Sunday 28 June 2020

রণজিৎ সরকারের গল্প 'আবুবেন আদম' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা,২০২০

              


আবুবেন আদম               

রণজিৎ সরকার

 

বদন মিত্র রাজ্যের ডাকসাইটে মন্ত্রী, দোর্দণ্ড প্রতাপ। হাই-কম্যান্ডের পরেই যার নাম উচ্চারিত হয়।ফলে দিন দিন নতুন দায়িত্ব, নতুন কাজের চাপ ক্রম বর্ধমান।তিল তিল করে নিজেকে প্রমাণ করেছেন কাজের ছেলে কাছের ছেলে হিসেবে। তার ওপর হাই-কম্যান্ডের অগাধ বিশ্বাস। ওঁর মর্যাদা রাখার জন্য সে সদাই তৎপর। যতই তিনি ওনার কাছের মানুষ হয়ে উঠছেন ততই তিনি নিজের ভেতর একা হয়ে যাচ্ছেন। এত লোকের মধ্যে থেকেও একা। এত স্তাবকের ভীড়ে  তিনি মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে উঠছেন ক্রমশ।আর এই অবসাদ কাটানোর জন্য নারীর কোমল স্পর্শে নিজেকে সপে দিয়েছেন। তাঁর শারীরিক সুখ চাই। নিজের উদ্যমকে আরো আরো বাড়িয়ে নিয়ে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে হবে। এই তীব্র আকুলতা নিরসনে বেছে নিয়েছেন টলিউডের প্রতিষ্ঠা পেতে চাওয়া নায়িকাদের। চিত্রনির্মাতারা তাদের ব্যবসার স্বার্থে বদনবাবুর গোপন ইচ্ছের আয়োজন করে সরকারী নানান সহযোগিতা পেয়েছেন। আর টলি পাড়ার মেয়েরা গলে গিয়ে বদনবাবুর কামাগ্নি নিভিয়েছে। বদন বাবুর কৃপা হলে তারা একের পর এক সিরিয়ালে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছে, এমন কি সিনেমার নায়িকাও হয়েছে কেউ কেউ।

নাথিং সাকসিড লাইক সাকসেস। পর্দার আড়ালের অন্ধকার কেউ দেখে না। প্রচারের স্পট আলোর ঝলকানির স্বাদ অনেক। একটুখানি কমপ্রোমাইজে কী আসে যায়! শরীরের এটুকু ক্লেদ মেখে যদি দিনের শেষে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছনো যায় ক্ষতি কী!

              ইদানিং এই নরম শরীরগুলো নিংড়ে তিনি যেন আর আনন্দ পান না ।তবুও অভ্যাস বশে ওদের পাশবালিশ করেন বিছানায়। ঘুম আসে না। পেগের মাত্র বাড়ে। বাড়ে আচ্ছন্নতা। এইমাত্র মেগা সিরিয়াল "অনন্ত আকাশ"এর নায়িকা এরিনা ইয়াশমিনের শরীরে গলানো লাভাস্রোত ঢেলে দিয়েছেন।আজ যেন একটু অন্য আমেজ পেলেন তিনি।অস্ফুট আনন্দ শীৎকারে বলে উঠলেন, ও মাই ডারলিং ইয়াসমিন।

------ইয়েস স্যার।

-----নো স্যার, স্যার বলবে না ডারলিং।

-----কী বলব তবে? ইয়াসমিন বুকের কামনা ক্ষতে ওড়না ঢেকে বিছানায় উঠে বসল।

-----নো নো নো ডিয়ার, এনিথিং এলস ইয়ু ক্যান। তুমি তো অভিনেত্রী, ইজ ইন্ট ইট!

-----আমি তো সংলাপ বলি না।জীবন খুঁজতে এসে জীবন হারিয়ে ফেলেছি।

-----অও নটি, হাউ ফানি ইয়ু আর।তুমি এমন অসহায়ের মত কেন ফিল করছ ডিয়ার। ভগবানের কাছে এলে কেউ অসহায় ফিল করে? তুমি আমার কাছে এসেছ সোনা।

ইয়াসমিনকে ফের বুকে জড়িয়ে ধরে ওর বর্ণহীন ফ্যাকাশে ঠোঁটে যন্ত্রণাদায়ক চুম্বন রাখলেন। শীতল প্রশান্তি অনুভব করছেন তিনি।মনে হচ্ছে আজ ঘুম হবে।ঘুমিয়েও পড়লেন।

রাত কত তিনি জানেন না এখন। হঠাৎ করে তার ঘুমের চটকা ভেঙ্গে গেল। অন্ধকার ঘর। কে যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে।

----কে? ইয়াসমিন!

হাত দিয়ে তিনি সুতোশূন্য পেলব শরীরের স্পর্শ পেলেন। এই তো ইয়াসমিন। তবে কে ইনি?

খুট করে আওয়াজ হল। হালকা নীল আলোয় ঘর ভেসে গেল। আলখাল্লা পরিহিত একটি মানুষ টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কী যেন লিখছেন।

বদনবাবু সভয়ে অস্ফুটে বললেন, কে আপনি?

ছায়ামূর্তি ঘুরে দাঁড়ালো, বলল,আমি আবুবেন আদম।

ঈশ্বর আমায় পাঠিয়েছেন। পৃথিবীর সমস্ত চরিত্রহীন মদ্যপ দুর্নীতিপরায়ণ মানুষদের একটি তালিকা প্রস্তুত করছি। আপনিই যোগ্যতম। সহযোগিতা করুন!

 

Saturday 27 June 2020

অসিকার রহমানের কবিতা




আগুন খেলা খেলবে নাকো
অসিকার রহমান

করোনা-ভয় —যেন এক সর্বধর্ম সমন্বয়, 

শত্রুমিত্র দাঁড়ায় ত্রাসে, ক্রমে দীর্ঘ সারি—

শহর গ্রামে জমাট বাঁধে ভীষণ মৃত্যুভয় 

দেখতে হবে রাস্তা যেন ঢুকে না যায় বাড়ি। 

এ যুদ্ধ মহামারী-করোনা-কূলের সাথে
সেরা দামী অস্ত্র বোমা লাগছে কি আজ কাজে? 
কোটি কোটি অর্থ ব্যর্থ মারণাস্ত্র খাতে —
বুদ্ধিমানের শরীর মনে মৃত্যু-বাজনা বাজে।
অতিমারীর সঙ্গে জীবন মহা নিয়ম মেনে 
ক্ষয়ে ক্ষয়ে লড়ছে সে বধ্যভূমির ময়দানে।
মারী বলে, "চলে যাবো, বলি কানে কানে —

 তুচ্ছ নগন্য তুমি এবার বুঝলে খুব ভালো, 
  বিভেদ ভুলে এখন তবে মিলেমিশে থাকো
                         সবাই সবার হৃদয়পদ্মে মুক্তির আলো জ্বালো,                          
সাবধান, ধর্ম নিয়ে আগুন খেলা খেলবে নাকো ।

চলে যাবো রেখে যাবো দুরন্ত দুঃসময়
 ফের যদি দেখি মানুষে মানুষে রক্তক্ষয়
ফিরবো আবার প্রলয়ংকরী অদৃশ্য ভাইরাস—
জানবে আমি কোভিদ উনিশ অতিমারী সন্ত্রাস ¡

মধুবনী চ্যাটার্জী , কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা, ২০২০




নীলকণ্ঠ

মধুবনী চ্যাটার্জী

আকাশের গায়ে বড়ো বড়ো ফাটল ধরেছে । 
খরায় যেমন মাটি ফেটে   শুকিয়ে আসা শিরা উপশিরার মতো 
এঁকেবেঁকে বয়ে চলে 
রুক্ষতা নিয়ে , 
 ঠিক তেমন ফাটল আকাশের গায়ে ।  
মাঝেমাঝে মনে হয় পলেস্তারা খসে পড়বে বুঝি ! 
হঠাৎ একদিন দেখা যাবে সমস্ত সভ্যতার গায়ে গুঁড়ো গুঁড়ো শুকনো আকাশ ! 
তাকে দুই হাতে বড়ো অযত্নে 
ঝেড়ে ফেলে আমরা চলে যাচ্ছি নিত্যদিনের কাজে ! 
মেঘেরা আজকাল জমাট বাঁধেনা , ঘর বাঁধে না , 
ঘনিয়ে ওঠে না আর । 
তারা এখন 
আধুনিক জীবনে আধুনা সম্পর্কের মতো  হালকা , অগভীর , ভেসে যাওয়া । 
আকাশের দিকে চোখ 
রাখতে ইচ্ছে হয় না । 
বড়ো মিথ্যে ওই নীল  , মিথ্যে ওই শরৎ চুঁইয়ে আসা আলো ! 
এই গভীর শ্রাবণে এমন আলোর  অশনিসংকেত , 
এমন আগুনে নিঃশ্বাস 
 ঘোষণা করছে আকাশের গায়ে ফাটল ধরেছে ! 
পাহাড়ের দেশে মেঘেরা নেমেছে সারে সারে
  বৃষ্টিদের সঙ্গে নিয়ে  ।  সেখানে একটা বিরাট জলাশয় তৈরী করেছে বৃষ্টি দিয়ে  !  তার উঁচু উঁচু প্রাকার , সেও মেঘেদেরই  । সেখানেই আষাঢ় শ্রাবণ অবিরাম ডুবসাঁতারের 
সুখ বিলাসে মগ্ন । 
আর এদিকে জ্বলন্ত ফুটিফাটা আকাশ নিঃস্ব দুহাত তুলে অভিশাপ দিচ্ছে প্রেমহীন বিশ্বচরাচর কে! 
কোনদিন তার গায়ের ওই ফাটল বেড়ে বেড়ে অন্তরীক্ষকে উন্মুক্ত করে দেবে , আর সেখান দিয়ে শত শত নক্ষত্র , জ্যোতিকণা , গ্রহ উপগ্রহ অবিশ্রান্ত ঝরে পড়ে ভাঙা কাঁচের মতো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেঁথে যাবে পৃথিবীর দেহে !  ফালা ফালা হয়ে যাবে বসুন্ধরার  দেহ , যন্ত্রণায় চিৎকার করবে সে , যেমন করে চলেছে 
প্রতি নিয়ত ! 
বধির সভ্যতা নির্লিপ্ত মুখে 
তারার খণ্ডগুলি ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলে যাবে নিত্যদিনের কাজে ! 
তারা একে অন্যকে বুঝিয়ে নেবে কাল থেকে নক্ষত্র বিহীন ফাটল ধরা আকাশের নিচের এই মৃতপ্রায় পৃথিবীই তাদের ঘর ! 
সমস্ত অভিশাপকে বিষের মতো ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে বাঁচতে শিখেছি আমরা 
লোহিত আকাশের নিচে সদর্পে দাঁড়িয়ে  সভ্যতার জয়ধ্বনির উন্মত্ত প্রলাপে ।

মৌমিতা পালের কবিতা 'আদর'








আদর

মৌমিতা পাল

দাঁতাল মাতাল আর কাঙাল শুয়োর ছত্রভঙ্গ হয়ে
একে অপরের চোখের ভেতর তুমুল নাদান

সুষম বণ্টনের আগে চিনে নাও প্রাথমিক সরলতা
পদ্মাবতী তোমার চোখে প্রেমিক চিনতে চায়নি
বলা ভালো , দেবতা সভায় বেহুলা
নেচেছিল ধ্যাবড়া কাজল চোখে
ফাতনা কাঁপলেও , রুই- কাতলার খবর নেবার
সাধ্য তেমন কই!

পদ্মাবতী প্রেমিক চিনেছিল যাকে ,
তাকে দেখতে দেখতে চোখ মটকাও গোছের
    কোন সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখেনি সে
না তাকিয়েই বলেছিল-
' হাতখানা রাখো কপালের ওপরে'।

প্লাবন ধুয়ে দিক খোপার ফুল,
আদর তারই।

মৃণালকান্তি দাশের কবিতা 'চর'




চর 

মৃণালকান্তি দাশ 

হাতেই ছিল শুশ্রূষা তার, হাতেই ছিল বিষ,
রাত্রি ছিল নদীর মতো, সহজ, সুন্দর-
গাছের ছায়া আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল চর  ?

অঙ্ক ছিল অন্যরকম, সাদা পাতায় লেখা,
মিলবে কিনা যোগবিয়োগের একাকী উত্তর  !
কঠিন, পরুষ হিংসা শুধু নিয়তিনির্ভর ।

ওপার মৃত, নারীবিহীন, এপারে পৌরুষ,
কপালে কার হাত রেখেছ  ? কার শরীরে জ্বর ?
অন্তরা আর সঞ্চারীকে মিলিয়ে দিও স্বর ।


অরুণাভ রাহা রায়ের কবিতা 'ডানা'

 




ডানা 
অরুণাভ রাহারায়

তোমার সুরের ডানা আশ্চর্য মায়াবী 
গান থেকে নিয়ে যায় শহরের ছাদে 
সেখানে চাঁদের রাত অতি বেশি নীল

দু'চোখে জোনাকি ওড়ে, অনুবাদ হয়। 
চাঁদের শরীরে শুধু গান ভাসে, ভেসে চলে সুর... 

যেভাবে ছাদের তারে মেলে দাও কবিতা প্রচুর

সঞ্জয় কর্মকারের কবিতা 'প্লাবন'







প্লাবন
              সঞ্জয় কর্মকার
                               
    তোমার চোখে  ভস্ম হতে পারি
     অশ্রু জলে বাঁচিয়ে রাখি প্রাণ
     তোমার ছোঁয়ায় গৃহস্থালির সুখ
     সন্ধ্যাকালে হাস্নুহানার ঘ্রাণ।

     তোমার ঘরে মুক্ত চড়ুই  যত
     জ্যোৎস্না নামায় অলীক  ভালবাসা
     তোমার কাছে পণ রেখে দিই মৃত্যু
     পূরণ করি সর্বনাশের  আশা।

     তোমার বুকে অষ্টাদশীর প্রেম
     রাতজাগা সব পতঙ্গদের ভিড়
     একলা ঘরে নিঃস্ব যাপন রোজ
     কূল ভাসানোর  নেই  তো  কোন তীর।

পুস্তক আলোচনাঃ সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়


পুস্তক আলোচনা


সবর্ণা  চট্টোপাধ্যায়



নামঃ নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী 

প্রকাশকঃ ধানসিড়ি

মূল্যঃ ৪৫০ টাকা 






নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা একটি ফিলোজফিক্যাল থ্রিলার। তবে শুধু তাইই নয়। বৌদ্ধ জীবনচর্চার এক যাত্রাপথও বটে। উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবনপথকে কেন্দ্র করে। তবে উপন্যাসের মোচড় এখানেই যে, এখানে সময়কাল দশম একাদশ, ত্রয়োদশ ও একবিংশ শতাব্দীকে কেন্দ্র করে ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে। সেই সাথে বদলেছে ভাষার প্রয়োগ। তৎসম শব্দের প্রয়োগ ত্রয়োদশ শতকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করেছেন লেখক সন্মাত্রানন্দ শোভন। যদিও দীপঙ্কর বা চাগ লোচাবা কেউই হয়ত এভাবে কথা বলতেন না। তবু সময়কালকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে বাস্তবতা দান করার জন্যই লেখকের এই প্রয়াস। 

প্রথমেই আসি নামকরণে। নাস্তিক কেন? সাধারণ ভাবে দার্শনিকরা মনে করেন বৈদিক প্রমাণকে যারা স্বীকার করেন না তারাই নাস্তিক কিন্তু এখানে নাস্তিক অর্থে ব্যাপ্তিকে অস্বীকার। পারমার্থিক দিক থেকে বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘ সবকিছুকেই অস্বীকার করেন অতীশ। অথচ মানবতার গুণে অতীশের চেয়ে বড়ো আস্তিক বোধহয় কেও নেই। তবুও ইতিহাস তাকে এমনই ভূষণে অলংকৃত করেছে। লেখক হয়ত এই দুইভাবে অর্থাৎ খানিক বিদ্রুপাত্মক অর্থেও নাস্তিক শব্দের প্রয়োগের দ্বারা নামকরণ করেছেন উপন্যাসটির।


গল্প কেন্দ্রীভূত হয়েছে একটি পুঁথিকে ঘিরে। বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামে অনঙ্গ দাস নামে এক গরীব কৃষক মাটি খুঁড়তে গিয়ে চন্দনকাঠের এক বাক্স হাতে পায়। তাতে ছিল এক প্রাচীন পুঁথি, একটি মালা ও একটি বৌদ্ধ তারামূর্তি। এই পুঁথিকে ঘিরেই শুরু হয় আবিষ্কারের সন্ধান। 

সময় যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অমিতায়ুধ থেকে চাগ্ লোচাবা কিংবা চাগ লোচাবা থেকে চন্দ্রগর্ভ। এই চন্দ্রগর্ভ হল দীপঙ্করের পূর্বনাম। গল্পে শাসন করে তিন নারী স্বত্ত্বা। এরা যেন একই কায়া, একই ছায়া। তবু ভিন্ন সময়ে এদের অবতরণ। জাহ্নবী থেকে কুন্তলা, আবার কুন্তলা থেকে স্বয়ংবিদা এরা পরস্পর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা একই নারীর তিনরূপ। যার অদৃশ্য পরিচালনায় বয়ে চলেছে যেন অতীশের জীবন। সময়ের তিনপর্বেই প্রয়াণাসক্ত তরুণীরা কোথাও অপেক্ষায় অবহেলায় ধৈর্যে সংযমে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তারা পরিণতি চেয়েছে প্রিয় মানুষের কাছে। তারই রেশ থেকে যেন বারবার জন্ম। অবশেষে জাহ্নবী, মর্যাদা পেয়েছে স্ত্রীর। গল্পের নায়ক একবিংশ শতকের অমিতায়ুধ বিবাহ করে তাকে। এও কি কোথাও পূর্বের অসম্পূর্ণ মিলন নয়? উত্তর থাক পাঠকের কাছে। পাঠক বুঁদ হয়ে  থাকে গল্পের বিস্তারে।

কখনো বজ্রযোগিনীতে অতীশের ভিটা,কখনো কলকাতা, কখনো তিব্বত, কখনো নেপাল ঘুরে ফের বাংলাদেশে ফিরে আসা। কলকাতায় এসে সমাপ্ত হয় এই যাত্রা। উপন্যাসের ভিতরে, উপন্যাস লিখেন শাওন বসু নামের এক চরিত্র। সেই শাওন বসুই আসলে লেখক সন্মাত্রানন্দ নিজে। চরিত্ররা ক্রমশ ঘিরে ধরেছে যেন তাকেই।


আমরা দেখি দীপঙ্করের বাল্যকাল, শিক্ষা, তার বাল্যবন্ধবী কুন্তলা, তার আত্মহত্যা, আবার নানা ভাবে নানা যুগে তাদের ফিরে আসা। এর মাঝেই চন্দ্রগর্ভের দীপঙ্কর হয়ে ওঠা, বিহার পরিচালনা, নেপাল যাত্রা। ত্রয়োদশ শতকে চাগ লোচাবার অবতরণ। অতীশকে নেপাল হয়ে তীব্বতে নিয়ে চলে সে। সময়ের আস্তরণে জড়ানো এই চরিত্রের সাথে সাক্ষাত হয় স্বয়ংবিদার। যিনি দীক্ষা দেন তাকে। সবশেষে

দেখা দেয় অমিতায়ূধ। বর্তমান শতাব্দী। অমিতায়ূধ এক আর্কিওলোজিক্যাল রিসার্চার। যে বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামে আসে হাজার বছরের সেই পুরোনো পুঁথি নিয়ে গবেষণার জন্যে। সেখানেই তার পরিচয় জাহ্নবীর সাথে, যে এ শতাব্দীতে অনঙ্গ দাসের কন্যা। 


উপন্যাসটি অবশ্যই একটি গবেষণা কেন্দ্রিক উপন্যাস। লেখকের ভাষায়, প্রত্যাখ্যানের কবিত্বের মুগ্ধতায় পাঠকও যেন ক্রমশ এগিয়ে চলে সেই যাত্রাপথ্‌ যেখানে হয়ত লেখকের কলমে কোথাও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে অতীশের জীবন।  


পরিভাষামুক্ত দর্শনের প্রকাশ লেখক ঘটিয়েছেন তাঁর সুদক্ষ লিখন ভঙ্গিতে। সেই সাথে একাকার হয়ে গেছে জীবনের আকস্মিকতা অর্থাৎ থ্রিলার এলিমেন্ট। অন্তর্জীবনে বৌদ্ধতারামূর্তির প্রণয়ে নিজেকে নিবেদন অথচ বর্হিজগতে সেই আস্তিকতাকেই অস্বীকার- এ দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে গল্পের সর্বত্র। অতীশের জীবনে কুন্তলার অবস্থান কি এরই বহিঃপ্রকাশ নয়? 


স্তরে স্তরে আচ্ছাদিত একটি টিলা যেন ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ কালের বহমানতায়। মিশে যাচ্ছে এক সময়কাল অপরের সাথে। মিশে যাচ্ছে অহং, অস্তিত্ব। এক চরিত্র রূপ নিচ্ছে আর এক চরিত্রের সাথে। এ যেন দুটি নদীর মিলনপথ। সমস্ত আবহটিকে লেখক সাজিয়েছেন বাংলার প্রকৃতির অসাধারণ বর্ণনায়। এ কালের ভাষা মিশে গেছে পলিমাটির মতো নদীর গর্ভজলে। নিঃসন্দেহে উপন্যাসটি একটি সার্থক সাধনার ফল। পাঠক হৃদয় ছুঁয়ে যার বিস্তার আদি অনন্তকাল।



সন্মাত্রানন্দ

লুইস গ্লাকের কবিতাঃ সুজিত মান্না

লুইস গ্লাকের কবিতা


ভাষান্তরঃ সুজিত মান্না



প্রতিধ্বনি

১.

এই প্রাণটাকে কল্পনা করতে পারলেই আমি আমার মৃত্যুকে অনুমান করতে পারি
যখন মৃত্যুকে কল্পনা করেছিলাম
আমার প্রাণের মৃত্যু হয়ে গেছে। সে কথা 
আমি স্পষ্ট ভাবে মনে করতে পারি।

আমার দেহ জেদ ধরে বসে থাকে।
এগোয় না, শুধু জেদ ধরেই বসে থাকে
কেন আমি জানবো না।

২.

আমার বয়স যখন খুব অল্প, মনে আছে বাবা-মা পাহাড় ঘেরা একটি ছোট উপত্যকায় স্থানান্তরিত হয়ে গেল
হ্রদের দেশ নাম ছিল জায়গাটির।
রান্নাঘরের জানালা থেকে অনায়াসেই পাহাড়গুলিকে দেখতে পাওয়া যেত মেঘে ঢাকা হয়ে আছে
এমনকী গ্রীষ্মের দিনেও।
এখনো মনে করতে পারি শান্তি যে এরকমও হতে পারে
আগে অনুভব করিনি কোনদিন।

পরে শিল্পী হওয়ার জন্য এগুলি নিজের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, এইসব অনুভবকে শুধুমাত্র ভাষা দেওয়ার জন্য।

৩.

বাকিটা ইতিমধ্যেই তোমায় আমি জানিয়েছি…
কয়েক বছরের অনর্গল যাপন এবং তারপর লম্বা নীরবতা, ঠিক কোন এক উপত্যকায় প্রকৃতির দ্বারা পরিবর্তিত তোমার স্বর সামনের পাহাড়টি প্রতিধ্বনি করে ফিরিয়ে দেওয়ার আগের মুহূর্তের নীরবতার মত।

এইসব নীরব মুহূর্ত এখন আমার সঙ্গী হয়ে গেছে।
জিজ্ঞেস করিঃ আমার সত্তার মৃত্যু ঘটলো কীসে
এবং এইসব নীরবতা উত্তর দেয়
যদি তোমার সত্তার মৃত্যু ঘটেই থাকে, তাহলে কার জীবন নিয়ে বেঁচে আছো এবং  কখনই বা তুমি সেই মানুষটি হয়ে গেছ?



পরিচিতি : লুইস এলিজাবেথ গ্লাক ( জন্ম এপ্রিল 22, 1943 ) – গ্লাক ছিলেন পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত একজন আমেরিকান কবি ও প্রাবন্ধিক। পেশায় অধ্যাপিকা। তার কবিতার একটি অংশ আত্মজৈবনিক। তার কবিতায় বারবার উঠে ইতিহাস পৌরাণিক উপকথা প্রকৃতি এবং মানুষের আধুনিক জীবন। নিচের তিনটি কবিতা তার Averno থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।