Sunday, 1 April 2018

সাহিত্য এখন,মার্চ-এপ্রিল সংখ্যা,২০১৮







 সম্পাদকীয় 
পলাশের মনখারাপ,শিমূলের মুখ ভার। বসন্তের যাবার সময় হয়ে এল।যাবার আগে সে উজাড় করে দিয়ে যাবে সম্বৎসরের ভালোবাসার রঙিন সিন্দুকখানা। প্রকৃতি কার্পণ্য শেখেনি। কার্পণ্য শুধু আমাদের অন্তরে। আমরাই মনের ভিতর কাঁটাতার দিয়ে রাখি, হারিয়ে ফেলি ভালোথাকার মূল্যবান চাবিকাঠি।
এই যে এত তোমার আমার বলে দড়ি টানাটানি, এত ঘর গুছিয়ে রাখার ধূম... এর কতটুকু সাথে যাবে? কী দিয়ে যাব আমরা পরের প্রজন্মকে? আমরা অভিভাবক, আমরাই ভাল বুঝি- এই বলে আর জাঁক করতে পারব কি? খবরের কাগজ খুললে, টিভির চ্যানেল খুললে বারবার ছোটদের সামনে মাথা নত হয়ে আসে কেন? কেন ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না?
এবার ভাবার সময় এসেছে বললে আসলে খুব ভুল হবে। ভাবার সময় এসেছিল অনেকদিন আগেই। আমরা ভাবিনি। অথবা ভেবেও করিনি কিছুই। নিজেদের গণ্ডীর মধ্যেই কেটেকুটে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি আমাদের ভাবনার শাখাপ্রশাখা। আমাদের কবিতায়,গল্পে, প্রবন্ধে সাময়িক ভাবে উঠে এসেছে এসব প্রসঙ্গ।ঘৃণার শিকড় খুঁজে তাতে লাগাতার আঘাত করার শক্তি অর্জন করতে পারিনি।
নতুন বছর আগত প্রায়। নতুন করে শপথ নেবার দিন আসছে। সর্বশক্তি দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে আমাদের এই ঘর, এই উঠোন। সাহিত্য এখনের পাতায় তারই স্পন্দন শোনা যাচ্ছে। বন্ধু,শুনবেন কি?
                                         শ্যামশ্রী রায় কর্মকার




মনের কথা (৭)
আরো কত প্রজন্ম?
মৈত্রেয়ী সরকার

আমার ঠাকুরদাদা যশোহরের নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ের মানুষ ছিলেন।নোয়াখালি দাঙ্গার সময় ভিটেমাটি দেশ ছাড়েন।আমার মা সাতক্ষিরার মেয়ে,একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে লিগ আমলীগের হত্যা দেখেছে,যুদ্ধের তান্ডবে এগারো বছর বয়সি মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো কিছুকাল।তারা লীগের হুমকি খেয়ে তিন দিন তিন রাত নৌকায় চেপে প্রাণ নিয়ে ইন্ডিয়ার ক্যাম্পে চলে এসেছিলো।তারপর ফিরেও গেছিলো স্বাধীন দেশে।কিন্তু সত্যিই কি ওই হিন্দু পরিবার স্বাধীনতা পেয়েছিলো? দাদুর বিবাহযোগ্য পাচ মেয়ে মা বাবা বাড়ি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় আত্মীয়ের বাড়িতে বাড়িতে থেকেছে, কি নিদারুণ ভয় ছিলো তাদের চোখে লুঠ হয়ে যাওয়ার।আমি ছেলেবেলায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় দেখেছি মায়ের চোখে কি নিদারুণ ভয়।বাংলাদেশে মা ভাইরা বেচেঁ থাকতে পারবে তো?  আমার ক্লাসের সাবিনা ইয়াসমিনের চোখে ভয় দেখেছি সেই বারবির সময়।তাদের নাকি ভারতবর্ষে থাকতে ভয় করে,বিশেষ এক সরকার ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এলেই তাদের ভয় বাড়ে।গুজরাটের দাঙ্গার সময় আমাদের এক দূর সম্পর্কের দাদা নিখোঁজ হয় লেবার শ্রেনীর কাজ করতে গিয়ে।তার মা আজো অপেক্ষায় বসে থাকে তার ছেলে ফিরে আসবে এই আশায়।আমার এক ছাত্র সাইফুল একবার আমার আর এক ছাত্র পলাশদের বাড়ি আমার সাথেই লক্ষ্মী পুজোর প্রসাদ খেতে গিয়েছিলো। পলাশের দাদুর সাথে আলাপচারীতায় সাইফুল তার নানার পরিচয় দিতেই জানতে পেরেছিলো ওই বিরাট বিরাট পুকুর বিঘা বিঘা সম্পত্তি একসময় তাদের ছিলো,দাঙ্গার সময়,মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়ার সময় প্রাণ
ভয়ে তারা সব ছেড়ে হিজলির মতো শ্মশান ভাগাড়ে গিয়ে তখন সবাই আস্তানা গড়েছিল।সাইফুলদের মুখে মুখে এখনো সেই যন্ত্রনার কথা ঘুরে বেড়ায়।
আমার ঠাকুরদাদা নোয়াখালি দেখেছে,মা মাসিরা একাত্তর দেখেছে,আমি সেই শিশুকালে বাবরি দেখেছি, গুজরাট দেখেছি,এখন বাদুড়িয়া দেখছি,দত্তপুকুর দেখছি,রানীগঞ্জ দেখছি।জানি না আমার পরের প্রজন্ম  আরো কি কি দেখবে! হে ভগবান! ওরা বোধহয় এই দেখাগুলো নিয়েই   ওদের মতো করে দেশকে চিনবে,যেখানে রাম রহিম নিয়ে যুদ্ধদিন খবরে রোজনামচায় থাকবে।আর কতদিন এই অভিশাপ বুকে নিয়ে বেড়াবো আমরা? আরো কতো প্রজন্ম?




মনের কথা(৮)
হ্যাপি ডে
পারমিতা মালী

       এবার শুরু করছি । ধরুন যারা কাগজপত্রে লেখালেখি করেন, মানে লেখাটা যাদের বাধ্যতামূলক কাজ বা পেশা, তাঁরা সবাই কিন্ত বাধ্যতামূলক  ভাবুকও। শুধু তারাই নয়, আমরাও, যারা কি বোর্ড এর সামনে বসতে পারি অন্তত , আমরাও অল্পবিস্তর ভাবি। আমরা সবাই স্তরে স্তরে
 বিস্তর ভাবনা চিন্তা করি। সাপ, ব্যাঙ, কড়া ও শর্করাধর্মী, স্নেহরস ও পিত্তরসধর্মী  বিচিত্র সব আইডিয়া ঠিক সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ছুটে ছুটে আসে,আর ভেঙে পড়ে আমাদের মগজে। তা এইসব করতে গিয়ে আমাদের প্রচুর মানসিক পরিশ্রম হয়, তাই আমাদের মাথা টাথা ধরে। আমরা ঘন ঘন চা খাই, সিগারেটে টান দিই, এস্পিরিন খাই, প্যারাসিটামল গিলি । কেউ কেউ আবার এইসান টেনশন খায়, যে খাবার টাবার খেতেই ভুলে যায়। তারপর সেইসব ভাবনা টাবনা জমলে আমরা লিখতে বসি। সাপ, ব্যাঙ, হাতি, ঘোড়া যাহোক কিছু একটা লেখা দাঁড়ায়। এবার সেইসব ভাবনাতেও টান পড়ে একসময়। তাই নিত্যনতুন ভাবনার সন্ধানে মনের মধ্যে মৃগয়া করতে হয়। হাতে তীরধনুক নিয়ে বন জঙ্গল,পাহাড়, পর্বত হাতড়ে বেড়াতে হয়,তারপর যা দু চারটে আইডিয়া বেরোয়! সুতরাং, এই পুরো ব্যাপারটা কিন্ত খুব শ্রমসাধ্য প্রজেক্ট,এই আর কি!

              এখন ব্যাপার হচ্ছে, যা কিছু চর্চাই চলুক না কেন,তা যদি অনর্গল চলে, তাহলে তো ভাঁড়ারে টান পড়বেই! চব্বিশ ঘন্টা ধরে যদি সাতশো খানা চ্যানেল চলে,অনলাইন দুনিয়ায় অনন্ত পোষ্ট পড়তেই থাকে  দিবারাত্র তাহলে চিন্তাধারায় তো কমতি পড়বেই। রোজকার থোরবড়িখাড়ার মধ্যে এত খবর আসবেই বা কোত্থেকে! এত কি এমন ঘটে চারপাশে যে রাবণের চিতা জ্বলতেই থাকবে? কোত্থেকে জুটবে এত জ্বালানি!...সুতরাং একটাই সলিউশন। খবর যদি ফুরিয়েই যায়, নিজেকেই জ্বালাও! অন্তত কিছু একটা দিয়ে আগুনটা জ্বালাও!

         মাথাটা কেন গরম হলো তা বলি। আজ নাকি হ্যাপি ডে ! বাপের জন্মে শুনিনি হ্যাপি ডে বলে কোনো ডে থাকতে পারে ! হ্যাপির ও আবার ডে রাখতে হবে! এত হ্যাপি আসে কোত্থেকে !

               আরে বাবা এন্টারটেইনমেন্ট এর ও তো একটা লিমিট আছে রে বাবা ! আর এতো বুদ্ধিহীন এন্টারটেইনমেন্ট দেখবই বা কেন !  পড়াশোনার ঝামেলা নেই, বুদ্ধিবিবেচনার দরকার নেই, দিবারাত্র মাড়ি বের করে পাগলের মতো হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ো! তবেই নাকি তুমি খুব হ্যাপি! কোনো মানে হয় এসব ছেলেমানুষির!

           ছোটবেলায় সিনেমা দেখে ভাবতাম, হিরোইনদের চুলে বুঝি জট পরে না, গায়ে ঘামের গন্ধ হয় না। বিজ্ঞাপনের সংসারে ময়লার লেশমাত্র নেই। চাদর টাদর সব টানটান করে পাতা থাকে। দুঃখকষ্ট সেখানে ঢোকেই না। ঝকঝকে জামাকাপড়, ফটফটে দাঁত, আর ফুরফুরে চুল নিয়ে তারা খালি হেসেই যায়,হেসেই যায়। কারণে অকারণে এ ওর গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে! বড় হয়ে তো সবাই বুঝেছি, এতো হাসির কোনো কারণ নেই। এতো ফুর্তির দুনিয়ায় কেউ বাস করে না। সক্কলকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে, রক্তাক্ত হয়ে হয়ে,তবে এগোতে হয়।  আচ্ছা, তারা নাহয় হাসার জন্য পয়সা পায়, কিন্তু গোটা আন্তর্জাল জুড়ে কেন এত অকারণের হাসাহাসি! কেন এমন ক্লাউন সাজা? পরীক্ষায় ফেল মেরেছ?.হেসে গড়িয়ে যাও। বউ ভেগেছে?.সে তো আরো হাসির ব্যাপার!  প্রেমিক ডিচ করেছে?.. নো প্রবলেম, ডিজে ভাড়া করে, একটা ব্রেকআপ পার্টি দিয়ে দাও! তারপর ধেই ধেই করে নেচে তুমি প্রমাণ করো যে, তোমার কোনো কষ্টই হয়নি। তোমার হাসি আর ধরছে না মুখে। এ কি অর্থহীন হাসি রে বাবা!

        সব্বাই বিজ্ঞাপন সেজে বসে আছে ! কেন?.. কে পয়সা দেবে আমাদের?.কি এতো দায় অনন্ত ভালো থাকার বিজ্ঞাপনের?..এই ভালো থাকাথাকির বাধ্যতা তো বড্ড হাঙ্গামার ব্যাপার মশাই !

        আসলে আমরা কেউ তেমন অসাধারণ কিছু ভালো নেই। সব্বাই হরেদরে একই রকম আছি। বছরের তিনশো দিনই দুর্ভোগ, দুশ্চিন্তা, অপমান নিয়েই কাটাই সকলে। সকলের সেই একই কাহিনী।  কি ভাবছেন?. বাকিরা সব তুমুলভাবে বেঁচে আছে, আর হাসির হররা ছুটিয়ে দিচ্ছে?....
  ধুর্.....সব গুল। অত হেসে কাজ নেই। চলুন,বরং জুকুদাকে সবাই মিলে একটা কবিতা গিফট করি....

   "  না আছে তার মুন্ডু মাথা
   না আছে তার মানে,
   তবুও তোমায় হাসতে হবে
    তাকিয়ে বুড়োর পানে!!! "


 কবিতা

পৃথিবীটা কোনোদিন
কান্তিময় ভট্টাচার্য

পৃথিবীটা সোজা হোতে পারলো না
আর মানুষগুলো বেঁকে-চুরে জানোয়ার হোয়ে গ্যালো

কেউ হাত ঢুকিয়ে দিলো সৈনিকের জোব্বায়
কেউ নুলো হাতে আঁকড়ে ধরলো চেয়ার

বারবার বুকের মধ্যে ভর্তি কোরতে থাকলো
সোনা, ফ্ল্যাট, গাড়ি আর অবৈধ যাপন

পৃথিবীটা কোনোদিন কমলালেবুর মতো ছিলো
এখন মানুষের ফুঁয়ে সেটা তেরছা-লম্বা-ডিম্বাকৃতি

ধরে নিন ফুঁয়ে বিষ, ফুঁয়ে লোভ, ফুঁয়ে ধর্ষণ, দেদার
                                             মিথ্যাচার
দেদার ফাটল, ফুঁয়ে ফুঁয়ে বিষোদ্গার-ভাষণ

লালসার বাজারে বিকিকিনি হোচ্ছে বিষাক্ত চুম্বন
আলিঙ্গনের ছিদ্রপথে ঢুকে যাচ্ছে লুন্ঠনের ব্যভিচার

আর আমরা আঁকড়ে ধরছি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
লুঠতরাজের সিংহাসন, বিভীষিকা-অন্ধকার,
                                       অট্টালিকা-জংগল

পৃথিবীটা ক্রমশঃ জংগল আর মৃত জলাশয়
                                         হোয়ে যাচ্ছে যে



অপরজন্ম-6
জাতবেদা মিশ্র

আদিগন্ত সর্ষে ক্ষেতের ভিতর হলুদ আলো
নাকফুল ছোটবেলা হারিয়ে গেছে
আলু ক্ষেত জুড়ে ব্যস্ততা ফসল তোলার
মাটি খুঁড়লে বেশ কিছু পাওয়া যাবে অবশেষে
পাকা দালানে রঙ বেরঙের গরম রোদ খায়
খোঁটা উপড়ানো গরু আচমকা জমিতে
হেই হেই হ্যাট হ্যাট অবুঝ অবলা জীব।
বাতাস খুশি বিলোয় ধানসেদ্ধর মিষ্টি গন্ধে
কেমন দুধ উথলানো গন্ধের মতো লাগে
নাক উঁচু করে শুঁকলেই মুখ ভর্তি কাঁচা জল
বড় খিদে আর জাড় লাগে, মাগো
ঘরে ঘরে নবান্ন করছে কারা!
তারপর, চরাচর জুড়ে নামে শীত
টায়ার পোড়া গন্ধে এখন বাতাস ভারি
কোঁচড়ে কুড়নো আলু আগুন খোঁজে
কচি ধান দাঁতে চিপলে দুধের স্বাদ জাগে জিভে
কবে আবার ধান রুইবে?
শীত কবে শেষ হবে? মাগো!

তালা ও চাবি
রুদ্রশংকর

ছোটবেলায় তালা ও চাবির সঙ্গে
আমার তোলপাড় সম্পর্কের কথা কাউকে বলিনি
এমনকি রূপকথাকেও নয়
রূপকথা এও জানতোনা জীবনে অঙ্ক মেলানোর থেকে
মধুসাহিত্যে আমার বেশী আকর্ষণ ছিল
তাই অঙ্কের মাস্টারমশাইরা এখনো
আমার ফোকলা অস্তিত্বের কাছে ফিসফাস করে

অনেক পরে যখন পথিক রায়ের সঙ্গে পরিচয় হল
আমার শোয়ার ঘরে তখন জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকার
অরুনিমার চলে যাওয়া
তলাপাত্র দিদিমনির বস্তুরূপ
শল্যচিকিৎসকের মতো আতঙ্কের ছুরি কাঁচি নিয়ে
টুকরো টুকরো করত মুখ-থোবড়ানো ভবিষ্যৎ

ধীরে ধীরে সবুজ ইজ্জতের জন্য হাঁটতে শিখলাম
যেখানে আমার মাত্রাহীন মৌনতার শক্তি ছিল
ঠিক সেখানেই ঘর্ষণে ও সংঘর্ষে এখন বুঝতে পারি
এক নির্জন তালার জন্য মসৃণ চাবির প্রয়োজন হয়।

মৃতের নগরী
জলিল সরকার

আমার পরিপার্শ্বে ভয়াবহ এক মৃতে নগরী পড়ে আছে
আমি বেঁচে আছি এক মহাসিন্ধু ধ্বংসস্তুপ বুকে নিয়ে,
শ্রাবণের বৃষ্টিতে থামেনা পোড়া অনল,
বাতাসের কাছে, বৃষ্টির কাছে, ঝর্ণার প্রবল বর্ষণের কাছে মুক্তি নেই আমার,
আমায় পুড়তেই হবে আকাশের নীলাদ্রি নীলে,
মনু কাকা একদিন বলেছিলেন,
পোড়া মানুষের কপাল এমনিতেই পোড়া হয়
সেদিন বুঝেনি আজ বুঝেছি সত্যি বলেছিলেন মনু কাকা
আমি আর সইতে পারছিনা এ পোড়া চাঁদের আলো,
দমবন্ধ হয়ে আসে আমার,
কোথাও কেউ নেই!
শুন্যতার ভিতর ডুবে গেছি আমি,
আমার ভেতর পোড়া লাশের গন্ধ নাড়িভূঁড়ি শুদ্ধ জ্বালিয়ে পুড়ি খাক করে দেয় সমস্ত অনুভুতির ডাল-পালা,

আমি বয়ে নিয়ে যেতে পারছিনা জগদ্দল পাথরে মোড়া মৃতের কফিন,
নগরীর চারপাশজুড়ে মৃত মানুষের দল,
জিঘাংসার অনলে পোড়ায় সাহারা মরুভূমি,
তবুও নক্ষত্রের ভিতর রক্তাক্ত শব বয়ে বেড়ায় রাতের আঁধার,
কেবলই যেদিকে তাকাই জীবনের কালোমেঘ তুলোর মতো ধেয়ে আসে শ্রাবণের বৃষ্টির ভেতর,
তবু, রাতের আঁধার গ্রাস করে রাতের মতো,
আর, আমি মৃতের নগরীতে পড়ে আছি হাজার বর্গমাইল জুড়ে
এখন আর কেউ চেনেনা আমায় আগের মতো।

 চলো আমরা আকাশ হয়ে যাই
আক্তারুজ্জামান-মিন্টো


নীল খামে ধুপ জ্বেলে
ফেরারি প্রাণের লীন হাওয়ায়
বৈকাল হ্রদের উপর দিয়ে
চলো আমরা আকাশ হয়ে যাই।

নিমগ্ন ফল্গুর বারতায় চমকিত বৃষ্টি রচনায়
কাননে কাননে পুষ্পরঞ্জিত গালিচায়
টলমল নদীর তরঙ্গায়িত জলে শূন্য ডানায়
চলো আমরা আকাশ হয়ে যাই।

আকাশ হওয়া সোজা ভীষণ সোজা
বাষ্পকণা তরল করে গাঙচিলের ঠিকানায়
দু'ঠোটে সাদা মেঘ উড়িয়ে
চলো আমরা আকাশ হয়ে যাই।



দৃশ্যমান..
ভাস্কর পাল

দৃশ্যত তোমায় ঘৃণা করবো বলেই
আজ এই চৈত্রে আহ্বান করেছি ঝমঝমে বর্ষা  গোধূলির সূর্য পট আকাশের খোলা পাতায়
বার কয়েক লিখেও কেটেছিলাম
তোমার নাম ......
ভেবেছিলাম ভাল যেহেতু বেসেছিলাম
হয়তো নিজের চেয়েও অনেক বেশি
আঁকতে চেয়েছিলাম  ঘৃণার রঙ কে মনের রঙ মিশিয়ে কবিতা লিখতে

যেভাবে তোমায় আমি ঘৃণা করি
সে তো ঘৃণা নয়ই-বরং ভালবাসা !
সময় ফুরোচ্ছে
গত 'সময়ে'র কাছে বর্তমান 'সময়'টা বেচে দিয়ে
আমিও ফুরোবো ভাবছি.........


আকাশ ছোঁয়া লোকটা
আর্যতীর্থ

যে লোকটা কালকেও পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আকাশের সাথে আড্ডা মারছিলো,
সে আজ দুম করে নেই হয়ে গেলো।
বলা নেই কওয়া নেই, মৃত্যু পাঠালো তাকে আচমকা হাতচিরকুট,
চলে এসো বাছা! গোধূলির আলো দেখো মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের কালোতে,
চলে এসো, আলো থেকে ঠাঁই নাও ঢেউহীন অনন্ত অন্তআঁধারে, যার পরে আর কিছু নেই ।’
সেই চিরকুট পড়ে পাহাড়ের মতো লোকটা আকাশকে বললো,
যাই রে! এইটুকু মনে রাখিস, কেউ তোকে ছোঁয়ার স্পর্ধা করেছিলো!’
আকাশ তাকে সযত্নে পরিয়ে দিলো তারার মুকুট, মেঘ দিয়ে
পরিপাটি করে মুছিয়ে দিলো জীবনের ঘাম,
তারপর, খুব মৃদুস্বরে বললো, ‘ যাই বলতে নেই, বলো আসি।’
পাহাড়ের মতো লোকটা দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে, ক্রমে তার মুকুটের তারাগুলোও আবছা হতে শুরু করলো,
সময় যথারীতি দুহাতে ঢেকে দিলো তার বাকি যাত্রাপথ।
আকাশ অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে, তারপর কালো মেঘেদের বললো,
ঝমঝম করে বৃষ্টি নামা বাবারা, আজকে পৃথিবীর ডুকরে কাঁদার দিন!’
তারপর, চারদিক কালো করে খুউউউব বৃষ্টি নামলো, আর  ছলো ছলো আকাশ পৃথিবীকে উদাসীন স্বরে বললো,
জানিস, আসি বললেও, চলে যাওয়া মানুষগুলো আর কোনোদিন ফিরে আসেনা!’
বৃষ্টি পড়েই চললো, ঝমঝম, ঝমঝম......



উৎসব
প্রত্যূষ কর্মকার

আস্ত একটা গোলাপ বাগান তোমাকে দিয়ে যাবো বলে
বসরা থেকে আনিয়েছিলাম খাস গোলাপের বীজ
সদ্য ডিম থেকে বেরোনো পাখিকে বলেছিলাম
জমিয়ে রাখো ওম,তোমার রঙীন চঞ্চলতা,
আমার গর্ভবতী বাগানে গোলাপের ভ্রূণ এলে চাইবো উপহার
বাগানটা তোমাকে দেবো বলে ঝর্নার সাথে চুক্তিপত্র লেখা হল
ঝর্না জল ছেটাবে গোলাপ বাগানে
বিনিময়ে ঝর্নাকে দেবো আদিম স্বাধীনতা
তোমার জন্য গোলাপের কাছে বসেছি প্রার্থনায়
হে আদিগন্ত গোলাপ বাগান,
আমার প্রিয়ার কাছে জড়ো হও আজ
ওকে দেখাতে চাই গোলাপের পাপড়ি থেকে কিভাবে হয়ে ওঠা যায় উড়ন্ত কার্পেট কিভাবে গোলাপের গন্ধে ভরে ওঠে মনখারাপের উঠোন গোলাপ,
তোমার অন্তরের কুসুমটুকু দিও
আজ আমার দেওয়াল ভাঙ্গা রাজবাড়িতে বসন্ত উৎসব

ভালোবেসো
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

এমন মায়াবী এই জীবন
আঙুল ছোঁয়ালেই বেরিয়ে পড়ে মুখবন্ধ খামের গোপন কথা
সূর্যাস্তের হলুদ ঝরে যায় কমলালেবুর বাগানে
শালিখের ডানা থেকে নেমে আসে বেকাবু কুর্ণিশ
মায়োপিক মেঘমালা চশমার রোদ মুছে নিয়ে
আনমনে ঢুকে পড়ে বৃষ্টির ঘরে
এইসব অতলান্ত, থই না পাওয়ার সুগহীন
আর কার সাথে ভাগ করে নেব বলো!
এই যে চড়াইয়ের পথে হাত ধরে হেঁটে হেঁটে যাই
হাঁপ ধরে গেলে দুদণ্ড হেলান দিই পাইনের গাছে
তুমি নিচু হয়ে ঝর্ণা দেখালে আমি ঝুঁকে পড়ি অকস্মাৎ
ভাঁড়ের চায়ের থেকে শুষে নিই মাটির গন্ধ
সন্ধ্যা এলে ঝিম হয়ে শুনি পাহাড়ি অন্ধকারের উপকথা
শুনি আর ভাবি,ভাবি আর লিখি
ভালোবেসো, ভালোবেসো
তুমি ভাবো এসবই কবিতা
সত্যি বলছি,জানো!
আমি যাপনের কথা লিখি।

Monday, 26 February 2018

সাহিত্য এখন,ফেব্রুয়ারি সংখ্যা,২০১৮


 সম্পাদকীয়



সদ্যই পার হয়ে এলাম ২১শে ফেব্রুয়ারী। এই তারিখটি স্মরণ করলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।যেমন নত হয়ে আসে প্রজাতন্ত্র দিবসে অথবা স্বাধীনতা দিবসের পরম লগ্নে। ২১শে ফেব্রুয়ারী আর ১৯শে মে, এই দিনদুটি আমাদের আবেগমথিত করে, মনে করায় সংগ্রামের কথা, আত্মত্যাগের কথা , আর মাথা উঁচু করে বাঁচার কথা।বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের দেশে বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষার জন্য লড়াই আসলে অস্তিত্বের লড়াই, টিঁকে থাকার লড়াই।
আত্মা যদি পরম শক্তির প্রতীক হয়, দেহ তার আধার অর্থাৎ শক্তির আলয়। প্রতিটি জীবন তবে উপাসনার যোগ্য,কারন তা সর্বশক্তিমানের প্রিয় সৃষ্টি। খাদ্যের পাশাপাশি আলো, হাওয়া, জল আর ভাষা সেই উপাসনার পঞ্চ উপচার। মনে হতে পারে, ভাষা কেন? ভাষা ছাড়া কি জীবন ধারণ সম্ভব নয়? আমি বলব, না। কারণ ভাষা হল আমাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। নিজেকে প্রকাশ করতে না জানলে আমাদের জন্মের সার্থকতা কোথায়?   
একটি শিশু যখন কথা বলতে শেখেনি,  তখন তার হাসি, কান্না, রাগ,বিরক্তিই তার ভাষা হয়ে ওঠে। যখন তাকে শব্দ দিয়ে ভাব প্রকাশ করতে শেখান হয়, তখন সে তার উপরোক্ত অনুভূতিগুলোকে সহজতম শব্দে রূপান্তরিত করতে শেখে। যত সহজে সে তার ভাব প্রকাশ করতে পারে, তত সাবলীল ভাবে গড়ে ওঠে তার চরিত্র এবং চিন্তাধারা। যদি শিশুকে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধির পথ থেকে সরিয়ে এনে অন্য পথে চালিত করতে চাওয়া হয়, তবে তার বেড়ে ওঠাটি ক্ষতিগ্রস্থ হবেই। স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে তার ফল কি হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে রঙ্গিত ওরফে তিস্তানদীর কথা ভাবা যেতে পারেরঙ্গিতকে যখন সিকিমে প্রথম দেখি, তখন সে প্রাণচঞ্চলা, খরস্রোতা।আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে তার গতিপথে।কিন্তু যত সে সমতলের দিকে  অগ্রসর হয়, মানুষ ততই তার গতি রুদ্ধ করে প্রয়োজন মত চালিত করতে  চায় তাকে। যতক্ষণে সে তিস্তা নামে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে, ততক্ষণে তার শক্তি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে ক্লান্ত। অবিকল আমার আপনার ঘরের শিশুদের মত।

পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশগুলিতে একটি সাধারন মিল দেখতে পাওয়া যায়। এসব দেশের নাগরিকেরা প্রত্যেকেই শৈশবাবস্থায় মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করেছে। অর্থাৎ শিক্ষাগ্রহণের সময় তাদের পদে পদে ঠোক্কর খেতে হয়নি, তাদের চিন্তার স্বাভাবিক ধারার সামনে কেউ বিদেশী ভাষা নামক বিরাট একখানা জগদ্দল পাথর বসিয়ে দেয়নি। তাহলে কি বিদেশী ভাষাকে আমূল বর্জন করতে হবে? ভারতের মত বহু ভাষাভাষীর দেশে এমনিতেই তা সম্ভব নয়।  বরং মাতৃভাষা ছাড়াও অন্য ভাষা শিক্ষা করলে ভাষায় দক্ষতা বাড়ে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। অন্যান্য দেশে যেমন সম্পূর্ণ শিক্ষা পদ্ধতি মাতৃভাষায় পরিচালিত হয়, আমাদের দেশে তা হচ্ছে না। অদ্ভূত এক খিচুড়ি ব্যবস্থার সামনে আমাদের শিশুদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সরকারী বা সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে যদিও মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা হচ্ছে, সেইসব স্কুলের ছাত্রদের অনেকের মধ্যেই জাগছে প্রবল হীনমন্যতা। কারণ কী? কারণ বেসরকারী স্কুলে অনুসরণ করা হচ্ছে ইংরাজী মাধ্যম,এবং কে না জানে যে শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে অধিকাংশই ইংরাজীতে দক্ষতা থাকলে পরম শ্লাঘা বোধ করেন। যেন তাদের সন্তানরা মাতৃভাষায় সুদক্ষ হয়ে উঠলে তা পরম লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সৌভাগ্যের কথা, যে ইংরাজী মাধ্যমে শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে সকলেই এই মত পোষণ করেন না। নচেৎ ভারতের কপালে আরও অনেকটা পরিমাণ দুঃখ লেখা থাকত। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন মাতৃভাষাকে। ‘তোতা-কাহিনী’ তে তোতাপাখিটির মৃত্যু আদতে তার স্বভাব বিরুদ্ধ শিক্ষারীতির দিকেই আঙুল তোলে

স্বদেশে থেকে বিদেশি ভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে বেছে নিলে যা হওয়া স্বাভাবিক, ঠিক তাই ঘটে চলেছে আমাদের দেশে।একটা আলাদা গোষ্ঠী তৈরী হচ্ছে, যাঁরা দেশীয় ভাষা বা সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন না। সেটা অস্বাভাবিকও নয়। প্রতিনিয়ত যদি শিশুকে বিদেশি ভাষায় কথা বলতে উৎসাহ দেওয়া হয়, মাতৃভাষায় কথা বলা বর্জন করতে বাধ্য করা হয়... তাহলে শিশুর অজান্তেই মাতৃভাষা সম্পর্কে হীন ধারণা গড়ে ওঠে। সে ভাবতে শুরু করে, মাতৃভাষা নিশ্চয় খুব একটা উৎকৃষ্ট মানের নয়, তা না হলে বিদেশি ভাষাকে মাতৃভাষা করে তোলা হবে কেন! জার্মানি, ফ্রান্স বা অন্যান্য ইওরোপীয় দেশের ছাত্ররাও বিদেশি ভাষা শিক্ষা করে, কিন্তু তাদের মূল শিক্ষার বাহন তাদের মাতৃভাষা। তাতে তাদের বিন্দুমাত্র পিছিয়ে পড়তে হয়েছে বলে তো মনে হয় না। বরং ঘরের পাশে চীনকে দেখলেই বোঝা যায়, মাতৃভাষায় শিক্ষিত চীন কী অবলীলায় বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ হবার দিকে পা বাড়াচ্ছে।
উন্নত হবার মূল কথাটি নিহিত আছে অন্য জায়গায়। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, সমস্ত উন্নত দেশের সন্তানেরাই নিজের দেশ,নিজের ভাষা সম্পর্কে গর্ব বোধ করে। তারা দেশকে যত্ন করে, ভালবাসে। আমরা ভারতীয়রা নিজের দেশের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে নাক কুঁচকাই,কিন্তু তাকে পরিচ্ছন্ন করার কাজে নিঃশর্তে এগিয়ে আসি না। যদি ইওরোপে বেড়াতে যান, দেখবেন সেখানকার অধিবাসীরা নিজের দেশের সৌন্দর্য এবং পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কত যত্নশীল। একবার একদল ভারতীয় পর্যটক সুইজারল্যাণ্ডে একটি রেস্তোঁরায় প্রাতঃরাশ সারছিলেন। রেস্তোঁরায় সবার জায়গা হয়নি বলে সংলগ্ন ফুটপাতে খাবার হাতে দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন। রাস্তার অপর প্রান্তে একটি স্থানীয় ট্যাক্সিচালক তখন দিনের প্রথম রোজগারের আশায় অপেক্ষা করছিলেন। ভারতীয় পর্যটকদের রেস্তোঁরার বাইরে দাঁড়িয়ে খেতে দেখে তিনি তড়িঘড়ি রাস্তা পার হয়ে এলেন। তারপর অত্যন্ত বিনীত ভাবে তাদের অনুরোধ করলেন যে তাঁরা যেন ভুক্তাবশেষ এবং খাবারের ব্যবহৃত প্লেটগুলি পাশের ডাস্টবিনে ফেলেন। আমাদের দেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে গেলে আমাদেরও এভাবেই এগিয়ে আসতে হবে। বুঝতে হবে নিয়ম তৈরী হয় পালনের জন্য, ভাঙার জন্য নয়।

ঠিক একই ভাবে মাতৃভাষাকে উন্নত করতে গেলেও আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। উচ্চশিক্ষায় পঠন পাঠনের জন্য বাংলায় ভাল বই নেই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। বই লেখার দায়িত্বটিও কাঁধে নেবার কথা ভাবতে হবে। শুধু বিশ্ব সাহিত্য নয়, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বইও বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। আবার দেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজকে বিদেশের দরবারে তুলে ধরার দায়টিও নিতে হবে কাঁধ পেতে। বিদেশের দরবারে নিজেকে তুলে ধরতে গেলে বিদেশি ভাষা শিক্ষা করাও খুব জরুরী। তবে সেটিকে ভীতিপ্রদ করে তুললে তা কোনদিনই সহজে ধরা দেবে না।  শুধু পড়া বা লেখা নয়, বলা এবং শোনার ওপরেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক শিক্ষিকার। তবে সবার আগে যেটি করতে হবে , সেটি হল মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করতে শেখা।বছরে দুবার নয়, প্রতিদিন। সেই কাজটি শুরু করতে আমাদের আর একমুহূর্তও দেরী করা উচিত নয়।
                                                  শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
 


 গল্প

যখন তোমার পাশেও অন্ধকার
সম্পূর্ণা চ্যাটার্জী





টিভিতে হাঁ করে বর্ষা "প্যাডম্যান"য়ের ট্রেলারটা দেখছে।সোফার পাশে দাঁড়িয়ে অন্তরা মানে বর্ষার মাও ডুবে গিয়েছে সিনেমাটার ক্লিপিংসে! অবাক হয়ে ভাবছে এইসব কনসেপ্টেও আজকাল সিনেমা হচ্ছে! কি বিরাট পরিবর্তন ! আগে এ ধরণের কনসেপ্টে সিনেমা শুধুমাত্র আপার ক্লাস বা বুদ্ধিজীবীদের জন্য বানানো হত, বিদেশী এ্যাওয়ার্ড পেত, সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মেসেজটা পৌঁছতই না!এখন সবার জন্য বানানো হয় নির্ভেজাল মোড়কে। যাতে সহজভাবে গভীর মেসেজ ছড়িয়ে যায় সবার কাছে! বলা যেতে পারে নিখুঁত বুদ্ধিতে সোস্যাল এ্যাওয়ারনেস বাড়ানো।
এসবই ভাবছিল অন্তরা দেখতে দেখতে। চেয়ে দেখল ক্লাস নাইনে পড়া বর্ষাকে! প্রথম প্রথম নিজেও খানিকটা লজ্জা পেত! প্যাড বা কন্ডোমের এ্যাডে বা সিনেমায় রেপ সিন দেখালে ঘুরিয়ে দিত চ্যানেল! ঋতু মানে অন্তরার প্রথম সন্তান পর্যন্ত এ জিনিস চলেছিল। কিন্তু বর্ষা যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন ওদের মেয়েদের "পিরিয়ড" হওয়া নিয়ে স্পেশাল এ্যাসেম্বলিতে প্রিন্সিপাল একটা ক্লাস করেছিলেন!আজকাল মেয়েদের পিরিয়ড আগের তুলনায় বয়সের একটু আগেই শুরু হয়ে যায়, তাদের ম্যাচ্যুরিটি আগেকার দিনের মেয়েদের থেকে বেশি থাকে বলে|তাই স্কুলে হঠাৎ করে এমন হলে টিচারকে লজ্জা বা ভয় না পেয়ে জানাতে| এটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়, জাস্ট একটা বায়োলজিকাল সিস্টেম, মেটাবলিক এ্যাক্টিভিটি ! এও বলেছিলেন, "মা পিরিয়ডসদের দিনে তোমায় জড়িয়ে ধরে আদর করলে বা খেতে দিলে খারাপ যদি না হয় তাহলে গড আর গডেসদের ছুঁলেই খারাপ হবে কেন? তোমরা কি তখন তোমার মাকে ছোঁওনা?" ভীষণ ভালো লেগেছিল কথাগুলো বর্ষার মুখে শুনে। ছোট থেকে ঠাকুমা-মা-কাকিমার তৈরি করা সংস্কারে হঠাৎ একটা আছড়ে পড়া স্রোত! যুক্তিতে ভেঙে যাওয়া আজন্মের ভাবনা! ছুটে গিয়ে অদ্রীজকে বলেছিল কথাটা! অদ্রীজ তখন অফিস থেকে সদ্য ফিরেছে! গরম চায়ের কাপে চুমুক না দিয়েই খানিক ভয় পেয়ে বলেছিল, 'তুমি কি এবার এ বাড়িতে এই রেভোলিউশন আনবে নাকি! হাতজোড় করছি অনু মায়ের কানে গেলে যাতা রকমের অশান্তি হবে! কেন মিছিমিছি স্রোতে ভাসতে চাইছ? যেমন চলছে চলতে দাও। ' অনু হতাশ গলায় বলেছিল, 'যাই বলো কথাটায় যুক্তি আছে।আর তুমি সায়েন্স নিয়ে পড়ে এসব....!' কথা শেষ হওয়ার আগেই অদ্রীজ উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, 'সায়েন্স আমার মাথায় থাক অনু। আইনস্টাইন থেকে ডারউইন এদের যদি বিধবা মা থাকত আর আত্মীয়স্বজনের "বাবা চোখ বুঁজতেই মাকে পর করে দিলি!" টাইপ ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ভয় থাকত তাহলে ওই আবিষ্কারগুলো, হত না। প্লিজ অনু যা বললে আমাকেই বললে, ঘুণাক্ষরে মেয়েদেরও উল্ট বুঝিও না। '
হঠাৎ করে শ্বাশুড়ির গলায় ঘোর কাটল। তিনি যে নিঃসাড়ে এসে দাঁড়িয়ে ওই "প্যাডম্যানে"র ট্রেলরটা দেখেছেন কেউই খেয়াল করেনি। আচমকা উচ্চস্বরে চমকে উঠল দুজনেই! "বাঃ! বাহ্ বা বাহ্! দেখার মতো দৃশ্য! মা মেয়ে পাশাপাশি এসব দেখা হচ্ছে!! এখনও আমি বেঁচে বুঝলে? এটা এখনও আমার বাড়ি। বেলেল্লাপনা চলবে না। মেয়েকে নিজে হাতে উচ্ছন্নে দিচ্ছ!! ' এতোটুকু শোনার পর বর্ষাই বলল, 'ঠাম্মি এতে লজ্জা কিসের!! আমাদের স্কুলে ক্লাস সেভেনের সিলেবাসেই....' কথা শেষ হলনা, অন্তরা মেয়ের দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলল, 'আহ্! চুপ কর, সব বিষয়ে বিতর্ক ভালোলাগেনা।' বলেই ঘর থেকে টিভি বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।
কথাগুলো যে শ্বাশুড়ি মানে সরমাকেই বলেছে সেটা সরমাও বুঝেছেন। তার গলার স্বরে উঠে এসেছে ছোট পিসিও। তিনি এসেছেন ঋতুর আশীর্বাদের জিনিস দেখতে। ঋতুর বিয়ে এখনও দেরি অনেক। ছেলে মুম্বইয়ের "ভাবা রিসার্চ সেন্টারে" চাকরি করে। ঋতুর সাথে পরিচয় যাদবপুরে এমএসসি করার সময়। ননকাস্টে বিয়ে হচ্ছে। এ বাড়ি ব্রাহ্মণ, মুখার্জ্জী। আর ছেলেরা কায়েস্ত মিত্র। রাজি করাতে বেগ পেতে হয়েছিল। নিজের আপত্তির থেকেও বেশি চিন্তা আত্মীয়-স্বজন কি বলবে! এরা বোঝেনা ভালো থাকাটাই আসল। ঋতু পিএইচডি করছে,অজয় চক্রবর্তীর কাছে গান শিখেছে, এমন মেয়ের কদর বুঝবে তেমন ছেলেরই দরকার। নির্ঝর ছেলে খুব ভালো। ওরই উদ্যোগে ঋতুর পিএইচডি করা। যতোদিন না কমপ্লিট হয় ঋতু থাকবে কোলকাতায়, ওদের বাড়ি গড়িয়াহাটাতে। অন্তরা সেইসময় প্রথম শ্বাশুড়ির মুখের ওপর বলেছিল, 'ব্রাহ্মণ কায়েস্ত দিয়ে ওর ভালো থাকা কি নিশ্চিত করা যাবে মা? বিয়ে তো কাস্টের আইকার্ড নয়, যে গলায় ঝুলিয়ে ঘুরবে। বরং ও যাতে ভালো থাকে সে চেষ্টা করাই উচিত। যে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এতো ভাবছেন তারা ও খারাপ থাকলে এভাবেই এসে পাশে দাঁড়াবে তো? ' সরমা চোখের জল মুছে বলেছিলেন, 'তোমাদের বাবা আমাকে একলা ফেলে চলে গেছেন। আমার বাড়ি হলেও আমি তোমাদের গলগ্রহ। মেনে তো নিতেই হবে। '
এসব ইমোশনাল টর্চারে অন্তরা ও বাকি সবাই অভ্যস্ত। দিনে একশবার আর আত্মীয়রা এলে বারবার এই "আমার বাড়ি" আর "ছেলে বউয়ের গলগ্রহ" কথাটা শুনে শুনে আর কেউ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেনা। আজও তাই শুনল না কথাটা। ছোট পিসি এসেছে ওদের জলখাবার দিয়ে চা করতে আসছিল। তখনই একটা ছোট ট্রেলার দেখতে গিয়ে এই বিপত্তি। ছোট পিসি এসে আরেকটু উস্কে দিল, 'আর বোলো না বৌদি। আমার বাড়িতেও এই চলছে| তোমার নন্দাইকেও বলেছি চুপচাপ চোখ উল্টে দেখে যেতে । সব এখন স্বাধীন, আমরা সেকেলে হয়েগেছি গো! আমার ছেলের বউ তো আবার হাতকাটা কি ওই কুর্তি না কি বলে তাই পরে কলেজে পড়াতেও যাচ্ছে!! স্যার দিদিমণিদের সাজের কি ছিরি! আর কিছু বলতে গেলেই চোদ্দোশ জ্ঞান তোমায় দিয়ে দেবে। ছাড়ো, ছাড়ো, নিজের মতো থাকো যতদিন আছো। ' তার মুখের কথা সরমা কেড়ে নিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, বিদ্যেধরী নাতনীর ঠাকুমা আমি। কিছু বলতে গেলেই একঘরে হতে হবে। এ পোড়া চোখে আরো কতো কি পরিবর্তন দেখতে হবে কে জানে!'খোঁচাটা ঋতুর বিয়ের ঠিক হওয়া থেকেই সরমার মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। উঠতে বসতে শোনান। সব বিষয়েই কথা বলে এটা বলেদেন। ঠিক যেন সিগারেটের প্যাকেটের স্ট্যাটুটরির মতো। নিজের মনে ভেবেই হেসে ফেলল অন্তরা। চা হয়ে গেছে, নিয়ে এগোল শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে। .....
আবার কাল...

ঘরে ঢোকার সময়ই অন্তরা বুঝল তাদের নিয়েই হয়তো কোনো আলোচনা চলছিল। তাকে আসতে দেখেই শ্বাশুড়ি ও ছোটপিসি থেমে গেলেন। ও আর কোনো কথা না বলে চা দিয়েই বেরিয়ে এল। কারুর পেছনে কাউকে নিয়ে অপ্রিয় কথা মানে পিএনপিসি জিনিসটা একদম অন্তরার পছন্দ নয়। এই ছোটপিসিরই আইবুড়ো বেলার কতো নিন্দে মা মুড ভালো থাকলে করেছে। অথচ সামনে দেখা হলে হলায়গলায়! ছোটপিসিও হয়তো তাইই করে! ওইজন্য কোনোদিন শ্বাশুড়ির প্রিয় বউমা হয়ে উঠতে পারলও না হয়তো। সাধারণ গৃহবধূ হয়েও মানসিকতায় অনেকখানি আলাদা অন্তরা। অদ্রীজও বলে, 'তোমায় দেখতে এতো সুন্দর, কিন্তু বুদ্ধি হাঁটুতে। সংসারে জলের মতো হতে হয়। যখন যে পাত্রে থাকবে তখন তার মতো। তবেই সুখ তবেই শান্তি। ' বুঝতে পারেনা অন্তরা বুদ্ধিমান হতে গেলে কি ভালোবাসার মানুষজনকে রোজ একটু করে ঠকাতে হয়! যারা তাকে বিশ্বাস করল, ভরসা করল নিজের স্বার্থের জন্য তাদের পেছনে ছুরি মারাই কি বুদ্ধিমানের পরিচয়!! ইনটেলিজেন্স আর ক্লেভার দুটো শব্দের অর্থ কি এক হতে পারে?
আপাত চোখে সেও সুখী। অদ্রীজের মতো নির্বিবাদী ভালোমানুষ খুব কম হয়। ভালোমানুষ? না, মেরুদণ্ডহীন মানুষ? । অদ্রীজকে দ্বিতীয় ভাগে ফেলা যায়। আজ ছাব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে অদ্রীজ জানেই না, অন্তরা কি চায়! কি পছন্দ অন্তরার! বোঝেই না অন্তরা "গৃহবধূ", "গৃহপালিত পশু" নয়।তারও স্বাধীনতা, ইচ্ছে এগুলো থাকতে পারে ! যাকে শুধু চুপ করিয়ে রাখতে পারলেই শান্তি সংসারে! দরজায় বেল বাজল। বোধহয় ঋতু এসেছে! বুঝতে পারল মনের ভারটা চোখের কোণে জমেছে। আঁচলের খুঁটে তাড়াতাড়ি মুছে নিল।
বর্ষা গিয়ে দরজা খুলল দৌড়ে। দুই বোনে খুব ভাব। ওই দুজনই এখন অন্তরার বন্ধুর মতো। কিছুদিন আগে অন্তরার বন্ধু সুকন্যা দিল্লী থেকে এসে যোগাযোগ করেছিল। ঋতুই তার অনুষ্ঠানের অজুহাত দিয়ে মাকে দেখা করিয়ে এনেছে। অদ্রীজও জানে না। জানলে নিজের থেকে বেশি মায়ের ভয়ে রাজি হতনা। অন্তরার যেন মনে হয় অদ্রীজ মায়ের ইচ্ছের মধ্যে দিয়ে নিজের ইচ্ছেটাই হয়তো পূরণ করে নেয়! ঋতু কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। হঠাৎই, 'কি গো! সব এতো চুপচাপ!! কিছু হয়েছে? ' বর্ষা পাশেই ছিল। সে তাড়াহুড়ো করে বলল, 'আর বলিস না দিভাই! কি কুক্ষণে প্যাডম্যানের ট্রেলারটা.....' কথাটা আর শেষ না করতে দিয়ে অন্তরা বলল, 'ছোটঠাম্মি এসেছে। যা গিয়ে দেখা করে নে। আর অশান্তি ভালোলাগেনা। ' ঋতু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, 'ওহ! যাচ্ছি মা! এতো নিয়ম, এতো মনে করা এসব আমারো ভালোলাগেনা। আর সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে তোমার এই সবেতে সর্বংসহা ভাবটা! এই সংসারে তোমার কাজটুকু এ্যাক্সেপ্টেবল কিন্তু তুমি এ্যাক্সেপটেবল নও! এটা কি তোমার মেয়ে হিসেবে আমারো খারাপ লাগে না! ' অন্তরা ম্লান হেসে বলল, 'তোর সংসারে তুই এ্যাক্সেপ্টেবল হবি, দেখিস? ' ঋতু আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, অন্তরা বলল 'আর কোনো কথা নয়। যা দেখা করেনে। '
ঋতু ঘরে ঢুকতেই ঠাম্মি 'দেখ কে এসেছে! কখন থেকে বসে আছে তোর সাথে দেখা না করে যাবেনা ' এটা একটা ভীষণ ভালো দিক সরমার। রাগ যতোটুকু তা অন্তরার ওপর| কিন্তু নাতনীদের কখনো সেই মতোবিরোধে টেনে আনেন না। ঋতু টুক করে একটা প্রণাম করেই বলল, 'কেমন আছ?? তুমি কিন্তু দিন দিন ইয়াং হচ্ছ মণিমা। ওইদিন তাড়াতাড়ি চলে আসবে কিন্তু! ' মণিমাও খুব খুশি হয়ে বললেন, 'আসবই তো যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব! তোর আশীর্বাদ বলে কথা!ওই তোরা যেটা বলিস এনগেজমেন্ট! ' বলেই মুচকে হেসে বললেন 'দেখ মণিমাও তোদের পাল্লায় মর্ডাণ হয়ে গেল! 'বলেই সবাই হেসে উঠলেন! ঋতু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, 'কাম্মা যেন সেদিন ছুটি নেয়। মা ফোনে বারবার করে বলেছে। ' ঠিক এই কথাটাতেই কেমন দায়সারা ভাবে উত্তর দিলেন, 'হম...আসবে। ওহ! দেখো কাণ্ড! কত্ত দেরি হয়ে গেছে কথায় কথায়! এবার আসি। '
#
আজ ঋতুর আশীর্বাদ। বাড়ি ভরতি আত্মীয়-স্বজন।ছোটপিসিও এসে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আসলে থাকতে পারেনা ছোটপিসের জন্য, হাই সুগার, ব্লাডপ্রেসার। ইনসুলিন চলে দিনে দুবার। খাওয়া দাওয়ায় হরেকরকম নিষেধ! তাই যায়না কোথাওই প্রায়। ঋতু অপেক্ষা করছে কাম্মার মানে রানু কাকিমা, ছোটপিসির ছেলের বউয়ের জন্য। ভীষণ শিক্ষিত আর আধুনিক মনের মানুষ। কিন্তু অহংকার নেই। ছেলে-মেয়ে হয়নি। কাম্মার থাইরয়েড শুরু বিয়ের পর থেকেই| পিরিয়ড ইররেগুলার। অনেক ট্রিটমেন্ট করিয়েও কিছু হয়নি। এখনকার চিকিৎসা অনেক উন্নত।এখন হলে এটা কোনো সমস্যা হয়তো হতনা। ঋতুকে খুব ভালোবাসেন। মায়ের কাছে শুনেছে, ঋতু হওয়ার সময় অন্তরা অসুস্থ ছিল, ব্রেস্টফিডিংও করাতে পারেনি ঋতুকে। সেইসময় কাম্মা সবটা করেছে ঋতুর। এখনও যেকোনো ছোটখাটো বিষয়ে কাম্মা ছাড়া চলে না ঋতুর। ঋতুর খুব ইচ্ছে কাম্মা ওকে আর নির্ঝরকে প্রথম আশীর্বাদ করুক। অন্তরাও তাইই চায়। কিন্তু বাবা বলছে ঠাকুমাই করবে প্রথম। নাহলে ভীষণ দুঃখ পাবে।
ওই তো! নীচে কারা এল! মণিমার গলা না! মা,ঠাম্মা,বাপির গলা পাচ্ছে! দৌড়ে গেল ঋতু। ওপরে সবাই উঠে আসছে। গিয়েই থমকে গেল। 'ওমা! কাম্মা কোথায়? কাকাই! আজও কলেজ গেল! 'বলল ঋতু। মণিমা খানিক মুখটা বেঁকিয়ে বলল, 'তোর আশীর্বাদ বলে কথা। কোনো ভুলচুক হতে দিতে পারি!!! বাঁজা মেয়েমানুষ, ওর মুখ দেখলে ভালো হবেনা দিদিভাই। ' অন্তরা খুব অবাক হয়ে বলল, 'মানে! কালও কথা হল রানুর সাথে, বলল নাতো কিছু! ' ততোক্ষণে ওরা ঠাম্মার ঘর পর্যন্ত উঠে এসেছে। ঘরে গিয়ে ছোটপিসেকে খাটে বসিয়ে একটু জল চাইলেন। অদ্রীজ পুরো চুপ, ভেতরের সেই ঘাড় ঝুঁকোনো ভাবটা মুখে স্পষ্ট। বর্ষা নিয়ে এল জল । ছোটপিসে একঢোঁক জল খেয়ে বললেন, 'তোমরা আধুনিক বৌমা। আমরা নই। যতোদিন বেঁচে আছি এটুকু মানিয়ে নাও। নাহলে এখনকার ওই ওল্ডেজ হোম হয়েছে দাও পাঠিয়ে। ' খুব জোর দিয়ে বলে দম নেয়ার জন্য থামতে ঋতু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, 'কিন্তু....' ঠাম্মা থামিয়ে বললেন, 'কোনো কিন্তু নয় দিদিভাই। সবটাই তোমার বা তোমাদের ইচ্ছে মতো হবেনা। ওইজন্যই জানাইনি এতোদিন। রানুকেও আজ বলে বারন করেছে।শুভ কাজে বাঁজা মেয়ে মানুষ অশুভ। এলে সবার সামনে বলতে অসুবিধা হত। এখন বলা যাবে সবাইকে ওর কলেজ আছে। '
হঠাৎ কোনোদিন অন্তরা যে স্বরে কথা বলেনা সেই জোর গলায় এনে বলল, 'কে কি ভাবল সেটা তো আসল নয় মা। রানু না এলে এ আশীর্বাদ হবেনা। আর ওই ঋতুকে প্রথম আশীর্বাদ করবে। ' ঘরে যেন আচমকা বাজ পড়ল। অদ্রীজ ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলেন, 'পাগল হলে নাকি! একটু পরেই নির্ঝররা চলে আসবে। মা, পিসিমণি যা বলছে ভুল তো নয়! ' অন্তরা ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাম্মা বলছে 'দেখ, বাবু! কি তৈরি করেছিস বৌকে! শাসন না করে করে আজ এই অপমান করতে শিখেছে গুরুজনদের!!' ঋতু পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে বলল,'মা বাচ্চা নাকি! যে বাবা শাসন করবে! ' অদ্রীজ স্বভাবের বাইরে গিয়ে রেগে উঠে বললেন, 'একটা চড়ে বড় বড় কথা থামিয়ে দেব!' অন্তরার দিকে একঝলক রাগ ছুঁড়ে বললেন, ' এই শিক্ষা দিয়েছ মেয়েকে? নিজের ঠাকুমাকে পর্যন্ত অপমান করছে! এই মেয়ে আবার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসার করবে? '
অন্তরা এতোক্ষণ চুপ ছিল। কারুর দিকে না তাকিয়েই সেই আগের স্বরে বলল, 'যা বলার বলে দিয়েছি। রানু এলেই আশীর্বাদ হবে, আর ওই প্রথম আশীর্বাদ করবে। ঋতুর জন্মের সময় আমার বাঁচার কথা ছিল না। তাহলে হয়তো আজ রানুই ওকে পুরোপুরি বড় করত। একবছর বয়সে ঋতুর লিভারে পক্স হল। বাঁচার কথা ছিল না। আমিও তখন পুরো সুস্থ্য হইনি। রানু!দিনরাত এক করে ওকে সুস্থ্য করেছিল। ' ঘরে তখন পিন ফেলার নিস্তব্ধতা! একনাগাড়ে অন্তরা বলে যাচ্ছে, 'আর বাচ্চা হয়নি তাই শুভ কাজে আসবে না। বাচ্চা না হওয়াটা কি ওর অপরাধ! ওর চেয়ে শুভ বোধহয় রানুর জীবনে আমরা কেউই নই। যে নিয়মে শুধু সংস্কারের বেড়াজাল থাকে, আর অকৃতজ্ঞ হতে হয়, তা উঠে যাওয়াই ভালো। ' সবার মাথা নীচু! ঋতু অবাক হয়ে দেখছে মা-কে, সবকিছু মেনে ও মানিয়ে নেয়া সেইই মা! সরমা আবেগহীন গলায় বললেন, 'রানুকে ফোন করে আসতে বলো। '
অন্তরা ঘর থেকে উঠে বোধহয় রানুকে ফোন করতে গেল। আজ যেন নিজের কাছে নিজের মাথা উঁচু লাগছে। কতোদিন নিজের কাছে ছোট হয়ে কারুর স্ত্রী বা ছেলের বউ হয়ে বাঁচা যায়! ঘরে এসে ফোনটা তুলতে যাবে ঋতু আর বর্ষা এসে জড়িয়ে ধরল আনন্দে...।

কবিতা

ও যে মানেনা মানা
আঁখি ফিরাইলে বলে, না-না-না…
.অপাংক্তেয়
.
দুরূহ অঙ্কের মতোই প্রেম-প্রেম খেলা। সিঁড়ি ভাঙে। কখনো উপরে নিয়ে যায়। কখনো নিচে। সমান্তরাল শরীর ঘেঁষে হা-হা ভাঙচুর। ভাঙাচোরা গাছের নীচে জমে উঠেছে আমাদের শোকসভা। শিকড়ে ঠিকানা লেখা থাক। ধুলো আর ঘাসে ছায়ালীন ভুল ব‍্যবধান
আলোটিকে ‘অমলকান্তি’ ভেবে হাতের তালুতে বা মরে যাওয়া তারাদের নীচে। লুকিয়ে ফেলেছিলাম। অনুরোধে সবুজ ঘ্রাণ। গাছেরা শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। আকাশ থেকেও নেমে এসেছিল দু-একটা তারা
এখন বেশ শীত। রোদ ওঠেনি আজ। আবছা কুয়াশা। পাখিরা উঠেছিল। ফোনটা এসেছিল ঠিক তখনই। ’উঠে পড়ো’। নীলরঙা দৃশ‍্যে হেঁটে গেছি যতটুকু। দূরত্ব বেড়েছে নক্ষত্রের। তুমি আলো আঁকো বা কালো। ধূসরতা আমাদের জন্মকালীন ভুল
দেহ ছিঁড়ে খাবে। এমন দস্যু কই ?
চুম্বন ? তাকে স্থাপত্য বলেই চিনি
এভাবেই তোমার মগ্নতায় আঙুল ছুঁয়ে যায়। রোদে গান জাগে বা বেলাশেষের মেঘে শরণার্থী দুটি হাত…….

কেমন আছো
বিশ্বজিৎ মাইতি

তুমি কেমন আছো
জানতে আজকাল ভয় হয় আমার,
সচেতন ভাবে তাই বারবার এড়িয়ে যাই কুশল বিনিময়ের প্রসঙ্গ।
ছেলেবেলার মতো তুমি যদি আবার বায়না ধরে বসো
আস্ত একটা নদী-
নদীর গা ঘেঁষে থাকা আঁকাবাঁকা মেঠোপথ,
কোঁচড় ভর্তি শুকনো মুড়ি,
আঁচলা ভরে খাওয়া জলের স্বাদ;
কিম্বা শিমপাতা বেটে লেখা সেই
বর্ণপরিচয়ের দিনগুলি
বকুলের ঘষা বাঁশির সুর-
কি করবো তখন?
ঘড়ির শব্দে যদি আজ ঘুম না আসে,
অবজ্ঞা করে ফেলে দাও
বালিশের পাশে রাখা জল ওষুধ,
তারাদের আলোয় প্রাচীন নদীটিকে খুঁজি চল সারারাত,
আমিও হাঁটবো তোমার পায়েপায়ে
পেরিয়ে যাব দুজনে উজানতলির মাঠ,
যত অলৌকিক বনবাদাড়-
তুমি কেমন আছো
জানতে আজকাল ভয় হয় আমার,
পাছে যদি সত্যি বলে দাও।




আমার_মা
সৌরভ বটব্যাল

আমার মা ও মিথ্যে কথাই বলতো!
ছোট্ট বেলায় পুকুরপাড়ে
দুপুর রোদে বনবাদাড়ে,
খেলার শেষে ফিরলে বাড়ি কষেই কান মোলতো।
আমার মা ও মিথ্যে কথাই বলতো।

আমার মা ও মিথ্যে বলতে জানতো!
মধ্যবিত্ত মাসকাবারি
চায়েই ফুরোয় দুধের হাড়ি,
আমার পাতে দুধ জোগাতে মায়ের থালায় পান্ত।
আমার মা ও মিথ্যে বলতে জানতো।

আমার মা ও মিথ্যে ভালোবাসতো!
নইলে কি আর বছরভরে
কাটিয়ে দিয়ে এক কাপড়ে,
আমায় নতুন জামা দিয়ে ভূবনভরিয়ে হাসতো!
আমার মা ও মিথ্যে ভালোবাসতো।

আমার মা'র ও মিথ্যে ভালো লাগতো!
পড়তে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি
মায়ের তখন ক্লান্ত শরীর,
তবুও আমায় চা যোগাতে রাত দুটোতেও জাগতো।
আমার মা'র ও মিথ্যে ভালো লাগতো।

আমার মা ও মিথ্যে জমিয়ে রাখতো!
যখন আমি অনেক দুরে
হায়ার স্টাডিজ, ফুল শহুরে,
রোজই আমার অপেক্ষাতে সোয়েটারে ফুল আঁকতো!
আমার মা ও মিথ্যে জমিয়ে রাখতো।

মা তো কেবল মিথ্যে বলতে থাকে!
জীবন এগোয় লড়াই বাড়ে,
তবুও আমায় একনাগাড়ে
ভরসা দিয়ে, নিজের বুকের কান্না চেপে রাখে।
মা তো আজও মিথ্যে বলতে থাকে।

 একটি কবিতা
 পিনাকী দত্তগুপ্ত

নোলকের গায়ে লেগে অন্ধকার সোহাগি কাঞ্চন... 
এখনও কুয়াশা লেগে আছে তার কৃষ্ণচুড়ায়... 
কিছুটা অস্পষ্ট তবু ক্রমে ক্রমে শিথিল গ্রীবায়... 
অবিন্যস্ত কিছু আঙুলের ছাপ, 
কিছু প্রেম, কিছু ঘৃণা, পাপ - অনুতাপ... 
এখনও অরণ্যের সুগভীর অন্তরাল খুঁজে নিয়ে 
নপুংসক চিতা ওত পেতে আছে, 
তিস্তার বুকে লেগে আছে তার থাবার আঁচড়।

 অমর ২১শে 
 কেকা সেন

 সূর্যের ঠোঁট ছোঁয়া লালিমা, যেমন
সবুজ শরীরকে স্পর্শ করে ছড়ায় মিঠে আবেশ 
সদ্য ঘুম ভাঙা পাখীর আধো বোল যেভাবে
আলোর স্নানে পার হয়ে যায় দিগন্তের সাদা ঢেউ 
কাজল কালো দীঘির গভীর বুক, 
যেখানে বাজে হেঁটে যাওয়া জলছবির ছলাত বন্দিস 
মাটির দাওয়া জুড়ে পাক খায় 
টগবগে মাতনে ফেনিল আমনের মৃদু বাস 
কলের ধোঁয়ায় জীর্ণ প্রেম ছোটে রূপোলী নদীর বাঁকে  
তখনি  তুমি মিঠে আবেশে, সাদা ঢেউ-এর ছলাত বন্দিসে 
কিংবা আমনের মৃদু বাসে,
চাঁদের  আঁচল হয়ে ভেসে যাও নক্সী কাঁথার মাঠে, 
কলমের অনুভবে কথাগুলো লিপি হয়ে যায় , 
ইতিহাসে রয়ে যায় স্মৃতির লাল দাগ--- " অমর ২১শে "

 আ মরি,বাংলা ভাষা
প্রত্যূষ কর্মকার

 ভাষার প্রেমে আজ প্রসেশন মুখ্য 
পতাকা মশাল তুলে পাবে কিছু সুখও 
কে বা কারা মরেছিল বরাকে বা ঢাকাতে 
জানতে লাগেনা সেটা মিছিলে পা মেলাতে 
যে মাটিতে রক্তের ছাপ দেয় সাক্ষ্য 
অ আ ক খ ব্রাত্যই,টি আর পি লক্ষ্য 
মাইকে শ্লোগান ভাসে-ভাষাকে বাঁচাও 
চোখ দুটো ফেটে আসে,বুকের খাঁচাও 
ভেজা চোখে সুখী সুখী,বাহ দেয় অনেকে 
বাংলাটা ঝুলে থাকে মঞ্চের মাইকে 
স্যুটেড আমার ছেলে,ইংলিশে গড়গড় 
তোরা শোন বক্তৃতা,বাংলায় তোরা মর 
নেহাত বন্ধ্যা নও তুমি হে জননী 
দিয়েছো অনেক কিছু,সবটা দ্যাখো নি 
রফিক আবুল আর আব্দুল জব্বার 
বলে গেছে দৃঢ় হও,দিন নয় কাঁপবার 
তোমার গর্ভে ফলা এমন রতন 
চাইছি আবার কিছু এদেরই মতন, 
অ্যাকাডেমি নন্দনে অযথাই হেঁটো না 
মগজে সহজপাঠ রাখো,বিদ্রূপ  না 
ঠিকানা আমার দেখো বাংলা দিয়েছে 
বাংলা আমার ভাষা-জন্ম বলেছে।


শপথ 
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার   

ভাষার জন্য আকাশ শিমূল 
ভাষায় জীবন গড়তে পারি
বাংলা মায়ের রক্তে লেখা
অমর একুশ ফেব্রুয়ারি 

জব্বার আর শফিক রফিক 
বরকত আর সালাম জানে
মায়ের ভাষা মায়ের আঁচল
তোমার আমার বাঁচার মানে

বাংলা আমার ভালবাসায়
বাংলা আমার আর্তনাদে
বুকের গোপন স্বপ্ন চেনার
আখর শিখি বাংলা ছাঁদে

রক্তফুলের পাপড়ি আঁকা 
শহীদ তোমার কলজে জুড়ে
তোমার জন্য দেশ বিদেশে
ভাষার জয়ের নিশান ওড়ে

আজকে শপথ তোমার নামে
মায়ের জন্য লড়াই জারি
বাংলা আমার কণ্ঠ কলম
মায়ের জন্য মরতে পারি।