Sunday, 1 April 2018

সাহিত্য এখন,মার্চ-এপ্রিল সংখ্যা,২০১৮







 সম্পাদকীয় 
পলাশের মনখারাপ,শিমূলের মুখ ভার। বসন্তের যাবার সময় হয়ে এল।যাবার আগে সে উজাড় করে দিয়ে যাবে সম্বৎসরের ভালোবাসার রঙিন সিন্দুকখানা। প্রকৃতি কার্পণ্য শেখেনি। কার্পণ্য শুধু আমাদের অন্তরে। আমরাই মনের ভিতর কাঁটাতার দিয়ে রাখি, হারিয়ে ফেলি ভালোথাকার মূল্যবান চাবিকাঠি।
এই যে এত তোমার আমার বলে দড়ি টানাটানি, এত ঘর গুছিয়ে রাখার ধূম... এর কতটুকু সাথে যাবে? কী দিয়ে যাব আমরা পরের প্রজন্মকে? আমরা অভিভাবক, আমরাই ভাল বুঝি- এই বলে আর জাঁক করতে পারব কি? খবরের কাগজ খুললে, টিভির চ্যানেল খুললে বারবার ছোটদের সামনে মাথা নত হয়ে আসে কেন? কেন ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না?
এবার ভাবার সময় এসেছে বললে আসলে খুব ভুল হবে। ভাবার সময় এসেছিল অনেকদিন আগেই। আমরা ভাবিনি। অথবা ভেবেও করিনি কিছুই। নিজেদের গণ্ডীর মধ্যেই কেটেকুটে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি আমাদের ভাবনার শাখাপ্রশাখা। আমাদের কবিতায়,গল্পে, প্রবন্ধে সাময়িক ভাবে উঠে এসেছে এসব প্রসঙ্গ।ঘৃণার শিকড় খুঁজে তাতে লাগাতার আঘাত করার শক্তি অর্জন করতে পারিনি।
নতুন বছর আগত প্রায়। নতুন করে শপথ নেবার দিন আসছে। সর্বশক্তি দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে আমাদের এই ঘর, এই উঠোন। সাহিত্য এখনের পাতায় তারই স্পন্দন শোনা যাচ্ছে। বন্ধু,শুনবেন কি?
                                         শ্যামশ্রী রায় কর্মকার




মনের কথা (৭)
আরো কত প্রজন্ম?
মৈত্রেয়ী সরকার

আমার ঠাকুরদাদা যশোহরের নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ের মানুষ ছিলেন।নোয়াখালি দাঙ্গার সময় ভিটেমাটি দেশ ছাড়েন।আমার মা সাতক্ষিরার মেয়ে,একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে লিগ আমলীগের হত্যা দেখেছে,যুদ্ধের তান্ডবে এগারো বছর বয়সি মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো কিছুকাল।তারা লীগের হুমকি খেয়ে তিন দিন তিন রাত নৌকায় চেপে প্রাণ নিয়ে ইন্ডিয়ার ক্যাম্পে চলে এসেছিলো।তারপর ফিরেও গেছিলো স্বাধীন দেশে।কিন্তু সত্যিই কি ওই হিন্দু পরিবার স্বাধীনতা পেয়েছিলো? দাদুর বিবাহযোগ্য পাচ মেয়ে মা বাবা বাড়ি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় আত্মীয়ের বাড়িতে বাড়িতে থেকেছে, কি নিদারুণ ভয় ছিলো তাদের চোখে লুঠ হয়ে যাওয়ার।আমি ছেলেবেলায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় দেখেছি মায়ের চোখে কি নিদারুণ ভয়।বাংলাদেশে মা ভাইরা বেচেঁ থাকতে পারবে তো?  আমার ক্লাসের সাবিনা ইয়াসমিনের চোখে ভয় দেখেছি সেই বারবির সময়।তাদের নাকি ভারতবর্ষে থাকতে ভয় করে,বিশেষ এক সরকার ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এলেই তাদের ভয় বাড়ে।গুজরাটের দাঙ্গার সময় আমাদের এক দূর সম্পর্কের দাদা নিখোঁজ হয় লেবার শ্রেনীর কাজ করতে গিয়ে।তার মা আজো অপেক্ষায় বসে থাকে তার ছেলে ফিরে আসবে এই আশায়।আমার এক ছাত্র সাইফুল একবার আমার আর এক ছাত্র পলাশদের বাড়ি আমার সাথেই লক্ষ্মী পুজোর প্রসাদ খেতে গিয়েছিলো। পলাশের দাদুর সাথে আলাপচারীতায় সাইফুল তার নানার পরিচয় দিতেই জানতে পেরেছিলো ওই বিরাট বিরাট পুকুর বিঘা বিঘা সম্পত্তি একসময় তাদের ছিলো,দাঙ্গার সময়,মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়ার সময় প্রাণ
ভয়ে তারা সব ছেড়ে হিজলির মতো শ্মশান ভাগাড়ে গিয়ে তখন সবাই আস্তানা গড়েছিল।সাইফুলদের মুখে মুখে এখনো সেই যন্ত্রনার কথা ঘুরে বেড়ায়।
আমার ঠাকুরদাদা নোয়াখালি দেখেছে,মা মাসিরা একাত্তর দেখেছে,আমি সেই শিশুকালে বাবরি দেখেছি, গুজরাট দেখেছি,এখন বাদুড়িয়া দেখছি,দত্তপুকুর দেখছি,রানীগঞ্জ দেখছি।জানি না আমার পরের প্রজন্ম  আরো কি কি দেখবে! হে ভগবান! ওরা বোধহয় এই দেখাগুলো নিয়েই   ওদের মতো করে দেশকে চিনবে,যেখানে রাম রহিম নিয়ে যুদ্ধদিন খবরে রোজনামচায় থাকবে।আর কতদিন এই অভিশাপ বুকে নিয়ে বেড়াবো আমরা? আরো কতো প্রজন্ম?




মনের কথা(৮)
হ্যাপি ডে
পারমিতা মালী

       এবার শুরু করছি । ধরুন যারা কাগজপত্রে লেখালেখি করেন, মানে লেখাটা যাদের বাধ্যতামূলক কাজ বা পেশা, তাঁরা সবাই কিন্ত বাধ্যতামূলক  ভাবুকও। শুধু তারাই নয়, আমরাও, যারা কি বোর্ড এর সামনে বসতে পারি অন্তত , আমরাও অল্পবিস্তর ভাবি। আমরা সবাই স্তরে স্তরে
 বিস্তর ভাবনা চিন্তা করি। সাপ, ব্যাঙ, কড়া ও শর্করাধর্মী, স্নেহরস ও পিত্তরসধর্মী  বিচিত্র সব আইডিয়া ঠিক সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ছুটে ছুটে আসে,আর ভেঙে পড়ে আমাদের মগজে। তা এইসব করতে গিয়ে আমাদের প্রচুর মানসিক পরিশ্রম হয়, তাই আমাদের মাথা টাথা ধরে। আমরা ঘন ঘন চা খাই, সিগারেটে টান দিই, এস্পিরিন খাই, প্যারাসিটামল গিলি । কেউ কেউ আবার এইসান টেনশন খায়, যে খাবার টাবার খেতেই ভুলে যায়। তারপর সেইসব ভাবনা টাবনা জমলে আমরা লিখতে বসি। সাপ, ব্যাঙ, হাতি, ঘোড়া যাহোক কিছু একটা লেখা দাঁড়ায়। এবার সেইসব ভাবনাতেও টান পড়ে একসময়। তাই নিত্যনতুন ভাবনার সন্ধানে মনের মধ্যে মৃগয়া করতে হয়। হাতে তীরধনুক নিয়ে বন জঙ্গল,পাহাড়, পর্বত হাতড়ে বেড়াতে হয়,তারপর যা দু চারটে আইডিয়া বেরোয়! সুতরাং, এই পুরো ব্যাপারটা কিন্ত খুব শ্রমসাধ্য প্রজেক্ট,এই আর কি!

              এখন ব্যাপার হচ্ছে, যা কিছু চর্চাই চলুক না কেন,তা যদি অনর্গল চলে, তাহলে তো ভাঁড়ারে টান পড়বেই! চব্বিশ ঘন্টা ধরে যদি সাতশো খানা চ্যানেল চলে,অনলাইন দুনিয়ায় অনন্ত পোষ্ট পড়তেই থাকে  দিবারাত্র তাহলে চিন্তাধারায় তো কমতি পড়বেই। রোজকার থোরবড়িখাড়ার মধ্যে এত খবর আসবেই বা কোত্থেকে! এত কি এমন ঘটে চারপাশে যে রাবণের চিতা জ্বলতেই থাকবে? কোত্থেকে জুটবে এত জ্বালানি!...সুতরাং একটাই সলিউশন। খবর যদি ফুরিয়েই যায়, নিজেকেই জ্বালাও! অন্তত কিছু একটা দিয়ে আগুনটা জ্বালাও!

         মাথাটা কেন গরম হলো তা বলি। আজ নাকি হ্যাপি ডে ! বাপের জন্মে শুনিনি হ্যাপি ডে বলে কোনো ডে থাকতে পারে ! হ্যাপির ও আবার ডে রাখতে হবে! এত হ্যাপি আসে কোত্থেকে !

               আরে বাবা এন্টারটেইনমেন্ট এর ও তো একটা লিমিট আছে রে বাবা ! আর এতো বুদ্ধিহীন এন্টারটেইনমেন্ট দেখবই বা কেন !  পড়াশোনার ঝামেলা নেই, বুদ্ধিবিবেচনার দরকার নেই, দিবারাত্র মাড়ি বের করে পাগলের মতো হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ো! তবেই নাকি তুমি খুব হ্যাপি! কোনো মানে হয় এসব ছেলেমানুষির!

           ছোটবেলায় সিনেমা দেখে ভাবতাম, হিরোইনদের চুলে বুঝি জট পরে না, গায়ে ঘামের গন্ধ হয় না। বিজ্ঞাপনের সংসারে ময়লার লেশমাত্র নেই। চাদর টাদর সব টানটান করে পাতা থাকে। দুঃখকষ্ট সেখানে ঢোকেই না। ঝকঝকে জামাকাপড়, ফটফটে দাঁত, আর ফুরফুরে চুল নিয়ে তারা খালি হেসেই যায়,হেসেই যায়। কারণে অকারণে এ ওর গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে! বড় হয়ে তো সবাই বুঝেছি, এতো হাসির কোনো কারণ নেই। এতো ফুর্তির দুনিয়ায় কেউ বাস করে না। সক্কলকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে, রক্তাক্ত হয়ে হয়ে,তবে এগোতে হয়।  আচ্ছা, তারা নাহয় হাসার জন্য পয়সা পায়, কিন্তু গোটা আন্তর্জাল জুড়ে কেন এত অকারণের হাসাহাসি! কেন এমন ক্লাউন সাজা? পরীক্ষায় ফেল মেরেছ?.হেসে গড়িয়ে যাও। বউ ভেগেছে?.সে তো আরো হাসির ব্যাপার!  প্রেমিক ডিচ করেছে?.. নো প্রবলেম, ডিজে ভাড়া করে, একটা ব্রেকআপ পার্টি দিয়ে দাও! তারপর ধেই ধেই করে নেচে তুমি প্রমাণ করো যে, তোমার কোনো কষ্টই হয়নি। তোমার হাসি আর ধরছে না মুখে। এ কি অর্থহীন হাসি রে বাবা!

        সব্বাই বিজ্ঞাপন সেজে বসে আছে ! কেন?.. কে পয়সা দেবে আমাদের?.কি এতো দায় অনন্ত ভালো থাকার বিজ্ঞাপনের?..এই ভালো থাকাথাকির বাধ্যতা তো বড্ড হাঙ্গামার ব্যাপার মশাই !

        আসলে আমরা কেউ তেমন অসাধারণ কিছু ভালো নেই। সব্বাই হরেদরে একই রকম আছি। বছরের তিনশো দিনই দুর্ভোগ, দুশ্চিন্তা, অপমান নিয়েই কাটাই সকলে। সকলের সেই একই কাহিনী।  কি ভাবছেন?. বাকিরা সব তুমুলভাবে বেঁচে আছে, আর হাসির হররা ছুটিয়ে দিচ্ছে?....
  ধুর্.....সব গুল। অত হেসে কাজ নেই। চলুন,বরং জুকুদাকে সবাই মিলে একটা কবিতা গিফট করি....

   "  না আছে তার মুন্ডু মাথা
   না আছে তার মানে,
   তবুও তোমায় হাসতে হবে
    তাকিয়ে বুড়োর পানে!!! "


 কবিতা

পৃথিবীটা কোনোদিন
কান্তিময় ভট্টাচার্য

পৃথিবীটা সোজা হোতে পারলো না
আর মানুষগুলো বেঁকে-চুরে জানোয়ার হোয়ে গ্যালো

কেউ হাত ঢুকিয়ে দিলো সৈনিকের জোব্বায়
কেউ নুলো হাতে আঁকড়ে ধরলো চেয়ার

বারবার বুকের মধ্যে ভর্তি কোরতে থাকলো
সোনা, ফ্ল্যাট, গাড়ি আর অবৈধ যাপন

পৃথিবীটা কোনোদিন কমলালেবুর মতো ছিলো
এখন মানুষের ফুঁয়ে সেটা তেরছা-লম্বা-ডিম্বাকৃতি

ধরে নিন ফুঁয়ে বিষ, ফুঁয়ে লোভ, ফুঁয়ে ধর্ষণ, দেদার
                                             মিথ্যাচার
দেদার ফাটল, ফুঁয়ে ফুঁয়ে বিষোদ্গার-ভাষণ

লালসার বাজারে বিকিকিনি হোচ্ছে বিষাক্ত চুম্বন
আলিঙ্গনের ছিদ্রপথে ঢুকে যাচ্ছে লুন্ঠনের ব্যভিচার

আর আমরা আঁকড়ে ধরছি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
লুঠতরাজের সিংহাসন, বিভীষিকা-অন্ধকার,
                                       অট্টালিকা-জংগল

পৃথিবীটা ক্রমশঃ জংগল আর মৃত জলাশয়
                                         হোয়ে যাচ্ছে যে



অপরজন্ম-6
জাতবেদা মিশ্র

আদিগন্ত সর্ষে ক্ষেতের ভিতর হলুদ আলো
নাকফুল ছোটবেলা হারিয়ে গেছে
আলু ক্ষেত জুড়ে ব্যস্ততা ফসল তোলার
মাটি খুঁড়লে বেশ কিছু পাওয়া যাবে অবশেষে
পাকা দালানে রঙ বেরঙের গরম রোদ খায়
খোঁটা উপড়ানো গরু আচমকা জমিতে
হেই হেই হ্যাট হ্যাট অবুঝ অবলা জীব।
বাতাস খুশি বিলোয় ধানসেদ্ধর মিষ্টি গন্ধে
কেমন দুধ উথলানো গন্ধের মতো লাগে
নাক উঁচু করে শুঁকলেই মুখ ভর্তি কাঁচা জল
বড় খিদে আর জাড় লাগে, মাগো
ঘরে ঘরে নবান্ন করছে কারা!
তারপর, চরাচর জুড়ে নামে শীত
টায়ার পোড়া গন্ধে এখন বাতাস ভারি
কোঁচড়ে কুড়নো আলু আগুন খোঁজে
কচি ধান দাঁতে চিপলে দুধের স্বাদ জাগে জিভে
কবে আবার ধান রুইবে?
শীত কবে শেষ হবে? মাগো!

তালা ও চাবি
রুদ্রশংকর

ছোটবেলায় তালা ও চাবির সঙ্গে
আমার তোলপাড় সম্পর্কের কথা কাউকে বলিনি
এমনকি রূপকথাকেও নয়
রূপকথা এও জানতোনা জীবনে অঙ্ক মেলানোর থেকে
মধুসাহিত্যে আমার বেশী আকর্ষণ ছিল
তাই অঙ্কের মাস্টারমশাইরা এখনো
আমার ফোকলা অস্তিত্বের কাছে ফিসফাস করে

অনেক পরে যখন পথিক রায়ের সঙ্গে পরিচয় হল
আমার শোয়ার ঘরে তখন জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকার
অরুনিমার চলে যাওয়া
তলাপাত্র দিদিমনির বস্তুরূপ
শল্যচিকিৎসকের মতো আতঙ্কের ছুরি কাঁচি নিয়ে
টুকরো টুকরো করত মুখ-থোবড়ানো ভবিষ্যৎ

ধীরে ধীরে সবুজ ইজ্জতের জন্য হাঁটতে শিখলাম
যেখানে আমার মাত্রাহীন মৌনতার শক্তি ছিল
ঠিক সেখানেই ঘর্ষণে ও সংঘর্ষে এখন বুঝতে পারি
এক নির্জন তালার জন্য মসৃণ চাবির প্রয়োজন হয়।

মৃতের নগরী
জলিল সরকার

আমার পরিপার্শ্বে ভয়াবহ এক মৃতে নগরী পড়ে আছে
আমি বেঁচে আছি এক মহাসিন্ধু ধ্বংসস্তুপ বুকে নিয়ে,
শ্রাবণের বৃষ্টিতে থামেনা পোড়া অনল,
বাতাসের কাছে, বৃষ্টির কাছে, ঝর্ণার প্রবল বর্ষণের কাছে মুক্তি নেই আমার,
আমায় পুড়তেই হবে আকাশের নীলাদ্রি নীলে,
মনু কাকা একদিন বলেছিলেন,
পোড়া মানুষের কপাল এমনিতেই পোড়া হয়
সেদিন বুঝেনি আজ বুঝেছি সত্যি বলেছিলেন মনু কাকা
আমি আর সইতে পারছিনা এ পোড়া চাঁদের আলো,
দমবন্ধ হয়ে আসে আমার,
কোথাও কেউ নেই!
শুন্যতার ভিতর ডুবে গেছি আমি,
আমার ভেতর পোড়া লাশের গন্ধ নাড়িভূঁড়ি শুদ্ধ জ্বালিয়ে পুড়ি খাক করে দেয় সমস্ত অনুভুতির ডাল-পালা,

আমি বয়ে নিয়ে যেতে পারছিনা জগদ্দল পাথরে মোড়া মৃতের কফিন,
নগরীর চারপাশজুড়ে মৃত মানুষের দল,
জিঘাংসার অনলে পোড়ায় সাহারা মরুভূমি,
তবুও নক্ষত্রের ভিতর রক্তাক্ত শব বয়ে বেড়ায় রাতের আঁধার,
কেবলই যেদিকে তাকাই জীবনের কালোমেঘ তুলোর মতো ধেয়ে আসে শ্রাবণের বৃষ্টির ভেতর,
তবু, রাতের আঁধার গ্রাস করে রাতের মতো,
আর, আমি মৃতের নগরীতে পড়ে আছি হাজার বর্গমাইল জুড়ে
এখন আর কেউ চেনেনা আমায় আগের মতো।

 চলো আমরা আকাশ হয়ে যাই
আক্তারুজ্জামান-মিন্টো


নীল খামে ধুপ জ্বেলে
ফেরারি প্রাণের লীন হাওয়ায়
বৈকাল হ্রদের উপর দিয়ে
চলো আমরা আকাশ হয়ে যাই।

নিমগ্ন ফল্গুর বারতায় চমকিত বৃষ্টি রচনায়
কাননে কাননে পুষ্পরঞ্জিত গালিচায়
টলমল নদীর তরঙ্গায়িত জলে শূন্য ডানায়
চলো আমরা আকাশ হয়ে যাই।

আকাশ হওয়া সোজা ভীষণ সোজা
বাষ্পকণা তরল করে গাঙচিলের ঠিকানায়
দু'ঠোটে সাদা মেঘ উড়িয়ে
চলো আমরা আকাশ হয়ে যাই।



দৃশ্যমান..
ভাস্কর পাল

দৃশ্যত তোমায় ঘৃণা করবো বলেই
আজ এই চৈত্রে আহ্বান করেছি ঝমঝমে বর্ষা  গোধূলির সূর্য পট আকাশের খোলা পাতায়
বার কয়েক লিখেও কেটেছিলাম
তোমার নাম ......
ভেবেছিলাম ভাল যেহেতু বেসেছিলাম
হয়তো নিজের চেয়েও অনেক বেশি
আঁকতে চেয়েছিলাম  ঘৃণার রঙ কে মনের রঙ মিশিয়ে কবিতা লিখতে

যেভাবে তোমায় আমি ঘৃণা করি
সে তো ঘৃণা নয়ই-বরং ভালবাসা !
সময় ফুরোচ্ছে
গত 'সময়ে'র কাছে বর্তমান 'সময়'টা বেচে দিয়ে
আমিও ফুরোবো ভাবছি.........


আকাশ ছোঁয়া লোকটা
আর্যতীর্থ

যে লোকটা কালকেও পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আকাশের সাথে আড্ডা মারছিলো,
সে আজ দুম করে নেই হয়ে গেলো।
বলা নেই কওয়া নেই, মৃত্যু পাঠালো তাকে আচমকা হাতচিরকুট,
চলে এসো বাছা! গোধূলির আলো দেখো মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের কালোতে,
চলে এসো, আলো থেকে ঠাঁই নাও ঢেউহীন অনন্ত অন্তআঁধারে, যার পরে আর কিছু নেই ।’
সেই চিরকুট পড়ে পাহাড়ের মতো লোকটা আকাশকে বললো,
যাই রে! এইটুকু মনে রাখিস, কেউ তোকে ছোঁয়ার স্পর্ধা করেছিলো!’
আকাশ তাকে সযত্নে পরিয়ে দিলো তারার মুকুট, মেঘ দিয়ে
পরিপাটি করে মুছিয়ে দিলো জীবনের ঘাম,
তারপর, খুব মৃদুস্বরে বললো, ‘ যাই বলতে নেই, বলো আসি।’
পাহাড়ের মতো লোকটা দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে, ক্রমে তার মুকুটের তারাগুলোও আবছা হতে শুরু করলো,
সময় যথারীতি দুহাতে ঢেকে দিলো তার বাকি যাত্রাপথ।
আকাশ অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে, তারপর কালো মেঘেদের বললো,
ঝমঝম করে বৃষ্টি নামা বাবারা, আজকে পৃথিবীর ডুকরে কাঁদার দিন!’
তারপর, চারদিক কালো করে খুউউউব বৃষ্টি নামলো, আর  ছলো ছলো আকাশ পৃথিবীকে উদাসীন স্বরে বললো,
জানিস, আসি বললেও, চলে যাওয়া মানুষগুলো আর কোনোদিন ফিরে আসেনা!’
বৃষ্টি পড়েই চললো, ঝমঝম, ঝমঝম......



উৎসব
প্রত্যূষ কর্মকার

আস্ত একটা গোলাপ বাগান তোমাকে দিয়ে যাবো বলে
বসরা থেকে আনিয়েছিলাম খাস গোলাপের বীজ
সদ্য ডিম থেকে বেরোনো পাখিকে বলেছিলাম
জমিয়ে রাখো ওম,তোমার রঙীন চঞ্চলতা,
আমার গর্ভবতী বাগানে গোলাপের ভ্রূণ এলে চাইবো উপহার
বাগানটা তোমাকে দেবো বলে ঝর্নার সাথে চুক্তিপত্র লেখা হল
ঝর্না জল ছেটাবে গোলাপ বাগানে
বিনিময়ে ঝর্নাকে দেবো আদিম স্বাধীনতা
তোমার জন্য গোলাপের কাছে বসেছি প্রার্থনায়
হে আদিগন্ত গোলাপ বাগান,
আমার প্রিয়ার কাছে জড়ো হও আজ
ওকে দেখাতে চাই গোলাপের পাপড়ি থেকে কিভাবে হয়ে ওঠা যায় উড়ন্ত কার্পেট কিভাবে গোলাপের গন্ধে ভরে ওঠে মনখারাপের উঠোন গোলাপ,
তোমার অন্তরের কুসুমটুকু দিও
আজ আমার দেওয়াল ভাঙ্গা রাজবাড়িতে বসন্ত উৎসব

ভালোবেসো
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

এমন মায়াবী এই জীবন
আঙুল ছোঁয়ালেই বেরিয়ে পড়ে মুখবন্ধ খামের গোপন কথা
সূর্যাস্তের হলুদ ঝরে যায় কমলালেবুর বাগানে
শালিখের ডানা থেকে নেমে আসে বেকাবু কুর্ণিশ
মায়োপিক মেঘমালা চশমার রোদ মুছে নিয়ে
আনমনে ঢুকে পড়ে বৃষ্টির ঘরে
এইসব অতলান্ত, থই না পাওয়ার সুগহীন
আর কার সাথে ভাগ করে নেব বলো!
এই যে চড়াইয়ের পথে হাত ধরে হেঁটে হেঁটে যাই
হাঁপ ধরে গেলে দুদণ্ড হেলান দিই পাইনের গাছে
তুমি নিচু হয়ে ঝর্ণা দেখালে আমি ঝুঁকে পড়ি অকস্মাৎ
ভাঁড়ের চায়ের থেকে শুষে নিই মাটির গন্ধ
সন্ধ্যা এলে ঝিম হয়ে শুনি পাহাড়ি অন্ধকারের উপকথা
শুনি আর ভাবি,ভাবি আর লিখি
ভালোবেসো, ভালোবেসো
তুমি ভাবো এসবই কবিতা
সত্যি বলছি,জানো!
আমি যাপনের কথা লিখি।

Monday, 26 February 2018

সাহিত্য এখন,ফেব্রুয়ারি সংখ্যা,২০১৮


 সম্পাদকীয়



সদ্যই পার হয়ে এলাম ২১শে ফেব্রুয়ারী। এই তারিখটি স্মরণ করলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।যেমন নত হয়ে আসে প্রজাতন্ত্র দিবসে অথবা স্বাধীনতা দিবসের পরম লগ্নে। ২১শে ফেব্রুয়ারী আর ১৯শে মে, এই দিনদুটি আমাদের আবেগমথিত করে, মনে করায় সংগ্রামের কথা, আত্মত্যাগের কথা , আর মাথা উঁচু করে বাঁচার কথা।বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের দেশে বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষার জন্য লড়াই আসলে অস্তিত্বের লড়াই, টিঁকে থাকার লড়াই।
আত্মা যদি পরম শক্তির প্রতীক হয়, দেহ তার আধার অর্থাৎ শক্তির আলয়। প্রতিটি জীবন তবে উপাসনার যোগ্য,কারন তা সর্বশক্তিমানের প্রিয় সৃষ্টি। খাদ্যের পাশাপাশি আলো, হাওয়া, জল আর ভাষা সেই উপাসনার পঞ্চ উপচার। মনে হতে পারে, ভাষা কেন? ভাষা ছাড়া কি জীবন ধারণ সম্ভব নয়? আমি বলব, না। কারণ ভাষা হল আমাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। নিজেকে প্রকাশ করতে না জানলে আমাদের জন্মের সার্থকতা কোথায়?   
একটি শিশু যখন কথা বলতে শেখেনি,  তখন তার হাসি, কান্না, রাগ,বিরক্তিই তার ভাষা হয়ে ওঠে। যখন তাকে শব্দ দিয়ে ভাব প্রকাশ করতে শেখান হয়, তখন সে তার উপরোক্ত অনুভূতিগুলোকে সহজতম শব্দে রূপান্তরিত করতে শেখে। যত সহজে সে তার ভাব প্রকাশ করতে পারে, তত সাবলীল ভাবে গড়ে ওঠে তার চরিত্র এবং চিন্তাধারা। যদি শিশুকে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধির পথ থেকে সরিয়ে এনে অন্য পথে চালিত করতে চাওয়া হয়, তবে তার বেড়ে ওঠাটি ক্ষতিগ্রস্থ হবেই। স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে তার ফল কি হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে রঙ্গিত ওরফে তিস্তানদীর কথা ভাবা যেতে পারেরঙ্গিতকে যখন সিকিমে প্রথম দেখি, তখন সে প্রাণচঞ্চলা, খরস্রোতা।আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে তার গতিপথে।কিন্তু যত সে সমতলের দিকে  অগ্রসর হয়, মানুষ ততই তার গতি রুদ্ধ করে প্রয়োজন মত চালিত করতে  চায় তাকে। যতক্ষণে সে তিস্তা নামে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে, ততক্ষণে তার শক্তি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে ক্লান্ত। অবিকল আমার আপনার ঘরের শিশুদের মত।

পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশগুলিতে একটি সাধারন মিল দেখতে পাওয়া যায়। এসব দেশের নাগরিকেরা প্রত্যেকেই শৈশবাবস্থায় মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করেছে। অর্থাৎ শিক্ষাগ্রহণের সময় তাদের পদে পদে ঠোক্কর খেতে হয়নি, তাদের চিন্তার স্বাভাবিক ধারার সামনে কেউ বিদেশী ভাষা নামক বিরাট একখানা জগদ্দল পাথর বসিয়ে দেয়নি। তাহলে কি বিদেশী ভাষাকে আমূল বর্জন করতে হবে? ভারতের মত বহু ভাষাভাষীর দেশে এমনিতেই তা সম্ভব নয়।  বরং মাতৃভাষা ছাড়াও অন্য ভাষা শিক্ষা করলে ভাষায় দক্ষতা বাড়ে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। অন্যান্য দেশে যেমন সম্পূর্ণ শিক্ষা পদ্ধতি মাতৃভাষায় পরিচালিত হয়, আমাদের দেশে তা হচ্ছে না। অদ্ভূত এক খিচুড়ি ব্যবস্থার সামনে আমাদের শিশুদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সরকারী বা সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে যদিও মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা হচ্ছে, সেইসব স্কুলের ছাত্রদের অনেকের মধ্যেই জাগছে প্রবল হীনমন্যতা। কারণ কী? কারণ বেসরকারী স্কুলে অনুসরণ করা হচ্ছে ইংরাজী মাধ্যম,এবং কে না জানে যে শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে অধিকাংশই ইংরাজীতে দক্ষতা থাকলে পরম শ্লাঘা বোধ করেন। যেন তাদের সন্তানরা মাতৃভাষায় সুদক্ষ হয়ে উঠলে তা পরম লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সৌভাগ্যের কথা, যে ইংরাজী মাধ্যমে শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে সকলেই এই মত পোষণ করেন না। নচেৎ ভারতের কপালে আরও অনেকটা পরিমাণ দুঃখ লেখা থাকত। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন মাতৃভাষাকে। ‘তোতা-কাহিনী’ তে তোতাপাখিটির মৃত্যু আদতে তার স্বভাব বিরুদ্ধ শিক্ষারীতির দিকেই আঙুল তোলে

স্বদেশে থেকে বিদেশি ভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে বেছে নিলে যা হওয়া স্বাভাবিক, ঠিক তাই ঘটে চলেছে আমাদের দেশে।একটা আলাদা গোষ্ঠী তৈরী হচ্ছে, যাঁরা দেশীয় ভাষা বা সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন না। সেটা অস্বাভাবিকও নয়। প্রতিনিয়ত যদি শিশুকে বিদেশি ভাষায় কথা বলতে উৎসাহ দেওয়া হয়, মাতৃভাষায় কথা বলা বর্জন করতে বাধ্য করা হয়... তাহলে শিশুর অজান্তেই মাতৃভাষা সম্পর্কে হীন ধারণা গড়ে ওঠে। সে ভাবতে শুরু করে, মাতৃভাষা নিশ্চয় খুব একটা উৎকৃষ্ট মানের নয়, তা না হলে বিদেশি ভাষাকে মাতৃভাষা করে তোলা হবে কেন! জার্মানি, ফ্রান্স বা অন্যান্য ইওরোপীয় দেশের ছাত্ররাও বিদেশি ভাষা শিক্ষা করে, কিন্তু তাদের মূল শিক্ষার বাহন তাদের মাতৃভাষা। তাতে তাদের বিন্দুমাত্র পিছিয়ে পড়তে হয়েছে বলে তো মনে হয় না। বরং ঘরের পাশে চীনকে দেখলেই বোঝা যায়, মাতৃভাষায় শিক্ষিত চীন কী অবলীলায় বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ হবার দিকে পা বাড়াচ্ছে।
উন্নত হবার মূল কথাটি নিহিত আছে অন্য জায়গায়। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, সমস্ত উন্নত দেশের সন্তানেরাই নিজের দেশ,নিজের ভাষা সম্পর্কে গর্ব বোধ করে। তারা দেশকে যত্ন করে, ভালবাসে। আমরা ভারতীয়রা নিজের দেশের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে নাক কুঁচকাই,কিন্তু তাকে পরিচ্ছন্ন করার কাজে নিঃশর্তে এগিয়ে আসি না। যদি ইওরোপে বেড়াতে যান, দেখবেন সেখানকার অধিবাসীরা নিজের দেশের সৌন্দর্য এবং পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কত যত্নশীল। একবার একদল ভারতীয় পর্যটক সুইজারল্যাণ্ডে একটি রেস্তোঁরায় প্রাতঃরাশ সারছিলেন। রেস্তোঁরায় সবার জায়গা হয়নি বলে সংলগ্ন ফুটপাতে খাবার হাতে দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন। রাস্তার অপর প্রান্তে একটি স্থানীয় ট্যাক্সিচালক তখন দিনের প্রথম রোজগারের আশায় অপেক্ষা করছিলেন। ভারতীয় পর্যটকদের রেস্তোঁরার বাইরে দাঁড়িয়ে খেতে দেখে তিনি তড়িঘড়ি রাস্তা পার হয়ে এলেন। তারপর অত্যন্ত বিনীত ভাবে তাদের অনুরোধ করলেন যে তাঁরা যেন ভুক্তাবশেষ এবং খাবারের ব্যবহৃত প্লেটগুলি পাশের ডাস্টবিনে ফেলেন। আমাদের দেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে গেলে আমাদেরও এভাবেই এগিয়ে আসতে হবে। বুঝতে হবে নিয়ম তৈরী হয় পালনের জন্য, ভাঙার জন্য নয়।

ঠিক একই ভাবে মাতৃভাষাকে উন্নত করতে গেলেও আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। উচ্চশিক্ষায় পঠন পাঠনের জন্য বাংলায় ভাল বই নেই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। বই লেখার দায়িত্বটিও কাঁধে নেবার কথা ভাবতে হবে। শুধু বিশ্ব সাহিত্য নয়, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বইও বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। আবার দেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজকে বিদেশের দরবারে তুলে ধরার দায়টিও নিতে হবে কাঁধ পেতে। বিদেশের দরবারে নিজেকে তুলে ধরতে গেলে বিদেশি ভাষা শিক্ষা করাও খুব জরুরী। তবে সেটিকে ভীতিপ্রদ করে তুললে তা কোনদিনই সহজে ধরা দেবে না।  শুধু পড়া বা লেখা নয়, বলা এবং শোনার ওপরেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক শিক্ষিকার। তবে সবার আগে যেটি করতে হবে , সেটি হল মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করতে শেখা।বছরে দুবার নয়, প্রতিদিন। সেই কাজটি শুরু করতে আমাদের আর একমুহূর্তও দেরী করা উচিত নয়।
                                                  শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
 


 গল্প

যখন তোমার পাশেও অন্ধকার
সম্পূর্ণা চ্যাটার্জী





টিভিতে হাঁ করে বর্ষা "প্যাডম্যান"য়ের ট্রেলারটা দেখছে।সোফার পাশে দাঁড়িয়ে অন্তরা মানে বর্ষার মাও ডুবে গিয়েছে সিনেমাটার ক্লিপিংসে! অবাক হয়ে ভাবছে এইসব কনসেপ্টেও আজকাল সিনেমা হচ্ছে! কি বিরাট পরিবর্তন ! আগে এ ধরণের কনসেপ্টে সিনেমা শুধুমাত্র আপার ক্লাস বা বুদ্ধিজীবীদের জন্য বানানো হত, বিদেশী এ্যাওয়ার্ড পেত, সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মেসেজটা পৌঁছতই না!এখন সবার জন্য বানানো হয় নির্ভেজাল মোড়কে। যাতে সহজভাবে গভীর মেসেজ ছড়িয়ে যায় সবার কাছে! বলা যেতে পারে নিখুঁত বুদ্ধিতে সোস্যাল এ্যাওয়ারনেস বাড়ানো।
এসবই ভাবছিল অন্তরা দেখতে দেখতে। চেয়ে দেখল ক্লাস নাইনে পড়া বর্ষাকে! প্রথম প্রথম নিজেও খানিকটা লজ্জা পেত! প্যাড বা কন্ডোমের এ্যাডে বা সিনেমায় রেপ সিন দেখালে ঘুরিয়ে দিত চ্যানেল! ঋতু মানে অন্তরার প্রথম সন্তান পর্যন্ত এ জিনিস চলেছিল। কিন্তু বর্ষা যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন ওদের মেয়েদের "পিরিয়ড" হওয়া নিয়ে স্পেশাল এ্যাসেম্বলিতে প্রিন্সিপাল একটা ক্লাস করেছিলেন!আজকাল মেয়েদের পিরিয়ড আগের তুলনায় বয়সের একটু আগেই শুরু হয়ে যায়, তাদের ম্যাচ্যুরিটি আগেকার দিনের মেয়েদের থেকে বেশি থাকে বলে|তাই স্কুলে হঠাৎ করে এমন হলে টিচারকে লজ্জা বা ভয় না পেয়ে জানাতে| এটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়, জাস্ট একটা বায়োলজিকাল সিস্টেম, মেটাবলিক এ্যাক্টিভিটি ! এও বলেছিলেন, "মা পিরিয়ডসদের দিনে তোমায় জড়িয়ে ধরে আদর করলে বা খেতে দিলে খারাপ যদি না হয় তাহলে গড আর গডেসদের ছুঁলেই খারাপ হবে কেন? তোমরা কি তখন তোমার মাকে ছোঁওনা?" ভীষণ ভালো লেগেছিল কথাগুলো বর্ষার মুখে শুনে। ছোট থেকে ঠাকুমা-মা-কাকিমার তৈরি করা সংস্কারে হঠাৎ একটা আছড়ে পড়া স্রোত! যুক্তিতে ভেঙে যাওয়া আজন্মের ভাবনা! ছুটে গিয়ে অদ্রীজকে বলেছিল কথাটা! অদ্রীজ তখন অফিস থেকে সদ্য ফিরেছে! গরম চায়ের কাপে চুমুক না দিয়েই খানিক ভয় পেয়ে বলেছিল, 'তুমি কি এবার এ বাড়িতে এই রেভোলিউশন আনবে নাকি! হাতজোড় করছি অনু মায়ের কানে গেলে যাতা রকমের অশান্তি হবে! কেন মিছিমিছি স্রোতে ভাসতে চাইছ? যেমন চলছে চলতে দাও। ' অনু হতাশ গলায় বলেছিল, 'যাই বলো কথাটায় যুক্তি আছে।আর তুমি সায়েন্স নিয়ে পড়ে এসব....!' কথা শেষ হওয়ার আগেই অদ্রীজ উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, 'সায়েন্স আমার মাথায় থাক অনু। আইনস্টাইন থেকে ডারউইন এদের যদি বিধবা মা থাকত আর আত্মীয়স্বজনের "বাবা চোখ বুঁজতেই মাকে পর করে দিলি!" টাইপ ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ভয় থাকত তাহলে ওই আবিষ্কারগুলো, হত না। প্লিজ অনু যা বললে আমাকেই বললে, ঘুণাক্ষরে মেয়েদেরও উল্ট বুঝিও না। '
হঠাৎ করে শ্বাশুড়ির গলায় ঘোর কাটল। তিনি যে নিঃসাড়ে এসে দাঁড়িয়ে ওই "প্যাডম্যানে"র ট্রেলরটা দেখেছেন কেউই খেয়াল করেনি। আচমকা উচ্চস্বরে চমকে উঠল দুজনেই! "বাঃ! বাহ্ বা বাহ্! দেখার মতো দৃশ্য! মা মেয়ে পাশাপাশি এসব দেখা হচ্ছে!! এখনও আমি বেঁচে বুঝলে? এটা এখনও আমার বাড়ি। বেলেল্লাপনা চলবে না। মেয়েকে নিজে হাতে উচ্ছন্নে দিচ্ছ!! ' এতোটুকু শোনার পর বর্ষাই বলল, 'ঠাম্মি এতে লজ্জা কিসের!! আমাদের স্কুলে ক্লাস সেভেনের সিলেবাসেই....' কথা শেষ হলনা, অন্তরা মেয়ের দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলল, 'আহ্! চুপ কর, সব বিষয়ে বিতর্ক ভালোলাগেনা।' বলেই ঘর থেকে টিভি বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।
কথাগুলো যে শ্বাশুড়ি মানে সরমাকেই বলেছে সেটা সরমাও বুঝেছেন। তার গলার স্বরে উঠে এসেছে ছোট পিসিও। তিনি এসেছেন ঋতুর আশীর্বাদের জিনিস দেখতে। ঋতুর বিয়ে এখনও দেরি অনেক। ছেলে মুম্বইয়ের "ভাবা রিসার্চ সেন্টারে" চাকরি করে। ঋতুর সাথে পরিচয় যাদবপুরে এমএসসি করার সময়। ননকাস্টে বিয়ে হচ্ছে। এ বাড়ি ব্রাহ্মণ, মুখার্জ্জী। আর ছেলেরা কায়েস্ত মিত্র। রাজি করাতে বেগ পেতে হয়েছিল। নিজের আপত্তির থেকেও বেশি চিন্তা আত্মীয়-স্বজন কি বলবে! এরা বোঝেনা ভালো থাকাটাই আসল। ঋতু পিএইচডি করছে,অজয় চক্রবর্তীর কাছে গান শিখেছে, এমন মেয়ের কদর বুঝবে তেমন ছেলেরই দরকার। নির্ঝর ছেলে খুব ভালো। ওরই উদ্যোগে ঋতুর পিএইচডি করা। যতোদিন না কমপ্লিট হয় ঋতু থাকবে কোলকাতায়, ওদের বাড়ি গড়িয়াহাটাতে। অন্তরা সেইসময় প্রথম শ্বাশুড়ির মুখের ওপর বলেছিল, 'ব্রাহ্মণ কায়েস্ত দিয়ে ওর ভালো থাকা কি নিশ্চিত করা যাবে মা? বিয়ে তো কাস্টের আইকার্ড নয়, যে গলায় ঝুলিয়ে ঘুরবে। বরং ও যাতে ভালো থাকে সে চেষ্টা করাই উচিত। যে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এতো ভাবছেন তারা ও খারাপ থাকলে এভাবেই এসে পাশে দাঁড়াবে তো? ' সরমা চোখের জল মুছে বলেছিলেন, 'তোমাদের বাবা আমাকে একলা ফেলে চলে গেছেন। আমার বাড়ি হলেও আমি তোমাদের গলগ্রহ। মেনে তো নিতেই হবে। '
এসব ইমোশনাল টর্চারে অন্তরা ও বাকি সবাই অভ্যস্ত। দিনে একশবার আর আত্মীয়রা এলে বারবার এই "আমার বাড়ি" আর "ছেলে বউয়ের গলগ্রহ" কথাটা শুনে শুনে আর কেউ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেনা। আজও তাই শুনল না কথাটা। ছোট পিসি এসেছে ওদের জলখাবার দিয়ে চা করতে আসছিল। তখনই একটা ছোট ট্রেলার দেখতে গিয়ে এই বিপত্তি। ছোট পিসি এসে আরেকটু উস্কে দিল, 'আর বোলো না বৌদি। আমার বাড়িতেও এই চলছে| তোমার নন্দাইকেও বলেছি চুপচাপ চোখ উল্টে দেখে যেতে । সব এখন স্বাধীন, আমরা সেকেলে হয়েগেছি গো! আমার ছেলের বউ তো আবার হাতকাটা কি ওই কুর্তি না কি বলে তাই পরে কলেজে পড়াতেও যাচ্ছে!! স্যার দিদিমণিদের সাজের কি ছিরি! আর কিছু বলতে গেলেই চোদ্দোশ জ্ঞান তোমায় দিয়ে দেবে। ছাড়ো, ছাড়ো, নিজের মতো থাকো যতদিন আছো। ' তার মুখের কথা সরমা কেড়ে নিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, বিদ্যেধরী নাতনীর ঠাকুমা আমি। কিছু বলতে গেলেই একঘরে হতে হবে। এ পোড়া চোখে আরো কতো কি পরিবর্তন দেখতে হবে কে জানে!'খোঁচাটা ঋতুর বিয়ের ঠিক হওয়া থেকেই সরমার মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। উঠতে বসতে শোনান। সব বিষয়েই কথা বলে এটা বলেদেন। ঠিক যেন সিগারেটের প্যাকেটের স্ট্যাটুটরির মতো। নিজের মনে ভেবেই হেসে ফেলল অন্তরা। চা হয়ে গেছে, নিয়ে এগোল শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে। .....
আবার কাল...

ঘরে ঢোকার সময়ই অন্তরা বুঝল তাদের নিয়েই হয়তো কোনো আলোচনা চলছিল। তাকে আসতে দেখেই শ্বাশুড়ি ও ছোটপিসি থেমে গেলেন। ও আর কোনো কথা না বলে চা দিয়েই বেরিয়ে এল। কারুর পেছনে কাউকে নিয়ে অপ্রিয় কথা মানে পিএনপিসি জিনিসটা একদম অন্তরার পছন্দ নয়। এই ছোটপিসিরই আইবুড়ো বেলার কতো নিন্দে মা মুড ভালো থাকলে করেছে। অথচ সামনে দেখা হলে হলায়গলায়! ছোটপিসিও হয়তো তাইই করে! ওইজন্য কোনোদিন শ্বাশুড়ির প্রিয় বউমা হয়ে উঠতে পারলও না হয়তো। সাধারণ গৃহবধূ হয়েও মানসিকতায় অনেকখানি আলাদা অন্তরা। অদ্রীজও বলে, 'তোমায় দেখতে এতো সুন্দর, কিন্তু বুদ্ধি হাঁটুতে। সংসারে জলের মতো হতে হয়। যখন যে পাত্রে থাকবে তখন তার মতো। তবেই সুখ তবেই শান্তি। ' বুঝতে পারেনা অন্তরা বুদ্ধিমান হতে গেলে কি ভালোবাসার মানুষজনকে রোজ একটু করে ঠকাতে হয়! যারা তাকে বিশ্বাস করল, ভরসা করল নিজের স্বার্থের জন্য তাদের পেছনে ছুরি মারাই কি বুদ্ধিমানের পরিচয়!! ইনটেলিজেন্স আর ক্লেভার দুটো শব্দের অর্থ কি এক হতে পারে?
আপাত চোখে সেও সুখী। অদ্রীজের মতো নির্বিবাদী ভালোমানুষ খুব কম হয়। ভালোমানুষ? না, মেরুদণ্ডহীন মানুষ? । অদ্রীজকে দ্বিতীয় ভাগে ফেলা যায়। আজ ছাব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে অদ্রীজ জানেই না, অন্তরা কি চায়! কি পছন্দ অন্তরার! বোঝেই না অন্তরা "গৃহবধূ", "গৃহপালিত পশু" নয়।তারও স্বাধীনতা, ইচ্ছে এগুলো থাকতে পারে ! যাকে শুধু চুপ করিয়ে রাখতে পারলেই শান্তি সংসারে! দরজায় বেল বাজল। বোধহয় ঋতু এসেছে! বুঝতে পারল মনের ভারটা চোখের কোণে জমেছে। আঁচলের খুঁটে তাড়াতাড়ি মুছে নিল।
বর্ষা গিয়ে দরজা খুলল দৌড়ে। দুই বোনে খুব ভাব। ওই দুজনই এখন অন্তরার বন্ধুর মতো। কিছুদিন আগে অন্তরার বন্ধু সুকন্যা দিল্লী থেকে এসে যোগাযোগ করেছিল। ঋতুই তার অনুষ্ঠানের অজুহাত দিয়ে মাকে দেখা করিয়ে এনেছে। অদ্রীজও জানে না। জানলে নিজের থেকে বেশি মায়ের ভয়ে রাজি হতনা। অন্তরার যেন মনে হয় অদ্রীজ মায়ের ইচ্ছের মধ্যে দিয়ে নিজের ইচ্ছেটাই হয়তো পূরণ করে নেয়! ঋতু কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। হঠাৎই, 'কি গো! সব এতো চুপচাপ!! কিছু হয়েছে? ' বর্ষা পাশেই ছিল। সে তাড়াহুড়ো করে বলল, 'আর বলিস না দিভাই! কি কুক্ষণে প্যাডম্যানের ট্রেলারটা.....' কথাটা আর শেষ না করতে দিয়ে অন্তরা বলল, 'ছোটঠাম্মি এসেছে। যা গিয়ে দেখা করে নে। আর অশান্তি ভালোলাগেনা। ' ঋতু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, 'ওহ! যাচ্ছি মা! এতো নিয়ম, এতো মনে করা এসব আমারো ভালোলাগেনা। আর সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে তোমার এই সবেতে সর্বংসহা ভাবটা! এই সংসারে তোমার কাজটুকু এ্যাক্সেপ্টেবল কিন্তু তুমি এ্যাক্সেপটেবল নও! এটা কি তোমার মেয়ে হিসেবে আমারো খারাপ লাগে না! ' অন্তরা ম্লান হেসে বলল, 'তোর সংসারে তুই এ্যাক্সেপ্টেবল হবি, দেখিস? ' ঋতু আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, অন্তরা বলল 'আর কোনো কথা নয়। যা দেখা করেনে। '
ঋতু ঘরে ঢুকতেই ঠাম্মি 'দেখ কে এসেছে! কখন থেকে বসে আছে তোর সাথে দেখা না করে যাবেনা ' এটা একটা ভীষণ ভালো দিক সরমার। রাগ যতোটুকু তা অন্তরার ওপর| কিন্তু নাতনীদের কখনো সেই মতোবিরোধে টেনে আনেন না। ঋতু টুক করে একটা প্রণাম করেই বলল, 'কেমন আছ?? তুমি কিন্তু দিন দিন ইয়াং হচ্ছ মণিমা। ওইদিন তাড়াতাড়ি চলে আসবে কিন্তু! ' মণিমাও খুব খুশি হয়ে বললেন, 'আসবই তো যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব! তোর আশীর্বাদ বলে কথা!ওই তোরা যেটা বলিস এনগেজমেন্ট! ' বলেই মুচকে হেসে বললেন 'দেখ মণিমাও তোদের পাল্লায় মর্ডাণ হয়ে গেল! 'বলেই সবাই হেসে উঠলেন! ঋতু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, 'কাম্মা যেন সেদিন ছুটি নেয়। মা ফোনে বারবার করে বলেছে। ' ঠিক এই কথাটাতেই কেমন দায়সারা ভাবে উত্তর দিলেন, 'হম...আসবে। ওহ! দেখো কাণ্ড! কত্ত দেরি হয়ে গেছে কথায় কথায়! এবার আসি। '
#
আজ ঋতুর আশীর্বাদ। বাড়ি ভরতি আত্মীয়-স্বজন।ছোটপিসিও এসে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আসলে থাকতে পারেনা ছোটপিসের জন্য, হাই সুগার, ব্লাডপ্রেসার। ইনসুলিন চলে দিনে দুবার। খাওয়া দাওয়ায় হরেকরকম নিষেধ! তাই যায়না কোথাওই প্রায়। ঋতু অপেক্ষা করছে কাম্মার মানে রানু কাকিমা, ছোটপিসির ছেলের বউয়ের জন্য। ভীষণ শিক্ষিত আর আধুনিক মনের মানুষ। কিন্তু অহংকার নেই। ছেলে-মেয়ে হয়নি। কাম্মার থাইরয়েড শুরু বিয়ের পর থেকেই| পিরিয়ড ইররেগুলার। অনেক ট্রিটমেন্ট করিয়েও কিছু হয়নি। এখনকার চিকিৎসা অনেক উন্নত।এখন হলে এটা কোনো সমস্যা হয়তো হতনা। ঋতুকে খুব ভালোবাসেন। মায়ের কাছে শুনেছে, ঋতু হওয়ার সময় অন্তরা অসুস্থ ছিল, ব্রেস্টফিডিংও করাতে পারেনি ঋতুকে। সেইসময় কাম্মা সবটা করেছে ঋতুর। এখনও যেকোনো ছোটখাটো বিষয়ে কাম্মা ছাড়া চলে না ঋতুর। ঋতুর খুব ইচ্ছে কাম্মা ওকে আর নির্ঝরকে প্রথম আশীর্বাদ করুক। অন্তরাও তাইই চায়। কিন্তু বাবা বলছে ঠাকুমাই করবে প্রথম। নাহলে ভীষণ দুঃখ পাবে।
ওই তো! নীচে কারা এল! মণিমার গলা না! মা,ঠাম্মা,বাপির গলা পাচ্ছে! দৌড়ে গেল ঋতু। ওপরে সবাই উঠে আসছে। গিয়েই থমকে গেল। 'ওমা! কাম্মা কোথায়? কাকাই! আজও কলেজ গেল! 'বলল ঋতু। মণিমা খানিক মুখটা বেঁকিয়ে বলল, 'তোর আশীর্বাদ বলে কথা। কোনো ভুলচুক হতে দিতে পারি!!! বাঁজা মেয়েমানুষ, ওর মুখ দেখলে ভালো হবেনা দিদিভাই। ' অন্তরা খুব অবাক হয়ে বলল, 'মানে! কালও কথা হল রানুর সাথে, বলল নাতো কিছু! ' ততোক্ষণে ওরা ঠাম্মার ঘর পর্যন্ত উঠে এসেছে। ঘরে গিয়ে ছোটপিসেকে খাটে বসিয়ে একটু জল চাইলেন। অদ্রীজ পুরো চুপ, ভেতরের সেই ঘাড় ঝুঁকোনো ভাবটা মুখে স্পষ্ট। বর্ষা নিয়ে এল জল । ছোটপিসে একঢোঁক জল খেয়ে বললেন, 'তোমরা আধুনিক বৌমা। আমরা নই। যতোদিন বেঁচে আছি এটুকু মানিয়ে নাও। নাহলে এখনকার ওই ওল্ডেজ হোম হয়েছে দাও পাঠিয়ে। ' খুব জোর দিয়ে বলে দম নেয়ার জন্য থামতে ঋতু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, 'কিন্তু....' ঠাম্মা থামিয়ে বললেন, 'কোনো কিন্তু নয় দিদিভাই। সবটাই তোমার বা তোমাদের ইচ্ছে মতো হবেনা। ওইজন্যই জানাইনি এতোদিন। রানুকেও আজ বলে বারন করেছে।শুভ কাজে বাঁজা মেয়ে মানুষ অশুভ। এলে সবার সামনে বলতে অসুবিধা হত। এখন বলা যাবে সবাইকে ওর কলেজ আছে। '
হঠাৎ কোনোদিন অন্তরা যে স্বরে কথা বলেনা সেই জোর গলায় এনে বলল, 'কে কি ভাবল সেটা তো আসল নয় মা। রানু না এলে এ আশীর্বাদ হবেনা। আর ওই ঋতুকে প্রথম আশীর্বাদ করবে। ' ঘরে যেন আচমকা বাজ পড়ল। অদ্রীজ ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলেন, 'পাগল হলে নাকি! একটু পরেই নির্ঝররা চলে আসবে। মা, পিসিমণি যা বলছে ভুল তো নয়! ' অন্তরা ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাম্মা বলছে 'দেখ, বাবু! কি তৈরি করেছিস বৌকে! শাসন না করে করে আজ এই অপমান করতে শিখেছে গুরুজনদের!!' ঋতু পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে বলল,'মা বাচ্চা নাকি! যে বাবা শাসন করবে! ' অদ্রীজ স্বভাবের বাইরে গিয়ে রেগে উঠে বললেন, 'একটা চড়ে বড় বড় কথা থামিয়ে দেব!' অন্তরার দিকে একঝলক রাগ ছুঁড়ে বললেন, ' এই শিক্ষা দিয়েছ মেয়েকে? নিজের ঠাকুমাকে পর্যন্ত অপমান করছে! এই মেয়ে আবার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসার করবে? '
অন্তরা এতোক্ষণ চুপ ছিল। কারুর দিকে না তাকিয়েই সেই আগের স্বরে বলল, 'যা বলার বলে দিয়েছি। রানু এলেই আশীর্বাদ হবে, আর ওই প্রথম আশীর্বাদ করবে। ঋতুর জন্মের সময় আমার বাঁচার কথা ছিল না। তাহলে হয়তো আজ রানুই ওকে পুরোপুরি বড় করত। একবছর বয়সে ঋতুর লিভারে পক্স হল। বাঁচার কথা ছিল না। আমিও তখন পুরো সুস্থ্য হইনি। রানু!দিনরাত এক করে ওকে সুস্থ্য করেছিল। ' ঘরে তখন পিন ফেলার নিস্তব্ধতা! একনাগাড়ে অন্তরা বলে যাচ্ছে, 'আর বাচ্চা হয়নি তাই শুভ কাজে আসবে না। বাচ্চা না হওয়াটা কি ওর অপরাধ! ওর চেয়ে শুভ বোধহয় রানুর জীবনে আমরা কেউই নই। যে নিয়মে শুধু সংস্কারের বেড়াজাল থাকে, আর অকৃতজ্ঞ হতে হয়, তা উঠে যাওয়াই ভালো। ' সবার মাথা নীচু! ঋতু অবাক হয়ে দেখছে মা-কে, সবকিছু মেনে ও মানিয়ে নেয়া সেইই মা! সরমা আবেগহীন গলায় বললেন, 'রানুকে ফোন করে আসতে বলো। '
অন্তরা ঘর থেকে উঠে বোধহয় রানুকে ফোন করতে গেল। আজ যেন নিজের কাছে নিজের মাথা উঁচু লাগছে। কতোদিন নিজের কাছে ছোট হয়ে কারুর স্ত্রী বা ছেলের বউ হয়ে বাঁচা যায়! ঘরে এসে ফোনটা তুলতে যাবে ঋতু আর বর্ষা এসে জড়িয়ে ধরল আনন্দে...।

কবিতা

ও যে মানেনা মানা
আঁখি ফিরাইলে বলে, না-না-না…
.অপাংক্তেয়
.
দুরূহ অঙ্কের মতোই প্রেম-প্রেম খেলা। সিঁড়ি ভাঙে। কখনো উপরে নিয়ে যায়। কখনো নিচে। সমান্তরাল শরীর ঘেঁষে হা-হা ভাঙচুর। ভাঙাচোরা গাছের নীচে জমে উঠেছে আমাদের শোকসভা। শিকড়ে ঠিকানা লেখা থাক। ধুলো আর ঘাসে ছায়ালীন ভুল ব‍্যবধান
আলোটিকে ‘অমলকান্তি’ ভেবে হাতের তালুতে বা মরে যাওয়া তারাদের নীচে। লুকিয়ে ফেলেছিলাম। অনুরোধে সবুজ ঘ্রাণ। গাছেরা শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। আকাশ থেকেও নেমে এসেছিল দু-একটা তারা
এখন বেশ শীত। রোদ ওঠেনি আজ। আবছা কুয়াশা। পাখিরা উঠেছিল। ফোনটা এসেছিল ঠিক তখনই। ’উঠে পড়ো’। নীলরঙা দৃশ‍্যে হেঁটে গেছি যতটুকু। দূরত্ব বেড়েছে নক্ষত্রের। তুমি আলো আঁকো বা কালো। ধূসরতা আমাদের জন্মকালীন ভুল
দেহ ছিঁড়ে খাবে। এমন দস্যু কই ?
চুম্বন ? তাকে স্থাপত্য বলেই চিনি
এভাবেই তোমার মগ্নতায় আঙুল ছুঁয়ে যায়। রোদে গান জাগে বা বেলাশেষের মেঘে শরণার্থী দুটি হাত…….

কেমন আছো
বিশ্বজিৎ মাইতি

তুমি কেমন আছো
জানতে আজকাল ভয় হয় আমার,
সচেতন ভাবে তাই বারবার এড়িয়ে যাই কুশল বিনিময়ের প্রসঙ্গ।
ছেলেবেলার মতো তুমি যদি আবার বায়না ধরে বসো
আস্ত একটা নদী-
নদীর গা ঘেঁষে থাকা আঁকাবাঁকা মেঠোপথ,
কোঁচড় ভর্তি শুকনো মুড়ি,
আঁচলা ভরে খাওয়া জলের স্বাদ;
কিম্বা শিমপাতা বেটে লেখা সেই
বর্ণপরিচয়ের দিনগুলি
বকুলের ঘষা বাঁশির সুর-
কি করবো তখন?
ঘড়ির শব্দে যদি আজ ঘুম না আসে,
অবজ্ঞা করে ফেলে দাও
বালিশের পাশে রাখা জল ওষুধ,
তারাদের আলোয় প্রাচীন নদীটিকে খুঁজি চল সারারাত,
আমিও হাঁটবো তোমার পায়েপায়ে
পেরিয়ে যাব দুজনে উজানতলির মাঠ,
যত অলৌকিক বনবাদাড়-
তুমি কেমন আছো
জানতে আজকাল ভয় হয় আমার,
পাছে যদি সত্যি বলে দাও।




আমার_মা
সৌরভ বটব্যাল

আমার মা ও মিথ্যে কথাই বলতো!
ছোট্ট বেলায় পুকুরপাড়ে
দুপুর রোদে বনবাদাড়ে,
খেলার শেষে ফিরলে বাড়ি কষেই কান মোলতো।
আমার মা ও মিথ্যে কথাই বলতো।

আমার মা ও মিথ্যে বলতে জানতো!
মধ্যবিত্ত মাসকাবারি
চায়েই ফুরোয় দুধের হাড়ি,
আমার পাতে দুধ জোগাতে মায়ের থালায় পান্ত।
আমার মা ও মিথ্যে বলতে জানতো।

আমার মা ও মিথ্যে ভালোবাসতো!
নইলে কি আর বছরভরে
কাটিয়ে দিয়ে এক কাপড়ে,
আমায় নতুন জামা দিয়ে ভূবনভরিয়ে হাসতো!
আমার মা ও মিথ্যে ভালোবাসতো।

আমার মা'র ও মিথ্যে ভালো লাগতো!
পড়তে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি
মায়ের তখন ক্লান্ত শরীর,
তবুও আমায় চা যোগাতে রাত দুটোতেও জাগতো।
আমার মা'র ও মিথ্যে ভালো লাগতো।

আমার মা ও মিথ্যে জমিয়ে রাখতো!
যখন আমি অনেক দুরে
হায়ার স্টাডিজ, ফুল শহুরে,
রোজই আমার অপেক্ষাতে সোয়েটারে ফুল আঁকতো!
আমার মা ও মিথ্যে জমিয়ে রাখতো।

মা তো কেবল মিথ্যে বলতে থাকে!
জীবন এগোয় লড়াই বাড়ে,
তবুও আমায় একনাগাড়ে
ভরসা দিয়ে, নিজের বুকের কান্না চেপে রাখে।
মা তো আজও মিথ্যে বলতে থাকে।

 একটি কবিতা
 পিনাকী দত্তগুপ্ত

নোলকের গায়ে লেগে অন্ধকার সোহাগি কাঞ্চন... 
এখনও কুয়াশা লেগে আছে তার কৃষ্ণচুড়ায়... 
কিছুটা অস্পষ্ট তবু ক্রমে ক্রমে শিথিল গ্রীবায়... 
অবিন্যস্ত কিছু আঙুলের ছাপ, 
কিছু প্রেম, কিছু ঘৃণা, পাপ - অনুতাপ... 
এখনও অরণ্যের সুগভীর অন্তরাল খুঁজে নিয়ে 
নপুংসক চিতা ওত পেতে আছে, 
তিস্তার বুকে লেগে আছে তার থাবার আঁচড়।

 অমর ২১শে 
 কেকা সেন

 সূর্যের ঠোঁট ছোঁয়া লালিমা, যেমন
সবুজ শরীরকে স্পর্শ করে ছড়ায় মিঠে আবেশ 
সদ্য ঘুম ভাঙা পাখীর আধো বোল যেভাবে
আলোর স্নানে পার হয়ে যায় দিগন্তের সাদা ঢেউ 
কাজল কালো দীঘির গভীর বুক, 
যেখানে বাজে হেঁটে যাওয়া জলছবির ছলাত বন্দিস 
মাটির দাওয়া জুড়ে পাক খায় 
টগবগে মাতনে ফেনিল আমনের মৃদু বাস 
কলের ধোঁয়ায় জীর্ণ প্রেম ছোটে রূপোলী নদীর বাঁকে  
তখনি  তুমি মিঠে আবেশে, সাদা ঢেউ-এর ছলাত বন্দিসে 
কিংবা আমনের মৃদু বাসে,
চাঁদের  আঁচল হয়ে ভেসে যাও নক্সী কাঁথার মাঠে, 
কলমের অনুভবে কথাগুলো লিপি হয়ে যায় , 
ইতিহাসে রয়ে যায় স্মৃতির লাল দাগ--- " অমর ২১শে "

 আ মরি,বাংলা ভাষা
প্রত্যূষ কর্মকার

 ভাষার প্রেমে আজ প্রসেশন মুখ্য 
পতাকা মশাল তুলে পাবে কিছু সুখও 
কে বা কারা মরেছিল বরাকে বা ঢাকাতে 
জানতে লাগেনা সেটা মিছিলে পা মেলাতে 
যে মাটিতে রক্তের ছাপ দেয় সাক্ষ্য 
অ আ ক খ ব্রাত্যই,টি আর পি লক্ষ্য 
মাইকে শ্লোগান ভাসে-ভাষাকে বাঁচাও 
চোখ দুটো ফেটে আসে,বুকের খাঁচাও 
ভেজা চোখে সুখী সুখী,বাহ দেয় অনেকে 
বাংলাটা ঝুলে থাকে মঞ্চের মাইকে 
স্যুটেড আমার ছেলে,ইংলিশে গড়গড় 
তোরা শোন বক্তৃতা,বাংলায় তোরা মর 
নেহাত বন্ধ্যা নও তুমি হে জননী 
দিয়েছো অনেক কিছু,সবটা দ্যাখো নি 
রফিক আবুল আর আব্দুল জব্বার 
বলে গেছে দৃঢ় হও,দিন নয় কাঁপবার 
তোমার গর্ভে ফলা এমন রতন 
চাইছি আবার কিছু এদেরই মতন, 
অ্যাকাডেমি নন্দনে অযথাই হেঁটো না 
মগজে সহজপাঠ রাখো,বিদ্রূপ  না 
ঠিকানা আমার দেখো বাংলা দিয়েছে 
বাংলা আমার ভাষা-জন্ম বলেছে।


শপথ 
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার   

ভাষার জন্য আকাশ শিমূল 
ভাষায় জীবন গড়তে পারি
বাংলা মায়ের রক্তে লেখা
অমর একুশ ফেব্রুয়ারি 

জব্বার আর শফিক রফিক 
বরকত আর সালাম জানে
মায়ের ভাষা মায়ের আঁচল
তোমার আমার বাঁচার মানে

বাংলা আমার ভালবাসায়
বাংলা আমার আর্তনাদে
বুকের গোপন স্বপ্ন চেনার
আখর শিখি বাংলা ছাঁদে

রক্তফুলের পাপড়ি আঁকা 
শহীদ তোমার কলজে জুড়ে
তোমার জন্য দেশ বিদেশে
ভাষার জয়ের নিশান ওড়ে

আজকে শপথ তোমার নামে
মায়ের জন্য লড়াই জারি
বাংলা আমার কণ্ঠ কলম
মায়ের জন্য মরতে পারি।

Sunday, 28 January 2018

সাহিত্য এখন,জানুয়ারি ২০১৮

সাহিত্য এখন,বইমেলা সংখ্যা


সম্পাদকীয় 
বইমেলা আসছে।সাজো সাজো রব চারদিকে।অসংখ্য নতুন বইয়ের খবর পাচ্ছি। তাদের মধ্যে কেউ কি বেস্ট সেলারের দলে নাম লেখাতে পারবে?পুরনো বেশ কিছু বই এখনও সেরাদের তালিকায় স্বমহিমায় বিরাজমান।  এবছরও কি বজায় থাকবে তাদের দাপট? এইসব হাজারো প্রশ্ন মনের কোণায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছে।বইমেলা যতই স্থান বদল করুক, আমরা পুরোদস্তুর মেলাতেই আছি।

মেলার কথা ভাবলে এখনো ময়দানের সেই পুরনো ধুলো ধুলো গন্ধটা নাকের ডগায় এসে সুড়সুড়ি দেয়। সেই ভস্তকের দরজায় কেমন হুড়োহুড়ি করে  ভীড় জমাতাম সস্তায় গোগোল,তুর্গেনিভ,টলস্টয়কে পকেটে পুরব বলে... স্টলে দাঁড়িয়ে অর্ধেক বই শেষ করে ফেলতাম।নতুন বই পড়ার আনন্দে দিব্যি হজম করে ফেলতাম বোম্বাই গুঁতোগাঁতা। আচ্ছা,এখনো কি কম বয়েসীরা এভাবেই বই পড়ে? ছোটরা? খুব জানতে ইচ্ছে করে।কিন্তু আগের মত প্রতিদিন বইমেলা চষে ফেলার সময়টা কখন যেন বাড়ির কচিকাঁচাদের পরীক্ষার সিলেবাসের তলায় চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে পড়ে আছে।সাধ থাকলেও তাকে উদ্ধার করার সাধ্য নেই।

তবু এরই মধ্যে যেটুকু খবর কানে আসছে, মানুষ আবার বইমুখো হচ্ছেন। অনেক বেশি মানুষ কলম ধরছেন,পড়ছেনও। আমার আপনার মত বইপোকাদের জন্যে এসব খবর সুসংবাদ বইকি।তবে ছোটদের জন্যে তেমন করে কলম ধরছেন কি কেউ? তাদের বোকাবাক্সের আর ভিডিও গেমের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য সুপারম্যানের মতই একজন সুপার অথরের অপেক্ষায় রইলাম।বইমেলা ভাল কাটুক।দেখা হবে।



মনের কথা(৫)
সৌরভ ভট্টাচার্য

‘দেশ’ পত্রিকার এবারের সংখ্যাটা হাতে পেলাম। রামকৃষ্ণদেবের অপূর্ব একটা ছবিতে মন আটকালো। লেখাগুলো মন দিয়ে পড়লাম। প্রথম লেখাটা নিয়ে কিছু বলার নেই, অর্থাৎ মার্টিন কেম্পশেনের লেখাটা, কথামৃতের অনুবাদ সংক্রান্ত।
     পরের লেখা দুটো ভাবালো। রামকৃষ্ণদেবের ছবি বাঙালী পরিবারে জন্মসূত্রে ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি। মাঝখানে মা-কালীর দু’পাশে রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী আর সামনে বিবেকানন্দ। বাবা প্রণাম করে অফিস বেরোতেন। মা স্নান করে প্রণাম করতেন। তারপর ঠাকুমার লেজুড় হয়ে থাকার সুবাদে বাংলা সিনেমায় রামকৃষ্ণের চরিত্রায়ণ দেখলাম। বুঝলাম ঈশ্বর এক, এই ওনার সব চাইতে বড় উপলব্ধি – যত মত তত পথ। তারপর স্কুলের কর্মশিক্ষা পরীক্ষায় প্লাস্টার অব প্যারিসে সবচাইতে পপুলার ছিলেন রামকৃষ্ণদেব। তাই লাগানো হল। শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কেন বিখ্যাত ছিলেন? উত্তর দিলাম, যত মত তত পথ বলেছিলেন। কিন্তু সেইটা উপলব্ধি করে জগতে যে কি উপকার হল তা বুঝিনি। শিক্ষক বললেন, শুধু তাই নয়, তিনি মা কালীর দর্শন পেয়েছিলেন। সেই কথা শুনে যতটা না শ্রদ্ধা জন্মালো, তার চাইতে বেশি জন্মালো কৌতুহল।
    তারপর পড়াশোনা বাড়ল। ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে। অবশ্যই আউট অব সিলেবাসের পড়া সেগুলো, কারণ নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সেদিন পড়েছিলাম, রামকৃষ্ণদেব ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ করেছিলেন; আজও ‘দেশ’-এ সেই কথাটার উপরেই সব চাইতে বড় জোর দেখলাম। সেদিনও বুঝিনি, আজও বুঝলাম না, তাতে কি লাভ হল? কথামৃত ভারতের নানা ভাষায় অনূদিত হল, প্রচুর রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা-উপশাখা খোলা হল। কত বড় বড় নামধারী শিক্ষিত কৃতী সন্তানেরা সন্ন্যাসী হল, কত লেকচার হল, কত অধিবেশন হল, কত বই লেখা হল, কত সেই বইগুলোর উপর বই লেখা হল...
     তাতে কি হল?
     ভারতের আজকের অবস্থানটাই কি তার যথেষ্ট নিষ্ফলতার প্রমাণপত্র নয়? কতগুলো দাঙ্গা হয়ে গেল ধর্মের নামে। আজও কত জায়গায় গনগনে আগুনের তাপ - ফুঁসছে সব। সলতে পাকানোই আছে, শুধু ফুলকির অপেক্ষা। কোথায় ‘যত পথ তত মত’-এর নমুনা? সেকি শুধু পাণ্ডিত্যের আর লেকচারের বিষয়? তবে গোলমালটা কোথায় হল?
     অনেকেই দোষটা রাজনীতির ঘাড়ে চাপিয়ে দায় এড়াতে চাইবেন। কিন্তু অতটা সরলীকরণের জায়গায় দাঁড়িয়ে কি আমরা? নয় তো। গোড়ায় গলদটা তো রয়েই যাচ্ছে। সেটা কি?

     প্রথম কথা, ধর্মে কি কোনোদিন সমন্বয় সম্ভব? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ দুটোই। যা লালন পারেন, কবীর পারেন, সেই অর্থে রামকৃষ্ণ ব্যর্থ হন। তার কারণ, রামকৃষ্ণ যতই পৃথক ধর্মমত প্রবর্তন না করে থাকুন, কিন্তু তাঁকে নিয়ে একটা সম্প্রদায়, ‘মিশন’ তৈরি হয়েছে। একটা সম্প্রদায় ‘সব সম্প্রদায়’ সমান প্রচার করতে পারেন, কিন্তু সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ হতে পারেন কি? হতে পারে সেখানে খ্রীষ্টানের মত পঁচিশে ডিসেম্বর, বৌদ্ধের মত বুদ্ধপূর্ণিমা, প্রাচীন হিন্দুর মত দূর্গাপূজা ইত্যাদির প্রচলন আছে; তাতে করে পাঁচমিশালি একটা সংস্কৃতি হয়, যার কোনোটাই আসল নয়, কিম্বা কোনটা আসল এই প্রশ্নে মানুষ বিভ্রান্ত হয়; কারণ সবক’টাই যে ‘মতো’, আসল তো নয়। যে খাঁটি খৃষ্টান সে চার্চে যাবে, যে খাঁটি মুসলিম সে মসজিদে যাবে, সে কেন বেলুড়ে যাবে? সময় কাটাতে, কৌতুহল মেটাতে, বা একজন দু’জন হয়ত বা আসতে পারেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেটা একটা ‘মতো’, আসল নয়।
     রামকৃষ্ণদেব কি তাই চাইতেন? তার নামে মন্দির হয়ে এরকম একটা পাঁচমেশালি কিছু হোক? সর্বোপরি তিনি কি রামকৃষ্ণ মিশন চাইতেন? মনে হয় না। আমি কোনো মিস্টিক তথ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু তিনি কোনোদিন এই সব তিথি পালনের মাধ্যমে খুব সরলীকরণের মাধ্যমে ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর বার্তা পৌছাতে চেয়েছিলেন? এটা কিরকম সেই রাজনৈতিক কৌশলের মত না? রামকৃষ্ণদেব কিন্তু এরকম কোনো বাহ্যিক সমীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। এমনকি তাকে মার্কেটিং করতে যে এই ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর ব্র্যাণ্ড করা হয়, এটা সারদাদেবীরও খুব অপছন্দ ছিল। তিনি বলেছেন, কোন মতলব এঁটে উনি এগুলো করেননি, ওটা হয়ে গিয়েছিল, ওনার প্রধান শিক্ষা ছিল ‘ত্যাগ’।
     মিশন কিন্তু সে পথে হাঁটেনি। তারা আমাদের মন্ত্রীদের মত বড়দিনে যীশুর ফটো, শঙ্করাচার্যের জন্মদিনে শঙ্করাচার্যের ফটো, আর বুদ্ধের জন্মদিনে বুদ্ধের ফটো টাঙ্গিয়ে উৎসব করার চেষ্টা করে আসছে। পাশাপাশি কালী-দূর্গা-সরস্বতীও চলছে। আমাদের বোঝানো হচ্ছে, এটাই রামকৃষ্ণদেবের ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’; কিন্তু তিনি এত সস্তা পথে হেঁটেছিলেন কি? না। রামকৃষ্ণ মিশনের স্টলে আপনি কোরাণ, বাইবেল, ত্রিপিটক পাবেন কি? না। কারণ রামকৃষ্ণ ‘অবতার-বরিষ্ঠায়’, অর্থাৎ সুপারলেটিভ ডিগ্রি লেগে গেল। তিনি সব অবতারের ফুল প্যাকেজ, প্রচারিত হতে শুরু হল; এমনকি তিনি সব দেব-দেবীর মূর্তির প্রকাশ – তাও প্রচারিত হতে শুরু করল। অর্থাৎ আমাদের বোঝানো হচ্ছে, একটু ঘুর পথে, কে শ্রেষ্ঠ বুঝে নাও। সুবিধা করে দিল কথামৃত – আকবরী আমলের টাকা এখন চলে না, এখন ফিভার মিক্সচার, পাঁচন না – ইত্যাদি উপমারাই রামকৃষ্ণের শিক্ষার উপর পুরো পাথর হয়ে বসল। শেষ পেরেকটা মারল রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষা পদ্ধতি। সেখানে যতই সর্বধর্মের সমন্বয়ের গল্প শোনানো হোক, মন্ত্র হয় রামকৃষ্ণদেবের নামেই প্রধান, কদাপি সারদাদেবীর নামে। সে আপনার যে দেবতাতেই অভিরুচি হোক। কারণ রামকৃষ্ণই সব – প্রধান। কি ভাবে একটা উদারতার ছদ্মবেশে গোঁড়ামি বাসা করছে দেখুন। ধর্মের ক্ষেত্রে এটাই চিরটাকাল হয়ে এসেছে, old wine in new bottle. তাই এবারের ‘দেশ’-এও যখন সুমন সেনগুপ্ত তার লেখার শেষ লাইন লিখছেন – “শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই এর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। শ্রীরামকৃষ্ণেই তাই মানবমুক্তি”, আমার কষ্ট হয় রামকৃষ্ণদেবের জন্যেই। এতটাই কি বোকা আমরা? কিসের ছদ্মবেশে কি বিষ গেলানো হচ্ছে বুঝি না? কবীর, শিরডির সাঁই, লালন – এরা কি শিক্ষা দিলেন তবে এই ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে?
     এতেই যত ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। রামকৃষ্ণ ক্যালেণ্ডারে এলেন, প্লাস্টার অফ প্যারিসে এলেন, সিনেমায় এলেন - কিন্তু জন-চেতনার গভীরে এলেন না। কারণ তাঁকে নিয়েই যে দল আজ। মঠ আজ। আরেকটা কথা বলে প্রসঙ্গের ইতি টানি – জীবসেবা যতই রামকৃষ্ণের শিক্ষা বলে চালানো হোক, আদতে তা নয়। পুরো কথামৃতই তার সাক্ষী। তিনি প্রাচীন ভারতের প্রধান ধারায় যে ভক্তি-জ্ঞানমার্গের কথা, তার পথচারী। নারদীয় ভক্তি, অদ্বৈতজ্ঞান ইত্যাদির পরিচায়ক, সমন্বয়কারী তো বটেই। একজন ভক্ত যখন সব অর্থ দিয়ে হাসপাতাল বানাবার কথা বলেন, রামকৃষ্ণদেব তাকে বিরত করেন। বলেন, ওসবের জন্য মানুষের জীবন না, তুমি ভক্তিলাভের সাধনা করো। এর অর্থ এই নয় যে উনি সেবার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু তাকেই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য করার পক্ষপাতী ছিলেন কি? ‘জীবেসেবার মাধ্যমেই আত্মার মুক্তি’ এটা পাশ্চাত্যের ধর্মের মূল সুর, যা তার প্রধান শিষ্যদ্বারা প্রচারিত। একসময় মঠে এই নিয়ে মেলা সমস্যাও হয় গুরুভাইদের মধ্যে। সারদাদেবী একটা মধ্যস্থতা করেন।
     তাই মনে হয়, আদতে রামকৃষ্ণদেব বলতে যা বুঝি তা দক্ষিণেশ্বরের ঘরে গেলে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে। তার নামে যে মিশন সে একটা পাঁচ-মিশালী সুকৌশলী প্রতিষ্ঠান। মোড়কটা অত্যন্ত উদার, ভিতরে তাই কি? সেইখানেই হল বিভ্রান্তির চূড়ান্ত। সত্যের যে জোর, কৌশলের সে জোর কি আছে?
     ‘Fact’-এর ব্যাখ্যা বদলে দিলে মাঝে মাঝে তা ‘আলোকে যে লোপ করে খায়, সেই কুয়াশা সর্বনেশে’ হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় রামকৃষ্ণদেবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কোথায় যেন একটা গোঁজামিল।

 মনের কথা(৬)
চিঠি
সুরাইয়া বেগম

 অভিমানী,
আজকাল কেউ আর চিঠি লিখেনা । উতল মনে কেউ আর থাকেনা চিঠির প্রতীক্ষায় । একটা সময় ছিলো যখন হোস্টেলে থাকতাম- উদগ্রীব হয়ে থাকতাম এই বুঝি ডাকপিয়ন ডেকে বলবে- ২২ নম্বর রূমের চিঠি এসেছে । নারে , আজকাল মানুষ ভুলেই গেছে চিঠি লেখার কথা । কেন লিখবে বল- ইচ্ছে করলেই মুঠোফানে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যায়, ফেসবুক ইনবক্সে চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যায় । তবুও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে শুয়ে শুয়ে চিঠি পড়ি । কাউকে দু' কলম লিখি মন খুলে । আজ তোকেই লিখছি । পড়িস সময় করে ।
কতগুলো বসন্ত চলে গেল জীবন থেকে , তাই নারে ! মনে হয় এইতো সেদিন জন্মেছিস । মেঘনার তীরে - আমাদের বাল্যস্মৃতির সবটুকুন নিয়ে যেই বাড়িটি চিরদিনের মতন তলিয়ে গেল , সেই বাড়িতে তোর জন্ম। ঠিক কোন এক বছরের এই দিন সন্ধ্যায় তোর জন্ম হলো । ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত, দুটো পা , ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা ছোট্ট একটা মানুষ ! কি বিস্ময় , কি বিস্ময় ! ছোট্ট আমি নেড়েচেড়ে দেখি তোর হাত , ধরে দেখি তোর পা । আহা ! এতো ছোট বুঝি মানুষ হয় ? একটু ক্ষিধে পেলেই চিৎকার করে ওঠে ওই ছোট্ট মানুষ ! ভীষণ ভড়কে যাই ছোট্ট আমি । সেই পুঁচকে মানুষটা বড় হতে লাগলো আমার হাত ধরে । খুব শখ করে কোলে নিতে চাইলে - বড়রা কেউ খাটে আমাকে বসিয়ে দিতো । তারপর তোকে আমার কোলে তুলে দিতো । ছোট্ট তুই আমার কোলে হাত পা নেড়ে জানান দিতি তোর অস্তিত্ব ।
খুব অভিমানী ছিলি সেই ছোট্টবেলা থেকে । বাবা তোকে ডাইনিং টেবিলের কোণায় তার বা পাশে তুলে বসাতেন । তারপর প্লেটে ভাত মেখে তোকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন । ভীষণ আহ্লাদী ছিলি , কথায় কথায় মুখ ভার হয়ে যেত । মাঝে মাঝে খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যেতি না খেয়ে । তোর উঠে যাওয়া দেখে বাবারও যে খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত ! আম্মা খুব একটা পাত্তা দিতেন না এসব রাগের । বলতেন- ক্ষিধে পেলে ঠিক খাবে ।
একবার কি হলো তোর মনে আছে ? মেঘনা নদী দেখতে যাবো বলে পুরো একটা পুঁচকের দল নানা বাড়ি থেকে রওয়ানা করলাম । আমাদের সাথে তুইও আছিস । তুই সাঁতার শিখিস নি । পানিতে তোর ভীষণ ভয় ! অথচ সেই মানুষ কিনা সবার সাথে চললো নদী দেখতে ! আমরা বাকিরা সবাই সাঁতার জানি । হাঁটছি তো হাঁটছি ! হঠাৎ সামনে পড়লো ছোট্ট একটা খাল । খালের উপর বাঁশের সাঁকো । সেই সাঁকো পেরিয়ে নদী বুঝি আর দেখা হবেনা আমাদের ! সাঁকো তো পাড় হওয়া সম্ভব নয় ! ওতোদূর পথ যেয়ে ফিরে আসবো , সবার খুব মন খারাপ হলো । শেষে একটা সিদ্ধান্ত হলো- নৌকা দিয়ে আমরা খালটা পার হবো । সবাই নৌকায় উঠে বসলো । মাঝি নৌকা অন্যপাড়ে ভিড়াবার আগেই পুঁচকের দলের কেউ একজন লাফঝাঁফ দিয়ে টালমাটাল করে দিলো নৌকা । সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করে উঠলো ভয়ে । আমি তো ভীষণ ভড়কে গেলাম ! তুই সাঁতার জানিস না । চিৎকার করে কাঁদতে লাগলি। পানিতে পড়ে গেলে ঠিক ডুবে যাবি । তোকে তো আর খুঁজে পাবোনা । তোকে হারানোর ভয়ে লাফ দিয়ে আমিই পানিতে নেমে গেলাম । দু' হাত দিয়ে শক্ত করে নৌকাটা ধরে রাখলাম । কোন রকম সেই যাত্রায় রক্ষা পেল নৌকা । তীরে ভেড়ানো হলো । সবাই নৌকা থেকে নেমে গেল । আমি ভেজা শরীরে তোকে জড়িয়ে ধরলাম । সেই দিনের মতন ভেস্তে গেল নদী দেখা । প্রচন্ড শীতে ভেজা কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ফিরলাম- না জানি আম্মা বুঝি আজ মেরেই ফেলবেন ! কিন্তু না । আম্মা দুজনকেই কাছে টেনে নিলেন । একটুও বকলেন না আমাকে ।
যেদিন ছোট ভাইটার জন্য সাইকেল কেনা হলো - কি যে আনন্দ আমাদের পুরো পরিবারে । দুই চাকার সাইকেলে আরো দুটো সাহায্যকারী চাকা । তাই নিয়ে তুমুল হুটোপুটি । কিছুক্ষণ তুই চালাস, কিছুক্ষণ ভাই চালায় । আস্তে আস্তে সাহায্যকারী চাকাদুটো ভেঙ্গে গেল । কি মুশকিল ! এখন আর তোরা দুজন সাইকেল চালাতে পারিস না । তোদের সাইকেল চালানো শেখাবার দায়িত্বটা আমিই নিলাম । সিটে বসিয়ে পেছন থেকে সাইকেল ধরে রাখি । তুই চালাতে থাকলি , আমি সাপোর্ট দিয়ে গেলাম । বলতাম- সামনে তাকিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যা , আমি ধরে আছি । তুই প্যাডেল মেরে যেতি - জোরে ছুটতো সাইকেল । আমি পিছনে পিছনে দৌড়ে দৌড়ে একসময় ছেড়ে দিতাম । তুই ঠিক চালিয়ে যেতিস নির্ভয়ে । কারণ তুই জানতি- তোর পেছনে তোর বড় বোন তোকে ধরে আছে, কিছুতেই তোকে পড়তে দেবেনা । যাতে সাইকেল থেমে গেলে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে না যাস তাই দৌড়ে দৌড়ে তোর সাইকেলের সাথেই থাকতাম। একদিনেই শিখে ফেললি সাইকেল চালানো । তোকে, ভাইকে আমি সাইকেল চালানো শিখিয়েছি- অথচ দেখ ! আমি নিজে সাইকেল চালাতে জানিনা । খুব আফসোস হয় আজ !
কত কিছুই না আজ মনে পড়ছে ! নারে সব লিখতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে । যেদিন তুই বেনারসি জড়িয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলি- আমার বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল । সারারাত এক ফোটা ঘুমাইনি আমি । রান্না ঘরের জানালা ধরে কত দিন যে অঝরে কেঁদেছি ! ঘরের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল । আমিও সব কিছুর মাঝে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম ।
এখনো কি সেই রকম অভিমানী আছিস ? একটু দুঃখ পেলে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলিস ? বুঝিরে ! সন্তান লালনপালন, সংসারের ঝক্কি ঝামেলা সামলে কখন আর অভিমান করবি ? হয়তো যখন বারান্দায় বসে থাকিস কোন একলা বিকেলে অথবা বৃষ্টিভেজা কোন সন্ধ্যায় - চোখের সামনে ঠিক শৈশব এসে ডানা ঝাপটায় । তাই নারে ? হয়তো মেঘনার অতলে হারিয়ে যাওয়া নানা বাড়িটা - যেটা আমাদের দু' জনেরই জন্মস্থান , খুব মনে পড়ে । ভালো থাকিস, খুউব ভালো ।
আপু

রম্য রচনা
গুরুত্ব
প্রদীপ গুপ্ত

কারা যেন তাদের গুরুত্ব নিয়ে খুব চিন্তান্বিত থাকে। বেশী বেশী করে  নিজেদের উপস্থিতির প্রদর্শন করে বোঝাতে চায় তাদের অপরিসীম গুরুত্বের কথা। তুমি ধরো ফুলের দোকানে দাঁড়িয়ে আছো, ফুল নেবে বলে, ধরো তোমার সামনে আরও জনাকয়েক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। দোকানি এক এক করে সব্বাইকে কার গাঁদা ফুলের মালা লাগবে, কার রজনীগন্ধার, কার আমসরা লাগবে তো কার পান আর কলা, সেসব জনে জনে জিজ্ঞাসা করে ক্যারিব্যাগে ভরে এগিয়ে দিচ্ছেন, এমনি সময় তিনি এলেন,
" কিরে স্যপন্ আজ কি দেরি করে এস্যেচিস নাকি? এত্তো লোক দাঁড়িয়ে লাইনে? "
দোকানি তার কাজ করে চলেছেন, মানুষজনেরা তাদের মতোন দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি হামলে পড়লেন দোকানে। একটা আমসরার বান্ডিল খুলে চারিদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে নিখুঁত পল্লব বাছতে লাগলেন।বেলপাতার ডাল থেকে বেলপাতা ছিঁড়ে নিয়ে খালি ডালটা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের দিকে ফেলে ডায়লগ দিলেন -
" নে নে, -- তাড়াতাড়ি দেতো , দশটার ভেতর আবার অপিস ঢুকতে হবে, এইনে -"
                  বলে হাতে ধরা বেলপাতা, আমপাতা এগিয়ে দিলেন। মানুষজন একটু এ ওর দিকে তাকালেন, মুখ থেকে চুকচাক শব্দ করলেন, কেউ একটু বদন বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসার চেষ্টা করলেন, দোকানি হাত বাড়িয়ে পাতাগুলো নিতে যেতেই একজন মানুষ ঠান্ডাকঠিন গলায় বলে উঠলেন --" স্বপন, লাইন অনুযায়ী দাও, এখানে কেউ ঘোড়ার ঘাস কাটতে আসেনি। সব্বারই হাতে কাজ আছে, তাড়া থাকলে কাল সকাল সকাল আসতে বলো। "
লাইনটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। মুখ বাঁকানো লোকটা অস্ফুটে কিছু একটু বললেন, দোকানী র হাত ফের আগের মতই চলতে লাগলো।

             একদিন বাজার করে ফিরছি রাস্তায় মুকুন্দের সাথে দেখা। আরে সেই মুকুন্দ যে আমাকেও তারই মতো পাগল না ভেবে তার মতোই সুস্থ মানুষ মনে করে।
--" কি একটু ঠান্ডা পড়ছে মনে হচ্চে? "
আমি শুধোই।
--" তা একটু তো বটেই। এখন অর্জুনগাছের ছাল ফাটতে শুরু করবে বুঝেছো? "
--" তাই? "
আমি উত্তর করি। যেন একটা খুব গূঢ় কথা বলছে এভাবে সামনে এগিয়ে এলো মুকুন্দ --
" সূর্যটা দেখবে এখন একটু ইচ্ছে করেই মিঠেকড়া রোদ ঢালবে, যেমনি গ্রীষ্মকালে শীত ডানা মেলে সাইবেরিয়া পালায়, আসলে প্রকৃতিও জানেন কাকে কখন কতটুকু গুরুত্ব দিতে হয় বুঝেছো? "
-- " তুমি বলবে আর আমি বুঝবো না? "
আমি হাঁদারামের মতো মাথা নেড়ে তাল মারি।
--" এই আমি চলি বুঝেছো? আমার আবার --"
বলে মুকুন্দ হনহন করে হাঁটা লাগায়। আমি পরিস্কার বুঝতে পারি মুকুন্দও তার গুরুত্ব বুঝেই হাঁটা লাগালো। আমি হাঁ করে তার চলে যাওয়ার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করি।

অনুগল্প

শিরদাঁড়া
দিব্যায়ন সরকার


“ আলো - আঁধারির খেলা, তীব্র উৎকট দুর্বোধ্য গান আর বিলিতি মদের উগ্র গন্ধ - সব মিশিয়ে একটা অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়েছিল সৌমেন। সমস্ত ডিস্কো বারটা যেন বিদ্রুপ করছে তাকে ! অ্যালকোহল বারৈর সুদৃশ্য কাউন্টারের ওপারে সুন্দরী অ্যাটেন্ডার, তারও ওপারে দামী মদের বোতলগুলো - সবাই মিলে একসঙ্গে চতুর্দিক থেকে চেপে ধরছে তাকে।

এই ডিস্কো ব্যাপারটার সঙ্গে প্রথমবার পরিচয় সৌমেনের। মফঃস্বলের ছেলে চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালোরে আর বন্ধু সূত্রে এখানে। গৌরব আর শ্যামানুজের চাপাচাপিতে কিছুটা কৌতুহলি হয়েই এসেছে। গৌরব আবার বদান্যতায় তার ভাড়াটাও দিয়ে দিয়েছে ঢোকার সময়। এক রাতের ফুর্তির জন্য অতগুলো টাকা ঢেলে দেওয়া দেখে কিছুটা শিউরেছিল সৌমেন, কিন্তু টাকাটা তার পকেট থেকে যায়নি জন্য চেপে গিয়েছিল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই অ্যালকোহল, সোডা আর রকমারি পারফিউমের ঝাঁঝালো গন্ধে নাক কুঁচকে গেলেও সহ্য করে নিয়েছে।

ঢোকার পর হয়তো মিনিট পাঁচেক বসেছে একটা টেবিলে, হঠাৎ দুজন 'স্বল্প বসনা'র আগমন। গৌরব ও শ্যামানুজের সঙ্গে বেশ রসিয়ে গল্প শুরু করেছিল। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল তারা পূর্বপরিচিত। সৌমেনের সাথে পরিচয় করিয়েছিল শ্যামানুজ। কিছুক্ষণ সৌমেনকে আগপাশতলা মেপে একটা অর্থপূর্ণ হাসি হেসেছিল দুজনে। সৌমেন প্রথমে কথা বলেছে দু একটা, তারপর নিজেই আগ্রহ হারিয়েছে।

বারের সামনে দাঁড়িয়ে ড্যান্সবারের দিকে তাকিয়েছিল সৌমেন।  তার দুই বন্ধুকেই চোখে পড়ছে, দুই সুন্দরীর কোমর জড়িয়ে নেচে যাচ্ছে দু'জনে। কিছুটা দেখেই চোখ ক্লান্ত হয়ে গেল, বুঝে এল ধীরে ধীরে।

আচমকা পিঠে এক আলতো টোকায় ফিরে দাঁড়াল সৌমেন। উজ্জ্বল নীল দুটি চোখ যেন গিলে খেতে চাইছে তাকে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাবেনা।  চোখ দুটির মালকিন আরও কিছুটা সরে এসে নাকিসুরে প্রশ্ন করে -
- “ আর ইউ সিঙ্গল ? ”
বিভ্রান্ত লাগে সৌমেনের। এতটা কাছ থেকে অচেনা এই অল্প পোশাক পরিহিতাকে দেখে কিছুটা থ' খায়। চোখে মুখে উগ্র মেকআপে, পারফিউমের জ্বালাময়ী গন্ধে দিশেহারা লাগে তার।
- “ হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ' সিঙ্গল' ?  আই কেম হেয়ার উইথ টু অফ মাই ফ্রেন্ডস।”
বেগুনি ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এসেই মিলিয়ে গেল, যেন বলতে চাইল - 'ন্যাকা !  বোঝে না কিছুই।'  কিন্তু দ্বিতীয় কথাটি বলার আগেই গৌরবরা এসে পড়ল সদলবলে।
- “ ওহ রিমলি ইউ আর লুকিং গরজিয়াস টুডে।”
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ঝড়ে পড়ল শ্যামানুজের গলায়। “ ইউ মেট সৌমেন? মাই ফ্রেন্ড অ্যান্ড কলিগ।”
সুতীক্ষ্ণ কটাক্ষের দৃষ্টিতে সৌমেনকে আর একবার মেপে নেয় রিমলি। তারপর পরিস্কার বাংলায় বলে,
- “তোমাদের এই খোকাটি তো কিছুই নিচ্ছে না। তাই আমিই এগিয়ে এলাম মানুষ করতে।”
হো হো হাসির হুল্লোরে ভেসে যাচ্ছে ওরা। সৌমেন কিছুই বলল না। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের একনিষ্ঠ পাঠক, চারপাশের পরিবেশ থেকে লক্ষ যোজন দূর তার দুনিয়া।
- “ কাম অন সৌমেন, এবার একটা হুইস্কি নিতেই হবে কিন্তু। মান বাঁচাতে।”
গৌরবের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল একবার সৌমেন। তার দিকে এগিয়ে আসা হাতের গ্লাসটিতে সোনালী তরল। হাতের আঙুলগুলির বাঁকানো ভঙ্গী, নখ থেকে ঠিকরে আসছে নেলপালিশের নকল রঙ। সাদা ফ্যাকাশে হাতে একটা দামী সোনার বালা। সৌমেনের হঠাৎ মনে হল ঐ রঙটার মতো এই দুনিয়াটাও নকল। বিরক্তর ভঙ্গিতে ঠেলে গ্লাসটিকে সরিয়ে দিল এক ধাক্কায়।
- “ লেট ইট গো গৌরব, অনেক আগেই বুঝেছি তোমাদের বন্ধুটি পুরোপুরি অক্ষম।”
আর একবার হাসির লহরে ভেসে যায় ওরা। গৌরব - শ্যামানুজও গলে পড়ে। হাসি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল গৌরব। তারপর স্থির অথচ দৃঢ় গলায় বলল,
- “ আমার অক্ষমতা ক্ষমা করিস গৌরব। সত্যি আর পারছি না দাঁড়িয়ে থাকতে। আর আমার মান এত সহজে যায় না আর তা রাখতে মদ গিলতেও হয় না।  ইউ এনজয় ইওর পার্টি। থ্যাংকস। ”
মাথা উঁচু করে সোজা হেঁটে বেড়িয়ে যায় সৌমেন। বাকিদের বিদ্রুপ করা দৃষ্টিগুলি পেছনে ফেলে রেখে..... ”

  না ! কেন জানি না গল্পগুলো আর মিলছে না অপ্রতিমবাবুর। বইমেলা সংখ্যায় এত এত লেখার অনুরোধ কিন্তু আজব ব্যাপার দুধের মতো গল্পগুলোকে ক্ষীর আর করা যাচ্ছে না। শেষে এসে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে । তাহলে কি মা সরস্বতী  তার ওপর রুষ্ট, না তার সমস্ত লেখা ফুরিয়ে গেছে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মীরাকে এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দিলেন অপ্রতিমবাবু। নতুন উদ্যমে আবার শুরু করতে হবে যে।

কবিতা

সিন্দুক
বিশ্বজিৎ মাইতি

ঘূর্ণাবর্তে ধুয়ে গেল আরো একটা চাঁদ,
মন খারাপের গল্পটা আজ তবে থাক।
সিন্দুকে কটা অক্ষর তুলে রেখেছি,
চলো বরং তোমাকে গিয়ে দেখাই-
এই দেখো বাদামি রঙের অক্ষরগুলো,
অনেকটা ঠিক ঝরে যাওয়া মেইপল পাতার মতন দেখতে,
তাই না?
তুমি চাইলে ছুঁয়ে দেখতে পার,
আজ বিকেলে পথের ধারে কুড়িয়ে পেলাম আবার কয়েকটা-
ওদের নাম দিয়েছি অবসাদ।
ওই কোণে লাল দোয়াতের পাশে রাখা অক্ষরগুলো
তুমি দেখতে চেয়ো না,
ওগুলো গোছানো হয় নি এখনো।
ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে ‘শেষের কবিতা’ লিখব,
দেখো তোমার দেওয়া ঝর্ণাকলম হলুদ মলাটের খাতা
সব গুছিয়ে রেখেছি,
ওরা আমার অভিমান।
চোখ বন্ধ করে এবার হাত রাখ এখানে-
তোমার শীত করছে বোধ হয়,
শুনতে পাচ্ছ,
সরবতি লেবুর কচি পাতা বেয়ে
ঘাসের উপর গড়িয়ে পড়ছে হেমন্তের শিশির-
হরিণ শিশুর দল সানন্দে ছিঁড়ে খাচ্ছে সেই সুগন্ধি ঘাস,
বড় অদ্ভুত তার স্বাদ।
দেখেছো তোমার জানালার ফাঁকে
রোদ মেখে চেয়ে আছে অপলক
দুটি আকাশ রঙের ঘাস ফুল,
দেখেছো কি?
ও দুটি এই অধমের আঁকা,
ওদের নাম রেখেছি সুখ।

সন্তান
জগন্নাথদেব মণ্ডল

হীরাসায়রের অতল জলে গর্ভপাত হয় রাঙাবৌয়ের।নাকে নথ পরা কালবোশ মাছ নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে দিয়েছিল।পাঁকের নীচে তলিয়ে যায় সদ্যোজাত সন্তান।
জাল ফেলেও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

রানিদি রাঙাবৌয়ের বড়ো মেয়ে।দিদি সারারাত মরা জ্যোৎস্নায় গা চুবিয়ে 'ভাই ভাই' করে কেঁদে মরেছে হীরাসায়রের পাড়ে।

মৃত সন্তানটির পুরুষাঙ্গ মিশে গিয়েছে গেঁড়ি- গুগলির চোখের জলে।ওই গুগুলি ঠুকরে খায় হলুদ পায়ের ধলা হাঁস।

পুরুষাঙ্গ বাদে  কাদায় ঢাকা পড়া  নতুন নাভি অার নাসারন্ধ্র থেকে জন্ম নয় শাপলা ফুল।কুড়ানী মাসি ওই শাপলা ফুল দিয়ে ঢ্যাপের খই ভেজেছে।

রানিদি কোঁচড় ভর্তি খই নিয়ে দত্তদের বাড়ি চলে গেছে।ওদের সাদাকালো টিভিতে ' জন্মভূমি' দেখতে দেখতে মুঠো মুঠো ভাই-খই খাবে রানিদি।

সন্ধ্যের অাঁধার যেন প্রসব যন্ত্রণায় চুপ।সন্তান শোক অতিক্রম করা, স্থির রাঙাবৌ হাঁস তুলতে এসেছে হীরাসায়রের কিনারে।বৌয়ের একঢাল চুলে ছোট্ট একটু গিঁট বাঁধা।

সন্তানস্পর্শ মাখা গুগলি খেয়ে পেট ভারী হয়ে গেছে হাঁসগুলোর।কিছুতেই উঠে অাসছে না হলদে পায়ের ধলা হাঁস।

জলের ভেজাভেজা বাতাসে শুধু মৃত পুত্রের ঘ্রান।কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে রাঙাবৌয়ের চৈ চৈ ডাক।
জলপাই গাছ পেরিয়ে বুড়ো পিটুলি গাছের পাশ দিয়ে স্নান করতে অাসছে মালোপাড়ার গর্ভবতী লবঙ্গবউ।

   


  ফ্যাসিস্ট
  আর্যতীর্থ

দাও, পিষে দাও, চাপ দাও আরো।
ঘাড় গুঁজে দাও যতখানি পারো।
এদিকে ওদিকে সাবধানে দেখো, প্রশ্নরা কার চোখে।
কিভাবে সে জিভে লাগাম টানবে আগে থেকে ফেলো ছকে।

আভূমি করছে কুর্নিশ যারা,তারাই কেবল প্রজা। বাকিরা সবাই বিপজ্জ্বনক, নীতি এ সাপ্টা সোজা। তোমার খেয়ালে তালে তাল দিলে সেইজন ভারী প্রিয়। বিরুদ্ধমত অন্ধকূপের আঁধারেই রাখা শ্রেয়।

শিরদাঁড়াটির বদলে চেয়েছো কেঁচো ।
সঙ্গী সাথীও সেভাবেই বেছেছো।
অষ্টপ্রহর গুণকীর্তণে ভরিয়ে রেখেছো ঘর।
স্বভাবত তাই বিরোধীকণ্ঠ স্বপ্নের অগোচর।

অথচ সেসব দোষারোপ নয়, ছিলো শুধু অভিযোগ। দিনগত পাপে নিত্যকালের লেগে থাকা দুর্ভোগ।
সে সব নালিশ লেগে থাকে সব যাপনের ভাঁজে ভাঁজে। খামোখা তাদের চেপে রেখে দিলে তোমার হুকুমরাজে।

সিংহাসনকে জীবন ভেবেছো, স্বয়ংকে ভগবান।অমৃতজ্ঞানে তাই ভালো লাগে ক্ষমতার বিষপান। বিরোধী কথাকে বিদ্রোহ ভেবে পায়ের তলায় পেষো। কবে ভুলে গেছো সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের অভ্যেসও।

বড্ড দুঃখ, ইতিহাস পড়ো নি।
আঁধারের দিকে গিয়েছে ও সরণী।
সত্যি জানাবে কখনো তোমায় আয়না ।
সব শিরদাঁড়া ওভাবে নোয়ানো যায় না।


শুধু তোমার লেখার অপেক্ষায়
প্রত্যূষ কান্তি কর্মকার

কিছুই যদি না লেখা যায় তবে আবার বৈঠা ধরো কবি
পালের ডগায় বাতাস ভরে ঢেউয়ের সাথে মিতালী করো
যেমন ভাবে বইবে তোমায় তেমন তেমন ভাসতে থাকো,বাঙ্ময়তায় ভরিয়ে তোলো বেঁচে থাকার দিগন্ত রঙ,মুহূর্তের অবিন্যস্ত দীঘি
আমার সুন্দর নদীর পাহাড়িয়া জল তল পাবে বলে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমেছে
তোমার নৌকো বাওয়া সাগরের কাছে,ভাবি
মিটে যাবে বহু বছরের অবিশ্রান্ত জমে ওঠা ঋণ
তোমার বুকের ভেতরে ফানুসের মত কূল আলোময় ভেসে থাকে
জেগে থাকে একশ পাতার কলকাকলি, হাজার পাতার ছল,দূরে বসে দেখতে দেখতে
দুঃখ আর মায়ার ভরে যায় বিকেলের গোধূলি রঙিন হাত
হলুদ ঠোঁটের থেকে প্রয়োজন ঝরে যায় ধূ ধূ শোওয়া মাঠের কোণায় কোণায়
আমি প্রতি বসন্তে জমিয়ে রাখা রাত্রির কণা জুড়ে গড়ে ফেলি দীর্ঘ উঠোন
শুধু তোমার লেখার অপেক্ষায়,কবি,আমার অঙ্গনে সন্ধ্যার ধূপের গন্ধ ওড়ে না

মাথুর
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

বনপলাশীর বনে তোমার ছাতিম গন্ধ মনে পড়ে
এখনি কি ফিরে যাবে হৃদি?
ছন্নদেহ বসে আছি বিষণ্ণ বনে
দূরাগত আমার বঁধুয়া,
আতুর পাখিটি দেখ ডাক দিল কার নাম ধরে
কাঁখের কলসে ভরে আকুলা নদীটি ঘরে গেল
অতসী অমিয়মাখা মুখখানি আহা
গ্রামের বধূটি,পায়ে চুম্বনের দাগ
কবে তুমি ডাক দেবে
দেহি পদ পল্লব বলে...