Showing posts with label সাহিত্য এখন শারদ ২০২০. Show all posts
Showing posts with label সাহিত্য এখন শারদ ২০২০. Show all posts

Monday 19 October 2020

মহম্মদ সামিম, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


 

বাকি সব অকিঞ্চিৎ

রক্ত মাংসে, পাপে, অসুখে, নিভৃতে
যতটুকু বেঁচে আছি, বিশ্বাস করো
আগন্তুক কোনও ঘোরের উদ্দীপনায়
বিড়াল তপস্বীর মতো বসে থেকে
কত আর্ত ডাকের সরলতায় সাড়া দিই নি
কত চেনা মুখকে অচেনা করেছি নিমেষে,
বিনিময়ে কি পেয়েছি ?
আত্মসুখ ও রাতের গভীরে স্বৈর-উল্লাস
সবাই আঙুল তুলেছে এমন জীবনের দিকে
ধিক্কার ছুঁড়ে মেরেছে, বলেছে—
পৃথিবী ক্ষমা করবে না এই স্খলন...

খোলা আকাশের নীচে,
বেঁচে আছে সহস্র পথ ও চোরাস্রোত
সমস্ত দংশন-জ্বালা মেখে দাঁড়িয়ে আছি একা
কেউ খোঁজ রাখেনি এইসব যন্ত্রণার
যতটুকু বেঁচে আছি, নির্জন আত্মমগ্নতায়
আঘাতে, নীরবে এবং প্রত্যাখ্যানে।

সুবিৎ, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


সময় 


তারপর সেই প্রায় অন্ধকার কোণটায় আমরা গিয়ে বসতাম। আমি আর আমার বন্ধু। 
আজ যার মনে নেই চোখ , নাক , কান। 

সেখানে শিশুর গায়ের মত নরম সবুজ শ্যাওলা আমাদের পেছন ভিজিয়ে দিত। 
কাছেই জং ধরা রোড-রোলার , ঘটঘটাং। 

এইখানে মাঠ এবড়ো খেবড়ো এসেছে রাস্তায় । দূরে একটিমাত্র গাছ নিয়ে আমাদের , পরিচিত আমের বাগান। 
ভূতুড়ে হস্টেল। স্মিতি শপের প্রাচীন দেয়াল। কিছু বিক্ষিপ্ত ফার্ণ।

তারপর সেই প্রায় অন্ধকার কোণটায় 
বিশ বছর পর গিয়ে বসলাম আবার।

আমার বন্ধুর নাম এখন , নির্জন। 
আলোচনায় বিশুদ্ধ কবিতা , যেমন থাকত।
সঙ্গে কিছু ঠোঙায় দৈন্যের অনুপান 
কালচে বাদামী দুঃখিত কেলাস। 

খুললাম আমার
কালো খাতা , নীল হরফ , হলদে পাতা

আর ওর হাতে কেবল , সেই চিরপরিচিত বই  ....

আনিসুজ্জামান।


Sunday 18 October 2020

রঞ্জন চক্রবর্ত্তী, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০, অঙ্কনে মঙ্গলদীপ সর্দার,

 


একটি রূপকথার জন্ম

   

১.

হয়তো কালের কথকের কথাই সঠিক ছিল -
নুড়ি বিছানো শুকনো নদীর খাতে জলের শীর্ণ রেখা
চকচক করছিল শুক্লা চতুর্দশীর অদ্ভুত মায়াবী রাতে,
তারপর স্বপ্নের মতো কেটেছিল অবশিষ্ট রাত,
একটা খুব চেনা ছবি, একটা খুব পরিচিত মুখ
একটা অচেনা দৃশ্য, একটা অজানা পথ -
এ সবই সত্যি হতে পারত – কিন্তু পারেনি,
তাই একটি রূপকথার জন্ম হয়েছে বিপরীতক্রমে

২.

হয়তো ঝরা সময়ের গান নিছক গান নয় বলেই
দিগন্তরেখার পারে শোনা যায় বাঁশির করুণ সুর
বুকের অর্ধেকটা জুড়ে গোধূলির রঙ – মুছে যেতে যেতে
নিত্যদিনের অভ্যাসমতো ঘরে ফিরে আসি,
আর কোনও কথা নয় – নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সন্ধ্যা আসে
আবছা আলোয় মনে ভাসে একটা অন্ধকার মুখ,
জ্যোৎস্নায় থই-থই রাতে পায়ে-পায়ে যাই পদ্মদিঘির ঘাটে
টলটলে স্বচ্ছ জলে দেখা যায় ঝক-ঝকে রুপালি চাঁদ -
এখন মাঝে-মাঝেই ঘুমের মধ্যে ছোটবেলার স্বপ্নে ঢুকে যাই
আবার জেগে ওঠার আগেই ইচ্ছেগুলো ঘুমিয়ে পড়ে

৩.

সারা জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য হাইওয়ে ধরে
দীর্ঘ পথ হেঁটে গেছি নতুন জনপদের অভিমুখে
অথবা হেঁটেছি বৃথা, ঘুরেছি উদভ্রান্ত একা -

দিনবদলের পালা সকলের অগোচরে ঘটেছে বলেই
দিবা-রাত্রির বিধিবদ্ধ ইতিহাস লেখা যায় না সবিস্তারে,
সেই সব ঘটনা লোকের মুখে মুখে রূপকথার গল্প হয়ে ফেরে

 অঙ্কনে মঙ্গলদীপ সর্দার

Saturday 17 October 2020

নীপবীথি ভৌমিক, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,


 

গল্পের মতো

মিথ্যেকেই আজকাল ছায়া বলেই সাজিয়ে নিই।
  জানি, যারা সব সত্য বলে হারিয়ে গিয়েছিল প্রাচীন প্রবাদ-অরণ্যে, 
 তাঁরা ঘুমিয়ে আছে কেউ বা
  ফুল হয়ে, কেউ আবার নদী হয়ে।

    আজকাল হেমন্তকে বড় অদ্ভূত লাগে জানো!
      পাখিরা আসে না এপথে।‌ 
     বিসমিল্লার নহবত ও 
        বসে না পড়ন্ত রোদের গায়ে।
   
  তাই বলি, আমাকে ভুলতে দাও বরং নিজেকেই...
        
        শীত আসুক শীত !
    গল্পের গায়ে লেখা হোক নতুন উপন্যাস ।

Friday 16 October 2020

বই আলোচনা, অমিতাভ মৈত্র, আলোচক- সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 

 


কবিতা সংগ্রহ/ কবি অমিতাভ মৈত্র

 

 কবিতা সংগ্রহঃ অমিতাভ মৈত্র

প্রচ্ছদ রাজীব দত্ত

দাম ২৫০ টাকা

প্রকাশক তবুও প্রয়াস

 

"আমার কাছে একটি ছবি আসে, আমি সেই ছবিকেই ভাষায় অনুবাদ করতে করতে এগিয়ে যাই"

 

কবি অমিতাভ মৈত্রের এই স্বীকারক্তিই হয়ত প্রমাণ কতটা নিষ্ঠা ও নেশায় এক বুদবুদকে সমুদ্র করে তুলতে পারেন তিনি। তার কবিতাগুলি চিরপরিচিত গন্ডীর বাইরে নিজেকে খুঁজে নেওয়ায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাষার প্রয়োগে তিনি যে ব্যতিক্রমী শুধু তাই নয়, কবিতার গঠনশৈলী ও বক্তব্যে তার দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া অসম্ভব।

 

পতনকথা, টোটেম ভোজ, ষাঁড় ও সূর্যাস্ত, পিয়ানোর সামনে বিকেল ও পরিশিষ্ট এইকটি বিভাগে কবিতাসংগ্রহকে সাজিয়েছেন সম্পাদক সেলিম মন্ডল।

 

"যদি চিতা বল, আমি দুই হাতে ছুঁয়েছি আগুন

হাড়ের গভীর মাংস মেলে দাও শস্যে ঘাসে ঘাসে

ছড়াও শরীরময় স্বেদ রক্ত রাত্রিবীজগুলি

দ্যাখো কত স্পর্শসহ আমি আর আমার অঙ্কুশ"

 

মৃত্যুর অতীত থেকে উড়ে চলেছে নীলঘুড়ি। কবির হাতে সেই অলীক সুতো। অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে অতিকৃত কালো কালো কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত মুখ। তারা হাঁটতে হাঁটতে নির্মাণ করছে পথ। বেজে উঠছে অস্ত্রের ছনছন। তৃষ্ণার ছুরি হাতে নত হচ্ছে ক্রমশ কবির শরীর। তবু ব্যর্থতায় বেঁচে থাকা। এ যেন এক তুমুল আত্মপ্রতারণা। যে সমস্ত পাপের কথা বিশ্বাস করেনা ঝরনার জল, তারা জানে আসলে পাপ বলে কিছু নেই। সবটাই ঘটমান, বর্তমান। সময়ের সুকৌশল কারচুপি। যে হাত ডুবে আছে বহুদিন জলে, যে চোখে বহুযুগ জ্বলেছে আগুন, কাপাস তুলোর মতো যে শরীর ভেসেছে কেবল, মাটি ও গাছের কাছে তার সব ঋণ আজ শেষ। গুমোট বমির মতো মাংসের কুয়াশা এলেও মৃত্যু আজ প্রস্তুত সমস্ত অন্ধকার পিছনে ফেলে।

 

টোটেম ভোজ কবির এমন এক সৃষ্টি যাতে ধরা পড়েছে এক তীব্র যন্ত্রণা। শুরুতেই কবি লিখছেন,

 

" অস্বাভাবিক সব চোখ, আর এক অদ্ভুত

গোল মাংসমাখা ভাষায় কথা বলা হয়েছে

তার বিষয়ে

যে ভাষায় 'আলো' শব্দটি নেই, এবং

কোন বিস্ময়চিহ্ন নেই…" 

 

এ কোন অন্ধকার। এ কোন ভালোবাসা তবে? কেঁচোর মতো পিছল ঠোঁট যার গাল ছুঁয়ে বলছে, ' তোমার ধর্মান্তরণ হল। এখন তোমার মুখে আমার রক্ত। শোনো, লাল থকথকে সেই জলাভূমির ওপারে সাদা হাড়ের ক্রুশকাঠে, আড়ষ্ট শরীর, এখন থেকে ঝুলে থাকবে তুমি।'

তবে কি শুধু শরীর! শুধুই জ্বলন্ত মশাল ও ঘোড়াটিকে নিয়ে স্নানঘরের বন্ধ দরজা? নাকি নগ্নতাকে গ্রহণ করা মাংসের বিরুদ্ধে? এমনই এক জটিল দর্শন বারবার দেখা দিয়েছে টোটেম ভোজের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে।

নিজের মৃতদেহের পিঠ হেলান দিয়ে যেন লেখা হয়েছে কবিতাগুলি। থমথমে বাতাসে শুধু ঘৃণা। কাঁধে হালকা কামড় দিচ্ছে পিশাচিনী। না খাওয়া অংশগুলো বাক্সে তুলে রাখছেন দুজন। বাঁচার তাগিদ নেই, তবু বেঁচে থাকা। প্রেরণাহীনভাবে কামড়ে ধরা তার গলা। নিষ্প্রাণ জলে, রক্তরসে ভরে উঠছে মুখ, কবি লিখছেন,

 

" দরজার ওপারে কোন মাংস ডাকছে, আলো হাতে নিয়ে"।

 

ক্রমশ পাগল হচ্ছে সব চরিত্ররা। সম্বিতহারা আত্মহত্যাপ্রবণ। প্রতি দু মিনিটে মৃত্যু আবার স্বাভাবিক শ্বাস। আলোহীন নাচঘরে ধূসর পোশাকের নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা। শূন্য চেয়ার থেকে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা এবং তারপরেই বসে পড়া, তার মাঝের যেটুকু সময়, তা যেন এক নাচেরই সমান। কখনো শূন্যে ভেসে ওঠে সেই রাজকীয় চেয়ার, কখনো বা ঠান্ডা স্পর্শযোগ্য এক আলোয় ম্যাডাম এম কে মৃতদেহের মতো তুলে ধরা ভারী রক্তের বোতলগুলোর ভেতর।

অবেশেষে সময় আত্মহত্যা করে। 'not understanding, not living either, not even aware of life trapped deep inside'   ( Michel Joiret)

আপেল চিবোতে চিবোতে ঝলসে উঠে রুটি। কবিতার চরিত্র ম্যাডাম এম ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে উঠছেন। দেশলাই নিতে পারছেন না। লাল সিলিন্ডার ও তার আপেল যেন মিশে যাচ্ছে একই বিন্দুতে। দরজার ফাঁক দিয়ে সাদা কাপড় হাতে এগিয়ে আসছে মৃত্যু। তিনি বাকরুদ্ধ। ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধ। দেশলাই ভিজে গেছে তবু মাংস মুক্তি চাইছে যন্ত্রণা থেকে।

 

ষাঁড় ও সূর্যাস্ত বইটির কবিতাগুলির গঠন আবার একটু আলাদা। বস্তুকে তার অর্থ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া কিংবা অন্ধকারে ছুটে চলা কোন ট্রেন, গতির মধ্যে পাক খাচ্ছে এমন কোন বিষয়, রাত্রি কিংবা চোখ সবকিছুকেই কবি রূপদান করেছেন অনন্য ভাষায়। ঘন বাষ্প আর বালির স্তর সরিয়ে উঠে আসা ঘড়ি কিংবা কোন বিস্মিত বারান্দায় ফুটে ওঠা কোন ছায়া ধরা দিয়েছে তার বহমানতায়।

 

" আমার সাদা কুকুরটা আবার যেদিন নিজেকে ভাবতে শুরু করবে

আর আরাম চেয়ারটায় বসে ঢুলতে ঢুলতে হঠাৎ দম আটকে আসার কারণ যেদিন থেকে খুঁজে পাব না আমি

 

সেদিন কেউ এসে যদি বলে যে আমার ঝগড়াগুলো নিয়ে,

কাগজপত্রগুলো নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই

এমনকী আমার বাসন ধোয়াকেও সে আর বাসন ধোওয়া বলে মনে করে না

তখন তাকে বোকা বানানোর জন্য এই একটা ঝরঝরে হাসি

আমি ভেবে রেখেছি

এক জায়গায় খানিকটা হলদে, মরা ঘাস দেখিয়ে বলব

এখানে তোমার জন্য একদুপুর লম্বা একটা ঘন্টার শব্দ রাখা আছে। তোলো!"  (বোকা)

 

লাল ধুলোর শরীর। অপেক্ষারত লাল বাঘ। জাদুকর আসলে সেই নারী যিনি রক্তমাংসের প্রশাসক। কিংবা এই চোখ মুখ নেমে আসা হাসিরা যেন একএকটি খোলা রাস্তা। সূর্যাস্তের মধ্যে গাঢ় হয়ে ওঠা সিংহরা যেমন কখনো জলের ধারে এসে দাঁড়ায় অবিশ্বাস্য কোন প্রতিবিম্বের কাছে, মৃত্যু থেকে না উদ্ধার হওয়া কোন বিভ্রান্তি যেমন রক্তাক্ত হয়ে থাকে চিরকাল, এ যেন সেই না জানা সূর্যাস্তেরই ছবি যা বারবার প্রতিভাত হয় অবচেতনের পর্দায়।

 

ভেসে যাওয়া বাড়িগুলো যে ভয় থেকে কথা বলে কুয়াশার সাথে কিংবা দরজা খোলার শব্দে বোবা মেয়েটি কামড়ে ধরে তার বিড়ালকে এমনিই সব অদ্ভুত দৃশ্যকল্প বারবার ওঠে আসে তার কবিতার কায়া গঠনের জন্য।

 

পিয়ানোর সামনে বিকেল কাব্যগ্রন্থটি আর একটি গভীর জীবনদর্শনের প্রমাণ। খোলা ওয়ার্ডরোবের সামনে মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যকল্প যেমন অতি সাধারণ হলেও গভীর তেমনই মসৃন হলুদ হাত যা একটু দেরি করে পৌঁছায় সবসময়, এই পংক্তিগুলি পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে কবিতার আসল উৎস তবে কোথায়! ক্যানভাসে কি দর্শন এঁকেছেন কবি। বহুপঠন দাবী করে প্রতিটি কবিতা। সাদা গজ এগিয়ে যায় কোনাকুনি যেন শেষ হয় দীর্ঘ অপেক্ষা। মৃত্যু পর্যন্ত শুধু ঝড়। কখনোই ঘুমিয়ে পড়া চলবে না। এমন সব পংক্তির আলোয় ঘিরে থাকে পাঠক।

 

' সমুদ্রের দিকে ব্লেড আসছে। বৃষ্টি আসছে শূন্যতা, সাইকেলের চাকায়।

দেয়াল ঘেঁষে নিয়ে চল। কেন মিথ্যে বলছ আমাকে?

তিন মাইল জুড়ে কোথাও ঠিকানা নেই।

আলো কমে আসছে। নৌকা বানানো হল না। নীরবতা থেকেও হয়তো রক্ত পড়বে এবার।

গা শিরশির করছে। ব্লেড সরানো দরকার।

তোমার হাসি কি আগের মতোই অবর্ণনীয় এখনো।'(ব্লেড)

 

কবিতাটির ভেতর এক অদ্ভুত অন্ধকার। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নিচ্ছে হতাশা। এই ছায়ার কারণ হয়ত অস্পষ্ট। হয়ত বা জানলার কাচে লাগা অর্থহীন বৃষ্টি। তবুও তা বিধ্বংসী। তবুও তা কালো আঙুরের মতো লোভনীয়। যা মানুষকে ধ্বংস করে তার দিকে ছুটে চলার প্রবৃত্তি বড়ো স্বাভাবিক। এ মৃত্যু যেন তেমনই এক বিস্ময়। মোটরবাইকের নীচে চাপা পড়া শেষ আর্তনাদ। তবুও জলহীন কঠিন দুচোখ, আত্মহত্যা চায় বাঁচার আশায়।

 

পরিশিষ্টেও বেশ কিছু কবিতা গুণমানের বিচারে আলোচনার দাবী রাখে। শিউরে উঠে 'যতক্ষণ টগর থাকবে'

কবিতাটি পড়ে। কী কঠিন বাস্তব সত্য কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর অনবদ্য ভাষায়।

 

' মেয়েটিকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মিলিটারি ব্যারাকে

নাচের জন্য। ভিতরে মাংসের গন্ধ, আগুন

আর জড়ানো গলায় হই হল্লা।

 

নতুন দখল হওয়া এই শহরে

কোথাও আলো জ্বলছে না আজ।

ধোঁয়া উঠছে এখানে সেখানে---

আর অন্ধকারে একটানা বেজে যাচ্ছে বলির বাজনা।'

 

 

অভ্রকণার মতো আলো পড়ছে চাঁদের। আর তাতেই দৃশ্যমান একপাটি রক্তাক্ত জুতো। কেঁপে উঠি শেষ লাইনে যেখানে কবি লিখছেন, ' কালো ওই মেয়েটিকে ঈশ্বর নিজের হাতে আজ অনুচ্ছিষ্ট মাংস খাওয়াবেন।'

 

আরো বেশ কিছু কবিতায় কবি তুলে এনেছেন এমন সব চিত্র যা অননুকরণীয় তো বটেই, নিজ বৈশিষ্ট্য ভাস্বর। এমন সব বাস্তব দৃশ্যকল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে কবিতার কায়া যাতে তারা নিজস্ব ভাবধারায় ধরা দেয় বারবার, নানা ভাবে পাঠকের মননে। বহুস্তরী এই লিখনের ভেতর মৌলিকত্ব শুধু নয়, উন্নত ও গভীরতার ছাপ সুস্পষ্ট।

 

সবুজ আলোয় ভরে উঠছে মাঠ। গ্রামীন মেয়ের হাতে এখন শুধু জল। হত্যা নয়। এ যেন এক ধর্মবিজয়। ভরে উঠছে ধানক্ষেত। কবি লিখে চলেছেন এক অনন্য বিজয়গাথা শৃঙ্খলমোচনের।

 

সবশেষে কবি সেলিম মন্ডলের প্রতি পাঠকের কৃতজ্ঞতা বেড়ে যায় এমন একটি সংকলনের জন্য। সম্পাদক হিসাবে 

নিঃসন্দেহে এটি সেলিমের একটি ভীষন ভালো কাজ।

 

 

 

        

 

  

 

স্বপনকুমার বিজলী, ছড়া, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


মেলার ছবি

     

গাঁয়ের মেলা সারাবেলা
দেখছি আমি ঘুরে
হাজার ঘুড়ি ওড়াউড়ি
করছে কাছে দূরে ।

ছ'টা ছেলে হেসে খেলে
কিনছে চানা-মুড়ি
ক'জন খুকি দিচ্ছে উঁকি
পরছে কাচের চুড়ি ।

গুড়ের জলে দলে দলে
জিলাপি সব ভাসে
গরম তেলে নেচে খেলে
পাঁপড় ভাজা হাসে ।

পুকুর ঘাটে তিলক কাটে
ন্যাড়া করে মাথা
চটে বসে হাঁকছে কষে
বেচছে নকশি কাঁথা ।

নিচ্ছে ঝুলে রুমাল তুলে
চড়ছে নাগরদোলা
ভরা প্রীতি মেলার স্মৃতি
যায় কখনও ভোলা 

 

Wednesday 14 October 2020

সুভান , কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 

 


একলা দ্বীপ


 

আসলে সমস্ত দ্বীপ একদিন ডুবে যায় একা,

জলস্তর বাড়ে, বাড়তে বাড়তে গলা পর্যন্ত উঠে আসে জল

শ্বাস থেমে থেমে আসে আর উঁচু হতে হতে জলের আঁচড় 

গিয়ে পড়ে বালি শরীরে, ক্ষততে

এত দীর্ঘকালের খোলা আকাশটাও ডুবে যায় চোখের সামনেই

 

নির্জন দ্বীপ আসলে কবির মতো, একলা...

মাঝে মাঝে গাছ বেড়ে ওঠে বুকে; ছায়া দেয়,

মন মেঘলা করে আসে, বৃষ্টি নামে চতুর্ভুজ।

পরিযায়ী পাখিদের ঙ্গে প্রেম হয় সাময়িক, বিরহ হাসে দীর্ঘকাল।

 

আবার ঢেউ এলে ভেসে যায় মেঘ, জমানো গল্পের নোঙর মাটি খোঁজে।

দ্বীপের চতুর্দিকে জল; জলের অতলে ভিজে চটি। শান্ত ডুবুরির মৃতদেহ

 

তবু ঢেউ আসবেই...

মরা ঝিনুক খোলস ভাসে হাওয়ায়,

ঢেউ আসে তার ভেতরে ভেতরে নোনারাগ... সমুদ্রঝড়...

 

জলের নিচে একলা দ্বীপ তার একলা শরীর ছুঁয়ে থাকা ঠান্ডাজল,

গভীর জন্ম-অন্ধকার, তার পাশে ভাঙা ভাঙা কাঠের প্রাসাদ,

তারও আগে ডুবে যাওয়া কোনো একলা দ্বীপ...

সারি সারি অতল না-বলা কথা, অন্তিম বিশাখাসঙ্গম বালিয়াড়ি। 

একলা দ্বীপের বুকের ওপর দিয়েই 

প্রত্যহ পার হয়ে যায় হাজারো নাবিকজাহাজ...   

Tuesday 13 October 2020

কমলেশ কুমার, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 

 

 
অভিযাত্রা


মুহূর্তের আগলঘেরা আত্মকথায় ছুঁয়ে থাকি ঘর
লুকোনো চিলেকোঠা, সান্ধ্য রূপকথা যেন পরস্পর —
সনাক্তকরণ শেষে ধ্রুবকান্তির স্পর্শে দীর্ঘকায়
অস্পষ্ট পৃথিবীজুড়ে ক্রমশ বৃষ্টি হতে চায় —
অনন্ত শূন্যতার যত মায়ামেঘ, আমি তাকে দেখেছি একাকি

 তাকে তুমি খুঁজে নিও, হে আমার 
                                            বিষাদের পাখি...

Wednesday 7 October 2020

অরণ্যা সরকার, গল্প , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,


 

গহন স্বপন সঞ্চারিণী

 

তুমি, আমি ও আমাদের কথামেঘ 

নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলে তুমি। আমি জানি তোমার এই ছেড়ে যাওয়ায় কোনো অনন্তের আহ্বান ছিল না। আমাকে অবশ্য কোন নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়নি। আমিই বারবার নতুন  হয়ে এসেছি। পুরোনোর শ্বাসের ভেতর শ্বাস ফেলেছি। স্থিতি আসেনি। একটা পাথুরে চলমানতা আমাকে বয়ে বেড়ায়। নাকি আমি তার ভার বয়ে বেড়াই বুঝি না। জানি তোমার আগুন আরও তীব্র ছিল।  লুকোনো আগুনবাইরে গান ছিল। কথা ছিল। রবি আর তোমার নন্দন কানন ছিল। তোমাদের  ছাদের বাগান। মর্তলোকের দৃষ্টি এড়ানো পথে ছিল স্পর্শ যাতায়াত ছিল সব অমোঘ ভোর।

আমার ভোরগুলো দখল করে থাকে নেশা জড়ানো ঘুম। সকালের বেল, জুঁই তোমার যত্ন পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হত। আমার শিথিল আঙুল আঁ কড়ে থাকে বম্বে ডাইং আরাম। শুধু ভোর নয়, সকাল, দুপুর রাত কোথাও তোমার ছিটেফোঁটা  নেই আমার মধ্যে। এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে যে সব শব্দ ব্যবহার করছি সেসবও কিন্তু আমার নয়। তবু তোমার সঙ্গেই কেন এত বকবক করছি সেটাও জানিনা। কারণ খুঁজতে বা অনুভূতির গায়ে যুক্তির বুলেট বিঁধিয়ে বিক্ষত করতেও  চাইছি নাতোমার চলে যাবার পর অনেক বদলের রিপোর্ট জমা পড়েছে যুগের ফাইলে। তবু নিজের ভেতর নিঃসাড় পড়ে থাকা অন্য এক আমি কী করে যেন জড়িয়ে গেছে তোমার সঙ্গে। তোমাকে কে প্রথম চিনিয়েছিল সে কথা  অন্য একদিন  বলবো। সে আর এক আমির গল্প।

এখন আমার ভেতর থমথমে ক্ষোভ, গনগনে আঁচ, চকচকে প্রেজেন্টেশান ও ঊপচে পড়া সুখের ক্লান্তি। তোমার কাছেই এই যে নিজের খিড়কি খুলে দাঁড়িয়েছি সে শুধু ইচ্ছে করে বলেই। এমনি এসে ভেসে যাবার এই ইচ্ছের গভীরে যা আছে তা কেমন ঘোলাটে  আর ঠাণ্ডা। তোমাদের নন্দনকাননের ধুলো হয়ে উড়েপুড়ে বেড়াই নিজেকে জুড়িয়ে নেব বলে।

এখন দুপুর। তোমার খাটে,  বিছানায় লেগে আছে নিঝুম কবিতা। তোমার রবির কবিতালেগে আছে অপমানের দাগ।  কষ্টের গুঁড়ো। একটা স্পর্শ উড়িয়ে দিচ্ছে সব কষ্টের অণুধুয়ে দিচ্ছে অপমান দাগ।  স্নিগ্ধতায় ফুটে উঠছে ঠাকুরবাড়ির শ্রীময়ী ঘর। আমার ঘর বেশ গম্ভীর। এখন আমি অফিসে। এসি চলছে। ইনডোর প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন মিশে যাচ্ছে বন্দী বাতাসে। করিডরে অ্যাকোয়ারিয়ামবানানো জলজগতে সাঁতরে চলেছে রঙিন মাছ। কেবিনে কেবিনে যন্ত্রমানব, যন্ত্রমানবীরা   সংখ্যা সৌরভে মশগুল। একটু খিটখিটে। তবে  আপাদমস্তক নিখুঁত পরিচর্যায় ঝকঝকে। তুমি কি ভাবছ এসব থেকে আমি ব্যাতিক্রমী কেউ ? একদমই তা নয়।

আমি কাদম্বরী সেন। রবীন্দ্রভক্ত বাবার দেওয়া নাম। জানিনা নামটা রাখার পেছনে বাবার কি ভাবনা ছিল। সেকেলে নামের  জন্য আমার বেশ ক্ষোভ ছিল।  তবে এখন বেশ ওজনদার মনে হয়। নামে পুরনো গন্ধ থাকলেও আমার  জিম ও স্যাঁলো  চর্চিত ঝকমকে  শরীর। স্পা করা লম্বা চুল। পছন্দের পোশাক জিন্স কুর্তি। দশ ঘণ্টা ল্যাপটপে চৌকশ আঙুল। সামনে ঝুলন্ত টার্গেট। আমার দৃষ্টিতে, শ্রুতিতে, কোথাও সমাহিত স্নিগ্ধতা নেই।

 

ছায়া নেমে এলে

দুপুরটা চলে যাচ্ছে। তুমি শব্দ পাচ্ছ ? আমি পাই।  আমার ধারালো দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে  তোমার ছবি প্রকট হচ্ছে।  তুমি এখন গা ধুতে যাচ্ছ। সেই প্রস্তুতির শব্দও আমি পাচ্ছি। সেই শব্দের উপর হামলে পড়ছে আমার সময়। চাপা পড়ে যাচ্ছে তোমার চুড়ির রিনিক ঝিনিক। তোমার শাড়ির খসখস।

মগজের কনফারেন্স শেষ। আজ শনিবার। সন্ধ্যে আটটা। বাড়ি ফিরছি। নন্দনকাননের দোলনা থেকে তুমি ফিরে গেছ অনেকক্ষণ। সন্ধ্যেপ্রদীপ নিভে গেছে। তোমার ভিজে শরীরের জলকণা যখন শুষে নিচ্ছিল বাতাস, যখন আকাশের দিকে  মুখ করে  তোমার তরলিত সুষমা ছড়াচ্ছিলে নরম সন্ধ্যেকে, তখন আমি অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে, শপিং করে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাম জ্যাবজেবে হয়ে একটা ঠাণ্ডা শাওয়ারের স্বপ্ন দেখছি। বুঝলে রবির ‘সরোবরময়ী’। আমার বুকের ভেতরও ঘাপ্টি মেরে থাকে একটু জলের টুকরো। একে সরোবর বলা যায় না। ওটা তোমার জন্য। তোমার রবির দেওয়া শব্দ। সে যাই হোক , শুধু তোমাকেই বলছি ওইটুকুই আমার ভিজে ওঠার গোপন। বাইরে আমি সবসময় নিজেকে পারফিউমে মুড়ে রাখি। সবসময় ক্যারি করি সুগন্ধ। আসলে নিজেকে লুকিয়ে রাখি সুগন্ধের ভেতর।

বাথটাবে নিজেকে ডুবিয়ে এখন আমি বেশ ফুরফুরে। আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে নিজেকে একটা পতঙ্গ মনে হল। খুব রূপসী, অহংকারী পতঙ্গ। আমার মাস্কারার কালো, আর আইশ্যাডোর নীল মিলেমিশে আকাশ তৈরি করলো। তারপর ছোট্ট    নীল পোশাকের চেন আটকাতেই আমি পাখি হয়ে গেলাম। সেই ছোট্ট নীল পাখি, যে গরমের ছুটির দিনগুলোতে ডালিম গাছে বসতো। না না আমি এখন কোন নীল পাখি বা ডালিম গাছের কথা মনে করতে চাইছিনা। বরং আমি নতুন কেনা পারফিউম মাখার জন্য উন্মুখ হতে চাইছি

পারফিউমটা স্প্রে করতেই আমি কেমন অদৃশ্য হয়ে গেলাম। তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ ? আমি কেমন ফুরিয়ে গেলাম দেখলে? এমনি করে আমি মাঝে মাঝে একেবারে ফুরিয়ে যাই। শুধু গন্ধটা থাকে। রূপক আসে। গন্ধে মাখামাখি হয়ে  কখনও আমি ওর সঙ্গে সেঁটে যাই। তারপর পার্টি, রেস্টুরেন্ট, নেশা আর ঘুমিয়ে পড়া। কতদিন যে ধীরে ধীরে ঘুমের মধ্যে নামিনি আমি ঘুমকে উপলব্ধি করিনি। আমার  ল্যাপটপের স্ক্রিনসেভারে নীল নীল ঢেউ আছড়ে পড়ে। ওরাও ঘুম জানেনা। কোথাও ঘুম নেই। ঘুমের মধ্যেও ঘুম নেইতরলে তরল নেই। শুধু ঘূর্ণন।  তাই নিয়ম ভাঙার ধুমধাম আছে। টলিয়ে  দেবার ও টালমাটাল থাকার হুল্লোড় আছে। 

আমি এখন সেই অন্ধকার আলোর মধ্যে শরীরী লটবহর বিছিয়ে রূপান্তরিত হবার চেষ্টা করছি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ না। আসলে আমি এখন একটা ডিস্কোতে। নব্বই ডেসিবেল শব্দের বিস্ফোরণ বুকে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি সেই সশব্দ ভাঙনের তালে তালে নেচে চলেছি। শরীরে শরীর জড়িয়ে সঙ্গ দিচ্ছে রূপক। আমরা এক দৃশ্যমান উষ্ণতার মধ্যে অদ্ভুত ভাবে শীতল   হচ্ছি। বরফদৃষ্টিতে  ভেসে উঠছে - নন্দন কানন থেকে মাদুর তাকিয়া ঘরে ফিরেছে। রুপোর রেকাবিতে রাখা ভিজে রুমাল শুকিয়েছে বহুক্ষণ। বেলফুলগুলো স্মৃতিদাগ রেখে চলে গেছে নক্ষত্রলোকে। সাদা চাদরে তুমি জেগে আছ। সন্ধ্যের তৈরি  হওয়া গান এসে শুয়েছে তোমার পাশে। তোমার  রবি ও কি জেগে থাকতো  তোমার মত ? তিনি কি তাঁর ধ্রুবতারার জন্য  নতুন করে দ্বিগুন হয়ে উঠতেন আগুনে আগুনে ?

 

মাধুকরী

রূপকেরও একরকম আগুন আছে। সেই গনগনে আঁচে নিজেকে সেঁকে নেওয়া যায়, তবে অলৌকিক আলোয় ভেসে থাকা   যায় না। আমি জানি অস্ফুট মুখরতা বলে আমার জগতে কিছু নেই। আমার মত টার্গেট তাড়িত মানুষের পাথরে পাথর ঘষে  শ্বাসরোধ করে বসে থাকাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও দ্বিধাগ্রস্ত ঋতুর চিবুকে মাঝে মাঝে  পথভোলা কোনো জোনাকি  এসে বসে। 

ব্যালনিতে বসেছিলাম। শহরের খোলস থেকে বেরিয়ে আসছিল অন্য এক শহর। রূপক এসে বসেছিল পাশে। মনে  হয়েছিল চরাচর ভরে উবে পূর্ণিমায়। আকাশে বড় চাঁদও ছিল। তবু পূর্ণিমা আসেনা। রূপক শুধু বলেছিল,  ‘আজ তোকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।’

কেমন অন্যরকম ?

সাম থিং ডিফারেন্ট। লাইক ফ্লাওয়ার, বাট নট  লাইক অ্যান  অর্কিড।’ 

আর প্রশ্ন করিনি। এটুকু বোঝে বলেই তো রূপক পাশে এসে বসতে পারে। আর আমি ও পাশে থাকলেও নিজের কাছে  থাকতে পারি। বাকিদের স্রোতে স্রোত রাখি শুধু। এই যে তুমি আমার মধ্যে বইছ এভাবে, তুমি তো সত্যিই স্রোতস্বিনী। তোমার মত আমিও প্রবাহই বহন করি। তবে আমার এই প্রবাহে ধারন বলে কিছু নেই। শুধুই বহন। যা কিছু রোজ ভাঙি  বানাই, তা শুধু বয়ে বেড়াই । দিন শেষে কিছুই জমেনা। ভেতরে গুমরে ওঠে ভিক্ষের ঝুলি। 

 

ছুটি ছুটি

আজ রবিবার। আমার ছুটির দিন। খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল।  অনেকদিন পর আজ সকাল দেখলাম। বসন্তের সকাল।  ব্যালকনিতে বসে থাকতে থাকতে মনে হল সকালের কোন ভূগোল থাকেনা। রোদ আর ব্যস্ততা হামলে পড়ার আগে যে  এমন  একটা  স্নিগ্ধ আহ্বান এসে রোজ  ডেকে ডেকে ফিরে যায়, ভাবতেই মনখারাপ হয়ে গেল। ঘর থেকে মার পুজোর   ফুল আর ধুপের গন্ধ ভেসে আসছে। ঘেন্নায় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে  নেওয়া , বিরক্তিতে সরে যাওয়া মুহূর্তরা সে সুগন্ধ মেখে ফিরে আসছে  আজ আর কোথাও যাবো না। আজ সারাদিন শুধু তুমি আর মা।  আচ্ছা তোমরা যে কি সব  পরপারের কথা বল, সে যদি থেকে থাকে তবে তো তুমি এখন সেই চির বসন্তের দেশের মানুষ। এবার বলো তো তোমার  রবি কি এখনও তার ‘সাধের সাধনার’ জন্য তেমনই একাগ্র ? যে অতৃপ্তি নিয়ে তুমি চলে গেলে সে কি এখনও আছে ? বাঁশির সুরের দূরত্বটুকু কি তোমরা অতিক্রম করেছ ? খুব আশ্চর্য লাগছে জানো, এই যে আমি তোমাকে যা যা বলছি, যেসব  শব্দে বলছি এসব নিয়ে কিন্তু আমি এখনও যথেষ্ট আমার ভাষায় খিল্লি করি।  অথচ দ্যাখ, কেমন স্বছন্দে তোমার সঙ্গে   বোকা বোকা বিষয় নিয়ে কথা বলছি। তবে কি --- না থাক, আর ছেঁড়াখোঁড়াও করতে ইচ্ছে করছে না এখন। বরং    তোমাকে সেই অন্য আমির গল্পটা বলি। 

আমার কলেজ জীবন শুরু ইলেভেন থেকে। দশটা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাস চলতো। কো এড কলেজ। ইচ্ছেমত ক্লাস কামাই-এর স্বাধীনতা, গাছতলার আড্ডা, সব মিলিয়ে বিস্ময় আর ঘোর। ছোট  থেকেই আমি খুব একটা হৈচৈ করতে    পারতাম না। শুনতাম আর ভরে উঠতাম। নির্ঝরও ছিল আমার মত। ওর চশমায় বন্দী চোখ, বাউন্ডুলে চুল, উদাস ভঙ্গি সবকিছুকেই ছুতে পারতাম আমি। অনেক বই পড়ত নির্ঝর। কবিতা ভালোবাসতো। আমাকে শোনাতো, ‘রাতের সব তারাই   থাকে দিনের আলোর গভীরে।’ বলতো ‘বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট, আর ফুসফুসভরা হাসি’র কথানির্ঝরই প্রথম    শুনিয়েছিল তোমার কথা রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠানের কথা। ও বলতো, তুমি নাকি কবির সৃষ্টির আত্মার বন্ধু ছিলে। তখন  তোমাকে জানার মত খুব বেশী উপাদান ছিল না আমাদের সামনে। তবু ও তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী জানতহয়ত  তোমার ঠাকুরপোর চেয়েও। ঠাকুরবাড়ির শিক্ষা, আদবকায়দা আর সবার উপেক্ষায় কুঁকড়ে থাকা তোমার যন্ত্রনাকে  চিনিয়েছিল নির্ঝর। কবির কবিতার প্রথম পাঠক ও সমালোচক ছিলে তুমি। অথচ কি স্নিগ্ধতায় মুড়িয়ে রাখতে তোমার সমস্ত শক্তি, সব আগুন। সেই প্রথম পূর্ণতার স্পর্শ পাই আমি। যত সময় পেরিয়েছে তোমার ভেতর আশ্রয় নিয়েছি আমি। যে সেই খোঁজ দিয়েছিল, সেই নির্ঝর কিন্তু হারিয়ে গেল জীবন থেকে। বাবার ইচ্ছেয় বড় চাকরীর জন্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল। প্রথমে কিছুদিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। বুঝতাম পড়াশোনাটা ওর কাছে খুব চাপের মনে হচ্ছে । তারপর দুজনেরই  নানা ঠিকানা বদল হল। আমরা হারিয়ে গেলাম। থেকে গেল ওর শোনানো কবিতা, ‘বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে...’    আমার একলা বিষাদ, একলা জাগা, একলা সকালের গল্পগুলো বড় হতে লাগলো। এই সফল জীবনে খুব জানতে ইচ্ছে করে ,ওর সেদিনের সেই দুঃখ বিহীন দুঃখগুলো কি এখনও আছে ? ভিড়ের ভেতর ওকে খুজি। খোঁজটা আড়াল করে রাখি আমার ঝকঝকে যাপন দিয়ে।

 

জমাতে জমাতে জমকালো পাথর

ওইটুকু ছাড়া আমার আর কোন ধার নেই। সামনে এগোনো কখন যেন অভ্যেস হয়ে গেছে। গতির স্রোতে ভেসে গেছে মুখচোরা মেয়েটা। জয়েন্টে আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি টেক পাস  করে   আমি এখন এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। এই পদে পৌঁছতে আমাকে কয়েকজন যোগ্যতা সম্পন্ন  ব্যক্তিকে টপকাতে হয়েছে। আর এই কাজ শুধু দক্ষতায় হয়নি। দেওয়া নেওয়ার শুরু সেই থেকেই। অ্যাম্বিশন নামের  জেদি   স্মার্ট শব্দকে কিছুতেই তাড়াতে পারিনি। আমাকে এক্সপ্লয়ে করেনি কেউআমিই  নিজেকে তুলে ধরেছি বসেদের দামী  একাকীত্বের কাছে। একের পর এক  বাধা ডিঙ্গিয়েছি। ক্রমশ জড়তা কেটেছে। নিজের থেকে শরীরকে আলাদা করেছি শানিত হয়েছে সৌন্দর্য। নেশা এসেছে। পুরুষ এসেছে। হাত পেতেছে। উভয়েই পূর্ণ হয়েছি। না, বিয়ে করবো না। গণ্ডী, খাঁচা এসব আমার জন্য নয়। দামী ফ্ল্যাটে মাকে নিয়ে থাকি। মা আছে বলে এখনও ঘরের গন্ধ পাই। এখনও কম কথা বলি, তবে শোনার কিছু পাই না। রো ওয়াইনের সঙ্গে গিলে ফেলি এক একটা অতিক্রমের গল্প।  

সন্ধ্যেটা থমথম করছে। দূরে কোথাও সন্ধ্যামণি ফুটেছে। ঝিঙ্গেমাচার হলুদ ফুলেরা সন্ধ্যাতারাকে পৃথিবীর গল্প পাঠাচ্ছে। চুল বেঁধে, গা ধুয়ে তুমি এসে দাঁড়িয়েছ ছাদে। পড়েছ ফলসা রঙের কালোপাড় শাড়ি। জমানো রক্তের মত ছোট্ট চুনির দুল  তোমার কানে। খোঁপায় দোলনচাঁপা। হোক না বসন্ত, তবুও দোলনচাঁপাই। আমি আমার সমস্ত আমিটুকু জড়ো করে বাড়িয়ে  দিচ্ছি। তুমি আমায় ছুঁয়ে থাক। আমার আলোয় পোড়া শরীরে তোমার প্রিয় সব অন্ধকার পুঁতে দাও। আজ চাই,    ভীষণভাবে চাই, তোমার হু হু ডাক আমায় নিংড়ে নিক। আমার ভালবাসতে না পারার যন্ত্রণা তীব্র হোক।  অন্তত দুএক  ফোটা সকাল পাক কাদম্বরী সেন। ভেতরের দিঘটা গভীর হোক। নির্ঝরের জন্য প্রতীক্ষা থাক অনিবার্য হয়ে। কিন্তু আমার  তো তোমার মত একাকীত্বের ঐশ্বর্য নেই। আমাদের একাকীত্বকে, কষ্টের গৌরবকে প্রতিমুহূর্তে  ঠুকরে খাচ্ছে  আমাদেরই আরোপিত স্মার্টনেস।  কি করে ফিরবে এযুগের কাদম্বরীরা ?  কতটা বিষ জমালে তবে নির্বাসন ?