Wednesday 7 October 2020

অরণ্যা সরকার, গল্প , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,


 

গহন স্বপন সঞ্চারিণী

 

তুমি, আমি ও আমাদের কথামেঘ 

নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলে তুমি। আমি জানি তোমার এই ছেড়ে যাওয়ায় কোনো অনন্তের আহ্বান ছিল না। আমাকে অবশ্য কোন নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়নি। আমিই বারবার নতুন  হয়ে এসেছি। পুরোনোর শ্বাসের ভেতর শ্বাস ফেলেছি। স্থিতি আসেনি। একটা পাথুরে চলমানতা আমাকে বয়ে বেড়ায়। নাকি আমি তার ভার বয়ে বেড়াই বুঝি না। জানি তোমার আগুন আরও তীব্র ছিল।  লুকোনো আগুনবাইরে গান ছিল। কথা ছিল। রবি আর তোমার নন্দন কানন ছিল। তোমাদের  ছাদের বাগান। মর্তলোকের দৃষ্টি এড়ানো পথে ছিল স্পর্শ যাতায়াত ছিল সব অমোঘ ভোর।

আমার ভোরগুলো দখল করে থাকে নেশা জড়ানো ঘুম। সকালের বেল, জুঁই তোমার যত্ন পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হত। আমার শিথিল আঙুল আঁ কড়ে থাকে বম্বে ডাইং আরাম। শুধু ভোর নয়, সকাল, দুপুর রাত কোথাও তোমার ছিটেফোঁটা  নেই আমার মধ্যে। এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে যে সব শব্দ ব্যবহার করছি সেসবও কিন্তু আমার নয়। তবু তোমার সঙ্গেই কেন এত বকবক করছি সেটাও জানিনা। কারণ খুঁজতে বা অনুভূতির গায়ে যুক্তির বুলেট বিঁধিয়ে বিক্ষত করতেও  চাইছি নাতোমার চলে যাবার পর অনেক বদলের রিপোর্ট জমা পড়েছে যুগের ফাইলে। তবু নিজের ভেতর নিঃসাড় পড়ে থাকা অন্য এক আমি কী করে যেন জড়িয়ে গেছে তোমার সঙ্গে। তোমাকে কে প্রথম চিনিয়েছিল সে কথা  অন্য একদিন  বলবো। সে আর এক আমির গল্প।

এখন আমার ভেতর থমথমে ক্ষোভ, গনগনে আঁচ, চকচকে প্রেজেন্টেশান ও ঊপচে পড়া সুখের ক্লান্তি। তোমার কাছেই এই যে নিজের খিড়কি খুলে দাঁড়িয়েছি সে শুধু ইচ্ছে করে বলেই। এমনি এসে ভেসে যাবার এই ইচ্ছের গভীরে যা আছে তা কেমন ঘোলাটে  আর ঠাণ্ডা। তোমাদের নন্দনকাননের ধুলো হয়ে উড়েপুড়ে বেড়াই নিজেকে জুড়িয়ে নেব বলে।

এখন দুপুর। তোমার খাটে,  বিছানায় লেগে আছে নিঝুম কবিতা। তোমার রবির কবিতালেগে আছে অপমানের দাগ।  কষ্টের গুঁড়ো। একটা স্পর্শ উড়িয়ে দিচ্ছে সব কষ্টের অণুধুয়ে দিচ্ছে অপমান দাগ।  স্নিগ্ধতায় ফুটে উঠছে ঠাকুরবাড়ির শ্রীময়ী ঘর। আমার ঘর বেশ গম্ভীর। এখন আমি অফিসে। এসি চলছে। ইনডোর প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন মিশে যাচ্ছে বন্দী বাতাসে। করিডরে অ্যাকোয়ারিয়ামবানানো জলজগতে সাঁতরে চলেছে রঙিন মাছ। কেবিনে কেবিনে যন্ত্রমানব, যন্ত্রমানবীরা   সংখ্যা সৌরভে মশগুল। একটু খিটখিটে। তবে  আপাদমস্তক নিখুঁত পরিচর্যায় ঝকঝকে। তুমি কি ভাবছ এসব থেকে আমি ব্যাতিক্রমী কেউ ? একদমই তা নয়।

আমি কাদম্বরী সেন। রবীন্দ্রভক্ত বাবার দেওয়া নাম। জানিনা নামটা রাখার পেছনে বাবার কি ভাবনা ছিল। সেকেলে নামের  জন্য আমার বেশ ক্ষোভ ছিল।  তবে এখন বেশ ওজনদার মনে হয়। নামে পুরনো গন্ধ থাকলেও আমার  জিম ও স্যাঁলো  চর্চিত ঝকমকে  শরীর। স্পা করা লম্বা চুল। পছন্দের পোশাক জিন্স কুর্তি। দশ ঘণ্টা ল্যাপটপে চৌকশ আঙুল। সামনে ঝুলন্ত টার্গেট। আমার দৃষ্টিতে, শ্রুতিতে, কোথাও সমাহিত স্নিগ্ধতা নেই।

 

ছায়া নেমে এলে

দুপুরটা চলে যাচ্ছে। তুমি শব্দ পাচ্ছ ? আমি পাই।  আমার ধারালো দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে  তোমার ছবি প্রকট হচ্ছে।  তুমি এখন গা ধুতে যাচ্ছ। সেই প্রস্তুতির শব্দও আমি পাচ্ছি। সেই শব্দের উপর হামলে পড়ছে আমার সময়। চাপা পড়ে যাচ্ছে তোমার চুড়ির রিনিক ঝিনিক। তোমার শাড়ির খসখস।

মগজের কনফারেন্স শেষ। আজ শনিবার। সন্ধ্যে আটটা। বাড়ি ফিরছি। নন্দনকাননের দোলনা থেকে তুমি ফিরে গেছ অনেকক্ষণ। সন্ধ্যেপ্রদীপ নিভে গেছে। তোমার ভিজে শরীরের জলকণা যখন শুষে নিচ্ছিল বাতাস, যখন আকাশের দিকে  মুখ করে  তোমার তরলিত সুষমা ছড়াচ্ছিলে নরম সন্ধ্যেকে, তখন আমি অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে, শপিং করে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাম জ্যাবজেবে হয়ে একটা ঠাণ্ডা শাওয়ারের স্বপ্ন দেখছি। বুঝলে রবির ‘সরোবরময়ী’। আমার বুকের ভেতরও ঘাপ্টি মেরে থাকে একটু জলের টুকরো। একে সরোবর বলা যায় না। ওটা তোমার জন্য। তোমার রবির দেওয়া শব্দ। সে যাই হোক , শুধু তোমাকেই বলছি ওইটুকুই আমার ভিজে ওঠার গোপন। বাইরে আমি সবসময় নিজেকে পারফিউমে মুড়ে রাখি। সবসময় ক্যারি করি সুগন্ধ। আসলে নিজেকে লুকিয়ে রাখি সুগন্ধের ভেতর।

বাথটাবে নিজেকে ডুবিয়ে এখন আমি বেশ ফুরফুরে। আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে নিজেকে একটা পতঙ্গ মনে হল। খুব রূপসী, অহংকারী পতঙ্গ। আমার মাস্কারার কালো, আর আইশ্যাডোর নীল মিলেমিশে আকাশ তৈরি করলো। তারপর ছোট্ট    নীল পোশাকের চেন আটকাতেই আমি পাখি হয়ে গেলাম। সেই ছোট্ট নীল পাখি, যে গরমের ছুটির দিনগুলোতে ডালিম গাছে বসতো। না না আমি এখন কোন নীল পাখি বা ডালিম গাছের কথা মনে করতে চাইছিনা। বরং আমি নতুন কেনা পারফিউম মাখার জন্য উন্মুখ হতে চাইছি

পারফিউমটা স্প্রে করতেই আমি কেমন অদৃশ্য হয়ে গেলাম। তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ ? আমি কেমন ফুরিয়ে গেলাম দেখলে? এমনি করে আমি মাঝে মাঝে একেবারে ফুরিয়ে যাই। শুধু গন্ধটা থাকে। রূপক আসে। গন্ধে মাখামাখি হয়ে  কখনও আমি ওর সঙ্গে সেঁটে যাই। তারপর পার্টি, রেস্টুরেন্ট, নেশা আর ঘুমিয়ে পড়া। কতদিন যে ধীরে ধীরে ঘুমের মধ্যে নামিনি আমি ঘুমকে উপলব্ধি করিনি। আমার  ল্যাপটপের স্ক্রিনসেভারে নীল নীল ঢেউ আছড়ে পড়ে। ওরাও ঘুম জানেনা। কোথাও ঘুম নেই। ঘুমের মধ্যেও ঘুম নেইতরলে তরল নেই। শুধু ঘূর্ণন।  তাই নিয়ম ভাঙার ধুমধাম আছে। টলিয়ে  দেবার ও টালমাটাল থাকার হুল্লোড় আছে। 

আমি এখন সেই অন্ধকার আলোর মধ্যে শরীরী লটবহর বিছিয়ে রূপান্তরিত হবার চেষ্টা করছি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ না। আসলে আমি এখন একটা ডিস্কোতে। নব্বই ডেসিবেল শব্দের বিস্ফোরণ বুকে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি সেই সশব্দ ভাঙনের তালে তালে নেচে চলেছি। শরীরে শরীর জড়িয়ে সঙ্গ দিচ্ছে রূপক। আমরা এক দৃশ্যমান উষ্ণতার মধ্যে অদ্ভুত ভাবে শীতল   হচ্ছি। বরফদৃষ্টিতে  ভেসে উঠছে - নন্দন কানন থেকে মাদুর তাকিয়া ঘরে ফিরেছে। রুপোর রেকাবিতে রাখা ভিজে রুমাল শুকিয়েছে বহুক্ষণ। বেলফুলগুলো স্মৃতিদাগ রেখে চলে গেছে নক্ষত্রলোকে। সাদা চাদরে তুমি জেগে আছ। সন্ধ্যের তৈরি  হওয়া গান এসে শুয়েছে তোমার পাশে। তোমার  রবি ও কি জেগে থাকতো  তোমার মত ? তিনি কি তাঁর ধ্রুবতারার জন্য  নতুন করে দ্বিগুন হয়ে উঠতেন আগুনে আগুনে ?

 

মাধুকরী

রূপকেরও একরকম আগুন আছে। সেই গনগনে আঁচে নিজেকে সেঁকে নেওয়া যায়, তবে অলৌকিক আলোয় ভেসে থাকা   যায় না। আমি জানি অস্ফুট মুখরতা বলে আমার জগতে কিছু নেই। আমার মত টার্গেট তাড়িত মানুষের পাথরে পাথর ঘষে  শ্বাসরোধ করে বসে থাকাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও দ্বিধাগ্রস্ত ঋতুর চিবুকে মাঝে মাঝে  পথভোলা কোনো জোনাকি  এসে বসে। 

ব্যালনিতে বসেছিলাম। শহরের খোলস থেকে বেরিয়ে আসছিল অন্য এক শহর। রূপক এসে বসেছিল পাশে। মনে  হয়েছিল চরাচর ভরে উবে পূর্ণিমায়। আকাশে বড় চাঁদও ছিল। তবু পূর্ণিমা আসেনা। রূপক শুধু বলেছিল,  ‘আজ তোকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।’

কেমন অন্যরকম ?

সাম থিং ডিফারেন্ট। লাইক ফ্লাওয়ার, বাট নট  লাইক অ্যান  অর্কিড।’ 

আর প্রশ্ন করিনি। এটুকু বোঝে বলেই তো রূপক পাশে এসে বসতে পারে। আর আমি ও পাশে থাকলেও নিজের কাছে  থাকতে পারি। বাকিদের স্রোতে স্রোত রাখি শুধু। এই যে তুমি আমার মধ্যে বইছ এভাবে, তুমি তো সত্যিই স্রোতস্বিনী। তোমার মত আমিও প্রবাহই বহন করি। তবে আমার এই প্রবাহে ধারন বলে কিছু নেই। শুধুই বহন। যা কিছু রোজ ভাঙি  বানাই, তা শুধু বয়ে বেড়াই । দিন শেষে কিছুই জমেনা। ভেতরে গুমরে ওঠে ভিক্ষের ঝুলি। 

 

ছুটি ছুটি

আজ রবিবার। আমার ছুটির দিন। খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল।  অনেকদিন পর আজ সকাল দেখলাম। বসন্তের সকাল।  ব্যালকনিতে বসে থাকতে থাকতে মনে হল সকালের কোন ভূগোল থাকেনা। রোদ আর ব্যস্ততা হামলে পড়ার আগে যে  এমন  একটা  স্নিগ্ধ আহ্বান এসে রোজ  ডেকে ডেকে ফিরে যায়, ভাবতেই মনখারাপ হয়ে গেল। ঘর থেকে মার পুজোর   ফুল আর ধুপের গন্ধ ভেসে আসছে। ঘেন্নায় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে  নেওয়া , বিরক্তিতে সরে যাওয়া মুহূর্তরা সে সুগন্ধ মেখে ফিরে আসছে  আজ আর কোথাও যাবো না। আজ সারাদিন শুধু তুমি আর মা।  আচ্ছা তোমরা যে কি সব  পরপারের কথা বল, সে যদি থেকে থাকে তবে তো তুমি এখন সেই চির বসন্তের দেশের মানুষ। এবার বলো তো তোমার  রবি কি এখনও তার ‘সাধের সাধনার’ জন্য তেমনই একাগ্র ? যে অতৃপ্তি নিয়ে তুমি চলে গেলে সে কি এখনও আছে ? বাঁশির সুরের দূরত্বটুকু কি তোমরা অতিক্রম করেছ ? খুব আশ্চর্য লাগছে জানো, এই যে আমি তোমাকে যা যা বলছি, যেসব  শব্দে বলছি এসব নিয়ে কিন্তু আমি এখনও যথেষ্ট আমার ভাষায় খিল্লি করি।  অথচ দ্যাখ, কেমন স্বছন্দে তোমার সঙ্গে   বোকা বোকা বিষয় নিয়ে কথা বলছি। তবে কি --- না থাক, আর ছেঁড়াখোঁড়াও করতে ইচ্ছে করছে না এখন। বরং    তোমাকে সেই অন্য আমির গল্পটা বলি। 

আমার কলেজ জীবন শুরু ইলেভেন থেকে। দশটা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাস চলতো। কো এড কলেজ। ইচ্ছেমত ক্লাস কামাই-এর স্বাধীনতা, গাছতলার আড্ডা, সব মিলিয়ে বিস্ময় আর ঘোর। ছোট  থেকেই আমি খুব একটা হৈচৈ করতে    পারতাম না। শুনতাম আর ভরে উঠতাম। নির্ঝরও ছিল আমার মত। ওর চশমায় বন্দী চোখ, বাউন্ডুলে চুল, উদাস ভঙ্গি সবকিছুকেই ছুতে পারতাম আমি। অনেক বই পড়ত নির্ঝর। কবিতা ভালোবাসতো। আমাকে শোনাতো, ‘রাতের সব তারাই   থাকে দিনের আলোর গভীরে।’ বলতো ‘বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট, আর ফুসফুসভরা হাসি’র কথানির্ঝরই প্রথম    শুনিয়েছিল তোমার কথা রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠানের কথা। ও বলতো, তুমি নাকি কবির সৃষ্টির আত্মার বন্ধু ছিলে। তখন  তোমাকে জানার মত খুব বেশী উপাদান ছিল না আমাদের সামনে। তবু ও তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী জানতহয়ত  তোমার ঠাকুরপোর চেয়েও। ঠাকুরবাড়ির শিক্ষা, আদবকায়দা আর সবার উপেক্ষায় কুঁকড়ে থাকা তোমার যন্ত্রনাকে  চিনিয়েছিল নির্ঝর। কবির কবিতার প্রথম পাঠক ও সমালোচক ছিলে তুমি। অথচ কি স্নিগ্ধতায় মুড়িয়ে রাখতে তোমার সমস্ত শক্তি, সব আগুন। সেই প্রথম পূর্ণতার স্পর্শ পাই আমি। যত সময় পেরিয়েছে তোমার ভেতর আশ্রয় নিয়েছি আমি। যে সেই খোঁজ দিয়েছিল, সেই নির্ঝর কিন্তু হারিয়ে গেল জীবন থেকে। বাবার ইচ্ছেয় বড় চাকরীর জন্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল। প্রথমে কিছুদিন চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। বুঝতাম পড়াশোনাটা ওর কাছে খুব চাপের মনে হচ্ছে । তারপর দুজনেরই  নানা ঠিকানা বদল হল। আমরা হারিয়ে গেলাম। থেকে গেল ওর শোনানো কবিতা, ‘বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে...’    আমার একলা বিষাদ, একলা জাগা, একলা সকালের গল্পগুলো বড় হতে লাগলো। এই সফল জীবনে খুব জানতে ইচ্ছে করে ,ওর সেদিনের সেই দুঃখ বিহীন দুঃখগুলো কি এখনও আছে ? ভিড়ের ভেতর ওকে খুজি। খোঁজটা আড়াল করে রাখি আমার ঝকঝকে যাপন দিয়ে।

 

জমাতে জমাতে জমকালো পাথর

ওইটুকু ছাড়া আমার আর কোন ধার নেই। সামনে এগোনো কখন যেন অভ্যেস হয়ে গেছে। গতির স্রোতে ভেসে গেছে মুখচোরা মেয়েটা। জয়েন্টে আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি টেক পাস  করে   আমি এখন এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। এই পদে পৌঁছতে আমাকে কয়েকজন যোগ্যতা সম্পন্ন  ব্যক্তিকে টপকাতে হয়েছে। আর এই কাজ শুধু দক্ষতায় হয়নি। দেওয়া নেওয়ার শুরু সেই থেকেই। অ্যাম্বিশন নামের  জেদি   স্মার্ট শব্দকে কিছুতেই তাড়াতে পারিনি। আমাকে এক্সপ্লয়ে করেনি কেউআমিই  নিজেকে তুলে ধরেছি বসেদের দামী  একাকীত্বের কাছে। একের পর এক  বাধা ডিঙ্গিয়েছি। ক্রমশ জড়তা কেটেছে। নিজের থেকে শরীরকে আলাদা করেছি শানিত হয়েছে সৌন্দর্য। নেশা এসেছে। পুরুষ এসেছে। হাত পেতেছে। উভয়েই পূর্ণ হয়েছি। না, বিয়ে করবো না। গণ্ডী, খাঁচা এসব আমার জন্য নয়। দামী ফ্ল্যাটে মাকে নিয়ে থাকি। মা আছে বলে এখনও ঘরের গন্ধ পাই। এখনও কম কথা বলি, তবে শোনার কিছু পাই না। রো ওয়াইনের সঙ্গে গিলে ফেলি এক একটা অতিক্রমের গল্প।  

সন্ধ্যেটা থমথম করছে। দূরে কোথাও সন্ধ্যামণি ফুটেছে। ঝিঙ্গেমাচার হলুদ ফুলেরা সন্ধ্যাতারাকে পৃথিবীর গল্প পাঠাচ্ছে। চুল বেঁধে, গা ধুয়ে তুমি এসে দাঁড়িয়েছ ছাদে। পড়েছ ফলসা রঙের কালোপাড় শাড়ি। জমানো রক্তের মত ছোট্ট চুনির দুল  তোমার কানে। খোঁপায় দোলনচাঁপা। হোক না বসন্ত, তবুও দোলনচাঁপাই। আমি আমার সমস্ত আমিটুকু জড়ো করে বাড়িয়ে  দিচ্ছি। তুমি আমায় ছুঁয়ে থাক। আমার আলোয় পোড়া শরীরে তোমার প্রিয় সব অন্ধকার পুঁতে দাও। আজ চাই,    ভীষণভাবে চাই, তোমার হু হু ডাক আমায় নিংড়ে নিক। আমার ভালবাসতে না পারার যন্ত্রণা তীব্র হোক।  অন্তত দুএক  ফোটা সকাল পাক কাদম্বরী সেন। ভেতরের দিঘটা গভীর হোক। নির্ঝরের জন্য প্রতীক্ষা থাক অনিবার্য হয়ে। কিন্তু আমার  তো তোমার মত একাকীত্বের ঐশ্বর্য নেই। আমাদের একাকীত্বকে, কষ্টের গৌরবকে প্রতিমুহূর্তে  ঠুকরে খাচ্ছে  আমাদেরই আরোপিত স্মার্টনেস।  কি করে ফিরবে এযুগের কাদম্বরীরা ?  কতটা বিষ জমালে তবে নির্বাসন ?

সিলভিয়া প্লাথের কবিতা, অনুবাদ : অশোক কর , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


 

সিলভিয়া প্লাথের কবিতা
অনুবাদ : অশোক কর

সিলভিয়া প্লাথ আমেরিকার উত্তরাধুনিক সাহিত্যধারার বিশিষ্ট কবি, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। আধুনিক কাব্যপ্রতিভা ও পাঠকের প্রশংসাধন্য কবি হিসাবে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যধারায় নিজের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সিলভিয়া প্লাথ।  তীব্র হতাশা, উগ্র মানসিক বিকার ও আত্মধ্বংশী মনোবিকলন কবিতায় ব্যাবহার করে উত্তরাধুনিক "কনফেশনাল পোয়েট্রি" এর একজন বিতর্কিত প্রবক্তা কবি হিসাবে বিবেচিত হয়ে ওঠেন। সিলভিয়ার জন্ম ১৯৩২ সালে বোস্টনে, পড়াশুনা করেন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটে এবং ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে। তাঁর সহযোগী কবি 'টেড হিউস'কে বিবাহ করেন সিলভিয়া ১৯৫৬ সালে। দুই সন্তানের জন্মের পর পারিবারিক অশান্তির কারনে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয় ১৯৬২ সালে। ব্যাক্তিগত জীবনে সিলভিয়া প্লাথ মানসিক অবদমন রোগাগ্রস্ত ও চিকিৎসাধীনে ছিলেন। কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টায় ব্যর্থ হবার পর ১৯৬৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৩০ বছর বয়সে মারা যান আত্মহত্যার মাধ্যমে। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত "কবিতাসমগ্র"এর জন্য আমেরিকার 'পুলিৎজার' পুরস্কার পান সিলভিয়া প্লাথ।

[১] Death & Co.
ডেথ এন্ড কোঃ


দু'জন, নিঃসন্দেহে ওরা দু'জনই।
এখন খুবই স্বাভাবিক বলেই মনে হয় -
একজন, যে চোখ তুলে তাকায়নি কখনো, যার চোখগুলো ঢাকা
আর বিস্ফারিত, ব্লাকি' এর মতো,
তার লোকদেখানো

জন্মদাগ, সেগুলোই তার ট্রেডমার্ক
ছেঁকা, ফোস্কাফাটা জরুল
আব্রুহীন
শকুন গ্রীবা'র তামাটে চামড়ার দলা।
আমি সেই কুৎসিত মাংসপিন্ড। ওর চঞ্চুদুটো

আড়াআড়ি শব্দ করে নড়ে: এখনো ওর হয়ে উঠতে পারিনি আমি।
ও বলে, কি যাচ্ছেতাই ফটোগ্রাফ আমি তুলি।
আমাকে বলে ও, কী মিষ্টি
দেখতে লাগে বাচ্চাদের হাসপাতালের ঐ
বরফ-বাক্সে, একেবারে সাদাসিধে

জামার গলার ঝালর,
তারপর ভাজে ভাজ কুঁচি দিয়ে বানানো
আয়োনিয়ান ডেথ-গাউন,
সবশেষে ছোট্ট দু'টি পা।
ও হাসেও না, ধুমপানও করে না।

অন্যজন কিন্তু এ সবকিছুই করে,
তার লম্বা চুল আর আপাতঃদৃষ্টসঙ্গত
জোড়াগোঁফ
আবেগমৈথুণে ব্যস্ত,
সে প্রেমাস্পদ হতে চায়।

আমি এসবে মাতি না।
তুষারকণা ফুল হয়ে ফোটে,
শিশিরবিন্দু তারা হয়ে জ্বলে,
মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি বাজে,
মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি বাজে।

কারো সব হয়ে গেছে সারা।


[২] Edge
কিনারা


মহিলা পরিপূর্ণ হলেন।
তাঁর মৃত
দেহ অভীষ্টপূরণের সকল সৌরভ মেখে সুরভিত,
কি এক গ্রীক অপরিহার্যতার বিভ্রম

শাস্ত্রপাঠের পুঁথির মোড়ানো পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় যাচ্ছে ছড়িয়ে,
তাঁর নগ্ন
পদযুগল এখনি হয়তো বলে উঠবে:
তোমরা বড় বেশি চলে এসেছো, পরিসমাপ্তি এখানেই।

প্রতিটা মৃতশিশু একেকটা শুভ্র সরীসৃপ, কুণ্ডলী পাকানো,
প্রত্যেকে তারা ছোট্ট এক

দুধপাত্রের পাশে শুয়ে, এখন সেগুলো শূন্য পরিত্যক্ত।
সুন্দর গুছিয়ে নিয়ে তিনি

সারাদেহে ওদেরকে সাজিয়েছেন অস্ফুট গোলাপ
পাপড়ির আদলে, যখন ফুলবাগানে

স্নিগ্ধ রজনীস্ফুট ফুলদের
আড়ষ্ট, গভীর কন্ঠনালী চিরে রক্তগন্ধ ছড়ায়।

চাঁদের কিন্তু তাতে মনোকষ্ট পাবার মতো কিছু নেই
হড়ের অবগুন্ঠনে চন্দ্রালোক ছড়িয়ে

কৃষ্ণপক্ষে রাতে নিজেকে খটমট টেনে-হিঁচড়ে চলে
এমন কাজ সচরাচর করতে অভ্যস্ত চাঁদ


[৩] Kindness
ঔদার্য


ঔদার্য ভেসে বেড়াচ্ছেন আমার ঘরজুড়ে।
দেবী ঔদার্য, কি মহিমান্বিতা তিনি!
তাঁর নীল লাল আঙ্গুরীয় রত্নের ধুম্রজাল
উড়ছে জানালায়, আয়নাগুলোর
প্রতিবিম্ব জুড়ে শুধু তাঁরই স্মিতহাস্যমুখ।

শিশুর কান্নার চেয়ে গূঢ় বাস্তবিক কি হতে পারে?
শশকের কান্না বস্তুতঃ বড্ড আরণ্যক
তাতে আত্মার ক্রন্দন নেই।
শর্করা আরোগ্য দিতে পারে সবকিছুর, তাই ঔদার্যদেবী বলেন,
শর্করা অতীব এক জরুরী পানীয়,

শর্করা দানারা কিছুটা ঔষধি প্রলেপ,
ও ঔদার্য, ঔদার্য
কি মাধুর্যে তুলে নিচ্ছ স্পর্শযোগ্য সবকিছু,
আমার জাপানি সিল্কে, উন্মত্ত প্রজাপতিদের
গেঁথে রাখা হবে যে কোন মুহূর্তে, বেদনা-আসাড় ঔষধ সহযোগে।


[৪] Child
সন্তান


তোমার স্বচ্ছ চোখ কি অবিসংবাদিত সৌন্দর্যমুখর
তাঁকে আমি সাজাতে চাই রঙে আর চাদরে
নতুনের চিড়িয়াখানা

অন্তরজুড়ে কাকে সমর্পণ করো তুমি-
এপ্রিলের তুষারকণা, আদিবাসীর বাঁশি,
ছোট্ট

ছিঁড়ে না তোলা ফুলবৃন্ত,
যে স্বচ্ছ পুস্করনীর জলে প্রতিবিম্বরা
হয়ে ওঠে  অনুপম, ধ্রুপদী মায়াবী

না, এই প্ররোচনাময়
হাতের সঞ্চালন নয়, এই গাঢ়
ছাদের নিচের নক্ষত্রহীন অন্ধকারও নয়।

Tuesday 6 October 2020

চন্দন বাসুলী , কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 

 

দুঃখবীজ


আমার জন্ম মুহূর্তে 
যে দুঃখবীজ রোপণ হয়েছিল
শৈশবে তারা বৃক্ষ

যৌবন পরিপূর্ণ 
বেশুমার কষ্ট-ফুল
আর কৃষ্ণবর্ণ যন্ত্রণা-ফলে 

বার্ধক্যে খসে যাবে
সকল অভিজ্ঞ পাতারা 
হরিদ্রাভ শরীরী ভাঁজ নিয়ে 

হয়তো সেদিনই খুঁজে পাব 
আঁতুড় ঘর থেকে পিস-হ্যাভেনে 
যাওয়ার একমাত্র ঠিকানা 

যার নাম শ্মশান অথবা মৃত্যুর পরের স্টেশন!

সমরেশ মণ্ডল , কবিতা ,সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


কলসি কথা



বেলা যায়। নিত্যদিনের সেবক এসে 
রোদ ধরে রাখে কলসিতে।

জীবিত জ্বলন্ত নারীরা এখন আকাশ থেকে 
নামে সরাসরি নদীপাড়ে।

চারপাশের গাছপালা বিপ্লবীর মত বন্দুকের
নিশানা  আড়াল করে দাঁড়ায়

এই যে ভালো থাকার জন্য কত আয়োজন অবশেষে থাকাও যায়না ভালো

অথচ রোজ রোজ মিহি মোটা বিপুল উন্মাদনা,
বেলা যায়,তেষ্টা পায় না ;জল পড়ে থাকে কলসিতেই।
 
 ভাস্কর্যে রামকুমার মান্না

প্রসঙ্গঃ বিদ্যাসাগর, কানাইলাল জানা , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

 


প্রসঙ্গঃ বিদ্যাসাগর

 

তাঁর জন্মের দুশ বছর পর,জন্ম মাসের শেষ দিনে কিছু কথা।  বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে মিথ থাকবেই। দুটির কথা বলব , সঙ্গে আরো কিছু প্রসঙ্গ। 

(১) যখন আমি ছাত্র, কলকাতা সহ ভিন্ জেলার মানুষজনকে বহুবার বলতে শুনেছিঃ
লেখাপড়ায় তো ভাল হবেই কারণ  তোমরা যে বিদ্যাসাগরের জেলার লোক। ' বিস্মিত হয়েছি কিন্তু উত্তর দিইনি। 1828 সালে আট বছর বয়সে ঈশ্বর চন্দ্র যখন কলিকাতা পাড়ি দেন তখন বীরসিংহ গ্রাম তথা ঘাটাল হুগলি জেলায়। 1872 সালের জুন মাসে ঘাটাল ও চন্দ্রকোণা থানা যখন মেদিনীপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত হয় ,বর্ণপরিচয় প্রকাশ ও অন্যান্য যুগান্তকারী সংষ্কার ততদিনে বিদ্যাসাগর সেরে ফেলেছেন যার সুফল যে কোনো বাঙালি পেতে পারে। আমাদের জেলা পূর্ব মেদিনীপুর যে শিক্ষার শীর্ষে আছে্‌ , মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোলে বোঝা যায়।তার কারণ  এই জেলার ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান। শিল্প নেই,  যেটুকু আছে হলদিয়ায়, তার সুযোগ সুবিধা এই জেলার মানুষ পেয়েছে অতি অল্প। বরং এই জেলার ছেলেমেয়েদের দুবেলা পড়তে বসার অভ্যেস আছে, তার ওপর আছে শিক্ষক ও অভিভাবকদের দায় দায়িত্ব যা এখন হয়ে গেছে পরম্পরা। ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী এই  জেলায় বিরাজ করে এক শান্ত পরিবেশ ( স্বাধীনতা সংগ্রামের  কাল বাদে) যা লেখা পড়ার ক্ষেত্রে  খুবই উপযোগী। 

(২) বিদ্যাসাগরের দামোদর নদ সাঁতরে পার হওয়াঃ
দামোদর নদ কিন্তু যে কোনো নদীর থেকে আলাদা। বয়স্ক অজগর যখন একটি ছাগল গিলে  হজম হতে না হতে আবার একটি  বাছুর গিলে ফেললে যেমন সরু মোটা হয় তার দেহ, তেমনি দামোদর সারা পথ সরু প্রশস্ত সরু প্রশস্ত আবার সরু আবার প্রশস্ত এভাবে তার দেহ সৌষ্ঠব। 
 ফোর্ট উইলিয়াম অধ্যক্ষ জন মার্শালের কাছে ছুটি মঞ্জুর হতে দুপুর। ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে কেনা ধুতিশাড়ি কিছু টাকা পয়সা ও দ্রব্য সামগ্রী মিলে ব্যাগটি নেহাত খুব ছোটো নয়, কানা দামোদর পার হয়ে যখন চাঁপা ডাঙায় হাজির হন ঘোর বর্ষায় উত্তাল দামোদরে নৌকো চলাচল বন্ধ। এখানে নদী বেশ সরু বলে স্রোত বেশি। পদাতিক ঈশ্বর চন্দ্র দক্ষ সাঁতারু কিন্তু ব্যাগপত্র নিয়ে ভয়াল নদ পার হওয়া অসম্ভব। আরামবাগ হয়ে বাড়ি পৌঁছোতে মাঝরাত। সম্ভবত মাতৃভক্তির মহিমা প্রচার করতে বিদ্যাসাগর জীবনীকার চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বর পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের কথা শুনে লিখেছেন। তাঁর থেকে অনেকে। 
এই দুটো বিষয় বাদ দিলে কিসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও মুগ্ধতা, ঋণ? একে একে বলি দুই পর্বে। 
(ক)  মনীষীদের মধ্যে বিদ্যাসাগরই একমাত্র প্রান্তিক মানুষ কলকাতায় এসে প্রথমে বড়বাজারে রাইমণির স্নেহ পরে জানবাজারের রাসমণির আজীবন (মৃত্যু 1861)  সাহচর্য পেয়েছিলেন, যা তিনি কোনোদিন  ভোলেননি। এদিকে সৎসঙ্গ না পেয়ে পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের কী হাল হল? বীরসিংহ গ্রামে  ঠাকুরদার লাগামহীন শাসনে থেকে বেয়াড়া বন্ধুদের সঙ্গে   মিশে জীবনকে এমনই বিপদজনক  করে তুললেন যে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করে ছাড়লেন বিদ্যাসাগর। সম্পত্তির ভাগ পর্যন্ত দেন নি। নিজের কাছে রাখলে তা একেবারেই হত না: (২) ঈশ্বর চন্দ্র যে হিন্দু কলেজে ভর্তি হতে পারেননি ( তাঁর বাবার মাসিক আয় যেখানে ১০ টাকা,হিন্দু কলেজের মাসিক বেতন ৫ টাকা) সেটা হয়তো আমাদের জন্য সৌভাগ্য কারণ ডিরোজিয়ান হালচাল সামলে বিদ্যাসাগরের এতোটা মৌলিক থাকাটা ছিল বেশ কঠিন। 
(৩) বোধোদয় -এ তাঁর ঈশ্বর ভাবনাঃ বিশ্বব্রহ্মান্ডের সব বস্তুই পদার্্‌  যা তিন রকম -চেতন, অচেতন -উদ্ভিদ। ঈশ্বরের জন্ম চেতনায়,তাঁকে কেউ দেখতে   পায় না। অসাধারণ এই বিশ্লেষণ অন্তত আমার কাছে। 
(৪)ছাপাখানা  স্থাপনঃ বটতলার কুরুচিপূর্ণ বইর ঠেক ছিল  চিনাবাজারে।কিন্তু বিদ্যাসাগর বুঝলেন ,কলেজ  স্ট্রিটই হবে আগামী দিনের প্রকৃত বইবাজার। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার কে সঙ্গে নিয়ে কলেজ স্ট্রিটে খুললেন ছাপাখানা সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটর  সেই ১৮৪৭ সালেই। 

(৫) তেলা মাথায় তেল না দেওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণঃ ১৮৬৬ সালে  নিজের গ্রামে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে অন্নসত্র খোলার পর দেখা গেল যারা  খেতে বসেছে তাদের মধ্যে অনেক দুঃখী মেয়ের মাথার 
চুল উস্কো খুস্ক্‌ তেল নেই বলে। 
তিনি মাথায় মাখার তেল দিলেন। ছোঁয়াচ এড়িয়ে তেল দেওয়া হচ্ছে  দেখে নিজেই কারু কারু মাথায় মাখিয়ে দিলেন। 
(৬) যুক্তি যুদ্ধের সেরা সৈনিকঃ দেশে দেশে মুক্তি যুদ্ধ হয় কিন্তু বিদ্যাসাগরের শক্তি ক্ষয় হয়েছে অনবরত যুক্তি- যুদ্ধে যুক্ত থেকে। শুধু তো রাধাকান্ত দেব ও তাঁর দলবল নয়, বংকিমচন্দ্র -ঈশ্বর  
গুপ্ত- হরপ্রসাদ  শাস্ত্রী-ভূদেব মুখোপাধ্যায় -রমেশ চন্দ্র দত্ত- কৃষ্ণ কমল ভট্টাচার্য এবং কে নন ,যিনি বিদ্যাসগরকে আক্রমন করেন নি? 

 
 
এবার শেষ পর্ব। 
 

(১) মহাত্মা গান্ধীর জীবনে বিদ্যাসাগরের প্রভাবঃ
বিশ বছরের বেশি ( ১৮৯৩-১৯১৫) দক্ষিণ   আফ্রিকায় কাটিয়েছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। শেষ দুবছর প্রবাসী ভারতীয়দের অধিকার অর্জনে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে যখন শ্বেতাঙ্গ সরকার   ঘোষণা করল ইন্ডিয়ান রিলিফ আইন- ১৮১৪। 
১৯১৫ সালে দেশে ফেরার পথে জাহাজে বসে কতকিছু ভেবেও ঠিক করতে পারলেননা পরবর্তী কর্মসূচি। বোম্বাইতে নেমেই ছুটলেন গুরু গোপাল কৃষ্ণ গোখলের কাছে। (গোপাল কৃষ্ণ মহামতি ,তাই বলে তিনি কখনোই বলেননিঃ What Bengal thinks to-day India thinks to-morrow.  তিনি বলেছিলেনঃ What educated Indians think to-day, the rest of Indians to-morrow.  ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ আন্দাজ করলেন বাঙালিদের মতো শিক্ষিত আর কারা? তিনিই প্রচার শুরু করে দিলেন ,যেটা সব বাঙালি বলে তৃপ্তি পান আজও। 
গুরু শিষ্যকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য বললেনঃ মোহন তুমি বিয়ে করলে বড্ড কম বয়সে (১৩) । তাও স্ত্রী তোমার থেকে বড়ো, আইন ব্যবসায় ব্যর্থ, হাতের অক্ষরও বেশ খারাপ। শারীরিক ভাবেও দুর্বল। এদিকে দেখ বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা রাজপত রাই, ,সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিরা এগিয়ে রয়েছেন কতো বিপুল বিক্রম ও তেজ নিয়ে। এঁদের ওপরে যদি যেতে চাও তবে নতুন  কিছু পথ উদ্ভাবন করতে হবে নিজেকেই। ঐ বছরই মৃত্যু হয় গুরুর । 
নাটাল  প্রদেশ ও অন্যত্র যে করমচাঁদ গান্ধী কোট প্যান্ট পরতেন, মনে পড়ে গেল ১০ বছর আগে তাঁর বাংলার বিদ্যাসাগরের ওপর লেখা প্রবন্ধের কথা,   যেখানে তিনি সোৎসাহে উল্লেখ করেছেন  খাদির ধুতি চাদর পায়ে চটি মাথায় টিকি বিদ্যাসাগরের সরল জীবন যাপনের কথা।  পেয়ে গেলেন তিনি আগামী দিনে কী পোষাক হবে তার পরিষ্কার আভাষ।
: (২) তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য রকমের পদাতিকঃ 
তখনো তৈরি হয়নি ৬নং জাতীয় সড়ক। বীরসিংহ গ্রাম থেকে ঘাটাল ও আরামবাগ হয়ে হেঁটে কলকাতায় যাতায়াত তাঁর কাছে ছিল এক অনায়াসসাধ্য ব্যাপার। কলকাতা থেকে অম্বিকাকালনা,যাদবপুর, হাওড়া ২৪ পরগণা এবং আরো কতো জায়গায় হেঁটেই যেতেন অধ্যাপকের খোঁজে ও অন্য কাজে। মা ভগবতী দেবী কাশীতে মারা গেলে ( ১৮৭১) উপস্থিত থাকতে পারেননি,   তাই পরবর্তী এক বছর খালি পায়ে হেঁটে হেঁটেই সারা কলিকাতা   কাজকর্ম সারতেন। 
(৩) তাঁর হিন্দি শেখাঃ 
এতো ব্যস্ততার মাঝেও হিন্দি শিক্ষক রেখে হিন্দি ভাষা জানা ও আয়ত্ব করাও এক মূল্যবান বিষয় ।  না হলে কিন্তু এভাবে হিন্দি থেকে অনুবাদ করা যায় না 'বেতাল পঞ্চবিংশতি।  যদিও রেভারেন্ড কৃষ্ণমেোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে  আবার কিছু সংশোধন করার পর তা পাঠ্য পুস্তকের মর্যাদা পায়। 
(৪) অপরিমেয় তাঁর সহ্যশক্তিঃ
বিধবাবিবাহ প্রচলনে খুশি হয়ে শান্তিপুরের তাঁতিরা শাড়ি বুনলেনঃ'বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে '। তখন কলিকাতার  কবিকুল পাল্টা দিলেনঃ 'শুয়ে থাক্ বিদ্যাসাগর চিররুগি হয়ে। ' বিদ্যাসাগর কিন্তু কাউকেই আক্রমণ করেননি শুধু চেয়ে চেয়ে  দেখলেন। 
(৫) তাঁর ব্যর্থতা ও আক্ষেপঃ
বহুবিবাহ ও গৌরীদান (বাল্যবিবাহ) রদ করতে কতো পরিকল্পনা ও শ্রম উজাড় করে দিয়েছেন কিন্তু  আইন যে তিনি চালু করতে পারেননি তার জন্য শুধু বিরোধীরা দায়ী নন । সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংল্যান্ডের রানি নিজ হাতে শাসন ব্যবস্থা নিয়ে নিলে কোম্পানির লোকজন কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের চাকরি বাঁচাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদেশের আচার বিচার নিয়ে আর ভাবিত নন। এ দুঃখ বিদ্যাসাগরের থেকেই গেল আমৃত্যু। 
(৬) শেষ জীবন কর্মাটাঁড়ে বসবাসঃ
বর্ণপরিচয় প্রকাশ যদি বাঙালি জাতির জন্য তাঁর শ্রেষ্ঠ নির্মাণ হয় তবে কর্মাটাঁড়ে শেষ জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর সঠিক ও মৌলিক নির্বাচন। এখন দেখে নেওয়া যাক্ কেন মৌলিক। 
গ্রামে তিনি শেষ ১৯ বছর যাননি, সম্পত্তি ও প্রেস নিয়ে ভাইদের সঙ্গে কোর্ট কাচারি, ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা, মার ওপর অভিমান । যখন স্ত্রী দীনময়ী  স্লেট খড়ি নিয়ে বসলেন শিক্ষারম্ভ করবেন বলে, ভগবতী দেবী বেঁকে বসলেনঃ 'তাহলে সংসারে আমি একাই শুধু খেটে মরি '।  স্ত্রী দীনময়ী-র সঙ্গেও দূরত্ব রচনা হল যখন ত্যাজ্যপুত্র নারায়ণ চন্দ্র নিজেই মত দিলেন যে বিধবাবিবাহে তিনি রাজি। বিধবাবিবাহ চালু নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও বিরোধ। ভাই শম্ভুচন্দ্রের মেয়ের বিয়েতে হঠাৎ পাত্রের বাবা বেঁকে বসলেনঃ 'এই বিয়েতে সম্মতি নেই কারণ আপনার দাদাতো বিধবাদের বিয়ে দেন।' শম্ভুচন্দ্র বিয়ে সারলেন মিথ্যে বলে যে ' দাদার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। '
কলিকাতায় এলিট-সমাজ তো তির ছুড়েই চলেছেন। এমনকি মাইকেল মধূসূদনের ব্যবহারেও আহত হলেন। মাইকেল মধুসূদন ফ্রান্স থেকে ফিরে যাতে ভালোভাবে থাকতে পারেন , তার জন্য তিন তলা বাড়ি ভাড়া করেন। ঠিক ভাবে যাতে ব্যারিস্টারি করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে দশ হাজার টাকা ধার করেন।  বিদ্যাসাগর একবার  খামের ওপর  বাবু মধুসূদন দত্ত লিখে তাঁকে চিঠি পাঠান। । এই অপরাধে মধুসূদন চিঠি ফেরত পাঠালেন প্রেরকের হাতে। 
৬০ টি বিধবাবিবাহ দিতে ধার হল আশি হাজার টাকার বেশি। বর সেজে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে  টাকাপয়সা হাতিয়ে কতজন যে কতভাবে হেনস্তা করলো বিবাহিত  বিধবাদের! তাতে খুবই মর্মাহত ও বিপর্যস্ত  হলেন তিনি। উপলব্ধি, করলেন  গ্রামে কিংবা কলকাতায়  নিজের বলে কেউ পাশে নেই। 
এমন অবস্তায় শেষ দুদশক তিনি সাঁওতাল পরগণার কর্মাটাঁড়ে জমি ও বাড়ি কিনে 'নন্দনকানন 'এ বেশ ছিলেন। আমার ব্রহ্মপুরের বাড়ির পেছনে ইট ভাটার মালিক কিছু সাঁওতাল এনেছিলেন এক সময়। এখনো বয়স্ক সাঁওতালদের সরলতা দেখে  অবাক হই, তাহলে দেড়শ বছর আগে সাঁওতাল পরগণার সাঁওতাল ও অন্যান্য জনজাতি যে সরল জীবন যাপন করতো তা ধ্রুব সত্য। বিদ্যাসাগর তাদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে, কলেরার চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রূষা করে বাঁচিয়ে, নিজ হাতে গড়া আম বাগানের আম ও নানা ফল খাইয়ে ও বিতরণ করে দেহ মনে স্নেহের হাত বুলিয়ে তিনি যে তাদের নিজের লোক হয়ে বাঁচলেন তা ভাবতেও ভালো লাগে।