Wednesday, 23 June 2021

রাজদীপ ভট্টাচার্য/ ব্যক্তিগত গদ্য/মাছ ধরা

  





মাছ ধরা   



হুইল ছিপে মাছ ধরা বাঙালির সুবর্ণযুগ দীর্ঘকাল আগেই গত হয়েছে। বাড়িতে বাবাকে দেখতাম একসময়। ছুটির দিন মানেই হয় অমুকের বড় শালা, নয় তমুকের মামাশ্বশুরের পুকুরে দলবেঁধে মাছ ধরতে যেত। যাওয়ার সময় কত উৎসাহ, তোড়জোড়। আর ফেরার পরে মায়ের মুখে অমোঘ প্রশ্ন, "কিনে আনলে?" সকালের সেই উদ্দীপনা ততক্ষণে বাবার মুখ থেকে উধাও!


সেইসময় বাবা মামারবাড়ি যাওয়া মানেই মাছধরার বিরাট আয়োজন। হাড়িয়ার পচা ভাত, পাঁউরুটি, চারের মশলা ইত্যাদি যোগাড় হয়ে যেত অবিলম্বে। বাগানে খুঁজে খুঁজে জামরুল গাছের মগডালে ঝুপসি পাতার ভিতর থেকে পেড়ে আনা হত পিঁপড়ের ডিম। আড়ালে পরখ করে দেখেছি অবশ্য সেই পচা ভাতের মতোই সাদা সাদা ডিমও বেজায় টক। তাই আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল মাছেরা টক স্বাদ বোধহয় পছন্দ করে। যাইহোক দুপুরে খাওয়ার পাট সেরে তিন-চারটে হুইল পাতা হল পুকুরে। আমার কাজ যোগানদারের। জল আনা, পান আনা, এইসব। 


আয়োজনের শুরুতেই পুকুর ঘাটে কাঁকড়া ধরে এই মার খাই কী ওই মার খাই! প্রথমে কাঁকড়া দর্শন নাকি চরম অশুভ। এদিকে সময় বয়ে যায়, মাছ আর টোপ গেলে না। সবাই মিলে আমাকেই কালপ্রিট সাব্যস্ত করে বসল। অবশেষে কেজি দেড়েকের রুই মাছ ধরা পড়ল ঘন্টাখানেক বাদে। দু'হাত দিয়ে কানকোর কাছে জাপটে ধরে পুকুরপাড় দিয়ে নিয়ে আসার সময় সেই মাছ যে আমাকে নতুন করে বিড়ম্বনায় ফেলবে তা আগে বুঝিনি। যখন মালুম হল ততক্ষণে সেই পিছল রুই ঝটকা মেরে হাত ফসকে জলের গভীরে ভাগলবা। এরপরে আমার কর্ণযুগলের মর্মবেদনার কথা আর সর্বজনসমক্ষে না বলাই শ্রেয়। 


যাইহোক, সে সময় গ্রীষ্মের ছুটি মানে সব মাসতুতো ভাই বোনেদের জমায়েত মামারবাড়িতে।  গাছ থেকে আম-কাঁঠাল-নারকেল পাড়ানো হত। পুকুরে জাল দেওয়া হত। এই জালে মাছ ধরা দেখা আর এক আনন্দের স্মৃতি। মেজমামা আগের দিন জেলেদের সাথে কথা ফাইনাল করে এসেছে। তাই ভোর না হতেই তাদের আগমন। জলের উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে চালের কুঁড়ো, সাথে বোধহয় আরও কিছু। এতে জলে অক্সিজেনের পরিমান দ্রুত কমে আসে। ফলে একটু পরেই উপরে ভেসে উঠতে থাকে মাছ। পাড়ের কাছে এসে খাবি খায়, ছটফট করে। এবার জালটানার কাজ শুরু। গলা অবধি ডুবে চারদিক থেকে জেলেরা জাল গুটিয়ে আনে ক্রমশ। মাঝখানে আটকে পড়া মাছেদের ছটফটানি চোখে পড়ে।


জেলেরা পুকুর ছাড়তেই আমাদের অপারেশন শুরু হয়। আনাচে কানাচে ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঠিক কিছু খাবি খাওয়া মাছ রয়েই যায়। খুঁজে পেতে সেগুলো ধরার মাঝেই তখন আমাদের চরম আনন্দ। জীবনের পরম সার্থকতা।  


এদিকে জেলেরা ততক্ষণে সব মাছ এনে ফেলেছে উঠোনে। ভাগাভাগি শেষে যা থাকে তাও যথেষ্টর চেয়ে অধিক। কিছু জ্যান্ত মাছ বড় গামলায় জলে জিইয়ে রাখা হয়। সেসময় ফ্রিজ নেই কোথাও। ফলে তেলে ভেজে দিন দুয়েক রাখা যায়। আর এরমধ্যে গুষ্টিশুদ্ধু গান্ডেপিন্ডে অবিরাম মাছভাজা খাওয়া চলতে থাকে।


মাঝে মাঝে গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে ছোটো হাতছিপ নিয়ে কেঁচো কিংবা ময়দার ডেলা বঁড়শিতে গেঁথে সেই বিরাট পুকুরের ঘাটে আঘাটায় অনুশীলন চালাতাম। প্রায়ই ফাৎনা নড়ে উঠত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টোপ খেয়ে বঁড়শিকে কলা দেখিয়ে কেটে পড়ত মাছ। আবার ট্যাংরা, পুঁটি কিংবা চারাপোনা ধরাও পড়ত অনেক সময়। তবে মাছ উঠলে এক দৌড়ে পুকুর ছাড়িয়ে বাগান পেরিয়ে চলে যেতাম বাড়ির ভিতরে। কারণ বিশেষ করে কাঁটাওলা মাছ বঁড়শি থেকে ছাড়ানোর সাহস তখনও রপ্ত করিনি। 


সেইসব নিরালা দুপুরে বাগানের বুকে থমকে থাকত জমাট ছায়া। কোনো ঝাঁকড়া গাছের পাতার আড়ালে বসে ক্রমাগত ডেকে চলত বসন্তবৌরী পাখি। কালো দাঁড়াস সাপ সামান্য খসখসে আওয়াজ তুলে পেরিয়ে যেত পায়ে চলা পথ। একটা জাম গাছ ঝড়ে হেলে পড়েছিল  পুকুরের জলে। শীতের দিনে নিস্তরঙ্গ দ্বিপ্রহরে জাম গাছের জল ছুঁয়ে ফেলা কাণ্ডের উপর রোদ পোয়াতো কয়েকটা গোঁয়াড়গেল আর শ্যাওলা রঙের কচ্ছপ। আমি দূর থেকে চুপিচুপি দেখতাম। আমার শৈশবের উপর শীতের শেষ বেলার অপার্থিব রোদ্দুর চুঁইয়ে পড়ত ফোঁটা ফোঁটা।


অলংকরণ - স্বরূপ দাস 

Sunday, 6 June 2021

শর্বরী চৌধুরীর কবিতা

 





জীবন 


                      


মৃত্যুর সম্মোহন উপেক্ষা করাই জীবন। 
স্টেশনের প্রান্তে এসে মনে পড়ে প্রথম
চুম্বন। একাকী গলিতে দাঁড়িয়ে যে মেয়েটি 
হাতছানি দেয়, তারও আছে প্রথম আদরের
স্মৃতি ! পঙ্কিল জীবন তাকে স্পর্ধিত করে ;
সেও বাঁচে নতুন সকালের আশায়।