Tuesday, 19 February 2019

সাহিত্য এখন, ফেব্রুয়ারি সংখ্যা, ২০১৯



সম্পাদকীয়ঃ
'আয়, আরো বেঁধে বেঁধে থাকি'
শঙ্খ ঘোষের এই অমোঘ পঙক্তি সংকটের সময়ে কেমন বীজমন্ত্র হয়ে বাজতে থাকে কানের ভিতর। দেশ কি শুধু মাটির নাম? দেশ হয়ে উঠতে গেলে ভালোবাসতে হয় পাশের মানুষটিকে, পাশের ধর্মটিকে। বুকে হাত দিয়ে কি আমরা বলতে পারি, কজন সত্যি করে ভালোবাসি আমাদের দেশকে? দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই বলে গলা ফাটানোর সময় কত সহজেই আমরা ভুলে যাই, আমাদের প্রতিদিনের কাজেকর্মেই আমরা দুর্নীতিকে জড়িয়ে ফেলেছি নিজেদের সঙ্গে।  ধর্মের নামে লড়াই করতে করতে, পশুপ্রেমের নামে লড়াই করতে করতে, রাজনীতির নামে লড়াই করতে করতে কত সহজেই আমরা আমাদেরই দেশের মানুষকে অন্যায় ভাবে আক্রমণ করে  বসি। দেশের ধারণাটাই বোধহয় আমাদের মধ্যে স্পষ্টভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। মানবতার এই বিপন্ন সময়ে ফিরে এলো তাঁর জন্মদিন, যিনি আজকের এই অন্ধকারকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন বহু আগেই। জীবনানন্দ দাশের এই কবিতা আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দেয়, কবিতার দৃষ্টিপথ সময়ের গণ্ডী পার হয়ে পৌঁছে যায় ঈশ্বরের কাছাকাছি।
 
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুনার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা 
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
                           

নক্ষত্র পতনের ঋতুতেই  চলে গেলেন ভালোবাসার কবি মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬ – ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) ,যাঁকে আমরা মনে রেখেছি আল মাহমুদ নামে ।কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক আল মাহমুদ   আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্‌ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন। ৭১এর যুদ্ধে সক্রিয় সৈনিক মাহমুদের অসংখ্য কবিতা আপামর বাঙালির হৃদয়ে ঘর করে আছে। এই সংখ্যায় তাঁরই একটি কবিতা দিয়ে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাব। 


আল মাহমুদের কবিতা 

কবিতা এমন
     
কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান  
 আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি  
 পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন  
 আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া–  
 আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!  
  
 কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী  
 কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন  
 পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ  
 মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর  
 বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।  
  
 কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর  
 ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান  
 চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে  
 নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।  
  
 কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস  
 ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর  
 গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর  
 কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার। 

 প্রবন্ধ

 

কবিতার তৃতীয় শ্রেণির পাঠক
তৈমুর খান 

কবিতার সেকেলে ধারণা নিয়ে কবিতার তৃতীয় শ্রেণির পাঠক জন্ম নেয়। স্কুল-কলেজের সিলেবাস মার্কা দৌড়, রাবীন্দ্রিক বলয়ের ঘুরপাক খাওয়া উপগ্রহ এবং কবিতা চর্চায় নিজস্ব তৃতীয় শ্রেণির জগৎ তৈরি করে এরা বসবাস করেন। কখনও আঞ্চলিক কোনও সংস্কৃতি কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে কূপমন্ডুকীয় ধারণায় এক কৃত্রিম করিশমা জাহির করেন। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যখন কবিতা চর্চায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার হিড়িক পড়ে গেছে ——তখন এই শ্রেণির পাঠক সংখ্যাই বেশি। নিতান্ত খারাপ সময় বলেই কবিতায় মিশে যাচ্ছে ইগোটিজমের বিপুল অ-সাধনা। 

এইসব কবিদের তৃতীয় শ্রেণির পাঠক কেন বলব? 
কবিতা যদি আনন্দের প্রকাশ হয় তা হলে সেই প্রকাশের মধ্যে একটা উত্তরণ খুঁজে পাওয়া যায়। স্রষ্টা নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবেই কবিতাকে বেছে নেয়। কবিতা ঘন্টা বাজিয়ে আসে না। কবিতার কোনও পূর্ব প্রস্তুতি নেই। অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ শব্দে প্রতিফলিত হলে লয়ে-মাত্রায় আন্দোলিত হলে কবিতা হয়ে ওঠে। সুতরাং কবিতা বিষয়ের বিবৃতি নিয়ে কিংবা পথ-সভার শ্লোগান হয়ে ফেটে পড়ে না। দুর্জ্ঞেয় মানসলোকের নিরন্তর পর্যবেক্ষণ থেকে দীক্ষিত হয়ে বেরিয়ে আসে। সুতরাং ব্যক্তির স্বপ্নটি সেখানে মর্যাদা পায়। তার অন্ধকার দশা কোন্ আকুতি নিয়ে স্পন্দিত হতে চায়, আলোকিত হতে চায় ——তা কেবল স্রষ্টাই জানেন। অতএব কবিতায় অধরা, অস্পষ্টতা, অসংলগ্নতা এবং অপ্রমেয়তা মিশে থাকেই। সেই কারণে অনেক সময় বিষয় না-থেকে বাজনার ব্যাপ্তিটাই বড় হয়ে ওঠে। 

      তৃতীয় শ্রেণির কবিতা পাঠক কবিতার ভেতর যখন বিষয় খুঁজে পান না, কবির অধরা, অপ্রমেয়তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন না, ব্যক্তির খোলসে যখন নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতির মিশেল ঘটাতে পারেন না ——তখন মুখ ফিরিয়ে পেছন দিকে হাঁটেন। হয়তো ফিরে যান রবীন্দ্রনাথে, ফিরে যান সিলেবাসের নির্বাচিত জীবনানন্দে। মোল্লার দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্তই। আবৃত্তিকার - সাংবাদিক - কবিরা ঘুরেফিরে জয় গোস্বামীর সাক্ষাৎকার নিতে এসে তিনটি কবিতার কথাই বারবার বলেন ——
১. নুন 
২. মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় 
৩. মেঘবালিকার জন্য রূপকথা 
বহুবার পঠিত। বহুবার আলোচিত এই কবিতাগুলি নিয়ে একই কথা বলতে শুনি। সেইসঙ্গে শুনি সুবোধ সরকারের “রূপম” কবিতাটির কথাও। 

       হে কবিতার পাঠক, কবি প্রতিভার কোনও একটি সময় এই সহজ কবিতাগুলি বেরিয়ে এসেছে কবিদের কলমে। আবৃত্তিকারদের কণ্ঠ টপাস করে তুলে নিয়েছে এগুলিকে। আর তাতেই এরা বিখ্যাত হয়ে গেছে। কিন্তু এই কবিদেরই আরও বহু কবিতা ছিল, সেগুলির কথা একবারও ওঠে না। পাঠক যখন তার প্রকৃত মনন হারিয়ে ফেলে, কবিতায় আত্মমগ্নতার ধার ধারে না, তখন সহজবোধ্য, বিবৃতিমূলক, শ্লোগানধর্মী কবিতাতেই প্রতিভার দীপ্তি দেখতে পায়। নিজের দৌড়টুকু বোঝার ক্ষমতা থাকে না। ভাবে, কবিতা হবে নজরুলের “সাম্যবাদী” লেখা আবেগের মতো। কবিতা হবে রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘা জমি”র মতো। কবিতা হবে ভিয়েতনামের সৈনিকদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রের মতো। শোষক ও শোষিতের বাস্তব চিত্র, কিংবা জীবনানন্দের “রূপসীবাংলা”র মতো। ঘুরেফিরে সেই একই সিলেবাস, একই সাজেশন, একই নোটস্। কবিতা তাদের কাছে বৈচিত্র্যহীন, আন্দোলনহীন, নতুনত্বহীন ডানাওয়ালা পিঁপড়ের মতো, স্তিমিত, মৃত্তিকাগামী, গর্তচারী ।

        মোটকথা তৃতীয় শ্রেণির পাঠক এক ঝাঁক পায়রার মতো গড্ডালিকা প্রবাহী জাতক-সাঁতারু। এরা সমুদ্র নয়, নদী নয়, এঁদো পুকুরের পশ্চাৎগামী মননহীন প্রাণী। জল ছিটিয়ে পাঁক মেখে চির শুভ্রতার গর্ব অনুভব করেন। শিক্ষক, অধ্যাপক থেকে শুরু করে ছাত্র-কবি-সম্পাদক অনেকেই এই দলে থাকেন। তাদের চোখের সামনে যখন তুলে ধরা হয় রবীন্দ্রনাথের “আরোগ্য” কাব্যের একটি কবিতা ——

“একা বসে সংসারের প্রান্ত জানালায় 
দিগন্তের নীলিমায় চোখে পড়ে অনন্তের ভাষা।”

তখন এই শ্রেণির কবিতা পাঠকরা “সংসারের প্রান্ত জানালা” কী তা জানেন না। “দিগন্তের নীলিমায়”, “অনন্তের ভাষা”ও তারা পড়তে পারেন না। এরকম বহু পংক্তি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে ——যা “দুই বিঘা জমি”র বাবু ও উপেনের বেড়া ডিঙিয়ে অনন্ত সভ্যতায় মানুষের চিরন্তন বাণী হয়ে উঠেছে। ঠিক তেমনি জীবনানন্দ দাশের “রূপসীবাংলা”র মৃত্যু এবং প্রকৃতির ধূসর ছায়া-মাখা থেকে বেরিয়ে আর এক জগতের ঠিকানায় পৌঁছাতে পারলে তাঁকে জানার সুবিধা হত ——

“আমলকী গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিক 
কার্তিকের রোদে আর জলে 
আমার হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন 
সূর্য? নাকি সূর্যের চপ্পলে”

এই পাঠকেরা আমলকী গাছের খোঁজ রাখেন না। তিনটি শালিকের সঙ্গে হৃদয়ের তিনটি নারী ——তারা সূর্য, নাকি সূর্যের চপ্পল পায়ে দিয়ে পৃথিবীতে এসেছে পাঠক জানতে চায় না। যেখানে বিষয়ের সহজ লভ্যতা নেই, কিংবা যে কবিতা সিলেবাসে ছিল না ——তা নিয়ে পাঠকের ভাবনার সময় থাকে না। সুতরাং আজকের কবিতা আন্দোলন এইসব কবিতা পাঠকের দরজায় কড়া নাড়তে পারে না। 

    তেমনি জয় গোস্বামীর “নুন”, “মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়” এবং “মেঘবালিকার জন্য রূপকথা”. ছাড়াও অনেক অনেক কবিতা আছে যেগুলির কথা উক্ত পাঠকদের মুখে একবারও শুনি না। “ভুতুম ভগবান”, “ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা”, “ওঃ স্বপ্ন!”, “পাগলী, তোমার সঙ্গে”, “বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা”, “পাখি, হুস”-এর মতো দুর্দান্ত কবিতাগুলি। এগুলিতে জয় গোস্বামীর প্রতিভা কতখানি বিস্ময়কর তার কিছুটা নিদর্শন মিলবে। অথচ কাব্যের কবিতাগুলি আলাদা বৈশিষ্ট্যে ও মাধুর্যে সমন্বিত ও উদ্ভাসিত। যেমন “বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা” কাব্যের “ভোজবাজি” কবিতায় লেখেন ——

“আর সাজাবো কানার পাশে খোঁড়া 
আর দেখাব হাতপোড়া রন্ধন 
আর মেলার সইপুতুলের জোড়া 
মানবো না আর মানবো না বন্ধন 
আর শোয়াব শিলের বুকে নোড়া 
আর দেখাব বরবধূ রং-ঢং 
মুড়িয়ে দেব হিংসে গাছের গোড়া 
মানবো না আর মানবো না বন্ধন”

তখন ছন্দ-লয়ের দোলায় আমরা কীরকম দুলতে থাকি তা পড়লেই অনুভব করা যায়। আমাদের শত অসামঞ্জস্যতায়ও আবেদনের মাধুর্যের রেশ শেষ হয়ে যায় না। কারণ কবিতার শেষ স্তবকে কবি বলেন ——

“আর নেভাব প্রেমের জ্বালাপোড়া 
দেব তোমার আঘাতে চন্দন 
ফেরাব ঢিল অন্ধকারে ছোঁড়া…”

এখানেই কবিতাটির উত্তরণ ও মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। “পাখি, হুস” কাব্যের “প্রেম”নামের একটি চার পংক্তির কবিতায়ও জীবনের আবেদন মারাত্মক ——

“আজ যেখানে রক্ত রাখো 
কাল সেখানে তৃণ 
কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছি সব 
বলিনি একদিনও!”

কবি তো নিঃশব্দে রক্ত এবং তৃণ দুই-ই কুড়িয়ে নিয়ে যান। প্রেম তো তাই-ই। এভাবেই জয়ের কবিতার বিশাল সমুদ্র ছড়িয়ে থাকে। তার কয়েক বিন্দু আবৃত্তিকারদের দৌলতে আমাদের কানে বাজে। আর সেসব নিয়েই তৃতীয় শ্রেণির কবিতা পাঠকেরা তাদের জানার সীমানাকে সংকুচিত করে ফেলেন। বাকি কবিতা পড়ার প্রয়োজন মনে করেন না। 

     সুবোধ সরকারের “রূপম” কবিতায় “রূপমকে একটা চাকরি দিন” আবেদনটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। বাস্তব দিক থেকে কবিতাটি আমাদের মনের দরজায় করাঘাত করে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে সুবোধ সরকার একটিই ভালো কবিতা লিখেছেন এ ধারণা উক্ত পাঠকেরা কেন পোষণ করবেন? এর কোনও সদুত্তর পাইনি। তা ছাড়া কবিতাটির ভেতর যে দর্শন আছে পাঠক কি তারও ঠিকানা জানে? সুবোধ সরকার যখন “আড়াই হাত মানুষ” কাব্যের একটা ছোট্ট কবিতায় বলেন ——

“ভালোবাসা কুয়াশায়, কুয়াশাকে পান করি, খাই 
আমি যেন এ জীবনে কুয়াশাকে লিখে রেখে যাই।”

তখনই মানবজীবনের জটিল ক্রান্তিকাল নির্দেশিত হয়। বাহ্যিক চাওয়া-পাওয়ার ভেতর লুকানো থাকে সেই কুয়াশা যা হয়তো জীবনানন্দের কাব্যে “উটের গ্রীবার মতো” আমাদের জানালায় এসে দাঁড়ায়। পাঠক খোঁজ রাখে না এই কুয়াশারও। এইভাবেই কিছু কিছু কবিতা দুর্বল পাঠকের ভাললাগার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এদের শিল্পীর মানসলোক বোঝার সামর্থ্য থাকে না। ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এমনকী সামাজিক অবক্ষয়ও অনুধাবন করার বোধ গড়ে ওঠে না। ফুরফুরে বাতাস আর পোশাকের নান্দনিক ঔজ্জ্বল্যে এরা হাইব্রিড প্রজন্মের কবি-পাঠক হয়ে সভ্যতার ক্রান্তদর্শী রূপে নিজেরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। কী তীব্র দহন আর নিঃসঙ্গের হাহাকার যখন মানুষকে অস্তিত্বের ধ্বংসস্তূপে ঠেলে দেয়, তখন কবি কী লিখতে পারেন? যা লিখতে পারেন তা শুধু আত্মিকসংকট থেকে বেঁচে থাকা তথা টিকে থাকার সংকটকেই। অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছেন ——

“I saw the best minds of My generation Destoeyed by madness, starving hysterical naked.”

সুতরাং ঐতিহ্য মুছে গিয়ে সময়ের স্বাক্ষর নিয়ে কবিতার সৃষ্টিধারা। কবিতা যেন উৎসবের নয়, ভালো থাকার নয়, কবিতা যেন ধ্বংস আর কালবেলার ; ইতিহাস আর রক্তের, মরণ আর জীবনের। কবিতার পাঠক আবেগের উদ্বেল কণ্ঠস্বরে কবিতাকে পেতে চায় । যেখানে মনন নেই, ফ্রয়েড নেই, জীবনের একান্ত নিঃসঙ্গতার স্তব্ধতা নেই, রূপক এবং সাংকেতিক বিনির্মাণে কবিতায় অসংলগ্নতা আসে না, ভাবের অস্পষ্টতায় কুয়াশা সৃষ্টি করে না, মেধার ইন্টেলেকচুয়াল পরিচয় নেই ——সেই ধরনের কবিতা এই শ্রেণির পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দুঃখের বিষয় এদের সংখ্যাই বেশি। আর এই কারণেই স্রষ্টার সৃষ্টি এখনও সেই আলোয় আলোকিত হয় না।

আঞ্চলিক কবিতা


বিকাশ দাশ 


ইটা কনু সুখের সময় লয় 


" ইটা কনু সুখের সময় লয় হ্যে
ইটা কনু সুখের সময় লয়,। " 
দুখের ডুংরি ডিঙ্গায় যিমন 
দু-চ্যখে লদী বয়। 
কতেক সুখে কতেক দুঃখে 
আশা লিয়ে বুক বাঁধি 
মরা ছায়ের সুহাগ লিয়ে 
পা ছ' ড়ায় লিতই কাঁদি। 
চুপ মারে সোব জুয়ান গুল্যান 
আর কতক সবুর সয়?  
ইটা কনু সুখের সময় লয় হ্যে
ইটা কনু সুখের সময় লয়। 

দ্যাবতা নকি বাঁচে আছেক 
ত ক্যামনে ইমন হয় দশা?  
রকত ঢাল্যে ফসল ফলাই 
গতর লিয়ে লাঙ্গল চষা। 
খাটেও ক্যানে খাবার নাই 
কি জানি ক্যামনে ইমন হয়?  
ইটা কনু সুখের সময় লয় হ্যে
ইটা কনু সুখের সময় লয়। 

ঝুপড়ি ঘরে জোসঠার আল্য 
ছায়ের পারা হাসছ্যে 
যিমন লইতন বউ মরদটাকে 
বেদম ভাল্য বাসছে। 
বইশাগ মাসের চ্যাঁদড় রদে 
ফাটে গ্যাছে মাটি 
পাহাড়ের পারা দুখ্যু লিয়ে 
কি করে কাল কাটি। 
কাঁসাই লদী শুয়্যে কাটায় 
কনু কম্মের লয়। 
ইটা কনু সুখের সময় লয় হ্যে
ইটা কনু সুখের সময় লয়। 

আগুন জ্বলে মনের ভিতরে 
যিমন মাদল্যে তাল দিছ্যে 
মরব ; না হয় মারব ইবার 
নাহ্ লে বাঁচা মিছ্যে। 
কাঁড় বাঁশ আর টাঙি গুল্যান 
তেমন কথাই কয়। 
ইটা কনু সুখের সময় লয় হ্যে
ইটা কনু সুখের সময় লয়।।







দুটি কবিতা 

মিঠুন চক্রবর্তী

 মুক্তি


চোখের ফুঁ-তে অন্ধকার নেভালে যখন
আমি আঁকছি বরফের চূড়ো,
হেসে, আঙুলে বিল্লি কেটে নামিয়ে আনলে পঞ্চনদী
নিমেষেই ভাসল আমার টেবিলে রাখা ঋণের খাতা

এবার কি করে যে বাজারে ঋণমুক্তি হবে আমার !
হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি যখন....
সবজির আড়ৎ থেকে বলে উঠলে, মুকুব
মাছের আড়ৎ থেকে বলে উঠলে, মুকুব
আরও কোথা থেকে কোথা থেকে যে বলে উঠলে,
                                                         মুকুব.... মুকুব....

এখন আমি চোখে কিচ্ছু দেখতে পাই না, আকাশ ছাড়া

দোতারার অধিকার

  বোধন এবং বিসর্জনের মাঝেও দু'লছে তৃতীয় নয়ন-নৌকা।
আলোর পিছনে অস্ফুট ক্ষতে রাত্রি জেগেছে চৌকাঠ....
অথচ, তুমিও হামাগুড়ি দিয়ে জল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছ এক শেকড়ে,
বৃক্ষ বেঁধেছে দোতারার ভাষা নারী-পুরুষের ভেতরের।

দিয়েছি তোমাকে ফুলের পাহাড়, এঁকেছি তোমাকে নরম,
মানুষ বলতে পুংলিঙ্গই, দেবীত্ব নাও বরং।
'নমস্তস্যৈ...' বলেছি অনেক, বলো, চেয়েছ কি নমস্কার ?
পাশের বাড়ির বোনটি চেয়েছে ভাইয়ের মতো অধিকার।


দুটি কবিতা
পিনাকী দত্ত গুপ্ত

এসো বিদ্রোহ করি

আজকে শৈত্যপ্রবাহের দিন, তবুও রক্ত ফুটছে শিরাতে শিরাতে,
গোলাপের কাটা বিঁধেছে হৃদয়ে, বেলা ও অবেলা ভালোবাসা খেলা মিথ্যে,
আজ নয় চোখ, মুখ বেঁধে রাখি কালো কাপড়ের লজ্জায় ভেজা মোড়কে,
রাজার আদেশ উপেক্ষা করে শানিত অস্ত্র তুলে নিক হাতে ভৃত্যে!

সাহিত্য-সভা মূলতুবি রাখো, ছিঁড়ে ফেলো মেকি লগ্নভ্রষ্ট সম্মান;
সমকাল কবি, আজ তোমাদের কলমে ঝরুক বজ্রকঠিন মন্ত্র,
সাজি ভ'রে ফুল তুলে রাখো, দিতে হবে সেনা'দের ছিন্নভিন্ন চরণে,
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, হাতে তুলে নাও অগ্নি-মূখর যন্ত্র

মৃত্যু না! নবজন্মের পথে না হয় ঝরুক তরতাজা কিছু রক্ত;
তবু কেন বলো বুক পেতে নেবো বুলেটের ধোঁয়া,  অর্বাচীনের স্বর্গে?
প্রতিশ্রুতির মিথ্যা প্রচারে কলঙ্কময় বিকলাঙ্গেরা হাসছে,
ভূমিহীন শিশু, নগ্ন যুবতী, জাতীশ্বরেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মর্গে!

মৃত্যু-মিছিলে হয়ত তুমিও, হয়ত আমিও, হয়ত মৌন ঈশ্বর!
রাষ্ট্রনেতারা, কান খুলে শোনো! সময় এসেছে, জবাব চাইছি আমরা!
আফিঙের ঘোরে আর কত কাল ভুলিয়ে রাখবে প্রাদেশীকতার মোড়কে?
প্রস্তুতিহীন বেলা বয়ে যায়, বারুদের তাপে এবার পুড়ুক চামড়া |

স্পষ্ট বলছি, এ কবিতা নয়, শাপমোচনের সময় এসেছে সমুখে,
বাজছে দামামা, বুঝে নেবো আজ অধিকার, তবু বারুদে পুড়ুক চামড়া...




কোনো কথা নেই

তোমাকে বলার মত আজ আর কোনো কথা নেই ;
এখন গভীর রাত... ঘুমের আড়ালে জাগে চোখ!
বিসন্ন তারা-গুলো টুপ টুপ টুপ ঝ'রে পড়ে,
অনিশ্চিতের সাথে কিছুটা সময় দেখা হোক |

দেখা হোক... ফিরে দেখা, একা একা বড় রাস্তায়..
কুয়াশায় ভিজে যাওয়া আবছা অবশ অবয়বে,
কিংবা গলির মোড়ে যেখানে ছায়ারা খেলা করে,
যেখানে সময়-সাঁকো ভেঙে গেছে, ভেঙে গেছে সবে!

দেখা হোক ভিনদেশি সেই ডাক-পিয়নের সাথে
যার কাছে গচ্ছিত ছিলো কিছু সাময়িক চিঠি,
কিংবা আগুন ঘিরে রাত-ভোর বসেছিলো যারা,
তারপর... অরণ্যে ফিরে গিয়েছিলো গুটিগুটি...

তারপর ... তারপর... কত দিন, রাত কেটে গেছে...
বৃষ্টিতে ভিজে গেছে জোষ্ঠের বুক ফাটা মাটি,
বুনোফুল, চোরকাটা, ভাঙা বেড়া, কাঠালের পাতা,
হেঁসেলের টুকিটাকি, টোল খাওয়া ঘর, ঘটি, বাটি;

এখন গভীর রাত, দেয়াল ঘড়িতে টিক টিক...
শুনশান পথ ঘাট, দরজাটা খিল দিয়ে আটা;
বাকি শব্দেরা আজ ধুম জ্বরে ঘুমিয়ে পড়েছে,
পেনিসিলিনের ঘোরে তাই কিছু আঁকিবুকি কাটা!

ঘুম নেই দুই চোখে, ছায়ারা শিশিরে ভিজে গেছে, 
হেটেছি অনেক পথ, বাকি আরো অনেকটা হাটা ||




দুটি কবিতা
জ্যোতির্ময়মুখার্জি

নেই বেহারা। নেই বেহারা


বহুবার অপেক্ষার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি
দেখলাম, সে আহারে ব‍্যস্ত। চামড়ার আশেপাশে

ভাঙতে ভাঙতে গড়িয়ে পড়ছে চাঁদ
আর আমি ভাবছি সন্ধ্যা হল

এভাবেই চাঁদগুলো সব একগুঁয়ে হয়ে যায়
আর আমরা ছাতা গুটিয়ে এসে বসি পাল্কীর ভিতর

‘পাল্কী চলে
পাল্কী চলে
দুল্কি চালে
নৃত্য তালে’

নেই বেহারা। নেই বেহারা

রান্নাঘরেও কবিতা থাকে

রান্নাঘরেও কবিতা থাকে
তোমার পাঁচমিশালী হেঁশেলে

দিন আনি
দিন খাই
ক্ষতি কী?

ঘি, মাখন যে হতেই হবে এমনতো নয়

তুমি ভাত বাড়ো
আমি এসে বসি পাতে

ছনছন চুড়ির শব্দ
আর তোমার আনাগোনায়, দেখো
ভাতগুলো’ও ঠিক কবিতা হয়ে যাবে



দুটি কবিতা

সুব্রত  মণ্ডল 



ছেড়ে চলে গেলে
জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পরে বন্দরে পড়ে থাকে একাকিত্ব শুধু। দুটো চোখ বন্ধ করে দুটো পাড়। মাঝরাতে ফিরে আসে নেশাতুর ঢেউ।
পাটাতনে শুয়ে থাকে যাবতীয় হিসেবের ছক। পুরোনো মাস্তুল।
অভিমানী সন্ধ্যার গন্ধ বুকে বন্দর ভরে যায় জলে। ভেসে যাই মাছেদের মতো। ঠিকানাবিহীন।
তুমিও কি চাঁদ দেখো? তারাদের নাম করো সারারাত জেগে?তারা কেউ বেঁচে নেই আর। নোঙর করতে করতে একদিন দেখা হবে জেনে ভালো আছে অভিমানী নদী।
এখন পাড়ে বসে তারাখসা দেখি। তোমার চোখে সেই খসা তারা।আলো জ্বলে। তারপর দপ করে নিভে যায় বন্দরের ঘুম। জাহাজ ছেড়ে গেলে সেও তো একা হয়ে পড়ে। তোমার মতো ।একদম একা।
ক্ষিদে
গালিচা বেয়ে চমৎকার উঠে এলো
গায়ে হলুদের মত দিন
উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সহস্র অসুখ গায়ে
এইসব নীল নীল যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কথা লিখে গেছে কুয়াশাচ্ছন্ন ঘুম
কেবলই স্রোতের টানে মিশে গেছি কচি লাউ খাড়ায়
সবুজে আচ্ছন্ন পরিপাটি সেই চুল
নিদ্রাহীনভাবে ঢুকে গেছে বালিকা বিদ্যালয়ের গেটে
যেনো সৌভাগ্যরা কতকাল অনাহারে বসে আছে পথের ধূলোয়

 দুটি কবিতা 
গৌতম কুমার গুপ্ত


সান্নিধ্য


ধোঁয়া গড়াতে না গড়াতেই রহস্যাবৃত হল প্রাণাধিক হৃদয়।ভালবাসা সেঁকে নিচ্ছে আগুন।রুটির মতো লুফে নিচ্ছে মাংসের তাল।আপ্লুত হচ্ছে স্নায়ুসন্ত্রাস উষ্ণ সান্নিধ্যে।

একটি ত্রিকোণ ক্ষেত্র কেন অহরহ ঘুরে বেড়ায়?  ধরা যায় না।প্রতুল হাওয়া আর ধোঁয়া কুন্ডলী পাকাতে পাকাতে চলে যাচ্ছে জ্বালায়।যন্ত্রণায়।বিষাদমন্দ্রে

সে কি এতোই অধরা মাধুরী ? কবে থেকে অভ্যাসে দিয়েছি মন, প্রযত্নের কারুকাজ, শস্যের বিবিধ তোলপাড়।মাটি ও জল ও বাতাস ও সার সব সব কিছু।অধ্যবসায় অনির্বাণ।

ক্রমে ক্রমে ঘুরে আসছে স্রোতস্বিনী। প্লাবিত উপলে জলবাহিকা হয়ে আমার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে নিরুচ্চার তটিনীবৈভব।আকাশে ছযলাপ এক নীলিমা কন্যা।

তখন ডানা মেলে উড়ে এল চন্দ্র নক্ষত্র রোহিণী।আনকোরা গন্ধে টের পেলুম এই আমার বাসন্তী শাল্মলী,ফাগুনসাটের মলয় চন্দন।আমার সবিশেষ ওৎ আমাকে পেতে দিয়েছে ভালবাসা।
বইমেলায় 
বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে আমি তো তোমাকেই পড়ছিলাম।
তোমার চোখ ছিল সিগনেটের শঙ্খ সুনীলে
কখনো জয় সুবোধে
আমি সুধীর শ্রীজাত পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে
তোমাকেই পড়ছিলাম।

দেখছিলাম তোমার অনুপ্রাস ব্যতিহার অলংকার
শরীর সংরাগে উপত্যকা বহুল অমিত্রাক্ষর
অভিন্ন মাত্রাবৃত্ত আমাতে মিশে যাচ্ছিল।

অথচ আমার কাঠিন্যে বেভুল ছন্দ 
বানান ভুলের মুখসিঃসৃত বাক্যবাণ ছিল।

অগত্যা আমি তোমার পৃষ্ঠায় ছন্দ শিখে নিলাম
তোমার সুঠাম পদ্যরীতি অভিরাম প্রচ্ছদ
লিথোগ্র্যাফি আমাকে মুগ্ধ রাখছিল ক্ষণে ক্ষণে
তুমি জানলে না বুঝলে না তোমার অজান্তে
আমি '---তুমি' বইটা কিনে নিয়ে
আমার পেপারব্যাকে বাড়ি ফিরলাম।

পশ্চিমে তখন সাঁঝবাতির মৃদু আলো ফুটছিল।




দুটি কবিতা
পার্থসারথি

আমার আমি

আমি জানি আজ কারা আমাকে ঘিরে সর্বক্ষণ
আমি জানি আজ কোথায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি দর্শন
আজকে বিবেক কোথায় করেছে আত্মসমর্পণ
কোন সুরে আজ গান বাধা হবে? কোন গালে চুম্বন?
পিছনের দিকে তাকাতে চাই না, স্মৃতির রোমন্থন
রং তো আমি বদলাতে পারি, পেলেই সমর্থন
সকল ক্ষেত্রে বক্তব্য আছে, অবাধ বিচরণ
আদর্শ? ওই বাজে কথা রাখো, ওসব বিসর্জন
এই দক্ষতা কাজে এসে গেছে, যা কিছু অর্জন
মিডিয়া আমাকে উপাধি দিয়েছে, আমি বিদ্দ্বজন


বিপণন

বহুচর্চিত প্রসঙ্গগুলো কে নিরপেক্ষ দৃষ্টি তে দেখার প্রহসন
আসলে আমি সব কিছু নিজের দৃষ্টিতেই দেখি
আর নীচে সাবধান বাণী শুনিয়ে রাখি
প্রতিষ্ঠাতত্ত্বে খারিজ হয়ে যাওয়া বাণীগুলি কে বক্তার  নিজস্ব মতামত বলে

আমি কখনো এগিয়ে  থাকি কখনো এগিয়ে রাখি
এপক্ষ ওপক্ষ  প্রতিপক্ষ কে নিয়ে আপনার ভাবনা চিন্তা কে
সহস্র যোজন পিছিয়ে দেই
গৌরব বৃদ্ধির কৌশল বাড়াতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করি না

আমি নিয়ন্ত্রণ করি পরাজিত মধ্যবিত্ত র অন্দরমহল
নিমেষে পৌঁছে যাই আমার সস্তার ঝুলি নিয়ে
আস্ফালন করি আমার শক্তির
আর উল্লাস করি আপনার নিশ্চিত পরাজয়ের

আপনি অবগত তথ্যের বিকৃতি আর অসত্যতা বিষয়ে
কিন্তু আপনি শ্রোতা, দর্শক
সচেতন মনে আপনি আটকাতে পারেন না
ঘন্টাখানেক আমার মগজ ধোলাইয়ের পারদস্তম্ভ

আমি আপনি সবাই নিশ্চিত ছাদের তলায় নিদ্রায়
কারণ সীমান্ত প্রহরায় অবিচল আমাদের সেনারা
আমি অবলীলায় টেনে নামাই তাদের
তাদের কৃতিত্ব কে খাটো করে পণ্য হিসাবে বাজারে বেচি

কিন্তু কোথায় কবে কার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে
তার চুলচেরা বিচার আমার কাছে
সোনালী জগতের তীব্র নেশায়
চোখ তুলে তাকানোর সময় নেই কফিনের দিকে

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আমি কাশ্মীরের সেনাকে উপহাস করি
কারন আমার কাচের ঘরে কেউ পাথর ছোড়ে না
উৎকণ্ঠার রাত কাটায় না আমার পরিবার
রাতের নিরাপত্তায় আমি ঘরে ফিরি, কফিন নামে না আমার দরজায়


 দুটি কবিতা 

সৌমী শাঁখারি


ঠিক কেউ না কেউ ভালো রাখে

ঠিক কেউ না কেউ ভালো রাখে
নদীর মতো ছেড়ে গেলো যারা..
বুকের মধ্যে ভালোবাসার শোক নামিয়ে
দেখেনি বন্যায় ভাসা চাঁদের খোঁজে তারা..
মাঝরাত্তিরে ঘুমঘোরে দেয় চোখের স্তব্ধতা কাঁপিয়ে!
একলাই তো আমি অনেকদিন দৃষ্টিছাড়া..
সোপানে এঁকে রেখেছি কান্নার জলছাপ
ফাগুন কোথাও অকালেই লুব্ধ বসন্তে পথহারা..
কেউ পড়ে দেখেনি পড়ন্ত মনের রুগ্নতাপ!
জোয়ারের সাথে পা বাড়িয়ে হাঁটি..
স্রোতের ঘরকে দ্রুততার সাথে বাঁধি
যদি পাওয়া যায় স্নেহমাটি খাঁটি?
সকালের বোবা রোদ্দুরকে সহস্র অনুনয়ে সাধি!
নদীর মতো ছেড়ে গেলো যারা..
বোঝেনি বিস্তর বোঝাপড়া বাকি থাকে
সুখ,অসুখেরও থাকে জড়ানোর অব্যাহত ধারা..
ঠিক কেউ না কেউ ভালো রাখে!!


ভালোবাসা কারে কয়


তুমি ছুঁয়ে না ছুঁয়ে সেই অনুভূতির বিকিরণ করেছো সূর্যালী প্রতিটি রোমকূপে,
যাকে বেলা অবেলার অস্তমেঘের আলয়রা নিশ্চিন্ত কোল বলে জানে।
তুমি বেদান্ত পারের ফেলে আসা স্মৃতি তলে হেঁটে যাওয়া সেই পূরাতন পথিক,যার  দীপ্তিতে চিরউজ্জ্বল কবেকার সড়কের পদচ্ছাপ।
তুমি সহস্রাব্দের পাথরে ক্ষয়িত সেই ইতিহাসের  বানী,যার অতল খুঁড়ে কেউ দেখতে চেয়েছে সৌম্যপুরুষের মুখ।গভীর অসুখে  ছেয়ে গেছে অস্তশেষের রাঙ্গা আলো, 

তুমি ঝড়বেগে সেই পাখিটির শিরশিরে কাঁদতে থাকার কাঁপন,যা দেখা যায় না চোখের আলোছায়া জড়ানো তটে।অথচ তার সিক্ততা ভিজিয়ে দেয় সামুদ্রিক হৃদয়ের জলরাশির ঢল।
তুমি নিয়ত জ্বলে থাকা একলা তারার নামহীন গীতিকবিতা,যার লেখনীর আঁচড়ে কবি লিখে রেখেছে মরমের যন্ত্রণার স্তুতি।
অনেক,অনেক কালঘুম পেরিয়ে,হৃদয় বিকিকিনির হাটে তুমি আবার এসে দাঁড়ালে নিশ্চিন্ত নীরবতায়।
জন্মের আগেও,জন্মের পরেও ঠিক তেমনি।
আমি কি চিহ্নিত করতে পারলাম আমার চিরচেনা
  শঙ্খচূড় শব্দের যৌবন?
জানলাম, কাকে বলে ভালোবাসা?

                           



একটি কবিতা

  সন্দীপ ভট্টাচার্য্য


  প্রিয় তপস্যা

   
ধানসিঁড়িটির নীরব স্রোতের ধারায়
অন্যরাতের আঁধার কথা বলে,
বুকের গভীর সেথায় শুধু হারায় -
যেথায় তোমার স্বপ্নেরা শুধু ঢলে ।

গগনচুম্বী স্মৃতির আকাশ জুড়ে
একফালি মেঘে মাতাল নাভিশ্বাস,
খণ্ডিত প্রেমে নির্বাক চোখ ভরে -
প্রাণদাহী বুকে শুধুই তোমার বাস ।

বেহাগ ছুঁয়েছে প্রিয় বাতাসের হাসি
মুঠোতে ধরেছি অবিরাম অভিমান ,
বিশ্বাসে ভাসে শুধু জীবনের রাশি -
দৈন্যতা তবু বাড়ায় প্রেমের দান ।

উদাসীন সুখে শুধু এক-আলো ঋণ
দিনযাপনের পরিযায়ী ভাষা ভাসে,
দুরন্ত চোখে বাড়ে ছায়াসৃত দিন -
নির্বাধ স্রোতে আগামীরা শুধু হাসে ।।






Wednesday, 26 December 2018

'সাহিত্য এখন' নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ২০১৮









সম্পাদকীয়-
রোদ্দুর হতে চেয়েছিলেন কবি। বাংলা সাহিত্যের আকাশে রোদ্দুর হয়েই ছিলেন এতদিন। কবিতার ছত্রে ছত্রে আলোকপাত করেছেন সমাজের ত্রুটিবিচ্যুতির দিকে  বলেছিলেন, “যা দেখি, তাই লিখি”। নিরাসক্ত এক দর্শকের মতো চুপ করে দেখেছেন, দেখতে শিখিয়েছেন আমাদেরও।প্রয়োজনে আঙুল তুলে  সেই শিশুটির মতো দেখিয়ে দিয়েছেন, রাজা কেমন উলঙ্গ।
নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা খুঁজে পাই অসংখ্য প্রশ্ন। নির্দিষ্ট করে কোন উত্তরের কথা বলে যাননি কবি। বরং বলা ভালো, প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন। তাঁর কোন কবিতাই একমাত্রিক নয়। কবিতা কোনদিনই একমাত্রিক হয় না। প্রতিটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হয় ভাবনার বহুস্তর। তিনি যেন এক বিরাট বটগাছ। ভাবনার বীজ ছড়িয়ে দেন পাঠকের হৃদয়ে, শেকড় ছড়িয়ে দেন কবিতায়।
'কলকাতার যিশু'  আর নেই। কিন্তু তাঁর কবিতার মৃত্যু নেই। কবিতার মৃত্যু হয় না। যিশুর মতোই কবিতার ছত্রে ছত্রে পুনরুত্থিত হবেন কবি। অমর হয়ে থাকবে তাঁর কবিতারা। 
 
শিয়রে মৃত্যুর হাত
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
(নীল নির্জনে)

শিয়রে মৃত্যুর হাত। সারা ঘরে বিবর্ণ আলোর
স্তব্ধ ভয়। অবসাদ। চেতনার নির্বোধ দেয়ালে
স্তিমিত চিন্তার ছায়া নিভে আসে। রুগ্‌ণ হাওয়া ঢালে
ন্যাসপাতির বাসী গন্ধ। দরজার আড়ালে কালো-টুপি
যে আছে দাঁড়িয়ে, তার নিষ্পলক চোখ, রাত্রি ভর
হলে সে হারাবে।
                           সিঁড়ি-অন্ধকারে মাথা ঠুকে ঠুকে
কে যেন উপরে এল অনভিজ্ঞ হাতে চুপিচুপি
ভিজিট চুকিয়ে দিয়ে ম্রিয়মাণ ডাক্তারবাবুকে।

শিয়রে মৃত্যুর হাত। স্তব্ধীভূত সমস্ত কথার
মন্থর আবেগে জমে অস্বস্তির হাওয়া। সারা ঘরে
অপেক্ষা নিঃশ্বব্দ জটলা। যেন রাত্রির জঠরে
মানুষের সব ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভাসিয়ে শূন্য সাদা
থমথমে ভয়ের বন্যা ফুলে ওঠে। ওদিকে দরজার
আড়ালে আবছায়া-মূর্তি সারাক্ষণ যে আছে দাঁড়িয়ে,
নিষ্পলক চোখ তার। নিরুচ্চার মায়ামন্ত্রে বাঁধা
ক্লান্তির করুণ জ্যোৎস্না নেমেছে শয্যার পাশ দিয়ে।

শিয়রে মৃত্যুর হাত। জরাজীর্ণ ফুসফুসে কখন
নিশ্বাস টানার দীর্ঘ যন্ত্রণার ক্লান্তি ধীরে-ধীরে
স্তব্ধ হয়ে গেছে কেউ জানে না তা। ভোরের শিরশিরে
হাওয়ায় জানলার পর্দা কেঁপে উঠে তারপর আবার
শান্ত হয়ে এল। ছায়া অন্ধকার। মাঠ-নদী-বন
পেয়েছে নিদ্রার শান্তি। এদিকে রাত্রির অবসানে
সে-ও নেই। শান্তি! শান্তি! সে চলে গিয়েছে। সঙ্গে তার
কে গেছে জানে না কেউ, শুধু এই অন্ধকার জানে।


 প্রবন্ধ
 

মানবতাবাদে বিশ্বাসী জগজীবনপুরের তুলাভিটা আজও অমলিন

ভাস্কর পাল



ইতিহাসে ঘেরা এক অনবদ্য শহর মালদহ বা মালদা। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত একটি  জেলা শহর। মনে করা হয় যে  মলদনামে এক প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর নাম থেকে মালদহবা মালদানামটির উৎপত্তিআবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ফারসিমালযার অর্থ ধনসম্পদ ও বাংলা দহযার অর্থ হ্রদ বিশেষ। এই শব্দদ্বয়ের সম্মিলিত রূপ মালদহ। এই প্রিয় শহরটি আমের শহর হিসেবেও পরিচিত , আবার মসজিদের শহর হিসেবেও মালদহের বেশ পরিচিতি রয়েছে। তাছাড়া এখানকার আম, পাটের কাজ আর সিল্ক পৃথিবী বিখ্যাত।  মালদা শহরটিকে ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে রেখেছে বাংলার গর্বের দুই প্রাচীন শহর গৌড় ও পান্ডুয়া। একসময় মালদা এবং তার আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলটি পুন্ড্রবর্ধন নামেও পরিচিত ছিল। এই পুন্ড্রবর্ধন ও গৌড় গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
ঐতিহাসিক ডাঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ এই সময়ে গুপ্ত বংশীয় বুধ গুপ্ত ছিলেন উত্তর ভারতের সম্রাট , তিনি ছিলেন গুপ্ত বংশের শেষ সম্রাট বুধগুপ্তের রাজত্বকালে সোমপুর ধৰ্ম্মবিহার  গুহ নন্দী প্রমুখ  নিগ্রন্থদিগের বাসভূমি ছিল । বুধগুপ্তের পরবর্তী সময়ে কে উত্তর -ভারতের একচ্ছত্র সম্রাট হবে সেটা নিয়ে  নিদারুণ সংগ্রাম চলছিল
পরে পাল বংশ গুর্জর বংশ কে পরাভূত করে নিজ বংশের গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছিলেন এই সময়ে ছিন্ন ভিন্ন হতোদ্যম বাঙালি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে শৌর্য বীর্য ও দক্ষতার সাথে বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিল। যার যাদু মন্ত্র ছিল বৃহত্তর বাংলার ঐক্যবদ্ধ শক্তি। এই শক্তির ভিত্তি রচনা করে গিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠাতা শশাঙ্ক পাল সপ্তম শতকে গোপালের নেতৃত্বে পুরো অঞ্চলটিতে পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অঞ্চলটি গৌড় হিসেবে পরিচিতি পায়। এসময়ে অঞ্চলটিতে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

বাংলার ইতিহাসে পালবংশের আধিপত্যের এই চারশো বৎসর নানাদিক থেকে গভীর ও ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। বর্তমান বাঙালি জাতির গোড়াপত্তন হয়েছে এই যুগে। শশাঙ্ক যদিও শুরু করেছিলেন কিন্তু পাল আমলেই বাঙালির রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ লাভ করে বাংলা ভাষা ও লিপির গোড়া খুঁজতে হলে এই চারশো বৎসরের মধ্যে খুঁজতে হবে। এই লিপি, ভাষা, ভৌগলিক সত্ত্বা ও রাষ্ট্রীয় আদর্শকে আশ্রয় করে একটি স্থানীয়সত্ত্বাও গড়ে উঠে এই পাল যুগে।

পাল রাজাগণ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তারা নিজেরা ছিলেন বৌদ্ধ অথচ বৈদিক হিন্দু ধর্মও তাদের আনুকূল্য ও পোষকতা লাভ করেছিল। এমনকি একাধিক পালরাজা হিন্দু ধর্মের পূজা এবং যজ্ঞে নিজেরা অংশ গ্রহণ করেছেন, পুরোহিত সিঞ্চিত শান্তি জল নিজেদের মাথায় গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মে ব্রাহ্মণের নিয়োজিত করেছেন , এইভাবে পালবংশকে কেন্দ্র করে বাংলায় প্রথম সামাজিক সমন্বয় সম্ভব হয়েছিল।

পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে নালন্দা, বিক্রমশীলা, ও দন্তপুরী, সারনাথের বৌদ্ধ সংঘ ও মহাবিহারগুলিকে আশ্রয় করে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ জগতেও বাংলা ও বাঙালির রাষ্ট্র এক গৌরবময় স্থান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।এই সকলের সম্মিলিত ফলে বাঙলায় এই সময়েই অর্থাৎ এই চারশো বৎসর ধরে একটি সামগ্রিক ঐক্যবোধ গড়ে উঠে। এটাই বাঙালির স্বদেশ ও স্বজাত্যবোধের মূলে এবং এটাই বাঙালির একজাতীয়ত্বের ভিত্তি। পাল যুগের এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ দান ।

এই পরম্পরা মেনে রাজা মহেন্দ্রপাল, কুড্ডলখটকা এবং পুণ্ড্রবর্দ্ধন ভুক্তি প্রজ্ঞাপারমিতা এবং অন্যান্যদের পূজার জন্য বজ্রদেবকে দায়িত্ব দেন  বৌদ্ধবিহার গড়ে তোলার জন্য। মহাসেনাপতি বজ্রদেবের অনুরোধে গৌতম বুদ্ধের পুজো এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপাসনার জন্য রাজা মহেন্দ্র পাল মহাবিহার নির্মাণ করার জন্য ভূমি দান করেছিলেন। এই মহাবিহার পরেনন্দদীর্ঘিকা উদরঙ্গবৌদ্ধ মহাবিহার নামে পরিচিত হয়। গবেষকদের মতে, এই মহাবিহার নালন্দা মহাবিহারের থেকেও পুরনো।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে পাল শাসক মহাদেব পাল জায়গাটি বৌদ্ধদের দান করেন এবং পাল শাসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়  তৈরি এই নন্দদিঘি বিহার। এই বিহারে আবিষ্কৃত হওয়া নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমন, বিভিন্ন ধরনের পোড়ামাটির মূর্তি ও টেরাকোটার ফলক প্রভৃতি নিদর্শনগুলো মালদা মিউজিয়াম ও কলকাতার প্রত্নতাত্ত্বিক মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
নন্দদিঘি বিহার যা বর্তমানে মালদা জেলার হবিবপুর থানার বৈদ্যপুর অঞ্চলে অবস্থিত যে অঞ্চলের মাটির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের বিস্মৃত হওয়া অধ্যায় ।
মালদা শহর থেকে প্রায় ৪৬ কি.মি. দূরে অবস্থিত জগজীবনপুর পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র দেড় ঘন্টা। ওপারে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার সীমান্তের কাছেই এর অবস্থান। জগজীবনপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মহানন্দা ও ট্যাঙ্গন নামের স্রোতস্বিনী দুই নদী। হটাত আবিস্কার হওয়া তথ্যে  ইতিহাস কে নতুন করে উপস্থাপন করেছে আমাদের কাছে ।

১৩ ই মার্চ ১৯৮৭  সালের ঘটনা। “ তুলাভিটা” নামে এক জায়গার এক ব্যাক্তি  মহেন্দ্র গায়েন। তার কনিষ্ঠ পুত্র জগদীশ গায়েন ১২ ফুট উঁচু ঢিপির উপরে উঠে মাটি কাটতে গিয়েছিল , সেই সময় তার কোদালের গায়ে আঘাত লাগে একটি ধাতব বস্তুর। মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হলে দেখা  যায় সেটি একটি লম্বাটে তামার পাত, যার দুপিঠেই কিছু কথা খোদাই করা আছে।যাকে তাম্রলিপি বলা হয় । সেই তাম্রলিপিটির ওজন ১১ কিলো ৮০০ গ্রাম। লম্বায় ৫২.২ সেন্টিমিটার। চওড়ায় ৩৭.১ সেন্টিমিটার। আর ০.৫ সেন্টিমিটার পুরু। সামনের পিঠে ৪০ লাইন, আর উল্টোপিঠে ৩০ লাইন লেখা আছে সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে। নবম শতকে সংস্কৃত ভাষা লেখা হতো এই লিপির সাহায্যে। তাম্রলিপির তারিখ -- সম্বত ৭-এর ২রা বৈশাখ ( ৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ)
তাম্রলিপির উপরে লাগানো ছিলো রাজকীয় সিলমোহর। মিশ্রধাতুর তৈরি গোলাকার সিলমোহরের উপরের অংশে ছিলো সারনাথের প্রতীক, যা অবধারিত ভাবে পালযুগের রাজত্বের প্রমাণ। উপরে প্রস্ফুটিত পদ্মের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মচক্র, মাথায় ছত্র আর দুপাশে দুটি হরিণ, আর পুরো ছবিটিকে ঘিরে  রেখেছে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি। নিচে লেখা শ্রী মহেন্দ্র পাল দেব
এইসব খননকার্যের ফলে উদ্ধার করা হয়েছে নবম শতকের একটি বিশিষ্ট বৌদ্ধবিহারের অবস্থিতি। ছোট-বড় কক্ষ, বৌদ্ধস্তূপের দেয়াল ও ভগ্ন চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। পাওয়া গেছে আড়াইশোর বেশি বিভিন্ন মূর্তি-সম্বলিত পোড়ামাটির ফলক, যেখানে খোদিত আছে অবলোকিতেশ্বর, সূর্য, গরুড়, বিভিন্ন কিন্নরী ও ময়ূর। বৌদ্ধ দেবতা মরীচির মূর্তি।
মহেন্দ্রপাল দেবের তাম্র ফলক এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক দলিল। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে এটি ছিল একটি বুদ্ধ মহাবিহার। যা নন্দদীর্ঘীকা মহাবিহার নামে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলে অনেক গুলি উঁচু উঁচু ঢিবি এখনো বর্তমান। যার মধ্যে ৫মিটার উঁচু তুলাই ভিটা বা সালাইডাঙ্গা সবচেয়ে বড়। এছাড়া আখরিডাঙ্গা, নিমডাঙ্গা, রাজার মায়ের ঢিবি ও নন্দগড় উল্লেখযোগ্য। যদিও ৯৪৩২বর্গমিটার তুলাইভিটার খুব সামান্য অংশই এপর্যন্ত খনন করা হয়েছে।

খ্ৰীষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে, প্রচলিত আদিম বাংলা অক্ষরে স্তম্ভগাত্রে উৎকীর্ণ একটি  উৎসর্গ পত্র উদ্ধার হয়েছে তা  থেকে জানা যায় ত্রিরত্নের ধর্ম , বুদ্ধ ও সঙ্ঘ প্রীতি লাভের উদ্দেশ্যে একটি স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করে যা দশবলগর্ভ নামে পরিচিত ।  নন্দদীর্ঘীকা শুধু যে ইহা বৌদ্ধ বিহারে পরিণত হয়েছিল তাহাই নহে, খ্ৰীষ্টীয় নবম শতাব্দী অৰ্থাৎ পাল রাজত্ব হতে আরম্ভ করে দ্বাদশ শতাব্দী অর্থাৎ সেন বংশের শেষ পর্য্যন্ত ইহা বৌদ্ধ বিহারই ছিল। ১২০২ সালে তুর্কি সামরিক নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমণ করেন।  বাংলা তুর্কিদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন বাধা না দিয়ে নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান।  লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলায় সেন শাসন দুর্বল হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্ত বিদ্রোহের ফলে সেন রাজ্যের পতন ঘটে।  গৌড়ে মুসলমান রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার  পর যখন গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্রহণ করতে লাগিল ও উত্তর-বঙ্গ মুসলমানপ্রধান হয়ে উঠিল, তখন বোধ হয় বৌদ্ধবিহারগুলি তাহাদের প্রভাব হারাতে থাকে
এই সময় বৌদ্ধ ধর্ম ভীষণ ভাবে প্রতিমাসক্ত হয়ে পড়ে এর ফলে মুসলমানগন বৌদ্ধদিগের উপর
 নৃশংস ব্যবহার করিতে লাগিল। মুসলমানদিগের প্রবল আঘাতে বৌদ্ধগণ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে । রাজ কৃপালোভে ও ইসলামের বিশ্বাসের তেজ ও সাম্যবাদে মুগ্ধ হয়ে বহু বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে    প্রচলিত হিন্দুধর্মের সঙ্কীর্ণতা ও অন্ধত্ব গোঁড়াবাদী চিন্তা এতে   আবার ইন্ধন  যোগায় ।  এইভাবে বঙ্গদেশ তথা ভারত থেকে বৌদ্ধ ধৰ্ম্ম নিৰ্বাসিত হয়সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধবিহারগুলিও পরিত্যক্ত হয় ।
আজ থেকে কয়েক শত বছর আগে পাল রাজাদের বিচক্ষণ ভাবনায় ও সকল ধর্মের মানুষকে নিয়ে চলার যে অনুপ্রেরনা ও মানসিকতা দেখাতে পেরেছিলেন । আজ সুদীর্ঘ সময়ের চলার পথে সেই আদর্শ কে পুনঃ সিঞ্চিত করে আমরা আবারও মেতে উঠতে পারি মানবিকতার আদর্শে । এই ইতিহাসের শহর , মন্দির মসজিদের শহর কান পাতলে যেন শুনতে পাই বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি

তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া
কমল বসাক (ঐতিহাসিক)
গৌড়ের ইতিহাস, রজনী কান্ত চক্রবর্তী




কবি নীরেন্দ্রনাথ ও কলকাতার যিশু(১৩৭৬,২৪শে ভাদ্র)
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বললেই যে তিনটি কবিতা সব কবিতা-পাঠকদের  মনে ভেসে ওঠে, সেগুলি হল অমলকান্তি, উলঙ্গরাজা আর কলকাতার যিশু। কবির সঙ্গে নানা সাক্ষাৎকার পড়ে দেখেছি, এই ত্রয়ীই সব আলোচনার কেন্দ্রে বিশেষ ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এই ত্রবেণীসঙ্গম থেকে কলকাতার যিশু-কে বেছে নিলুম আজকের আলোচনায়।

       কবিতাবিষয়ক আলোচনায় কবি অকপটে বার বার বলেছেন, কবিতায় তিনি কল্পনাপ্রবণ নন। বড় মাপে কল্পনা করতে তিনি পারেন না। জীবনে চলার পথে যেখানে যতটুকু পেয়েছেন, কবিতায় তাদেরই সোজাসুজি ঠাঁই দিয়েছেন। তাই কবিতা-কল্পনালতায় তাঁর পদচারণা নেই। তবে অন্য কবিদের কল্পনাকে তিনি সমীহ করেন। এই পরিপ্রক্ষিতেই ‘কলকাতার যিশু’-কে দেখার চেষ্টা করব।

      কবির অন্যান্য কবিতার মত এখানে কোনও প্রচ্ছন্ন গল্প নেই। ধরে রাখা আছে কলকাতার একটি বিশেষ সময়কে ধরা আছে  কলকাতার চৌরঙ্গিপাড়ার একটি ব্যস্ত  রাজপথের ক্ষণিকের দৃশ্যময়তা,  কবি যাকে কবিতার চরণে নিজেই ব্যক্ত করেছেন-‘ যেন স্থির চিত্রটির মত শিল্পীর ইজেলে লগ্ন হয়ে আছে।’ আর আমরা দেখলুম – একটি অবোধ উলঙ্গ পথশিশু দুদিকে মূর্তিমান উদ্যত মৃত্যুকে উপেক্ষা করে রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে কি অক্লেশে হেঁটে চলে যাচ্ছে পথচলতি সমস্ত গাড়িকে স্তব্ধ করে দিয়ে। তার গায়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে সদ্য বৃষ্টিস্নাত রোদ্দুর! এই চিত্ররূপময়তায় পাঠক যখন ভরপুর, তখনই প্রথম স্তবক শেষ হল। জন কীটস-এর ‘ওড টু দি গ্রীসিয়ান আর্ন’ কবিতার মত বহমান সময়ের  একটি মুহূর্তকে  কবি অমরত্ব দিলেন। এই সময়টিকে আমার মত আরও যাঁরা দেখেননি, তাঁদের জন্য এক চমৎকার অ্যারকাইভ তিনি গড়ে দিয়ে গেলেন।

     
            এবার আসা যাক কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে। এখানে কবি একেবারে আ্ত্মগত। পাঠক-বৃত্ত থেকে অতর্কিতে বেরিয়ে এসে তিনি সরাসরি শিশুটির সঙ্গে একেবারে একাত্ম, যা কিছু বলছেন, তাকেই সম্বোধন করে। অন্তর্জগতের এই অবস্থানে কবির ব্যাবহৃত দুটি বাক্-প্রতিমা (ইমেজারি) আমাকে থমকে দাঁড় করায়। একটি ‘মূর্ত মানবতা’ , আর অপরটি ‘যিশু’। কল্পনার চরম উন্মেষ ছাড়া এমন ইমেজারি কিছুতেই আসেনা যে !! অনায়াসে এই কল্পনাজাত শব্দ দুটি কবিতার শেষ স্তবকটিকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেল, যে পুরো কবিতার অভিমুখ, তাৎপর্য- সব গেল বদলে।কবি আরও কল্পনা করলেন, শিশুটি সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দেই বিশ্বকে নিজের হাতের মুঠোয় ভরেছে। রাস্তার এপার ওপার নয়, পৃথিবীর এক কিনার থেকে সে আর এক কিনারে চলেছে। কবির কল্পনার এই ডানা মেলা মুন্সিয়ানার কাছে সব পাঠক মাথা নত করেছেন। ‘কবিতা কল্পনালতা’তে তিনি যে অনাস্থার কথা বলেছেন, সেটা সম্ভবত: কল্পনার অকারণ আধিক্যের বিড়ম্বনার  কথাই বলতে চেয়েছেন।  

       অন্য এক আলোচনায়  কবি একবার বলেছিলেন, কবিতা তাঁর কাছে সচেতন মনেরই প্রকাশ। কোনও অজ্ঞাত অনুপ্রেরণায় তিনি কখনও কোনও কবিতা লেখেন নি। তাই যদি হয়,  তাহলেও তাঁর কল্পনার তরী যে মোটেই ছোট মাপের নয়, তাতেও  আর সন্দেহ থাকেনা।

        কবি কোনও একটি সাক্ষাৎকারে বলছেন – ‘একটা ঘটনা দেখলাম, সেটি মাথার মধ্যে গেঁথে রইল। - - - এরপর লিখতে বসলাম। আর লেখার সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবনাগুলো আমার মাথায় জড়ো হয়েছিল, ওই ভাবনার হাত থেকেও মুক্তি পেলাম। যতক্ষণ না লিখছি ততক্ষণ মুক্তি নেই, বুঝেছ?’(কবির সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের সাক্ষাৎকার-২০১১)। কিন্তু কলকাতার যিশুর ক্ষেত্রে এমন মুক্তি কবি পাননি বলেই মনে হয়। তাই এই কবিতা লেখার  আরো পনেরো বছর পর দেখি আর একটি কবিতায় আবার যিশুর স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি।

‘এক-একবার মনে হয় যে
এই জীবনের যাবতীয় ভ্রমণ বোধহয়
ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু
ঠিক তখনই
আমার চোখের সামনে হঠাৎ খুলে যায়
সেই রাস্তা,
যার ধুলো উড়িয়ে আমি কখনও হাঁটিনি।
. . . . . . . . . . . .  . . . . . . . .
কলকাতার এক রাজপথে
যাকে আমি দেখতে পেয়েছিলুম,
ভাদ্রমাসের আকাশ জুড়ে
উলঙ্গ সেই দৈবশিশুর মুখচ্ছবি তখন আমার
চোখের সামনে ভাসতে থাকে।’
              ‘যাবতীয় ভালবাসাবাসি’(১৩৯১, ২৭শে ভাদ্র)।


      শেষে, আজকের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে যে কথা ভাবনাতে এসেই যায়, তা হল- এখনকার কলকাতা শহরে যেখানে রোজকার বেপরোয়া পথদুর্ঘটনার সাক্ষী হতে হয় আমাদের, সেখানে দাঁড়িয়ে কি এমন কবিতা কোনও কবি  আর  লিখতে পারবেন , সঙ্গে নিয়ে এমন ঈশ্বরীয় বাক্-প্রতিমা? 


মনের কথা

একটি বৈদিক বিবাহ
মধুবণী চ্যাটার্জি

একটি বিশেষ প্রয়োজনে বইয়ের আলমারি ঘাঁটতে গিয়ে হাতে এলো বেদের কবিতা , গৌরী ধর্মপাল রচিত এক অসাধারণ বই । মনে পড়লো  সোম আর সূর্যার বিবাহের গল্প । খুব বিস্তারিত ভাবে বলার ক্ষমতা আমি রাখিনা একেবারেই । কিন্তু বিবাহ শব্দটির সঙ্গে নেতিবাচক যে ধারণা আমার মনে বাসা বেঁধেছে, তার থেকে কিছুটা হলেও  মুক্তি পেতে আবারও একবার বইটি খুলে বসলাম । 
আনন্দ দেবতা সোম আর সূর্যকন্যা সূর্যা ....তাঁদের প্রেম বিবাহে পরিণতি পেলো । কেমন ছিলো সেই বিবাহ ? সে এক অদ্ভুত কল্প কথা । তাকে পড়লে বোঝা যায় আজকের যুগ  কোন আলো থেকে কোন অন্ধকারে নিজেদের পিছিয়ে নিয়ে গেছে  ! 
সূর্যা তাঁর সোমের ঘরে গিয়েছিলেন কোনো উপঢৌকন নিয়ে নয় ! তিনি গিয়েছিলেন তাঁর প্রেমে ভরা হৃদয় নিয়ে,   বিশ্বাসে নির্ভর করে ! কারণ তিনি নিজেই ছিলেন সোমের শ্রেষ্ঠ উপহার ।  স্বামীর ঘরে যাবার সময় মন ছিলো তাঁর রথ যার বাহন ছিলো দুটি তারা ।  পৃথিবী ছিলো তাঁর রথাসন  , আলোয় ভরা আকাশ ছিলো চাঁদোয়া ....আর তাঁর চোখের কাজলে লেখা ছিলো , ' প্রথম দেখায় চিনেছি তোমায় ' ...। 
চার চোখের মিলনে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে সোম  শপথ নিলেন একে অন্যকে জড়িয়ে থাকার  সুখে দুঃখে , জীবনে মরণে ! শপথ নিলেন বহিরাগত শত্রুদের থেকে মিলিত ভাবে নিজেদের দাম্পত্যকে রক্ষা করার । শপথ নিলেন একে অন্যের সঙ্গে বার্ধক্যে প্রবেশ করার । প্রবল বীর্যে বলীয়ান সোম শপথ নিলেন সূর্যাকে পুত্রবতী করার । সবিতা দেবতা সূর্যাকে সম্প্রদান করলেন । অগ্নি প্রদক্ষিণের মন্ত্রে সূর্যাকে পাওয়ার আনন্দ ব্যক্ত হয়েছে প্রতি ছত্রে । সূর্যাকে রাণী হিসেবে গ্রহন করেন সোম । অবশেষে হয় হৃদয় বিনিময় ... তোমার হৃদয় আমার হৃদয় ...আমার হৃদয় তোমারই ...! 

আচার্য আশীর্বাদ করলেন শ্বশুরকুলের মহারাণী হও বোলে ....! আচার্য্য গৌরী ধর্মপাল তাঁর  এই অসামান্য বইটিতে  বেদের এই কাহিনী কবিতায় ব্যক্ত করেছেন ।   সূর্যা সত্যিই সুখী  হয়েছিলেন কিনা সে গল্প জানা নেই । কিন্তু যে মর্যাদায় এক কন্যা তার  স্বামীর ঘরে যায় , যে প্রেম যে বিশ্বাস নিয়ে ....তা কি সত্যিই রক্ষিত হয় ? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না বোধহয় । আসলে এই মন্ত্র শুধু মন্ত্র হয়ে থেকে গেছে যুগে যুগে । এর অর্থ যদি পুরুষরা বুঝতেন তবে হয়তো সমাজ কিছুটা হলেও  এগোতো ....হয়তো যৌতুকের জন্য  নারকীয় হত্যালীলা বন্ধ হোতো । সূর্যাদের  শরীর সোমেদের নখের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হোতো না ! পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তি হৃদয় ভাঙা সূর্যাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করতো না ....!  হৃদয় আদান প্রদানে যে সম্পর্কের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় সেখানে প্রথম যে সেই হৃদয়কেই ভাঙা হয় খণ্ড খণ্ড করে .....! মনে রাখতে হবে , সোমকেই শপথ নিতে হয় সূর্যাকে মর্যাদা দিয়ে ধারণ করার । তাই শপথ নেওয়ার আগে একবার জেনে নেওয়া প্রয়োজন ....মন্ত্রের ভিতর লুকিয়ে থাকা এক অপূর্ব আলোর গল্পকে  । 



অনুগল্প 

বংশ প্রদীপ
সুমন্ত কুণ্ডু

 দত্ত বাড়ির বড়বউয়ের পরপর যখন দুটোই মেয়ে হল শাশুড়ি মুখ কালো করে বলেছিল ‘মেয়ে বিয়োনো আর আঁটকুড়ী তো একই আমাদের আর বংশে প্রদীপ দেওয়ার কেউ রইল না’ বড়বউ কষ্ট পেয়েছিল, একা কেঁদেছিল নিজের মেয়ে দুটোকে এ বংশের কেউ বলে আর ভাবতে পারেনি কখনও
পরে ছোটবউয়ের যখন পরপর দুটি ছেলে হল শাশুড়ি গালভরা  হাসি নিয়ে বলেছিল ‘এতদিনে আমার বংশ রক্ষা হল ছোটবউয়ের জন্যই বংশে বাতি দেওয়ার কেউ এল’ ছোট বউ খুশীতে গদ গদ হয়েছিল এ বংশটা একমাত্র তার ছেলেরই বংশ এমন মনে হয়েছিল তার

আজ বেশ কয়েক বছর পর দেখা যায়  বড়বউ ঘুরেফিরে দুই মেয়ের বাড়িতে  ভালোই আছেন দুই জামাই খুব আন্তরিক নাতি-নাতনিদের সাথে সময় কেটে যায় ভালো কর্তা চলে যাওয়ার পর আর দত্তবাড়িতেও আসেন না খুব একটা । মেয়েদের বাড়িতেই বছর ঘুরে যায় ভালো
ছোটবউয়ের সংসারে শান্তি নেই দুই ভাই জমি-জায়গা, বাড়ি-ঘর, আর বিশয়-সম্পত্তির চুলচেরা ভাগ বাঁটোয়ারা করতে গিয়ে চুলোচুলি করে মরছে বিধবা মাকে নিয়েও এদিক ওদিক ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে ক্রমাগত ছোটবউও স্থিতু হতে পারছেন না কোথাও । তিনি এখন বংশের দুই জাজ্বল্যমান প্রদীপের নীচে জমে থাকা কালো অন্ধকারে আসা যাওয়া করে মরছেন রাতদিন


কবিতা 

জ্বর
কুমারেশ তেওয়ারী

মোহনীয় জ্বরের নিকটে কিছু
                                    কারুভাষ ফুল
জলের গভীরে ভাসে ফুলস্বর প্রিয়

আহা তিতিরউল্লাস কোতলের আর
আর কী কী ভাষা আছে বলো

শিমুলতুলোতে ওড়া ব্যাহত সাধন
জ্বর গায়ে সমুদ্র সিনানে গেলে
কেটে যাবে কবেকার মোহর বাঁধন?


সংখ্যামাত্র
 শুভদীপ পাপলু

মারাত্মক দিগ্বিজয়ী এক ভগ্নসকাল...হত্যার নেশা
উদযাপিত কলহগুচ্ছে-পরিবর্তিত,হীন পিছুটান।
তবু আয়ত্ত করেছি যাকে বঙ্গানুবাদে,সে পরিভাষা 
হস্তান্তর প্রক্রিয়ায়-এক পরাধীন স্নায়ু,পতঙ্গপ্রমান।

মায়াবিনী'র ঐ-রশিপথ ধরে হেঁটে চলি,অনেকাংশে
প্রতিশব্দের নভেলে;যে সৃষ্টিরহস্যে আবৃত,স্বয়ম্ভূ...
ধমণী ডাক পাঠালে,যে জন্মগ্রহন করে রাজবংশে-
আদপে সে ঔপনিবেশিক অত্যাচার,শেষার্ধে প্রভু। 

নিজে তো ধারালো কৃপান,ক্রিয়াপদের মনস্কামনা-
ত্রিভুজ,দশমিক,ভাগ করে দি-ই জ্যামিতির অঙ্গে।
অথচ কম্পাস অন্যের সাদা পৃষ্ঠা নিয়ে,আনাগোনা
করে সঞ্চয়;ওপাশে,বৃত্তের বিয়ে হয়,গণিতের সঙ্গে। 

এভাবে কবিতার ছাদ,আর সরাসরি পুলকিত নখে
সন্তান প্রতিপালিত হয়,পিতা-মাতা'র আলেখ্যে...

ব্ল্যাককফি
নীপবীথি ভৌমিক

  এক একটা করে ধোঁয়ার হরিণরা হারিয়ে যায়
 আকাশের মথ স্পর্শে।


 বা হাতের মুষ্টিবদ্ধ শরীর ছুঁয়ে 
  যে বিকেল নেমে আসে আজও...
সে চেনে, জানে,  ডাকবাস্ক অপেক্ষায় থাকে ফিকে হয়ে আসা মায়াবী ঘ্রাণে।

  উঁহু ! আমি ফিরি আবার সেই
    নেশাতুর অ্যালঝাইমারিক স্নানে।

কফি আনো, ভাঙুক ঘুম মাগ'এর
 ব্ল্যাক আর হরিণ'ধোঁয়া সুগন্ধে ।



ভালোবাসা।এক পা দু'পা
কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর

যে নারীর দেহে কোনোদিন পুরুষের গন্ধ ওঠেনি
অথচ রাত বাড়লেই, ঘড়ির কাটা জিরাফের গ্রীবার মতো
চাদরের ভাঁজে ভাঁজে জন্ম দেয় অসংখ্য ভালোবাসা
উত্তেজনাহীন শরীর মেপে নেয় লোমকূপের এনার্জিটিক নেচার
ছেঁড়া ছেঁড়া পাখির পালকের মতো ব্যালকনিতে সকাল আসে গোলাপ ভর্তি টবে
গুঁড়ো গুঁড়ো রাতভাঙা স্টেডিয়াম
স্লিপলেস।ঝুকে পড়া রেলিং -এ আটকে যায়,এ শহরের ট্রাফিক
তবু, রাতের স্থাপত্যে জন্মে যে ভালোবাসার জীবাশ্ম
স্ট্রিটলাইটের ফোকাসের সাথে কর্পোরেট ফিন্যান্সে মিস্কড হয়ে যায়
রাত।ভালোবাসা।গন্ধ। ভাগাভাগি। আর একটা সকাল



ঘড়ি

---সবর্না চট্টোপাধ্যায়


বারোটা থেকে কাঁটা সরে যায়
ঘুম নেই।
ঘুরন্ত ফ্যানে কাটা পড়ে চোখ
ট্রেন দুটো রোজ, একে অপরকে
ভেদ করে ছোটে।
চাপা পড়া শব্দের ভেতর খুন হয় দুটো মানুষ…
এভাবে ঢিঙিয়ে যেতে থাকি,  লাশ
চারদিকে শব্দের ঝড়।

তারপর ঢেউ আর ঢেউ...
জ্যোৎস্নায় কত ভেসে আসা কত জেলিফিস
একবার যদি কেউ ছেড়ে দিয়ে আসে,  আবার...


বীজ
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

বীজ বা ডিম শব্দদুটো
কেমন গোলমেলে
কখনও স্বপ্ন কখনও
উষ্ণতার ব্যাকরণ
খানিকটা পাপবোধ
কিছুটা ইচ্ছা আর ইচ্ছাভঙ্গ
প্রতিজ্ঞা আর ব্যর্থতা।

ঐতিহ্য

তাপসী  লাহা

সদর দরজা দিয়ে ঢুকে গেছে অপরিচিত আবহাওয়ারা,
 মরসুমি  পূর্ণতায় এক একটা পৃথিবী  ছড়িয়ে  দেয়   অকিঞ্চিৎ সারবত্তা।
নতুন ফুলের মতো অস্বস্তিরাও নজর কাড়ছে,
চিরন্তন  নবান্নতায় কিছুটা মিশে যাচ্ছে অব্যক্ত ধানক্ষেত।
অগুনতি শালুকেরা পুকুর খুঁজছে প্রস্ফুটনের প্রবল কামনায়।
অনভ্যস্ত পরিযায়ীরাও  ভীড় বাড়াচ্ছে চেনাগুলো
পালটে যাচ্ছে  তাই।
ধবল স্বপ্নদের  সৎ  হতে দেখে আমিও সব কিছুর পরেও বিশ্বাস রেখেছি অতীতবেলায়----
মায়ের প্রাকনবান্নের তোড়জোড়ে,
ভোরের শিশির আর আতপ চালের বিশ্বস্ত সুঘ্রাণে।

           
একটি লেটারবক্স ও আমি 
দেবব্রত রায়

একটি সরল রেখার উপর
এসে দাঁড়াতেই, আমার ছায়াটিও
দ্বিধান্বিত!
কারণ, সেই সমকোণের একটিতে
বিস্তৃত ছিল আমার নস্টালজিয়া----
অর্থাৎ, একটি স্বপ্নের লেটারবক্স।
আর, অন্য  কিনারাটির  
দখল নিয়েছিল বোধবুদ্ধি
  ঝলসে দেওয়া আড়াই বছরে
লোটা-কম্বল তিনগুণ হয়ে যাবার
মতো কিছু  টোপ। 
                           
  একটি দীর্ঘ Tug of war-এর পর
  চোখ বন্ধ  করতেই, দেখলাম,
  সেই রূপকথার রঙিন বাক্সটির থেকে বেরিয়ে  আসছে 
আমার  উড়ান-স্বপ্নগুলি

  স্বপ্নচিল 
চিরঞ্জিত সাহা

আবার দেখা তোর শহরে , নতুন কোনো গল্প হোক ,
বোধন ভোরের নতুন সকাল , কাশ মুছেছে ব্যর্থ শ্লোক ;
কবিতাতে মন আসে না , অটোগ্রাফে নেই তো ঝোঁক
পোস্ত যদি তুই নিতে চাস , হেমলকটা আমার হোক ।
অ্যালগির ওই প্যাঁচপয়জার হয়তো বা তোর বিষের ঘোর ,
ইনফ্লোরেসেন্স আনছি সখা , করতে রঙিন তোর শহর।
শরৎ তখন মাঝআকাশে , ঢ্যামকুরকুর ঢাকের রেশ ;
সন্ধিপুজোর অষ্টমীতে রংহেয়ালির নতুন দেশ ।
আর্দ্র দুপুর , খসখসিতে , তোর স্বরেরই নতুন শ্লোক ;
সিঁদুর রাঙা দশমী দিন , থমকে শহর তোর দু' চোখ ।
জল চিনেছে শালুক আলো , মৌ পেয়েছে পদ্মবিল ,
তোর আকাশে মন ভাসিয়ে উড়ল নতুন স্বপ্নচিল ॥

তোমার আমার ব্রিজ -
আকাশ সরকার


সকালগুলো বড্ড নিস্তব্ধ
রোদের তাপ গায়ে লাগিয়ে
তোমার আওয়াজ শুনি না আর,
তোমার আমার তর্কের দাপটে
সতর্ক হয়না কাকেরা,
বিকেলের ল্যাম্পপোস্টের আলোয়
তোমায় ভাবতে ভাবতে
চোখ ঝলসে যায় না,
তুমি জানো
তুমিও তো ছিলে আশেপাশের জড়বস্তুগুলোকে নিয়ে
যারা নিরন্তর ব্রিজ বানিয়ে গেছে,
তোমার আমার আঁকাবাকা রাস্তার
আমরা কি ব্রিজগুলোর এপারওপার করতে পারিনা আবার?
হেঁটে হেঁটে বানাতে পারিনা
আবার কতশত নতুন ব্রিজ