Sunday 5 November 2017

সাহিত্য এখন, নভেম্বর প্রথম পক্ষ


সম্পাদকীয়

এখন কার্তিক মাস। হাওয়ায় হিমেল গন্ধ ভেসে আসছে। গ্রামবাংলার ভরন্ত বুকে  ধানগাছের সারি আমার আপনার ঘরের সন্তানের মতই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কৈশোরের ঔৎসুক্যে আর কোমল দৃপ্ততায়। মানুষের মনে নতুন সাধ, নতুন আশা ভরসা। 'সাহিত্য এখন' পাক্ষিক অনলাইন পত্রিকা হিসাবে পা বাড়াবে, এমন একটা আশা সুপ্ত হয়ে ছিল অনেক দিন ধরেই। আজ তাই সে পথে পা বাড়ালাম। ভরসা রাখি আপনাদের পাশে পাব। আমাদের এই পত্রিকা নতুন ধানের মতই উজ্জ্বল আশ্বাস নিয়ে আসুক, এটুকুই প্রার্থনা।


দুটি অনু গল্প
গোপেশ দে

পরিবর্তন
বিরাটের ভেতরে বেশ কিছুদিন ধরে একটা আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করছে ওর বন্ধুরা।বাড়িতে সারাদিন একা একা বসে থাকে ও।দুচারটে গান শোনে তাও আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত।অথচ এই সেদিনও হিন্দি ডিজে গানে গা ভাসিয়ে দিতো।এই পরিবর্তন বাড়ির লোককেও কিছুটা চমকে দিয়েছে।গৌরব প্রায়ই ওর বাড়িতে আসে।বিকেলে বেরুতে বলে।ক্লাবে ক্যারাম খেলার জন্য আসতে বলে,রাতে মদের জলসা।কোনো কিছুকেই পাত্তা দিচ্ছেনা ও।অথচ এই সেদিনও ও বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোর,রকে বসে মেয়ে দেখলে শিটি, রাতে ভদকা,রামে মাতোয়ারা,উৎসর বাইকে করে অনেকদূরে চরুইভাতি করেছে।বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।শুধু একটি কাজ ও খুব মন দিয়ে করছে।ওদের পাড়ার দীপ্তিকে ফেসবুকে সকালে গুড মর্নিং রাতে গুড নাইট এসব দিতে ভুলে না ও।ওর ভেতরে এতোটা পরিবর্তনের কারণ অবশ্য আছে।দীপ্তিকে ও যেদিন প্রপোজ করে মেয়েটা এক রাশ ঘৃণা এনে বলে,লজ্জা করেনা আমাকে প্রপোজ করতে।নিজে কতটা খারাপ একবার ভেবে দেখেছো?চায়ের দোকানে বসে মেয়ে দেখলে বাজে আচরণ,শিটি,রাতভর মদ গেলো।আবার আমার পেছনে এখন লেগেছো?এই কথাগুলোর পর ও দীপ্তিকে আর সামনা সামনি বিশেষ কিছু বলার সাহস পায়নি।সেদিন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওসব ছেড়ে দেবে।দীপ্তিকে যে সত্যিকারের ভালোবাসে ও।শুধু ফেসবুকে রোজই একটা কথাই বলে,আমি ওসব খারাপ অভ্যেস ছেড়ে দিয়েছি।আমাকে আর ওসব করতে কখনই দেখবেনা তুমি।সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকি।শুধু তোমার ভালোবাসার জন্যই আমি সব কিছু ছাড়তে রাজি আছি।একটিবার বলো ভালোবাসি।এসব ন্যাকা কথায় দীপ্তির মন কিছুতেই গলে না।সে বলে দিয়েছে,কুকুরের লেজ কখনই সোজা হয়না।এভাবেই দিন চলল।কিন্তু একদিন বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসতেই দেখতে পেল দীপ্তি ঠিক ওর সামনে দিয়েই অয়নদার বাইকের পেছনে বসে কোথায় যেন যাচ্ছে।ওর সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।অয়নদা!দীপ্তি কি অয়নদার ব্যাপারখানা জানেনা।আসলে বিরাট অয়নদাকে দুমাস আগে অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে দেখেছে।একদিন না বেশ কিছুদিন।সেও মদ,সিগারেট সবই খায়।আর মেয়ে দেখলে জিভ লকলক করে।কিন্তু দীপ্তি এটা কী করল।রাতে দীপ্তিকে ফেসবুকে অয়নদার প্রসঙ্গটা বলতেই দীপ্তি লিখে দেয়,অয়ন আমার বয়ফ্রেন্ড।তুমি আর আমায় ডিস্টার্ব করবেনা।বিরাট ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মনেই বলে,এই তাহলে সমাজ!কিছুক্ষণ পর ও গৌরবকে ফোন করে বলে,ভদকার পাঁইট রেডি কর।আজ সারারাত আড্ডা হবে,ডিজে হবে।বলেই ফোনটা কেটে দিল আর বিড়বিড় করে বলল,কুকুরের লেজ সত্যিই সোজা হয়না!

এক্কাদোক্কা
সায়নীর ছোট্ট সংসার।একমাত্র ছেলে বয়স ১০ ক্লাস ফাইভে পড়ে।বর মাল্টিন্যাশনাল জব করে।ওদের বাড়িটি অনেক বনেদিআনা।চারপাশেই ঘর আর মাঝখানে একটা উঠোন সাথে তুলসীমঞ্চ।ওর জা ভাসুর সবাই একই বাড়িতে থাকে।ওর বর নীলাদ্রি চার ভাই।নীলাদ্রি সবার ছোটো।বাকি তিনজনের মেঝজন বিহারে একটা ব্যবসা করে।বাকি দুই দাদা এই বাড়িতেই থাকে।তবে সবাই আলাদাভাবে থাকে।একান্নবর্তী ব্যপারটা নেই।নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি।ভরদুপুরে প্রায় সময়ই একা একা বসে টিভি সিরিয়াল দেখে সায়নী।ছেলে স্কুলে,ছেলের বাবা অফিসে।আজ হঠাৎ দুপুরে লোডশেডিং হওয়ায় ঘরের পেছনের জানলাটা খুলে বসল ও।শীতের দিন।পেছনের জানলা দিয়ে হালকা রোদ এসে পড়ছে।বেশ ভালোই লাগছে।হঠাৎ চোখ গেল দূরের একটা বাড়ির ছাদে।একটা বাচ্চা মেয়ে ছাদের ওপর  কি যেন খেলছে।সায়নী একবার চোখ ফেলেই বুঝে নিল খেলাটা এক্কাদোক্কা।হঠাৎ ওর ভেতর সোনালী স্মৃতি চকচক করে উঠল যেন চোখের সামনে এইচডি পর্দা।সে ও তারসাথে আরো তিন চারটে মেয়ে রাস্তার পাশে দাগ টেনে খেলা শুরু করল।গ্রামের সহজ সাদামাটা রাস্তা।মাটির ওপর আয়তকার দাগ টেনে তারপর ঘরের ভেতরে আড়াআড়িভাবে সরল রেখা টেনে ছয়টি খোপ করে ভাঙা কলসীর চাড়া নিয়ে সেই ছোটোবেলার খেলা।অনেক দিন পর সায়নী নস্টালজিক হয়ে গেল।সত্যি কী আনন্দের দিনই না গেছে ওদের!এখন সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।এক্কাদোক্কা খেলা কোনো গ্রামের বাড়ি কি রাস্তায় আর দেখা মেলেনা।সায়নী এখনও একনজরে বাচ্চা মেয়েটির খেলা দেখছে।

অনুগল্প 
অতনু টিকাইৎ


রাজনীতি 

'এতো তাড়াতাড়ি হারামির বাচ্চাগুলো মুখ ফিরিয়ে নেবে ভাবা যায়!' --- বলেই পার্টি অফিসে ঢোকে স্থানীয় যুব নেতা বিপ্লব দাস। স্থানীয় MLA এর ডাকে আজ আলোচনা সভা বসেছে পার্টি অফিসে। সামনেই বিধানসভা ভোট। কিভাবে এই ভোটে জয়লাভ করা যায় তাই এই আলোচনা সভার প্রধান বিষয়। আলোচনায় উপস্থিত MLA সহ স্থানীয় প্রথম সারির কয়েকজন দাপুটে নেতা।
বিপ্লব দাসের এমন উক্তির কারন বর্তমানে স্থানীয় মানুষদের আচার ব‍্যবহার যাতে স্পষ্ট হয় বেশিরভাগ মানুষজন তাদের পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এই পাঁচ বছরের মধ‍্যেই অথচ একটা সময় এই মানুষরাই একত্রিত হয়ে তাদের পার্টিকে বিপুল ভোটে জিতিয়েছিল, পার্টির নেতাদের তাদের হৃদয়ে জায়গা দিয়েছিল।
মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারন অবশ‍্য  স্বয়ং MLA থেকে স্থানীয় নেতা কারুরই অজানা নয়।
যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল, যেমন স্থানীয় পাকা রাস্তা, পর্যাপ্ত পানীয় জল, বেকার সমস‍্যা দুরীকরন এর মতো অনেকগুলি স্থানীয় সমস‍্যা তার কোনটারই সুফল পায়নি জনগন।
রাস্তাটা যদিওবা করা হয়েছিল কিন্তু কয়েকমাস এর মধ‍্যেই তা নষ্ট হয়ে যায়, জলের সমস‍্যার কোন সমাধান হয়নি এবং স্থানীয় বেকার যুবকদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। রাগটা আরও চরমে উঠেছে যখন দেখেছে নেতা ঘনিষ্ট যোগ‍্যতা না থাকা ব‍্যক্তিদের চাকরি হয়েছে।
'কিচ্ছু চিন্তা করবেন না দাদা, আমরা আছি তো। কাজ আগের পার্টি'ই বা কি করেছিল তবু তো তারা এতোগুলো বছর ছিল ক্ষমতায়, নেতা মানে কি ভগবান নাকি যে মানুষ যা চাইবে তাই করে দিতে পারবো আমরা, আর এসব মানুষ বোঝে। কিচ্ছু চিন্তা করবেননা। আমরাই আছি, আমরাই থাকবো।' --- এই বলে MLA এর চিন্তা কমানোর চেষ্টা করেন স্থানীয় দাপুটে নেতা অরিন্দম চ‍্যাটার্জ্জী।
পাশের আরেক নেতা এই শুনে বলে ওঠে --- 'দুই পরিস্থিতি এক নয় অরিন্দমদা। ওই পার্টিতে কালু মস্তানরা ছিল, আমাদের পার্টিতে আছে এমন কেউ যারা ভোটের আগের রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের ধমক দিয়ে আসবে, ভোট লুটবে? আর ভোট না লুট করে মানুষের ভরসায় ভোট হলে আগের পার্টিও ওতোদিন থাকতোনা আর আমরাও থাকবোনা।
বিশ্বাস করুন বা না করুন বাসুদেবদাদা, এটাই fact।'
কালিপদ দাস ওরফে কালু মস্তান। আগের পার্টির শেষ অস্ত্র ছিল এই কালু। কিন্তু আগেরবার বিধানসভা ভোটে সাধারন মানুষ বর্তমান MLA বাসুদেববাবুর নেতৃত্বে একজোট হয়ে স্থানীয় নেতা ও কালুর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করে। এরজন‍্য বাসুদেববাবুকে কম কাঠ্-খড় পোড়াতে হয়নি। দিনের পর দিন মানুষের মধ‍্যে থেকেছেন, অসুবিধায় পাশে দাঁড়িয়েছেন, মানুষকে বুঝিয়েছেন ঘুরে দাড়ালেই সুদিন নিশ্চিত, আস্থা দিয়েছেন যেমন পাশে রয়েছেন কিন্তু ক্ষমতা না থাকায় চেয়েও করতে পারছেননা অনেক কিছুই, ক্ষমতা পেলেই সেসব কাজ করে দেবেন চুটকি মেরে। মানুষও সেইসময়কার পার্টির নেতাদের এবং সাথে কালু মস্তানদের নানান দুষ্কৃতিমুলক কাজের থেকে রেহাই পেতে পথ খুঁজতে জড়িয়ে ধরেন বাসুদেববাবুকে। জয়লাভ করে বাসুদেববাবুর দল। জয়লাভের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব পার্টির বহু স্থানীয় নেতার সাথে কালু মস্তানও ঘরছাড়া। এই পাঁচ বছর কালু কোথায় আছে, কি করছে কেউ জানেনা। স্থানীয় মানুষজন তার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর দিন'ই।
তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। এক বিধানসভা ভোটের পেরিয়ে আরেক বিধানসভা ভোট এসেছে। মানুষের বিশ্বাস গড়েছে ভেঙেছে। মুখোশ খুলেছে অনেকের। দুরত্ব বেড়েছে বাসুদেববাবুর সাথে মানুষের।
এতোদিন সব ঠিক থাকলেও ভোটের নির্ঘন্ট বাজার সাথে সাথেই কপালে ভাঁজ দীর্ঘ হয়েছে পার্টির স্থানীয় নেতা সহ স্বয়ং MLA এর।
ভাবুক প্রত‍্যেকেই, চিন্তিতও। অবশেষ আলোচনা সভার নীরবতা ভেঙ্গে বাসুদেববাবু জানতে চান --- 'কালু এখন কোথায় থাকে কেউ জানিস?'
'শুনেছিলাম ওর শ্বশুরবাড়ির গ্রামে ঘর বানিয়ে থাকছে।' --- উত্তর আসে।
---- 'ওকে বল গিয়ে বাসুদেবদা ডেকেছে। দরকার আছে।'


কবিতা 

প্রবেশ নিষেধ
দেবাশীষ সান্যাল

পদ্মা কিংবা গঙ্গা
ঢাকা থেকে কোলকাতা
কোথাও তোমার চাকরী নেই যুবক!

কাঁধে বন্দুক
পশ্চাতে ১৪ প্ল্যাটুন তীরন্দাজ
রাষ্ট্রনায়ক এখন দেশ শাসনে বিভোর।
ওখানে তোমার প্রবেশ নিষেধ!
যতই চাও না স্বীকৃতি
বেকারত্বের অভিশাপ
তোমার পিঠে শতাব্দীর দগদগে ঘা হে যুবক!
যতই তোমার চোখে জাগুক বিস্ময়।
জেনে রেখো
এই জনমে তোমাকেই বেঁধে রেখে দেবে
বিপুল কংকালসার দেহ!
তোমার চেতনার দৈন্যতায়
কখনোই জেগে উঠবে না
পথভ্রষ্ট মহাকাল!
হায় অমানিশা কৃষ্ণপক্ষ
তোমাকে আর কে শেখাবে বলো
কার্ল মার্ক্সের অ আ ক খ?




নিবিড়  থেকে থেকে নির্জনে
পিনাকী দত্তগুপ্ত

একা থাকার উপহার তুমি ফিরিয়ে নিয়েছো
অতঃপর। আমি প্রতিবাদ করিনি; কারণ,
তুমি জানতে, যত কাছে আসবো প্রতিদিন,
ততটাই একা হয়ে যাবো দুইজনে। নির্জনে ।

রাতের অন্ধকারে ছায়া মাখে হেমন্তের বক।
ঝাপসা কুয়াশা নামে অবসন্ন আমনের মাঠে।
অচেনা নারীর খোঁজে ঝরে পড়ে চেনা লুব্ধক;
দীর্ঘশ্বাস জমে শেষ প্রহরের খেয়া-ঘাটে।

তবুও যখন তুমি ফিরিয়ে নিয়েছো তানপুরা,
জানাইনি দাবি, জানি ওই সুর বাজবেনা আর।
কারণ আমি জানতাম, আমরা ঠিক ততটাই
দূরে সরে যাচ্ছি প্রতদিন, যতটা নিবিড় হয়েছি
“চেতনে কিংবা অচেতনে”।


ফিনিক্স পাখি
মতিউল ইসলাম

"ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি-
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে" ||

ফিনিক্স পাখির ঠোঁটে এক টুকরো আগুন,
নতুন জীবনের জন্য মৃত্যু চাই,
পোড়া অস্থি আর বাসস্থানের মধ্যে থেকে
জন্ম নেবে নবজাতক.
চলো পবিত্র হওয়ার জন্য
আগুন জ্বালি,
পুড়ে যাক বাক্সবন্দী অহং,
দিগন্ত বিস্তৃত আমিত্ব,
চলো পুড়িয়ে ফেলি লালসার বীজ.
যমদূত আসার আগেই
আত্মায় আগুন দিই,
যমদূতের বিস্ফারিত চোখের সামনে-
নগণ্য মানুষ থেকে চলো
ফিনিক্স পাখি হয়ে যাই.

মিছিল
বিশ্বজিৎ মাইতি

পৃথিবীর ব্যাস বরাবর চলো আমরা মোমবাতি মিছিল করি-
জানি অন্ধকারে শুয়ে আছে আমাদের আত্মীয় স্বজন তবু
কুচকাওয়াজ থামাও প্রিয়তম
যুদ্ধ থেমে গেছে,
আমি দিয়ে এসেছি একশত গোলাপের চারা
যুদ্ধবাজের হাতে।
চলো এবার ভোরের রোদে ডুব দিয়ে আসি,
দিগন্তে মুখোমুখি বসব এসে আমরা
তারপর,
কে আছো কাঁটাতার গুটিয়ে নাও-
এখুনি মাটি ভেদ করে জন্ম নেবে উদ্ভিদ,
রঙচটা কফিনের পাশে।

 ক্যানভাস
সুশান্ত ভট্টাচার্য 

 উকুন এক প্রাণী বিশেষ

চুলের গভীরে
দ্রুত ফেলে শ্বাস

আমার ঝাঁকড়া চুল
আলতো চিরুণী চালাই

উকুন কি কবির বাহন
জল রঙে যাকে আঁকতিস।


যাবো ভেবে  
প্রত্যূষ কান্তি কর্মকার  

যাবো ভেবে যেতে পারিনি এখনও
যাওয়া মানে সমূহ অন্ধকার
স্তব্ধ হয়েছে সব তরবারি
বাঁচা মরা সনাতন ঘর বার
তরল হাওয়ায় ভেসেছে সব গান
আগুনের পরিপাটি সাধনার ভোর
বেঁচে থাকা ভেবে ছুঁয়ে গেছি যত মূল
তার সবটাই শুধু ঘন হয়ে থাকা ঘোর
রাত্রি নিবিড় হলে জোনাকিরা কথা বলে
আলোর বিন্দু প্রান্তরে যায় ভেসে
শরীর থেকে ঝরে পড়ে যায় বিপন্নতার পালক
আগুন শিখর ছাইয়ে ডোবে অবশেষে
মুঠোয় থাকা লাভার বিচ্ছুরণ
টেবিলের কোণে মাথা নুয়ে পড়ে আছে
ভুলে গেছি তার আপামর প্রবণতা,
কুহকের চোখ সংকেতে কাছে ডাকে


অক্ষর লিখি চল
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

আঁকড়ে ধরেছি স্মৃতির দরজাখানা 
পুরনো সময় হাসছে সকৌতুক 
অবাক হচ্ছ? তোমারও কি আছে জানা 
কোন দিকে যাবে জীবনের অভিমুখ? 

ভাতের থালায় জ্যোৎস্না ফুটতে দেখি 
খালের শরীরে ভাসে রূপবতী মাছ 
কিভাবে লিখব এইসব ভালোলাগা 
কিভাবে লিখব এত স্নেহময়ী গাছ?

আরও কিছু আছে এসময়কার কথা 
সব কথা নয় বৃষ্টি রৌদ্র মেঘ 
আরও কিছু আছে লজ্জিত শব্দাদি 
বোবা চীৎকার ঝলসানো উদ্বেগ 

নতুন কবিতা পাশ ফিরে শুয়ে আছে 
পুরনো কবিতা গায়ে লিখে দেয় ঋণ 
যেসব দশক আঁকড়ে ধরেছি আমি 
খুন হয়ে গেছে তাদের সোনালি দিন 

অক্ষর লিখি বাঁধভাঙা বিন্যাসে 
অক্ষর লিখি আগুন এবং জল 
ফুরিয়ে যাচ্ছে যেসব শিশু ও পাখী 
আজ সেইসব অক্ষর লিখি চল।

Monday 30 October 2017

Nature unfolds /Dr. Tripura Shankar Saha

Nature unfolds its  beauty opulent
To seer blessed with the violent
passion.Sees unseeable, feels
unfelt, taste untasted,and smells
          its hair.

Nature speaks incessantly  only
with him, who understands clearly
the nuances of its dancing eyebrow,
the melodious tune of the flow
          of river,

Nature holds right hand with
passion,
passes its warmth, love with emotion.
Entangles its fingers like the tentacles
with him who is connoisseur of signals
             of her.

Nature hugs him with arm and legs
who shuns his manly reason & begs
to get empowered with the sense
of receiving every expression dense
             so far.

Wednesday 25 October 2017

বিষাদের মত/ প্রত্যূষ কর্মকার

জলের ধারে এরকম সন্ধ্যে নেমে এলে জলের গভীরে ফুটে ওঠে উদাসীন রাস্তার আলো,
অসংখ্য কাঁপা কাঁপা ঢেউয়ে জ্বলে ওঠে নিয়নের ছাঁচ
নিঝুম পাড়ে বসে আরতির উৎসব মনে হয়,
বেজে ওঠে ঢাকের  পুরনো বোল
এমন সময় খুব নীচু হয়ে মাটির কাছে যেতে ভাল লাগে
পিঁপড়ের মত নিবিষ্ট চলাচলে মনে হয় মিশে যাই মানুষের ধড়াচুড়ো ফেলে
আমার নগণ্য শরীরের ওপর দিয়ে যখন বয়ে যায় উন্মত্ত হাওয়া,
ধূলোয় ঢেকে আড়াল করি জীবনেের অন্তহীন পাওয়া,
ঝড়ে যখন বিশ্বাসের সৌধ টলমল করে ওঠে, 
আমি পিঁপড়ের মত প্রেম দেওয়া নেওয়া করি মুহূর্তের অবসরে

Tuesday 24 October 2017

ইশকুল বাড়ি / শ্যামশ্রী রায় কর্মকার


এই এত বৃক্ষ এসে দাঁড়িয়েছে নরম বিহানে
পড়ন্ত ইশকুল বাড়ি, ভেঙে আসা বুকের পাঁজর
ওই যায় হেঁটে যায় ছেলেপিলে ছবির উঠোনে
ওরা কি সামান্য বলো? ওরা কেউ স্বপ্ন দেখেনা    
হারিয়ে যাচ্ছে সব স্মৃতিপথ, সোনালি অক্ষর
প্রতিদিন খসে যায় আরও এক আরও এক দিন
হঠাৎ টুকরো কিছু কণ্ঠস্বর হাওয়ার শরীরে
ভাঁজ ভেঙে ঝরে যায় মুছে আসা স্মৃতির ভিতর 
ওই দেখো ঝুরঝুরে গেট ধরে দোল খেলো পাখি
ওই দেখ কবেকার বেঞ্চিতে বসে আছে রোদ
দেওয়ালের দেহ জুড়ে পেন্সিলে শব্দের ভীড়
কারা যেন লিখেছিল? চাইলে কি খুঁজে পাওয়া যাবে?
এই এত বৃক্ষ  এসে দাঁড়িয়েছে নরম বিহানে
হাহাকার মেলে আছে ফলহীন সন্ততিহীন 
ক্ষুধার্ত পাখি এসে বারবার ফিরে চলে গেলো
এভাবেই একদিন পৃথিবী ফুরিয়ে যেতে পারে।

Monday 23 October 2017

যেভাবে জীবন / পরিচয় প্রধান

দ্যাখো, কি সুন্দর নরম আলোয় সেজেছে এই ভোরবেলা
আজ নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে
যত জমানো দুঃখ সব শুকনো পাতার মতো ঝ’রে যাবে আজ ।
কুয়াশার উড়না সরিয়ে ঐ দূরের পাহাড় উঁকি দিচ্ছে পেঁজা মেঘের আড়াল থেকে
ঝাপসা পাহাড়টা বোধয় মেঘ হ’য়ে উড়ে যাবে সাত সাগরের পারে
নাকি মেঘেরাই নেমে আসবে পাহাড়ের পাশে
বলবে, ‘এই যে এলাম, আর কোথাও যাব না’ ।
এসব কিছুই হয়তো হবেনা
তবে আজ কিছু না কিছু একটা হবে ।
নিরালা বারান্দার পাশে একটা ঝাঁকড়া জামরুল গাছ
সবুজ পাতায় হলুদ রোদ্দুর মাখিয়ে
আলোর আলপনা ছড়িয়ে দিচ্ছে নিরিবিলি পথে, এই বারান্দায়
কিছু তো একটা হবেই আজ
কিছু একটা হবে আর
সারা প্রাণময় ছড়িয়ে পড়বে আলোর আলপনা ।
ওপাশের দুটো পলাশ গাছেই উপচে পড়ছে হাজার ফুলের লাল টুকটুকে খুশি
কিছু একটা হবেই আজ ।
সরু পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে নেমে আসছে DTDC’র ডেলিভারি বয়
কি মিষ্টি চেহারা ছেলেটার, মাথায় পশমের টুপি, হাতে হলুদ রঙের খাম
খামের ভিতর একটা রঙধনু ভরা আছে
নাকি হাজার প্রজাপতি ?
আজ কিছু একটা তো হবেই হবে
কিছু একটা হবে, কিছু একটা হবে
জীবন তো এভাবেই ভাবে
যত দুঃখ সব একদিন টুপ টুপ করে ঝ’রে যাবে
শুকনো পাতার মতো । আলো মাখা আলপনা ছোঁবে
কিছু তো একটা হবে !


Wednesday 18 October 2017

নতুন বই, বইমেলা ২০১৮

বিটলসঃ বদলের তালে তালেঃ- শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
প্রকাশকঃ বোধিসত্ত্ব
মূল্যঃ ১৬০


রবীন্দ্রচর্চার রূপ রূপান্তর -  ডঃ নিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ বোধিসত্ত্ব
মূল্যঃ ২৫০


যেমন দেখেছিঃ নৌশাদ মল্লিক
প্রকাশকঃ বোধিসত্ত্ব


আমার গুরুদেবঃ স্বামী বিবেকানন্দ
প্রকাশকঃ বোধিসত্ত্ব


মোদীনামাঃ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ বোধিসত্ত্ব
মূল্যঃ ১৬০

বইমেলা ২০১৮ তে নতুন বইয়ের খবর (গল্প,কবিতা,উপন্যাস)

বেহিসেবি অর্কিডঃ পৃথ্বীদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ বাতায়ন
 মূল্যঃ ১৮০


বেঁচে থাকার গল্পঃ গল্প সংকলন
সম্পাদকঃ শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
প্রকাশকঃ বাতায়ন
মূল্যঃ ১৫০


বাঁধভাঙা রোদ্দুরঃ কবিতা সংকলন
প্রকাশকঃ বাতায়ন
মূল্যঃ ১২০


অন্ধকারের অন্তরালেঃ দীপিকা ঘোষ
উপন্যাস
প্রকাশকঃ বাতায়ন


বাছাই কবিতা ২ঃ কবিতা সংকলন
সম্পাদকঃ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ বাতায়ন
মূল্যঃ ১২০


তুমি প্রেমঃ ভাস্কর পাল
কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশকঃ বাতায়ন
মূল্যঃ ১০০


কুন্তলীনাঃ দীপশিখা ঘোষ ভৌমিক
প্রকাশকঃ বাতায়ন
মূল্যঃ ১০০

শূন্যতা ঢাকিঃ পার্থসারথি
কবিতা
প্রকাশকঃবাতায়ন
মূল্যঃ ৮০



অসহিষ্ণু সময়ঃ কবিতা সংকলন
সংকলকঃ প্রিয়ব্রত দত্ত
প্রকাশকঃ বাতায়ন


বল ভালোবাসিঃ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, মৌ ঘোষ
কবিতা
প্রকাশকঃ বাতায়ন
মূল্যঃ ১০০






Sunday 15 October 2017

Blowing in the Wind/ Bob Dylan অনুবাদ শ্যামশ্রী রায় কর্মকার






আর কত পথ পার হলে তবে
বুঝবে মানুষ বলে ?
বালুময় তটে ঘুমোয় কপোত
কত সাগর উড়ান দিলে?
আর কতবার আগুন বর্ষা
ঝরলে কামান জুড়োবে?
জবাব আছে এই নিঃশ্বাসে
ও বন্ধুগো, এই বাতাসে।

কতকাল বলো পাহাড় জীবন
সাগরে ডোবার আগে?
কতকাল বলো বন্দী জীবন
স্বাধীন হবার আগে?
আর কতবার ও মুখ ফেরাবে
যেন কিছু তুমি দেখোনি?
জবাব আছে এই নিঃশ্বাসে,
ও বন্ধুগো এই বাতাসে।

আর কতবার চাইলে আকাশে
আকাশকে খুঁজে পাবে?
কত শ্রবণ পেরোলে কাঁদন
তোমার হৃদয় ছোঁবে?
কত মৃত্যুর মূল্যে কিনেছ
অমূল্য এই জীবন?
জবাব আছে এই নিঃশ্বাসে,
ও বন্ধুগো,এই বাতাসে।

Saturday 14 October 2017

কালো সূর্য /কেকা সেন






বিকেলের পসরা সাজানো রাজপথ আর
সিগনালের হিসেব নিকেশ পার করে
ঝাঁকড়া চুলের তলায় জীর্ণ দুটি চোখ
চোখ রাখে সুদৃশ্য কাঁচের দেওয়ালে।
চোখ রাখে,চকোলেট আর ভেনিলার সম্ভারে।
ঠিক তখনি,মুঠোয় দলা পাকানো কাগজ -কারেন্সি চাবুক মারে তার ইচ্ছার দরজায়।
"মিয় আমরে" এর কাঁচে তখন বুকজোড়া গোধূলির মাখামাখি রূপ।
আরও একবার আগামী আকাশের ঠোঁট জুড়ে সূর্যটা কালো হয়ে পুড়ে যায়---
বরাবরের মতো ।

অধিকার/বিশ্বজিৎ মাইতি


বিশ্বাস নেই অলৌকিক আচারে-
আমার অস্তিত্ব উৎসব যা কিছু সবই গোলাঘর ছুঁয়ে।
আমি চাই না আকাশগঙ্গা স্বর্গীয় কল্পনায়-
চাই শুধু ধুলোমাখা রোদ জল শিশিরে
আমার আজন্ম অধিকার।
দুর্বা ঘাসের উপর শুয়ে থাকা ওই যে কাস্তেটা,
ওই আমার ইহকালের সুখ-
সারা উঠোন জুড়ে যত আলপনা সব তোমার থাক।

সুন্দর/সুতপা পূততুন্ড


দিন দিন আমার দুপুরগুলো
হয়ে উঠছে জলজ।
প্রতিদিনের ছায়াপথ, হারাচ্ছে ক্রমশ......
রোজকার নামচা থেকে বাদ
পরে যাচ্ছে সবুজ ধুলো।
তার পাশে পাশেই হাঁটছে
বিকেলের মনখারাপ গুলো.....
এমন সংকটে আমি ভাগ বসাতে চাই,
তোমার অফিস ফেরতা কিছুটা সময়।
সেই ইচ্ছের বীজে একটু একটু করে জল দিই,
তোমার নিকোটিনের সুগন্ধ
পাতো, উত্তাপ বিনিময়ের...
ধুলোর জীবন থেকে কিছুটা
অনিশ্চিত ধুয়ে মুছে যাক।
আমার অধিবাস তোমার
সুন্দরের দিকেই থাক.......


প্রাইভেট টক/ সম্পূর্ণা


বহুক্ষণ চেয়ে বসে আছি। এ কমাস কয়েকশো বার ওপর নীচ করেছি, বাহাত্তরটা সিঁড়ি,ঝকঝকে মুখস্থ। জুতোর তলায় লাগা ধৈর্য্যটা কয়েকবার ছিঁড়ে গেছিল পেরেক লাগিয়ে মেরামত করে নিয়েছি। খুব দৌড়াদৌড়ি করছি, যেখানেই যাচ্ছি পাশের টেবিল দেখিয়ে দিচ্ছে, বা পাঠিয়ে দিচ্ছে ওপর তলায়! আমার মতো আম আদমির জন্য লিফট নয়! অগত্যা...! চৌত্রিশের দাদা থেকে ছসাত বছরের দিদি, আন্দোলন, পরিবর্তন সব একই! দেয়ালের রঙ গুলোয় শুধু বদলের নতুন গন্ধ শুঁকে নেয়া।
বাবার পেনশন নিয়ে ছোটাছুটি। বড়দা আছে বেশ! গর্ভমেন্ট অফিসার, সত্যি অর্থে সোনার টুকরো ছেলে । প্রতি বছর পে-কমিশন আর বোনাসে বদলে যাচ্ছে ওর রোগা গিলগিলে চেহারাটা! তবু অসম্ভব সংযমী পকেট, নেই নেই লেগেই আছে। আর বাড়িতে বেকার ভাই থাকলে তো "আপনার আজকের দিনটি"তে সবসময়ই থাকবে খোঁচা, চিমটি আর হাহুতাশ! এইবার লোকটা তাকিয়েছে! আজ তিনমাস আসছি, এতোদিন পড়তে পারিনি চশমার পেছনে আড়াল করা ইচ্ছেটা। চকচক করছে চোখ,বোধহয় বলতে চাইছে, প্রাইভেট টক আছে!
কাজ শেষ, ফিরছি! ঝিমলিকে একটা ফোন করতে ইচ্ছে করছে। সেই ঝিমলি, যাকে দেখার জন্য রোজ দুপুরে ঠা ঠা রোদে ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেছি, বৃষ্টিতে ভিজে চুবচুবে হয়ে ওর কোচিংয়ের পাশের গলিতে অপেক্ষা করেছি! ওর একবার চাউনিতে লুকোনো ইচ্ছে গুলো রোজ একটু করে সেঁকে নিয়েছি! ওই কালভার্টটার সোঁদা সন্ধ্যে গুলোয় ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে বারবার বলেছি,'আমি শুধু তোমারই সোনা!' কতোবার বাবার মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে ওকে সিনেমা দেখিয়েছি! না, সততার বাতিক ছিল না কোনোদিনই! প্রেমিককে সৎ হলে চলে না, প্রেমিক মানেই ব্র্যান্ডেড মিথ্যেবাদী, অসৎ; সব চলে। ওটায় নরক দর্শন হয় না, শ্রীকৃষ্ণ থেকে জন লিলি একই কথা বলে গেছেন।
সবাই বলত পড়াশোনায় মাথাটা আমার বেশ ভালোই! ঝিমলিও হয়তো তাই ভেবেছিল! কিন্তু বরাবরই আমার গড়পরতা কিছুই ভালোলাগে না। দাদা খুব হিসেব করে চলত। কলেজে থাকতেই ছাত্র-রাজনীতি, ভোট, মিছিল, মিটিং, সাথে রঙবেরঙের স্বপ্ন বুনে দেয়া তরুণ পলিটিসিয়ান! তারপরে আখের গুছিয়ে কাট্টুস! আমার ওসব আসে না! তাই ঝিমলিকেও বোধহয় ঠিকঠাক স্বপ্ন দেখাতে পারিনি। বেকার বাউন্ডুলে প্রেমিকের থেকে, গান্ধীর হাসি ভরা নোট গোনা অফিসার অনেক দামি। প্রেমও হরেদরে সেই ডারউইনের থিওরি, "সার্ভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট "।এখন তাই ইংলিশ ফন্টে বাংলা ভালোবাসা ভরা মেসেজ গেছে কমে। হাড়হাভাতে ফোনটা তবু অপেক্ষায় থাকে। তবু আজো বুকপকেট ভরতি ঘামে ভেজা প্রাইভেট টক!
ভীষণ ঘুম পাচ্ছে! আজ ফিরেছি দেরিতে। খাবার গুছোনো ছিল টেবিলে, খেয়ে নিয়েছি। একবছর আগে পর্যন্ত মা বসে থাকত। তখনো পর্যন্ত বাড়ির কিছু নির্বিরোধ সমস্যা জানাত। হয়তো আশা ছিল কোথাও আমিও কালেকালে দাদা হয়ে উঠব। মশা ধূপ জ্বলছে, অভ্যস্ত মশা গুলো তাও বার করে নেবে জীবনের নির্যাসটা! কড়া ধোঁয়ায় দেখছি কিছু মুখ, ঝাপসা । ওরা কারা? মা বাবা দাদা ঝিমলির মতো লাগছে! দেখতে আলাদা, কিন্তু সেই চেনা গন্ধ একেক জনের! আমার হাতে অনেক গুলো মুখোশ! ছড়িয়ে পড়ে আছে মায়ের তেলচিটে আঁচলটা, বাবার পেন, দাদার গিটার , ওই তো ঝিমলির সেই বুকের কাছের লাল তিলটা! রোজ সূর্যাস্ত দেখতাম, ওটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! সেই পুরনো মিলটা,তেলকলটা ! বিকেলে পাড়ার মোড়ের ক্যারামবোর্ড! চারিদিক নিশ্চুপ! কথাগুলো, শব্দগুলো ফুরিয়ে গেছে! মাথার করিডোর অন্ধকার, মোমবাতিগুলো মিছিলে যাচ্ছে হেঁটে! বুকের কষ্টটা নিঃশ্বাসে চেপে বসছে। উফফ! স্বপ্নটাও বলছে, সব প্রাইভেট টক শেষ, শেষ, শেষ.....!

নাট্য কথা ------ প্রতীক মল্লিক






সকাল বেলা উঠেথেকেই দেখছি মুখ ভার। টিপ টিপ, টিপ টিপ তালে পৃথিবী ভবিষ্যতে যাত্রা করছে। প্রকৃতি একেবারে কুম্ভক মেরে আছে। এমনিতে আজকাল লেখা টেখা কেমন শিকেয় উঠে, বসে বসে ভ্যাংচাচ্ছে। এমন হয় মাঝে মাঝে। আমিও প্রতি-ভ্যাংচামি দিচ্ছি সুযোগ পেলেই। হয় ঘেঁটি কাথ করে কাগজে পেন্সিল ঘসা চলছে, বই নিয়ে পড়ার ভান হচ্ছে, নাহয় অন্যের প্রোফাইল দেখা হচ্ছে, কে কেমন মুখকরে ছবি তুলেছে, - আর কিছু নাহলে চিৎপাৎ হয়ে শবাসনে সরাসরি অবচেতনে। এমন কি আর আসবে যাবে ব্রহ্মান্ডে, পাশ ফিরি না ফিরি একটা কিছুও কি এদিক ওদিক হবে? মোটা সোটা বস্তুবাদে মনে তো হয়না তবু আজ গোটা দিনটা একটু অন্যরকম গেল, সেইটই একবার ভাগ করবো।

আমার এক দাদা সুজনদা, তার সাথে কথা হয়ে গেলো যে আজকে একটা নাটক দেখতে যাওয়া হবে। থেটার আরকি, অ্যাকাডেমি তে সন্ধ্যে 'টা। আমি তো এদিকে বিনাকাজে বেশ রকম ব্যাস্ত। তবু কথা দেওয়া আছে, সুজনদাও তার এক বন্ধুকে কথা দিয়ে রেখেছে। বেরিয়ে পড়লাম ছাতা মাথায় করে। এর পর রাস্তা, - প্রগতিশীল বঙ্গে বরাবরই বর্ষাকালের সময়তেই রাস্তার কাজ করাটা নিয়ম। কাজেই গলির পুরোটাই কাদায় - জলে পা ফেলবার মত জায়গা কোথাও নেই প্রায়। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নিজেকে মিঠুন মনে হয়। মনে হয় ব্যাকগ্রাউন্ডে কোথাও ডিস্কো ড্যান্সার বাজছে। এই করে করে গিয়ে .সি. যানে চড়িতেই দেখি অ্যাকাডেমি নিকটে। জায়গাটা পরিচিত, কিন্তু মানুষজন? জানিনা কেন মনে হয় কোন কোন চাহনি চিবিয়ে খাবো, গিলে নেবো এমন এমন নীতিবাক্য বলতে থাকে। নীল রঙা গান্ধীর কাগজ দিতে টিকিট পাওয়া গেল। নাটক কারু-বাসনা। আমি আবার কারুর থেকেও চারুর একটু বেশি। ইতি মধ্যে সুজনদার সেই বন্ধু বুবুনবাবু এসে পড়েছেন, দেখা হলো। আজ যে দলের পারফরমেন্স, উনি সেই দলের সামান্য পিছনের সারীর অভিনেতা, তেমনই বললেন। সবে সবে দলের সঙ্গে যুক্তো হয়েছেন। হাল্কা পসলা আলাপ চারিতার পর গেলাম হলের গেটের সামনে।

এখোনও হলের সদোর খোলা হয়নি। বাইরে গিজ গিজ বিজ বিজ করছে সকলের মাথা। কেউ কেউ নাটকের সরঞ্জাম আনা নেওয়া করছে ওই ভীড়ের মধ্যেই। আর কি সাজ পোষাকের ঘটারে বাবা। মহিলাদের কাউকে কাউকে দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গ টর্গ বেশি দুর নয়। পুরুষদের কারুর কারুর সাজ দেহ ছাড়িয়ে মস্তকে এসেছে। তবে দৃষ্টি বা আচরণে কাউকেই এলেবেলে ভাববার যো নেই। একজন জেঠু গোছের, ভীড়ে ভালো করে চলতেতো পাচ্ছেইনা লাঠিটাও কোথায় ফেলবে তা নিয়ে সংসয়ের ভাষা চোখে মুখে ফুটে উঠছে। ভীড় সামান্য পিছনে রেখে একটু ফাঁকা জায়গায় লাঠি ফেলতেই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। অমনি সংসয়ের চোখ মুখ পাল্টে অন্যরকম হয়ে গেল, মনে হল বেশ বড় মাপের কেউ হবেন হয়তো এবং সেই সম্ভ্রমের ভাবও আমার মধ্যে ফুটিয়ে তোলাটা আমার কর্তব্য। তারপর একজন একটা পেল্লাই কাঠের বাক্স নিয়ে আমার গায়ের কাছে এসে বলল 'সাইড প্লিজ' ইংরিজিতে সরতে তো পারিনা, আবার আমার পিছনে একজন ভদ্রলোক বুকে পেটে জগদ্দল পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, এক ইঞ্চি পিছনে যাওয়া যাবেনা। আবার ওনার পাশেই এক বিরাটকায় মহিলা, চুড়িদার পিসি দাঁড়িয়ে আমি কোনোরকমে পিসি সরকার হয়ে যতটা পারি অদৃশ্য হলাম।যিনি সাইড চেয়েছিলে তিনি চলে গেলেন। বুবুনবাবু এবার দেখালেন নাট্য জগতের একজন নামকরা ব্যক্তিত্বকে। হ্যাঁ, আমারও চেনা চেনা লাগলো বটে। টিভিতে দেখেছি কয়েকবার মনে হচ্ছে। অদ্ভূত, অবিকল মানুষের মতনই! সব হতে হতে দেখলাম একসময় দরজা খুলেছে। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল হয়ে আমরা সবাই মিলে এবার ভিতরে যাবো আর কারু-বাসনার সামনা সামনি হবো।

দরজার বাইরে লাইনটা বেঁকে গেছিল চোখে পড়েনি। আমি ভাবলাম বুঝি এভাবে ঢুকলেই হয়েযাবে। নামকরা অভিনেতার পাশাপাশি ঢুকলে কিছু নাহোক নিজের কাছে নিজেই একটু হোমড়া নাহয় চোমড়া হতুম। পথের পাশে হাঁটলে যদি পথিক হয় তবে নামের পাশে হাঁটলে সুনাম হবেই। তো জি কের ব্যাপার। কিন্তু লাইন গেল এগিয়ে , সবাই বেশ সভ্য সভ্য নিয়ম মাফিক, মাপা মাপা পা ফেলতে হবে - রেজিমেন্ট মার্চ করে এগোচ্ছে। লাইনের পিছনটা ধরে ভিতরে প্রবেশ করলাম।

ভিতরে আলো আঁধারী পরিবেশ, আঁধারটাই বেশি। সবাই বেশ টান টান হয়ে বসে আছে, যেন ডাক্তার খানা। অনেককে দেখলে আবার ভয় হয়।বড় বড় দাড়ি, ঝুঁটি, ম্যাগির মতন চুল, তায় আবার কতরকম নক্সা, ছেলেদেরও হেয়ারব্যান। সেই দেখেছিলাম মৌটুসি- মাথায়, ক্লাস ওয়ানে। আর কলেজে ওঠার পর থেকে দেখছি। ওসব মাথার সোসাল- ইকোনমি কন্ট্রোলার। ওসব মাথায় দিলে বুদ্ধি খোলে, ওজন বাড়ে। শুধু তাই নয়, মেকাপ করা মণি, ফুরফুরে গাল, ফরফরে অঙ্গভঙ্গি, আর কি ধারালো দৃষ্টি রে ভাই। এঁদের চেনা চেনা লাগে। এই ফেসবুকের দৌলতে, সমাজটা গ্যালিলিওর দূরবীন মতন হয়েছে। লগইন করলেই মনেহয় চাঁদে এসেছি। সবাই নয় তবে সংখাটা বেশির দিকেই। এঁরা পৌনে-ইন্টালেকচুয়াল, স্ব -এর চেতন এর চাইতে সচেতন, স্বাধীন এই শব্দ গুলো বেশি প্রোয়োগ করে, নিজেদের ফ্যান মন্ডলীর দলের বাইরে কারুর সঙ্গে কথা বলেনা, আর কিছুনা হলে দেওয়ালে দুম দুম করে স্ল্যাং ছাড়বে। কি ছোঁড়া কি ছুঁড়ি। ওটা ফ্যাশান , সহজ প্রচার আর আধুনিক হবার  ব্রহ্মাস্ত্র।

তা যা হোক এসব হতে হতে দেখি মঞ্চের দুদিকথেকে দুজন অভিনেতা প্রবেশ করলেন। মুখে সংলাপ দিচ্ছেন - "  স্বপ্ন নয় শান্তি নয়, ভালোবাসা নয়, / হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়"  তা হবে হয়তো, এতো খরচ-পাতি করে বলছেন যখন। আবার বলছেন - " সহজ লোকের মত কে চলিতে পারে! / কে থামিতে পারে এই আলোর আঁধারে / সহজ লোকের মত!......... স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, কোন এক বোধ কাজ করে / মাথার ভিতরে! " সে আপনার মাথা, আপনার - ''কার , অসম্ভব হবে কেন, হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে এই ঢপের বাজারে জীবনানন্দ! মানে প্রেসার নরমাল তো? তার পর সেখানে হেম বলে এক দুর্ভাগা কবি, কবিতা লেখে। দেখছি সে তার গিন্নীর সঙ্গে কথোপকথন কচ্চে। দু-আনা দামের দুধ কিনে কে খাবে এই নিয়ে চাপা দোনামনা, একে অপরকে খেতে বলছে। আমার কেমন ফিক করে হাসি পেয়ে গেল। দুশোটাকার টিকিট কেটে এসে আমরা দুআনার শোক দেখছি, ভাবাযায়। আসলে প্রদর্শন তো, কনসেপশনে কন্ট্রাস্ট ভালো যায় আরকি? ওই যেমন বাইরে যে আদুর গায়ে বসে আছে, তার ছবি গ্যালারিতে দেখছে সুট-টাই। মানুষটা মর্কট, তার ছবিটা মার্কেট। আর আর্ট ফিল্ডে মার মার কাট কাট। নাটক এগিয়ে চলে, মাঝে মাঝে বাংলার এক নামকরা কব্যকার বিজয় গোস্বামী ঢুকে পচ্ছেন, আর একটা একটা করে জীবনান্দ আওড়াচ্ছেন। আগাগোড়া ওনার ভূমিকাটা পরিস্কার হচ্চেনা, কেন অমন গ্যালোপিন লোকালের মত যাতায়ত কচ্চেন কে জানে। গোটা নাটকের বিষয়বস্তু এরকম, - হেম নামে এক কবি তার পরিবার। বড়লোক কাকা তার বাড়িতে এসেছে। কিন্তু হেম এখনও বেকার। তার অভাবের সংসার দেখে কাকু বিদ্রুপ করছে। কিন্তু হেম লুচির মত ফুলছেনা, গোটা ব্যাপারটাকে কাটিয়ে উঠে সে কালের গোলপোস্টে গোল করেছে। বলছে সচ্ছলতা না থাকলে তুমি বাবা যাই জানো যাই বোঝো না কেন ঠিকানা - বিসর্জনের গঙ্গা মাটি, আর ভাষাণের ব্যান্ড পাটি। কিন্তু অর্থ থাকলে সমাজ তো পোষ্য, মান সম্মান আগাছার মত গজিয়ে উঠবে, নারী হাতের পুতুল মনে হবে ইত্যাদি। তা কথা কিন্তু ভুলভাল হলেও যুক্তির ব্যাপারটা বেশ টনটনে। তোমার মানা না মানায় থোড়াই কিছু আসে যায়? তবে অভিনয়ে, উপস্থাপনায় বেশ একটা দুঃখ টুখ্য দেবার নিরলস চেষ্ঠা।তবে আমার মতো স্থূল অসামাজিককে কাবু করতে পারেনি। আমার পাশের লোকটির  ওপাশে এক মহিলা দেখি পিক মোমেন্টে হঠাৎ একটু নাকের মধ্যে ফ্যাঁচ করে আওয়া করলো, ভাবলুম জিজ্ঞেস করবো উনি পিঁয়াজ কেটে ভুলেগেছিলেন কিনা। সব শেষে সে দারিদ্রতা দেখেই হোক বা কাব্যের ফুলঝুরিতেই হোক কিম্বা অভিনেতাদের উদ্দেশ্যেই হোক হাত্তালির রোল উঠলো ভালোই।

বাইরে বেরিয়ে বুবুনবাবু প্রশ্ন করলেন - কিছু বুঝলে? আমি বললুম - হেম কি ডিওডোরেন্ট নাকি বেলজিয়াম গ্লাস?
-
কোনটিই নয়
-
যদি জীবনানন্দের ছদ্মনাম হয়, আর যদি তিনি কবিতা লিখে থাকেন প্রকৃত জীবনের আনন্দে, তা হলে বুঝিনি।
তারপর অনেককেই জিজ্ঞেস করেছেন যে তাঁরা বুঝেছেন কিনা। এমন এমন উত্তর তিনি পেয়েছেন বলে শুনলাম আমার আরও গুলিয়ে গেল। ডিমের ডেভিলকে সত্য ডেভিল মনে হল। যারা আয়না বেচলো জেনে বেচলো? দেখে বেচলো? যারা কিনলো তারা দেখে কিনলো? দেখলে কিনতোযারা কষ্ট পেল তারা বেশ রসিক। হেমেরা এসে প্রতিক্ষণে যেন বলবে - কিছু মনে করবেন না, একটু ইয়ার্কি মারলুম। জন্মেগেছি তো, আর কি বা করবো করবার মতন বিশেষ কিছু দেখছি না যে। এদিকে দিন দিন ইয়ার্কি মারবার জায়গাও তো বিস্তর বাড়ছে। তাই........