Showing posts with label সুজিত কুসুম পাল. Show all posts
Showing posts with label সুজিত কুসুম পাল. Show all posts

Monday 16 September 2024

মার্গারেট অ্যাটউডের কবিতা অবলম্বনেঃ সুজিত কুসুম পাল

 

 


কবিতা দেরিতে পৌঁছায়  

(মার্গারেট অ্যাটউডের লেইট পোয়েম্সঅবলম্বনে)

 

 

আমি আজ কবিতার কথা বলতে এসেছি   

দেরিতে পৌঁছানো সেইসব কবিতার কথা;

অবশ্য বেশির ভাগ কবিতাই দেরিতে পৌঁছায়,

ভীষণ দেরিতে।

 

ফিরতি জাহাজ ডুবে গেলে

প্রেরক পৌঁছে যায় ডুবে যাওয়া ঠিকানায়;

তরঙ্গের সুরঙ্গ পেরিয়ে

নাবিকের লেখা চিঠিটিও পৌঁছে যায়

দেরিতে পৌঁছানো কবিতার মতো

প্রাপকের দরজায়।  

 

কী কথা ছিলো চিঠিতে?

ভাসমান জাহাজে বসে লেখা

অসমাপ্ত চিঠির অবারিত অন্তর্বাসে

লড়াকু নাবিকের অনিষ্পন্ন যুদ্ধের কথা ছিলো হয়তো,

ছিলো রোদেলা ঠোঁটের অ-বলা ছোঁয়ায়

কামার্ত দিবসের মীমাংসিত বেদনার কথা;

সঙ্গমশয্যায় জোছনার রাত্রিযাপন

কিংবা

একটি সমাপ্ত কবিতার অসমাপ্ত সংলাপের কথা।

 

বিভাজিত জাহাজের অবিভাজ্য অবশেষ

অবশেষে ভিজে যায়, 

বার্তাবোঝাই অন্তর্বাস সৈকতের আমন্ত্রণে

দেরিতে পৌঁছানো কবিতার মতো হয়ে যায়।

 

নৈশটেবিলে দেরিতে পৌঁছলে

ক্রমশ উবে যায় মেন্যুর উষ্ণতা,

আরও দেরিতে পর্যাপ্তি,

বেশি দেরিতে ডাইনিং আওয়ার।

সময়ের ক্রমোচ্চতায় নাবিকের কবিতা যেন

ডাইনিং টেবিলের নিঃশেষিত নৈশখাবার।

 

মরচেপড়া ক্ষতবিক্ষত বর্ণমালা

জেগে ওঠে তবু রাতজাগা নেত্রকোণে

জীর্ণ কোরাসে পরিত্যক্ত আনন্দে

অধ:কৃত বেদনায়।

 

প্রতীক্ষার প্রভাতে বাজে না তাই প্রতিশ্রুত নূপুর;

বিলম্বিত দুপুরে জ্বলে শুধু আলো, বেজে ওঠে সুর।

 

 

অনুবাদ ও ভুমিকা:

বেশির ভাগ কবিতাই দেরিতে পৌঁছায় – ভীষণ দেরিতে। প্রিয়জনের কাছে নাবিকের লেখা চিঠি এইসব কবিতার মতো দেরিতেই পৌঁছায়জাহাজ ডুবে গেলে প্রেরক পৌঁছে যায় ডুবে যাওয়া ঠিকানায়; তরঙ্গের সুরঙ্গ পেরিয়ে নাবিকের লেখা চিঠিটিও পৌঁছে যায় দেরিতে পৌঁছানো কবিতার মতো প্রাপকের দরজায়। ভাসমান জাহাজে বসে লেখা অসমাপ্ত চিঠির অবারিত অন্তর্বাসে, হয়তো, লড়াকু নাবিকের অনিষ্পন্ন যুদ্ধের কথা ছিলো, ছিলো রোদেলা ঠোঁটের না-বলা বার্তায় কামার্ত দিবসের মীমাংসিত বেদনার কথা; সঙ্গমশয্যায় জোছনার রাত্রিযাপন কিংবা একটি সমাপ্ত কবিতার অসমাপ্ত সংলাপের কথা। 

বাষট্টিটি গ্রন্থের লেখক মার্গারেট অ্যাটউড (জন্ম:১৯৩৯) বিশ্বসাহিত্যের দরবারে কুইন অফ ডিস্টোপিয়ানামে খ্যাত হলেও তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন ষাটের দশকে অসাধারণ কাব্যরসের মহিমায় অলংকৃত সার্কেল গেমশিরোনামের একটি কাব্যিক পাল্কির সওয়ারি হয়ে। উপরোক্ত কাব্যিক বচনগুলো তিনি উপস্থাপন করেছেন তাঁর ‘লেইট পোয়েম’ কবিতায়। ১০ নভেম্বর ২০২০, ক্যানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুগপৎ প্রকাশিত তাঁর ‘ডিয়ারলি’ কাব্যগ্রন্থের প্রার্থিত উদ্বোধন হয়েছে এই ‘লেইট পোয়েম’ কবিতা দিয়ে। এবং এই কবিতারই এগারোটি লাইন দিয়ে তিনি পরিপূর্ণ করেছেন গ্রন্থের পশ্চাদ মলাটের পূর্ণ ললাট। পঞ্চান্ন বছরের রাইটিং ক্যারিয়ারে তিনি একুশটি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা হলেও, গত তেরো বছরের মধ্যে ‘ডিয়ারলি’ হচ্ছে অ্যাটউডের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। দীর্ঘ তেরো বছর পর কাব্যিক ভুবনে প্রত্যাবর্তন করে ‘ডিয়ারলি’ কাব্যগ্রন্থের পাঠকদের তিনি বার্তা পাঠিয়েছেন; তাঁর কাব্যনদী ‘চেতনা’ পর্বত থেকে উৎসারিত শাশ্বত অবিকার্য এক অজর ঝর্ণাধারা। রসবোধ আর পর্যবেক্ষণ কৌশলের কারণে বার্ধক্যে এসেও তিনি ফিরে যাবার ক্ষমতা রাখেন উল্টোস্রোতের যৌবনে। তাঁর কাব্যিক ঘটকালির দৌরাত্ম্যে অতীত ও বর্তমান এখন সহবাস করে চিত্রকল্প দিয়ে নির্মিত বর্ণশয্যায়। ঝরাপাতার রঙের ক্রম রূপান্তর আর দৈহিক বৈকল্য দেখে, মোমের আগুনে পোড়ানো খণ্ডিত কাগজটি দুমড়ে মুচড়ে ওঠে অগ্নিশিখার আওতায় এসে। ঝরাপাতার বর্তমান আর বর্তমানহীন কাগজের অতীত একাত্ব হয়ে যায় অ্যাটউডের রৈখিক স্বচ্ছতায়।  

পাঁচ খণ্ডের এই দুর্দান্ত কাব্যিক সম্ভারটি তিনি সাজিয়েছেন জীবন ও জগতের নানান কীর্তন-কথনে পরিপূর্ণ একশ’ একুশটি কবিতা দিয়ে। যাপিত জীবনের বিবিধ আখ্যান স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেছে অসাধারণ অ্যাটউডীয় শব্দজালে। জীবন, মৃত্যু, বার্ধক্য, ব্যাধি, প্রিয়তার বিচ্ছেদ, জলবায়ুর পরিবর্তনে আবর্তিত বিরূপতায় আমাদের বিপন্ন অস্তিত্ব উজানমুখি তরঙ্গ হয়ে সারাক্ষণ ছুটে বেড়িয়েছে বর্ষীয়ান কবির বর্ণস্রোতে। তিনি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর একমাত্র কন্যার জনক ২০১৯ সালে প্রয়াত সাহিত্যিক গ্রেম গিবসন (১৯৩৪২০১৯)কে। গিবসনকে নিয়ে লেখা যে কটি কবিতা তিনি এই গ্রন্থে সংযুক্ত করেছেন, তার সবই রচিত হয়েছে প্রিয়তম এই প্রাণের প্রয়াণপূর্বকালে; এই এক অসাধারণ বিস্ময়! কিন্তু পাঠকালে, একবারের জন্যেও ব্যক্তিগত কোনো শোকের ছায়ার সন্ধান মিলেনি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে। অথচ কবিতার শব্দগুলি মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে আপনজনের সন্ধানে, এবং তাঁর থাকা নিশ্চিত করেছেন তাঁর না-থাকার মধ্যে।

কাব্যগ্রন্থের নাম ডিয়ারলি’ (Dearly) হলেও, কিংবা গিবসনকে ডিয়ারলিভালোবাসলেও তাঁর  মনে হয়েছে ডিয়ারলিশব্দটিকে আজকাল আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এটি যেন একটি ভুলে যাওয়া অপ্রচলিত শব্দ। ডিয়ারলিশব্দটিকে না পাওয়ায় অ্যাটউড  দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পরক্ষণেই তাঁর মনে হয়েছে, এই দুঃখশব্দটিকেও আজকাল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শোকের আড়ালে তাই তিনি প্রজ্ঞার প্রদীপ জ্বালিয়েছেন। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতার বৈদগ্ধ আর সার্বক্ষণিক রসবোধের ঝলকে দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে তাঁর সমগ্র কাব্যসম্ভার।

 

 অনুবাদক সুজিত কুসুম পাল কানাডা নিবাসী বাঙালি। তিনি মার্গারেট অ্যাটউড সোসাইটির সদস্য।