলের লোকেরা যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তির পরিচয়ও দিল । ততক্ষণে লোক জমেছে অনেক । বেলা পড়ে এসেছে । দু’একটা ফুচকা ভেলপুরি বেলুনওলা জমতে দেখে রাজাদা নিশ্চিন্ত হল । ওর মুখ দেখে বুঝলাম আমাদের দায়িত্ব ফুরিয়েছে । থাকার দরকারও নেই আর । এবার নদী যথানিয়মে মোহনায় যাবে ।

ভিড় ভেঙে পিছোতে লাগলাম । সঙ্গে ভটচাজ ক্যাবলাদা আর পুরুতও ফেরার পথ ধরেছে । ভটচাজ বলল, এভাবে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে... সব যখন মিটেই গেল । রাজাদা মৃদু হেসে বলল, যার জন্মদিন তার কথা জানো না... প্রেসিডেন্ট হয়েও ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে গিয়ে অজানার পথে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন যে। শুনে ক্যাবলাদাও বেশ মজা পেয়ে হাসতে লাগলো । ঠিক সেই মুহূর্তেই পাগলা বাজিয়েটা বাজাতে শুরু করেছে -‘একলা চলো রে ...’। 
 
শীতের ছোট বেলা ফুরিয়েছে। তখনই ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করলো না। চায়ের দোকানে আগডুম বাগডুম কথাবার্তায় মেতে উঠলাম আমরা। উনুনে আঁচ বেশ গনগনে । মনে হল, ছাই চাপা আগুন ঠিক সময়ে বেরোবেই ।