সম্পাদকীয় বলে আলাদা কিছু লিখব না এই সংখ্যয়। যা বলার, তা বলা আছে ‘ভালোবাসা’ সংখ্যার গদ্যাবলীতেই। পরিবর্তে রইলো নবনীতা দেবসেনের বহুল পঠিত ‘ভালোবাসা’ কবিতাটি । এর চাইতে এই মুহূর্তে আর কোন কথা প্রাসঙ্গিক হতে পারে! এই সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছেন শুভব্রত চৌধুরী।
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
ভালোবাসা
নবনীতা দেবসেন
ভালোঃ তোমার ভালো, আমার ভালো
ভালো এখন নয় তো, ‘আমাদের’-
কখন ভালোর ‘ভালো’টা ফসকালো
ভালো এখন এদের ওদের তাদের।
বাসাঃ তোমার বাসা, আমার বাসা
বাসা এলহন নয় তো, ‘আমাদের’
কখন বাসায় শাপ দিয়ে দুর্বাসা
বে&টে দিলেন এদের ওদের তাদের।
পালাক ভালো, যাক না উড়ে বাসা
জগতটাকে দিচ্ছি তবু ফাঁকি
চিতার ভস্ম নাভির কুণ্ড বাকিঃ
তোমার আমার উহ্য ভালোবাসা।
এই সংখ্যার কবি
গৌরাঙ্গ মণ্ডল
পথের আড়ালে
১
সারা গা, আঙুল জ্বলছে
অপেক্ষাকে পুড়তে দেখে আমি
শ্মশানের পথ ছেড়ে পালিয়ে এলাম
চেয়ে আছি। যেমন তাকিয়ে রাখে ভয়
জ্যান্ত মানুষের প্রেতে
নিজেকে কবর মনে হয়
শুনি --- বিছানার পাশে
হতাশা ছিটকে ওঠে
শক্ত লাগে বালিশের খোল
যা খুঁজি, তা মিছে খুঁজি
অগ্নি হারিয়ে তার পেয়েছে সকল
২
দু'জন শোকের মতো দেখতে
বসে থাকে কাঁধের উপর
কেবলই ফুসলিয়ে বলে
পাশ ফেরো, দেখো --- জড়তা, তরুণ দূত
পথ ধরে আনিয়েছে ঘাটে
কিছু খোয়া গেল কি সহজে?
শুধু ভেঙে আসা, ভেঙে ভেঙে আসা আর
আজীবন ধরে তার নখরক্তশাপে
পরজন্ম ঘোলে যায় ইহজন্ম বিষাদ সরাতে
সেলুন
মাথার উপর ঘন হয়ে আছে নিরাশার কালো
ছাটুন, এভাবে। আর কেউ
সহজে না ধরে ফেলতে পারে
ক্রিম
ক্রিমবিস্কুটের খোলে বেঁধে ছিল দু'খানি অযোগ
দেবতা, আরামপ্রিয়। মধ্যে এসে
সাদা হয়ে ভেঙেছে আঁটুনি
রক্ষী
বারান্দা পাহারা দেয় ছিটেফোঁটা রোদ
যেন ভীতু, আদুরে বেড়াল। কেউ
দরজা খোলার আগেই, বিছানায়
এসে পড়ে কোলের উপর
একটি চতুর্দশপদী
হিন্দোল ভট্টাচার্য
আমাদের ভূতে পাওয়া
হিজিবিজি শস্যক্ষেতে আরও
পঙ্গপাল উড়ে আসে; কেড়ে নিয়ে যায় সব ধান
রক্তদাগ পড়ে থাকে, মিশে যায় ভোরের আজান
বিষাদসিন্ধুর সঙ্গে, মাথা নীচু হয়ে যায় তারও
যে অস্ত্র ধরেছে হাতে, যে ঘৃণা করেছে তার ব্রত-
কী আচমকা ভূমিকম্প হয়ে গেল
শহরে শহরে...
এমন বিদেশি ঝড় কখনও কি
এসেছিল ঝড়ে?
মানুষ নিজের পায়ে কুড়ুল
মেরেছে অবিরত
সাক্ষী তো সময়, তার কাছে বসে হেমলকের স্বাদ
করেছে যে জন, জানে, সে তো নয় সক্রেটিস কোনও
যা কিছু অসীম নয়, ভেঙে যায়, যা কিছু বানানো
ভাসে নোংরা জল যেন,
কালভার্ট পেরোলেই খাদ।
আগুন লেগেছে তাই, তোমাকেই বলেছি বাঁচাও।
কত ভালোবাসো তুমি? কতদিন বেঁচে থাকতে চাও?
অপেক্ষা
শঙ্খশুভ্র পাত্র
অপেক্ষায় থেকে থেকে আজ সেই পয়মন্ত ভোর ৷
মন তো জানান দিল ৷ জানালার একপাশে তুই —
ইতু হয়ে বসেছিস ৷ আনমনা কাগজ-কলম,
ষোল ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, জবুথবু, লেখে না কিছুই ৷
নিকানো উঠোন, তুমি সর্বভূতে আর্বিভূত ক্ষমা...
নিরক্ষীয়, ক্ষীণকায়া, মায়াভরা চাহনি অশেষ ৷
কে বোঝে সকল অর্থ — সকালেই এত এত ঋণ
হরিণে জাগ্রত করো... সীমাহীন অরণ্যপ্রদেশ ৷
সৌজন্য, প্রসীদাপন্ন — এই ভোর করকবলিত
বলিতে পারি না সব — কথায় কি এসে যায়, প্রভু ৷
রাতুল-বাতুল মন একাকার হয় যদি আজ
তুমি কেন মানবে না যথাবিধি একটু সবুর !
ইতু থেকে তুই, তুমি... মাঝখানে পয়মন্ত ভোর...
অন্তহীন আশা, ভাষা— এসো, এসো...খোলা আছে দোর ৷
শঙ্খশুভ্র পাত্র
অপেক্ষায় থেকে থেকে আজ সেই পয়মন্ত ভোর ৷
মন তো জানান দিল ৷ জানালার একপাশে তুই —
ইতু হয়ে বসেছিস ৷ আনমনা কাগজ-কলম,
ষোল ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, জবুথবু, লেখে না কিছুই ৷
নিকানো উঠোন, তুমি সর্বভূতে আর্বিভূত ক্ষমা...
নিরক্ষীয়, ক্ষীণকায়া, মায়াভরা চাহনি অশেষ ৷
কে বোঝে সকল অর্থ — সকালেই এত এত ঋণ
হরিণে জাগ্রত করো... সীমাহীন অরণ্যপ্রদেশ ৷
সৌজন্য, প্রসীদাপন্ন — এই ভোর করকবলিত
বলিতে পারি না সব — কথায় কি এসে যায়, প্রভু ৷
রাতুল-বাতুল মন একাকার হয় যদি আজ
তুমি কেন মানবে না যথাবিধি একটু সবুর !
ইতু থেকে তুই, তুমি... মাঝখানে পয়মন্ত ভোর...
অন্তহীন আশা, ভাষা— এসো, এসো...খোলা আছে দোর ৷
অন্ধ
মেয়েটির গল্প
অমিত সরকার
একটি বড়গল্প ধীরে ধীরে
হেঁটে আসছে
অন্ধ মেয়েটির সিঁথিতে
তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে
রাজি হচ্ছে না গাছ
ঘরের জানলা খুলতে রাজি নয়
শ্রীমতি আলোটিও
এখন কীভাবে জমিয়ে রাখবো
তার এই একটু একটু করে মরে
যাওয়া
বিছানায় নখ বার করে শুয়ে
যে বেগুনী সূর্যাস্ত
কীভাবে শেখাব তাকে গর্ভবতী
নষ্টতার মহড়া
অন্ধ মেয়েটি শুধু শরীর
বেলতে বেলতে অভ্যস্ত রুটি
অন্ধ মেয়েটি শুধু শরীর
সেঁকতে সেঁকতে পোড়া তরকারি
মাঝখানে কিছুক্ষণ বৃষ্টি
নেমেছিল অপারেশন টেবিলে
আর সমস্ত মনখারাপ রোমকূপ
থেকে
উৎফুল্ল হয়ে বেরিয়ে এসেছিল
ছিপছিপে ঘাসেরা
প্রাচীন প্যাপিরাসেরা
এরকমই
আমি, এই
অন্ধ মেয়েটির পিতা
এই গল্পটাই লেখার জন্যে এতকাল …
ঝমঝম
অরণ্যা সরকার
তোমার শব্দের
হাত ধরে বসি
আমাদের জড়িয়ে
স্তরীভুত বধিরতা
বৃষ্টি এঁকে
ডুবিয়েছি জলে
ঝমঝম পড়ে আছে
অগভীর বলে ছেড়ে
গেছে নদী
‘দুয়ো’ লেগে
আছে কলারে,
আস্তিনে
যত গোপন মোছা
রুমাল
রুমাল লুকোনো
ড্রয়ার বেজে ওঠে
তুমি আমার
শব্দে নামাও পানসি
বাতাস শানাও
চিৎকারে
ঠোঁটের মেঝেতে
পসরা জমায় সোরগোল
চুমুতে সাজাও
ছিপ
কে কার মত হতে
চেয়ে নিভে যায়
কারা সব সীমানা
বাঁচায়
তবুও তো পৌরুষ
ডাকে,
গর্ভজল আড়ি পেতে থাকে
যৌনতা পেলে খুব, শব্দেরাই সঙ্গম করে
শব্দযোনি উগরে
দেয় পাথর শুধু পাথর...
কথকতা
রণদেব
দাশগুপ্ত
তোমাকে
বলব বলেই তো এত কথা
জারুল
গাছে এইমাত্র লুকিয়ে পড়া দুপুর
আর
ঢুলতে থাকা অফিস-কেরাণী
ট্রেনের
জানলায় কৌতূহলী শিশুর মুখ
আর
অনেকদিন বরের খবর না পাওয়া
গ্রামের
বধূটি
সবাই
তো তোমার জন্যই বসেছিল এতক্ষণ |
তোমাকে
শোনাব বলে এতসব দেখা
এতদিন
লেখা হয়েছিল
তোমাকে
বলব বলে আমি একা নদীতে নেমেছি, অমলিন
অনুপম দাশশর্মা
মেঘের দরজা ফাঁক করে ছুটে আসছে খাবলা রোদ
শীত গভীর হলে ভাঙা কার্নিশের
অভিমান নিভে যায় হিম ছুঁয়ে
হাওয়ায় ভেসে আসে মায়াবীডাহুকের শিস
অথচ কুয়াশার সমস্ত রহস্যময়তা থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষকে উত্তাপ যোগান দিচ্ছে
রাস্তার মোড়ের একধারে শিবুকাকার চায়ের দোকান।
সেখানে পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকার ছোট ছোট জটলায়
চলকে ওঠে দারিদ্র্যের বিনীত মুখগুলি।
আভিজাত্যের লেশমাত্র নেই, প্রত্যেকের বুকে
এক সমুদ্র ঢেউ উথলে ওঠে কুশল বিনিময়ে
ভয়হীন আকাঙ্খার ছোট ছোট সরলমুখে
সে-যেন জন্ম নেওয়া বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস।
মিথ্যে অভিমানের আকাশ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া
নরম রোদ ঢলে পড়ে দিনমজুরের শান্ত সকালে।
হাওয়া বয়। সবার মুঠোতে গজিয়ে ওঠে
পরিশ্রমী তাপের শিকড়
রোদের বয়স বাড়লে দালানকুঠিতে
আরম্ভ হতে থাকে ছন্দহীন প্রণয়ের মহড়া
সাক্ষী থাকে পেয়ালায় ধরা অসাড় আঙ্গুলগুলি।
দুপুর কলোনি
সুপ্রভাত মেট্যা
এখন রাতের প্রহর ।
তোমার হাত ছুঁয়ে জ্বলেছি দুপুর কলোনি ।
শরীরের ভালো ও মন্দের কাছে যাই।
গিয়ে দেখি, যা- কিছু পাওয়া সে একান্তই নিজের । পরের বলতে
কিছু নেই আর।
এই যে সত্য, এটা সত্য যে
আমারা কেউ কাউকে সেভাবে দিইনি;
যেভাবে দিয়ে আর চাওয়া যায়না কখনও ।
প্রথম তোমাকে মেশায় আমি খুশি হইনি।
পরের রোববার, তারও পরের রোববার কেটে গেলে একটা ম্লান হাসি খেলে
যায়, এবং
তুমি ক্রমশ বৃহৎ হয়ে ওঠো!
এই বত্রিশ বছরের বিছানা ছুঁয়ে দেখি,
চেনার উপায় নেই,
কখন বাহান্নয় পৌঁছে গিয়েও হয়েছি....
ছাব্বিশ ডিসেম্বর
উৎপল মান
ভুলে গেছ
স্বাভাবিক
ভুলে যাওয়া ধর্ম মানুষের
না হলে কীভাবে আবার
তুমি চড়বে
অন্য জাহাজে
সমুদ্রের ঢেউ
নীল তার দ্যুতি
অমোঘ টান, ঘূর্ণির
ভুলে যাওয়া
প্রবণতাটি ঠিক
তাই ভুলে যাও এই ডিসেম্বর
ছাব্বিশে খুব শীত
ছিল আগুন
আজও আমার বুকে ঘোড়া ছোটায়
প্রকৃত চলন
ছিল তোমারও
এত আলো, স্পর্শ, গাঢ় শিখা
তোমার মনে নেই ঠিক
স্বাভাবিক, স্বাভাবিক
কৃষ্ণ'দা
অভিজিৎ
বেরা
কৃষ্ণদা
অফিসে ঘুমোয়—এটা কোনও বিষয় না
বিষয়টা
হল—কৃষ্ণদা অফিসে নাক ডেকে ঘুমোয়।
এটাও
তেমন বিষয় না, বিষয়টা হল—
কৃষ্ণদা
নাক ডাকার ফাঁকে ভীষণ বকে।
এটাও
না, মূল হল—
কৃষ্ণদা
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সাহেবকে গালি দেয়।
কৃষ্ণদা
কালো, টেকো, ক্যাজুয়াল ওয়ার্কার।এখন বাঁচার জন্য
সাহেবের
পেনের ডগায় ঝুলছে। পাঁচতলায়।নিচে
বাস,
ট্যাক্সি, ট্রাম। হর্ন। কৃষ্ণদা পড়ছে...চারতলা পেরল।বাবা বলল
—কৃষ্ণ
রে! তিনতলা পেরল, মা বলল—কেষ্টা! দোতলা
পেরল,
ছেলে কঁকিয়ে উঠল—বাবা! একতলা পেরল—কোলের
মেয়ে
কেঁপে উঠল ঘুমে।নিচে পড়ল, বৌ দৌড়ে এল।রাস্তার
লোকজন।
কৃষ্ণদা
নিচে পড়ল—এটা কোনও বিষয় না, বিষয়টা হল—
কৃষ্ণদার
বৌ কোনও টাকা পয়সা পাবে না।এটাও কোনও বিষয়
না,
বিষয়টা হল—লোকটা কালো, টেকো, ক্যাজুয়াল ওয়ার্কার।
পুরো
নাম কৃষ্ণ আমেদ!
খোঁজ
মাধবী দাস
বুড়ো বট গাছটার তলে
দাঁড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যা- আজান সেখানে শিবের থান ...
বিতর্কের মাঠে মাঠে
বেদনা প্রসব করে
বিদায় নিয়েছে হেমন্তের
বিপন্ন গঙ্গা ফড়িং
কুয়াশা দিগন্ত ঢেকে দিলে
পুরাণের পাতায় পাতায়
বুঁদ হয়ে খুঁজি
'ভারত' শব্দের ইতিহাস
মাধবী দাস
বুড়ো বট গাছটার তলে
দাঁড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যা- আজান সেখানে শিবের থান ...
বিতর্কের মাঠে মাঠে
বেদনা প্রসব করে
বিদায় নিয়েছে হেমন্তের
বিপন্ন গঙ্গা ফড়িং
কুয়াশা দিগন্ত ঢেকে দিলে
পুরাণের পাতায় পাতায়
বুঁদ হয়ে খুঁজি
'ভারত' শব্দের ইতিহাস
শীতের সঙ্গে ভালোবাসাবাসি
পিয়াল রায়
বাতাস কমে যেতেই
ধীরেধীরে আবির্ভূত হল শীত
শ্লথ ক্ষুরধার
ভেঙে পড়া অশরীরী জ্যোৎস্না থেকে
একটা কালো স্রোত
ধাক্কা মারতে চাইল
এ কথা সরাসরি বলিনি কখনো
বলিনি যে প্রবল শীত কিভাবে আমাকে
ঠেলেছিল অতল নরকে
মরা তাপে কাতরে উঠেছিল স্বপ্ন
এখন নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
নিজের ভিতর নিতে আমি ভালোইবাসি
তার ঠাণ্ডা বিরূপ আবেগ
আমি এখন শীতের সঙ্গে ভালোবাসাবাসিতেই আছি
শিশুর মতো শূন্য...শিশুর মতো পূর্ণ
ভবঘুরে মানুষটা
বাপ্পাদিত্য রায়বিশ্বাস
রাস্তা ও ফুটপাথ দুটোকেই বাঁচিয়ে
রেলিংয়ে পিঠ দিয়ে
লোকটা পাশ ফিরে আছে
তোমার ছুটে যাওয়া
আমার হেঁটে চলা
কোনোটারই সে অন্তরায় নয়
অতখানি অপমান সত্ত্বেও
সভ্যতা, ভাল করে দ্যাখো
জুতোদুটো জড়ো করে আমাদের দৃষ্টির তিরপথে রাখা
যেন তোমার আমার –
কারো যদি কাজে লাগে ভাল হয়
সমস্ত জমি থেকে সরে যাওয়া মানুষটা
এটুকু ভেবেই
বড় আরামে ঘুমোয়
খেলাঘর
কমলেশ কুমার
-
কথা ছিল নিদারুণ যন্ত্রণায় ভেসে গেলেও
বেঁচে থাকবে দিগন্তের অবিচ্ছিন্ন সম্বল;
হাসির ভিতরে লুকিয়ে থাকা কান্নার আড়াল
জানত
বৈশাখের আগুনে পুড়েও
আমরা ঠিক পেরিয়ে যাব
যত প্রলয় আর দুর্যোগের দিন।
আমাদের সাজানো ডানা
একদিন এই ধুলোমাখা গন্ডগ্রাম পেরিয়ে
আত্মপ্রকাশ ঘটাবে আলোঝলমল এক নতুন
নক্ষত্র-পৃথিবীর!
-
এভাবেই স্তব্ধতার কাছে বন্ধক রেখেছিলাম
যত আবহমান
শুধু, সূর্যাস্তের আগুনে শীত শেষ হয়ে এলে দেখি
আমরাও বকুল ফুলের মতোই
কেমন ঝরে গেছি টুপটাপ,
নিরন্তর
মতিউল ইসলাম
আমার ঘর জুড়ে অ আ ক খ
রান্নাঘরে ব্লাকশিপ চিলেকোঠায় লিটিল স্টার,
স্নানঘরে সাঁতার কাটে পেনসিল ইরেজার।
দেওয়াল জুড়ে ব্লাকবোর্ড,
কখন সেগুলো যেন মেঘ হয়ে যায়
ভেলার মতো ভাসতে থাকে 1 2 3 4,
আমার সন্তানের আধোগলায় জাতীয় সঙ্গীতে
মুছে যায় হিন্দু মুসলমানের চিরন্তন বিরোধ,
জলা জমিতে চুটিয়ে কাবাডি খেলে
রাম আর মহম্মদ।
আমার সন্তানের স্কুল ব্যাগে
এক পৃথিবী বিশ্বাস,
আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি।
কৃষ্ণ ইশারা
শুভদীপ
রায়
তাকে
কথার
জবাব চাওয়াতে
সম্পর্ক নিরবতা মাখে যেন মুকমুখ
তবু নক্ষত্রদ্বীপ
ভ্রমণে জ্বালি
হৃদয়ের ঘরে জোনাকি
অথচ চোখে
ঠোঁটে তার বুনো মেঘ
একা গলে
গলে পড়ে পোড়া মন
আর বাক্য
বিরাম চিহ্নে দেখি ফ্যাকাশে ডটেড শূন্য
এবং বাকি
যতটুকু আবদার, তার অধিকাংশ আলোকবর্ষের
দেশে অভিযান আঁকে বিগব্যাং,
তবু কৃষ্ণ ইশারা ছায়া শরীরে
অনন্তের
ঋণ সংবাদ আর উড়ে যাওয়া যত অভিমান
খোঁজে প্রতিবিম্বের গাওয়া বোবাগান
অথচ ফিরে আসেনি আজও প্রিয় প্রতিভাস
তাকে অসম্ভব নাম ভূমিকায়, পথ প্রতীক্ষায় থাকে পথিকের...!
ব্যক্তিগত
মিঠুন চক্রবর্তী
বেলুনওয়ালার মতো এসে দাঁড়িয়েছি আলোর উৎসবে....
পথ-সমুদ্রের কোলাহল থেকে যে সমস্ত হাতের ঢেউ
আমার কাছে ভেসে এসে যেমনটি চেয়েছে, তাদের ঠিক তেমনটি দিয়েছি,
সূর্যমুখী রঙের হলুদ, ময়ূরের গলার মতো চোখ ধাঁধানো কিংবা
জলরঙের মতো ফুরফুরে....
তারপর
আমার ভেতরে যখন কেবল কিছু খুচরোর ধাতব ঝনঝন... ঝনঝন...
তখন তুমি এলে,
তোমার জন্যই বুঝি আমি অপেক্ষায় ছিলাম!
অপেক্ষায়
ছিলাম আমার পছন্দের বৃক্ষরঙটির জন্য, যেটা কেউ চাইলেই
তার মাথা বুকের কাছে টেনে এনে প্রতিটি প্রেমিক শেকড়ের দোতারা
বাজিয়ে শোনায়
অথচ তুমিও কিনা আকাশরঙ চাইলে!
কাউকে ফেরাইনি আমি, দাবানলের ভেতর থেকে দু'হাত বাড়িয়ে
তোমাকে
সাজিয়ে দিলাম ডানায়
তোমার শ্যাম্পু চুলে উড়ছে লাল রঙের প্রজাপতি আলো
যে যা চেয়েছে তাই দিয়েছি, শুধু,
দারুণ আলোর ভেতরে নিজস্ব অবয়ব যতটুকু ছায়ার
অন্ধকার চায় সেই টুকু থাক ব্যক্তিগত
সেই মেয়েটি
অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী
যে ছেলেটির মাথায় থাকে একশ’খানা বাঘের হাসি
যে ছেলেটির হৃদয় থাকে মিশ়্কালো রং প্যাঁচার কামড়।
পাল তুলে তুই জ্যোৎস্না মেখে তারই হলি সর্বনাশী –
তুলোট পাতায় নাম লেখালি তাকিয়ে রইলি অনন্তভর?
কেন অমন হলিরে তুই সাঁতরে চলিস শূন্য দেওয়াল
কেন অমন হলিরে তুই বুকের উপর শিশির চাপা ?
তোরও মাথায় বাঁজ বেঁধেছিস আগুন খেয়ে শক্ত চোয়াল?
তোর চোখেও উঠছে ফুঁটে প্যাঁচার হাসি বাঘের ছাপা।
এক প্রেমিকের দেশ এবং এক প্রেমিকা
বিধান শীল
তুমি ছিলে বামপন্থী ঘরের মেয়ে
তোমার ভেতর কমিউনিজম ছিল কিনা জানি না
মার্কস, লেলিনের সাথে পরিচয় হয়েছিল কিনা সেটাও জানি না
তবে অগাধ ভালোবাসতে আমায়
বামপন্থীরা আমাকে গুপ্তচর বলে সন্দেহ করতো
আর ডানপন্থীরা বলতো বিশ্বাসঘাতক!
অথচ কোনদিন কারোর সাথে অবিশ্বাসের কাজ করিনি
আমার সাথে ওরা কেউ কথা বলতো না
অথচ ওই ভিড়ে মিশে ছিলো আমার বন্ধু, দাদা, কাকা, আত্মীয়স্বজন ।
আমার কোন দলীয় পতাকা ছিল না,
বুকের ভেতর মেঘের মতো ভেসে বেড়াতো জাতীয় পতাকা ।
ভালোবাসাকে উপেক্ষা করিনি কক্ষনো
কে কী বললো, সে কথা ভাবিনি কোনদিন
নিজের ভালোবাসার পেছনে ছুটেছি বহতা নদীর মতো ।
কোন পন্থা বিশ্বাস ছিল না আমার
দেশপ্রেম মজুত ছিল বুকের স্তরে স্তরে
তবু যারা একদিন একটা নির্দিষ্ট পার্টির তকমা মেরেছিল গায়ে
দেখি, তারাই আজ গাইছে, ' রং দে তু মোহে গেরুয়া '।
আসলে কেউ কোন নীতি বা আদর্শে বিশ্বাসী নয়
সবাই সুবিধাবাদী; স্বার্থপর
ভরা জোয়ার দেখলে নদীতে গা ভাসানোর আকুলতা প্রবল।
তুমি ছিলে বামপন্থী ঘরের মেয়ে --
অথচ দেদার ক্রুশে ঘর গুনে-গুনে
সবুজ, গেরুয়া, হলুদ উল দিয়ে বানাতে নানা ডিজাইনের সোয়েটার ।
তোমার মুখোমুখি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বললে
সকলেই মনে-মনে ভেবে নিতো
আমরা দু'জন দাঁড়িয়ে আছি একটা লাল লেডিস ছাতার নীচে
অথচ কালো ছাতার ভেতর অন্ধকার চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়তো মাথার উপর
আর আমরা নক্ষত্র ভাঙা বিচ্ছিন্ন আকাশ দেখতাম বিস্ময়ে ।
জেলের ছেলে জাল বুনে মাছ বিক্রি করবে
চাষির ছেলে মাঠে চাষ করে ফসল তুলবে
বামপন্থী ঘরের মেয়ে বামপন্থী হবে
এই পরম্পরা নীতিতে বিশ্বাস ছিল না কোনদিন
তাই কখনো জিজ্ঞেস করিনি তোমার প্রিয় রং কী?
আমার বিশ্বাস ছিল তোমার অগাধ ভালোবাসায়
মার্কস, লেলিন কিংবা গাঁধী কারো ছবি তোমার নক্ষত্র চোখে দেখিনি
বারবার শুধু ভেসে উঠেছে আমার প্রতিবিম্বের অবয়ব
আর আমি তেরঙ্গা ঝান্ডা উঁচিয়ে সগর্বে বলেছি,
"ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো "
ঘুর্ণি
জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়
আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্বে অপরিচয় এসে ঘাই মারছিল
কী নিঁখুত অবয়ব, হাতে গড়া নৌকা
যা পূর্বজন্মে কোনও চিঠি ছিল
ধীরে ধীরে সিক্তে জড়াচ্ছে আমাকে
এসব গ্রাহ্য নয়, তবু ডুবন্ত যা কিছু
ফেলে আসা ঘুর্ণি, ছোট্ট একটা বৃত্ত
টেনে ধরে আমাদের
জল এসে হানা দেয় অনেক ভিতর
গৈরিক
শান্তনু পাত্র
তুমি দিব্যি হেঁটে যাও
অত্যাশ্চর্য রাস্তায়।
গেরুয়া রঙের ঘ্রাণ।
আমরা তো দূরেই থাকি
পথের আড়ালে। এসে। হেসে
নিজেই ঘুরেছো একা বাউলের বেশে।
তুমি দিব্যি হেঁটে যাও
অত্যাশ্চর্য রাস্তায়।
গেরুয়া রঙের ঘ্রাণ।
আমরা তো দূরেই থাকি
পথের আড়ালে। এসে। হেসে
নিজেই ঘুরেছো একা বাউলের বেশে।
ছবি
সৌরভ বর্ধন
নিজের ছবির কাছে হাঁটু মুড়ে বসে আছি
বসে থাকা আমার প্রিয় নয়
তবু অনেক সেকেন্ড পর একটু বসতে ইচ্ছে করে
নইলে তো আমার সাইকেল আমি দুর্বার ছুটিয়ে দিই
গ্রামান্তরে, হালকাপলকা জঙ্গলে, অমোঘ বাতাসে
একটা দুটো কাঠবেড়ালী আর ঝোপঝাড় তখন
অপেক্ষমান স্রোতের মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে
ঘোরের মধ্যে নামে একটা কাঠ, কাঠের শেষে রোদ্দুর
ছবির কাছে বসে আছে তন্দ্রা, হাঁটু মুড়ে বসে আছে
আমিও বসে থাকি অসুখে, দংশনে, গাছের পাতায়
নাইটিঙ্গেল
রথীন পার্থ মণ্ডল
একটা নাইটিঙ্গেল উঠে আসে, মাঝরাতে
শরীর জড়ের মতো সংজ্ঞায়িত ।
আত্মা উঠে দাঁড়ায়
নদীমাতৃক দেশের নামে অক্ষর সাজায়
চামচিকেরা উড়ে যায় ভয় পেয়ে
মহাসাগরের ওপার থেকে সুর নামে
গান লিখিত গাছটি ডানা মেলতেই
জেগে ওঠে নাইটিঙ্গেলের ভাষা।
পাশা খেলায় হেরে
আত্মা অজ্ঞাতবাসে যায়
শ্বাস জাগে জড় শরীরে
প্রশ্বাসে ভেসে যায়
আকাশগঙ্গার কলরব।
মুগ্ধ পাণ্ডুলিপি
রাখী সরদার
পাথর পোড়ানো রাতে
মনে পড়ে তার মুখ
আগুনের পটচিত্রে যে এঁকেছিল দহন...
পরজ নিঃস্বতা...
ইদানীং সে আসেনা
গোপন ক্ষতের জলে দেখতে পাই
হাল্কা মরালী ভঙ্গীতে সাঁতরে আসছে
কুয়াশা আর বিষাদ...
যেন অলৌকিক ভুবনের মুগ্ধ পাণ্ডুলিপি
যেখানে ছায়ার দেহে মায়া ও মায়ার দেহে
ফোঁটা ফোঁটা শূন্য খেলা করে।
ক্রিয়াপদের বাইরে
অভিজিৎ দাসকর্মকার
হয়তো আমি জানি না।
নদীটির প্রসবযন্ত্রণা হলে
এপার ওপার প্রতিবেশিরা কি প্রতিফলিত হয়?
নাকি প্রতিফলক জুড়ে পরিভ্রমণ করে
ল অফ আর্কিমিডিস---
জানি না____
অথচ
যে অনুকুল স্রোতে নদীটি গা ভাসিয়েছিল, সেই অনুকূলে ঋতু ভাসে,
সাথে থাকে অভিস্রবণ পদ্ধতির জীবন।
একটি ডিঙিনৌকো ভাসতে ভাসতে গরিষ্ঠ শরীরে সরলরেখা টানছে
নির্ধারিত
সংলাপ
দৌড়াচ্ছে
দৌড়াচ্ছে এবং দৌড়াচ্ছে
রূপান্তরিত প্রস্তর হাতে ক্লান্ত গণশত্রু
ঠিক হঠাৎই
ক্রিয়াপদের
বাইরে আমি নাস্তিক, অথচ
আমি
সমকোণে সম্মোহিত হই না___
কারণ
কখনও মেঘ আর নদীর মিলনে মধুচন্দ্রিমা দেখিনি...
একবার নিয়ে যাবে তুমি?
তুহিন কুমার
চন্দ
একদিন চলে যাবো ওপারের ঘাটে,
যেতে হবে নিশ্চিত, ওপারে বসে আছে
স্বজন সবাই।
সব কিছু ফেলে যাবো উঠোনের ঘাসে,
বীছন বিছানো মাঠ, মরা নদী শ্মশানের কাঠ,
ঠিকঠাক রাখা আছে ঘাটে।
এপারে কেটে গেছে বহুদিন এবার তো ওপারের ডাকে সাড়া দিতে হবে।
আগামী মরশুমে গোলাপের গাছটা আবার গর্ভবতী হবে।
তাই নক্সা কাটা টব দিয়ে গেছে নদীর মাঝিরা।
ওপারের ঘাট থেকে ডাক দেয় স্বজন সবাই।
ওগো মাঝি একবার নিয়ে যাবে ওপারে আমায়?
এপারে বহুদিন জেগে বসে আছি,
যেতে হবে নিশ্চিত চন্দনের ঘ্রান নিয়ে ওপারের ঘাটে।
ওগো মাঝি একবার নিয়ে যাবে তুমি?
নিয়ে যাবে একাকী ওপারের ঘাটে?
ভ্রমণকাহিনী
নিলয় নন্দী
আলো এবং আঁধারে
কেবল এক দিগন্তরেখার দূরত্ব...
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। গোধূলি। ফিরে আসছে। ঊষা।
আর মধ্যবর্তী বালুচর মেঘ ম্রিয়মাণ রামধনু বা
পারাপার হিসেব নিকেশ উদাসীন বনলতা চোখ
গভীরে যাই জরায়ু ঠোঁট সাঁতরে পার অন্ধকার
এই আলো এই তো নেই কি ভাঙচুর দিব্যি তোর
আলো। প্রলাপ। আঁধার। বিলাপ। এবং....
আঁধারের বায়োগ্রাফি লিখি। আলোর সংলাপ।
বাকি যারা চেটেপুটে বিলম্ব স্বাদ নিশ্চিন্ত প্রহর
সাদা নয় কালো নয় শুধু রঙ শারীরিক স্কেচ
প্রচ্ছদে আমরণ ভোর বা সান্ধ্যবিলাস তবে কার?
কবি। জল ছুঁয়ে যায়। নদী। কাব্যিক আড়াল।
গোধূলি, ঊষা বা ভ্রমণকাহিনী...
আর সেই ফাঁকে,
বকের ডানারা ঝেড়ে ফেলে সম্পূর্ণ একটা দিন।
শপিং মল
চন্দন বাসুলী
নিঃসঙ্গ জানলার ভিতর দিয়ে
বৃদ্ধ পুকুরের দিকে আড়চোখে তাকালে
মাঝ জলে রাজ হাঁসের খেলা অদৃশ্য
ব্যাঙের ডাকে বিরক্ত হওয়ার মতো সশব্দ রাত আজ নেই
প্রতিদিন আধুনিক হতে-হতে
আমারা হারিয়ে ফেলছি গ্রামীণ যা-কিছু...
হৈচৈপূর্ণ বিকেলের শব্দ আর কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছায়না
গড়ে উঠছে বিশাল শপিং-মল
শৈশবের ঘ্রাণ লেগে থাকা পাড়ার প্রিয় মাঠে
মৃতপ্রায় স্মৃতি বুকে নিয়ে কাঁদছে ছেলেবেলা
অত্যাধুনিক ও দাম্ভিক জীবন শৈলীর স্রোতে গা ভাসতে গিয়ে
গোপনে কাঁদা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিনা!
বকুলদহন
সঙ্গীতা মাইতি
একসাথে পুড়ে গেলে চারখানি চোখ
আমারও সাধ হয় গাছের মতো জন্মান্ধ হতে,
কোটরে কোটরে বুনে দিতে ঢেউয়ের মেধাবী উচ্চারণ
বুকের ওম হারালে দূরত্ব বাড়ে ছায়ার সাথে
উপেক্ষার ছুঁচে বুনতে হয় নিজেরই কঙ্কাল
মাটির দেউলে নিথর পড়ে থাকে ভ্রমগুলি,
জন্মের ঠোঁট ছুঁয়ে যেন বকুলদহন।
বহুদূরের নগরে থাকি
মারুফ আহমেদ নয়ন
তোমার থেকে বহুদূরের নগরে থাকি, ধূলো-বালি মাখি সারা গায়ে,
হাওয়ারা এসে নিঃশব্দে উড়িয়ে নেয় তোমার দীঘল কালো চুল, তখন আমি ঝড়ো পাতাদের সাথে
কান্নার মাহফিলে ঝরে পড়ি বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে, আয়ুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সমন্ধে বলুন
পিতামহ, জীবন এতো ছোটো কেনো তবে মৃত্যু ও তার পরবর্তী জীবন কি দীর্ঘস্থায়ী হবে,
ফুলের মায়াবী ঘ্রাণের মতো যেনো বোঁটা থেকে খসে পড়া বকুল-বেলীর সংসার, তা কি তোমার
আমার মৃত্যু চেতনার মতো ফ্যাকাশে...
মায়ানদী
রাবাত রেজা নূর
যেদিকে তাকাই একটা বড়সড় নদী প্রবাহিত হতে দেখি;
শুকনো খটখটে চারদিক; নদীটার তবুও ভরা যৌবন
অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছে নদীটা।
শূন্য মরুভূমির মধ্যেও নদীটা তুমুল সতেজ;
গাঢ় কাকচক্ষু জলে মিটায় তিয়াস।
নদীটার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই; আদিবাসী শামুকের মত শক্ত খোলসে
লুকানো জলতরঙ্গ
পাথরের বুক চিরে বয়ে চলে নদীটার প্রেম।
কবে কোথায় নদীটার সাথে পরিচয়; জানিনা
সে না আমি, কিভাবে প্রণয়; বেমালুম ভুলে গেছি
সে এক অবাক নদী; তার প্রেমে কোনোদিন ডুবেনি; এমন পুরুষ নাই।
নদীটা উৎসারিত হয়েছে মানুষের কলব থেকে;
সিনার ভেতরে তার রঙধনু রঙ
নদীটা প্রবাহিত মানুষের মধ্য দিয়ে;
পা থেকে মাথা অবধি, নদীটার আশ্রয়স্থল।
নদীটার নাম মায়ানদী।
সবুজ সন্তানের জন্য
আমিনুল ইসলাম
সবুজ পাতাগুলোকে স্বাচ্ছন্দে
বাঁচতে দাও, এটা অধিকার
খাঁচায় পুষে রাখা পাখিদের উড়ে যাওয়ার যথেষ্ট সময় এটা,
ওদেরও উড়তে দাও
উড়তে উড়তে ক্রমশঃ অনেক দূরে তোমার ছোঁয়ার বাইরে-
অচিরেই দেখো, কীভাবে একা হয়ে পড়েছো নিজের অলক্ষ্যেই
চোখের সীমানায় তোমার বাড়ি, আর অন্যের বাড়ি সে অনেক দূর
দূরবীনের ভ্রু-পল্লবে তাই - একটাও শীত বিন্দু নেই,
নেই বলেই, তোমার চোখ ঝাপসা কাঁচের ফ্রেমে গৃহবন্দী আজ...
আর ওদের চোখ, কোনো অন্ধকার নেই, আলো শুধুই আলো জ্বলছে...
প্রেক্ষাগৃহ
সূর্য ঘোষ
এইমাত্র আলো নিভে গেলো
এইমাত্র আমরা
আকুল অন্ধকারের নিছক দর্শক...।
এইমাত্র তুমি
আলোর প্রতীতি...
বিরহী দুপুর, মূর্ছনা সপ্তম সুর।
হে মহামতি
অশোক,
সমস্ত খুনের
পর পরে থাকা দেহের উত্তাপ-স্মৃতি
গঙ্গার
জল-তর্পণে যেভাবে অদৃশ্য হতে থাকে নিরবধি
সেভাবেই বুকে বাজে ক্লান্ত নুপুর।
রাত ক্রমশঃ
বাড়ছে।
বেশ কিছুক্ষণ
হলো— বিশিষ্ট জনেরা চলে গেছে ।
সুধীবৃন্দ
ধীর লয়ে ত্রিযামা পেরিয়ে ফিরেছে বাড়ির পথে।
এখন ভাঙা ঘর, তবুও মঞ্চে কুশীলব।
এখন আবার আলো
নিভে গেলো
শীতার্ত
আবেশে অন্ধকারের মধ্যে মৃত জোনাকিরা!
শেষ প্রযোজনা, ঘোষক বললেন— নাটক’টা
দেখে যেতে ভুলবেন না...।
নিম্নচাপ কেটে গেছে
দেবাশীষ সান্যাল
আকাশের দিকে তাকালে
শুধু বৃষ্টির কথা মনে পড়ে যায়।
সেই কথা ভাবতে ভাবতে
আমার বুকের ভেতরে
কবিতার খাতাগুলো ভিজে যায়
ভেজা ভেজা অক্ষরে আমি দোতারা বাজাই-
কাঙ্ক্ষিত মেঘ ছুঁয়ে আছে আমাকে।
আমার কবিতার শরীর যখন সোচ্চার-
আবহাওয়া দপ্তর জানিয়ে দিলো
নিম্নচাপ কেটে গেছে
হায় বৃষ্টিনন্দিনী!
আজ আমি কোনো কবিতা লিখিনি-
যা লিখলাম তা শুধুই আমার আর্তনাদ।
পুলওয়ামা
পার্থসারথি
আজকে যারা
কফিন নামায়
বুকের ভেতর পাথর চাপে
আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসাও
দমিয়ে রাখে নিরুত্তাপে
দিনের শেষে গোলাপ ছোড়া
আকাশ বলবে এবার থামা
কান্না চোখে জড়ো কোরো
বুকের ভিতর পুলওয়ামা
জড়িয়ে ধরার আবদারে আজ
মুছতে গিয়েও যায় না মিশে
ভালোবাসার সুপ্রভাতে
রক্ত ঝরে বিয়াল্লিশে
তোমার বুকের দরবারে আজ
বসিয়ে নিও শব্দনামা
কান্না চোখে জড়ো কোরো
বুকের ভিতর পুলওয়ামা
বুকের ভেতর পাথর চাপে
আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসাও
দমিয়ে রাখে নিরুত্তাপে
দিনের শেষে গোলাপ ছোড়া
আকাশ বলবে এবার থামা
কান্না চোখে জড়ো কোরো
বুকের ভিতর পুলওয়ামা
জড়িয়ে ধরার আবদারে আজ
মুছতে গিয়েও যায় না মিশে
ভালোবাসার সুপ্রভাতে
রক্ত ঝরে বিয়াল্লিশে
তোমার বুকের দরবারে আজ
বসিয়ে নিও শব্দনামা
কান্না চোখে জড়ো কোরো
বুকের ভিতর পুলওয়ামা
নব প্রেম
কেকা সেন
তপ্ত দেউলে
সোনালি আঁচড় কেটে নদী এঁকে দিলে
লাল মাটির ধোঁয়া ওঠা বুকে
মিঠে বাঁশির সুরে
বাউল গন্ধ ওড়ে আজ।
কালবৈশাখী মেঘে ডুব দিয়ে
কবির পেলব শব্দেরা
শ্রাবণ-রাগিণী হয়ে ঝরে পড়ে দিগন্ত রেখায়।
ওষ্ঠ রাগ। নব প্রেম। পুরনো গজল।
দড়ির ওপর ফের হাঁটতে হাঁটতে দিন শুরু হল।
ফুলের বাড়ি
বদরুদ্দোজা শেখু
শীতের বেলায় পাড়ায় দেখি অনেক ফুলের মেলা
মৌমাছি আর প্রজাপতি মৌটুসীদের খেলা
উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ফুলের ডগায় ডগায়
জুঁই শিউলি গাঁদা টগর চন্দ্রমল্লিকায়,
তাদের কি যে আনন্দ ভাই খুশবু শুঁকে শুঁকে
পারলে থাকে সারাটি রাত ওই ফুলেদের বুকে,
হাজার রঙে ফুলের মেলা আলোয় আলোয় ভরা
বাগান যেন হাসতে থাকে আনন্দে অধরা ----
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন হাওয়ার তরী
ভাসিয়ে আসে ফুল-বাগানে ছোট্ট ছোট্ট পরী
ফুলগুলোকে আদর করে দিয়ে চাঁদের হাসি
ভোরের আগেই লুকায় তারা তেপান্তরবাসী,
তোমরা যেও ঘুরতে সেথায়, দেখো ঘুরে ঘুরে
রঙ-মহলা ফুলের বাড়ি ভালবাসায় মুড়ে'
হাত দিও না, ফুল তুলো না, ফুল তুলো না ভায়া
ফুল তুললে শুকিয়ে যাবে, দুখিয়ে যাবে মায়া,
গাছগুলো তো ওদের মা-বাপ, তাদের ক'রে দুখী
সর্ভানু দাশগুপ্ত
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন-
"হাতের নীচে তোমার হাত, ওপরে হাত অন্য কারও
আমি তো শুধু জানতে চাই,সহ্য কেন করতে পারো?
ফেটে তো কই পড়ে না রাগে,লুকিয়ে ঠিক রাখো তো ক্ষোভ
রান্নাঘরে তোমাকে পেয়ে বার্স্ট করে না একলা স্টোভ?..."
তোমাকে একলা না বলে,কবি স্টোভকে কেন একলা বললেন জানো? কারণ একটা সময় তোমার ভেতরেও এমনই জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আমার সাথে দেখা না হলে,আমার সাথে কথা না হলে কী অসম্ভব ছটফট করতে তুমি। আমি প্রায়শই টের পেতাম সেই আগুনের তাপ।কবি কিন্ত তোমার মৃত্যু কামনা করেননি। উনি শুধু জানতে চেয়েছেন কোথায় গেল সেই বারুদের স্তূপ?আচমকাই যেন নিভে গেল সব। এই রহস্যময়ী রান্নাঘরে আমি ঢুকিনি কখনও।তবু চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পাই,এই রান্নাঘরের ধোঁয়াশা আমার বুকে পাথরের মতো চেপে বসে থাকে।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখে গেছেন-
"হারিয়ে যারা যাচ্ছে এবং হারিয়ে যারা আসছে
তাদের বুকে ভাসছে পাথর,তাদের বুকেই ভাসছে..."
হয়তো যে উত্তাল সময়ে দাঁড়িয়ে কবি এমন পঙক্তির জন্ম দিয়েছিলেন,সেই সময়ে হারিয়ে যাওয়া বলতে একটা গোটা মানুষ কর্পূররসের মতো উবে যাওয়া,যেন সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল আর কখনো বাড়ি ফিরবে না বলেই। হারিয়ে যারা যাচ্ছে, তাদের বুকে কেমন পাথর থাকে তা আমার জানা নেই। সে খবর রাখতে গেলে আপাদমস্তক কবি হতে হয়। আমি শুধু জানি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। কী অদ্ভুত ভাবো,আমি তোমাকে হারিয়ে সামনের পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি,আর রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি প্রথমবার দেখতে পেলেন আমি হারিয়ে আসছি,তিনিই অনুভব করলেন আমার বুকে চেপে বসে থাকা পাথরটিকে,পুরো ঘটনাটা শুনলেন,বুঝলেন তুমি হারিয়ে গেছ আমার জীবন থেকে।তার চোখে তুমি 'হারিয়ে যারা যাচ্ছে' তার পর্যায়ভুক্ত। অথচ তোমার বুকের পাথরের কথা না ভেবেই অবলীলায় বলেই দিলেন,যে হারিয়ে যেতে চায় তাকে হারিয়ে যেতে দাও!
আমি কিন্তু সেই পাথরটা খুঁজেই চলেছি,ক্ষত আরো গভীর হবে জেনেও।যখনই তোমাকে ফোন করি তখনই শুনতে পাই-'আপনি যে ব্যক্তিকে কল করেছেন তিনি এই মুহূর্তে অন্য কলে ব্যস্ত আছেন...'
তুমি আমার অপর প্রান্তে,আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তোমাকে দেখতে না পেয়ে,আর তোমারও অপর প্রান্তে আরও কেউ যে তোমাকে সারাদিন ব্যস্ত রেখেছে,অথচ আমি জানি সেও তোমাকে শান্তি দেবে না আমার মতোই...কে আছে ওই অপর প্রান্তে? বলো? বলো আমায়?
জয় গোস্বামী আগে ভাবতেন, হয়তো খুব অপরিণত বয়সে...জলের ওপারে প্রেত বসে থাকে ক্ষিদে তেষ্টা নিয়ে...কিন্তু উনিও যে আপাদমস্তক কবি,খুব সহজেই বুঝে গেছেন...
"আজ ভাবি কেউ নেই, কিছু নেই মৃত্যুর ওপারে।
দেহটা পুড়িয়ে দিলে, পুঁতে দিলে—সব,সব মাটি—সব হাওয়া।
যতদিন বেঁচে আছি,ততদিন,হাতের মুঠোয়
কেবল বিশ্বাস আছে।
আর আছে বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া!"