Saturday 27 June 2020

অসিকার রহমানের কবিতা




আগুন খেলা খেলবে নাকো
অসিকার রহমান

করোনা-ভয় —যেন এক সর্বধর্ম সমন্বয়, 

শত্রুমিত্র দাঁড়ায় ত্রাসে, ক্রমে দীর্ঘ সারি—

শহর গ্রামে জমাট বাঁধে ভীষণ মৃত্যুভয় 

দেখতে হবে রাস্তা যেন ঢুকে না যায় বাড়ি। 

এ যুদ্ধ মহামারী-করোনা-কূলের সাথে
সেরা দামী অস্ত্র বোমা লাগছে কি আজ কাজে? 
কোটি কোটি অর্থ ব্যর্থ মারণাস্ত্র খাতে —
বুদ্ধিমানের শরীর মনে মৃত্যু-বাজনা বাজে।
অতিমারীর সঙ্গে জীবন মহা নিয়ম মেনে 
ক্ষয়ে ক্ষয়ে লড়ছে সে বধ্যভূমির ময়দানে।
মারী বলে, "চলে যাবো, বলি কানে কানে —

 তুচ্ছ নগন্য তুমি এবার বুঝলে খুব ভালো, 
  বিভেদ ভুলে এখন তবে মিলেমিশে থাকো
                         সবাই সবার হৃদয়পদ্মে মুক্তির আলো জ্বালো,                          
সাবধান, ধর্ম নিয়ে আগুন খেলা খেলবে নাকো ।

চলে যাবো রেখে যাবো দুরন্ত দুঃসময়
 ফের যদি দেখি মানুষে মানুষে রক্তক্ষয়
ফিরবো আবার প্রলয়ংকরী অদৃশ্য ভাইরাস—
জানবে আমি কোভিদ উনিশ অতিমারী সন্ত্রাস ¡

মধুবনী চ্যাটার্জী , কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা, ২০২০




নীলকণ্ঠ

মধুবনী চ্যাটার্জী

আকাশের গায়ে বড়ো বড়ো ফাটল ধরেছে । 
খরায় যেমন মাটি ফেটে   শুকিয়ে আসা শিরা উপশিরার মতো 
এঁকেবেঁকে বয়ে চলে 
রুক্ষতা নিয়ে , 
 ঠিক তেমন ফাটল আকাশের গায়ে ।  
মাঝেমাঝে মনে হয় পলেস্তারা খসে পড়বে বুঝি ! 
হঠাৎ একদিন দেখা যাবে সমস্ত সভ্যতার গায়ে গুঁড়ো গুঁড়ো শুকনো আকাশ ! 
তাকে দুই হাতে বড়ো অযত্নে 
ঝেড়ে ফেলে আমরা চলে যাচ্ছি নিত্যদিনের কাজে ! 
মেঘেরা আজকাল জমাট বাঁধেনা , ঘর বাঁধে না , 
ঘনিয়ে ওঠে না আর । 
তারা এখন 
আধুনিক জীবনে আধুনা সম্পর্কের মতো  হালকা , অগভীর , ভেসে যাওয়া । 
আকাশের দিকে চোখ 
রাখতে ইচ্ছে হয় না । 
বড়ো মিথ্যে ওই নীল  , মিথ্যে ওই শরৎ চুঁইয়ে আসা আলো ! 
এই গভীর শ্রাবণে এমন আলোর  অশনিসংকেত , 
এমন আগুনে নিঃশ্বাস 
 ঘোষণা করছে আকাশের গায়ে ফাটল ধরেছে ! 
পাহাড়ের দেশে মেঘেরা নেমেছে সারে সারে
  বৃষ্টিদের সঙ্গে নিয়ে  ।  সেখানে একটা বিরাট জলাশয় তৈরী করেছে বৃষ্টি দিয়ে  !  তার উঁচু উঁচু প্রাকার , সেও মেঘেদেরই  । সেখানেই আষাঢ় শ্রাবণ অবিরাম ডুবসাঁতারের 
সুখ বিলাসে মগ্ন । 
আর এদিকে জ্বলন্ত ফুটিফাটা আকাশ নিঃস্ব দুহাত তুলে অভিশাপ দিচ্ছে প্রেমহীন বিশ্বচরাচর কে! 
কোনদিন তার গায়ের ওই ফাটল বেড়ে বেড়ে অন্তরীক্ষকে উন্মুক্ত করে দেবে , আর সেখান দিয়ে শত শত নক্ষত্র , জ্যোতিকণা , গ্রহ উপগ্রহ অবিশ্রান্ত ঝরে পড়ে ভাঙা কাঁচের মতো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেঁথে যাবে পৃথিবীর দেহে !  ফালা ফালা হয়ে যাবে বসুন্ধরার  দেহ , যন্ত্রণায় চিৎকার করবে সে , যেমন করে চলেছে 
প্রতি নিয়ত ! 
বধির সভ্যতা নির্লিপ্ত মুখে 
তারার খণ্ডগুলি ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলে যাবে নিত্যদিনের কাজে ! 
তারা একে অন্যকে বুঝিয়ে নেবে কাল থেকে নক্ষত্র বিহীন ফাটল ধরা আকাশের নিচের এই মৃতপ্রায় পৃথিবীই তাদের ঘর ! 
সমস্ত অভিশাপকে বিষের মতো ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে বাঁচতে শিখেছি আমরা 
লোহিত আকাশের নিচে সদর্পে দাঁড়িয়ে  সভ্যতার জয়ধ্বনির উন্মত্ত প্রলাপে ।

মৌমিতা পালের কবিতা 'আদর'








আদর

মৌমিতা পাল

দাঁতাল মাতাল আর কাঙাল শুয়োর ছত্রভঙ্গ হয়ে
একে অপরের চোখের ভেতর তুমুল নাদান

সুষম বণ্টনের আগে চিনে নাও প্রাথমিক সরলতা
পদ্মাবতী তোমার চোখে প্রেমিক চিনতে চায়নি
বলা ভালো , দেবতা সভায় বেহুলা
নেচেছিল ধ্যাবড়া কাজল চোখে
ফাতনা কাঁপলেও , রুই- কাতলার খবর নেবার
সাধ্য তেমন কই!

পদ্মাবতী প্রেমিক চিনেছিল যাকে ,
তাকে দেখতে দেখতে চোখ মটকাও গোছের
    কোন সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখেনি সে
না তাকিয়েই বলেছিল-
' হাতখানা রাখো কপালের ওপরে'।

প্লাবন ধুয়ে দিক খোপার ফুল,
আদর তারই।

মৃণালকান্তি দাশের কবিতা 'চর'




চর 

মৃণালকান্তি দাশ 

হাতেই ছিল শুশ্রূষা তার, হাতেই ছিল বিষ,
রাত্রি ছিল নদীর মতো, সহজ, সুন্দর-
গাছের ছায়া আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল চর  ?

অঙ্ক ছিল অন্যরকম, সাদা পাতায় লেখা,
মিলবে কিনা যোগবিয়োগের একাকী উত্তর  !
কঠিন, পরুষ হিংসা শুধু নিয়তিনির্ভর ।

ওপার মৃত, নারীবিহীন, এপারে পৌরুষ,
কপালে কার হাত রেখেছ  ? কার শরীরে জ্বর ?
অন্তরা আর সঞ্চারীকে মিলিয়ে দিও স্বর ।


অরুণাভ রাহা রায়ের কবিতা 'ডানা'

 




ডানা 
অরুণাভ রাহারায়

তোমার সুরের ডানা আশ্চর্য মায়াবী 
গান থেকে নিয়ে যায় শহরের ছাদে 
সেখানে চাঁদের রাত অতি বেশি নীল

দু'চোখে জোনাকি ওড়ে, অনুবাদ হয়। 
চাঁদের শরীরে শুধু গান ভাসে, ভেসে চলে সুর... 

যেভাবে ছাদের তারে মেলে দাও কবিতা প্রচুর

সঞ্জয় কর্মকারের কবিতা 'প্লাবন'







প্লাবন
              সঞ্জয় কর্মকার
                               
    তোমার চোখে  ভস্ম হতে পারি
     অশ্রু জলে বাঁচিয়ে রাখি প্রাণ
     তোমার ছোঁয়ায় গৃহস্থালির সুখ
     সন্ধ্যাকালে হাস্নুহানার ঘ্রাণ।

     তোমার ঘরে মুক্ত চড়ুই  যত
     জ্যোৎস্না নামায় অলীক  ভালবাসা
     তোমার কাছে পণ রেখে দিই মৃত্যু
     পূরণ করি সর্বনাশের  আশা।

     তোমার বুকে অষ্টাদশীর প্রেম
     রাতজাগা সব পতঙ্গদের ভিড়
     একলা ঘরে নিঃস্ব যাপন রোজ
     কূল ভাসানোর  নেই  তো  কোন তীর।

পুস্তক আলোচনাঃ সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়


পুস্তক আলোচনা


সবর্ণা  চট্টোপাধ্যায়



নামঃ নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী 

প্রকাশকঃ ধানসিড়ি

মূল্যঃ ৪৫০ টাকা 






নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা একটি ফিলোজফিক্যাল থ্রিলার। তবে শুধু তাইই নয়। বৌদ্ধ জীবনচর্চার এক যাত্রাপথও বটে। উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবনপথকে কেন্দ্র করে। তবে উপন্যাসের মোচড় এখানেই যে, এখানে সময়কাল দশম একাদশ, ত্রয়োদশ ও একবিংশ শতাব্দীকে কেন্দ্র করে ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে। সেই সাথে বদলেছে ভাষার প্রয়োগ। তৎসম শব্দের প্রয়োগ ত্রয়োদশ শতকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করেছেন লেখক সন্মাত্রানন্দ শোভন। যদিও দীপঙ্কর বা চাগ লোচাবা কেউই হয়ত এভাবে কথা বলতেন না। তবু সময়কালকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে বাস্তবতা দান করার জন্যই লেখকের এই প্রয়াস। 

প্রথমেই আসি নামকরণে। নাস্তিক কেন? সাধারণ ভাবে দার্শনিকরা মনে করেন বৈদিক প্রমাণকে যারা স্বীকার করেন না তারাই নাস্তিক কিন্তু এখানে নাস্তিক অর্থে ব্যাপ্তিকে অস্বীকার। পারমার্থিক দিক থেকে বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘ সবকিছুকেই অস্বীকার করেন অতীশ। অথচ মানবতার গুণে অতীশের চেয়ে বড়ো আস্তিক বোধহয় কেও নেই। তবুও ইতিহাস তাকে এমনই ভূষণে অলংকৃত করেছে। লেখক হয়ত এই দুইভাবে অর্থাৎ খানিক বিদ্রুপাত্মক অর্থেও নাস্তিক শব্দের প্রয়োগের দ্বারা নামকরণ করেছেন উপন্যাসটির।


গল্প কেন্দ্রীভূত হয়েছে একটি পুঁথিকে ঘিরে। বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামে অনঙ্গ দাস নামে এক গরীব কৃষক মাটি খুঁড়তে গিয়ে চন্দনকাঠের এক বাক্স হাতে পায়। তাতে ছিল এক প্রাচীন পুঁথি, একটি মালা ও একটি বৌদ্ধ তারামূর্তি। এই পুঁথিকে ঘিরেই শুরু হয় আবিষ্কারের সন্ধান। 

সময় যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। অমিতায়ুধ থেকে চাগ্ লোচাবা কিংবা চাগ লোচাবা থেকে চন্দ্রগর্ভ। এই চন্দ্রগর্ভ হল দীপঙ্করের পূর্বনাম। গল্পে শাসন করে তিন নারী স্বত্ত্বা। এরা যেন একই কায়া, একই ছায়া। তবু ভিন্ন সময়ে এদের অবতরণ। জাহ্নবী থেকে কুন্তলা, আবার কুন্তলা থেকে স্বয়ংবিদা এরা পরস্পর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা একই নারীর তিনরূপ। যার অদৃশ্য পরিচালনায় বয়ে চলেছে যেন অতীশের জীবন। সময়ের তিনপর্বেই প্রয়াণাসক্ত তরুণীরা কোথাও অপেক্ষায় অবহেলায় ধৈর্যে সংযমে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তারা পরিণতি চেয়েছে প্রিয় মানুষের কাছে। তারই রেশ থেকে যেন বারবার জন্ম। অবশেষে জাহ্নবী, মর্যাদা পেয়েছে স্ত্রীর। গল্পের নায়ক একবিংশ শতকের অমিতায়ুধ বিবাহ করে তাকে। এও কি কোথাও পূর্বের অসম্পূর্ণ মিলন নয়? উত্তর থাক পাঠকের কাছে। পাঠক বুঁদ হয়ে  থাকে গল্পের বিস্তারে।

কখনো বজ্রযোগিনীতে অতীশের ভিটা,কখনো কলকাতা, কখনো তিব্বত, কখনো নেপাল ঘুরে ফের বাংলাদেশে ফিরে আসা। কলকাতায় এসে সমাপ্ত হয় এই যাত্রা। উপন্যাসের ভিতরে, উপন্যাস লিখেন শাওন বসু নামের এক চরিত্র। সেই শাওন বসুই আসলে লেখক সন্মাত্রানন্দ নিজে। চরিত্ররা ক্রমশ ঘিরে ধরেছে যেন তাকেই।


আমরা দেখি দীপঙ্করের বাল্যকাল, শিক্ষা, তার বাল্যবন্ধবী কুন্তলা, তার আত্মহত্যা, আবার নানা ভাবে নানা যুগে তাদের ফিরে আসা। এর মাঝেই চন্দ্রগর্ভের দীপঙ্কর হয়ে ওঠা, বিহার পরিচালনা, নেপাল যাত্রা। ত্রয়োদশ শতকে চাগ লোচাবার অবতরণ। অতীশকে নেপাল হয়ে তীব্বতে নিয়ে চলে সে। সময়ের আস্তরণে জড়ানো এই চরিত্রের সাথে সাক্ষাত হয় স্বয়ংবিদার। যিনি দীক্ষা দেন তাকে। সবশেষে

দেখা দেয় অমিতায়ূধ। বর্তমান শতাব্দী। অমিতায়ূধ এক আর্কিওলোজিক্যাল রিসার্চার। যে বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামে আসে হাজার বছরের সেই পুরোনো পুঁথি নিয়ে গবেষণার জন্যে। সেখানেই তার পরিচয় জাহ্নবীর সাথে, যে এ শতাব্দীতে অনঙ্গ দাসের কন্যা। 


উপন্যাসটি অবশ্যই একটি গবেষণা কেন্দ্রিক উপন্যাস। লেখকের ভাষায়, প্রত্যাখ্যানের কবিত্বের মুগ্ধতায় পাঠকও যেন ক্রমশ এগিয়ে চলে সেই যাত্রাপথ্‌ যেখানে হয়ত লেখকের কলমে কোথাও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে অতীশের জীবন।  


পরিভাষামুক্ত দর্শনের প্রকাশ লেখক ঘটিয়েছেন তাঁর সুদক্ষ লিখন ভঙ্গিতে। সেই সাথে একাকার হয়ে গেছে জীবনের আকস্মিকতা অর্থাৎ থ্রিলার এলিমেন্ট। অন্তর্জীবনে বৌদ্ধতারামূর্তির প্রণয়ে নিজেকে নিবেদন অথচ বর্হিজগতে সেই আস্তিকতাকেই অস্বীকার- এ দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে গল্পের সর্বত্র। অতীশের জীবনে কুন্তলার অবস্থান কি এরই বহিঃপ্রকাশ নয়? 


স্তরে স্তরে আচ্ছাদিত একটি টিলা যেন ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ কালের বহমানতায়। মিশে যাচ্ছে এক সময়কাল অপরের সাথে। মিশে যাচ্ছে অহং, অস্তিত্ব। এক চরিত্র রূপ নিচ্ছে আর এক চরিত্রের সাথে। এ যেন দুটি নদীর মিলনপথ। সমস্ত আবহটিকে লেখক সাজিয়েছেন বাংলার প্রকৃতির অসাধারণ বর্ণনায়। এ কালের ভাষা মিশে গেছে পলিমাটির মতো নদীর গর্ভজলে। নিঃসন্দেহে উপন্যাসটি একটি সার্থক সাধনার ফল। পাঠক হৃদয় ছুঁয়ে যার বিস্তার আদি অনন্তকাল।



সন্মাত্রানন্দ

লুইস গ্লাকের কবিতাঃ সুজিত মান্না

লুইস গ্লাকের কবিতা


ভাষান্তরঃ সুজিত মান্না



প্রতিধ্বনি

১.

এই প্রাণটাকে কল্পনা করতে পারলেই আমি আমার মৃত্যুকে অনুমান করতে পারি
যখন মৃত্যুকে কল্পনা করেছিলাম
আমার প্রাণের মৃত্যু হয়ে গেছে। সে কথা 
আমি স্পষ্ট ভাবে মনে করতে পারি।

আমার দেহ জেদ ধরে বসে থাকে।
এগোয় না, শুধু জেদ ধরেই বসে থাকে
কেন আমি জানবো না।

২.

আমার বয়স যখন খুব অল্প, মনে আছে বাবা-মা পাহাড় ঘেরা একটি ছোট উপত্যকায় স্থানান্তরিত হয়ে গেল
হ্রদের দেশ নাম ছিল জায়গাটির।
রান্নাঘরের জানালা থেকে অনায়াসেই পাহাড়গুলিকে দেখতে পাওয়া যেত মেঘে ঢাকা হয়ে আছে
এমনকী গ্রীষ্মের দিনেও।
এখনো মনে করতে পারি শান্তি যে এরকমও হতে পারে
আগে অনুভব করিনি কোনদিন।

পরে শিল্পী হওয়ার জন্য এগুলি নিজের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, এইসব অনুভবকে শুধুমাত্র ভাষা দেওয়ার জন্য।

৩.

বাকিটা ইতিমধ্যেই তোমায় আমি জানিয়েছি…
কয়েক বছরের অনর্গল যাপন এবং তারপর লম্বা নীরবতা, ঠিক কোন এক উপত্যকায় প্রকৃতির দ্বারা পরিবর্তিত তোমার স্বর সামনের পাহাড়টি প্রতিধ্বনি করে ফিরিয়ে দেওয়ার আগের মুহূর্তের নীরবতার মত।

এইসব নীরব মুহূর্ত এখন আমার সঙ্গী হয়ে গেছে।
জিজ্ঞেস করিঃ আমার সত্তার মৃত্যু ঘটলো কীসে
এবং এইসব নীরবতা উত্তর দেয়
যদি তোমার সত্তার মৃত্যু ঘটেই থাকে, তাহলে কার জীবন নিয়ে বেঁচে আছো এবং  কখনই বা তুমি সেই মানুষটি হয়ে গেছ?



পরিচিতি : লুইস এলিজাবেথ গ্লাক ( জন্ম এপ্রিল 22, 1943 ) – গ্লাক ছিলেন পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত একজন আমেরিকান কবি ও প্রাবন্ধিক। পেশায় অধ্যাপিকা। তার কবিতার একটি অংশ আত্মজৈবনিক। তার কবিতায় বারবার উঠে ইতিহাস পৌরাণিক উপকথা প্রকৃতি এবং মানুষের আধুনিক জীবন। নিচের তিনটি কবিতা তার Averno থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।


Wednesday 13 May 2020

সাহিত্য এখন ২৫শে বৈশাখ সংখ্যা, ২০২০ ; Sahitya Ekhan 25 she Boishakh issue, 2020

হে নূতন



সাহিত্য এখন পঁচিশে বৈশাখ সংখ্যা, ১৪২৭


প্রিয় বন্ধু, এই অতিমারীর সময়ে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্বের পাশাপাশি  আমাদের আত্মিক নৈকট্যের বড়ো প্রয়োজন। নিজেকে প্রকাশ করতে না পারলে কীভাবে উঠে আসবে আমাদের ক্ষোভ, দুঃখের কথা, আমাদের সমবেদনার কথা! মানুষ বড় কষ্টে আছে। আমরা যেভাবে সম্ভব, তার পাশে দাঁড়াব। সাহিত্য মনকে সমৃদ্ধ করে, উদার করে। একথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই।
প্রিয় লেখক ও পাঠক বন্ধু, সাহিত্য এখন ২৫শে বৈশাখ সংখ্যায় একটি নবতম সংযোজন করা হল। প্রতি সংখ্যায়  এই সময়ের কবিতার অডিও বা ভিডিও সংযোজিত হবে। সেই সঙ্গে থাকবে চিরকালীন বাংলা কবিতাকে অডিও বা ভিডিওর মাধ্যমে নতুন করে খুঁজে নেওয়া।এই প্রয়াসে আমাদের সঙ্গে থাকছে 'বাংলা কবিতা' চ্যানেল এবং থাকছেন আমাদের আবৃত্তিকার বন্ধুরা । কবিপক্ষে আমাদের পরম প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে আমরা এই নতুন যাত্রা শুরু করলাম।




চিরকালীন বাংলা কবিতা

কবিতাঃ লুকোচুরি
কবিঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পাঠেঃ শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

ভিডিও উপস্থাপনঃ বাংলা কবিতা



 

এই সংখ্যার কবি

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


মধ্যরাতের সংলাপ 
   
( একুশ )

ছাদে উঠে যেখান থেকে তুমি রোজ সবুজ দেখো সেখান থেকেই একদিন তুমি আমাকে দেখেছিলে, এই দেখায় ক্যামেরাও কথা বলতে পারে, যদিও সেটা এমন কিছু ব্যাপার নয়, ছবি না তুললেও ছবি দেখা যায়, ছবির ভাষা আলাদা হলেও কেউ কেউ তা অনায়াসেই পড়ে ফেলতে পারে, যাক সেসব কথা, অত দূরের কথা এত তাড়াতাড়ি এত কাছে টেনে না আনলেও চলবে, এককথায় ছাদ থেকে তাহলে অনেক কিছুই চোখে পড়ে, অথচ অদ্ভুত নাটকে কিন্তু দেখা না দেখা নিয়ে পাতার পর পাতা উল্টে যেতে হয়, যাদের ছাদ নেই যারা ছাদের সিঁড়ি ভুলে গেছে তারা সবাই সবুজ মানুষ দুটোকেই খুব কাছ থেকে দেখেছে, গুটিকয় ছাদের মানুষ দিনের পর দিন এই একই নাটক লিখে যাচ্ছে আর মাটির মানুষ সব জেনেও দল বেঁধে রাত জেগে নাটকে তালেতালে হাততালি দিয়ে যাচ্ছে



( বাইশ )

মায়ের মুখে ছাদের গল্প শুনতাম, বাবা মাটির মানুষ হলেও তার মুখেও মাঝে মাঝে ছাদের গল্প উঠে আসত, আসলে আগের ছাদগুলো বেশ বড় ছিল, একসঙ্গে অনেক মানুষ বসতে পারত, এখন তো তিনজনের ছাদ, আর ছাদগুলো এত উঁচু উঁচু যে মাথায় সূর্য উঠে যায়, ভালো করে দেখাও যায় না নিচে কিছু আছে কিনা, তাছাড়া ছাদে উঠলেই আজকাল সবাই তেনজিং নোরগে হয়ে যায়, তাই ছাদে গল্প নেই, ছাদের গল্পও নেই

( তেইশ )

লিখতে গিয়েও থেমে গেলাম, কেন লিখব, মনে রাখার জন্যে তো, এত জোর কেন, ওই তো বড়রাস্তা পার হয়েই প্রকাণ্ড বটগাছটা, একটা পাতাও কোথাও লেখা নেই, আমরাই দুপুরের রোদ বাড়লে তার কাছে গিয়ে ছায়ার কথা সেলাই করি, মাঝে মাঝেই পাড়ার নদীটা চোখের সামনে কত ভাগে ভাগ হয়ে যায়, এই নদীর শ্রেণীবিভাগ তো কোনো সিলেবাসে পড়ি নি, কেউ হাত ধরে চেনায়ও নি, তবুও যে দুপুরে খুব দুঃখ পেলাম কেন জানি না পা নদীর দিকেই এগিয়ে গেল এবং এক নিঃশ্বাসে সব কথা বলেও ফেললাম তাকে


( চব্বিশ )

গরমের দুপুরে বাইরে থেকে এসে দাদু আটহাতি কাপড়ের ওপর থেকে ফতুয়াটা খুলে মাটির দাওয়ায় বসে পা ছড়িয়ে দিত, ডানহাতের পাখার বাতাস দাদুর দেহ থেকে উধাও করে দিত ঘাম, ঠাকুমা জল বাতাসা হাতে সকালের গল্প শোনাতো, গল্পের রঙে নদী এসে দাঁড়াত গোটা উঠোন জুড়ে, সেই জলে বাড়ির ভুলো মেনিরা সব ডুব দিত, দাদু ঘটি ডুবিয়ে জল নিয়ে পুজোর ঘরে ঢুকে যেত, জলের কাজ শেষ হলে নদী একপাশ দিয়ে হেঁটে খিড়কি পুকুরে নেমে যেত, তারপর ঠাকুমা রাতের বাসন হাতে নামতো জলের ভেতর, সারাদিনের অভাবের আগুনে জল ঢেলে দিত নদী, ভোরবেলা ঠাকুমা ভাত ডাল চচ্চড়ি নিয়ে উঠে আসতো উনুনে আগুন দেবে বলে


( পঁচিশ )

আমাকেও কেউ একজন দেখিয়েছিল, কে দেখিয়েছিল আজ আর ঠিক মনে নেই, আসলে মনে রাখতে হয় সেটাই তো জানতাম না, ভেবেছিলাম জিনিসটা নিয়েই আমার দিন কেটে যাবে, কিন্তু তা হয় নাকি, সব কোণের দেখাই তো একদিন শেষ হবে, তখন সে তো আর বিশেষ কেউ থাকবে না, আর ঠিক তখনই তাকাতে হয় মাথায়, কারণ মাথা ভালো রাখার এর থেকে ভালো উপায় আর কারও জানা নেই





অণুগল্প



১লা বৈশাখ



 পারমিতা মালী 

  
     সকাল থেকে দম ফেলার সময় নেই আজ। লম্বা মানুষের ঢল। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে আজ সত্যিই তিলধারণের জায়গা নেই। সবার হাতে পূজার সাজি।লাইন এগোচ্ছে শামুক গতিতে।  ফুল,প্যাড়া, হালখাতা ,নতুন কাপড় আর ধুতির খসখসে শব্দ চারদিকে,  ঘর্মক্লান্ত নরনারী।পূজারীরাও আজ বড্ড বেশী চাপে। 

              যন্ত্রের মতো কাজ হচ্ছে। ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি করে কোনোরকমে লোক এগোচ্ছে। মিনিট খানেকের জন্য সামনে পিছন থেকে চাপাচাপি খেয়ে একটু দাঁড়ানো। তারই মাঝে পূজারীর হাতে পুজোর ঝুড়ি তুলে দেওয়া। যন্ত্রবৎ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুজোও হয়ে যায়। তারই মধ্যে একবার ঢিপিস করে সামনের দরজায় মাথা ঠোকা, ব্যস। পূজো শেষ। স্বর্নালঙ্কার আর লাল বেনারসি ভূষিতা দেবীমূর্তি স্থির,  অকম্পিতা।

           পুরোহিত দুজন সকাল থেকে ঘর্মক্লান্ত দেহে কাজ করে যাচ্ছে। ভক্তি ভাবে গদগদ দর্শনাভিলাষীদের দিকে তাকাবারও সময় নেই। কে দিচ্ছে ,কি দিচ্ছে দেখারও ফুরসৎ নেই। একের পর এক পূজো চলছে। হঠাৎই কেমন করে যেন চোখে পড়ে যায় একটা মুখ। নিতান্তই কিশোরী একটি মেয়ে ।শ্যামলাপানা মেয়ে,মায়াভরা দুটো চোখ, বছর বারো তেরো হবে। কোলে একটা বছর পাঁচেকের  শিশু। ধাক্কাধাক্কি তে পাছে ভাইটির ব্যাথা লাগে,তাই কষ্টেসৃষ্টে  হলেও কোলে রেখেছে।একটা পুচকি ঝুরিতে সামান্য কিছু পূজা উপাচার। সাথে একটা অক্সফোর্ড এর মোটা খাতা। খাতাটি দেখেই ভুঁরু কোঁচকান বামুন ঠাকুর্। 
    ' এটা আবার কি খাতা রে এটা?এ আবার কেমন হালখাতা? '
    'না গো ঠাকুরমশাই, অঙ্ক খাতা। আমার আর ভাইয়ের।'
  'কিইইইই! '
  ' আসলে আমরা দুজনেই অঙ্কে খুব কাঁচা তো, তাই পূজো দিচ্ছি। 

                  এত চাপের মধ্যেও হেসেই ফেললেন পূজারী। স্নেহভরে পূজোর থালাটা নিয়ে মায়ের পায়ে স্তুপীকৃত ফুল মালার মধ্যে ছোঁড়ে। হঠাৎই  চোখ আটকে যায় মায়ের মৃন্ময়ী মুর্তিতে। আবার পেছনে ফিরে মেয়েটিকে দেখেন। একই রকম চোখ না? এমনকি মুখের হাসিটা পর্যন্ত এক। তৃতীয় নয়নের জায়গায় ঠিক যেন একটা কাটা দাগ আছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে পুজারীর। কোত্থেকে ঢুকলো এই মেয়ে? মুঠোভরা একটা কোঁচকানো দশ টাকা আর এক টাকার কয়েন। প্রণামী। তাই হাসিমুখে দিয়ে পূর্ণ দুই চোখ মেলে তাকায় সে মেয়ে। অভ্যেসবশে পূজারীর হাত ছোঁয় তার মাথা। কে যে কাকে আশীর্বাদ করে ! সারাদিন কাজের ভিড়ে ওই এগারো টাকা প্রাপ্তিটুকু মাথায় ছোঁয়ান পূজারী। এগিয়ে যায় মেয়েটা। আর সুযোগ নেই দাঁড়াবার। বারবার মুখ বাড়িয়েও আর দেখতে পায় না মেয়েটাকে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় সেই চিন্ময়ী। পুজারী এবার ক্লান্তিতে মুখ ঘোরায় মৃন্ময়ীর দিকে। নাহ্, সে আছে ঠিকই। তার তো আর যাওয়ার উপায় নাই! অলংকার আর বেনারসিতে সজ্জিতা সেই নারী দাঁড়িয়ে আছেন উদাসীনভাবে। পুজারী বিড়বিড় করে বললো,
" নেহাৎ তোমার উপায় নেই মা, নেহাত পা দুটো মাটিতে গাঁথা, নইলে দাঁড়াবার তোমারই বা কী দরকার মা?"


বুটাস

দেবব্রত রায়



                         সন্ধ্যার থেকেই গরম খিচুড়ির একটা  মৌতাত করা গন্ধ যেন কোথার থেকে ভেসে আসছিল। কৈলাসের পাহাড়ের চূড়োর মতো খাড়া নাকের ফোঁদলে গন্ধটা এসে ঢুকতেই , ওর নোলার জল  সকসক করে উঠলো। গন্ধ শুঁকেই যেন কৈলাস বুঝতে পারলো এ-গন্ধ সাধারণ চালডালের খিচুড়ির গন্ধ নয়।  মনেমনেই ও আন্দাজ করে নিল খিচুড়ির ভিতরে নিশ্চয়ই অনেক কিছু মিশেল দেওয়া হয়েছে! গন্ধটা যতই গাঢ় হচ্ছিল কৈলাসের উসখুসুনি ভাবটাও যেন ততই বাড়ছিল। আজ সাত-আটদিন তারা শুধু কলমি সেদ্ধ আর, দু-গরাস ভাত খেয়েই কাটাচ্ছে ! সেই কবে নীলু বাবু আর, কমল ঠাকুরের দল দু-কেজি করে চার কেজি চাল, আড়াইশো ডাল, দু-টো বাটি সাবান, দু-প্যাকেট মুড়ি ঘরে ঘরে দিয়ে গেছিল। কৈলাসের ন-জনের ফ্যামিলিতে সে-সব কবেই নস্যির মতো নাকের তলা দিয়ে উড়ে গেছে। রেশনটা আপাতত মাগনাই হলেও সেটাও মাসে একবার বৈ-তো নয়!কিন্তু, কৈলাসের ফ্যামিলিতে তাতেও কুলোই না! আজকাল লেন্ডিগেন্ডি- গুলোরই যেন একেবারে রাক্ষস-খোক্কসের  খোরাকি লেগে যাচ্ছে  !       
    সন্ধ্যেটা একটু গাঢ় হতেই , কৈলাস বুঝতে পারল নোলায় জল আনা গন্ধটা শুধু ওর একার নাকেই নয়, বস্তির সবার নাকেই এসে সেঁদিয়েছে। বস্তির খুপরি ঘরগুলোর থেকে একে একে নিশিনাথ, ওর পরিবার, সুকুমার লদো হেবো জগাই ফড়িং যে-যার পরিবার আর, ছানাপোনাগুলো নিয়ে একেবারে এক পাল শুয়োরের মতো বাইরে বেরিয়ে এলো। 
নিশিনাথের ছোট ছেলে গৌরাঙ্গ আজকাল কখনো নীলু বাবু, কখনো কমল ঠাকুরদের সঙ্গে মিশে একটু নেতা গোছের হয়ে উঠেছে। সে-ই আগ বাড়িয়ে বললো, নীলুবাবু, কমলবাবুরা আখন ক-দিন ইস্কুল-মাঠে খিচুড়ি খাওয়ানোর এক্কেবারে এ-কেলাস বেবস্তা করেচেন।     
আরেকবার নোলার জল সুড়ুৎ করে টেনে কৈলাস ওর পরিবারকে নিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে পা বাড়াল। পিছনে ভিন্ডুলটা। বড়ো রাস্তায় পা দিতেই কৈলাসের দুটো পা-ই যেন পিচে আটকে গেল। ওর একেবারে সামনাসামনি লালকমল দা দাঁড়িয়ে আছে। কৈলাস থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যেতেই  পিছনের ভিন্ডুলটা ওদেরকে পাশ কাটিয়ে স্কুল মাঠের দিকে এগিয়ে গেল। কৈলাস আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো নিশিনাথও ভুতগ্রস্ত মানুষের  মতোই  মাথা নিচু করে ডান পা-টা টেনে টেনে দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে  মিলিয়ে গেল। এই নিশিনাথ-ই এক সময় লালকমল দা-দের  খুব কাছের লোক ছিল। এখন একদমই বসে গেছে। লালকমল  কৈলাসের দিকে তাকিয়ে বললো, আজ তাহলে, তোমরাও বস্তিটা অন্ধকার রেখে মোমবাতি জ্বালালে!
তারপর, ফস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ব্রুটাস, সব কটাই বেইমান! 
কৈলাস কোনোদিনই লালকমলদাদের উপর উচ্চবাচ্য করে কথা বলেনি কিন্তু, আজ হটাৎ-ই সে উষ্ণ গলায় বলে উঠলো, দেখ লালকমল দা, বস্তির একটা মুথাঘাসের জটও আমার অচেনা লয়। উখানে বুটাস বলে কেউ থাকেনাই ! আর, বেইমান আমরা লই  !  আজ ছ-সাত মাস আমাদের বস্তিতে লাইন নাই। আখুন প্রায় দিন-ই আমরা অন্ধকারে থাকি। গেলদিনে উয়ারা মোমবাতি দিয়ে আইচিল, ছানাপোনাগুলান সেগুলানই  ফুর্তি করে জ্বেলেচিল!
বউটা পিছন থেকে গুঁতো মাড়তেই খিচুড়ির গন্ধটা যেন কৈলাসের নাকে এসে আবার গোঁত্তা মারল। কৈলাস একটু উসখুস করে বললো, লালকমল দাদা, আমরা তালে আখুন আসচি বটে ! 
লালকমল নিরবে হাসে। কৈলাস ইস্কুল-মাঠে পৌঁছে দেখে পাতা পড়ে গেছে কিন্তু, তখনও খিচুড়ি দেয়নাই। দেরি হচ্ছে দেখে নীলুর ডানহাত  ছেনোকে ডেকে সে বললো, ছেনো দা, সবাই তো বসে গেছে, এবার পাতে পাতে দিয়ে দাও কেনে ! 
ছেনো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, গুরুদের মিটিং চলছে। মিটিং শেষ না হলে পাতে লাপ্সি পড়বেক নাই !
মিটিন! কীসের মিটিন? কৈলাস জিজ্ঞেস করে।  
গুরু বলেছে, লালকমলদের পার্টির কাছ থেকে কোনো সাহায্য লেওয়া চলবেক নাই এমনকি, উয়াদেরকে পাড়ায় -বস্তিতে ঢুকতে দেওয়াও চলবেক নাই ! যারা রাজি হবেক তাদের পাতেই খিচুড়ি পড়বেক নইলে, ফুটুসফুট ! 
কৈলাস দেখলো মিটিংয়ের ভিতর থেকে হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে এসে নিশিনাথের ছোট ব্যাটা গৌরাঙ্গ চিৎকার করে বললো, ছেনো দা,পাতে পাতে  খিচুড়ি দিয়ে দাও, মিটিন ছাকছেস! 

      কৈলাস ভিড়ের মধ্যেই শালপাতাটা দলামচা করে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর, খাবার লাইন থেকে বেরিয়ে এসে হাতের পাতাটা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘেন্না ঘেন্না মুখ করে মাটিতে এক দলা থুথু ফেলে বলে উঠলো, শালা, বুটাস ! 
কথাটা বলে পিছন ফিরতেই কৈলাস দেখলো ওর বউ নিঃশব্দে কখন যেন এসে ওর পিছনে দাঁড়িয়েছে ।    

আপনজন

কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর


               শেষ বিকেলের আলো পাড়াটাকে মাখিয়ে অসিত বাবুর স্ত্রীর নিথর দেহটা মাঝ উঠানে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। ষাটোর্ধ অসিত বাবু চশমাটা খুলে কাঁচদুটো মুছে, ধীর পায়ে বাড়ির সামনের রাস্তার নামলেন। না-- লাঠি কোনদিন নেননি, পড়ার নেশায় চশমাটা নাকের উপর চেপে বসেছে । লোকের অভিমুখ তার বাড়ির দিকে, অথচ উনি চলেছেন বিপরীতে। এ-ছবিটা অনেক পুরানো। কারণ আগেও এ-বাড়ি মৃত্যু দেখেছে--- তার দাদু, ঠাকুমা, বাবা, মা ছবিটা কিন্তু একই থেকেছে, কোন পরিবর্তন তারা দেখেনি। 

                ব্রিজের মাথায় চায়ের দোকানে তখন জটলার চায়ের কাপের গায়ে আলোচ্য বিষয় লেখা-- অসিত বাবুর স্ত্রী। না নিন্দে কেউ করেনি। বরং দীর্ঘ রোগভোগ, আর তা থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টার প্রশংসায় হচ্ছে। অসিতবাবু এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। জানেন ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার থাকে। সবাইই কাছে এসে সমবেদনা জানালেন। আপাদমস্তক একজন রাশভারি মানুষ, ব্যাস অতটুকুই, ওর বাইরে কারও জিজ্ঞাসা থাকলেও-- সেটা মনে মনে।
--স্যার দাদা-বউদি চাকরির জায়গা থেকে এসেছে? আর দিদির তো এখন দিল্লিতে পোস্টিং...
--হ্যাঁ ছেলে-বউমা এসেছে। মেয়েও ঢুকে যাবে। এয়ারপোর্টে গাড়ি গেছে...
--আচ্ছা স্যার আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো?
--হ্যাঁ, বল। পাড়ার এই ছেলেটি তমাল বাবুর বেশ প্রিয়। নিজের ছেলের থেকে কম, বেশি পরিমাপের প্রয়োজন নেই।
-- স্যার শুনেছি, কোন মৃত্যুই, আপনাকে কাঁদাতে, কেউ দেখেনি...! এখনো কোন চাকরি জোটেনি। মাঝে মাঝে বাবার দোকানটা সামলায়। উনারই স্কুলের ছাত্র অপু কথাটা বলেই ফেললো। তমালবাবু চা-টা শেষ করে মাটির ভাঁড়টা সামনে রাখা প্লাস্টিকের ঢপে ফেলতে গেলেন, কিনারায় লেগে রাস্তায়, উল্টো দিক থেকে আসা দশচাকা লরিতে পিষে দিয়ে বেরিয়ে গেল। অসিতবাবু চশমাটা খুললেন-- কাঁদতে ইচ্ছে করে... বিশ্বাস কর খুব, খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। আবার করে না।
 
--মানে... স্যার...
-- সেই কবে সুনীলবাবু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা গেলেন। হাউমাউ করে কাঁদলাম। সামনে কোন পূজাবার্ষিকীতে উনার কোন লেখা থাকবে না, ভেবে। আসলে আমার জীবনে এমন আপনজনের মৃত্যুই ঘটলো না, যে মৃত্যু আমায় কাঁদাতে পারে।
 

              সূর্য কেবলই অস্ত গেছে, একটা আলোর রেশ রয়ে গেছে। বাক্যহারা অপু দেখছে স্যারের ঘোলাটে চোখ দূরে... প্রায় মজে যাওয়া মাঝ নদীতে একটা মাল বোঝায় করা নৌকা, মাঝি আপ্রাণ চেষ্টায় লগি টানছে।
-- অপু নৌকাটা কোন পাড়ে ভিড়বে জানিস? নৌকোটা ভিড়বে তো? অপু...
-- আঁ...জানিনা... জানিনা স্যার। তবে নৌকা এতো ভার কিভাবে বহন করে!

দুটি কবিতা

তৈমুর খান

কলহ       

অনেক কলহ এসে রোজ ভিড় করে
 আমারই নিজস্ব কলহ সব 
গর্জন করে, ঘুমায় না রাগে
 রাত জেগে জেগে শূন্যে চেয়ে থাকে

 শূন্যে কে আছে?
ওই তো শূন্য!  নক্ষত্র জ্বলজ্বল করে
হয়তো হাওয়ার ট্রেন যায়
 অদৃশ্য আত্মাগুলি প্যাসেঞ্জার তার

 নিজেকে প্রবলভাবে খুন করতে চায়
 কিন্তু করে না;  ক্ষুব্ধ হয়ে ফেরে 
অথচ কোথাও ফেরার নেই তার
 নিজের ভেতরেই দেখে সব পথ অন্ধকার

শেষপর্যন্ত একটি হাত আর একটি হাতের কাছে শুশ্রূষা চায়
একটি পা আর একটি পায়ে পা ঘষে নেয়
দুটি ঠোট জিভ দিয়ে চাটে বারবার
ভেজা চোখ মুছে নেয় আত্মীয়ের মতো

কলহ বিরামহীন, মিলনেও দারুণ সংশয় ।

 বিদ্বেষ

বিদ্বেষের ব্যবসা খুব ভালো চলছে
অল্পদিনেই যা হতে চাও তাই হবে
এটা তো পুরনো ব্যবসা 
কেউ খন্ডন করতে পারবে না

তোমার নামাবলী ঠিকঠাক আছে 
অভিনয়ও ভালো হচ্ছে এখন
আহা! তোমার মুখে ইষ্টনামও মানায় ভালো!

যোগ্যতা আছে বলে সবাই মেনে নিচ্ছে
রক্ত গড়িয়ে পড়াকে বলছ: জল
হত্যাকে বলছ: একটু সোজা করা গেল!

 সবাই বিদ্বেষ নিয়ে যাচ্ছে দলে দলে
 বিদ্বেষের বৃক্ষ বড় হচ্ছে
 হাটে-বাজারে সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বিদ্বেষের ফুল ফল ।

দেবাশিস তেওয়ারী

বাঁচার তাগিদ

এবারের আকাঙ্ক্ষার জ্বরে ভাসতে ভাসতে ছুটে গেছি মহুলবনেও।পর্যায়ক্রমিক যত ভুলত্রুটি চক্রের আকারে মেখেছি নিজস্ব শীৎকারে।বনের গালিচা থেকে জন্ম নেওয়া অন্যায় আমাকে পোড়ায় আর পাপবিদ্ধ করে দেখিয়েছে বাঁচার তাগিদ কোথায় কোথায় বড় আলগা হয়ে বাঁচে।



 অক্ষরব্রহ্ম


তোমাদের জোছনায় আমার ব্যথিত আত্মা ত্বরা উঠে বসে নৌকার গলুইয়ে,তার মৃত তলদেশে ধাক্কা লাগে---জলের আঘাত যত দৃষ্টি নিক্ষেপিত করে,তত বর্ষা নামে না অধরে।


চন্দ্র থেকে নেমে আসা আত্মার প্রতীক জোছনায়, সুকেশ পথিক তুমি মেঘেবজ্রে বর্ণমালা আনো।সেই বর্ণমালা থেকে আরও আরও ক্লান্ত, জন্ম নেয় কবির অক্ষর।


আজ ছাতিমের তলা পরিচ্ছন্ন হয়ে আছে---তোমার উঠোনহীন বুক ছাতিম ফুলের গন্ধে ভরা।মরা আত্মারা আজ যত বেশি দৃষ্ট হয়, তত বর্ষা নামে কি অধরে?


শুধু বিস্ফারিত হয় ছায়ার যুগল রূপ--- লিপ্সাহীন শোণিতে, অঙ্গারে।


পৃথ্বী ব্যানার্জী 

অশেষের কবিতা

কবি তুমি "শেষের কবিতা" লিখে গেছ অথচ
তুমি তো জানতে শেষের কোন কবিতা হয় না।
সাদা কাগজের উপর বৃষ্টির ফোটার মত আজো
 যা কিছু ঝরে পড়ে সবই অশেষের কবিতা।
তবুও শেষ অশেষের দোলাচলে,বেলা অবেলার প্রান্তসীমায আমি আমারই না লেখা কবিতার মত
পথ,প্রান্তর, নদী নালা পেরিযে লুব্ধক কিংবা কালপুরুষ
অতিক্রম করে পৌঁছে যাই মায়াময় এক ভোরের আকাশে
যেখানে ভোরের রবির মতই ফুটে আছ তুমি আমার অশেষ! আমার জীবন কবিতা! আমার জীবন দেবতা তুমি!

 কৃষ্ণকলি ও একটি কবিতার জন্মঃ--

আকাশ জুড়ে কাজল কালো মেঘ ছিল না।
তোমার কৃষ্ণকলিকে দেখলাম চৈত্রের খরতাপে!

আকাশ গনগনে মারুত চুল্লীর মত জ্বলছিল।
বাতাসে ক্লেদ,ঘাম রিরংসা ও বঞ্চনার বিবমিষা।
তবু সেই হিংস্র দুপুরে কবির সাথে দুচোখ মিলতেই
তার অমনস্ক দু চোখে চমকে উঠল বঙ্কিম জলবিদ্যুত।
তন্মুহূর্তে বেহিসাবী কলকাতা কি হয়ে উঠল ময়নাপাড়ার মাঠ?বাইপাস থেকে  ধেয়ে এল সজল বাতাস! বেসামাল অলিতে গলিতে ফুটে উঠল রক্তিম মুশান্ডারা! আর কবির হৃদয়ের গভীরে গোপনে জন্ম নিল বড় ভালোবাসার  কবিতার কুঁড়িরা!


গৌতম কুমার গুপ্ত
সরব নীরব


চুপ থাকতে থাকতে
         আকাশ নীল -নীরব হল যেদিন
আমি ভঙ্গুর খোলামকুচি নিয়ে ভাবছিলাম
ইত্যবসরে তুমি দৃশ্যে এলে
শাড়ির খুঁটে বাঁধা ছিল তোমার চলতি অবহেলা
বিপন্ন হতে হতে কার্নিশে ঠেকেছে পা

সরব হওয়ার অবকাশে আমি সশস্ত্র হচ্ছিলাম
দু একটি বাক্যষ্ফুরণ সূঁচ সূতোর ভেদ্য রসায়ন
প্রতিবাদী হওয়ার পতাকা কোরাস সঙ্গীত ইত্যাদি
তোমার হাতে দিয়েছিলাম অগ্নি প্রজ্জ্বলনের পদ্ধতি
পায়ে পায়ে পদাতিক রণকৌশল 

কথা তো ফুটতেই হবে একদিন
    এবং প্রতিদিন
        সঙ্গে সঙ্গে নিক্ষেপ প্রক্রিয়া
জেনে নেবে দ্যুতি, অবোধ বাৎসল্য, পরিণত যৌবন
আবশ্যিক গার্হস্থ্য অপ্রচুর বাণপ্রস্থ
তুমিই রেখেছো বেঁধে আমাদের সরল সমাধান 

সরবের সমাপ্তি শেষে
তুমিও উপসংহার খুঁজে পাবে নিশ্চিত
 আমিও স্বনামধন্য হবো খেচরের গানে
তোমার আঁচলের নিবিড় ছায়ায়


জনক


এই রুক্ষ্ম আবহ নির্বাসন দিলে 
       ফিরে ফিরে আসি শিকারি শরীরে
সবুজে শ্বাস যদি পাই তৃণসুখ
ধূলার ধূসরে বিরল কখনো 

দেখো এ কলম
বিরুদ্ধে জেগেছে কালির অক্ষম
কাগজে জ্যোৎস্না এঁকেছে রাত
সুনীলে ভেজা এক আকাশ জুড়ে চাঁদ
          রয়েছে প্রবল সাম্রাজ্যে 

করতল অনভ্যাসে থাক পাখিরও পালক
বিনীত পোশাকে ঢাকি অক্ষম দীর্ঘশ্বাস

তুমি কে সেই বিদ্যুতের জনক
যেখানে আঁধার সেখানে আলোর চমক
তুমি শুধু উচ্চারণে থাকো ঈশ্বর
সানন্দ নিশীথে আমি অপলক অপলক


একটি কবিতা


বিষয়
পার্থপ্রতিম বিশ্বাস

স্পষ্ট করে ডাকেনি কোনওদিন তবু প্রিয় শব্দের
জন্য জেগে থাকে নবীন কিশোর। সমস্ত
অক্ষরমালা ভাঙি, ভেঙে ফেলি মায়া বৃত্তের চারিপাশে
বাঁধন সুতোর মায়াজাল। বিষাদ বোঝে না সব
প্রার্থিত আলোর কাছে পড়ে থাকে দিন, দিনের
লুণ্ঠিত অন্ধকার। প্রান্তিক জীবনের খণ্ড খণ্ড
ছবি হাতবদল হয় আকাঙ্খার চিত্রশালায়।
বহুদূর থেকে স্বপ্ন দেখি, লালিত রাত্রির বুকে
বাসনার ঘর। তখন তুমি রাতের অনুষঙ্গে চিনে নাও
পাখির আকাশ, অবহ্লা, তুমুল আনন্দের নির্জনতম দাগ।
তোমাকে নদীময় করতে পারিনি কোনওদিন
চোখের তারায় জ্যোৎস্না ।
আগুনের কাছে দীক্ষা নিয়ছিলাম, শিখা
জ্বলছিল নত হয়ে, রক্তকরবীর আলোয়
জেগে উঠছিল নবীন কিশোর, বিদায় বোঝেনি।

তোমাকে স্পর্শ করে
রবীন বসু

আনন্দ ভৈরব তুমি, আনন্দ সেই অবগাহন
তোমাতে স্নিগ্ধ হই, তোমাতেই অনন্ত গমন l

যাত্রাপথ অমসৃণ থরে থরে বিচ্ছেদ বিরহ
তুমি তাকে বুকে ধরো অসীমে আর অনাগ্রহ l

গোধূলির স্নিগ্ধ আলো গল্পদেশ নদীজলে মেশে
নৃত্যের তালে ভ্রমণ আপন দেশ হতে বিদেশে l

সৃষ্টির অমিত বাণী দীর্ঘ হয় দেবদারু ছায়া
চৈত্র-শালবনে দেখি রেখে গেলে সুবিপুল কায়া l

গান দিলে মান দিলে, অসহায় নারীকে সন্মান
ঋজু এক প্রেম নিয়ে অমিত-লাবণ্য হয়না ম্লান l

আনন্দ ভৈরব তুমি, আনন্দেই ছুঁয়েছিলে মাটি
তোমাকেই স্পর্শ করে আজ তাই বেঁচেবর্তে থাকি l




এইতো এমন  
বৈজয়ন্ত রাহা

হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলো আমায় একলা হতে শেখায়।
অস্তিত্বের কাছে জল যেমন নতজানু,
মাটির কাছে মেঘ,
অরণ্যের কাছে বাতাস,
তেমন শহরের বিষবায়ুর  কাছে আমি আনত হতে শিখি।

 শরীরের ভিতর থেকে স্তব্ধতা ঠিকরে বেরোয় ,
দৃষ্টি ঝরতে থাকে অবিরাম,  অবয়বহীন,
রাস্তার কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না,
তোমাদের  আত্মহত্যার কথাও না,
আকাশের ঠোঁটে মেঘকে  চুমু খেতে দেখে
মনে মনে হেসে নিই একচোট,

কারা যেনো বলতে চায়, চৈত্র শেষ,  বৈশাখ পড়ে যাবে,
রোদের গায়ে ভালো করে তেলমালিশ করো,
আমি তাদের চুপ করিয়ে দিই, ।

পশলা বৃষ্টির পরে, বেঞ্চির ফাঁকা কাঠ বেয়ে জল চোঁয়ায়,
চারপাশে অগণিত খিস্তি খেউড় উড়ে যেতে দেখি,
আমি বেঞ্চিতে বসিনা,

বসব একদিন,
শেষ কবিতা লিখব নিজের মৃতদেহের পাশে বসে,

এখন দু চারটে  আলো  বরং তোমায় পাঠাই,  তোমার ওদেশে বড়ো অন্ধকার।

তারপর নববর্ষের কাছে দু হাত পাতবো।

ডেকেছ যখন -যাবো
বিকাশ  দাশ

ঝরা বাঁশ পাতা
নিক্কণের ইশারায় ডেকেছ যখন - আমি যাবো।  
কিন্তু তার আগে -- 
ব্যালেন্সের দড়িতে হাঁটা মেয়েটি মাটিতে নামুক
বাবার ব্যবসায় অবাধ্য হয়ে স্কুলে যাক
চড়াই -শালিখে মিতালি করুক ; 
নজরবন্দি খেলায় যে মেয়েটি খুন হল এইমাত্র
সে বেঁচে উঠলে আমি যাবো।

মানুষ মানুষকে মানুষ জ্ঞান করলে  
কোন সন্তাপ না রেখে আমি যাবো।  
কোনদিকে  " না ' শব্দ ছড়াবো না
আমার তাল সুপারির বাগান ফেলে
আম - কাঁঠালের বাগান ফেলে
মায়ের আঁচল থেকে স্নেহভার আলগা করে
আমি ঠিক যাবো ।
যাওয়ার আগে জেনে যাবো
যে দুঃখ দিতে এসে ফিরে গেছে
সে ক্ষমা করেছে কি না
আমার তক্ষক ঘর আমাকে ক্ষমা করেছে কি না
 তারপর আমি যাবো হাসতে হাসতে।


মন পুড়লে মনে পড়ে
অনুপম দাশশর্মা

কয়েকবারের চেষ্টায় সেলাইয়ের সুঁচে
সুতো পরালে মা খুব খুশি হতেন

মাসের প্রথম সপ্তাহে জং-ধরা জানলার
শিকের গাল ছুঁয়ে বাবা এনে দিতেন
ঝকঝকে 'শুকতারা'

এখন, বিষন্ন প্রদোষকালে ভিড় করে
অক্ষরের অংশগ্রহণ
যদিও পারস্পরিক অবিশ্বাস লেপটে থাকে
প্রতিটি সন্ধের পিছল উঠোন

এখন উদাসী হাওয়ার পালে ভাসিয়েছি 
আগ্রহের আলাপন 
আমার ঘ্রাণহীন বাসগৃহে সঙ্গদান করতে থাকে
বাবা-মায়ের আশীর্বাদের একদা ঋণ।


নতিস্বীকার

মন্দিরা ঘোষ

একটা
  নতিস্বীকারের বিকেলে জড়িয়ে যায়
ভাঙচুরের
  অনাবশ্যক।
ঝিমোনো দুপুরের গা বেয়ে পিছলে যায় রোদ।
আহত বিকেলের গালে ধুলোর তামাসা।
সব ভুল থেকেই বেড়ে ওঠে
  অতিক্রমের ক্রিয়াপদ।
একটি জড়তার সকাল সাজি হাতে দাঁড়ালে
ভাঙনের পরেও উপকথার চাঁদ ওঠে।
সব প্রতিফলিত আলো বিচ্ছুরিত হয়েও জ্বলে ওঠে
  না,
প্রতিসরণে ভূমিকা বদলে নেয়।
অন্ধকার কখনো
  নদীর মতোই নিঃসারী
হতে হতে ধুয়ে দেয় শোকের বিসর্গ।
যৌথখামারে
  উদারতার আসবাব ঝিকিয়ে ওঠে।
একটি
  বিষণ্ণ রাস্তার চর্যাপদ ভুলিয়ে দেয়
এই অনাবশ্যক
  নতিস্বীকারের উপকথা।



খেলার সিলেবাস
অরণ্যা সরকার

সুতনু মিথ্যের খাঁজে কুশল ভঙ্গিমা
হুল্লোড়ে উঁচু হয়ে ওঠে রঙ
টের পেলে আলোযান, না পেলে প্রতিভা
অপ্রকাশিত কবিতার ছায়া ছোটখাটো সুনামের পাশে বেঁচেবর্তে 
এইতো প্রাচীন পুঁথির জামা, এইতো নতুন দিনের বোতাম
কী হবে ব্যাধির বিজ্ঞানে? 
পাখিদের সর্দি-জ্বর, বাতাসের শ্বাসকষ্ট, জংলি ফুলের দাবিদাওয়া 
এমন তো কত কিছু সিলেবাস বিহীন
খোঁজের শরীরে নিখোঁজ
ধরা যাক সবই খেলার আগে খেলা খেলা প্রস্তুতি… 















একটি ব্যাগ রহস্য
অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী

বুক তো নয় যেন ব্যাগের দু’পাশ...
বুকের খাঁচাদু’টো যেন চেইন আর জিপার দিয়ে আঁটা।
ব্যাগ খুলে ফেললেই থকথক করে বেরিয়ে আসবে
বুকের কফ লালা ফুসফুসের রক্ত...
বেরিয়ে আসবে লোকটির কোনও পাপ ছিলো না।
বেরিয়ে আসবে মানব সভ্যতার ত্রিশ হাত জিহ্বা
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে একনায়ক তন্ত্রের হাঁচি কাশি।

মরার আগ-পর্যন্ত লোকটি জানতই না
তার বুকের খাঁচায় জিপার আঁটা আস্ত একটি ব্যাগ।
তা খুললেই নাকি বেরিয়ে আসবে উহানের অভিসন্ধি,
হাতড়ালেই নাকি পাওয়া যাবে
গোপনে আমেরিকা নাকি টাকা দিত ল্যাব চালানোয়।
অথচ লোকটির কোনও পাপ ছিলো না।

ব্যাগটি কোনও দিনও বিদেশে ট্রাভেল করতে যায়নি।
ব্যাগটির সে যোগ্যতাই ছিলো না ‘আমেরিকান টুইষ্টারে’র কাছে...
বিদেশ ঘুরলো বাবুরা
অথচ গরীব ব্যাগটির জিপার ভেঙে চেইন কেটে গেলো।
সেদিক থেকে লোকটির কোনো দোষই ছিলো না।

সেই বাসের গল্পের মত-
‘‘নিজ নিজ ব্যাগ নিজ নিজ দায়িত্বে রাখিবেন,
খোয়া গেলে বাস কতৃপক্ষ দায়ী নহে’’
রাষ্ট্র চোখ রাঙালো, বিদেশ থেকে গুটিকয় রোগগ্রস্থ
চোরকে বাসে এনে ছেড়ে দিয়েছি।
তোমার ব্যাগ বাপু সামলানোর দায়িত্ব তোমার।
লোকটি ব্যাগ সামলাতে পারেনি।

রাষ্ট্র বলল-
বিষধর সাঁপ ছেড়ে দিয়েছি তুমি বাঁচতে পারলে বাঁচ
লোকটি বাঁচতে পারলো না।
কারণ লোকটির খাদ্যের দরকার ছিলো
খাদ্য জোগাড় করতে তাই গিয়েছিলো জন-অরণ্যে...
সাপের কামড় খেয়ে লোকটির ব্যাগ বিষে ভরে উঠলো।
পারত পক্ষে লোকটির কোনও পাপই ছিল না।

ব্যাগের চেইন খুলতেই বুক থেকে
লক্ষ লক্ষ সাঁপ বেরিয়ে পড়ল
ছোবল দেওয়ার জন্য ফণা তুলল তারা।
ভয়ে কেউ লোকটির বুকের কাছে গিয়ে
জিপার টেনে দিতে পারল না।
কারণ ব্যাগটি এখন অচ্ছুৎ...
অথচ লোকটির কোনও পাপ ছিল না।

নীল বৃত্তে তুমি জেগে আছো
পৃথা চট্টোপাধ্যায় 

সহজে ঘুম আসে না 
অথবা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় 
চোখের সামনে এক নীলবৃত্ত ঘুরপাক খায় ,
দীর্ঘদেহী সুপুরুষ মাথা নিচু করে হেঁটে যায় 
কোথায় কোপাই!
চোখ কচলে বারবার দেখি-
সে ক্রমাগত গ্রহ থেকে  গ্রহান্তরের পথে 
ছোট আরও ছোট হয়ে  যায় ।

একটা নিউক্লিয়ার ফিউসন 
অস্তিত্বের লড়াই এ বহু দূর থেকে 
ভেসে আসে  ক্ষীণ স্বর
শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা একাকী বৈশাখ এনে দিল
আমরাও মহাশূন্যে ভয়ে ভয়ে আছি 
অবাক বিস্ময়ে দেখি নদী হাঁটে, 
হাত ধরাধরি করে চলে গাছপালা!

আতস কাচের নিচে বিপন্নতা
ভাইরাস কিলবিল করে
পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে গভীর অসুখে
মৃদঙ্গের সুরে তালে
মহামানবের ফের যাত্রা হলো শুরু 


 
সন্ন্যাস
অক্ষমালী

চৈত্র মাসে পাঁচ গ্রাম ঘুরে
ভরতে হতো হাতের সরা,
গরম ঝামায় পায়ে ফোস্কা পড়ে যেত,
কোনো কায়েত বাড়ির গাছ পাকা ডয়রা কলা
বা সোনালী হলুদ নোনা
পরমানন্দে চুষে বীজ
ফেলে দিতাম ফুৎকারে।
সন্ধ্যায় ডুব দিয়ে শীতল শরীরে গরম ভাতের গন্ধ__
আহহহ্ !
মনে হতো যেন শিবলিঙ্গ সতীপীঠ সমেত ফুটছে মালসায়
হাতের মুঠোয় শিবলোক।
খিদে পেটে গরম ভাতের গন্ধ আমাকে আজও
সুরতের অধিক তৃপ্তি দেয়,
আর তৎক্ষনাত আমি সন্ন্যাস নিয়ে ফেলি...


শান্তিনিকেতনে অদিতিদি 
বিভাসকান্তি মণ্ডল 

শান্তিনিকেতনে বর্ষা আসে
 ক্যানেলপাড় উজিয়ে 
জলের স্রোত দেখতে যাওয়ার
 সে বিষন্ন বিকেলে 
অদিতিদি থাকতো আমাদের সঙ্গে

ক্যানেলপাড়ে ঝরে পড়ত
আমাদের কান্না বিকেল
সোনাঝুরি ও কাঁকর ভূমি 
উপহার দিত অস্তরাগ সন্ধ্যা
দিগন্ত রেখায় ভেসে যেতো
কাজল রমণীর প্রদীপ আর
অদিতিদির উর্দিপরা প্রেমিক 

তবুও শালবীথি থেকে সোনাঝুরি জুড়ে 
রবি ঠাকুর হাঁটতেন আমাদের ঘিরে
ব্যথাগুলো ভরিয়ে দিতেন মাধুর্যে
আমরা শ্বাস নিতাম পরস্পরকে ছুঁয়ে


জন্মের শুভক্ষণে
তুহিন কুমার চন্দ 

পাড়ার মোড়ে একটা গলি তারপর 
গলির প্রান্ত ছুঁয়ে যেখানে অনেকবছর আগে বিশাল বটের নিচে ধুতি শাড়ি দিয়ে 
হ্যাজাক জ্বালিয়ে পুজো হতো ছোটবেলায়, 
নিমাই সন্ন্যাস পালা, পুতুল নাচের সাথে 
ছোটদের রবীন্দ্রজয়ন্তী।

ঠানদির কাছে শুনেছি ভাসানের গল্প,
চরকের মেলা থেকে রবিঠাকুরের মূর্তি কিনে সারাদিন ধরে নানা গান, কবিতা আর নাচের সাথে একটাই কবিতা সবার মুখে "বীরপুরুষ"।
পাড়ার সবচেয়ে মেধাবী ছোট্ট ছেলেটার কাঁপা গলায় "দেবতার গ্রাস" শুনতে শুনতে চোখের পাতা ভিজে রাতের জোনাকির আলোয় ঘরে ফিরে যেতো গ্রামের মানুষজন।
যতীন কাকা বলেছিলো ছেলেটা অনেক বড় হবে, অনেক দূর যাবে ছেলেটা।

কালবোশেখী ঝড়ে বৃষ্টির শেষ বিন্দু পড়েছিলো পলিথিন দেওয়া ঘরের ভেতরে। 
এখন আর সেভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়না বটের চাতালে।
বিশাল মাঠ জুড়ে নির্বাচনী সভা, 
নেতাদের বাক্যবানে আমার রবীন্দ্রনাথ 
এখন এক বস্তিতে থাকে সারাদিন।

যতীন কাকার সেই ছেলেটা যাকে একদিন মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন - অনেক বড় হবে, অনেক দূরে যাবে তুমি, এখন সত্যি সে অনেক বড়, প্রতিদিন রাধিকাপুর এক্সপ্রেস ধরে অনেক দূরে যায়।

মাথায় ঝাঁকড়া চুল, আঁকা ছেঁড়া পাঞ্জাবীতে ঢাকা বুকের পাঁজর, 
আর গোটা পাঁজর জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। 

গলায় বাদামের ডালা ঝুলিয়ে হেঁকে যায় মোমফলি,বাদাম ভাজা,টাইমপাস।
নেবেন গো বাবু গরম বা...দা....ম।
ধাচনা ষ্টেশনে গাড়ি থামে নেমে যায় বাদামওয়ালা।
একগাল দাড়ি নিয়ে উদাত্ত গলায় শুনতে পাই " গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে,
মৈত্র মহাশয় যাবে সাগরসঙ্গমে......''।

চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসে,
নেমে পড়ি ট্রেন থেকে সামনে আমার গ্রাম
মুসুন্দি পাড়ায়,
বৃষ্টি হয়ে গেছে কাল শেষরাতে।
বিশাল বটের ঝুড়ি নেমে গেছে বহুকাল, চারদিকের ঘন কাঁটা বনে একদল পাংশু কিশোর সেই আগের মতো ধুতি শাড়ির মণ্ডপে রাত জেগে ঝিমোয় এখন।

বাদামের ফেরিওয়ালা কাছে যেতেই একসাথে ছুটে আসে সব।
বাদামের নিচে রাখা একাকী রবীন্দ্রনাথ 
এযুগের মোক্ষদারা ছুটে আসে সাগরসঙ্গমে।
সারাটা আকাশ তখন গেয়ে ওঠে গান,
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে.....
এইতো রবীন্দ্রনাথ, সবার হৃদয়ে ঠায় বসে আছেন।

মুক্তি
 রিতা মিত্র

নাভি মূল ছুঁয়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস
কুয়াশার আড়ালে বেঁচে থাকে বিপন্ন অস্তিত্ব। 
রোদের পরিসর থেকে সরিয়ে রাখি নিজেকে
আলোর রশ্মি কোনো রেখাপাত করবে কি জীবনের উপর? 
স্তব্ধতার বেড়াজাল ডিঙোতে পারে না কোনো উত্তর। 
ছায়াপথের আড়াল নিয়ে ভাবনার সাথে খেলা চলে অবিরাম। 
আমি মুক্তি চাই পর্ণমোচীর মতো। 


আমাদের স্কুলবেলা
              সুমন কাঞ্জিলাল
              
আমরা দূরের ছাত্র ছিলাম ‌
খালিপায়ে আমারা মাঠ পেরোতাম 
গাছগুলি বৃক্ষসমেত চেয়ে থাকতো
মাষ্টারমশাই রোজ বুদ্ধ শেখালে
আমাদের চোখে জল আসতো
ডানায় ডানায় আমারা হাজার হাজার -
বছর এগিয়ে যেতাম
বইগুলো হালকা হয়ে যেতো
টিফিনের ঘন্টা বাজলে
আমারা গোল হয়ে থাকতাম
মাঝখানে মাষ্টারমশাই একটা বলের-
উপর দাঁড়িয়ে বলতেন," দ্যাখো বালকেরা,
আমাদের পায়ের নিচে এইরকম বিশাল-
একটা বল আর মাথায় উপর সীমাহীন -
একটা বেলুন, এ’দুটি ফুটো করলে-
সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডটাই চুপসে যাবে ।"



পুরোনো হ‍্যালুসিনেশন
সম্পা পাল


অনুভূতির একটু প্রকাশ জরুরি
অথচ বারো লাইনে থেমে যাচ্ছি
এই থেমে থাকার কি কোনো মানে আছে?

জানালায়
  মিউজিয়াম
ভেতরে অন্য পৃথিবী
আর আমার কাছে সেই পুরোনো হ্যালুসিনেশন

শুধু কবিতার জন্য
সুবিৎ
১) 

কবিতা !

লক্ষীর পা.... এখানে ফেলো না এ দ্বিপ্রহরে।

ধু ধু মাঠ.... কুঁজোর গড়ান ঘটি জল
পুড়ে গ্যাছে আয়ুষ্কাল!

হলুদ রোদ্দুরে।

২) 

যতবার কারো মিথ্যা স্তুতি করি,
একটু একটু করে বেঁটে হয়ে যাই আমি।

যেন অপুষ্ট পেয়ারা গাছ,
মূক চিত্রল অঙ্গে নিজেই নিজেকে ভেংচি কাটে।

একেবারে বামন হয়ে যাবার আগে,
ছুট্টে গিয়ে কলম ধরে বসি অকপট ,
যেন বালখিল্য বাস ড্রাইভার।

কলম হাতে মিথ্যা বলি না আমি।

যদিও ,
তোমায় ছুঁয়ে ... কতবার .... কতবার!


যতবার কবিতা লিখব ভাবি
সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় 


যতবার কবিতা লিখব ভাবি, ততবার
অট্টহাস্যে কেঁপে উঠে জল।
স্তব্ধ হয়ে যাই। 
বুঝতে পারিনা কিভাবে মুক্তি একবার... 
ফটাস করে ফেটে যাবে করোটির যোগসূত্র।

তবুও শব্দ নেই। 

ভাবো মৃত্যু আসেনি আজো।

অথচ রোজ বিষপানের পর সরিয়ে নিই নীল কলস। 
প্রমাণ রাখি না কোন। রবি ঠাকুর বাজে। 
রাতের শরীরে, ঝড়ের তীব্র উল্লাস। 
অথচ কী স্তব্ধ, কী শান্ত!

যতবার কবিতা লিখব ভাবি, ততবার তুমি ছুঁড়ে দাও অ্যাসিড মুখের ওপর। হেসে ওঠে বিদ্রুপ । আর আমার শরীরের সমস্ত ঘৃণা এসে বলে, 'ক্ষমা করো পাপ'!

শান্ত হই। ভাসিয়ে দিই নিজেরই ছাই। 
ভাসতে ভাসতে…. যতদূর চোখ যায় 
মৃদু আলো এসে পড়ে নদীতটে। 
চিকচিক করে সাদা বালি…

নিভৃত চোখের জলে!



শামুক
   দীপ্তেন্দু জানা


টর্চের ব্যাটারির ভেতর আপনার ছায়া
খেলা করে

কে যে আমায় ডাকে - দৃশ্যের গভীরে মুখমণ্ডল আর মুখমণ্ডলের গভীরে দৃষ্টি শুধু ডুবুরি হয়ে যায়

জলের সাথে  দ্যাখা হয়
পাতাঝাঁঝির সাথে দ্যাখা হয় 
ট্রাউট মাছের সাথে দ্যাখা হয়

কেন আরও কান্না করে দেয় আপনার দাঁতের গুনফল - আমার ভেতর বসে বসে আমরা শুধু ভাবি

ভাবি যে - চুম্বক এর ব্যাখ্যা নিয়ে আমরা একমত হতে পারিনা কেন

দেখুন অনুষ্কা - তবু কেমন আটকে নিচ্ছে একটি শামুক ডুমুর পাতায় নিজেকে



বৈদেহী

শুভনীতা মিত্র

হারিয়ে যাচ্ছে ডায়েরির পাতা, পাতায় থাকা গোলাপ...একটা পাপড়ি কলম কে আঁকড়ে
ধরে বলে তার গল্প লিখতে। লেখা হয় যখন তখন বদলে যায় আশপাশ,
নোনাখসা মরচে দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় কার দীর্ঘশ্বাস।
পট পরিবর্তন হলেও কলম জাল বুনতে থাকে আবার বিচ্ছেদের, আবার কারুর
ভবিতব্য মাঘী পূর্ণিমায় বাতাস পায়। রূপসী একলা হলেই ঘিরে
ধরে অদ্ভুত সব মায়াকল্প, যন্ত্রণাশূন্য মুখে খুলে রাখে তার অন্তর্বাস। আজ সবটাই
ঠিক, নয়তো পুরোটাই ভুল। কারুর কোথাও অর্ধেক সুখ নেই।
প্রতি জন্মের ধূসর প্রেমিক কে যদি চিনে ফেলা যেত! পাহাড়ি মেয়ের গুনগুন ভেসে
যায় খাদের ভাঁজে, প্রথম আলোর স্পষ্ট উচ্চারণ আঙুল থেকে আঙুল ছাড়ায়...
মায়াজাল...সাদা কালো..সরে সরে যায় সময়..কাল..খাদ...




কবিতার বিষ

     রাখী সরদার

মধ্যদুপুরে আমি আবার‌ও পুড়ে যাচ্ছি
লাল পায়রার অভিসম্পাতে
যে আমাকে চিনিয়েছে অতি অগ্নি তিল
পানি ঘেঁষা মীনের চুম্বন

এইমাত্র সে কার
  দুরন্ত হরিণ পিপাসায়
ঘাসে ঘাসে তপ্ত বুনে দিল
দেহখানি ডুকরে ডুকরে ছাই।

নিজেকে দ্বিধায় রেখে আবারও ভেসে উঠি
অন্তহীন সমুদ্রের নীলে,
যে আমাকে দিয়েছিল গহন শরীর
ডুবে থাকা নোনা কলরোল

হঠাৎ কার বাঁকানো ফণার আঘাতে
লিখে দিল মৃত্যুর অক্ষর,
ফোঁটা ফোঁটা কবিতার বিষ...

ছায়াজন্ম
    ভগীরথ সর্দার

গাছটি মানুষকে প্রশ্ন করলো––
“আপনি কবে গাছ হবেন?”
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে
মানুষটি কুকড়ে যায়
সে বলে–
“গাছ নয়, গাছের ছায়া হয়ে জন্মাতে চাই “৷





আলো নিভিয়ে দাও
সায়ন তরফদার

                           (১)

আলো নিভিয়ে দাও, আলো নিভিয়ে দাও
আলো নিভিয়ে দাও।
আলোয় আমি কিছু দেখতে পাই না।
চশমায় জমে যায় শব্দের বাষ্প...
অন্ধকার ছাড়া তারা জন্ম দিতে পারে না
কোনো বাক্যের।
আলো নিভিয়ে দাও, আলো জ্বেলে রেখো না।
                               (২)
আমি ব্যাকরণগত ভুল করে তোমার দিকে
এগিয়ে যাই। তুমি নগ্ন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে।
এখনো তোমার শরীর অনাবৃত নারীর।
শিল্পী এখনো তোমার শরীরে রঙ ছোঁয়ায় নি। 
তাই তোমার স্তনে মুখ ছুঁইয়ে পেয়েছি শুকনো মাটির ঘ্রাণ।
অনেক প্রাণ মিশে গেছে মাটির গভীরে,
                        শুধু তোমার রত্নগহ্বর খুঁজতে গিয়ে।

যেখানে পাহারায় বসেছেন স্বয়ং মৃৎশিল্পী।


চক্রব্যূহ
প্রত্যূষ কর্মকার

পাতার ভেলায় ভাসাই জীবন, জ্যোৎস্না জোড়ে সেতু
ভস্ম থেকে রাত্রি ওড়ে, মৃত্যু গোপন হেতু,
জুড়েছিল চাঁদের রেকাব, বনের মাথায় টিপ
দুঃসাহসী রাত্রি জাগে পৃথক অন্তরীপ

আঙুল জড়িয়ে রেখেছি প্রাচীন বনানীকে ছুঁয়ে যাওয়া
শাল শিমুলের কেশরে বেঁধেছি তরুনী ফল্গু হাওয়া
গভীর কালো রাস্তা ছুটেছে, দু ধার দীর্ঘশ্বাসে
শনশন করে, ছুঁয়ে আসে মেরু, নীল হেমন্ত মাসে
ঝাড়গ্রাম আর বেলিয়াতোড়ের শীর্ণ বিকিকিনি,
মূল খুঁড়ে যায় কাঁকড়াঝোর, আর প্লাবনে গাঢ়রাসিনি,
আজও যখন সন্ধ্যে এসে রোদের আলো মোছে
নশ্বরতার প্রদীপ জ্বলে; সংকেতে, আলগোছে,
শালের বীথি শিমূল পলাশ ফিসফিসিয়ে বলে,
'সাজিয়ে গেছো চক্রব্যূহ জলে ও জঙ্গলে'

 রাতভ্রমণে
সুমন কুণ্ডু

        এক । 
ফাঁপা দিনগুলো নামের পেছনে ঘুরছে । 
কোনো কোনো অস্পৃশ্য ইচ্ছে
 অক্ষরশূন্য হল,  
দুরের লেখায়  অতিবেগুনি শব্দ 
কাছাকাছি এলে মনে হয় 
অজস্র রাতের জটপাকানো শিরা  
 কৈফিয়ত যেখানে 
    আর স্পষ্ট নয় ! 
       দুই । 
এভাবে বন্য এক শহুরে গলি । 
 জং ধরা লোহার রড 
ভাঙাচোরা লাল ইটের গায়ে 
পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে । 
রং থেকে খুলে গেছে মসৃণতা, 
       আমাদের উৎসব । 
       তিন ।

রাতগুলো আর কাটবে বলেও
 কাটে না! মিথ্যের মতো কোথা থেকে ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গলের নিবিড় কুয়াশা । ছড়াতেই থাকে । শুনশান রাস্তার ভেতর অবিন্যস্ত এক হাঁটাচলা থমকে দাঁড়ায় । স্নায়ু ফেঁসে থাকে অবশে । হরফগুলো আড়ষ্ট, হাতের বাইরে । একা । এভাবে ব্যূহ, নিরুপায় ফিরে তাকানো । প্রবল রাত, বড়ো হয় । 

হুগলী সেতু ধরে
সাত্যকি


জানি অনেক বিরোধ  
অনেক না পাওয়ার অভিমান
পাশাপাশি সামনাসামনি 

অনেক মতানৈক্য অনেক ভুল বোঝাবুঝি
অনেকটা হারিয়ে ফেলার দুঃখ

তবুও সবকিছু পিছনে ফেলে 
রোজ এগিয়ে যাই
রোজ আর একটু এগিয়ে যেতে চাই
তোমাকে পৌঁছে দিতে চাই 
                            সীমান্তরেখায়...


ইরা, উন্মাদ! 
দেবেন্দ্র নাথ দাস

যে গলি অসংলগ্ন শুয়ে আছে তার আমি বুক দিয়ে হাঁটি
থুতনিতে উবু হয়ে দেখি আকাশের আলোছায়া খেলা 
উন্মত্ত গতির গাড়ি রহস্যে মশগুল 
দোকানিরা বন্ধ করেছে ঝাঁপ
জ্বেলেছে অপ্রকৃতিস্থ আগুন তালাবন্ধ পাথরে প্রলয়ে
সেও এক উন্মাদ ইরা বুনে চলে হাজার কথার মায়াজাল 
দেখছ কি অমন করে!
ভেবেছিলে তুলে দেবে সর্বহারা একমুঠো ভাত
ভিক্ষাপাত্র জুড়ে হতাশার চিহ্নটুকু খুঁজে l

এক কাপ চা দিয়ে চলে গেল মাধবের বাবা
ও কে চেনো, নেশাগ্রস্থ এইবেলা ঘরে ফেরে অপেক্ষার রাত 
উন্মাদ! চুপরাও 
বারান্দায় মঞ্চ সেজেছে 
চেয়ে দেখো জহ্লাদ রাত্রির বুক চিরে অন্ধকার  নামে 
বিদ্রুপ হেঁটে যায় ঘনান্ধ পথ

ইরা শুয়ে শুয়ে হাসে 
বাড়ি ঘর দালান দোকান রাতকালে মঞ্চে আলো জ্বেলে  l




   
স্বপ্নের বাসাবাড়ি

সোনালী ঘোষ


আমি জানি কোনদিনই
সাজানো হলো না স্বপ্নের বাড়ি,
জানালায় থাকে থাকে সাজানো গাছেদের ঢল
নরম ফুল, আর থোকা থোকা রোদ
ঘুঘু চড়ানো দুপুরে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গান শোনাবে 
আর একটু করে সূর্য স্তিমিত হয়ে যাবে.....

বুঝলে এবার বুঝি আর বাসাবাড়ি গড়া হলো না আমাদের।

পারস‍্যের গালিচা, চিনা লন্ঠনের আলো, আর আমাদের চাহনি
মদের চেয়েও অনেক অনেক বেশী মাতাল করে তুলবে
চাঁদের আলো টুকরো টুকরো হয়ে আসবাবের গায়ে,
তখন না হয় আরেকটু বেশি করেই, জুঁই ফুল ফুটত....
একটা ঘুম ও আমাদের সময়কে হত‍্যা করতে পারত না সেদিন,
আমাদের সম্পর্ক ডানা মেলে পাড়ি দিত আদিগন্ত
কিংবা মুখোমুখি বসে থাকা ডাহুকের মতোই...
 জানি হল না , হল না এ জন্মে কত কিছু ই হল না....




                                             -।
জানালা
পিন্টু দাস

জানালার ধার ঘেঁষে
এক ঘর বেয়ে ওঠে,
ঘরের ভিতর আর এক ঘর...
জানালা আমার গভীরে প্রবেশ করে
জানালা আমার সত্তা পড়ে
                     আমার ভালোবাসা পড়ে
                              আমার দুঃখ পড়ে
জানালা আমার দিকে চেয়ে থাকে
         আমার প্রতি অভিমান করে
                   আমাকে শাসন করে
                      আমাকে ভালোবাসে,
আমি ফ্যালফ্যাল করে জানালাকে দেখি
                         দুচোখে অশ্রু ঝরে পড়ে
এক চোখে ভালোবাসার, আর এক চোখে ঋণের
জানালা আমার অশ্রু মুছিয়ে দেয়
            আমাকে বুকে জড়িয়ে আগলে ধরে
আমার অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ একাকার হয়ে যায়,
                       জানালা মধ্যস্থলে স্থির, দৃঢ়...
বিশ্ব জগতের সঙ্গে মহাজগতের বন্ধন ঘটায়
                 ইহ লোকের সাথে পরলোক,
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে থাকি
        জানালার প্রতি চির ঋণী হয়ে থাকি।


সেই শিশুটি 

আশিস ভট্টাচার্য্য 

মন্দির দাঁড়িয়ে আছে পাথরের গায়ে 
গির্জা দাঁড়িয়ে আছে ক্রসের সাথে 
মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে আজানের সুরে 
একজন কারিগর হাঁটছে  চোখ রাঙিয়ে  ভূলোক দ্যুলোকে 
সময়ের পারদে ওঠানামায় ত্র্যস্ত জীবন 
জীবিকার কলস ক্ষয়ে ক্ষয়ে  কোথায় হাঁটবে?  
কেউ জানেনা। 

ওদিকে এক পুরোহিত জপে চলেছেন মন্ত্র 
কখনও তিনি ধ্যানে কখনও বিধানে তিনি, 
তিনি কল্পতরু নন 
তবু রচনা করে চলেছেন পথ ও পন্থা 
অন্ধকার ঝেড়ে ফেলে চলেছেন আলোর ঠিকানাতে 
এ'সময়ে প্রজাকূল সময়ের বন্দরে দাঁড়িয়ে 
নিত্যদিনের ব্যাপ্তিতে উৎকন্ঠার মালায় সংযমী । 

সবুজ কল্পনালতার পিঠে ধূসর চাদর 
অশীতিপর মহীরুহ ঢেকে যাচ্ছে  কালো ধোঁয়ায়,
মহাকাল দাঁড়িয়ে আছে দূরে 
সে বুঝি ইতিহাস লিখবে  কালবিলম্ব না করে, 
ফুটপাতেদাঁড়িয়ে এক শিশু 
ঠিকানা খুঁজছে আলোর 
ঠিকানা খুঁজছে  নীল আকাশের। 

মন্দির থেকে মসজিদ থেকে গীর্জা থেকে 
কয়েকশো ঘন্টাধ্বনি মিশে যাচ্ছে
শিশুটির হাসির সাথে। 


মগ্ন বিষাদ
সুধাংশু রঞ্জন সাহা


আমার এই জীবন এক, একফসলি জমিন।
চাষাবাদ মুলতুবি করে তাই বসে আছি!
মাথার ভিতর এক নির্জন ঝরনা বেজে যায়...
বুকের লুকনো সরোদে অভিমানের
হারানো ঠিকানা খুঁজে খুঁজে হয়রান ।

কেউ বুঝতে চায় না সব নদী তিস্তা নয়,
যার শরীরে উপচে পড়া শ্রাবণঢেউয়ে
একশো এক আরব্য রজণীর গল্প ।
বিবাহিত চোখের গাঢ় কাজলে
হাওড়া স্টেশনের পুরনো সাবওয়ে,
অথবা ঢাকুরিয়ার উড়াল সেতুর নিচে
অবিবাহিত শূন্যতা খেলা করে 
সরোদে ভোরের অজ্ঞাত রাগে মগ্ন বিষাদ
বেজে যায় বেখেয়ালে।



প্রাইভেসি
সুশোভন সাহা

আমার ঘরে কান পেতে থাকে বিভীষণ
ঘরের দেওয়ালে টিকটিকি ঘোরে- শিকারী
স্নান করি খোলা বাথরুমে, কোন ছাদ নেই
নগ্ন শরীরে দাঁড়িয়ে রয়েছি একাকী।

যা কিছু গোপন, বেসাত হয়েছে বাজারে,
সব "প্রাইভেট", "পাবলিক" হয়ে গেছে,
খুঁটিনাটি কত চড়াই-শালিক গল্প,
ক্লাউন সেজেছে সার্কাসে সার্কাসে।

যত আগলাই তত বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে,
আমার চিতায় হাত সেঁকে ওরা, আমার ভাল চাইছে;
সব নাশ করে তবু নেই... নেই শান্তি
মানুষ চিনতে দেরী আছে; আছে শুধু বিভ্রান্তি।


কিছু কথা

তীর্থঙ্কর সুমিত

কত কথা এইভাবেই বৃষ্টি নামায়
সারাদিনের ব্যার্থতা
আর রাতের নীরবতা
আমায় টেনে নিয়ে যায় অন্য পৃথিবীর দিকে
যে পৃথিবীতে একপশলা জল
আর ভালোবাসার পাহাড়
 
টেনে নিয়ে যায়
মনমুগ্ধকর পরিবেশের কাছে
যে পরিবেশে লুকিয়ে থাকে
এক একটা কথার পাহাড়



হয়তো এইভাবেই দিন কেটে যায়
রাত্রিকালীন কথায়।

আগন্তুক
-মারুফ আহমেদ নয়ন

তোমাকে যদি একদিন ভাল না বাসি। বুকের ভেতর বজ্রপাতের শব্দ শুনি। হৃদ-স্পন্দন
থেমে যায়। ভয়ে জুবু থুবু হয়ে পড়ে থাকি। নিজেকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এই ক্লান্তি। প্রিয়
আগুনের ফুল, আমার এই খেলায় একমাত্র প্রতিপক্ষ তুমি, আমার প্রেম ও কামনা
সম্পর্কিত ধারণা, মিশে গেছো অবচেতন মনে। যখন মাটির ছাঁচে ঢালি এই মদ, অপূর্ব
এক বাসনা। টাল-মাটাল হবার সম্ভাবনা থাকে প্রবল, তবুও খনির অন্ধকারে তলিয়ে
যাই। জানি, কোন মানুষ শোক করবে না মাছের পুত্র হত্যার পাপের জন্যে। 
পৃথিবী এক লীলাময় প্রান্তর। কেউ চেনে না আমাকে, সবাই ভাবে, হয়ত দূর দেশ
থেকে আসা কোন আগন্তুক। ঘোড়া বেঁধে রেখে বিশ্রাম করছে গাছের ছায়ায়।

গ্যালাক্সি জীবন
বাপ্পাদিত্য জানা
সন্ধ্যাকে দিলাম ব্যালকনি আর কাঠের চিয়ার
যতদূর দেখা যায় -- যতদূর
হাতের তালুর মতো চেনা
দেখার শেষ নেই, তৃপ্ততা নেই, বিরক্তিও না
শুধু এক সম্পূর্ণতা
উপরে তাকাই
উলটানো সরায় আঁকা তারা, অমাবস্যার জোনাকি আলো
আগুনের পিন্ডে এতো মায়া?
কঠোর মানুষও প্রেম ছুঁলে নরম!
তারারা প্রেম বিলোয় রাতে
ধুলোছায়া নদী হয় শিরায় শিরায়
এসব দেখবো বলে আমি সুতোকাটা ঘুড়ি হই
         গ্রহে গ্রহে ঠক্কর খেয়ে খেয়ে
         তারায় তারায় প্রেম নিয়ে
         কক্ষপথ থেকে কক্ষপথে
         রিলে দৌড় দিতে দিতে
         ছুঁয়ে ফেলি গ্যালাক্সি জীবন।


আত্মীয়তা
হিমাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়

মৃত্যুর সঙ্গে একই নৌকোয় ভাসতে ভাসতে করুণ
মুখগুলো যে কোথায় গিয়ে মিশবে জানা নেই-
শুধু মেঘে ভেসে থাকবে কিছু স্বপ্নবলয়।
পায়ে পায়ে,তারা কাছে আসবে আত্মীয় হয়ে!
নিভে যাওয়া হেমে গোধূলি আকাশ এখনও লালনের-
নষ্টরাতের ক্ষত নিরাময়ে পাব কি সেই জোছনাপালক আর শিশিরস্নাত আলিঙ্গন?
সমস্ত বাতিঘর বন্ধ হয়ে গেলে কি তোমরা জানতে চাইবে সে আলোর কথা?



 গুচ্ছ কবিতা
মতিউল ইসলাম 

১.ডাল থেকে মাছরাঙা উড়তেই
মাছ চোখ বন্ধ করলো,
আর নিমিষেই চরাচর জুড়ে অন্ধকার।
  

২.চায়ের কাপে তলানিতে অল্প চা,
 ধুতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালে,
জীবনে প্রথমবার প্রতিবাদ 
না ধুয়ে ভেঙে ফেললে কাপটা।

৩. ঘুমালেই ঈশ্বর,
জবাবদিহি চাইলে ও নির্বাক
সর্বশক্তিমান! নিদ্রাহীন রাত,
অগত্যা কবিতা।

৫-লাইনের কবিতায় আরাম
অভিজিৎ দাসকর্মকার


[১]


আমার একটা বটগাছ আজও রয়েছে 
পার্শ্ববর্তী ঝুরো গল্পের গায়ে লেগে রয়েছে নদীর কৌতুহলী  এপাড়_____
    মুখের আড়ালে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। চিহ্ন নেই পরিস্কার জঙ্ঘার গায়ে ———
শুধু,
   শুদ্ধ উচ্চারণ লেগে আছে বাঙ্কের উপর রাখা বিকেলের অলস আড়মোড়ায়।
   
[২]

যে হাওয়ায় অন্য আ'রেক শুরুয়াত্ টগর হয়ে হেসে ওঠে, তার আর আমার সকালের ওঠার সময়সীমা মাত্র একটি শব্দ____


[৩]

   পড়শির প্রাচীরের অটুট ওপারে পরিচর্যিত হওয়া দুটি করবি ফুল, আর
নৈর্ঋত কোণে বাঁশঝাড় জুড়ে হেটে চলা নদী, নদীর যৌবন, আর ক্ষয়ে আসা রজঃস্বলা;

   আস্তে আস্তে মাটির সোঁদাবাষ্প হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা... 

[৪]

গাছ থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে ১টি বড়ো ফাঁকা জায়গা___

গাছের পাতা অনুযায়ী পরবর্তী কয়েক দিন পর আবার কবিতায় আসবে কলিঙ্গ জয়ের কথা, এবং
    ফেসবুক স্টোরিতে সাঁটানো থাকবে আপনার আর ১টি বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের ক্যাপশন। 

তারপর,
প্রতিদিন ৩:৪০ এর পর ঘড়ি দেখে অনর্গল ওলট-পালট হবে বড়ো, সরু আর সেকেণ্ডের কাঁটা---

[৫]

জলের কাছে এসে আকাশের মেঘলা জীবনে সংগীতময় স্নিগ্ধ বৃষ্টি এবং 
    নৌকাসহ বয়ে চলেছে আমার, নৌকা আর জলের ছায়া।

আমি উত্তম পুরুষকে অন্ধ আঘ্রাণে, প্রতিটিদিনকে মুখরিত হতে দেখেছি গোমেদ রঙে___

এবার আষাঢ় আসুক সমাজে। সব লেখাই ধানশিষ হয়ে অক্ষরিত হোক তোমার শরীরে। আমি শরীরদ্বারে পথ আগলে বসে রয়েছি...

  ১টিবার রঁদেভুতে এসো____

ভালোবাসা



বউঠান ও সাম্রাজ্যবাদ
অর্ঘ্য কমল পাত্র

১.
ঘাম ঘাম ব্লাউজের গায়ে
লেখা থাকে
খামারবাড়ির ইতিকথা।

সেখানে বুলবুলি আসে।
ধান খেয়ে যায় ম্লেচ্ছ 

এর প্রায় দুশো-আশিদিন পর আসে
একটা নতুন ইতিহাস। 

২.
মুখভর্তি শীতকাল নিয়ে 
যখন মেয়েটি চলে গেল

তখন কিছু কুয়াশা লেখা হয়েছিল

সেইসব সংলাপ, বউঠান পড়েছে 
বউঠান তা তুলে রেখেছে

যত্ন করে... 



ছড়াক্কা ও ছড়া কবিতা

অবিনশ্বর
সতীশ বিশ্বাস

বিশ্বে চলেছে সৃষ্টির খেলা; সবকিছু অবিনশ্বর
যা কিছু ধ্বংস, আসলে সৃজন।
এখানে মৃত্যু ওখানে জীবন।
কখনো এ রূপ, কখনো অন্য।
হে বৈচিত্র, তুমিই ধন্য।
আজকে যেখানে নীরবতা,কাল জেগে ওঠে কন্ঠস্বর।

ছোঁয়াছুঁয়ি
পিনাকী দত্ত গুপ্ত


কতদিন দেখিনি গো তোমাকে!
কতদিন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলিনি!
রাত জেগে ঝিকিমিকি জোনাকে
ভুল করে হাতে ধরে ফেলিনি।

কতদিন আম-জাম-কাঠালের 
ছায়া খুঁজে দুই চোখ মেলিনি,
আলো-আঁধারির ঘন মায়াতে
কতদিন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলিনি।


(ধুমসো আলো, ভীষণ কালো,
নখ উঁচিয়ে, দাঁত দেখালো!
বীভৎস মুখ, জ্বলন্ত বুক,
বললো, আমি কালের অসুখ)  


এখন তো আমি তুমি বন্দি
নেই ঘুম, নেই দিন, নেই রাত!
নেই হার-জিত, নেই সন্ধি,
ভিটে-মাটি থেকে যারা উৎখাত...

রাজপথ কিবা রেল লাইনে
ঘেঁষাঘেঁষি করে' যারা হাঁটছে,
ঘিনঘিনে দেহে বিনা-মাইনে,
যারা শুধু জঞ্জাল চাটছে....


(জানিস তোরা, তোদের ঘরে 
ওঁত পেতেছে ধূর্ত শেয়াল,
মায়ের মুখে ছাঁই দিয়ে বাপ
খেলছে শরীর নগ্ন খেয়াল ) 


রেডিও বা খবরের হেডিং এ
যুদ্ধ যুদ্ধ যারা খেলছে,
রাতভোর সুগন্ধী বেডিং এ
চোখ থেকে নোনা জল ফেলছে,

মনে হয় ডেকে বলি একবার,
কতদিন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলিনি!
ভুল করে কাঁপাকাঁপা দু-হাতে 
শুকনো দু-চোখ মুছে ফেলিনি!

 
কবির কথা
ছোটন গুপ্ত

এক যে আছেন কবি…
যখন কোনো কাজ থাকেনা দেখি তাঁরই ছবি।
প্রখর রোদের তাপপ্রভা জাগায় যখন আলো–
তাঁর স্নিগ্ধ কবিতা গান সরায় মেঘের কালো।

হিম পাহাড়ের ডাকে...
যখন বরফ কাঁপিয়ে দেয় চোখ মেলি তাঁর ডাকে।
মেঘের কোলে রোদ হেসে কয় ভয় পাসনে তুই
কবিয়ালের খুশির খেয়াল আলোর কণায় ছুঁই।

সময় থমকে আছে...
কী যায় আসে মনের কবি যখন থাকেন কাছে!
কষ্টগুলো ওড়ায় ধুলো ডুব দিলে তাঁর গানে–
একলা থাকার দুঃসময়েও রইবো কবির টানে।

কেউ ডাকেনি আর ...
মেঘ বৃষ্টির রিমঝিম সুর বাজাক না সেতার!
সুরের আলোয় মন ভরালো সকাল সন্ধ্যা রাত
এক যে কবি বড্ডো আপন ছাড়বো না তাঁর হাত।

কান পেতে গান শোনো…
রাত আকাশে লক্ষ তারা কালোয় আলোয় গোণো।
সমস্ত রাত বাউল বাঁশির সে সুর আপন প্রিয়,
প্রাণে আমার সেই যে কবির আশীষ টুকুন দিও।

প্রিয় বই, প্রিয় কবিতা



সেরা শব্দের বাণীবিন্যাসে নির্মিত এক কাব্য
সঞ্জয় কর্মকার

ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ বলেছিলেন, " কবিতা হল সেরা শব্দসমূহের শ্রেষ্ঠ বাণী বিন্যাস (Best words in the best order )। তরুণ কবি কমলেশ কুমারের ' তুমিও না হয় রয়ে গেলে চিরকাল ' কাব্যে কোলরিজের এই বক্তব্যটিই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বস্তুত, আঠাশটি প্রেমের কবিতায় ঋদ্ধ এই কাব্য গ্রন্থটিতে কবির ব্যক্তিগত আবেগ - অনুভব- ভাবকল্পনা পাঠকের চিন্তা চেতনাকেও তাই স্পর্শ করে যায় বারবার । আসলে,আত্মতন্ময় কবি কমলেশ তাঁর কবিতাগুলিতে যে চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন তা এককথায় " সৌন্দর্যের ছন্দিত সৃজন " । প্রসঙ্গতই 'প্রতিকৃতি' কবিতায় কবি লিখেছেন - " ঘোড়ার মতই শব্দ ছুটেছে, হেরেছি ,জিতেছি আর / শূন্যের কাছে জমিয়ে রেখেছি গিলে নেওয়া চিৎকার ।" আবার 'খেলাঘর' কবিতায় কবি যখন লেখেন " আমারাও বকুল ফুলের মতোই/ কেমন ঝরে গেছি টুপটাপ, নিরন্তর--" তখন সহজেই অনুমান করা যায়, অনুভূতির গভীরে অবতরণশীল কবির মানসিক যন্ত্রণাকে । অথবা 'স্বপ্ন' কবিতায় কবি লিখেছেন, " একদিন ঠিক ফিরে এসে দেখো তুমি/ আগলে রেখেছি হেরে যাওয়া বিশ্বাস ।" হ্যাঁ,এই বিশ্বাসে ভর করেই তো কবি প্রেমের প্রতিটি স্তর ছুঁয়ে গেছেন।
দূরে গিয়েও ফিরে এসেছেন তাঁর ভালবাসার কাছে । কবি বিষ্ণু দে- র লেখা ' চোরাবালি' কাব্যটির সমালোচনা করতে গিয়ে আর এক বিশিষ্ট কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মন্তব্য করেছিলেন, " আমার বিবেচনায় কবি প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দস্বাচ্ছন্দ্য ।" এই উক্তির নিরিখে বলা যায়, কবি কমলেশ কুমারের ছন্দবোধ সর্বার্থেই প্রশংসাযোগ্য। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলতে হয়, " একটি বিকেল নীরবতা হয়ে আমি/ তোমার শহরে বেঁচে আছে কিছু আলো / অস্থির মেঘে রেখে যাওয়া দূরগামী/ বুকের পাঁজরে বিদ্যুৎও চমকালো ( মেঘাবৃতা ) কিংবা " আগলে রেখো , আগুন দিও,ক্ষয়/ রাখতে দিলাম অজানা প্রত্যয় !" ( দুপুর )
আসলে, ছন্দ নিয়ে যে কবি নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন তা এই কাব্যের একাধিক কবিতায় স্পষ্ট । 'তুমিও না হয় রয়ে গেলে চিরকাল' কাব্যটির আর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল -- কবিতাগুলির নামকরণ । যেমন- স্বপ্ন ,ডাক , ঘুম , বর্ষা , হত্যা ,স্বর ,পথ , ঘৃণা ফেরা , বৃষ্টি... লক্ষণীয় , মাত্র দু- তিন অক্ষরে কবিতার নামকরণ করেছেন কবি অথচ তার মধ্যেই যে ভাবব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন তা কবিতার গভীর অর্থকে উপলব্ধি করতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে ।" ঠিক তখন কবিতা রঙের একটি ছেলে নিঃস্ব এসে দাঁড়ায় গাছের কাছে / ভুল করে দু-একটি কথা বলে ফেলে কান্না-- বাষ্প মাখা পাখিদের সুরে ( স্বর ) -- কবিতায় এমন সজীব ভাষা বা ইমেজারি তৈরি করতে প্রায় সিদ্ধহস্ত কবি । কবিতাগুলি পড়তে পড়তে পাঠকের মনও জারিত হয় -- আনন্দ- দুঃখ- বিষাদ বা অব্যক্ত যন্ত্রণার সঙ্গে। আর এখানেই কবি কমলেশের মুন্সিয়ানা । আসলে , ' তুমিও না হয় রয়ে গেলে চিরকাল' কাব্যটিতে কবি ভালবাসার যে চিত্রাঙ্কন করেছেন তাই তো চিরকালীন ,তাই তো শাশ্বত । আর ঠিক এই কারণেই কমলেশ কুমারের এই কাব্যটিকে খুব যত্ন নিয়ে পড়তে হয় ।
কাব্যগ্রন্থ- তুমিও না হয় রয়ে গেলে চিরকাল
কবি- কমলেশ কুমার
প্রকাশনি সংস্থা - ঋতভাষ
প্রচ্ছদ- কৃষ্ণেন্দু মন্ডল
মূল্য- ৫৫ টাকা


 একুশ শতকের বাংলা কবিতা

কবিতাঃ আমিজন্মের স্কুল
কবিঃ অমিত সরকার
আবৃত্তিঃ দেবেন্দ্রনাথ দাস

ভিডিও উপস্থাপন- বাংলা কবিতা