Monday 19 October 2020

মাধবী দাস,কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 



রক্তপাত


তোমার চোখের জল আমার বুকের রক্তপাত 

বট-ঝুরিটির পাশে রিদমিক আলো ফেলে ফেলে

উদাস কোরো না 

বুক পোড়া ঘুড়িটি তো ইমোশন ছিঁড়ে 

কবে উড়ে গেছে...


ঝলসানো আয়নার ঠোঁটে লাইট ক্যামেরা ফেলে ফেলে 

টিউলিপ আঁকার দিনে ঘন হয়ে আসে মিড-শট

জিরাফের মতো মাথা তুলে

বিবর্ণ ক্যানভাসে দেখি বিষণ্ন ফানুস


আলোর আন্দাজ ভুলে গিয়ে

অবিভক্ত দূরত্বের মানচিত্র আঁকি


মরতে মরতে বলে যেতে চাই

বন্ধ হোক গণ্ডিবাঁধা জীবনের সব রক্তপাত

সার্থকতা পাক এ মানুষ-জন্ম।


শ্যামশ্রী রায় কর্মকার, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


নাম

শ্যামশ্রী রায় কর্মকার 


মানুষ চেনার চিহ্ন খুঁজে খুঁজে বেলা বয়ে যায় 

কী দিয়ে চিনব তাকে

নাম?

লক্ষ্মী , লিলিথ, জন , মুহাম্মদ, রাম

নামের গোপন ভারে কারো কারো পিঠ ভেঙে পড়ে 

কারো কারো জাদু আয়নায় 

পলকে  বদলে যায় চেনা অবয়ব 


নামের শিকড় 

বেয়ে বেয়ে নেমে যাই অতীত গহ্বরে

একেকটি ইশারা  যেন

কালখণ্ড, স্রোত 

একেকটি শব্দের কাছে বারবার ফিরে যাই

শুনি

অহম, ঝড়ের রাগ, বিষাদ ও বিদ্যুৎ 









 

 

বিকাশ দাশ, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


বীর্য পুরুষ


 

যজ্ঞের অগ্নি থেকে

বেরিয়ে আসছে যে পবিত্র শব্দের উচ্চারণ

তাকে ধারন করার মতো দীক্ষিত মানব নেই দেখে

যিনি এগিয়ে এলেন তিনি এক বীর্যবান কবি।

এই বিরাট ভুবনের দায়ভার নিয়ে

বেদ ব্রাহ্মণ রূপে জাগ্রত হলেন সমাজে।

 

অথচ যিনি মহামন্ত্রোচ্চারণে কমণ্ডলু হাতে  

প্রলয় ওঙ্কার হয়ে দাঁড়াতে পারতেন

তিনি মৌনব্রতে ব্রহ্মকে তেজ রূপে ধারনে ব্যস্ত।

দধীচির যে হাড়, একদা যে সত্য রচনা করেছিল

সে বজ্র সংকল্পচ্যুত হয়ে

ভেসে যাচ্ছে অনন্তের গভীরে 

বহু বীর্যবান হারিয়ে যাচ্ছে ভুল ঠিকানায় ।   

 

অথচ একমাত্র বীর্যবানের বসার কথা ছিল পদ্মবেদীতে

আসন্ন যজ্ঞের পুরোহিত হয়ে ; 

সেই সংকল্পের চুল্লিতে এখন আগুন নির্বাপিত।  

 

যার ধীরজ কণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণে সমুদ্র থেকে

সজল শরীরে উঠে আসত মৎস্যগন্ধা ; 

অনুত সুখের ভেতর কবিতার বর্ণগুলি

দম্ভের সৌন্দর্য হয়ে ফুটে উঠত দু- একটি তারায় ; 

তিনি " জবা কুসুম সংকাশ্যং " - মন্ত্রোচ্চারণের আরম্ভ ছুঁয়ে

শব্দকোষ সাজাচ্ছেন চটুল ইস্তাহারে ; 

অবশেষে নতজানু হয়ে

আস্বীকার করলেন সমস্ত দায়ভার ।  

 

 

আগুন মায়ায় ছায়া ফেলে


কুসুম
  নিও না  কেউ  হাতে 
এখানে
  চুলের ঢেউয়ে কুসুম ভাসানো মানা 
আমাদের কুসুমিত মেয়েরা
 
বহুকাল
  পুষ্পরাগে সাজিয়েছিল দেহ 
মুখে লোধ্র রেণু ; হাতে লীলাপদ্ম
  ;
সেই শৃঙ্গার দেখে সাদা দেবলোকের ছিল অপাবৃত লোভ ।

আমাদের পুরুষেরা কুসুমের আগুনকে
 
বহুকাল বুক পেতে নিয়েছিল
 
আগুনের মশালকে হাতে নিয়ে হেমন্তের যুবকেরা
 
অরণ্যে অরণ্যে জ্বেলেছিল হা-হা দাবানল।
 

আমাদের মেয়েরা দেবদাসী ছিল না কখনো
আমাদের পুরুষেরা আসলে মর্ত্য দেবদূত।
 
ওদের নিহিত প্রেম কুসুমকে ঘিরে
ওদের নিহিত
  প্রেম আগুনকে ঘিরে 
এখানে কুসুম ফোটে না তারপর।
 

এখানে আগুন নেই জেনো
আগুনের গোধূলি আলোয় কিছু মায়া জেগে থাকে
ছায়ার মতন চিরন্তন।

কেকা সেন,কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

  


প্যান্ডেমিক


সময়ের যন্ত্রনা কাঁধে

কারা যেন হেঁটে চলে , রাত্রির ক্লান্ত জঠর

ঘামে ভেজা শরীর আর অবসন্ন ঝুলন্ত স্তনে 

লেগে আছে ছিন্ন জীবন 

ক্লান্তির করুণ জ্যোৎস্না তাদেরকে ঘিরে থাকে

নিরুচ্চার মন্ত্রে বাঁধা তাদের ভীরু চোখ।

দূরে কাঁঠালতলায় ভাতের গন্ধ তখন

একে একে খুলে যায় প্রাণিত গ্রন্থিগুলি

হাজার পদ্ম বুকে শূন্য দাওয়ার দিকে

হেঁটে যায় নষ্ট দুর্গারা।

মনীষা শেখ, গল্প, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০, ভাস্কর্যে রামকুমার মান্না,

 


একটি চেনাশোনা রূপকথা


আমাদের গাঁয়ে কোন নদী আছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন? 

আছে। নদীর নাম মধুমতী। গাঁয়ের নাম?  

মনে করুন গাঁয়ের নাম রানির বাজার। 

সেখানে বাপ মা ভাই বোনের সাথে থাকতাম। বাপের আমার কিছু জমি জায়গা ছিল। চাষবাস করে চলত। কিছু হাঁস-মুরগি পালতাম। বাড়ির উঠোনে মরশুমি  সব্জি।

 লেখাপড়া করেছি কিনা? তা একটু-আধটু করেছি। মাধ্যমিক পাস দিলাম। আরো পড়ার ইচ্ছে ছিল জানেন!

পড়লাম না কেন? 

বাবা খরচ চালাতে পারলোনা। মাধ্যমিকের পরে বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগল। ভাইটা বদসঙ্গে পড়ল। ছোট ছোট ভাই বোন আমি দেখতে কেমন বলুনতো?

কী বললেন? সুন্দরী!   সুতরাং গ্রামের ছেলেরাও পিছনে লাগবে। বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবা একে তাকে ধরে সম্বন্ধে আনতে লাগলো। সে একটা উত্তেজনার সময় জানেন! বয়সটা তো তখন কাঁচা তো! বিয়ে, স্বামী, নতুন জীবন সব কিছু নিয়ে একটা রঙিন জগতে যেন চলে গিয়েছিলাম। 

প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিন কোন না কোন পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসত জানেন! তারপর বাড়ীটা যেন বিয়ে বাড়ি হয়ে যেত বাবা-মা বসে বসে আলোচনা করত পাত্রের কি কি গুণ, বাড়ির লোকেরা কেমন, সেখানে আমার কেমন লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। 


মা আমাকে চুলোর ধারে যেতে দিত না আমার গায়ের রং ময়লা হয়ে যাবে বলে। বাবা অবসর সময় নানা উপদেশ দিত। শ্বশুর-শাশুড়িকে যত্ন করতে বলতো। এইভাবে কেটে যেত পনের দিন কি এক মাস। মনে করুন পাত্রপক্ষের গ্রামের বাজারে মুদির দোকান। এই কদিন আমি হয়ে যেতাম মুদির দোকানের বউ। কীভাবে চললে মুদি দোকানি খুশি থাকবে তাই ভাবলাম বসে বসে। নিশ্চয় দোকান থেকে দুপুরে  ভাত খেতে আসে। সুতরাং তাকে ভাল করে রান্না করে খাওয়াতে হবে। রান্না পছন্দ না হলে সে কি আমায় মারধর করবে? কল্পনায় মার খেয়ে কেঁদেছি কত! ভালোবাসার কথা, আদরের কথা ভাবতাম কিনা?

যাহ! আপনি না! 

এই আমি চুপ করলাম।

কী বললেন?  তারপর কি হল? তারপর মুদির দোকানীর পছন্দ হল না। এরপর হয়তো চালের আড়তদার।

তার বউ সাজার কল্পনা চলল আরও এক মাস। 

 এই ভাবেই নানা পেশার লোকজনের বউ সাজা চলতেই থাকল। কিন্তু বিনা পয়সায় বিয়ে করার লোক  পাওয়া গেল না। 

এভাবে বছর দুই গড়িয়ে গেল। বাবা-মার উৎসাহ অনেকটা কমে এলো। তারপর?  তারপর রোজ সূর্য উঠতে থাকলো আর ডুবতে  থাকলো। ছোট ছোট বোনেরা বড় হয়ে উঠল। পাত্রপক্ষের আনাগোনাও অনেক কমে গেল। যদিও বা আসে তারা আমার বদলে আমার বোনদের পছন্দ করতে চায়। আমার মা তাদেরকে লুকিয়ে রাখতে লাগলেন। তবু কি করে যেন তারা সব খবর পেতে থাকলো। এমনকি কেউ কেউ বিনা পয়সায় বিয়ে করতেও রাজি হয়ে গেল। কিন্তু বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না বড়কে বসিয়ে রেখে ছোটদের পাত্রস্থ করার কথা। 


তারপর? এরপরেও আপনাদের শোনার ইচ্ছা হচ্ছে?

এরপর আমার ভাই একটা মেয়েকে তুলে আনল। সেই নিয়ে দিনরাত অশান্তি। সেই মেয়ে কিছুদিন পরে স্ব মূর্তি ধরলো,  আর আমি হয়ে গেলাম দিন-রাতের দাসী। 


বিয়েটা কি করে হলো? সে এক গল্প। ভাইয়ের বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে একদিন এক লোক এলো। তার বউ নাকি এক বছর হল মরে গেছে। বাড়িতে মেলা বাচ্চাকাচ্চা। তার একটা বউ দরকার। বাড়িঘর দেখাশোনা করবে, বাচ্চা সামলাবে। বয়স বেশি হলে অসুবিধা নেই। এমনকি বিয়ের খরচ বাবদ কিছু টাকা দেবে বলেছে। 

বাবা খুঁতখুঁত করতে লাগলেন। দ্বোজবর, বাচ্চাকাচ্চা- কিন্তু আমি রাজি হয়ে গেলাম। বেঁচে থাকার জন্য তখন আমি খড়কুটো ধরতেও রাজি। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে জোগাড় যন্ত্র করে বিয়েটা চুকে গেল। 


তারপর? তারপর আর কি? লোকটা বলল, শিবানী! তোমার হয়তো আমাকে পছন্দ হচ্ছেনা। বুড়ো হয়ে গেছি তো। তা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে চলো দুজন কোথাও ঘুরে আসি। গেলে তো সেই সংসারের যাঁতাকলে পড়ে যাবে। তুমি কোনদিন সমুদ্র দেখেছ? একথা শুনে আমি লোকটাকে কেমন যেন ভালোবেসে ফেললাম।  

    আহারে! সদ্য বউ মরে গেছে। তাকে হয়তো এখনো ভুলতে পারেনি। এর মধ্যেই আবার আমার কথা ভাবছে। সমুদ্রে গেলাম কিনা? গেলাম তো। জায়গাটার নাম খুব সুন্দর। চাঁদিপুর। সেখানে স্বপ্নের মতো তিন-চার দিন চলে গেল। 

তারপর? তারপর আমার বর একদিন জরুরী কাজের শহরে গেল। সেদিন রাত্রে সেদিন রাত্রে চারটে লোক আমার ঘরে ঢুকে এলো। বললো, আমার স্বামী আমাকে তাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে এক লাখ টাকায়। এটাই নাকি তার পেশা। 

তারপর? তারপর আমি পালাবার চেষ্টা করলুম। চিৎকার-চেঁচামেচি করলুম। অনুনয়-বিনয় করলুম। কান্নাকাটি করেও পার পাওয়া গেল না 


তারপর? 

তার আর পর নেই। গলা শুকিয়ে গেছে। মালকড়ি কিছু ছাড়ো তো বাপু! তখন থেকে বকিয়ে মারছে। 

কী বললে? টাকা কম আছে? শালা হারামির বাচ্চা! পয়সা নেই, বসে বসে গল্প মারাচ্ছে।

এ নিতাই! মাল আন বাপু।  গলাটা শুইকে গেছে। 

 

 ভাস্কর্যে রামকুমার মান্না

জয়িতা মুখার্জি,কবিতা,সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


 আত্মনির্ভর



কোনো কোনো  রাত মৃত চাঁদের কবর খোঁড়ে 


যে বিষ গিয়েছে বয়ে শিরায় শিরায় 

তার গোপন আস্তিনে আছে অভিশাপ

আমি নিরস্ত্র যুদ্ধে নামি একা 

এই কি ক্ষাত্রধর্ম   

দুন্দুভি -দামামা 

সাত পুরুষের হাহাকার 

শিয়রে তান্ডব এই

দিন মাস বছরের পরে 

অযুত বছর আরও 

যুদ্ধক্ষেত্রে  পড়ে  থাকা জীবন্মৃত যেন। 



বর্ণালী কোলে,কবিতা,সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


একটি কবিতা

 

আমার থাকা না থাকায় পৃথিবী ঠিকঠাক?

আকাশের নীল চুরি হয়নি একটুও?

শ্যামের বিষাদ?

আমারচলে যাওয়ার দিনও

গরু, ছাগল চরাচ্ছিলাম দুপুর রোদে

সেই মাঠের মুক্তি চুরি হয়নি একটুও?

আমি মনসারঞ্জন , পুরুষচিহ্ন জন্ম

অথচ আই ইচ্ছে নারী, একা

কুলুঙ্গির আলতা, সিঁদুর, সুগন্ধী তেল

দড়ির আলনায় শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ

ওরা আনমনা?

আমাকে সাজিয়েছ তোমরা সাধ্বীর সাজ?


শবযাত্রায় তোমাদের কাঁধ চড়ে যেতে যেতে

কত যে সুখ

খুশি, খুশি দালানবাড়ি, হিল্লোল

রাঙাবউ আমি ঠিক পরজন্মে

সুদীপ্ত মাজি,কবিতা,সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

সুদীপ্ত মাজির কবিতা

 


অসমাপ্ত গানের খাতা : ২৮


তোমার সুরশ্রী থেকে জেগে ওঠা আলো 

মেঘের আহ্লাদ থেকে ঝরে পড়া সজলের 

                                        পাশে জেগে থাকে !

#

— এই দৃশ্য আজীবন প্রতিটি গোধূলিবেলা 

মনের মহলে লিখে যায়... 

#

আমি সেই আলোটুকু কৃতাঞ্জলিপুটে নিয়ে 

                                           একা বসে থাকি... 

#

আর কোনও গল্প নেই, গান নেই 

প্রবাহিত আয়ুষ্কাল ঘিরে —

#

দৃশ্যটির কিছু দূরে, গুলঞ্চের ঝোপেঝাড়ে 

জেগে ওঠে সন্ধের জোনাকি !