Thursday, 14 January 2021

ভাস্কর পাল,প্রবন্ধ,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 


 

বয়সসীমা, নাকি মানসিকতা

মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে ঠিক কোন পরিবর্তনের দিকে জোর দিতে হবে আমাদের?

==============================================================



অষ্টাদশ শতকে নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট যে গভীর ভাবনা উপলব্ধি করে বলেছিলেন - ‘Give me an educated mother, I will give an educated nation’ আজ ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসে এসে আমাদের মনে হল দেশের মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন। মেয়েদের বিয়ের বয়স চিন্তাভাবনায় দেশ স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আবার নিয়ে এসেছে নারীর মর্যাদা ও তাঁর সম্পর্কে রাষ্ট্রের ভাবনা প্রসঙ্গ।বিয়ের ন্যূনতম বয়স,বিশেষত মহিলাদের জন্য এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেযে আইন এখন নির্ধারিত রয়েছে সেই অনুযায়ী বিয়ের সর্বনিম্ম বয়স ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১বছর এবং মেয়েদের জন্য ১৮বছর। যদিও ধর্মীয় এবং সামাজিক রক্ষণশীলদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে এই আইনকে। অনেকাংশের আবার মত বয়সের ক্ষেত্রে আইনের উচিত লিঙ্গ-নিরপেক্ষ থাকা। ভারতীয় ম্যারেজ আইন, ১৮৭৫ অনুসারে ১৮ বছর বয়সকে বিবাহের ন্যূনতম বয়স হিসেবে ধরা হয়েছে।

বিগত কয়েক সহস্রাব্দে ভারতীয় নারীর অবস্থা বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে তাদের অবস্থার অবনতি আর কয়েকজন সমাজসংস্কারকের প্রচেষ্টায় তাঁদের সমমর্যাদার অধিকারে উত্তরণের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নারীর অধিকারের অর্ন্তভুক্ত মূল বিষয়গুলি হল সাম্য,মর্যাদা। আজও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা লিঙ্গবৈষম্য ও অপরাধের শিকার।

বৈদিক যুগের আদিপর্বে নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার ভোগ করেছে। পতঞ্জলি বা কাত্যায়ণের মতো প্রাচীণ ভারতীয় বৈয়াকরণের লেখা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে আদি বৈদিক যুগে নারীরা শিক্ষিত ছিলেন। ঋক বেদের শ্লোক থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে নারীরা পরিণত বয়সে বিবাহ করতেন এবং সম্ভবত স্বয়ম্বরা নামক প্রথায় নিজের স্বামী নির্বাচনের বা গান্ধর্ব বিবাহ নামক প্রথায় সহবাসের স্বাধীনতা তাদের ছিল। ঋক বেদ, উপনিষদের মতো আদি গ্রন্থে বহু প্রাজ্ঞ ও ভবিষ্যদ্রষ্টা নারীর উল্লেখ আছে, গার্গী ও মৈত্রেয়ী তাঁদের নাম আমরা জানি

মধ্যযুগীয় ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থার ভীষণ অবনতি ঘটে এবং বাল্যবিবাহের প্রচলন ও বিধবাদের পুনর্বিবাহের নিষেধাজ্ঞা ভারতে কিছু সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গেই ভারতীয় সমাজে পর্দা প্রথার প্রচলন ঘটে। রাজনৈতিক কারণে হিন্দু ক্ষত্রিয় শাসকদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল।

ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে নারী সম্পর্কে ধারনা অনেকটাই দুর্বল সংস্কারগ্রস্ত পুরুষ নির্ভর পরিবার সত্তা রূপেই ছিল। পরিবারের উন্নতির কথা ভেবেই মেয়েদের জন্য অন্তঃপুরের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সংস্কারপন্থী নব্য শিক্ষিত পুরুষেরা পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থার সাথে সংগ্রাম করে বাইরের পৃথিবীতে মেয়েদের পরিচিত করে তুলতে চাইলে উনিশ শতক থেকেই অন্তঃপুরের আগল মুক্তির সূচনা হয়। পরবর্তীতে সতীদাহ রদ, বাল্য বিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ আইন তৈরি হল। জনচেতনা বৃদ্ধির ফলে নারীদের উপর থেকে সামাজিক ব্যভিচারের দায়ভার অনেকটাই কমে গেল।1876 এ কাদম্বিনী বসু উচ্চ শিক্ষার জন্য আবেদন করলেন। উনিশ শতকে উচ্চবিত্ত শ্রেণী ইউরোপীয় বিদুষী নারীকে যেরূপ সর্ব গুণান্বিত দেখে এলো বাঙালী মেয়েদেরও তেমনি মেমসাহেব মডেলে গড়ে তুলতে আগ্রহী হলো।

1913 য় শরৎচন্দ্রের “নারীর মূল্য” যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখনও মেয়েদের আপন কথা আপন ভাষায় প্রকাশ করা খুব সহজ ছিল না। আশাপূর্না দেবী যে প্রক্রিয়ার সূচনা দেখেছিলেন,আধুনিক কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত চেয়েছিলেন পুরুষ সর্বস্ব এই পৃথিবী উভলিঙ্গ হোক সেই সময় লেখিকা মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় নারী আন্দোলনের ইতিহাস ও নারীবাদ শীর্ষকে লিখলেন  “সমাজ এতটুকু বদলায়নি, বরং যে সব সুযোগ সুবিধে এখন আমরা পাই  যেমন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া, চার দেওয়ালের বাইরে পা বাড়ানো , বিশাল বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা,শিক্ষার অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সেগুলি আমাদের পূর্বসূরীরা অনেক লড়াই করে অর্জন করেছে। সেই পথিকৃৎ দের পথ বেয়েই এযুগের মেয়েরা মেয়েমানুষ থেকে মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে পৌছেছি"

প্রবাহমান সময়েও বাল্যবিবাহ এবং নাবালিকাদের উপর অত্যাচার এবং তার অতীত সেই ঘটনা রুখতেই বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। শুধু তাই নয়, আইনে ১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে তাঁকে অবৈধ ঘোষণা করার কথাও বলা রয়েছে। যদিও বাল্যবিবাহকে এখনও আইনানুযায়ী অবৈধ ঘোষণা করা যায়নি।

একথা ভাবতে খুব অবাকই লাগে যে আইনে পুরুষ এবং মহিলাদের বিবাহের জন্য বয়স কেন আলাদা হবে এর কোনও সঠিক যুক্তি নেই। আইনের বেশ কিছু নীতি এবং ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী এই বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে।

বর্তমানে উদ্বেগজনক ভাবে শিশু মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়া ও সাথে মেয়েদের শারীরিক সমস্যার কথা ভেবেই এই আইন বদলানোর বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখা হচ্ছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক গর্ভাবস্থার ঝুঁকি কমাতে নারীদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স বাড়ানোর পক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে। প্রথম পর্যায়ের গর্ভাবস্থা শিশু মৃত্যুর হারের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং মায়ের স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে।

যদি বায়োলজিক্যাল ভাবনায় একজন নারীকে আমরা জানতে চাই তাহলে নারীর দেহ হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি, গোনাড, ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি নিয়ে অন্তক্ষরা প্রজননতন্ত্র গঠিত।  সত্যিকারের বয়ঃসন্ধিকে কেন্দ্রীয় বয়ঃসন্ধি হিসেবে অভিহিত করা হয়, কারণ কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে এই পরিবর্তন শুরু হয়।

মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশ জিএনআরএইচ হরমোন ক্ষরণ শুরু করে এবং এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোন ক্ষরণ শুরু হয়, এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোনের প্রভাবে যথাক্রমে ডিম্বাশয় ও শুক্রাশয় কাজ করা শুরু করে। সেই সাথে এরা যথাক্রমে এস্ট্রাডিওল ও টেস্টোস্টেরন উৎপন্ন করা শুরু করে, শরীরে এস্ট্রাডিওল ও টেস্টোস্টেরনের বৃদ্ধি ঘটায় মেয়ে ও ছেলের মাঝে বয়ঃসন্ধিকালীন বৈশিষ্টগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।স্বাভাবিক ভাবেই  আঠারোর আগে শারিরীক ও মানসিক কোন দিক দিয়েই একটি মেয়ে বিয়ে এবং গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয় না। আঠারো বছরের আগে যদি মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় তখন তার প্রপার গ্রোথ হয় না। এক্ষেত্রে গর্ভধারণ করলে প্রিম্যাচিওর ডেলিভারির শঙ্কা থাকে। যেটি শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি করে। দেখা যাচ্ছে বাল্য বিবাহ মেয়েদের স্বাস্থ্যে সমস্যার পাশাপাশি শিশু মৃত্যুরও অন্যতম কারণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গর্ভকালীন 37 সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে বা 259 দিনেরও কম সময়ের পূর্বে জন্মগ্রহণ করা শিশুকে প্রিম্যাচিওর কথা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। বিশ্বজুড়ে ২০১০ সালের সমস্ত জীবিত জন্মের আনুমানিক ১১.১% প্রিম্যাচিওর জন্মগ্রহণ করেছিলেনপ্রিম্যাচিওর শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই পূর্ণ-মেয়াদী বাচ্চাদের চেয়ে অনেক ছোট এবং অনেক ওজন দুই পাউন্ডের চেয়েও কম। জন্মের আগে জন্মগ্রহণ, শিশুর অন্যান্য কারণের কারণে মারা যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়ায়, বিশেষত প্রসবকালীন জন্মের সাথে নবজাতক সংক্রমণ থেকে সমস্ত নবজাতকের মৃত্যুর কমপক্ষে ৫০% ঝুঁকির কারণ বলে মনে হয়।

বর্তমানে অনেকটাই বদলেছে বাংলার কিশোরীদের মানসিকতা। অনেক দৃঢ় হয়েছে তাদের চিন্তা। নিজের পায়ে স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ের কথা মাথাতেই আনছে না তাঁরা। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগেও তাদের বিয়ের কোনও ইচ্ছাই নেই। যেখানে সারা দেশে নাবালিকা ও কিশোরীদের বিয়ে দিয়ে পরিবারের লোকজন দায় ঝাড়তে চাইছে, সেখানে বাংলার ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। সবুজসাথী, কন্যাশ্রী ও মাধ্যমিকের আগে ও পরে স্কলারশিপের ফলেই এই পরিবর্তন বলে মনে করা যায়  আমাদের ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ,কেরল, তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ নারী উন্নয়নে এগিয়ে রয়েছে সবথেকে পিছিয়ে আছে মধ্যপ্রদেশ। নানহি কলি নামক এক সংস্থার করা সমীক্ষায় যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সেখানে দেখা গেছে জেলার ৫৪ শতাংশ এবং কোলকাতার ৭৫ শতাংশ কিশোরী ঋতুকালীন সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নেয়। দেশের ৬০০ টি জেলায় এই সংস্থা কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট তৈরী করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে কোলকাতার ১৩ থেকে ১৯ বছরের মেয়েদের প্রায় ১০০ শতাংশ পড়াশোনা করছে। যেখানে দেশের গড় ৮০। চাকরি করতে আগ্রহী কোলকাতার ৫৯ ও পশ্চিমবঙ্গের ৭১ শতাংশ কিশোরী।

যুগের পরিক্রমায় নারী শিক্ষার গুরুত্ব বর্তমানে অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। নারীর অবস্থান সমাজে চিরকাল ধরেই অবহেলিত। নারীর এই অবস্থান থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা অর্জন করে নারী তার নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে, স্বাস্থ্য সচেতন হবেতাই নারীর উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক উপাদান হলো নারী শিক্ষা।

নারীকে স্বাবলম্বী হতে হলে কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। কেননা কর্মসংস্থানই নারীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে। নারীর জন্য যুগোপযোগী কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারের একটি পরিবারের সুরক্ষায় একজন শিক্ষিত নারী একটি সুরক্ষিত দুর্গের মতো কাজ করে। কারণ একজন সুশিক্ষিত নারী স্বাস্থ্য সচেতন। একজন সুশিক্ষিত নারী সুরক্ষিত পরিবারের জন্য খুবই প্রয়োজন।

সন্তান জন্মের পর থেকে মায়ের সংস্পর্শেই বেশির ভাগ সময় থাকে। মায়ের আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা সব কিছুই সন্তানকে প্রভাবিত করে। মায়ের হাতে সন্তানের শিক্ষার প্রারম্ভিক আবর্তন। মা যদি শিক্ষিত হন তাহলে সন্তান অবশ্যই শিক্ষিত হবে। একজন নারী শিক্ষিত হওয়ার অর্থ ওই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে ওঠা।

তাই স্বাভাবিক ভাবেই নারীকে সঠিক মানসিকতায় শিক্ষিত করে এবং শরীর ও স্বাস্থ্যের পরিপূর্ণতা এনেই বিয়ের ভাবনা প্রবাহিত করতে হবে। বর্তমানে একটি সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্য জানিয়েছে বিবাহের জন্য ২৩ বছর হল আদর্শ সময় । এই সময়ে একজন শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে পরবর্তী প্রজন্ম কে ধারণ করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলার জন্য । এক্ষেত্রে দায়িত্ব শুধুই নারীর নয় এই দায়িত্ব সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের,এই দায়িত্ব সমাজের সর্বোপরি দেশের। প্রয়োজন সঠিক আইন যে আইনের ভেতর আইনের ফাঁক থাকবেনা ।তবেই এই বিশাল জনসমষ্টিকে শিক্ষার মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া বর্তমানে সময়ের দাবী। নারীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করলে দেশ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 ছবিঃ মঙ্গলদীপ সর্দার

Sunday, 10 January 2021

সুমন মল্লিক,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 

দু’টি কবিতা

 

 

একটি কবিতার জন্মকথা

 

টেবিলে বসতেই, ঠিক সামনে

শাদা কাগজের ওপর

হাঁটু মুড়ে বসল ফেরারি যুবক৷

বুকে সম্মোহনের অঙ্গার,

হাতে অদৃশ্য নীলমণি ক্ষত...

মুখ তুলে হঠাৎ সে হাসল–

সে-হাসি লক্ষ কান্না দিয়ে বাঁধা৷

তারপর বেশ খানিকটা সময়

কথাবার্তা চলে – স্মৃতিচারণ ও

ভাবের আদান-প্রদান৷

এইসব চলতে চলতেই আচমকা

সে উধাও হয় আর আমি

অবাক হয়ে দেখি, শাদা কাগজটি

ভরে উঠেছে ভেজা ভেজা অক্ষরে৷

 

 

একটি স্বপ্নের জন্মকথা

 

শ্বেতপদ্মের মতো মায়াবী মাতল গ্রীবা

গ্রীবায় ছোঁয়ানো আঙুল পুড়ে হয় ছাই

ছাই দিয়ে সাজানো এই জীবন-গরাদ

গরাদের মাঝে উড়ে বেড়ায় প্রাণপাখি

পাখির চোখের সিন্দুকেই আছে মুক্তি

মুক্তির উন্মথনগুলি মুছে যায় অশ্রুতে

অশ্রু একমাত্র সত্য, অশ্রু সত্য মুকুর

মুকুরে লুকনো আছে আরেকটি মুকুর 

 

Saturday, 9 January 2021

কী লিখলাম, কেন লিখলামঃ তুষারকান্তি রায় ,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 কী লিখলাম, কেন লিখলাম 

তীর্থংকর মল্লিনাথ: অতীত অনুসন্ধানের আর এক নাম: তুষারকান্তি রায় 


 

তীর্থংকর মল্লিনাথ / তুষারকান্তি রায়  / অভিযান পাবলিশার্স  / দাম – ২০০ টাকা

অতীতের সঙ্গে বর্তমানের আলাপের মধ্য দিয়েই উন্মোচিত হয় ভবিষ্যতের অনন্ত সম্ভাবনা । সম্ভবত সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য চিরকালই সমাজ ও ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে । অতীতের স্বপ্ন – সময়যাত্রা কিংবা পুরাণ – ইতিহাস অথবা কিংবদন্তি থেকে উঠে আসা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান কোনও এক মহা- ব্যক্তিত্ব । অভিযান পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘ তীর্থংকর মল্লিনাথ ’ আধুনিক অভিঞ্জতার চোখে দেখা প্রাচীন জীবনের অনালোকিত এক কিংবদন্তির বিস্মৃত ইতিহাস । আমার এই উপন্যসটি ( জৈন ধর্ম বিষয়ক প্রথম বাংলা উপন্যাস ) পাঠকের দরবারে হাজির করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ।

যদি কেউ প্রশ্ন করেন , ‘ তীর্থঙ্কর মল্লিনাথ ’ লেখার কারণ কী ? আমার উত্তর হবে , অনালোকিত  অতীত অনুসন্ধানের আর এক নাম ‘ তীর্থংকর মল্লিনাথ ’ । সকলেই জানেন , জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীর এর পূর্বেও তেইশজন তীর্থংকর ছিলেন । যাঁদের হাত ধরে জৈন ধর্মমত গড়ে উঠেছে এবং প্রসারলাভ করেছে । একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে , গৌতমবুদ্ধ এবং মহাবীরজৈন প্রায় সমসাময়িক হলেও ধর্মবিস্তারে বৌদ্ধধর্ম গোটা বিশ্বে যতটা প্রসার লাভ করেছিলো জৈন ধর্মমত সেই জনপ্রিয়তা পায়নি । সম্ভবত পালনীয় কর্তব্য সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতনতা এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এই দায়িত্ব পালন করেছে । যাই হোক , খৃস্টপূর্ব  তৃতীয় শতকেই অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের কারণে ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে দিগম্বর এবং স্থূলবাহুর  নেতৃত্বে শ্বেতাম্বর নামে দুটি শাখায় জৈন ধর্মাবলম্বীদের বিভাজিত হতে দেখা যায় । জৈন ধর্মমতের প্রথম তীর্থংকর ঋষভনাথ এর সময় থেকেই দিগম্বর এর ধারণাটি পরিষ্কার হলেও শ্বেতাম্বর মতাম্বলম্বীদের মতাদর্শের সমর্থনে তেমন যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ পাওয়া যায়না ।

একথা অনস্বীকার্য , জৈনধর্মের  শ্বেতাম্বর শব্দের উৎস সন্ধানে যথাযথ তথ্যের অভাব ছাত্রজীবন থেকেই আমাকে অনুসন্ধানী করেছে । কিন্তু চব্বিশজন তীর্থংকর এর মধ্যে অজিতনাথ থেকে নমিনাথ পর্যন্ত তীর্থংকর এমন সুদূর সময়ের যেখানে শুধু কিংবদন্তি ও শ্রুতিঞ্জান ছাড়া আর কোনও কিছুর উপরই নির্ভর করা যায় না । তবুও সামান্য শাস্ত্রীয় তথ্য পেরিয়ে উনিশতম তীর্থংকর মল্লিনাথ এর কাছে পাওয়া যায় সেই উত্তেজনাময় সন্ধানের উৎস । পাওয়া যায় এক অনালোকিত ইতিহাসের ছোঁয়া। জৈন দিগম্বরদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে চব্বিশজন তীর্থংকরের সকলেই দিগম্বর এবং পুরুষ । অথচ শ্বেতাম্বর মতাবলম্বীরা উনিশতম তীর্থংকর মল্লিনাথের নারীত্বের মর্যাদা স্বীকার করেন । এবং তিনি শ্বেত অম্বর ব্যবহার করতেন । এই সূত্রই আমাকে উসকে দিয়েছে তীর্থংকর মল্লিনাথকে অনুসন্ধানের বিষয়ে ।

জৈন সাহিত্যপাথেদেখা যায় , খৃস্টপূর্ব  ভারতে পুরুষের মতো নারীরাও শিক্ষা – শাস্ত্র – শস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হতেন ।  ভারত সংস্কৃতির সেইসব আখ্যান সাহিত্যে প্রায় উপেক্ষিতই রয়ে গেছে । আমার অনুসন্ধিৎসার মেটাতে গিয়ে জৈন মঠ – মন্দির – লাইব্রেরী ( আমার নাগালের মধ্যে ) থেকে পেলাম প্রচলিত কিংবদন্তি ( মল্লিনাথ সম্পর্কে ) এবং অতিরঞ্জিত ভক্তিমূলক কাহিনি । হতাশ হলাম । জৈন তীর্থংকরদের বিষয়ে সর্বপ্রাচীন  কল্পসূত্রেও প্রকৃতসত্য বা বিশ্বাসযোগ্য জীবনচিত্র পাওয়া যায় নি । অথচ আমি চেয়েছি ধর্মীয় ধর্মীয় ভাবাবেগে মোহাবিষ্ট পঁচিশ ধনুষ উচ্চতা সম্পন্ন পঁয়তাল্লিশ হাজার বয়স্ক কলসলাঞ্ছন মল্লিনাথের বর্ণনাকে এড়িয়ে গিয়ে সেই সময়ে ভারতের সমাজে এক নারীর তীর্থংকর হয়ে ওঠার প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটন করতে । ফলে আমার উপন্যাসে উঠে এসেছে তৎকালীন ভারতবর্ষের ধর্মীয় চেতনা ও যুক্তিগ্রাহ্য ভাবনার বিকাশ । আর , সেই আর্থ – সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেই সময়ের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের অবস্থান । সর্বোপরি ষোড়শমহাজনপদ গড়ে ওঠার প্রাক্কালে ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থান ।

জৈন ধর্মবিশ্বাস ( শেত্বাম্বর ) অনুসারে উনিশতম তীর্থংকর মল্লিনাথ ইক্ষাকু কুলসম্ভুত মিথিলারাজ কুম্ভের কন্যা মল্লিকা । কিংবদন্তি অনুসারে শাপগ্রস্ত ইক্ষাকু বংশীয় রাজা মহাবল জন্মান্তরে নারী রূপ পরিগ্রহ করেন এবং তিনিই তীর্থংকর মল্লিনাথ হিসেবে পরিচিত হন ।  প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে , তীর্থংকর মল্লিনাথ জৈনধর্মের আত্মাতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা । যিনি বলেছেন , আত্মার বিনাশ নেই , এবং আত্মার  কোনও লিঙ্গ নেই , যেকোনো রূপেই তার প্রকাশ ঘটতে পারে । পরবর্তীকালে প্রবর্তিত  জৈনধর্মমতে এই তত্ত্বটি বিশেষ ভূমিকা পায় । সুতরাং জৈন ধর্মতত্ত্ব নয় কুম্ভরাজকন্যা মল্লিকার মল্লিনাথ হয়ে ওঠার কাহিনিই আমার ‘ তীর্থংকর মল্লিনাথ ’ । তাই এই উপন্যাসে কেবল আত্মাতত্ত্ব নয় প্রাচীন ভারতবর্ষের সার্বিক পরিচয়টিও পাওয়া যাবে । কিংবদন্তি ও জৈন পরম্পরায় বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলিকে অক্ষুন্ন রেখে পাঠকের হাতে তুলে দিতে চেয়েছি জৈন সংস্কৃতির এক অনালোকিত ইতিহাস ।

                                                     সমাপ্ত  

তথ্যসুত্রঃ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস – নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য / কল্পসুত্র -  বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত/ শ্রমণ ( পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা ) / kalpasutra : Trans & Ed . by Herman Jacobi / A Competitive History of Jainism – A Chatterjee / মহাভারত / মহাভারতের সমাজ – শ্রী সুখময় ভট্টাচার্য্য শাস্ত্রী সপ্ততীর্থ /  Jain Jarnal  / Political Histry of Ancient India – H . Roychowdhury / Comprehensive Histry of Jainsm – A Chatterjee / ইন্টারনেট এর বিভিন্ন লিঙ্ক

যোগাযোগঃ তুষারকান্তি রায় , ‘ তুলিতোড়া ’ , সুভাষ বাগ , বিরাটি , কোলকাতা ৭০০০৫১ ।

মোবাইল – ৮০১৭৯৬৫৬০৪ / ৯৪৩৩৫৫৬৪০৩        

Friday, 8 January 2021

সুবিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 
 

 
 

 

 

প্রকৃতি বিষয়ক

যারা যারা সাঁকোটা পেরিয়ে গ্যাছে , অথবা যারা চেয়েছিল কিন্তু পেরোতে পারেনি। তাদের সকলের নাম মনে রাখবে নদী। কারণ তাদের সকলেরই ছায়া পড়েছে। কতটা সময় ধরে সেটা বিবেচ্য নয় কেবল। অভিযাত্রীর একটা গোটা ক্যারাভ্যান চলে গ্যাছে মরু পেরিয়ে। সকলেই যে ওপারে পৌঁছেছে এমন নয়। তবু যারা ওয়েসিসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে , পেড়ে খেয়েছে মিষ্টি খেজুর , ছায়া ঢাকা সরোবরের নীল জল অথবা যারা মরীচিকা দেখে উপুড় হয়েছে বালির ওপর কিংবা  চোরাবালির নীচে আস্তানা গেড়েছে চিরতরে , তাদের সকলের জন্যই মরুভূমি আজ খুশি। লিখে রেখেছে এক একটা বালিয়াড়ির ছাদ বা তলায় তাদের প্রত্যেকের নাম অতি যত্ন করে , মনে রেখ এটা।

 

সিংহল যাত্রা


সুচয়ন তুলে আন ফুল!

দ্রাবিড় কোমরে গাঁথা মালা
নিতম্বে স্খলিত বসন।

সুচয়ন তুলে আন ফুল!

দ্রাবিড় অধরে দেখ রাঙা তাম্বুল
ঈষৎ রক্তাভ চোখ।

সুচয়ন তুলে আন ফুল!

অষ্টোত্তর শত ইন্দিবর , 
খোঁজ সহস্র সরোবর অযুত যোজন দূর।

সুচয়ন তুলে আন ফুল!

বাঁধ সাঁকো নীল অর্ণব
বানর সেনানী যত লাগে পাবে।

সুচয়ন তুলে আন ফুল!

অকাল বোধন যাত্রা
চলেছেন

দাশরথী রঘুবীর , বহিছে মৃদু মন্দ সমীর , 
দিনমণি গেল অস্তাচলে।

© সুবিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়