সম্পাদকীয়
বহু প্রতীক্ষার পর বৃষ্টি এল।
সিক্ত সবুজ মেলে শ্বাস নিচ্ছে প্রকৃতি। নতুন জীবনের পদধ্বনি বেজে উঠছে গাছের ডালে
ডালে। অথচ, সভ্যতার দিকে চোখ ফেরালে কেন যেন আসন্ন মৃত্যুর ছায়া ভেসে উঠছে বারবার।
এমন এক বর্ষা আসুক, যা ধুয়ে দিয়ে যাবে আমাদের ক্লেদাক্ত জীবন। রোধ হোক সমস্ত
অবক্ষয়। এই অস্থির সময়ে সাহিত্য এখন ব্লগজিনের পাতায় উঠে এল প্রাসঙ্গিক কিছু লেখা। এল নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতা “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না” এর অনুবাদ। শুরু হল একটি নতুন ধারাবাহিক, “নিদ্রাহারা রাতের এ গান”। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে চলেছে সাহিত্য এখন। সাথে থাকুন আপনারা।
প্রবন্ধ
জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো
ভাস্কর পাল
বাঙ্গালীর মননে রবীন্দ্রনাথ একদম মিলে মিশে একাকার ।
আজ এই অস্থিরতাময় সময়ে প্রাসঙ্গিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথ চলে আসে । বাঙ্গালীর আত্ম
অন্বেষণের আর এক নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
রবীন্দ্রনাথকে জানা মানে নিজেকে আবিষ্কার করা। নিজের
উপলব্ধির দ্বারটা আরেকটু খুলে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর নিজের কথা বলেন এভাবে,
‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না—এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা’ , নিজেদের
সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কে চরম কুঠারাঘাত করে
প্রজ্জলিত দীপ শিখার মত জ্বলজ্বল করে ওঠে এই উপলব্ধি
।
রবীন্দ্রনাথের নান্দনিক বিষয়টিই তাঁকে আমাদের হৃদয়ে
অমরত্ব দিয়েছে । যদি প্রশ্ন করা হয় রবীন্দ্রনাথ কে? এ প্রশ্নের জবাব শতকরা ৯৫ জন দেবেন
তিনি একজন নোবেল জয়ী বিশ্বকবি, তাঁর লেখা গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত তিনি একজন
গীতিকার এবং সুরকার । এই পরিচিত রবীন্দ্রনাথের বাইরে যে রবীন্দ্রনাথ আছেন তাঁকে
উন্মোচিত আরহিত আবিষ্কৃত করলেই আমরা ঋদ্ধ হবো রবীন্দ্র মননে ।
রবীন্দ্রনাথ জানতেন অনুশাসন চরিত্র গঠনের জন্য
প্রয়োজনীয় আর
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শিক্ষা রুচির জন্য প্রয়োজনীয় । রুচির জন্য চাই প্রথমে নৈতিকবোধ
ও শিল্পকলার চর্চা। নৈতিকতাকে তিনি রুচিতে পরিণত করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ
করেছেন। যুগিয়েছিলেন স্বাধীনতার অমোঘ প্রেরণা। জাগিয়েছেন তার চেতনার রঙে, নানা
বর্ণ সমাহারে। ভাসিয়েছেন তার সত্তার জ্যোতির্ম্ময় শিখার আলোকের ঝর্ণাধারায়। রবি
রশ্মির শ্বেতশুভ্র দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময়। রবীন্দ্রনাথের
এই জাতীয়তাবাদ ছিল সামগ্রিক অর্থে সর্বজনীন অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ ও যুক্তিনির্ভর।
রবীন্দ্রনাথ শুধু জাতীয়তাবাদীই ছিলেন না, তিনি তার
জাতীয়তাবাদী ভাবনায় ভারতবাসীকে উজ্জ্বীবীত করেছেন এবং তাঁর সৃষ্টি আজও সম ভাবে
মানুষের অন্তরে জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে ।তাঁর জাতীয়তাবাদের মাঝে
আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিচয় মেলে তাই দেশ সীমানা এসব সরিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বমানব।
তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়াবহতা জানতেন তিনি
প্রত্যক্ষ করেছেন হিটলার, মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবনা এবং তাদের উগ্র
জাতীয়তাবাদের পরিণতি । তিনি ঐক্যের প্রয়োজনে ভারতবর্ষে এক রাষ্ট্র শাসনের পরিবর্তে
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের পক্ষে মত দিয়েছেন। ‘নেশন’কে কিছুটা মানতে পারলেও
‘ন্যাশনালিজম’কে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করতে পারেননি। ১৯১৬ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে
জাপান ও আমেরিকায় ন্যাশনালিজমের ওপর বক্তৃতা করেন। এই ন্যাশনালিজম তাঁর মতে,
বিশ্বের জন্য ভয়াবহ বিপদ এবং এর পেছনে চালিকাশক্তি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও লুণ্ঠনের
অতি উগ্র বাসনা।তাঁর কলমে তিনি আমলাতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়
‘যৌথতার নতুন নির্মাণের’ স্তুতি করলেও, মানব চরিত্রের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার
রীতিও তিনি মানতে চাননি। তিনি সেই রাষ্ট্রকে মানেননি, যে রাষ্ট্র স্বৈরাচার।
স্বৈরাচার সমাজের বিরুদ্ধেও তার ধিক্কার ছিল স্পষ্ট। ব্রিটিশ যুগে রাষ্ট্র ছিল
স্বৈরাচার। রবীন্দ্রনাথ তাই চেয়েছিলেন সমাজকে আলাদা করে নেবেন রাষ্ট্রের সর্বভুক ও
বুভুক্ষুগ্রাস থেকে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সমাজই প্রধান, রাষ্ট্র নয়। এ কথা তিনি
বারবার বলেছেন, খুব জোর দিয়েই।
ব্রিটিশ শাসন আমলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক
নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন রকম আন্দোলনে বিক্ষোভসহ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিলেন
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি কোন বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়নি যদিও
রবীন্দ্রনাথ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। তিনি যুগাতিক্রমী দার্শনিক এবং
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছিলেন; তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দর্শনসমৃদ্ধ প্রবন্ধ, ভাষণ
পড়লে এটা বোঝা যায়। এ কারণেই বাঙালির ক্ষোভ, বিক্ষোভ এবং বাঙ্গালির সংকট মুক্তির
পথ প্রদর্শক রূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তা যুগে যুগে আলোচিত
হতে পারে। তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শন যুগে যুগে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ নির্দেশ
হিসেবে আলোচিত হতে পারে। সাম্প্রতিক আমদের দেশের রাজনৈতিক সংকট এবং সদিচ্ছায়
রবীন্দ্রনাথকে আমরা অনুসরণ করতে পারি। যেহেতু তিনি মিশে আছেন আমাদের চিন্তায়,
আমাদের ভাবনায়, আমাদের অস্তিত্বের গভীর সত্তায়।
স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশক্তি অমর নয়, তার পরাজয়
অবশ্যম্ভাবী- এ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ কখনো হারাননি। সে জন্যই তার তাসের দেশের
তাসেরা মানুষ হয়ে ওঠে, অচলায়তন ভেঙে পড়ে, মুক্তধারা বইতে থাকে এবং রক্তকরবীর সেই
ভীষণ রাজারও পতন ঘটে। রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকটে’ ইংরেজ রাজত্ব অবসানের
অবশ্যম্ভাবিতার যে বিশ্বাস ফুটে উঠেছে, তার সেই একই বিশ্বাস সংস্কৃতি চর্চার
ক্ষেত্রেও। তার পাহাড় মেঘ হয়, নদী থাকে সতত প্রবহমান, আর মানুষ এগিয়ে চলে মুক্তির
লক্ষ্যে- সকল বন্ধন ছিন্ন করে। তার মতে, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।
মানুষের শক্তির ওপর আস্থা তার অবিচল
নিজ মাতৃভূমি বা দেশ সম্বন্ধে তার চিন্তাভাবনার
জায়গাটি ছিল আলাদা। তিনি শান্তি নিকেতনের দশম বার্ষিক উৎসবে একটি ভাষণ দেন, যা
‘দেশের কাজ’ নামে প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি বলেছেন ‘দেশের কাজ’ মানে শুধু রাজনৈতিক
আন্দোলন নয়। তাঁর কাছে স্বদেশ বলতে নিজের দেশের লোক এবং দেশের কাজ বলতে বুঝাতেন
দেশের সর্বহারাদের জন্য কাজ করাকে বুঝতেন।
তিনি আরও বলেছিলেন- দেশ মানুষের সৃষ্টি, দেশ মৃন্ময়
নয় দেশ চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা
ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটাব ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দান
তো উপাদান মাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটা গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে জল যদি যায়
শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মারীবীজে, শস্যের জমি যদি হয়
বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরি নয়, মানুষের
তৈরি।”।
তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করেননি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ
কিংবা বিশেষ কোনো সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেননি। রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদে কোনো বিশেষ
মতাদর্শকেও শ্রেষ্ঠত্ব দেননি। তার জাতীয়তাবাদ উঠে এসেছে মানবিক চেতনা থেকে। আত্ম
উপলব্ধি থেকে। গান্ধীর জাতীয়তাবাদও তাই ছিল। কোনো ধর্ম-বর্ণ বা জাতি-গোষ্ঠীর চেতনা
থেকে উদ্ভূত নয়। রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী দু’জনেই জাতীয়তাবাদী ভাবনায় রাজনৈতিক
দায়বদ্ধতা নয়, নৈতিক শক্তির ওপর জোর দিয়েছেন।
ধর্ম সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব চিন্তার
প্রতিফলন পরিষ্কার ছিল। ভারতবর্ষ যেন ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত হয় এটা রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের ঐকান্তিক প্রত্যাশা ছিল। গোরা উপন্যাসে তিনি এক জায়গায় বলেছেন, “ধর্ম
মানুষের ব্যক্তিগত সাধনার জিনিস, তাকে কোন সমাজের সঙ্গে জড়িত করা উচিত না।” তিনি একটি বিস্ময়কর
বিষয় দেখিয়ে দিয়েছেন তা হল : যে কোনও ধর্মে জন্মগ্রহণের এবং ধর্মচর্চার
অন্তসারশূন্যতার বিষয়টি।
ধর্ম বিষয়ে বাড়িবাড়ির প্রবলতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ছিলেন বিরুদ্ধে। তিনি বিষয়টিকে চিহ্ণিত করেছেন ধর্মতন্ত্র বলে। “সমাজের সকল
বিভাগেই ধর্মতন্ত্রের শাসন এক সময় ইউরোপেও প্রবল ছিল। তারই বেড়জালটা কাটিয়া যখন
বাহির হইল তখন হইতেই সেখানকার জনসাধারণ আত্মকর্তৃত্বের পরে যথেষ্ঠ লম্বা করিয়া পা
ফেলিতে পারিল”।...
তিনি বলেছেন যে ধর্মতন্ত্র যদি মানুষের তুলনায় বড় হয়ে
ওঠে তাহলে একটি সংকট সৃষ্টি হয়।
“ধর্ম আর ধর্মতন্ত্র এক জিনিস নয়।” “ধর্ম বলে,
মানুষকে যদি শ্রদ্ধা না কর তবে অপমানিত ও অপমানকারী কারো কল্যাণ হয় না। কিন্তু
ধর্মতন্ত্র বলে, মানুষকে নির্দয়ভাবে অশ্রদ্ধা করিবার বিস্তারিত নিয়মাবলী যদি নিখুত
করিয়া না মান তবে ধর্মভ্রষ্ট হইবে। .. ধর্ম বলে, যে মানুষ যথার্থ মানুষ সে যে ঘরেই
জন্মাক পূজনীয়। ধর্মতন্ত্র বলে সে যতবড়ো অভাজনই হোক, মাথায় পা তুলিবার যোগ্য।
অর্থাৎ মুক্তির মন্ত্র পড়ে ধর্ম, আর দাসত্বের মন্ত্র পড়ে ধর্মতন্ত্র।”
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবতাবাদে বিশ্বাসী ।
ধর্মতন্ত্রের অপব্যবহারে সামষ্টিক বিচ্ছিন্নতা, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য, অর্থনৈতিক
বৈষম্য একটি দেশের মানুষের সমাজমানসে ঐক্য সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এসব বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তাঁ মানবতাবাদী মতামত ব্যক্ত করেছেন।
গোরা উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রাজনৈতিক
উপন্যাস। এখানে রবীন্দ্রনাথের দেশ ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে তিনি একস্থানে
বলেছে “ইতোপূর্বে দেশ বলে আমাদের সমস্ত দেশকে , জাতি বলতে আমাদের সমস্ত জাতিকে এক
করে দেখতে পারিনি। সেইজন্যই তার শক্তি জাগেনি। এখানে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের
বিষয়ের উল্লেখ করেছেন এই বিষয়ে
তাঁর বিখ্যাত গান-
“বাংলার মাটি বাংলার জল,
বাংলার ফুল বাংলার ফল
এক হোক এক হোক
এক হোক হে ভগবান”
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
দেশ এবং রাজনীতি সম্বন্ধে চিন্তায় তিনি ছিলেন সারা
ভারত বর্ষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তিত। দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন,
শ্রেণি বৈষম্যজনিত বিভাজন, হিন্দু ধর্মের মধ্যে বর্ণ বৈষম্যগত বিভাজন। এ ছাড়া ও
রয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রের আলাদা আলাদা মাধ্যমে শিক্ষার জন্য চিন্তার ঐক্যের অভাবে
সৃষ্ট বড় রকমের চেতনাগত বৈষম্যর সংকট। দেশের মানুষের মানসিক উন্নতির জন্য শিক্ষা
ভাবনাও ছিল রাজনৈতিক চিন্তার অঙ্গীভূত বিষয়।
তিনি তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন-
“আজ অন্ধকার রাত্রির অবসান হোক তরুণদের নবজীবনের
মধ্যে। আচারভেদ মতভেদ ধর্মভেদ ,স্বার্থভেদের সমস্ত ব্যবধানকে বীরতেজে উত্তীর্ণ হয়ে
তারা ভ্রাতৃপ্রেমের আহ্বানে নবযুগের অভ্যর্থনায় সকলে মিলিত হোক। দুর্বল যে সেই
ক্ষমা করিতে পারে না, বলিষ্ঠ তারুণ্যের ঔদার্য সকল প্রকার কলহের দীনতাকে নিরস্ত
করে দিক। সকলে হাত মিলিয়ে দেশের সর্বজনীন কল্যাণকে (common wealth) অটল ভিত্তির
উপর প্রতিষ্ঠিত করি।”
সাম্রাজ্যবাদী, মানববিধ্বংসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে
সংঘবদ্ধ হয়ে ‘নূতন সৃষ্টির উপকূলে/ নূতন বিজয়ধ্বজা তুলে’ উত্তরণের আহবান জানিয়েছেন
রবীন্দ্রনাথ ঝড়ের খেয়ায় চড়ে। দীর্ঘ এ-কবিতাটির বিশেষ একটি পঙ্ক্তি – (‘এ আমার এ
তোমার পাপ’) নিয়ে সংগত প্রশ্ন তুলেছেন লেখক এই বলে যে, ‘পাপ করেছে পাশ্চাত্যের
সাম্রাজ্যবাদ। তারাই যুদ্ধ বাধিয়েছে। অথচ কবি সকলকেই এক কাতারে ফেলেছেন। কারণ কবির
মতে সকল মানুষই অবিভাজ্য।’
রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানমনস্কতা যা শুধু বিশ্ব পরিচয়
রচনাতেই নয়, পরিস্ফুট তাঁর কবিতায়, তাঁর গদ্য রচনায়, তাঁর সামাজিক সংস্কারের
বিরুদ্ধে লেখা নাটকে ও প্রতিবাদী আচরণে। যেমন বিহার-ভূমিকম্পে গান্ধীর অন্ধ
সংস্কারবাদী মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, তেমনি মার্গারেট ম্যাঙ্গারের জন্মনিয়ন্ত্রণ-বিষয়ক
আধুনিকতার সমর্থনে যদিও এক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর আপত্তি ছিল। পদার্থবিদ্যার জটিল
বিষয়কে সহজভাবে তুলে ধরার প্রয়াস এমন সার্থক রচনা আমাদের বিস্মিত করে।… কবি
জীবনরহস্য, সৃষ্টিরহস্য ও মানবচেতনা সম্পর্কিত যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তার
মধ্যে বিজ্ঞানের ছোঁয়া আছে।’ শেষ দশকের বিজ্ঞানমনস্ক, মৃত্যু সম্পর্কে বাস্তববোধের
অধিকারী রবীন্দ্রনাথকে তাই পূর্বাপর অধ্যাত্মবাদী পরিচয়ে চিহ্নিত করা সঠিক কিনা তা
ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করি।
সন্ত্রাসবাদ নীতি হিসেবে সমর্থন না করেও বিপস্নবীদের
দুঃসাহসী আত্মদানের ভূয়সী প্রশংসা রবীন্দ্রনাথের। এ-বিষয়ে একটি রাবীন্দ্রিক
উদ্ধৃতি-সহযোগে রনোর মন্তব্য : ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে সঠিকভাবে ধরেছেন যে, রাষ্ট্র
বিপ্লব বিচ্ছিন্ন কয়েকজন ব্যক্তির কাজ না। গণ বিপ্লবে বিশ্বাসী মার্কসবাদী
কমিউনিস্টদের সঙ্গে তার চিন্তায় এখানে মিল রয়েছে। তিনি কখনও সশস্ত্র বিপ্লবে
বিশ্বাস করতেন না।’
একথা ঠিক যে, শোষিত ‘ইউরোপীয় শ্রমজীবীদের গুমরে মরার
পেছনে বিপস্নবের সম্ভাবনার’ কথাও উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এমন ছিল
পর্বপর্বান্তরে রাবীন্দ্রিক স্ববিরোধিতা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায়
রবীন্দ্রনাথের সুস্পষ্ট সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ভূমিকা, যার শুরু উনিশ
শতকের শেষদিক থেকে, সেইসঙ্গে তিনি যুদ্ধবিরোধী ও বিশ্বশান্তির প্রবক্তা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা এবং বাঙালিকে এনে
দিয়েছেন আত্মসম্মান, আত্মগৌরবের অধিকার। আজ আমাদের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে
যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা বহু পূর্বেই যে সংকট সৃষ্টি হচ্ছিল সে সম্বন্ধে
তিনি তাঁর মতামত দিয়েছেন। তরুণদের বিষয়ে তিনি ছিলেন আশাবাদী। তারুণ্যকে যথার্থভাবে
শিক্ষার মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে গড়ে তুলবার ইচ্ছা তাঁর লেখায় ব্যক্ত
হয়েছে। সার্বজনীন কল্যাণাকাঙ্ক্ষা তাঁর উন্নত রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই পরিচয় বহন করে।
তিনি তার জাতীয়তাবাদকে দেখেছেন বোধের গভীর থেকে। অন্তরাত্মার বিশ্বাসের ধ্বনি
হিসেবে। যার সমন্বয় করতে চেয়েছেন তিনি বিশ্বমানবের সর্বজনীন চেতনার আলোকে। তিনি
পশ্চিমা জাতিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন, উপেক্ষা করতে পারতেন তাদের ভোগবাদী ও জীবনবাদী
চিন্তাধারা। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং তিনি পশ্চিমা ভাব ও দর্শনকে সাদরে গ্রহণ
করেছেন। নিতে চেয়েছেন নির্যাষ। মিলাতে চেয়েছেন ভারতবর্ষের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে।
একইভাবে তিনি ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও চিরন্তন সৌন্দর্যকে বিলাতে
চেয়েছেন জগতের আনন্দযজ্ঞে। কারণ ইউরোপ যেমন একদিকে সৃষ্টি করেছে সাম্রাজ্যবাদ ও
সামরিকতন্ত্র। অন্যদিকে ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতাও তাদেরই অবদান। আবার
রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং তার জীবনযাপন ও বিশ্ব ভ্রমণ তাকে
উদারনৈতিক চেতনায় গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তার জীবনবোধ ও অধ্যয়ন ও ব্যক্তিত্ব
বিশ্বমানবে পৌঁছে দিয়েছে। তাই তিনি যখন আন্তর্জাতিকতার কথা বলছেন, তখন একই সঙ্গে
ভারতবর্ষের স্বাধীনতাও চাচ্ছেন। সমর্থন করছেন গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত দেশের
স্বাধীনতা আন্দোলনকে। বিগত শতকের ৫০-এর দশকে ভারতবর্ষে সর্বজনীনতার ধারণাকে ভিত্তি
করেই জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়। এই জাতীয়তাবাদের মূল সুর ছিল উন্নত মূল্যবোধ এবং জ্ঞান
ও সমতার চেতনা ভিত্তিক স্বাধীনতা। রবীন্দ্র আদর্শ থেকেই এ চেতনার স্ফূরণ ঘটে।
মনের কথা
মধুবনী চ্যাটার্জী
আমার এক ছাত্রী গত সন্ধ্যেবেলা জাহ্নবীতে রিহার্সাল সেরে রাত
৯টায় আমার অন্য মেয়েদের সঙ্গে পাটুলি তে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোয় । আমার বলাই থাকে বাড়ি
পৌঁছে খবর দিতে । একটু আগে সে
আমায় জানালে , রাস্তায়
একটি মধ্য বয়সী লোক তাকে অনুসরণ করে এবং অত্যন্ত নোংরা কথা বলতে থাকে । আমার
ছাত্রী কোনো ক্রমে তার বাড়ি অবধি পোঁছে তারপর চিৎকার করে প্রতিবাদ করে । Caretaker
ও অন্যান্য লোক লোকটিকে ধরে ফেলে । আপাতত সে পুলিশ হেফাজতে ।
আমরা সত্যি কোনো সভ্যতায় আছি ? এ কোন দেশ ? কোন রাজ্য ? এত বিকৃত মানুষ পথে
ঘাটে ....এত নির্লিপ্ত আমরা কি করে থাকি যখন বিপদ আমার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে ?
শুনলাম সহানুভূতিশীল মহিলার দল এসে আমার মেয়েটির
পোশাক সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিলেন ! নাচের পর
আমার মেয়েরা সালোয়ার কামিজের ওপর ওড়না জড়িয়ে বাইরে বেরোয় ....ওড়নাটি সঠিক ভাবে
ছিলো কি না , তার
ফিরিস্তি তাঁরা চাইছেন ! আমার মেয়েটি
এই মুহূর্তে বিপর্যস্ত ! আর কতো নিচে
নামবো আমরা । মহিলা হয়ে
মহিলার সম্মান নিয়ে খেলা করি ! পুরুষ হয়ে
কাপুরুষের মতো সাক্ষী দেবার ভয় পালিয়ে যাই । তারপরেও নিজেদের মানুষ বলে দাবী করি .....ধংসের মুখে
দাঁড়িয়ে এখনও বোধ নেই যে আমরা কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি ! সমাজ নামক নিদারুণ প্রহসনের বুকে অসামাজিক জীব .... এবার প্রস্তুত হও ! তুমিও তিরের নিশানায় আছো ...
শুধু সময়ের অপেক্ষা ....
আমার মেয়েটির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং তাকে ঘিরে
সমাজের চেহারা কাল সারা রাত আমায় ঘুমোতে দেয় নি । যখনই এই বিকৃত সমাজ কে দেখি একটি কথা আমার মনকে
শিউরে তোলে ....। আমরা দেবীর
পুজো করি । তাঁর মৃন্ময়ী প্রতিমা এক নারী মূর্তি । উন্নত স্তনযুগল , সুডৌল কটিদেশ , গভীর নাভিস্থল , ভারী নিতম্ব , ঘন জঙ্ঘা .....দশভূজা
মা । তবে কি এই
বিকৃত সমাজের চোখ এই দেহকেও তাদের পাপ দৃষ্টিতে কলুষিত করে ? কারণ এদের কাছে মা
শব্দটির কোনো অর্থ নেই । এরা মাতৃযোনি সম্ভূত নয় । এরা পাপ থেকে জন্ম নিয়েছে । যে পাপ যুগে যুগে
মেয়েদের পায়ে দলেছে ...ধর্ষণ করেছে ,
হত্যা করেছে । আজকের
সমাজের কাছে নারীর একটিই পরিচয় ...তার দেহ ! সেই সমাজে যখন দশভূজা আসেন তখন তিনিও তো সেই দেহই
.... তাই তো মন্দির থেকে যে মুহূর্তে তিনি বের হন , ছিন্নভিন্ন হতে থাকেন । তারপর যখন জলে ভাসেন ...যেন
ধর্ষিত এক নারী ! অর্ধ উলঙ্গ , ছেঁড়া চুল , সিঁদুর লেপা অসহায় এক
মুখ ! আমাদের
সমাজে জগজ্জননীর মুখ ! ঘরে ঘরে
তিনি নির্যাতিতা । বাবার হাতে
, ভাইয়ের হাতে , স্বামীর হাতে , পুত্রের হাতে এবং সর্বোপরি অশিক্ষিত নারীত্বের
হাতে । তাই যে সমাজ মিথ্যা পূজার আড়ালে হায়নার দৃষ্টি নিয়ে নারী দেহ ভোগে মা কেও রেহাই দেয় না , তার এই পরিনতি
অবশ্যম্ভাবী । আর বাকি রইলেন সমাজের মহিলারা। আচ্ছা , তাঁরা কি জানেন , যে দেবীর পায়ে মাথা
ঠুকে মাথা ফুলিয়ে ফেলেন , সেই দেবীর
কোনো পিতৃপরিচয় নেই ! যাঁর মাথার
সিঁদুরের জন্য বেতো পায়ে , ভাঙা
হাঁটুতে পর্বত লঙ্ঘন করে ফেলেন , সেই মা
কুমারী ! এবং যে
সন্তানরা মা কে ঘিরে থাকেন , তাঁরা তাঁর
পালিত সন্তান ! ভয় হয় , যেদিন এই সত্যটি
জানাজানি হবে সেদিন দশভূজা মাও কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন ! সমাজ তাঁর বিচার করবে ....জিগ্গেস করবে পায়ে বসা
সুদর্শন মহিষাসুরটির সঙ্গে কতো যুগের প্রণয় ? ওই স্থানে
বসে পুরুষটি মার শরীরের কোন অংশটি দেখতে পায় ? ছি ছি ...মা বুকের আঁচলটা আর একটু কষে নিতে পারতেন
না ? হোক ...হোক
...আমাদের দেহের বিচার , মনের বিচার
, নারীত্বের বিচার যদি
প্রতিদিন হয় , তবে তাঁরও
হোক । তিনি তো
আমাদেরই প্রতিভূ ! তাই বলি মা
, এ অসুরকে যদি চিনতে তবে
সহস্রভুজা হয়ে আসতে । ওটিও হয়েছো
, তবে বিজ্ঞাপনে.... কিছু
মানুষকে পয়সা পাওয়াতে ! কারণ এখন
এরা তোমায় বেচে বাঁচে ! এবার যখন এই
ভোগরাজ্যে দেহ ভোগীদের মাঝে আসবে , অস্ত্র ফেলে দশ হাতে নিজের দেহকে ঢেকে রেখো মা .....নিজের লজ্জা
বাঁচাতে এবার দশভূজা
হয়ে এসো .... এই বিকৃত সমাজে তুমি সুডৌল দেহী পুতুল মাত্র , আমরা যেমন দেহ সর্বস্ব
জীব .....।
গল্প
আমরা মানুষ নই..
অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী
আমাদের
ছোটবেলাটা শৃঙ্খলেই কেটেছে। হাগু-মুতু কোল ভরে, অথবা খুব জোর ঘরের আনাচ কানাচ। তবুও শৃঙ্খল মুক্ত হইনি।
একটু
বড় হতেই মুক্তি পেলাম। তখন বাড়ির উঠোন এবং সামনের রাস্তা। ক্রমে রাস্তা পেরিয়ে
মাঠ।
তারপর
একদিন মাঠের ওপারে অবধারিত হিসেবে আমার প্রেম হলো মিঠুয়ার সাথে।
মিঠুয়া
আমার চেয়ে ছোটই হবে। মিঠুয়াকে নিয়ে আমার আনন্দ থামে না। মাঠ, ঘাট, জমির আল, পুকুর
পাড় সব জায়গায় শুধু আনন্দ আর আনন্দ।
লালু, বিট্টু, কালিয়া, আরো
জনাকয়েক আমরা একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম।
কিন্তু
বাদ সাধলো মিঠুয়ার বাড়ির লোক দত্তখুড়ো। আমার মনিব সাধন প্রমানিককে একদিন ডেকে আচ্ছা
করে দু’চার কথা শুনিয়ে দিলেন—শুনুন, আপনার তিলককে আপনি সামলান। এপাড়ায় এলে কিন্তু আমি ওর হাড়
ভেঙে দেবো।
--আরে
থামুন, থামুন। আমার বাড়ির কাউকে এতটুকু টাচ্
করেই দেখুন না, আপনাকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।
তাদের
ঝগড়া চলতেই থাকলো....চলতেই থাকলো... এ ওর মুখোশ ধরে টানাটানি করতে করতে অবশেষে
মানব সভ্যতার অসহ্য কঙ্কালগুলো বেরিয়ে আসতে লাগলো ক্রমশ।
আমি
কিন্তু মিঠুয়াকে, মিঠুয়া আমাকে
ছাড়া থাকতেই পারলো না। কেন থাকবো? আমাদের মধ্যে কোনো মিথ্যে
মুখোশ নেই যে।
আমাদের
বন্ধুদের মধ্যেও মারামারি হয়। চিৎকার হয়। তবু আবার একসঙ্গে মিলে পাড়ার অনুষ্ঠান বাড়িতে গিয়ে দেখা করি। বন্ধুত্বের পুনর্মিলন হয়।
আবার
মারামারি হয়... আবার মিলন হয়...কিন্তু কখনো কঙ্কাল বেরিয়ে আসে না।
কারণ
আমরা মানুষ নই। কুকুর।
ভূতের পরিচয়
শৈলেন্দ্র
নাথ চক্রবর্তী
গগন বাবু প্রায় আশি
ছুঁই ছুঁই। সর্বদা হাসিমুখ ভোলেভালা।
ছিটেফোঁটা দেমাক নেই। বাচ্চাদের নিয়ে মেতে থাকেন।
বাচ্চারাও তাকে আহ্লাদে দাদু , গল্প দাদু বলতে অজ্ঞান। ওদের
আজকের আব্দার ভূতের গল্প। ডালি খুলেছেন গগন বাবু।
শোনো ওরা তিন ভূত। লম্বা ভূত , বেঁটে ভূত আর মোটা ভূত।
' মালঞ্চ ' পুকুরের ধারে ঐ যে বুড়ো বট ওরই ঝুরি ধরে
দোল খায়। নিজেদের মধ্যে চিঁহি চিঁহি স্বরে কথা বলে। রাস্তা দিয়ে চলা লোকেরা
শুনতে পায় না। তাদের একটুও বিরক্ত করে না।
শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কারোর কোনো ভালো করার।
-- ধূর ভূতেরা আবার মানুষের ভালো করে নাকি ? - আরে
শোনো শোনো একদিন কি হলো জানো ? বটগাছের পাশ দিয়ে
যে মেঠো রাস্তা ঐ রাস্তা দিয়ে সবে জন্মানো এক বাচ্চাকে নিয়ে
বাড়ি ফিরছিলো এক চাষী আর তার বউ। মাঝ দুপুর, মাথার
উপর গনগনে রোদ, সঙ্গে ছাতা নেই। সদ্যোজাত বাচ্চাটির
প্রাণ
বেরিয়ে যাবার জোগাড়। ঠিক তখনই রাস্তার ওপাশ দিয়ে
একটা অল্পবয়সী ছেলে ছাতা মাথায় সাইকেল চেপে কোথায় যেন যাচ্ছিল। ভূত তিনটে
লাফিয়ে লাফিয়ে এসে ছেলেটার হাত
থেকে ছাতাটা কেড়ে নিলো। ছেলেটা কাউকে দেখতে না পেয়ে
ভয়ে পড়ে গেল সাইকেল থেকে। ছাতা নিয়ে ভূতেরা
বাচ্চা- কোলে বউটার মাথায় ধরলো আর বললো ' তাঁড়াতাঁড়ি চঁলো
তাঁড়াতাঁড়ি চঁলো। ' ভয় পেয়ে বউটা আর তার স্বামী
জ্ঞান
হারাবার উপক্রম। পড়েই যাচ্ছিল। ভূত তিনটে ধরে ফেললো
তাই রক্ষে।
ওদের মুখে ' ভঁয় নেঁই
ভঁয় নেঁই ' শুনে আস্তে আস্তে হাঁটা
লাগালো কত্তা- গিন্নি বাড়ির দিকে। গাঁয়ের মানুষের
চোখ
ছানাবড়া। একটা ছাতা শূন্যে ভেসে ভেসে চলছে। ধারককে
কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কেউ ভয়ে রা
কাড়ছে না।
তারপর ? তারপর কি হলো
দাদু ? গগন বাবু বলতে বলতে
মাঝেমাঝেই গল্প থেকে হারিয়ে যান। ছোটরা নাছোড়। দাদু
শুরু
করেন-- তারপর আর কি ? সেই কত্তা- গিন্নিকে বাড়ি
পৌঁছে দিয়ে ছাতা নিয়ে ফিরে এলো ভূতেরা। সেখানে তখন আর এক অবস্থা। ছাতার মালিক
ছেলেটি মাটিতে অজ্ঞান একদিকে তার
সাইকেল আর একদিকে। কোথা থেকে জল এনে ছেলেটির
চোখেমুখে দিতে দিতে ভূতেরা বলছে ' ভঁয় নেঁই ভঁয়
নেঁই। উঁঠে পঁড় তাঁড়াতাঁড়ি। চঁলে যাঁ নিঁজের বাঁড়ি। ' ব্যস গল্প শেষ।
না না দাদু ছাড়লে হবে
না। আর একটা চাই। বলোনা
দাদু আর একটা গল্প। -- বেশ শোনো। অনেক অনেক দূরে ভিন
রাজ্যের এক গ্রামে ওরা ছিলো তিন ভাই। কালু , ভুলু আর
তলূ।
একজন বারো , অন্য দুজন দশ আর আট। খুব দুরন্ত দামাল।
অপাট- কুপাটে জুড়ি নেই। বেশ ধনী ঘরের ছেলে। তার উপর
ছিলো ওদের দাদু। নাতি বলতে অজ্ঞান। আস্কারায় আস্কারায়
একেবারে তাল গাছে তুলে দিতেন। বাড়িতে যা যা আছে
টিভি,
ক্যামেরা , আলমারি , ফ্রিজ , রোজ কিছু না কিছু
ভাঙছে। দেয়ালে পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছে। লোভনীয় কিছু খেতে
রান্নাঘরে ঢুকে হাঁড়ি, গামলা সব উল্টে ফেলা। ভাত,
ডাল, তরকারি সব মেঝেয় গড়াগড়ি। এমনধারা আরো অনেক কাণ্ড।
আবার পাড়ার কোনো খড়ের চালের বাড়িতে আগুন লাগলে
দৌড়ে সেখানে হাজির।হাতে হাতে জলের বালতি। কারো অসুখ
বিসুখে রিক্সা , ভ্যান ডেকে আনা। অনেক দূরের ওষুধের
দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনা সবেতেই তিন ভাই। লম্বা, বেঁটে
আর মোটা। এমনকি কেউ মারা গেলে শ্মশানেও ওরা তিনজন।
বাড়ি থেকে লুকিয়ে বড়ো একটা পুকুরে ওরা চান করতে
গেলো। ছোট দুভাই সাঁতার জানতো না। তাদের ডুবে যেতে দেখে বড়ো ভাই তাদের বাঁচাতে
ঝাঁপালো। সে সাঁতার জানলেও
ছোটো ভাই দুটি তাকে জড়িয়ে ধরাতে সেও তাদের নিয়ে
আস্তে
আস্তে তলিয়ে গেলো।
থাক দাদু আর বলতে হবে
না। তোমার দুচোখে জল।
কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে। কেন দাদু ? ওরা কি তোমারই নাতি
ছিলো ? যারা মরে গিয়ে ঐ তিন ভূত হয়েছে ?
ধারাবাহিক
নিদ্রাহারা রাতের এ গান
মণিমেখলা মাইতি
( আইসল্যাণ্ড)
(05/06/2018--07/06/2018)
"A story has no beginning or end: arbitrarily one
chooses that moment of experience from which to look back or from which to look
ahead"
মনে হল শেষ থেকেই শুরুটা
করলে কেমন হয়। শেষপাতের চাটনি বা আইসক্রিমটা একটু লোভের বশে আগে খেয়ে ফেললে খুবই
কি ক্ষতি হয়!! তারপর না হয় আবার নুন লেবু দিয়ে শুরু করা যাবে। আপরুচি খানা। রসনাকে
যেমনভাবে আস্বাদিত করব তেমন ভাবেই স্বাদগঙ্গায় সে ডুব দেবে। কোথায় যেন শুনেছিলাম
একজন ভদ্রলোক চাটনি দিয়ে খাওয়া শুরু করে শেষ পাতে তেতো পছন্দ করেন। ব্যাপারটা আমার
বেশ মনে ধরেছিল। তাই প্রচণ্ড দাবদাহে শেষপাতের আমের চাটনি দিয়েই শুরু করলাম।
পর্ব-1
05/06/2018
ঝকঝক করছে কোপেনহেগেন এর
সকালটা। সূর্য উঠল ভোর চারটে নাগাদ। চমৎকার নরম লাল আলো তার রক্তিমরাগ ছড়িয়ে আমায়
জাগিয়ে দিল। সবেমাত্র
তিনঘন্টা হল ঘুমিয়েছি। নিজের এক অত্যন্ত জরুরী কাজ আটকে গেছিল রাতে। কিছুতেই করতে
পারছিলাম না। তাই আবার সকালে উঠে চেষ্টা করার জন্য উঠে পড়েছি। কিন্তু চোখদুটো আটকে
গেল সদ্য ঘুম থেকে ওঠা শহরটার দিকে তাকিয়ে। আস্তে আস্তে হাই তোলা শুরু করেছে
পদ্মকলির মত। সমুদ্রের সব শাখা প্রশাখা জালেরমত শহরটা ছেয়ে ফেলেছে। শহরের টুকরো
গুলোকে এক একটা পেল্লায় ব্রিজ সুন্দর করে জুড়েছে। আমার রুম থেকে দেখা যায় ওমন একটি
ব্রিজ। ব্রিজের
ওপারে কালো রঙের সুন্দর গীর্জাখানি দাঁড়িয়ে। ওটা আর দেখতে যাওয়ার সময় পেলাম না।
পেছনে এরোপ্লেনের ছবিসহ একটা 5C বাস ব্রিজটা পেরিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে চলে গেল। ছ
তলা থেকে দেখছি আমি। সারারাত মিনিটে মিনিটে সব উড়ান ওঠানামা করছে। একটু পরেই ওই
বাসটা ধরেই আমরাও ছুটব বিমানবন্দরের দিকে। আজই তথাকথিত স্ক্যানডিনেভিয়ার মূল
ভূভাগ ছেড়ে আমরা
ভূগোলবই এর পাতায় পাড়ি দেব। মনটা যেন শূন্য হয়ে গেল হঠাৎই। কারণ জানিনা।
সকাল নটা নাগাদ সমস্ত
বোঁচকা বোঁচকি নিয়ে হোটেল থেকে বেরোতেই একটু হিমেল হাওয়ার সঙ্গে ধাক্কা খেলাম।
তার আগে লিফট এর সঙ্গে জোর ধস্তাধস্তি হয়েছে। প্রত্যেকটা ফ্লোরে চারটে করে লিফ্ট
হোটেলে। রুমের কার্ড ঠেকালে সেটি আপনা আপনি বলে দেবে কোন লিফ্টএ যেতে হবে। তখন চেক
আউট এর টাইম শুরু হয়েছে। ষোলতলা থেকে সবাই নামছে একে একে। আমাদের চারজনের
জিনিষপত্র সমেত আমাদের ঢোকার জায়গা নেই। এক লিফট থেকে অন্য লিফটে ছুটছি। আমাদের
মর্জিমাফিক নামলে হবেনা, লিফট এর মর্জিমাফিক নামতে হবে। ছতলা থেকে নামতে মিনিট
দশেক লাগল। সবসময় যন্ত্রচালিত জীবনযাপনের কিছুতো ফলভোগ করতেই হয়। হোটেলের পাশেই 5C
বাসের স্টপ। পাঁচ
মিনিট অন্তর অন্তর এয়ারপোর্ট ছুটছে। আর ইওরোপের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সময়জ্ঞানতো
যারা এসেছে তারা জানে। তাই ট্যাক্সি চাপা বাতুলতা।
নির্দিষ্ট সময়ের প্রায়
দেড়ঘন্টা পর উড়ান ছাড়ল। এই প্রথম ইওরোপে দেখলাম ফ্লাইট দেরি করল। আগে কখনো এ
অভিজ্ঞতা হয়নি। সুন্দরী কোপেনহেগেনকে বিদায় দিলাম। অসামান্য সুন্দরী এ শহর। সে
বর্ণনা পরে দিচ্ছি। ওপর থেকে অনেকটা কোচির মত দেখাচ্ছে। নীলজলের শিরা উপশিরা সারা
শহরজুড়ে ছড়িয়ে আছে।সবুজের মাঝে মাঝে লাল টালির ছাদওয়ালা সারসার বাড়ি। একটা শহর
পরিকল্পনা মাফিক হলে তা এক অন্যমাত্রা পয়।তবে কোচি শহরকেও দারুণ দেখায় ওপর থেকে। কখন যে দুটো
চোখের পাতা এক হয়ে গেছে বুঝিনি। ধড়মড়িয়ে উঠলাম যখন মিষ্টিন বলছে --'' মা দেখ দেখ
নীচে কীরকম লাগছে"।
মুখ বাড়িয়ে দেখি সব
বাদামী রঙের পাহাড় বেশ অদ্ভুত রকমের। হয়তো আয়ারল্যাণ্ডের উপর দিয়ে উড়ছি। আমরা
উড়ানের বামদিকে বসেছি। তার পরেই নীল, সুনীল জলরাশি অর্থাৎ অতলান্তিক। ইওরোপ
মহাদেশের কোস্টলাইন সুন্দর দেখা যাচ্ছে। ছোটবেলায় তো কোনদিন উড়ানে চড়ার সৌভাগ্য হয়নি।
নিজের জলপাণিতে কেনা চণ্ডীচরণের মানচিত্রে সারাপৃথিবী আমি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে
ঘুরে বেড়াতাম। পরে এরোপ্লেনে চড়ার পর ওপর থেকে বিভিন্ন দেশ দেখে মনে হয়েছে ভূগোলটা
এভাবে পড়লে আমার প্রিয় বিষয়টি হত বদলে যেতে পারত। আবার কখন চোখের পাতা দুটো এক হয়ে
গেছে ক্লান্তিতে। টানা পনেরদিন এতবার টাইমজোন পরিবর্তন করেছি যে শরীরের ঘড়ি ঠিক
তাল রাখতে পারছেনা। ঘুম আমার চোখ থেকে প্রায় ছুটি নিয়েছে। বুঝলাম সে এবার গুছিয়ে
প্রতিশোধ নিচ্ছে।
আবার একটু পরে ঘুমটা
ভেঙে গেল। পাতাদুটো আলাদা করে মিষ্টিনকে ডিঙ্গিয়ে জানালায় মুখখানা বাড়িয়ে দিলাম।
তীব্র রোদ মুখে আছড়ে পড়ল। নীচে বরফ নীল জলে পাতলা পাতলা বরফ ভাসছে। এমনতো কোনদিন দেখিনিরে
বাবা। বরফঢাকা হিমালয় পেরিয়েছি বহুবার, বহুবার আল্পস পেরিয়েছি এমন বাপু দেখিনি যে
সমুদ্রের ওপর পাতলা বরফমত ভাসছে।
কৌতুহল বশে মুখটা একটু ডানদিকের জানলার দিকে বাড়াতে ঠোঁটদুটোর লকগেট আপনা আপনি
খুলে গেল। পুরো ভ্যানিলা আইসক্রিমের স্টল। বুঝলাম উত্তর নরওয়েকে ডানদিকে রেখে চলেছি। পুরো সাদা
বরফে ঢাকা। মাঝে মাঝে কালো জল। কিছু অংশে আবার বরফ গলে
গিয়ে কালোর ওপর সাদা ডোরাকাটা দাগ কেটেছে। উত্তর সুইডেন দেখতে পাচ্ছি। আকাশ তার
সবটুকু নীল রং ঢেলে দিয়েছে তার গায়ে। সবে শীতকাল গেছে। ছমাসের রাত্রিযাপন শেষ
করেছে এরা। সারা
উত্তরমেরু জুড়ে
গ্রীষ্মকে বরণ করার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে প্রকৃতি। কতরকমের ফুলে সে নিজেকে
সাজিয়েছে। পায়ে হলুদ হলুদ ঘাসফুল ও বেগুনী ল্যাভেণ্ডারের নুপূর, মাথার চুলে অদ্ভুত রঙের
রডোডেনড্রনের গুচ্ছ, সারা শরীর জুড়ে কতরকমের ফুল-সজ্জা। ইওরোপ সবচেয়ে রমণীয় মে
মাসের মাঝামাঝি সময়ে। বরফের পুরু চাদর সরিয়ে গাছগুলো অপূর্ব সবুজে নিজেদের রাঙিয়ে
নিয়েছে। সে সবুজ সব চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। সে প্রসঙ্গে পরে আসব যখন
পিছু ফিরব। তবে উত্তর ইওরোপ এখনো পুরু বরফের চাদরে ঢাকা। সে চাদর সহজে সরবার নয়।
যত উত্তরে চলেছি তত
বরফের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। যে উদাসীনতা আমায় গ্রাস করেছিল টের পেলাম সেটা ধীরে
ধীরে কেটে যাচ্ছে। আচ্ছা এটাই কি Antonio র 'sadness' যেটি ' Merchant of Venice
'এ শেক্সপিয়র বলেছেন? কীজানি বাপু! আজ আমাদের গন্তব্য উত্তর অতলান্তিকের কোলে
ইওরোপ মহাদেশের লাভা ও আগ্নেয়গিরির দেশ, ছমাস দিন-ছমাস রাত্রিযাপনের দেশ, উত্তর
মেরুপ্রভার দেশ আইসল্যাণ্ড। প্রায় একলক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এ দেশের বিস্তৃতি। অফিসিয়াল
ভাষা আইসল্যাণ্ডিক আর রাজধানী -- রিইকাভিক।
যদিও আইসল্যাণ্ড
প্রজাতন্ত্র হয়েছে সবে 1944 সালে, দেশটির পত্তন কিন্তু প্রায় আটের শতকে। যখন
নরওয়ের আরনারসন প্রথম এর স্হায়ী অধিবাসী হন। তার পর একে একে আসতে থাকে নরউইজিনান,
স্ক্যানডিনেভিয়ান রা। তারপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসকদের হাতে শাসিত হয়ে প্রায়
একশ বছর আগে দেশটি স্বাধীনতা পেয়েছে।
কিন্তু যতই এগোচ্ছি
উত্তরে আকাশখানার মুখটা দেখছি গোমড়া হচ্ছে আস্তে আস্তে। টানা পনেরদিন সূর্যদেবের
খালি হাসিমুখটাই দেখেছি যেটি সহজে হবার থাকেনা। কিন্তু আইসল্যাণ্ডে এই সময়ে এটাই
দস্তুর। আবহাওয়া ভীষণ ই তার মর্জিমাফিক চলে। সে চলুক। আমরা ঠিক তাল দিয়ে দেব। খুব
লোভ হচ্ছে ডানদিকের জানালায় চলে যাই। ভগবানের এটাই বিচার। আমাদের দরকার ছিল ডানদিক
কিন্তু দিল এমন সব গোমড়া সাহেব আর চীনাদের তারা সব উড়োজাহাজের জানালার খিড়কি টেনে
ঘুমোচ্ছে নয় মোবাইল দেখছে। ইওরোপের যে অংশে ঘুরলাম এবার সে অংশে দু তিনটি ভারতীয়
পরিবার কিঞ্চিত দেখেছি। বাঙালি তো কোপেনহেগেন ছাড়া কোথাও পাইনি, বাকী সব চীনা নয়
জাপানী। ঝাঁকে ঝাঁকে, দলে দলে ইওরোপ এসে সব কিলবিল করছে। সারা ভারতে যেমন
বাঙালিদের কিলবিল করতে দেখা যায়। সব দ্রষ্টব্যস্হানে হামলে পড়ছে। এত সংখ্যক মঙ্গোলীয়
পর্যটক কোথাও দেখিনি। খুব দুঃখ দুঃখ মন করে বাবাকে বললাম মোবাইলটা দাও জানালার
ধারে বসা বিদেশিনীকে, দুটো ফটো তুলে দিক। এদের আবার ফটো তোলাতেও কিপ্টেমি। একটা
তুলে ফেরত দিল। আবার পাঠাতে বললাম।
ধীরে ধীরে উত্তেজনার
পারদ এবার চড়ছে। মিষ্টিন খালি নীচে দেখে লাফাচ্ছে --' মা দেখ কী সুন্দর!'
আইসল্যাণ্ডের তটভূমি দেখতে পাচ্ছি অতলান্তিক বরাবর। মাঝে মাঝে শুভ্র সফেন বরফওয়ালা
পাহাড়। কিছু কিছু সাদা বাড়িঘর চোখে পড়ছে। আমরা নীচে নামছি পাখির মত ধীরে ধীরে। শেষ
অবধি পাইলট মাখন
মাখানো রানওয়ে তে মসৃনভাবে ওয়াও এয়ারের চাকাগুলো ছুঁইয়ে দিল কেপলাভিক আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে। আইসল্যাণ্ডের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আইসল্যাণ্ডের রাজধানী
রিইকাভিক থেকে প্রায় ছেচল্লিশ কিলোমিটার দূরে কেপলাভিকে। রিইকাভিকএ একটা বিমানবন্দর আছে তবে
সেটা অতীব ছোট। বিমানের দরজা থেকে বেরিয়ে যখন পা দিলাম এ ভূমিতে মনে হল '' না জানি
কোথায় এলেম"। স্বপ্ণেও কোনদিন ভাবিনি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সুদূর
ভারতের প্রত্যন্ত এক মফস্বলে বড় হয়ে মেরুপ্রভার দেশে পা দিতে পারব যে দেশটির কোন
অস্তিত্ব ছিলনা আমার মনোজগতে, শুধু স্বপ্ণে আবছা আবছা দেখতে পেতাম, ছুঁতে পারতাম
না।
( ক্রমশঃ)
অনুবাদ কবিতা
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
নবারুণ ভট্টাচার্য
অনুবাদঃসুকন্যা
বন্দ্যোপাধ্যায়
যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চীৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহ্ত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
.৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়
লক-আপের পাথর হিম কক্ষে
ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও
লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার স্টেনগানের
গুলিতে সেলাই হয়ে
যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার
একান্ত দরকার।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে
মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত
দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে
আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।
হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খন্ড খন্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা
আ্যালকোহল
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিকৃত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে
গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভীক।
চেয়ে দেখো মায়াকোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার
চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।
গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ণায় কুচিলা
টঙ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গান্ডীবের ছিলা
তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা-
ভল্ল তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুকরি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার কনভয়ের মিছিল
চলমান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই-
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।
যে মৃত্যু রাত্রির শীতে জ্বলন্ত বুদবুদ হয়ে উঠে যায়
সেই দিন সেই যুদ্ধ সেই মৃত্যু ডেকে আনো
সেভেন্থ ফ্লিটকে রুখে দিক সপ্তডিঙা মধুকর
শিঙা ও শঙ্খে যুদ্ধারম্ভ ঘোষিত হয়ে যাক
রক্তের গন্ধ নিয়ে বাতাস যখন মাতাল
জ্বলে উঠুক কবিতা বিস্ফোরক বারুদের মাটি
আলপনা গ্রাম নৌকা নগর মন্দির
যখন তরাই থেকে সমুদ্রের সীমা
সারা রাত্রি কান্নার পর শুষ্ক দাহ্য হয়ে আছে
যখন জন্মভূমি ও বধ্যভূমির কাদা এক হয়ে গেছে
তখন আর দ্বিধা কেন
সংশয় কীসের
ত্রাস কী
আটজন স্পর্শ করেছে
গ্রহণের অন্ধকারে ফিসফিস করে বলছে কোথায় কখন প্রহরা
তাদের কন্ঠে অযুত তারকাপুঞ্জ ছায়াপথ সমুদ্র
গ্রহ থেকে গ্রহে ভেসে বেরাবার উত্তরাধিকার
কবিতার জ্বলন্ত মশাল
কবিতার মলটভ ককটেল
কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা
এই আগুনের আকাঙ্ক্ষাতে আছড়ে পড়ুক।
This valley of death is not my country...
I hate the father
Who fears to identify
The corpse of his son....
I hate the brother
Who still acts normally
Follows the daily mundane chores...
I hate those teachers and intellectuals,
Poets and clerks,
Whose blood doesn't boil
To avenge this death...
I hate all of them.
Eight dead men...
Their bodies block the path
Of my senses...
I lose my sanity
Gradually...
Eight pairs of eyes
Ogle at me,
I cry out loud
In my slumber...
They call by my name
In the garden...
Their untimely call,
Drives me crazy...
I want to kill myself.
I want to die....
I want to do whatever I wish.
This is the time for poetry...
Agendas on walls, flexes, stencils,
This is the time for poems...
A collage of my blood and my tears,
Written with my bones...
On the face of acute pain,
On the face of terror,
And looking straight into the eyes
Of piercing headlights of the police van...
This is the time to throw a poem,
Without a care
For the .38
And other weapons
In the murderer's hand...
This is the time
To recite a poem
Aloud.
In the stony cold of the lock up,
Wavering the post mortem lights,
In the killer's trialroom,
In the school of lie and treachery,
Amidst the fearful, sucking rule....
Let protest and poetry echo in all hearts,
Of civilians and the military men...
Let the poets of my land
Be prepared too,
Like Garcia Lorca.
Let the strangled dead
Be prepared to be sealed
By the bullets of the untraced guns....
Still it's necessary
So absolutely necessary
To surround the city with villages...
Villages of rustic poems.
This valley of death is not my country,
Neither is this pasture of wild hangmen,
This vast crematory is not my country,
Nor this gory slaughter den.
I pledge to snatch my country back...
I pledge to embrace the smoggy fall,
The twilight,
And the autumn deity's farewell...
Fireflies, fireflies, all over me...
Or the harvest of the hilly 'jhum',
Numerous hearts of grains
And fairy tales,
Flowers, rivers, beautiful belles...
I'll name each star,
After each martyr,
I'll call back the wobbly breeze,
The water of the lake
So crystal clear
Under the shady glade.
I'll call back love---
Exiled some light years far...
Unkissed, untouched...
Ever since I was born.
I'll call love back too,
On this festive occasion
Of rebellion
And revolution.
I don't accept
This interrogation under the thousand watt lamps,
Day and night...
I don't accept.
Needle pricked under nails,
Laying on ice packs,
Hanging one upside down,
Till nose bleeds like hell--
Crushing the lips with boots,
Scalding the skin with a red hot probe,
Lashing with sharp edged whip
Burning the bloody wound with alcohol...
I strictly don't accept.
Electric shock on naked skin,
Repulsive sexual crimes,
Perverted tortures and molesting acts
I say, I dont accept.
Thrashing to death,
Lynching the souls,
Shooting humans
At point blank range...
I repeat again, I dont accept.
Poems don't accept any hindrance,
Poems are weapons themselves,
They're free and fearless,
They are our tools and our arms...
Look, Mayakovsky, Hikmet, Neruda, Aragon ...
We've kept your emblems high...
We didn't allow your poems to lose.
We didn't allow your verses to die.
The whole state in union,
Is on the verge of writing a new epic..
The beautiful prosody of guerilla verses,
And the ornate rhetoric.
Let the drums rumble
Rural locales, like some coral reef,
Indigo fields, drenched in blood...
The river... hurt....
With the foamy venom of the cobra king...
Nux vomica leaves,
To quench the deadly, poisonous thirst...
The twang of Arjun's bow,
Thrown up.... to the sun... blindly..
The cruellest blade of the sharpest dart...
Your lance, beside your battle axe,
Your spear and your javelin...
The weapons to control your land, your field...
The bloodshot eyes of tribal totem,
Rumbling with the rhythm of the drums...
Guns, khukris, choppers, knives...
And a lot of courage... a lot.
So much, that fear escapes your mind...
More cranes,
Convoy of dentate bulldozers,
Huge dynamos, turbines and engines...
In procession with mobile lathe machines..
In the deepest darkness of the mines,
Methane, from landslided coal,
Glowing bright, like diamond eyes...
By the marvellous hammer of steel.
A thousand hands lifted to the sky,
The sky over the furnace of the dock...
And that of the jutemills too..
The hands that fear none.
The pale face of fear,
Seems so unfamiliar..
'Coz I know, death is nothing but love.
If they kill me,
I'll be born again...
As million flames, in million earthen lamps,
Of every household of Bengal,
In every home of my native land.
I'll come back each year
As the greenish sprout of hope,
Splitting the mother earth's breast,
A thousand saplings of harvest...
I can't be wrecked,
Nor be ruined.
I'll be there in joy,
And in pain,
In death
And in birth--- when new lives begin.
I'll be there till man exists...
Till my nation breathes her last.
Usher that death, that end of life...
The death that shoots up like blazing bubbles
In the cold of the night...
Let the tiny boat with beehive sails,
Intercept the seventh fleet...
Let the blowing trumpet and conch
Mark the beginning of war..
When the drunken air,
Is heavy with the smell of blood,
Let thousand flaming poems explode,
From beneath the soil
Of gunpowder...
When the painted decors of houses,
Temples, villages, boats....
When the hilly terrains to the sandy sea shores...
All are dried and flammable to the core of their
heart,
After weeping the full night away...
When the muddy soil of my motherland,
Merges with the slime of the slaughter house...
Then,
Why a fig of doubt?
Why should there be dread?
Why should one hesitate?
Eight souls have touched....
In the dark ecliptic gloom,
They whisper in our ears....
When and where the sentry are
Watching over us.
In their voices, do rest
The billion stellar stars,
The milky way,
Endless oceans,
And the inheritance
To drift
through the entire galaxy.
So,
Let the burning torch of poetry
The Molotov cocktail of poetry
The Toluene flame of poetry...
Throw itself
Knock itself
In this fiery desire.
বিশেষ রচনা
ওগো দুখজাগানিয়া
বিশ্বজিৎ লায়েক
"প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে" --- কিন্তু
যারা সেই চরণের ধ্বনি শুনতে না পায়! তবে কি ব্যর্থ এই জীবন! তা কেন! দেখো, একটা নক্ষত্র
ঝরে পড়ছে-- শব্দহীন বিষাদ ও অশ্রুতে। তুমি সেই নক্ষত্রের আলো চিনে চিনে দেখছো
" তরুণ চোখের করুণ চাওয়া।"
ক্লান্ত হয়ে উঠছ। অভিমন্যুর মত মতো জটিল বৃত্তের ভেতর
ঘুরপাক খাচ্ছো। ভাবছো," সে যে বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে" কে সে?
কোথায় থাকে! কেন কেন " আমার প্রাণে সে দেয় পাখার ছায়া বুলায়ে।।"
দিন যায়। রাত যায়। কুমারী কংসাবতীর জল শুকাতে শুকাতে
আমাদের অশ্রু পর্যন্ত নেমে আসে। তুমি মৃত স্বপ্নদের জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা কর।
স্বপ্ন এসে বালিশের নীচে চাপা পড়ে।
" যখন মল্লিকাবনে প্রথম ধরেছে কলি
তোমার
লাগিয়া তখনি, বন্ধু বেঁধেছিনু অঞ্জলি।"
ঠিক কি যেন হয়। কিছুই বুঝতে পারো না তুমি। কেবল শূন্য
ক্রমশ শূন্যের দিকে হেঁটে যায়। এত শূন্য নিয়ে কী করবে তুমি! ভাসিয়ে দেবে! কোথায়!
সমস্ত চৌম্বক ক্ষেত্র জুড়েই তো বসন্ত যাপন!
" এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর
কাল গুণে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে।"
" তোমার উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার
উত্তরী।" আমার মনেও জাগিয়ে দিলে " তোমার মুখের চকিত সুখের
হাসি দেখিতে
যে চাই"--- চাই বললেই আমারও ইচ্ছে করে অমিত যেরকম লাবন্যের কানে ফিসফিস করে
বলছে জন ডানের কবিতা--
"For God's sake, hold your tongue and let me
love!" তোমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে না! আমি কিন্তু সত্যি সত্যি উন্মাদ
পাঠশালায় গিয়ে শিখছি পিথাগোরাসের সূত্রের বদলে "তোমার চোখে দেখার আগে তোমার
স্বপন চোখে লাগে বেদন জাগে গো--
না চিনিতেই ভালোবেসেছি।"
তখন সাহস ছিল। " অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবন"
ছিল না মোটেই তাই " বসন্ত জাগ্রত দ্বারে" তাকে ফেরাইনি। ডেকে এনেছি ঘরে।
বলেছি বসো। তোমাকে গান শোনাব---
" ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-- তোমার
মনের
মন্দিরে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো - তোমার
ললাট চন্দনে।"
সেদিন আকাশে বিপুল মেঘ। আকুলি বিকুলি। সমুদ্রের লবণ
এসে নোনা করে দিচ্ছে আমেজ। " যেন কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে।"
সকালেই তুমুল মেঘ দেখেই ভাবলাম বৃষ্টি হবে। হল না। কেবল আঁধার পৃথিবী। পথ চেয়ে বসে
আছি। " আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।"
ঘুমের ভেতর গলগল করে নামছে স্বপ্ন। বিছানায় টুপটাপ খসে পড়ছে
এক একটা নক্ষত্র। রাতের তারারা জেগে আছে আমার বুকের ভেতর। " ঘুমের ঘন গহন হতে
যেমন আসে স্বপ্ন
তেমনি উঠে এসো এসো।
যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ
তেমনি তুমি চমক
হানি এসো হৃদয় তলে--"
ঘুম ভাঙলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আয়নার বাইরের আমি
দেখে আয়নার ভেতরের আমিকে। সন্ধ্যে হয়। রাত্রি তার ছাই ফেলে যায়। "দুজনের চোখে
দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে--" পাশাপাশি হাঁটছি। কারো মুখে কোনো কথা
নেই। নীরব এই সম্পর্ক। কোনো ইরেজার নেই মুছে দেবে আমাদের প্রথম ছুঁয়ে থাকা "
জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি।"
" ভালোবেসে থাকো যদি লও এই হৃদি--" এখনও বসন্ত জেগে আছে।
মনে। প্রাণে। সংগোপনে। হয়ত " বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা।" ভরুক। তাতে কি!
পৃথ্বী জুড়ে সাপের জিভের মতো লকলক করছে লোভ। কিন্তু আমাদের পেরিকার্ডিয়াম ভেদ করে
বেরিয়ে আসে স্বপ্ন।
" রোদন- ভরা এ বসন্ত, সখী
কখনো আসেনি বুঝি আগে।
মোর বিরহবেদনা রাঙালো
কিংশুকরক্তিমরাগে।"
দুজনের চোখে দুজনের স্বপ্ন। তুমি আছ, আমি আছি।কেউ
কাউকে ফিরিয়ে দিইনি অবহেলায়। জ্যোৎস্নায় ভিজে গেছি। শরীরের গন্ধ বিলিয়ে দিয়েছি
বাতাসে, মেঘের শরীরে। চাঁদের তরণী বেয়ে ছুটে গেছি সেই নক্ষত্রের কাছে যে তোমাকে
দিয়েছিল বেঁচে থাকার আলো।
" চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।
পাড়ি দিতে
নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি
আছি।।"
কবিতা
মেহজাবিন
সর্ভানু
দাশগুপ্ত
আজ আগুন লাগার খবর পেলে-
শুধু ব্রহ্মচারিণীকে নিয়ে কবিতা লিখি,
এই কোষকাব্যে আমার কপালে চাঁদ নেই
তবু হে দোজখ -
পুড়ে যাওয়া চাঁদমালার পেছনে
আমাকে আবিষ্কার করেছিল মেহজাবিন।
সেই চান্দ্রবর্ষের এক অবুঝ তীর্থঙ্কর আমি...
দুটো শালগাছের মাঝে-
গালে হাত দিয়ে তথাগত যখন অস্তগমনের পথে
তখন বাসি কাপড় আর বাসি ফুল নিয়ে
আত্মহননের বীজ পুঁতে দিয়ে আসতাম
লিখে আসতাম
"শরীর মানে ফাঁদ ও মরণের হাতছানি"
সেইসমস্ত লঘু দ্বিপদরাশি
আর ফুটন্ত বৈষ্ণবীর দল ও বৈদিক প্রেমিকারা
কেউ একবারও গেয়ে ওঠেনি
"মুঝে কাতিল করকে,খুনকি মেহেন্দি লাগালেনা"
হে আল্লাহ, রোজা রাখিনি আমি-তবুও
বুকে পয়স্বিনীর স্বপ্ন নিয়ে শুকিয়ে যাওয়া
সেই পলাশের জীবাশ্মগুলোকে
ঠোঁটে তুলে নিয়েছিল মেহজাবিন,
কবিমুখে তুলে দিয়েছিল ইফতারের শ্লোকবদ্ধ ফল
আর্যতীর্থ
প্রারম্ভে গেছি আটকিয়ে আমি, হে ধর্মাবতার।
যে গ্রন্থে হাত রেখে শপথ করতে আজ বলেন আমায়,
সত্যি বলতে ,মানুষেরা কিছু মূল্য রেখেছে কি তার?
যে গ্রন্থে হাত রেখে শপথ করতে আজ বলেন আমায়,
সত্যি বলতে ,মানুষেরা কিছু মূল্য রেখেছে কি তার?
এসব গ্রন্থে পথের হদিশ নাকি উত্তরণের দিকে,
কজন আর সেটা নির্দেশ বলে মেনে পথ চলে, শুনি?
ধার্মিক আজ বিভিন্ন সব শর্টকাট গেছে শিখে।
কজন আর সেটা নির্দেশ বলে মেনে পথ চলে, শুনি?
ধার্মিক আজ বিভিন্ন সব শর্টকাট গেছে শিখে।
খোলা তরোয়াল, বোম পিস্তল গোলাগুলি বন্দুকে,
মানুষী রক্ত ফোয়ারার মতো ধর্মের নামে ঝরে,
মাথা কাটা যায় অক্লেশে ওই গ্রন্থকে এনে মুখে।
মানুষী রক্ত ফোয়ারার মতো ধর্মের নামে ঝরে,
মাথা কাটা যায় অক্লেশে ওই গ্রন্থকে এনে মুখে।
ওসব গ্রন্থে হত্যাকে যদি বলে থাকে উপাসনা,
তাহলে হুজুর, ধরে নিতে হয় হিংসাই শাশ্বত,
সত্য বলবে কি করে যে দেয় নিধনের প্ররোচনা?
তাহলে হুজুর, ধরে নিতে হয় হিংসাই শাশ্বত,
সত্য বলবে কি করে যে দেয় নিধনের প্ররোচনা?
যদি বলে দেন ওইসব লেখা নেই এ গ্রন্থে কিছু,
আমি মেনে নেবো, অতটা খুঁটিয়ে পড়া নেই ঈশ্বর,
শুধু বলে দিন, কতগুলো খুন রয়েছে গ্রন্থপিছু?
আমি মেনে নেবো, অতটা খুঁটিয়ে পড়া নেই ঈশ্বর,
শুধু বলে দিন, কতগুলো খুন রয়েছে গ্রন্থপিছু?
শুধু পড়া বা না পড়ার অপরাধে গেছে অসংখ্য প্রাণ,
সেটুকু রইলো নাহয় ইতিহাসে, আগামীতে যাবেনা যে,
অন্তত সেই আশ্বাসবাণী আমাকে শোনান।
সেটুকু রইলো নাহয় ইতিহাসে, আগামীতে যাবেনা যে,
অন্তত সেই আশ্বাসবাণী আমাকে শোনান।
কাল যদি এ গ্রন্থ অজুহাত হয়ে ওঠে ফের হত্যার
নির্ঘাত তবে ধার্মিক সেজে কেউ মিছেকথা বলছে,
সন্দেহ রয়ে যায় তবে একে ছুঁয়ে শপথের সারবত্তার।
নির্ঘাত তবে ধার্মিক সেজে কেউ মিছেকথা বলছে,
সন্দেহ রয়ে যায় তবে একে ছুঁয়ে শপথের সারবত্তার।
প্রারম্ভে আটকিয়ে গেছি তাই আমি, হে ধর্মাবতার।
তফাতটা শুধু এ শিড়দাড়াতে
পিনাকী দত্ত
গুপ্ত
তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ
কেউ হাঁটে, কেউ হামাগুড়ি দেয়
নিশানার খোঁজে দিশাহীন রাতে
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে,
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে।
কেউবা আসল, কেউবা নকল
কেউ কেনে, কেউ জবরদখল
কেউ মারে, কেউ মরছে হাভাতে
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে,
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে।
আমিও বলছি, তুমিও বলছো
কেউ জ্বালে, কেউ জ্যান্ত জ্বলছো
চার পায়ে কেউ, কেউবা দুহাতে
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে,
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে।
শীতঘুমে কেউ গর্ত খুঁড়ছো,
বুকটা চিতিয়ে কেউবা পুড়ছো
আগুন পোহাও কেউবা ছায়াতে
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে,
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে।
গিরগিটিরাও রঙ বদলেছে,
সরিসৃপেরও ল্যাজটা নড়েছে
তবু শাঁখ বাজে রুদ্ধ-কারাতে
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে,
তফাতটা শুধু এ শিরদাঁড়াতে।।
নোনতা
শান্তনু
পাত্র
কঠোর দীর্ঘ অনুশীলনে
পরিণত জিভের স্পষ্ট উচ্চারণে
খোসা ছাড়ানো ধ্বনিগুলি
বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে আসে
ঘটে যায় শব্দচাষে কৃষিবিপ্লব।
শাওয়ারের নীচে ক্লান্ত কণিকা
শীতল শারীরিক স্রোতে
নিজস্ব ছন্দে ফিরে
দুদন্ড শান্তি খুঁজে পায়।
পাগলের উদাসীন স্বগতোক্তিতে
অস্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনি ---
আমাদের নোনতা রক্তে
হয়তো কোনোদিন সমুদ্র মিশেছিল।
হিসেব
প্রত্যূষ
কর্মকার
ভিতরে বিষণ্ণতা বাইরে আলো
ধীরে ধীরে দরজা খোলে অন্ধকারের মেলা
ও হাতে পানপাত্র আমেজ ছড়ালো
এ হাত আলতো করে চিরে দেয় গলা
আমরা ভেবেছি ভুল,এটাই রীতি
হাতে অলিভ পাতা,মায়াভেজা চোখ
মৌখিক সম্ভাষণে সুকোমল প্রীতি
তলে তলে লালসায় হিংস্র হচ্ছে রোখ
বন্ধু তুমি?না হলে শত্রু আজন্ম
মাঝখানে থমকে আছে দিকভ্রষ্ট সাঁতার
নষ্ট গায়ে জড়িয়েছি জলের বর্ম
এইমাত্র,আর কিছু সঙ্গে নেই বাঁচার
সারি সারি মৃতদেহে ভরে যাচ্ছে খাতা
তুমি ধ্বংস করো,আমরা সৃষ্টি-উদগাতা
ইছামতী
শ্যামশ্রী
রায় কর্মকার
পড়ন্ত বিকেলে এসে নদীটির ধারে দাঁড়াতেই
প্রত্যক্ষ করলাম অপরূপ
ক্ষীণতনু ইছামতী উঠে এল মেঘের চাতালে
চাঁদের ওপারে গিয়ে উন্মোচিত করলো তার যৌবন
জ্যোৎস্নায় জেগে উঠলো তার কুমারী সাজের জল
সে জলে ডোবালে হাত পুড়ে যায়
হু হু করে ডাক দেয় চিত্রময় তরল আগুন
নদীর খোঁপা খুলে ঝরে পড়ল গন্ধরাজ
আদিম মাঝির পিঠ ছুঁয়ে গেলো তার এলো চুল
মাঝি নোঙর খুলে ভাসিয়ে দিল তার নৌকা
বাদামি যুবকবৃন্দ অবিরাম মন্ত্র পড়লো গুপ্তপুঁথি থেকে
নদী তার বিম্ববতী ঠোঁট ভীষণ শ্রাবণে রেখে দিতেই
আষাঢ়ের স্পৃহা কেঁপে উঠলো ,
কেঁপে উঠলো ছায়ার স্তব্ধতা
রক্তিম হয়ে উঠলো মোহাতুর চাঁদ
তীরবর্তী গাছের কোটরে জমা হল বিন্দু বিন্দু রূপকথা
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না 💗💗
ReplyDeleteএখন সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বোধহয় এই কবিতাটি
ReplyDelete