Friday, 1 December 2017

সাহিত্য এখন, ডিসেম্বর, প্রথম পক্ষ, বিশেষ আকর্ষণ অনুবাদ সাহিত্য




সম্পাদকীয়
 সাহিত্য এখনের তৃতীয় সংখ্যায় এসে আলাদা কিছু করার কথা মনে হল। একথা আমরা সকলেই জানি যে 'সত্য মাত্রেই সাহিত্য নয়'। হৃদয়ের প্রকৃত অনুভূতি যখন নানান আভরণে ভূষিত হয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়, তাকেই আমরা সাহিত্য বলি। তবু মূল কথাটি হল আমাদের উপলব্ধির কথা। তাই গল্পের বদলে এই সংখ্যায় এমন কিছু উপলব্ধি হাজির করলাম, যা আজকের দিনে অনুভব করা বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সেই সঙ্গে নিয়ে এলাম এমন কিছু কবিতার ঝাঁপি,যেগুলি সমাজ ও সাহিত্যের নিরিখে বিশ্ব সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই।আমাদের কবি বন্ধুরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমের সঙ্গে এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন। আশা রাখি, আপনাদের সংখ্যাটি ভাল লাগবে। পড়ুন, আলোচনা ও সমালোচনা করুন, বন্ধুদের কাজকে বেশি করে ছড়িয়ে দিন নতুন নতুন পাঠকের কাছে... এটুকুই অনুরোধ। ভাল থাকবেন।



মনের কথা (১)
বেড়ালের তালব্য শ

অনেকদিন ধরে লিখব ভাবছি। হয়ে উঠছে না। এমনিতে হাসতে ভালোবাসি, অন্যকে হাসাতে পারলে আরো ভালো লাগে। কিন্তু মাঝে মাঝে জংলা রাগ হয়। ঘৃণা। 

আমি খুব প্রোটেক্টেড জীবন যাপন করেছি গড়ে ওঠার সময়টা। ঊর্ধ্বতন চৌদ্দপুরুষে শিক্ষার সংস্পর্শ থেকে আসা উদারমনস্ক কিন্তু ঐতিহ্যবাদী বাবা-মা খারাপ দেখতে, শুনতে, বুঝতে দেন নি। ভুল করেছেন, কিন্তু তা নিয়ে এখন বিচার করতে বসে লাভ নেই। 
খারাপ তো স্কুল কলেজেও দেখিনি। আশেপাশে যেসব ছেলেরা পড়াশোনা খেলাধুলো করত তারা বিচ্ছু বদমাইশ পাজি ন্যাকা আহ্লাদী বা গোঁয়ার ছিল, খারাপ ছিল না; অথবা, খারাপ বলে বুঝতে পারিনি। 

তাই প্রথম যখন খারাপ দেখলাম, চিনতে পারিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানে প্রথমে রেডিফ ক্যালকাটা গ্রুপ, পরে অরকুট, তারও পরে ফেসবুক। একটু দেরীতে ঢুকেছিলাম তাই এএসএল দিয়ে আলাপ শুরু হয় কেন বা কারা সেটা করে বুঝতে সময় লাগলো। তারপর যেটা প্রত্যক্ষ করলাম তা হলো একটা সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। মেয়ে বলে বুঝতে পারলেই হটচ্যাটের আহ্বান, খিস্তি, প্রেম-প্রেম ভাব এবং হটচ্যাটের আহ্বান, প্রেম-প্রেম ভাব, খিস্তি। যে গ্রুপেই যাই ঐ এক এএসএল। কেউ কথা বলে না, আলোচনা করে না, কারো কোনো প্রশ্ন নেই, শুধু দু'লাইন পর থেকে টেল মী ইয়োর ফ্যান্টাসিজ অ্যান্ড ডার্কেস্ট সিক্রেটস। কেন হে বাপু, তুমি বা তোমরা কে? তোমরা কি আমার কলেজের বন্ধুরা, ছদ্মনামে বুভুক্ষু প্রেতের মতো ঘুরছ? তোমরাই কি আমার সঙ্গে বসে ছবি আঁকা শিখতে? গান গাইতে? তোমাদের সঙ্গেই কি ক'বছর আগে পর্যন্ত ক্রিকেট বা ক্যারম খেলেছি? তখনো কি এটাই ভাবতে যে এই নারীমাংসটার ডিপেস্ট ডার্কেস্ট সেক্স-সিক্রেট কী? 

যে পুরুষ যতো নিজের স্ত্রীকন্যাবোনের প্রতি রক্ষণশীল, সে দেখি ততো অন্য মেয়ের প্রতি হিংস্র, আক্রমণাত্মক। সন্দেহ জাগে, রক্ষণশীলতার উৎস কি তাহলে দ্বিবিধ; আমার সম্পত্তি/ আমার সম্পত্তি নয় এই মেরুকরণ, এবং অপরাপর পুরুষ সম্পর্কে স্বজাত্যবোধ-জাত প্রকৃষ্ট ধারণা, যে রাস্তাঘাটে যারা হাঁটাচলা করছে, বাসে ট্রামে উঠছে তারা ঠিক এই আমারই মতো নারীমাংসলোলুপ? 

এর উত্তর নেই। ইতিহাস বরাবরই his story. মেয়েদের হাতে কলম উঠেছে সে আর কতো বছর? এখনো আমাদের উচ্চারণ নেই, বয়ান নেই, নেই প্রকাশক্ষমতা। এখনো আমরা কীই বা পারি, খুব সাধারণ কিছু নিজস্ব, ব্যক্তিগত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, বিদ্রোহ করা ছাড়া? সেইসব বিদ্রোহের সীমারেখা, অস্ত্রশস্ত্রও আবার নির্ধারণ করে দেয় পিতৃতন্ত্র। কোথায়, কবে, কতোটুকু, কোন রঙের কী পোষাকে কাদের মিছিলে হাঁটবো আমরা, মুখের ভাষা কতোটা "ভদ্রজনোচিত" বা "সাব-অল্টার্ন" হবে; কতোটা সাধারণের বোধগম্য হবে বা কতোটা থাকবে জার্গনের হেঁয়ালির অন্ধকারে। আমরা পড়াশোনা করব কি না, চাকরি করব কি না, কটা বাচ্ছা হবে এবং কবে-কখন হবে, হলে সেই সন্তানদের লিঙ্গ কী হবে, বাচ্ছা জন্মানোর পর আমরা আর চাকরি করব নাকি ফুল টাইম "মা" তথা "গৃহবধূ" হয়ে যাবো, এসবই এখনো ৯৯% ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রই ঠিক করে দেয়। যেমন ঠিক করে দেয়, অবিবাহিতা, বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা, ডিভোর্সি মেয়েদের সামাজিক অবস্থান। ধর্ষিতার সংজ্ঞা, ধর্ষণের কারণ। ধর্ষণ, যৌন অত্যাচারের সমূহ সম্ভাবনার সামনে পড়ে অথবা পরবর্তী সময়ে অত্যাচারিতা নারীটি কী ভাববে, কী করবে, তাও সম্পূর্ণভাবে ঠিক করে দেয় সেই পিতৃতন্ত্রই। কারণ, আর কোনোভাবে বাঁচতে তো আমরা শিখিনি! 

আর তাই, ইয়াজিদি মেয়েরা "আমাদের যৌনদাসী ক্যাম্পের ওপর বোমা ফেলে সবাইকে মেরে ফেলো" বলে আবেদন জানালে আমরা তা মিথ্যে বলে নাকচ করে দিই, বা জীবনের চূড়ান্ত দিক-পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা শোনাই; উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বাণী পাঠাই। তাই ২-৪ লক্ষ বাঙালি নারী বারংবার গণধর্ষিত হবার পর তাদের দেশ, সমাজ তাদের কথা সম্পূর্ণ চেপে যায়, তাদের সরকার একবার "বীরাঙ্গনা" উপাধি দিয়ে আর টুঁ শব্দটিও করে না তাদের সম্বন্ধে; তাদের ধর্ষণজাত হাজার কুড়ি "যুদ্ধশিশু" (সরকারি হিসেবে) চ্যারিটির হাত ধরে পৌঁছে যায় ইউরোপ আমেরিকায়; এমনকী তাদের নিয়ে স্বাধীন গবেষকদের লেখাপত্তরকে অগ্রাহ্য এবং ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় মাত্র চল্লিশ বছরের অন্তরালেই। তাই, মা মেয়েকে নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে সবাই প্রশ্ন করে, জিয়ারপি ডাকেনি কেন, আগের স্টেশনে নেমে যায়নি, যদি মরে যেতো তো মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী হতো কে, মা ছাড়া? তাই চার বছরের শিশুকন্যা যৌনাঙ্গে ক্ষত নিয়ে কাঁদলে তার মা যখন স্কুলের বিরুদ্ধে, নিগ্রহকারী পুংশিশুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় তখন দেশ ভেঙে পড়ে ছিছিক্কারে, পুত্রসন্তানের বাবামায়েরা বলেন ছোট্ট মেয়েটি মিথ্যে বলছে, তাকে হয়ত তার বাড়িতেই কেউ অত্যাচার করেছে, তার বাবা-মা প্রচারের আলোয় আসতে চাইছেন, মা "নারীবাদী" তাই "নির্দোষ" পুং-শিশুটির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন। তাই চাকরি করতে না চাওয়া মেয়েটি আত্মহত্যা করলে আমরা চোখ কপালে তুলে বলি, সে কী! আত্মনির্ভর হওয়া তো সবচেয়ে সুখ ও স্বস্তিদায়ক! এবং ভুলে যাই যে সেই মেয়েটি হয়ত "বাপের বাড়িতে" কোনোদিন জানেইনি, তাকে ভাবতেই দেওয়া হয়নি যে তারও চাকরি করা উচিত, নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত এবং বিশেষজ্ঞরা তাকে, তাদেরকে "দুর্বল মানসিকতার" বলে দেগে দেন। তাই সু-কাই অহিংস বৌদ্ধদের দ্বারা রোহিঙ্গা মেয়েদের নির্যাতনের প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ দেন, আর পৃথিবীর তাবৎ প্রগতিশীলরা সেই রোহিঙ্গাদের দ্বারাই উত্তরপূর্ব বাংলাদেশ এবং ভারতীয় মেয়েদের ওপর চালানো অত্যাচার নিয়ে ততোটাই চুপ করে থাকেন। তাই প্রবাসী "নারীবাদী" বৌদিদি রায় দিয়ে দেন, রাজস্থানী মেয়েরা সবাই স্বামীর ঘরে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার; তাই বিধর্মী যবনসেনা তুলে নিয়ে গিয়ে গনিমতের মাল হিসেবে গণধর্ষণ করলে, দাসীহাটে বেচে দিলে কীই বা এমন যেতো-আসতো, out of the frying pan into the fire হতো না কী? 

এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণ থেকে ভৌগোলিক সময়-সারণি অনুযায়ী মানুষ অভিধা দেওয়া যায় এমন প্রাণীর আবির্ভাব মাত্র দু'লাখ বছর আগে। পৃথিবীর বয়েসের (প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর) কাছে এই সময় হলো নস্যি। সময়ের চিরকালীন ছন্দ, বৃহত্তর ছকে তাই হয়ত মানুষীদের এইসব ছোটখাটো দুঃখদুর্দশা, সমুদ্রবক্ষে বুদ্বুদের মতো ক্ষণিক, তুচ্ছ, অর্থহীন। হয়ত এভাবেই লিঙ্গসাম্য আসবে, নারীমুক্তি ঘটবে, অতি ধীরে, অতি মন্থরতায়। ততোদিন এইসব খেলা চলুক। আমরা পিতৃতন্ত্রের শেখানো বুলি দিয়ে, চোখে সেই একই রেফারেন্স ফ্রেমের ঠুলি এঁটে, আলোচনা এবং ক্রিটিক করতে থাকি সেই একই চিন্তাপদ্ধতি থেকে উদ্ভূত শিল্পের, সাহিত্যের, ভাবপ্রকাশের সমস্ত ভঙ্গীমার, যেখানে নাকি "মেয়েদের কথা" বলা হয়েছে। আমাদের সব মেয়েদের সবটুকু বাঁচা এইভাবেই প্রাকনির্ধারিত হতে থাকুক। মরাও, মরাটুকুও। জীবনের ওপর যাদের অধিকার নেই তারা নিজের মতে, স্বেচ্ছায় মরতে পারবে, এ আবার কেমন কথা? তারা মরবে, শান্ত হয়ে, চুপ করে, চুপিচুপি। কম খেয়ে, অপুষ্টিতে, অত্যধিক সন্তান-ধারণ করে, চাকরি এবং সংসারের জাঁতাকলে পিষে,  পুরুষের ঘটানো যুদ্ধে বোমার আঘাতে, দুর্ভিক্ষের সময় তাদের খাদ্য হয়ে, গায়ে বোমা বেঁধে, তাদের যৌনদাসীত্ব স্বীকার করে। এর কোনোটা না হতে চেয়ে মরে গেলেই, মরে নিষ্কৃতি পেতে চাইলেও, সমস্ত রকম ধর্ম, যাদের সব কটাই প্রায় পুরুষ-রচিত, পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত, ছুটে আসবে আত্মহননকারীকে হয় ধিক্কার দিতে। অথবা লোকাচার তাকে বানাবে দেবী, আত্মত্যাগে মহিমান্বিতা। 


তবু, সময়ের এই তাৎক্ষণিকতায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, উপকথার রাণী পদ্মিনী ষোল হাজার রাজপুত মেয়েকে নিয়ে জওহরব্রত করে ভুল করেছিলেন কি না তা বাংলাদেশের "বীরাঙ্গনা"দের দিকে তাকালেও হয়ত কিছুটা বোঝা যায়। সেই তারা, যাদের খবর তাদের পরিবার, সমাজ, দেশ, কাল কেউই রাখেনি, রাখতে চায়নি। সেই তারা, রেপ ক্যাম্পে যাদের ব্যবহার করা হয়েছিল একটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার জন্য। শত্রুপক্ষের জেনারাল টিক্কা খান যাদের গর্ভবতী করে রেখে যেতে নিজের সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে পরের প্রজন্ম হয় "পিতৃভূমি"র প্রতি উদ্বেল। আজকের বাংলাদেশে পাকিস্তান-প্রীতি দেখলে আমার সত্যিই মনে হয়, পদ্মাবতীর পিতৃতন্ত্র কতোটা ভুল জানি না, তবে তার জায়গায় থাকলে আমিও পুড়ে মরতেই চাইতাম, মেয়ের হাত ধরে ঝাঁপ দিতাম চলন্ত ট্রেন থেকে, ইয়াজিদি ভাইঝির মুখে মাখিয়ে দিতাম ব্যাটারি অ্যাসিড। মেরে মরতে না পারলে অন্ততঃ দিনের পর দিন relentless অত্যাচারের সামনে নিরুপায় হয়ে পড়ে না থেকে মরে যাবার চেষ্টা করতাম, কারণ সেই মৃত্যুও একরকম মুক্তিই। এই সিস্টেমে জীবনটা আমার নয় যখন, মৃত্যুটা ক্ষমতায় কুলোলে অন্ততঃ নিজের করে নিতাম, নিতামই।



 মনের কথা(২)
দেবশ্রী  মিত্র

সম্প্রতি অন্তত দুটি ঘটনায় দু'জন নববিবাহিতা মহিলা আত্মহত্যা করেছেন কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছিলো চাকরি করার জন্য। রিলেটেড অন্যান্য কারণও থাকতে পারে, কেস শেষ না হওয়া অবধি কিছুই বলা যায় না। তবে, আমি শুধু মা হিসেবে দু'চারটে কনসার্ন রেখে যাই। আমরা সন্তানদের ঠিকমতো মানুষ করছি তো? কোথাও কোন বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? আরও মেয়েকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, এমন ভবিষ্যৎ তৈরি করে যাচ্ছি না তো? 

ছেলে সন্তান আর মেয়ে সন্তানের মধ্যে "আপব্রিংগিং" এ তফাত করাটা একটা সুপরিচিত নিয়ম আমাদের সমাজে। যে বাড়ি মেয়েকে স্বাবলম্বী বানায়, তারাও দুধের গ্লাস আর মাছের বড় টুকরো ছেলেকে দেয়। কথায় কথায়, মেয়ে যখন বাড়ির কাজটাও সাথে শিখুক, বলে। "আমার মেয়ে রাঁধতেও পারে" বলে প্রতিবেশীর কাছে গর্ব করে, ছেলের জন্য কিন্তু করে না। এই যে তফাতটা, অতি সূক্ষ্ম তফাতটা, এটাই কিন্তু একটা মেয়ের "ছেলে আর মেয়ে আলাদা" এই মানসিকতা গড়ে দেয়। বিয়ের পরেও তারই প্রতিফলন ঘটে। স্বামী খানিক হুকুম করতে পারে, আয়েশ করতে পারে, অন্যায় জুলুমও করতে পারে। কারণ সে পুরুষমানুষ। এই মানসিকতা তো আমরাই তৈরী করে পাঠাই মেয়ের মধ্যে। 

দুই, স্বাবলম্বী হওয়া। অর্থনৈতিক এবং মানসিক, দুভাবেই। বেঁচে থাকতে গেলে টাকা লাগে এবং সেটা রোজগার করতে হয়, এটা একটা কঠিন সত্য। প্রত্যেক সুস্থ মানুষের উচিত একটা বয়সের পর নিজের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া। চাকরি করার জন্য কেউ চাপ দিক বা না দিক। শ্বশুরবাড়ি অবধি যাওয়ার কী দরকার, মেয়েকে এই সহজ সত্যি কথাটা কেন শেখাবো না? যে মেয়ে চাকরি করে না, ঘরে শ্রম দেয়, তাকে কোনরকম ছোট না করেও বলা যায়, কেন সে একা শুধু ঘরে শ্রম দেবে এবং বাইরে যাবে না? কেন? ঘর এবং বাইরে, বিয়েতে দুজায়গাতেই দুজনের সমান দায়িত্ব, যদি না কোন শারীরিক অসুস্থতা থাকে। আমি নিজেই যদি নিজের আর্থিক দায়িত্ব নিতে না চাই, অন্য কেউ কেন নিতে বাধ্য থাকবে? প্রচুর মেয়ে সন্তান জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দেয়, এই বলে যে সন্তান কে দেখবে? হাজার হাজার লাখ লাখ মহিলা সন্তানকে ডেকেয়ারে রেখে চাকরি করেন। তাদের সন্তানরা সবাই অমানুষ হচ্ছে কি? স্বাবলম্বী হওয়াটা বেসিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। ও লাজুক, এ কথা কম বলে, এসব কোন যুক্তি না। যে লাজুক তাকে কেউ ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করতে বলে নি। পৃথিবীতে আরও হাজারটা কাজ আছে করার। 

তিন, যদিও দ্বিতীয়টা করলে এইটা করতে লাগবে বলে আমার মনে হয় না, তবুও বাবা মা দয়া করে বিয়ের আগে মেয়েকে একটু বলবেন কি যে বাবার বাড়িতেও তার একটু কদিনের জন্য জায়গা হবে, খুব অসুবিধা হলে, যতই তার বিয়ে হয়ে যাক না কেন? বলবেন কি যে পাশের বাড়ির কাকিমার তির্যক দৃষ্টির চেয়ে মেয়ে তাঁর কাছে দামী? মেয়ে যাবে কোথায়? এই প্রশ্ন শুনে শুনে কানে ব্যথা হয়ে গেছে। আর শুনতে ইচ্ছা করে না। অত্যাচারিত মেয়েকে দু'দিন আশ্রয় দিলে যাদের মান যায়, তারা মেয়ে সন্তান জন্মালে মেরে ফেলেন না কেন আমি বুঝি না! বাঁচিয়ে রেখে কী হবে যদি এই পরিণতির দিকেই ঠেলে দিতে হয়? 


বাবা মায়েরাও একটু মানুষ হোন দয়া করে। খালি খুনীকে দোষ দিয়ে লাভ কী, যদি আপনি একজন ভালনারেবেল, আত্মসম্মানহীন, নিজেকে রক্ষা করতে অসমর্থ, ভীতু পোটেনশিয়াল ভিক্টিম তৈরী করে তাকে খুনীর কাছে পাঠান? আপনি তো জেনেশুনেই মেয়েকে মরতে পাঠিয়েছেন, অভিযোগের চারটে আঙুল তো আসলে আপনারই দিকে।



জেলখানার থেকে
কবিতা: সামি আল-কাশিম (প্যালেস্টাইন)

অনুবাদ:চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
.
বন্ধু আমার
ওরা আমার দরজায় কড়া নাড়লে
তুমি নাছোড় কান্নায় ভেঙে পড়ো।
কখনও ফুঁপিয়ে, গুমরে কখনও,
কখনও বুকফাটা বিলাপী চিতকারে।
.
মা আমার, মাগো,
শুধু তোমার চোখের জল
বুকচাপা পাথরের বেদনা দেয়।
.
মা, জানো এই গরাদের আড়ালেই
আমি অনুভব করছি বোধের আশ্চর্য
অনুপম চেতনা আর
প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করছি।
.
আমি ঠিক জানি,
আমার শেষ দর্শণপ্রার্থী হয়ে আসবে
কোনও লোহার ঠোট আর লম্বা ডানার
কোনও কুতসিত অন্ধ বাদুড় নয়!
আসবে আমার স্বাধীনতা,
আমার আজন্মলালিত স্বপ্ন!
.
মা আমার, তুমি দেখো,
আমার বিশ্বাস, সেই উজ্জ্বল দিন
আসবেই, আসবেই, আসবেই...


ওয়েস্ট রাইডিং (পশ্চিমের পথে সওয়ারী )
ইয়ান এম্বারসন
অনুবাদ:গোপেশ দে

আঁধারের রাস্তায় উজ্জ্বল শাড়ি
ইয়র্কশায়ারের আকাশে ধূসরতা
ধ্বংসপ্রাপ্ত কারখানার জন্য স্তব
কারলেওয়ার কান্না খোঁজ নিচ্ছে বারংবার।

কোনদিন জেন এই মইয়ে বসে বসে
চাঁদটাকে খড়ে ডুবে যেতে দেখেছিল
একটা কুকুরও ছিল,আর একটা ঘোড়া
ধাতব শব্দে হেঁটে পার হয়েছিল এ ধূসর রাত


এরপরে শুধু তুমি অপেক্ষায় রত
(কুকুরেরা  বন্ধুকে স্বাগত জানাতে দৌড়ে আসেনা)
রক্তাভ সূর্য পড়ন্ত বিকেলে ডুবে যায়
হতাশার লাল ডিসেম্বরে।

এবং পৃথিবীরা এখনও  আঙুলে ভর করে তাদের তারাদের প্রদক্ষিণ করে
যখন মঞ্চে তরুণ অভিনেতারা দেখা সাক্ষাৎ করে
সোনালী ফ্রেমে এক অষ্পষ্ট ছবি
উজ্জ্বল শাড়ি আঁধারের রাস্তায়।



সিজফায়ার(যুদ্ধবিরতি)
মাইকেল ল্যাংলি
অনুবাদঃ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়


বাবার কথা মনে করে
অ্যাকিলিস কান্নায় ভেঙে পড়ল
হাত ধরে আস্তে করে এগিয়ে নিয়ে গেল বৃদ্ধ রাজাকে।

প্রায়াম তারই পায়ে কান্নায় লুটিয়ে পড়ল
বিষন্ন বাতাসে প্রাসাদ না ভরে যাওয়া পর্যন্ত
চোখের জলে ভিজে গেল দুজনেই।

হেক্টরের নিষ্প্রাণ দেহটা হাতে নিয়ে
বৃদ্ধ রাজার কাছে উপস্থিত হল
যেন সব ধুয়ে মুছে গেছে।
যুদ্ধসাজে সাজিয়ে প্রায়ামের হাতে তুলে দিল
যেন ট্রয়ের যুদ্ধবিরতির দিনে
বাড়িতে এক উপহার নিয়ে চলেছে।

তারা যখন একসাথে খেতে বসেছিল
প্রেমিকের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল পরস্পরের দিকে
অ্যাকিলিসের শরীরটা ছিল দেবতার মত
প্রায়ামকেও সুন্দর মানিয়েছিল
পারস্পরিক কথাবার্তার মাঝপথেই
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলেছিলঃ

“আমি নতজানু হই। আমি তাই করি
যা আমার করা উচিত।
আমি অ্যাকিলিসের হাতে চুমু খাই
সেই তো আমার সন্তানের খুনী”।  




সেন্ট্রিফিউজ(কেন্দ্রাতিগ)
ডিন ইয়ং
অনুবাদঃ পিনাকী দত্তগুপ্ত


সম্ভবত সেটি ছিলো মধ্যরাত যখন ম্যাপেল গাছটার নিচে
শেষবার আমরা কথা বলেছিলাম, যেখান থেকে কবিতাটির
জন্ম হল। তোমার শরীরের দুর্বার চুম্বকীয় আকর্ষণ, সোঁদা
গন্ধ, উড়ন্ত উত্তরীয় , কিংবা এক দীর্ঘ চুম্বন উপেক্ষা করেও
কোনো এক অনতিক্রম্য টানে আমার কবিতা উড়ে যাচ্ছে
মহাজাগতিক দুর্গম উচ্চতা ভেদ করে। আর সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে
চূড়ান্ত উৎকন্ঠায় চেয়ে আছে দুর্বৃত্ত ছায়াপথ।  এসো, রক্ষা
করো, যাতে ঐ কৃষ্ণগহ্বর থেকে আমরা বিচ্ছেদের অতল
গভীরে তলিয়ে না যাই। শীতের লাল আপেলের মিষ্টি গন্ধ
আর দুর্বিনীত ছাই এর মন্দবাসের তীব্র যুগপৎ আকর্ষণে,
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি একা, আজও ম্যাপেল গাছটার নিচে। 


মহান ধর্মযাজক বসে আছেন উচ্চ আসনে। আর যিনি তার
পদতলে, তিনিও মহান ধর্মযাজক। পাখিদের বহিরঙ্গে নরম
পালক, অস্থির গভীরে বুদবুদ। সম্মুখে আঁধি ও বৃষ্টি, তবুও
মেটাতে হবে ঋণ। উল্কার মতো ঝ’রে পড়া ধন ভান্ডারে মৃত্যু
নিশ্চিৎ জেনেও তুমি যেন প্রবেশ করে চলেছ এক অপার্থিব
আকর্ষণে। আর মনে পড়ছে সেই অনুবাদকের কথা যে বিষন্ন
ক্লান্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে একটি ব্রাজিলিয়ান কবিতার
বইএর  পিছনের মলাটে,, যেন এক অশ্বেতরের পিছনে ছুটতে
ছুটতে নিজের অজান্তেই সে প্রবেশ করেছে একবিংশ শতকের
অনভিপ্রেত সন্ধিক্ষণে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎই পিট্সবার্গের বিবর্ণ
পথে পশমের জ্যাকেটের নিচে তাঁর নিঃশ্বাস হালকা হয়ে আসছে।
মনে করো,  ধুলোয় ঢাকা রাজপথ, একটু উত্তাপের আশায়  জড়ো
করেছে অবিন্যস্ত আণবিক হাসি। তারপর, বিস্মৃত প্রেমিকার কথা
ভেবে, দাগলাগা জীর্ণ পাতলুন পরিপাটি করে জড়িয়ে নিয়েছে তার
অমলিন দেহে।

আমরা হয়ত এভাবেই অরণ্যের সুগভীরে কোণে হেঁটে চলছিলাম
আগামীকে অতিক্রম করে আরো কিছু বেশি পান করার মায়াবী
নেশায়। দুহাত নাড়িয়ে, ভেঙচি কেটে,  সেই আগামী নিশ্চিৎ
করছিল আমাদের বিচ্ছেদ। যদিও আমি নিঃশব্দে তোমায় অপহরণ
করতে চেয়েছিলাম। তবু জেনো আমি উৎকণ্ঠিত নই। অবশেষে,
আমার বিষাক্ত নখ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে আমারই হৃৎপিন্ডের 
 নরম চাদরে। আমি আবিষ্কার করতে চাই স্বেচ্ছামৃত্যুর সুখ। আমি
যেন অবিন্যস্ত হয়ে যাই যখন সে আলোর কথা বলে রাত্রির কাছে, 
যখন অজাতশত্রু মেঘ তার ভয়ঙ্কর ছায়ার আড়ালে গল্প করে চাঁদের
সাথে,, কিংবা যখন তুমি তোমার বিবাহিত রাতের একান্ত মুহূর্তগুলি
তুলে ধরো আমার সামনে দ্বিধাহীন ভাবে। অথচ আমার ইন্দ্রিয় সাড়া
দেয়না, কিংবা হয়ত দিতে পারে না। এমনকি মুখোশের আড়ালেও
ওরা জাগ্রত হয় না।


আমি কিছু দুর্বোধ্য নামের লাল, কালো ফলের ঝোপ থেকে উঠে দাঁড়াই।
তারপর স্যাঁতসেঁতে  পশ্চাৎদেশ শুকিয়ে নিতে নিতে আবার মদে ডুবে
যাই। আমি ক্রমাগত নিজেকে ভাঙতে থাকি। যদিও জানি কালের অসুখ
আমাদের নিকট হতে দেবেনা, তবুও ওরা আমাদের অদৃশ্য হতে সাহায্য
করে অনেকটা রাত্রির অন্ধকারে কালো বস্ত্র পরিহিতের মতন। আমি
আবর্তিত পৃথিবীর মাটি আঁকড়ে ধ’রে  শুয়ে থাকি। আমি কাঁদতে
থাকি এক আবর্তিত পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ তীব্র আকর্ষণে।

ড্রিমস(স্বপ্ন)
ল্যাংস্টন হিউস
অনুবাদ: প্রত্যূষ  কান্তি কর্মকার

স্বপ্নগুলো আগলে রেখো,
স্বপ্ন যেন হারায় না কক্ষনো 
স্বপ্নবিহীন জীবন দিশাহারা 
ডানাভাঙা পাখির মতই,জানো?

স্বপ্নগুলো জড়িয়ে ধরো জোরে,
স্বপ্ন যদি হারিয়ে ফেলো তুমি-
রুক্ষ কঠিন বাস্তবেরই মত

উষর হবে জীবনযাপন জমি। 



বন্দী পাখি(কেজড বার্ড)
মায়া এঙ্গেলো(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
 অনুবাদঃশ্যামশ্রী রায় কর্মকার

স্বাধীন পাখি লাফ দিল ঐ
মুক্ত হাওয়ার পিঠে
ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেল
স্রোতের সীমানায়
ডুবিয়ে দিয়ে পাখনাদুটি
সূর্য আগুন রঙে
ছিনিয়ে নিল আকাশ মালিকানা।

বন্দী পাখি দৃপ্ত পায়ে
হাঁটল খাঁচা জুড়ে
গরাদগুলো আটকেছে তার
দৃষ্টিগাড়ীর পথ
পাখনা জুড়ে বাঁধন আঁটা
পায়ে লোহার বেড়ি
অবাধ কণ্ঠে তবুও সপ্ত স্বর।

বন্দী পাখি গাইছে এখন
বুক কাঁপানো সুরে
অজানা সব দেশের কথা
দীর্ঘ যে তার শ্বাস
সুরের খেলা পৌঁছে গেছে
দূর পাহাড়ের দেশে
পাখির গলায় শুনছে সবাই
শিকল ছেঁড়ার গান।

ভাবল পাখি ভাবল এবার এক পশলা হাওয়া
আয়ন বাতাস মিলিয়ে গেল দুঃখী গাছের ফাঁকে
পৃথুল পোকা বসল এসে সবুজ রোদের ঘাসে
আকাশপটের দলিল জুড়ে সেই পাখিটার নাম।

বন্দী পাখির স্বপ্ন ঘুমায় কোন কবরের নীচে
ছায়াটি তার গর্জে ওঠে কোন বিপদের ভয়ে
পাখনা জুড়ে বাঁধন যে তার,পায়ে লোহার বেড়ি
মুক্ত কণ্ঠে গাইছে তবু স্বাধীন হবার গান।

বন্দী পাখি গাইছে এখন
বুক কাঁপানো সুরে
অজানা সব দেশের কথা
দীর্ঘ যে তার শ্বাস
সুরের খেলা পৌঁছে গেছে
দূর পাহাড়ের দেশে
পাখির গলায় শুনছে সবাই
শিকল ছেঁড়ার গান।

9 comments:

  1. শুভেচ্ছা তোমাকেও গোপেশ

    ReplyDelete
  2. ভালো । বেশ ভালো ।

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ রাজেন্দ্রবাবু।অন্তহীন শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগলো পড়ে

    ReplyDelete
    Replies
    1. এভাবেই পাশে থেকো সবসময়

      Delete
  5. ধন্যবাদ। আন্তরিক শুভ কামনা বন্ধু

    ReplyDelete
  6. দিদি পড়তে পারছি না। ব্যাকগ্রাউন্ড কালারগুলো সরিয়ে দিলে ভালো হতো।

    ReplyDelete