Monday 5 October 2020

হিন্দোল ভট্টাচার্য, চারটি কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 

 


 

চারটি কবিতা 

 

 

 প্রহরী

 

যেন বা শিকারী তার সমস্ত কৌশল ভুলে গেছে 

 

কত টান মারলে তবে ছিলা থেকে হিংসা ছুটে যায়...

 

 

অথচ শিকারী তার শিকারের মুখোমুখি আজ 

 

ব্যবধান সামান্যই, শুভদৃষ্টি হয়েছে চোখের 

 

দুজনেই সম্মোহিত, জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি 

 

সরু একটি আলপথের বেশি কিছু নেই ধৃতিরূপা...

 

কেউ কারও চোখ থেকে কখনওই লক্ষ্য সরাবে না 

 

দুপাশে শহর, গ্রাম,  হাইরোড, লাপিস লাজুলি 

 

যতই আসুক, তারা কোথাও যাবে না কোনওদিন 

 

 মৃত্যু যত বনলতা সেন তত তুমি কি আমার?

 

 

 

পুরোহিত

 

আমিও তো দুশ্চরিত্র,  কাকে বলি ওয়দিপাউস? 

 

যেদিকে রয়েছে ঢাল জল যায় সেদিকেই ঠিক

 

পাপ থাকে প্রেমে যদি তবে সেও পুণ্যবান হয় 

 

গভীর জলের মাছ হাবুডুবু খায় না কখনও...

 

প্রকৃত পাপের জন্য কত জন্ম আসে আর যায় 

 

নাড়ি কেটে দিলে তবে শিশুও ভূমিষ্ঠ হতে পারে 

 

কোন ফুলে কার মধু শ্রীমৌচাক কত আন্তরিক 

 

কিছুই বোঝে না কেউ, আমরা তো শুধু মধু খাই 

 

আমিও তো দুশ্চরিত্র, কাকে বলি বাইজেন্টিয়াম? 

 

প্রকৃত পাপের কাছে পুণ্যবান উপাসনা করে

 

 

গাথা

 

আমাদের মাঝখানে ভেঙে পড়ে গেছে সব পুরনো খিলান 

 

বাহারি শৌখিন জানলা, দেওয়ালের চিত্রিত কথন 

 

এখন ধ্বংসস্তূপে তুমি কার মানচিত্র খোঁজ?

 

রক্তের যে কোনও দাগ কিছু কিছু গল্প বলে জানি; 

 

সেসব গম্বুজ নেই, জলসাঘরও নেই 

 

আমাদের মাঝখানে ভেঙে পড়ে আছে সব পুরনো খিলান 

 

এখন কোথাও নেই তেমন পাগল করা বাঁশি 

 

এখন কোথাও নেই অশ্বারোহী ভয় 

 

এসো তবে, মুখোমুখি আবার দাঁড়াই 

 

যেভাবে শহিদ গাছ পাথর ফাটিয়ে ফের মাথাচাড়া দেয়

 

 

 শিল্পী 

 

দূরে আজও ধুলো ওড়ে, গগনঠাকুর যেন তুলি 

 

আকাশ-দিগন্ত যদি এমন সমাধিরঙ হয় 

 

আমাদের ভাগ্য তবে হবে না তেমন ক্যানভাস

 

যেখানে তুমিও নেই, আমিও জলরঙ, তবু,--

 

একটি দৃশ্যের মধ্যে আমরা দুজনই কোনও ছবি...

 

হয়তো বা জানলা খুলে যাওয়া আসা করি দুজনেই 

 

কখনও বা দৃশ্য দেখি, কখনও সে দৃশ্য হয়ে যাই

 

দূরে আজও ধুলো ওড়ে, কনে দেখা আলোয় দেখেছি 

 

গগনঠাকুর আজও আমাদেরই দিকে তবু তাকিয়ে আছেন

 

 

 

বেবী সাউয়ের কবিতা, সাহিত্যএখন শারদ 2020

 



ইয়োকাস্তা 

১. 

আমাদের দিকে পুরো মেঘ করে আছে...


থমথমে মেঘ দেখলে বিষণ্ণ ময়ূরের কথা মনে পড়ে 


যেন তারা একদিন খুঁজে নেবে  কোনও এক  সন্ধের পানশালা...


আর শহরের লাল চুলের মেয়েরা খিলখিল করে হেসে উঠবে রোজ...


২. 


বিষণ্ণ ময়ূর অধিক বিষণ্ণ এক গল্পের কাছে বসে আছে


যেন অ্যাকোরিয়ামের ভেতর পোষমানা মৃত  রঙিন চোখ...


কোনও আত্মহত্যা নেই যেখানে...


তবুও পেখমের লোভ,  প্রভূত সংসার,

ঈশান-মেঘের জন্য তাহাকে খানিক নেশাখোর করে তুলছে


৩.  


সে, হারিয়ে ফেলা পথ, একটা মায়াবী  মাঠ...


ময়ূরকে কাঙ্ক্ষিত করে তুলছে পোষা মাছটির প্রতি 


তাহার পায়ের কাছে রূপোর ঘুঙুর দেবে? 

দেবে তাকে অউদিপাসের বাঁশি! 


বরং তাহাকে দিও অপমান, বাংলা কবিতা..

সু(স্মলী দত্ত, কবিতা, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 


অনিঃশেষ 


তারপর?

স্বচ্ছ অ থেকে ... ধারাবাহিক ঔ 

তারপর

দু এক কুচি রোদ্দুর একপশলা বৃষ্টি

তারপর...

ব্যস্ততা কর্তব্য আর চন্দ্রবিন্দু র ককটেল

তারপর

একটা একটা সুতো ছাড়বে লাটাই

সবশেষে ওই ছাদের চিলেকোঠায় মেঘ

তার পর....

শেষ অবধি


জানার অপেক্ষায় বিছিয়ে দিতে পারি আমার জন্মজন্মান্তরের সর্বস্ব

Saturday 3 October 2020

রাখী নাথ কর্মকার , ছোটগল্প , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 


 

 

চ্যাম্পিয়নশিপ

 

আর তো মোটে একটা মাস...তারপরেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! চারিদিকে কানফাটানো হাততালির শব্দ আর জাতীয় সঙ্গীতের গায়ে কাঁটা দেওয়া সুরেলা, সোনালি মুহুর্তে গলায় সোনার মেডেল ঝুলিয়ে ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে আর কেউ নয়, সোনার মেয়ে বুনাই!      

হ্যাঁ, বুনাইএর শয়নে-স্বপনে-জাগরণে এখন একটাই প্রতীক্ষা-এশিয়ান সাব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ ! অনেক, অনেক কষ্টে মায়ান্মারে এই ট্রিপে যাওয়ার টাকাটা জোগাড় হয়েছে বাবা মুখে কিছু স্পষ্ট করে না বললেও বাবার চোখের কোণে হতাশার নীল ছায়া বুনাইএর নজর এড়ায় নি। একটামাত্র মেয়ে তাঁর, চাহিদাও তার সামান্য  কিন্তু জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তে অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া বোধহয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের আর কিছু করারও থাকে না  একটা ছোটোখাটো প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেন তিনি সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে জীবন থেকে মূল্যবান কিছু মুহূর্ত আর শরীর থেকে অমূল্য কিছু প্রাণশক্তি বাঁধা রাখতে হয় যেখানে  সম্প্রতি মায়ের একটা বড় অপারেশনের পর থেকেই হু হু করে জলের মত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে  আর তার পরে পরেই এই চ্যাম্পয়নশিপের জন্যে এতগুলো টাকা জোগাড় করা-যাতায়াতের খরচ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অনেক খরচই আছে, সেটা খুব একটা কম নয়! নিঃসঙ্গ, আঁধারাচ্ছন্ন রাতে অসহায়ভাবে পথ খুঁজে গেছেন অনিলবাবু বাবার চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ছুঁয়ে গভীর হত।  এক একসময় তো বুনাইএর মনে হচ্ছিল - এমন সুযোগটা এবার বোধহয় হাতছাড়াই হয়ে গেল!                

ক্রমাগত জমতে থাকা বিষণ্ণতার ধূসর বাষ্প যখন বুনাইকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে,  কোথাও একবিন্দু সতেজ বাতাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিল না ও - অফিস থেকে ফিরে এসে অনিলবাবু একদিন আধো আলো, আধো অন্ধকারে এক ঝাঁক জোনাকির মত উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে স্ত্রীকে বলেছিলেন-“দেশের শরিকি জমিটা বিক্রিই করে দেব ভাবছি, বুঝলে! ইচ্ছে-অনিচ্ছের দোলাচলের মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন মিতাদেবী ঐটুকুই তো সম্বল ছিল, ভাড়াবাড়ির অসহায়তার মাঝে ঐ এক্টুকুনি নিশ্চিন্ততার আশ্বাস-সেটুকুও হারিয়ে গেলে… ! পাশের ঘরে হলুদ বাল্বের আলোয় খাটের ওপর বইএর মাঝে মুখ গুঁজে থাকা বুনাইএর মনটা প্রথমে একটু দমে গেলেও পরক্ষণেই মনে হয়েছিল যেন টেনিস রুমের মতই টুপটাপ লাইন দিয়ে ফ্লুরোসেন্ট আলো জ্বলে উঠেছে ঘরের মধ্যে! ভাড়াবাড়ির নোনাধরা দেওয়ালে ছিটকে যাওয়া স্পিড ড্রাইভের একটা আক্রমণাত্মক স্ট্রোক...আর স্ট্রেট সেটে ও হারিয়ে দিতে চলেছে প্রতিপক্ষকে! সেদিন, সেই সন্ধ্যায়, জলভরা চোখে সেই মুহূর্তটাকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে বুনাই ঠিকই করে নিয়েছিল- নাহ, এবার কিছুতেই খালি হাতে ফিরবে না ও               

এমনিতেই এই খেলার জন্যে কম লড়াই করতে হয়নি ওকে  নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অনিলবাবু্র বড় ইচ্ছে ছিল মেয়ে তাঁর ডাক্তার হবে মধ্যমেধার বুনাই পড়াশুনোয় কিন্তু কোনোকালেই খুব একটা আহামরি কিছু ছিল না বুনাইর খুড়তুতো দাদা বুড়োদা টেবিল টেনিস খেলত ওদের পাড়ারই  ক্লাবে কোথা থেকে যেন সে খেলার নেশাটা চারিয়ে গিয়েছিল মেয়েটার মধ্যেও! মিতাদেবীর অসুস্থ বিকেলটা যখন একদলা অন্ধকার হয়ে নেমে আসত অবশ দুচোখের ফাঁকে, একাকী বুনাই স্কুলফেরত তখন প্রায়ই বুড়োদার টিটি ব্যাটবল হাতে বুড়োদারই সঙ্গে ক্লাবে গিয়ে জুটত ! ফলে, যখন তখন গার্জেন কল, ক্লাসটিচারের চোখ রাঙানি ! বাবার বকুনি ! এর মাঝেই ওকে সাহস জুগিয়েছিল ওদের গেমটিচার মিলিন্দস্যারের সাহচর্য  স্যার বলতেন, সব কাজ কিন্তু সবার জন্যে নয়  প্রতিটি শিশুর মধ্যেই কিছু না কিছুর সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছেসেই সম্ভাবনাটিকেই খুঁজে বের করতে হবে, তারপর তাকে চারাগাছের মত যত্ন করে বড় করে তুলতে হবে! মিলিন্দস্যার বাবাকেও সেকথা বুঝিয়েছিলেন নিতান্ত অবুঝ মানুষটাও সেদিন থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন মিলিন্দস্যারের ঐকান্তিক চেষ্টাতেই কম খরচে এই টিটি কোচিং সেন্টারে বড় বড় কোচেদের তত্ত্ববধানে আজ এতোদূর এগোতে পেরেছে ও, এতবড় সুযোগটা আজ ওর সামনে এসেছে !   

আজকাল তাই বেশ কিছুদিন ধরেই ওর জন্মদিনের কেক, পায়েস কিংবা পুজোর পছন্দের জামা-সবেতেই স্বেচ্ছায় বিস্তর কাটাছেঁড়া করে চলেছে মেয়েটা  এমনকি বিভিন্ন ট্যুর্নামেন্টে জেতা প্রাইজমানি যা ও এতদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিল-বড় কোন স্বপ্নের পিছনে খরচ করার জন্যে, সে টাকাও নির্দ্বিধায় বাবার হাতে তুলে দিয়েছে বুনাই  অসুস্থ মায়ের বুকে মাথা রেখে মেয়েটা খুঁজে বেরিয়েছে শুধু একটা  পথের দিশা!   

এখন শুধু সেই স্বপ্নটাকে সফল করার অপেক্ষা দুবছর আগে চেন্নাইতে ইন্টারন্যাশনাল ওপেন টিটিতে ব্রোঞ্জ পেলেও গতবছর ইন্দোরে সাব জুনিয়র সিঙ্গলসে বুনাই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি ওকে। এছাড়াও সিঙ্গলস, ডাবলস, জুনিয়র টিমের বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিক সাফল্যের মধ্যে তো ও আছেই। ও জানে, যত বেশী ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট খেলতে পারবে ও, তত ওর অভিজ্ঞতা বাড়বে সেই সঙ্গে এও জানে, এই হার্ডলটা টপকালে ওর মাথার ছোট্ট মুকুটে যে পালকটা যোগ হবে, সেই পালকের ডানায় ভর করেই ওকে পার হয়ে যেতে পারবে হাজার প্রতিবন্ধকতার কাঁটা তারের বেড়া, বাধার সুউচ্চ পাঁচিলএই চ্যাম্পিয়নশিপটা জিতলে ওর সামনে খুলে যাবে বন্ধ দরজার কপাটগুলো এককালের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন অখিলেশস্যারের কাছে অ্যাডভান্সড কোচিং নেওয়ার সুযোগটা অনেক অনেক সহজ হয়ে যাবে আর অখিলেশ ফাউন্ডেশনের বৃত্তিটার জন্যে যদি একবার মনোনীত হয়ে যেতে পারে-তাহলে আর ওকে পিছনে ফিরে তাকাতেই হবে না!   

                                                                                         

টেবিল টেনিস কোচিং থেকে বাড়ি ফিরেই খাটের ওপর এসে উপুড় হয়ে পড়েছিল ক্লান্ত বুনাই ! মিতাদেবী রান্নাঘরে রাতের রান্নার জোগাড় করছিলেন  অনিলবাবু তখনো অফিস থেকে ফেরেননি          

হঠাৎই খাটের পাশে পড়ে থাকা ছেঁড়া খবরের কাগজের ঠোঙার গায়ে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল বুনাইএর  দিগন্তবিস্তৃত জলছবি বানভাসি ঘোলা জলে খেলনার মত জেগে থাকা বাড়িঘরগুলোর মাথায় দাঁড়িয়ে অধীর অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকটি ছোট ছেলে !      

নীচে ছোট ছোট অক্ষরে সীমাহীন কষ্টের সাতকাহন! গত কয়েকদিনের তুমুল বৃষ্টিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছে  সেখানকার বন্যা পরিস্থিতির টুকরো টুকরো খবর আজ সারা দিন ধরেই কানে আসছিল ওর, যদিও দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে সেসব নিয়ে আর সেভাবে ভাবার সময় পায় নি বুনাই ! কিন্তু পড়ন্ত বিকেলের ঝিমিয়ে আসা আলোয় এই একটা ছবিই যেন ওর সামনে হাজার গল্পের অমনিবাস খুলে দিল !     

ছবিতে অসহায় ছেলেগুলোর কাতর দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ম তীরের ফলার মত! এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় বুকের ভিতরটা পশ্চিম মেদিনীপুর আর হাওড়ার শখানেক কিলোমিটারের ব্যবধান যেন মুহূর্তে ঘুচে যায়  উতলা হয়ে চেয়ে দেখে বুনাই, বাচ্চাগুলোর চোখে একরাশ প্রতীক্ষা-কখন হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ ফেলা হবে ওদের জন্যে, কখন উদ্ধারকারী দল আসবে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে ! কিংবা কখন একটা ছেঁড়া ত্রিপল, একমুঠো শুকনো চিঁড়ে হাতে উঠে আসবে ওদের,  কখনই বা থই থই জলের মাঝে একফোঁটা খাবার জলের প্যাকেট ঝুপুস করে এসে পড়বে স্কুলের ছাদহা পিত্যেস করে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলোর রুক্ষ, ফাটা ঠোঁটে  স্বস্তির রেখা ফুটে উঠবে    

কেন জানি না, আজ হঠাৎ বীণামাসির কথা মনে পড়ে গেল বুনাইর  বীণামাসি ওদের পাশের বাড়িতে ঠিকে কাজ করত  বছরখানেক আগে, এমনই এক বর্ষায় অসুস্থ মাকে দেখতে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়েছিল মাসি সঙ্গে ছিল মাসির একমাত্র ছেলে, বারো বছরের ছোট্টু  সেবারও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নদী ছাপিয়ে উঠে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে গ্রামের সবকিছু বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়েছিল গ্রামের অগুনতি মানুষ মাসির ছেলেটি নাকি ত্রাণের খোঁজে বেরিয়েছিল বুকডোবা জলে আর ফেরে নি বীণামাসির ছেলেটা সাঁতার জানত না!      

বীণামাসি অবশ্য কিছুদিন পরে ফিরে এসেছিল একা ! পাগলের মত অবস্থা তখন তার তারপরএকদিন সেও কোথায় হারিয়ে গেল

 

-“মা !”

রান্নাঘরের টিমটিমে হলুদ আলোয় মাথা নিচু করে বসে মিতাদেবী সবজি কুটছিলেন মেয়ের ডাকে মাথা না তুলেই প্রশ্ন করেন -“কী রে কিছু বলবি? খিদে পেয়েছে? টেবিলের ওপর বাটিতে দেখ, ছোলা ভেজানো রয়েছে…”  

মিতাদেবীর মুখের কথা শেষ হয় না, মেয়ে খসখসে গলায় বলে ওঠে -“মা, এ বছর আমি চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেব না !”

মিতাদেবী প্রবল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকান মেয়ের দিকে অর্থহীন শব্দগুলো পাঁচ বাই চারের আলোআঁধারি রান্নাঘরে ঝোড়ো হাওয়ার মত পাক খেতে থাকে যে মেয়ের সকালসন্ধে খালি একটাই স্বপ্ন, একটাই আশা, একটাই অপেক্ষা - চ্যাম্পিয়নের শিরোপা, সেই মেয়ে আজ বলছেটা কী ?  

-“মা, আমার ট্রিপের টাকাটা ওদের হাতে তুলে দিতে চাই মা…”  

মিতাদেবীর বিহ্বল, বিমূঢ় চোখের অতলে অবাধ্য প্রশ্নেরা হাবুডুবু খেতে থাকে 

-“মা, চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার জীবনে হয়ত আবার আসবে, কিন্তু …” ইতিমধ্যেই মনস্থির করে নিয়েছে বুনাই বুকের ভিতর মোচড় দিচ্ছে না বলা শব্দগুলো ধরা গলায় ফিস ফিস করে ওঠে মেয়েটা-“ঐ বন্যার্ত মানুষগুলো- যাদের প্রাণটুকু নিয়ে জীবন আর মৃত্যু আজ দড়ি টানাটানিতে চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করে দিয়েছে, তাদের জীবনে হয়ত এ সুযোগ আর আসবে না …”  

                                                     -------------------------------------------------------

                                           

সঞ্জয় কর্মকার , অণুগল্প, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০,

  


 

 

পাগলটা

                                                                                

রেল বস্তির পাগলটা সেই সন্ধে থেকে বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে । কে যেন একজন তাড়াতে গেছিল, তাও যায়নি। রূপকবাবুর ছেলের  আজ অন্নপ্রাশন । আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বাড়ির  চারদিক । অথচ পাগলটা নিজেকে আড়াল করার জন্য একটু অন্ধকার খুঁজছে। অকস্মাৎ  রূপকবাবুর  চোখে পড়ল পাগলটা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভাঁড়ার ঘরের দিকে। রূপকবাবু পাগলটার কাছে গিয়ে কিছুটা বিরক্তির ভঙ্গিতে বলে উঠলেন , ' এখানে কী চাই রে তোর? সেই থেকে এভাবে কী দেখছিস? বলি, মানুষকে বিরক্ত করা ছাড়া তোদের কি আর কোন কাজ নেই?'

রূপকবাবুর মুহুর্মুহু প্রশ্ন শুনে পাগলটা ভয় পেয়ে   দু-হাত পিছনে সরে গেল। তারপর মুহূর্ত খানিক নীরব থেকে শেষে একটু যেন  সংকোচের সুরে বলল, ' খুব খিদা লাগছে। আমারে কিছু খাবার দিবেন?'

'উফ্ জ্বালিয়ে খাস একেবারে! এখানেই দাঁড়া । দেখছি।' কথাটা বলেই দ্রুতপায়ে আবারও বাড়ির  ভিতরে ঢুকে গেলেন রূপকবাবু।

খাওয়া- দাওয়ার লাস্ট ব্যাচ উঠে গ্যাছে। পাগলটাকে এখনও  বাড়ির গেটে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রূপকবাবু বললেন, ' ঈশ , একদম ভুলে গেছি রে!' 

কিছুক্ষণ  পরই রূপকবাবু একটা থার্মোকলের থালায় কিছু খাবার - দাবার এনে পাগলটার হাতে তুলে দিলেন। খাবার পেয়ে পাগলটা বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই রূপকবাবু বলে উঠলেন, ' যাচ্ছিস কেন ,খেয়ে নে!'

'এই খাবারটা ও বাবা- মাকে দিয়ে খাবে। সব অনুষ্ঠান বাড়ি থেকেই এভাবে ও বাবা- মায়ের জন্য  খাবার নিয়ে যায়।' পাশ থেকে বলে উঠল শুভম ক্যাটারার্সের একটা ছেলে।

ছেলেটার কথা শুনে বুকের ভিতরটা  হঠাৎই মোচড় দিয়ে উঠল রূপকবাবুর। স্ত্রী বৈশালীর চরম আপত্তিতে শেষ দু-বছর একটা বারের জন্যও  বাবা - মায়ের খোঁজ নেয়নি ও। তারা এখন কী খেয়ে যে ...  
                      ............................

পারমিতা মালী, প্রবন্ধ, একটি রূপকথার কাহিনী, সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 

 


 

 একটি রূপকথার কাহিনী 


      
                 

         তারপর হলো কি, খৃষ্টজন্মের দেড় থেকে দুই হাজার বছর আগে, এক শ্রাবণ মাসের ঝড়জলের রাতে একটি খোকা হলো। রাজার ঘরের ছেলে। সে ছেলের ভবিতব্য ছিলো মরেই যাওয়া। কিন্তু কপালে মৃত্যু না থাকলে কার সাধ্য তাকে মারে? ওই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য গোপনে প্ল্যান ছকা হয়ে গেছিল। বেশ কিছু রাজ কর্মচারী এক নিশ্ছিদ্র শলা করে শিশু অদলবদল করে ফেললো জন্মের ঠিক কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। কাকপক্ষীতেও টের পেলো না। বদলিতে যে শিশুটি এলো, সে ফরসা, চোখা চোখা নাকমুখের সুন্দর দেখতে একটা কন্যা। যাতে লোকের সন্দেহ না হয়। যাতে রাজার মেয়ে বলে সহজেই বিশ্বাস হয়ে যায়। আর ছেলেটি হাওয়া হয়ে গেলো রাতারাতি। বড় হলো নিশ্ছিদ্র এক সুরক্ষিত ঘেরাটোপে। এমনটা আমাদের অনেক হয়। রাজাগজাদের জন্য বলি যায় বহু গরীব। 


               এবার ধীরেধীরে বড় হচ্ছে সে ছেলেটি। একটি শ্যামবর্ণ ছেলে, যে তার রূপ গুণ আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মোহিত করে রেখেছে চারপাশ।  একটা গোটা যুগকে দুই কাঁধে বহন করেছে এসেছে। আর আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি তাকে। একটা মানুষ গোটা জীবনে যে এত কিছু করতে পারে, এটা অসম্ভব ছিলো আমাদের চোখে। তার জীবনরহস্য  বিশ্বাসযোগ্য হয়নি আমাদের । আর তাই লোকে বার বার তাকে দেবতা ভেবেছে। 

             যে দেশে,যে সমাজে প্রেমের ওপর চোখ রাঙানি এসেছে , যে দেশে এখনো খাপ পঞ্চায়েত আছে, সেই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সে ছেলে কি করে এমন করল? বয়সে বড়ো অগম্যা এক নারীর প্রতি এমন খুল্লমখুল্লা প্রেম?  একি মানুষের সাধ্য? নির্ঘাত এ কোনো দেবতা।    
          এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে এ ছেলেটির নাম পরিচয়। হ্যাঁ, আমি  কৃষ্ণ, বাসুদেবের কথাই বলেছি। 
               তাঁর ওপর  বার বার দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায় পরেছিলেন দেবত্বের মুকুট।  নিজে হাতে তিনি কুরুক্ষেত্রের ঘুঁটি সাজিয়েছেন, গোটা আর্যাবর্তের রাজনীতির নিয়ন্ত্রন করেছেন একা হাতে, আর তারপর এক দু পয়সার ব্যাধের তীর খেয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে মরে পড়ে থেকেছেন। কি অদ্ভূত এই বৈপরীত্য!  দেবতা হলে কেউ এমনভাবে মরে? অন্তত কিছুটা রহস্য করে তো মরতে পারতেন!  গ্যাংগ্রিন কিন্তু এখনো ঘাতক রোগ। সুতরাং দু হাজার বছর আগে এ রোগ হলে মৃত্যু হবে,সেটাই স্বাভাবিক। 
         

        তাঁর কাজের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা আছে, কিন্ত দেবত্ব নেই কোত্থাও। কিন্তু ভক্তিবাদী  মন তা মানে না। এতো ক্ষমতা নিয়েই যদি কেউ জন্মাবে,তাহলে অন্তত মানুষ নয়, দেবতা হয়েই জন্মাক !  তাতে অন্তত মন কে চোখ ঠারা যায়! কৃষ্ণ তাঁর যৌবনের প্রথম দিন থেকে শুধু নিয়ম ভেঙে গেছেন একের পর এক। তা এমন নিয়ম ভাঙা লোক কি ইতিহাসে আসেনি?নাকি তাঁদের এমন তুখোড় বুদ্ধি ছিলো না? তা তাঁরা যদি দেবতা না হন,খামোকা কৃষ্ণই বা দেবতা হতে যাবেন কেন? পর্দা সরিয়ে ওই ঝকঝকে আকর্ষনীয় পুরুষটিকে আর একবার খুঁজে দেখলে কেমন হয়?


            গোপ জাতিরা পেশায় দুধ বিক্রেতা। এই তাদের রুটিরুজি।  সহজ সরল কিছু গ্রাম্য মানুষের মধ্যে বড় হচ্ছে দুটি ক্ষত্রিয় ছেলে। যুদ্ধ যাদের জিনে। বছরের পর বছর তাদের পূর্বপুরুষেরা কতরকম অস্ত্রবিদ্যা চর্চা করেছে।   তীরচালনা, ভল্ল, গদা, তলোয়ার,  রথচালনা এসব তাদের নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতন কাজ। সেই বংশের ছেলেদের বাগে আনা কি সামান্য গোপদের পক্ষে সম্ভব? তাদের চোখে তো এ ছেলে বিস্ময়ই !

          আর যারা বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, তাদের শরীর ও মনের বৃদ্ধি খুব তাড়াতাড়ি হয়। মানসিক ম্যাচিওরিটি আসে দ্রুত। এ কিশোরের রূপ তো ছিলোই, আর সাথে যোগ হয়েছিল ক্ষুরধার উপস্থিত বুদ্ধি। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করার মতো অদ্ভূত ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল সে। খুব ছোটবেলা থেকেই তার প্রখর স্মৃতিশক্তি।  দুরন্ত, বুদ্ধিমান, শক্তিমান  কিন্তু স্বাভাবিক এক বালক। গোপবালকরা আচার্যের কাছে যেত না, তাদের মধ্যে পড়াশোনার পাট নেই। তাই কানাই আর বলাইয়েরও গুরুগৃহে যাওয়া হয়নি। এমন কিচ্ছুটি করা যায় নি যা সাধারণের নজরে আসে। তবে গোপনে প্রশিক্ষণ কিন্তু শুরু হয়ে গেছিল। দামিল্য, অক্রুর  ওই বালকদের গোপনে তৈরি করছিলেন মল্ল বিদ্যায় আর ধনুর্বিদ্যায়। 

      শুধুমাত্র দ্রুত পরিস্থিতি বোঝা, আর আত্মরক্ষার এক সহজাত প্রবৃত্তি তাঁকে আলাদা করেছে অন্য সকলের থেকে। যুদ্ধকালে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে তিনি অন্যদের চোখে ধুলো দিয়েছেন বার বার। লোকের মনে হয়েছে এ ম্যাজিক। এ দৈবী শক্তি । কৃষ্ণর আর এক নাম গিরিগোবর্ধনধারী। তিনি গোবর্ধন পাহাড় নাকি কড়ে আঙুলে তুলেছেন। গল্পের গরুকে খুঁটিতে বেঁধে খুঁজলে দেখা যাবে সে সত্যিই হিরো।

              কৃষ্ণ  প্রথমবার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এই পাহাড় কে নিয়েই। গোকুলের নিয়ম ছিলো, প্রতিটি বর্ষায় ইন্দ্রের পুজো করতে হবে। ইন্দ্রদেব বৃষ্টির দেবতা। সাথে তার বজ্র-বিদ্যুৎ সহ হাবিজাবি আরো কিছু  সঙ্গীসাথী আছে। কথা না শুনলে ধনেপ্রাণে শেষ করে দেবেন তাঁরা। সোজা কথায় তোলা দিতে হবে তাদের। ঠিক সময়ে এসে হপ্তা নিয়ে যাবে। নেহি তো গব্বর আ যায়েগা। বড় ধরণের গুন্ডা অথবা দেবতা, যাই বলুন না কেন তারা আসলে তাইই। গোপবাসীদের সংসার চলে  গোরুর দুধ আর দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রয় করে। বৃষ্টির ওপর কারুর হাত নেই। তা সে যত বড় নেতাই হোক না কেন!  কিন্ত যদি যমুনা নদীর বাঁধ তুলে নেওয়া হয়? যদি গতিপথ কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রিত করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর পাড়ের গোচারণভূমি?বহতী নদী যদি হঠাৎ করে বিপুলা হয়ে যায়?ভেসে যায় ক্ষেত, বা গোচারণক্ষেত্র? তাহলে?বোকাসোকা গ্রাম্য গোয়ালাদের ভয় পাওয়াতে এই তো যথেষ্ট ! হয়তো তেমনই কিছু হয়েছিল। এই কঠিন  সময়েও কিন্তু  শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলেছিল ওই কিশোর বালক। সমস্ত ব্রজবাসী আর গাভীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল ওই গোবর্ধন পাহাড়ের গুহায় বা কোটরে। আঙুলে করে কেউ কখনো পাহাড় তুলতে পারে না। সেটা অসম্ভব। কিন্তু, ওই বিশাল জনগণকে বাঁচিয়ে ছিল,এটা তো সত্যি! ওই কিশোর মাথা নোয়ায়নি সেদিন ইন্দ্র নামক গুন্ডার কাছে!  এরপরেও সে দেবতা হবে না?  

        সেই প্রথম সে আঘাত আনে প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে,তাই ঠিক নয়।  নিজের বুদ্ধি ও পুরুষাকার যদি থাকে,তাহলে পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রনে। অন্ধ, বোকা, ভীরু, অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের সে আগলেছে বুক দিয়ে। আর এটাই তো ক্ষত্রিয়ের কাজ ! 

             কালিয় নাগ বিষাক্ত করে দিয়েছিল কালিয়াদহের জল। সেই জল খেয়ে গরুরা মারা যাচ্ছে, মাছ মারা যাচ্ছে। সে দহের আশেপাশে কেউ যেতেই পারছে না। ওটা ছিলো কালিয়র নিজস্ব  প্রপার্টি। কিন্তু সাপের বিষে কোনোকালে জলাশয়ের জল বিষাক্ত হতে পারে কখনো ? সে তো অসম্ভব!  সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধী এই কাহিনী। তবে জলে বিষ মেশানো আর কি এমন কঠিন কথা! এ তো হামেশাই হয়। আর জলের মধ্যে লড়াই করে সাপকে হারিয়ে, সেই সাপের মাথায় উঠে ধেইধেই করে নাচা ?ওসব যে গপ্পকথা, সে তো শিশুরাও বুঝবে। তবে মানুষের থেকে ক্ষতিকারক বা বিষধর সাপ কি জন্মেছে এদ্দিনেও? কালিয় মানুষ হলেই বা ক্ষতি কি? বুদ্ধিমান কৃষ্ণ কি তাকে পরাস্ত করতে পারে না?  

      এইভাবে  একের পর এক শত্রু আক্রমণ থেকে গ্রামের লোকদের বাঁচিয়েছে এ কিশোর। এর পরও যদি দেবতা না হয়,তবে কাকে বলবো আমরা দেবতা? যে রক্ষা করে, সেই তো দেবত্ব পাওয়ার অধিকারী ! আর এমন পুরুষের জন্য নারীকুল পাগল হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘ নারীপ্রেমেও অবসাদ আসে বীরের। ক্লান্তিকর লাগে ওই অর্থহীন বাক্যালাপ। প্রেম তার জন্য নয়। গোটা পৃথিবী তার অপেক্ষায়। 

           এ ব্যক্তির সাথে তুলনা করতে গেলে আমার শুধু একটা লোককেই মনে পড়ে। রাসবিহারী বোস। ভারতের যুগসন্ধিক্ষনের এক অবতার পুরুষ। ঠিক অতখানিই মেধা, রূপ, গুণ, আর ক্ষমতা নিয়ে, আমাদের পরম পুণ্যবলে জন্মে গেছিলেন এই পোড়া দেশে। গোপনে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন এক বিশাল স্বাধীনতার যুদ্ধ। দেশ পেয়েছিল তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা। এর আগেপিছেও অনেক কাহিনী আছে বটে। লোকটির মেধা বটে!  অবহেলার ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোই পাস করে রেখেছিলেন কোন ফাঁকে। আমাদের কপাল খারাপ, তাই সে দেবতাকে কাছে রাখতে পারিনি। ১৯১৫ সালে, পাকাপাকিভাবে জাপান চলে যান তিনি ।  শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবি' তে যে ডাক্তারকে আমরা পাই সেও কিন্ত এই রাসবিহারীই।

       আমাদের পোড়া কপালে দেশ। বিদ্যেবুদ্ধি নেই, তাই অবতার চিনতে ভুল করি বার বার। যেখানে সেখানে বাবাজিদের পায়ে ধুপ ধাপ করে মাথা ঠুকি। আর আসল অবতারেরা রয়ে যায় অন্তরালে।  

            
                  *          *          *